১. সামাজিক আসঞ্জন ও মানবিক প্রকৃতি

বক্তৃতা : এক
সামাজিক আসঞ্জন ও মানবিক প্রকৃতি

আমি এই বক্তৃতাগুচ্ছে যে বিবেচনাযোগ্য মূল বিষয়টিকে প্রস্তাবাকারে রাখতে চাই, তা মোটামুটি এই রকম ও অস্তিত্বরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক আসঞ্জন ও প্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাত্রাভিত্তিক সমন্বয় আমরা কিভাবে ঘটাতে পারি? সামাজিক সহযোগিতার চালিকাশক্তি হিসাবে চিহ্নিত মানবিক প্রকৃতিজাত প্রেরণার প্রসঙ্গ দিয়েই আমি শুরু করবো। সর্বপ্রথম আমি বিশ্লেষণ করবো-একেবারে আদিম সমাজে ও সভ্যতায় এই মানবিক প্রেরণার ধরন-ধারণ ঠিক কিরকম ছিল, তারপর বিচার করবো, উন্নততর সভ্যতার ক্রমপরিবর্তনশীল বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার উদ্যোগে এই মানবিক প্রেরণার কীভাবে ও কতদূর অভিযোজন ও পরিবর্তন ঘটেছে। তারপর আমি বিবেচনা করবো-বিভিন্ন সময় পর্বে ও বিভিন্ন স্থানে, এমনকী সাম্প্রতিককালের সমাজে ও সম্প্রদায়েও এই সামাজিক আসঞ্জনের বিস্তার ও গভীরতার স্বরূপটিকে, এবং এই সূত্রে অদূর ভবিষ্যতে এই প্রবণতার অধিকতর অগ্রগতির সম্ভাবনাটিকেও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবো। সামাজিক ঐক্য অটুট রাখার অনুকূল শক্তি ও শর্ত-সম্পর্কিত আলোচনার পরে, সমাজ ও সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত মানবজীবনের অন্য দিকটিতে দৃষ্টিপাত করবো-যথা ব্যক্তিগত উদ্যোগ, মানুষের বিবর্তনের বিভিন্ন পর্বে এই বিষয়টি কী ভূমিকা পালন করেছে, বর্তমান কালে তা কী ভূমিকা পালন করছে এবং ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত পটভূমিতে এই উদ্যোগে কতটা বেশি বা কতটা কম ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই সম্ভাবনাকেও দেখানোর চেষ্টা করা হবে। তারপর, আমি আমাদের এই সময়ের মূল সমস্যার বিশেষ একটি প্রসঙ্গে আসবো-আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে সংগঠন ও মানবিক প্রকৃতির পারস্পরিক সংঘাতের ফলে উদ্ভূত সেই সমস্যা, অথবা অন্যভাবে বলা যায়-সৃজন ও অধিকারের প্রেরণার সঙ্গে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির বিচ্ছেদ-প্রসঙ্গ। এই সমস্যাটিকে বর্ণনা করার পরে এর সমাধানকল্পে কী করা যায়, তা অনুসন্ধান করবো এবং চূড়ান্তভাবে, ব্যক্তিগত চিন্তা, উদ্যোগ ও কল্পনার সঙ্গে সামাজিক কর্তৃত্বের সামগ্রিক সম্পর্কটিকে নীতিশাস্ত্রের একটি বিষয়রূপেই গণ্য করবো।

মানুষ সহ সমস্ত সামাজিক জীবের মধ্যেই সহযোগিতা ও গোষ্ঠীগত ঐক্যের প্রবৃত্তিগত অর্থে কিছুটা ভিত্তিভূমি রয়েছে। এটা সম্পূর্ণভাবে দেখা যায় পিঁপড়ে ও মৌমাছিদের ক্ষেত্রে, যারা আপাতভাবে অসামাজিক কাজকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় না এবং কখনই বাসা বা মৌচাকের প্রতি তাদের গভীর অনুরাগ বিনষ্ট হয় না। জনহিতকর কর্তব্যের প্রতি এই নিরবচ্ছিন্ন অনুরাগকে আমরা একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু এরও রয়েছে অপূর্ণতা; পিঁপড়ে ও মৌমাছিরা কোন মহৎ শিল্প সৃষ্টি করে না অথবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও করে না কিংবা এমন কোন ধর্মমতও প্রচার করে না যে, সমস্ত পিঁপড়েই পারস্পরিক সহোদরা সম্পর্কে আবদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে, তাদের সামাজিক জীবন যান্ত্রিক, সুনির্দিষ্ট ও নিশ্চল। আমরা এই ইচ্ছা লালন করবো যে, মানুষের জীবনে বিশেষ ধরনের তুমুল আলোড়ন থাকা দরকার এবং সেইভাবে যদি আমরা উপরোক্ত বিবর্তনমূলক স্থবিরতা থেকে মুক্ত হতে পারি।

আদিম মানুষ ছিল এক দুর্বল ও বিরল প্রজাতি, যার প্রাথমিক অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টিই ছিল উদ্বেগজনক। কোন এক সময়-পর্বে তার পূর্বপুরুষ গাছ থেকে নিচে নেমে এসেছিল এবং পায়ের আঙুলের আঁকড়ে ধরার যে ক্ষমতা সেই সুবিধা সে হারিয়েছিল, কিন্তু লাভ করেছিল বাহু ও হাতের সুবিধা। এইসব পরিবর্তনের সুবাদে তারা অর্জন করলো বনবাসী না হওয়ার সুবিধা, কিন্তু পক্ষান্তরে যে উন্মুক্ত প্রান্তরে তারা ছড়িয়ে পড়েছিল সেই প্রান্তর আফ্রিকার ক্রান্তীয় জঙ্গলের তুলনায় অনেক কম পুষ্টি-প্রাচুর্য সরবরাহ করতো। স্যার আর্থার কিথের হিসাব অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় খাদ্যসংগ্রহের জন্য আদিম মানুষের প্রয়োজন ছিল মাথাপিছু দুই বর্গমাইল অঞ্চল এবং অন্যান্য কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, মাথাপিছু প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ ছিল আরো বেশি। বনমানুষ-গরিলা জাতিয় প্রাণী ও আধুনিক যুগেও অস্তিত্ববাহী প্রাচীনতম কিছু সম্প্রদায়ের কথা মনে রেখে এ কথা বলা যায়–আদিম মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠীতেই বসবাস করতো, যে গোষ্ঠীগুলি পরিবারের চেয়ে খুব বেশি বড় ছিল না, এ-ও অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না। এ রকম এক একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পঞ্চাশ থেকে একশো জন ব্যক্তি নিয়ে। প্রতিটি গোষ্ঠীতে নিজেদের মধ্যে থাকতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পারস্পরিক সহযোগিতা, কিন্তু একই প্রজাতির ভিন্নতর গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ ঘটলে শত্রুতাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। যতদিন পর্যন্ত মানুষের অবস্থান বিরল ছিল, ততদিন পর্যন্ত অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ ঘটতো কালেভদ্রে এবং সেই যোগাযোগও তেমন কোন গুরুত্ব বহন করতো না। প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব সুনির্দিষ্ট এলাকা ছিল, এবং কেবলমাত্র সীমান্ত অঞ্চলেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতো। সেই প্রাচীন কালে, সম্ভবত একই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল, সেই কারণেই অন্তঃগোষ্ঠী বংশবৃদ্ধিই নিশ্চিতভাবে ব্যাপক মাত্রায় প্রচলিত ছিল, অবশ্য বংশবৃদ্ধির এই প্রবণতাই সেই যুগে প্রবহমান ছিল। যদি কোন একটি গোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছাতো যে তাদের নির্দিষ্ট এলাকা হয়ে উঠতে সংক্ষিপ্তরে, তখন সেই গোষ্ঠীর তরফে কোন প্রতিবেশী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠতো, আর এ ধরনের সংঘর্ষে অভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত অধিকতর জৈব সুবিধাভোগী বংশধারাই জয় করায় ও করতো, এবং সেই কারণেই অব্যাহত ছিল জয়-পরাজয়ের এই বৈশম্যধারাই। এই বিষয়গুলো খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্যার আর্থার কিথ। এটা স্পষ্ট যে, আমাদের আদিম ও বিরল মানবিক পূর্বপুরুষেরা কোন সুচিন্তিত ও সুনির্ধারিত নীতি-নিয়মমাফিক কাজ করতে পারত না, বরং তারা চালিত হতো প্রবৃত্তিজাত প্রক্রিয়ার দ্বারা নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে বন্ধুত্ব ও গোষ্ঠী-বহির্ভূত অন্যদের প্রতি বৈরিতা, এ রকমই এক দ্বৈত প্রক্রিয়া। যেহেতু আদিম মানবগোষ্ঠী ছিল খুবই ক্ষুদ্র, সেই কারণে গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিরা পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে ও জানতো, এর ফলে পরিচিতি ও সহাবস্থানের ভিতের ওপর গড়ে উঠতো বন্ধুত্বের অনুভূতি।

সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় ও সহজাত সূত্র, যা অতীতেও ছিল-বর্তমানেও আছে, তা হলো-পরিবার। শৈশবাবস্থার অত্যধিক দৈর্ঘ্যের কারণে মানবজাতির মধ্যে পরিবারপ্রথার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল, এছাড়া এর পিছনে ছিল এই বাস্তবতা যে, পরিবারপ্রথা প্রচলিত না থাকলে শিশুসন্তানের জননীকে খাদ্যসগ্রহের ক্ষেত্রে পদে পদে বাধাবিঘ্নের মুখোমুখি পড়তে হতো। পক্ষীকুলের অধিকাংশ প্রজাতির মতোই মানবসমাজেও এই অনিবার্য পটভূমিতে পিতার ভূমিকা নির্ধারিত হলো পরিবার গোষ্ঠীর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরূপেই। এভাবেই গড়ে উঠলো এমন এক শ্রমবিভাজন, যেখানে পুরুষেরা শিকারের উদ্দেশ্যে বাইরে যেত এবং মেয়েরা থাকতো বাড়িতে। পরিবার থেকে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে অবস্থান্তরের যে ঘটনা, সম্ভবত তার পিছনেও ছিল একটি বিশেষ জৈব কারণ, এবং তা হল এরকমই একটি ধারণা যে, পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত হলে শিকারপর্ব অনেক বেশি কার্যকরী ও সফল হয়ে উঠতে পারে এবং এ কারণেই বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন গোষ্ঠীগত সংঘাত- বিরোধের তুলনায় আন্তঃগোষ্ঠী সহযোগিতা ও সমন্বয়ের প্রবণতাই বাড়তে শুরু করেছিল।

প্রাচীন মানুষ ও অর্ধ-মানবদের সম্পর্কে অসংখ্য তথ্য-প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে, এবং এই সব তথ্য-প্রমাণ থেকে গরিলা জাতীয় বনমানুষ থেকে আদিম মানবে বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর-সম্পর্কিত মোটামুটি পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। এতদিন পর্যন্ত আদিমতম মানব সম্পর্কিত পূর্ববর্তী প্রায় দশ লক্ষ বছরের সমসাময়িক প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু ওই যুগপর্বের বহুলক্ষ বছর আগেও সম্ভবত নরাকার পশুর অস্তিত্ব ছিল, যারা গাছের পরিবর্তে মাটিতেই বসবাস করতো। এইসব প্রাচীন পূর্বপুরুষের বিবর্তন সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কের আকৃতির মধ্যে, বর্তমান সময়ের মস্তিষ্কের আকার-আয়তনে পৌঁছানোর আগে প্রাচীন যুগের মস্তিষ্কের পরিমাপ খুবই দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, তারপর আবার কয়েকশত হাজার বছর ধরে এর আয়তন অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। এই হাজার হাজার বছর ধরে জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন ও সামাজিক সংগঠনে মানুষের অগ্রগতি ঘটেছে, কিন্তু যতদূর মনে হয়-সহজাত বৌদ্ধিক অগ্রগতি ততটা ঘটেনি। অস্থিসূত্রে প্রমাণের ভিত্তিতে প্রাপ্ত ওই ধরনের নিছক জৈব অগ্রগতির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে বহু আগেই। সেই কারণে, আমাদের প্রচলিত ধারণার বিপরীতে আমরা ধরে নিতে পারি-আমাদের সহজাত মানসিক পরিকাঠামো প্রত্ন-প্রস্তরযুগের মানুষের চেয়ে খুব বেশি আলাদা ধরনের নয়। সম্ভবত আমাদের মধ্যে সেইসব প্রবৃত্তির অস্তিত্ব রয়ে গেছে, যা মানুষকে, তার স্বেচ্ছাকৃত আচরণধর্মিতার আগে, অভ্যন্তরীণ মৈত্রী ও বহির্মুখী বৈরিতার বৈপরীত্য নিয়ে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বসবাস করতে প্রণোদিত করেছে। সেই প্রাচীন যুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত পরিবর্তনগুলোকে চালিকাশক্তির জন্য আংশিকভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল এই আদিম প্রবৃত্তির ভিতের ওপর ও মাঝেমধ্যে আংশিকভাবে শুধুমাত্র যৌথ স্বার্থবোধপুষ্ট সচেতনাতার ভিতের ওপর। মানুষের সামাজিক জীবনে যেসব মানসিক চাপ ও অবসাদ আসে, তার অন্যতম কারণ হল-সহজাত ও স্বাভাবিত প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত নয় এমন কোন কোন আচরণ শুধুমাত্র যুক্তিবাদী পটভূমি সম্পর্কে অবহিতও হওয়া সম্ভব একটি স্ত। র পর্যন্ত। এ ধরনের আচরণ যখন স্বাভাবিক প্রবৃত্তির ওপর ব্যাপক চাপ ফেলে, তখন অবসাদ ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতার জন্ম দিয়ে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেয়; এর ফলে যুক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত কোন পরিকাঠামোও ভেঙে পড়তে পারে ।

সামাজিক আসঞ্জনের শুরু শত্রুভীতির সুবাদে গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রতি আনুগত্য দিয়ে, তারপর এই আসঞ্জনের (Cohesion) বৃদ্ধি ঘটেছিল প্রক্রিয়া-পরম্পরায়-যা আংশিকভাবে ছিল স্বাভাবিক, আংশিক ছিল স্বেচ্ছাকৃত। অবশেষে এই আসন পৌঁছাল সেই সুবিশাল একীভূত পর্যায়ে, যা আমাদের কাছে জাতি রূপে পরিচিত। এইসব প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উপাদান ও শক্তির অবদান ছিল। খুব প্রাথমিক স্তরে, নেতার প্রতি আনুগত্য থেকে বলবৎ হতো গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য। এমনকী যখন সাধারণ আদিম মানুষেরা প্রায়শই পরস্পরের কাছে অপরিচিত ছিল, তখনও একটি বড়সড় গোষ্ঠীর প্রধান বা রাজাকে সকলেই চিনতো। এইভাবে, গোষ্ঠীগত আনুগত্যের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আনুগত্যই, প্রবৃত্তির ধ্বংসাত্মক ক্ষতি না করেও, গোষ্ঠীর আয়তন-বৃদ্ধি সম্ভব করে তুলেছিল।

একটি নির্দিষ্ট পর্বে, আরও পরিবর্তনমুখী অগ্রগতি ঘটলো। যুদ্ধ মানেই হয়ে দাঁড়ালো ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ, অন্তত আংশিকভাবে জয়ের জন্য যুদ্ধ; পরাজিতদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরিবর্তে ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো, যারা তাদের বিজেতা প্রভুদের আদেশে শ্রমদান করতে বাধ্য থাকতো। এরকম ঘটনা যখন ঘটতে লাগলো, তখন কোন সমাজে দুই ধরনের মানুষ দেখা গেল, যথা-মূল সদস্যবৃন্দ, যারা নিজেরা ছিল স্বাধীন ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক প্রেরণার অছি, আর দ্বিতীয় বিভাগে ছিল মূলত প্রজাশ্রেণী, যাদের আনুগত্যের উৎস ছিল প্রবৃত্তির পরিবর্তে ভীতি। নিনেভে ও ব্যাবিলনের শাসন সুবিশাল এলাকাজুড়ে প্রসারিত ছিল, অবশ্য তার কারণ এই নয় যে, এই অঞ্চলের প্রজাদের এই প্রভাববিস্তারী নগরের প্রতি ছিল কোন সামাজিক সংসক্তিজাত প্রবৃত্তিগত চেতনা, বরং আসল কারণটা ছিল- যুদ্ধবিজেতাদের শৌর্যবীর্জ-প্রভাবিত সন্ত্রাস। সেই প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক আমল পর্যন্ত যুদ্ধ মূলত হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণের প্রধান চালিকাশক্তি এবং সামাজিক সংসক্তির উৎসরূপে দ্রুততর গতিতে গোষ্ঠী ঐক্যের জায়গা নিয়েছে ভীতি। এই পরিবর্তন বৃহদায়তন গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না; দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়-স্পার্টায় স্বাধীন নাগরিক ছিল সংখ্যালঘু, এবং হেলটরা নির্দয়ভাবে নিষ্পেষিত হতো। প্রশংসনীয় সামাজিক আসঞ্জনের জন্য স্পার্টানগরী সমগ্র প্রাচীন কাল জুড়েই প্রশংসা অর্জন করেছে, কিন্তু এটা এমনই এক সংসক্তি ছিল, যা কখনই সমগ্র জনসাধারণকে কাছে টানতে চেষ্টা করেনি, বরং সন্ত্রাসের সুবাদে বাহ্যিক আনুগত্যেরই প্রকাশ ঘটেছিল।

সভ্যতার অগ্রগতির পরবর্তী স্তরে এক নতুন ধরনের আনুগত্যের অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিলঃ আঞ্চলিক জ্ঞাতিত্ব বা সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং মতবাদের অভিন্নতার ভিত্তিতে আনুগত্য। পাশ্চাত্য দেশে অরক্ষিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রবণতা উদ্ভূত হয়েছিল, যেখানে ক্রীতদাসদেরও সমানাধিকারীর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও প্রাচীনযুগের ধর্মাধিকারের সঙ্গে সরকারি সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ছিল যে, সমধর্মচারীদের সঙ্গে পুরাতন জৈব ভিত্তিতে লালিত গোষ্ঠীদের অবস্থান মোটামুটিভাবে সদৃশ ছিল। কিন্তু মতবাদের অভিন্নতা ক্রমশ প্রবলতর নির্ণায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়ালো। এর সামরিক শক্তি সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল ইসলামের নেতৃত্বে-সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর বিজয়াভিযানের মাধ্যমে। এই শক্তি মুসলমান বিরোধী জেহাদে ও অন্যান্য ধর্মযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদী আনুগত্যকে প্রায়শই ছাপিয়ে যেত ঈশ্বরবাদী আনুগত্য ও ইংরেজ ক্যাথলিকরা প্রায়শই স্পেনের পক্ষ গ্রহণ করতো, আর ফরাসি-ইংল্যান্ডের পক্ষ । আমাদের নিজেদের সমকালে দুটি ব্যাপক প্রচলিত মতবাদে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে মানবজাতির এক বিশাল অংশ। এর মধ্যে একটি হল-কমিউনিস্ট মতবাদ, একটি পবিত্র পুস্তকে সন্নিবেশিত রয়েছে এই মতবাদের প্রভূত গোঁড়ামি ও অনুরাগের আয়োজন। অন্যটি অনেকটাই অনির্দিষ্ট ধরনের হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী, যাকে বলা যায় জীবনযাপনের মার্কিন পদ্ধতি। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ে গড়ে ওঠা আমেরিকার কোন জৈব ঐক্য নেই, তা সত্ত্বেও দেশটির রয়েছে ইয়োরোপীয় দেশগুলোর মতোই দৃঢ় ঐক্য। সম্ভবত এ কারণেই আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, এই দেশ একটি শপথের প্রতি উৎসর্গীকৃত।’ আমেরিকায় অভিবাসীরা প্রায়শই ইয়োরোপের জন্য স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন, কিন্তু তাদের সন্তানসন্ততিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরনো পৃথিবীর চেয়ে মার্কিনী জীবনধারাকে অধিকতর পছন্দ করে, এবং তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, এই ধরনের জীবনবিচিত্রা যদি বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে, তাহলে তা মানবজাতির ঐক্য একাঙ্গীভূত হয়ে এক নতুন ধরনের ক্ষমতা অর্জন করেছে, কিন্তু এই পরস্পরবিরোধী মতবাদ দুটির এমন আকর্ষণ রয়েছে, যা প্রায়শই জাতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে যায়।

আমাদের সময়ের বিশাল গোষ্ঠীর প্রতি আধুনিক আনুগত্য, তা যতই শক্তিশালী ও আত্মবাদী অর্থে সন্তোষজনক হোক না কেন, এখনও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীজীবনের দিনগুলোতে বিকশিত প্রাচীন মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ রয়েছে। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক আকারের সঙ্গে মানুষের যখন সর্বপ্রথম পরিচিতি ঘটেছিল, সেই দিনগুলো থেকে আজও সহজাত মানবিক প্রকৃতির বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি, যদিও বিদ্যালয় ও ধর্ম, প্রচার ও সংগঠনের সমবেত উদ্যোগে এর বিপরীত প্রবণতা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। প্রবৃত্তিগত অর্থে আমরা মানবজাতিকে দুই ভাগে ভাগ করবো-মিত্র ও শত্রু-তারাই হল মিত্র, যাদের প্রতি আমাদের রয়েছে সহযোগিতার নৈতিকতা; আর যাদের প্রতি রয়েছে আমাদের প্রতিযোগিতার নৈতিকতা, তারা-শত্রু। কিন্তু এই বিভাজনেরও অবিরাম পরিবর্তন ঘটে চলেছে; কোন মুহূর্তে হয়তো কোন ব্যক্তি তার ব্যবসায়ী-প্রতিযোগীকে ঘৃণা করেন, কিন্তু অন্য কোন মুহূর্তে তাদের দু’জনের প্রতি যখন সমাজবাদ বা কোন বহির্শক্র ভীতি প্রদর্শন করে, তখন হঠাৎ তিনি তাঁর শত্রুকেও বন্ধুরূপে ভাবতে শুরু করেন । যখন আমরা পরিবারের সীমানা ছাড়িয়ে যাই, তখন সবসময়ের বহির্শক্রই সংসক্তির রসদ সরবরাহ করে। নিরাপদ সময়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের ঘৃণা করার সুযোগ পাই, কিন্তু বিপদের সময়ে তাকে আমাদের ভালবাসতেই হবে। অধিকাংশ সময়েই, মানুষ বসে তার পাশে বসে থাকা ব্যক্তিকে ভালবাসে না, কিন্তু বিমানহানার সময়ে সে তাকেই ভালবাসে।

এই কারণের জন্যই পৃথিবীব্যাপী ঐক্যের উপায় উদ্ভাবন করা দুরূহ হয়ে ওঠে। যদি কোন দিন বিশ্বরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে গঠিত হয়, তখন ভয় পাওয়ার মতো কোন শত্রুপক্ষ থাকবে না; এই অবস্থায় সে কারণে, সংসক্তিমূলক উপাদানের অভাবে সেই রাষ্ট্রের ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও থাকবে। বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিস্টানধর্ম-এই দুটি মহৎ ধর্মমত স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানবজাতির মধ্যে সহযোগিতার বাতাবরণ সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছে। তারা মানুষের সৌভ্রাতৃত্ববোধ সম্পর্কে প্রচার করেছেন, ‘সৌভ্রাতৃত্ববোধ’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা তাদের স্বাভাবিক বাধ্যবাধকতা অতিক্রম করে এক ধরনের আবেগময় দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার চেষ্টা করছে, যার বৈশিষ্ট্য মূলত দৈব্য। যদি আমরা সকলেই ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের সকলকে নিয়েই তো একটি পরিবার। কিন্তু বাস্তবে যারা তত্ত্বগতভাবে এই মতবাদ গ্রহণ করেছে, তারা সবসময়ে মনে করে, যারা এই মত গ্রহণ করে না, তারা ঈশ্বরের সন্তান নয়, বরং তারা শয়তানের সন্তান এবং গোষ্ঠীবহির্ভূত ক্ষেত্রে ঘৃণার যে প্রক্রিয়া, তা আবার বর্ধিত শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে এই প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ধর্ম, নীতি, অর্থনৈতিক স্বার্থ, জৈবিক অস্তিত্বরক্ষা-এসব কিছুই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে সরবরাহ করে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার পরিপূরক নিরুত্তরযোগ্য যুক্তিবাদ, কিন্তু আমাদের গোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহিত প্রবৃত্তি ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধে জ্বলে ওঠে এই কথা চিন্তা করে যে, যদি ঘৃণার পাত্র কেউ না থাকে, তাহলে জীবন স্বাদহীন হয়ে পড়বে, নির্বোধের মতো যাকে তাকে ভালবাসতে পারে একমাত্র কীটপতঙ্গরাই, চিন্তার মধ্যে এও থাকে যে, সংগ্রামই হল জীবনের সূত্র; এমন কোন পৃথিবীতে যদি সকলেই পরস্পরকে ভালবাসে, তাহলে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। যদি কোনদিন মানবজাতির ঐক্যের রূপায়ণ করতে হয়, তাহলে আংশিকভাবে আইনের শাসন কায়েম করে, এবং আংশিকভাবে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক প্রবৃত্তিসমূহের নির্দোষ নির্গমনের ব্যবস্থা করে আমাদের অসচেতন আদিম হিংস্রতাকে বিদায় জানানোর পথ খুঁজে বার করতে হবে।

এটা কোন সরল সমস্যা নয়, এবং এটা এমন এক সমস্যা, যার সমাধান শুধুমাত্র নৈতিকতার দ্বারা সম্ভব নয়। মনোসমীক্ষা-তার কিছু কিছু সুনিশ্চিত অতিরঞ্জনী ও অবাস্তবতামূলক বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও আমাদের প্রচুর সঙ্গত ও মূল্যবান শিক্ষা প্রদানও করেছে। একটি প্রাচীন প্রবাদ-যদি তুমি বিশেষ ধরনের নিক্ষেপ-দন্ড দিয়েও প্রকৃতিকে বিতাড়িত করো, তাহলেও তা ফিরে আসবে, কিন্তু মনোবিশ্লেষণ এই পটভূমিতেই বিবরণীটিকে সরবরাহ করেছে এখন আমরা জানি-যদি কোন মানুষের জীবন মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিকে অতিক্রম করে ফেলে, তখন সেই জীবনে নানাবিধ মানসিক চাপের কুফল দিখা দেতে পারে, যা নিষিদ্ধ প্রবৃত্তিতে আসক্তির মতোই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে ।

যেসব মানুষের জীবন একটা নির্দিষ্ট বিন্দু অতিক্রম করে অস্বাভাবিক প্রবাহিত হয়, তাদের জীবন সাধারণত নানাবিধ ঈর্ষা, অপচিকীর্ষা ও নির্মমতায় পরিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাদের মধ্যে নিষ্ঠুরতাপুষ্ট মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে, অথবা-পক্ষান্তরে তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে পারে সব ধরনের আনন্দ, যার ফলশ্রুতিতে তারা আর উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা দেখাতে পারে না। যেসব আদিম সম্প্রদায়কে আকস্মিকভাবে আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের মধ্যে উপরোক্ত প্রবণতার প্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে। নৃতত্ত্ববিদেরা বর্ণনা করেছেন; কীভাবে পাপুয়া নরমুন্ড-শিকারিরা শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের দ্বারা তাদের দীর্ঘকালীন অভ্যাসলালিত খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হয়ে সব ধরনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে এবং কোন বিষয়েই তাদের আর আগ্রহী করে তোলাও সম্ভব হয়নি। আমি অবশ্যই এই মন্তব্য করতে চাই না যে, তাদেরকে আবার নরমুন্ড-শিকারের অনুমতি দেওয়া হোক, কিন্তু আমি যা বলতে চাই, তা হল-মনস্তত্ত্ববিদরা যদি সামান্য কষ্ট করে তাদের জন্য কিছু নির্দোষ কর্মোদ্যোগের বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করেন। পৃথিবীর সর্বত্রই সুসভ্য মানুষের অবস্থা, অন্তত আংশিকভাবেও, চারিত্র-বৈশিষ্ট্যের শিকারস্বরূপ পাপুয়া সম্প্রদায়ের মতোই। আমাদের মধ্যে রয়েছে সবধরনের আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি এবং অবশ্যই সৃজনমূলক প্রবৃত্তিও রয়েছে, যার সঙ্গে যুক্ত হতে সমাজ নিবৃত্ত করে, এবং এর পরিবর্তে সমাজ ফুটবলম্যাচ-কুস্তি ইত্যাকার আঙ্গিকে যেসব বিকল্পের ব্যবস্থা করেছে, তা আদৌ যথেষ্ট নয়। যদি কেউ এমন আশা পোষণ করেন যে, যথাসময়েই যুদ্ধকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে, তাহলে আদিমতার প্রজন্মপরম্পরা ও উত্তরাধিকারবাহিত প্রবৃত্তিসমূহের আপাত-নির্দোষ চরিতার্থকরণ জনিত সমস্যাটিকে নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে তাদের ভাবনাচিন্তা করতে হবে। আমার তরফে বলতে পারি-আমি গোয়েন্দা গল্পের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে নির্গম-পথ খুঁজে পাই, সেখানে আমি বিকল্প-পদ্ধতিতে হত্যাকারী ও শিকারি গোয়েন্দার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করি, কিন্তু আমি এও জানি-এমন মানুষও রয়েছে, যাদের কাছে এই ধরনের মামুলি নির্গম-পথগুলো খুবই অনুগ্র, এবং তাদের জন্য কিছু কড়া ধরনের খোরাকের ব্যবস্থা করা উচিত।

আমি মনে করি না প্রতিযোগিতা ছাড়া সাধারণ মানুষ সুখী হতে পারে, কেননা মানবজাতির জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিযোগিতা যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মোদ্যোগের অনুপ্রেরণার ভূমিকা নিয়েছে। সে কারণে প্রতিযোগিতার বিলোপসাধনের চেষ্টা করা উচিত নয়, শুধু এদিকটায় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, প্রতিযোগিতা যেন খুব অনিষ্টকর রূপ না নিতে পারে। আদিম প্রতিযোগিতা ছিল এমন এক ধরনের সংঘাত যেখানে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষ, তার স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিকে হত্যা করতো; আধুনিক যুগের প্রতিযোগিতাতেও যুদ্ধের আঙ্গিকে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু ক্রীড়া-সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং সাংবিধানিক রাজনীতিতে প্রতিযোগিতায় নামমাত্র ক্ষতি জড়িয়ে থাকে এবং তা সত্ত্বেও এগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্গমনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে থাকে। এক্ষেত্রে যা অসঙ্গত, তা হল-এ ধরনের প্রতিযোগিতা মন্দ নয়, কিন্তু এগুলোতে সাধারণ পুরুষ ও নারীদের এক অতি ক্ষুদ্রাংশই নিজেদের যুক্ত করে থাকে।

যুদ্ধ ছাড়াও আধুনিক সভ্যতা ক্রমশ নিরাপত্তার বিষয়টিকে লক্ষ্যবস্তু রূপে নির্ধারিত করেছে, কিন্তু আমি আদৌ সুনিশ্চিত নই যে, সব ধরনের বিপদ দূরীভূত হলেই সুখের সন্ধান মিলবে। এ প্রসঙ্গে আমি স্যার আর্থার কিথের ‘নিউ থিওরি অব হিউম্যান ইভলিউশন’ (New theory of human evolution) থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করতে চাই

“বন্য বিচারের রাজত্বে যারা বসবাস করে, তাদের পরিদর্শন করে, কিছু মানুষ উপরোক্ত সদৃশ অবস্থায় বসবাসকারী স্বদেশীয়দের মধ্যে সেই বৃত্তান্ত পরিবেশন করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ-ফ্রেয়া স্টার্ক দক্ষিণ-আরব সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে-’আমি ওই দেশের এমন একটি অংশে পরিভ্রমণ করতে এলাম যেখানে নিরাপত্তাব্যবস্থার কোন অস্তিত্ব নেই, সেখানে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের মানুষের সাক্ষাৎ পেলাম, যাদের জীবনের অপর নাম ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে ভীতিপ্রদর্শন ও লুণ্ঠনকর্ম-তা সত্ত্বেও তাদের জীবন পৃথিবীর যে কোন স্থানে বসবাসকারী মানুষদের মতোই আনন্দ-বিনোদনে পরিপূর্ণ থাকত।’ ডঃ এইচ-কে-ফ্লাই অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সম্পর্কে অনুরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘অরণ্যরাজ্যের আদি অধিবাসী বসবাস করে চলমান বিপদকে সঙ্গে নিয়ে; বৈরি আত্মারা সবসময়েই তাকে প্রদক্ষিণ করে। তা সত্ত্বেও, সে কোমলহৃদয় ও আনন্দময়…তার সন্তানসন্ততির প্রতি সে যথারীতি প্রশ্রয়প্রবণ ও বাবা-মায়ের প্রতি সহৃদয়। আমার তৃতীয় দৃষ্টান্ত হল-আমেরিকার ক্রো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়, যারা বহু বছর ধরে ডঃ আর লৌরির চোখের সামনেই বসবাস করেছে। তারা এখন সংরক্ষিত নিরাপত্তা-বলয়ে বাস করছে। ডঃ লৌরি বলেছেন, একজন ক্রো-কে জিজ্ঞাসা করো যে, সে বর্তমানের নিরাপত্তা অথবা অতীতের বিপন্নতা-কোনটিকে বেছে নেবে, তার উত্তরটি হবে-”অতীতের বিপন্নতাই বেছে নেব…কারণ তার মধ্যে অনেক গৌরব ছিল। আমি ধরে নিচ্ছি-আমার বর্ণিত জীবনের আরণ্যক শর্তগুলো উদ্ভূত হয়েছে সেই পটভূমি থেকে, যা মানবজাতি বিবর্তনের সমগ্র প্রাথমিক পর্ব জুড়ে অতিবাহিত করেছে। এই রকম পরিস্থিতির মধ্যেই গড়ে উঠেছিল মানুষের প্রকৃতি ও চারিত্রিক ধর্ম এবং এই পরিস্থিতিনির্ভর একটি শর্ত ছিল-রক্তস্নাত প্রতিশোধের অভ্যাস।”

মানব-মনস্তত্ত্বের এধরনের ফলাফলের পিছনে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো ১৯১৪ সালে সর্বপ্রথম জানার পরে, অন্তত আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছিল । এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা শান্তিকালীন সময়ের চেয়ে যুদ্ধের সময়ে বেশি সুখী অনুভব করে, অবশ্য এই শর্তসাপেক্ষে যে যুদ্ধরত মানুষদের প্রত্যক্ষ দুঃখকষ্ট যেন তাদের ওপর খুব বেশি না পড়ে। শান্তশিষ্ট জীবন মানে একঘেঁয়ে জীবনও হতে পারে। মোটামুটি ভাল উপার্জন করেন, সচ্ছল জীবনযাপনে অভ্যস্ত-এরকম রোমাঞ্চহীন সদাচারী নাগরিকের অস্তিত্বের ফসল হল এক বৃহত্তর মানবিক প্রকৃতি-৪,০০,০০০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করলে যে প্রকৃতির সুবাদে সে উদ্যোগ নিত খাদ্যান্বেষণে, নরমুন্ড শিকার ও বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার অঢেল সুযোগে। যখন যুদ্ধ বেধে যায়, তখন ব্যাংকের করণিক পালিয়ে কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে, এবং অবশেষে সে মনে করতে পারে, প্রকৃতি ঠিক যেভাবে চেয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই তো সে এখন জীবনযাপন করছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, বিজ্ঞান আমাদের হাতে বর্তমানে আমাদের ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি চরিতার্থকরণের এমন সব দারুণ শক্তিশালী উপকরণ তুলে দিয়েছে। যে, মানুষের অবাধ আচরণ-যখন তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল-সেরকম কোন বিবর্তনমূলক উদ্দেশ্যে আর সিদ্ধ করবে না। আমাদের নৈরাজ্যমূলক প্রবৃত্তির সঙ্গে শান্তি র সংযোগস্থাপনের সমস্যা এমনই একটি বিষয়, যার ওপর চর্চা খুব বেশি হয়নি, অথচ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যা একান্ত প্রয়োজনীয় ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। একেবারে নির্ভেজাল জৈব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রযুক্তির সৃজনাত্মক দিকের তুলনায় ধ্বংসাত্মক দিকটার দ্রুততর গতিতে অনেক বেশি প্রসার ঘটেছে। এক মুহূর্তের মধ্যে একজন মানুষ ৫,০০,০০০ মানুষকে হত্যা করতে পারে, কিন্তু সে প্রাচীন আদিম যুগের তুলনায় সামান্যতম কম সময়েও একটি শিশুর জন্মাধিকার অর্জন করতে পারেনি। মানুষ একটি আণবিক বোমা দিয়ে যতখানি দ্রুততায় ৫,০০,০০০ মানুষের জীবন ধ্বংস করতে পারে, যদি ঠিক ততটা দ্রুততায় মানুষ ৫,০০,০০০ শিশুকে হাতে পেয়ে যেতো, তাহলে আমরা অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের বিনিময়েও, জৈব সমস্যাটিকে অস্তিত্বের সগ্রাম ও যোগ্যতমের উদ্বর্তনের দিকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে বিবর্তনের পুরনো প্রক্রিয়াটির ওপর আর আস্থা রাখা যায় না।

সুতরাং সমাজ-সংস্কারকের সমস্যা নিছক নিরাপত্তার উপায়-অনুসন্ধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, কারণ এই উপায়সমূহ খুঁজে বার করা সম্ভব হলেও কোন গভীর তৃপ্তি সরবরাহ করতে পারে না-রোমাঞ্চ-বিপদ-প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঙ্গিকের সমন্বয়সাধন এবং এই সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার সময়ে আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে-যদিও আমাদের জীবনের আচার ব্যবহার এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ ও জ্ঞানবৃত্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে, তবুও আমাদের ভাল ও মন্দ প্রবৃত্তির ক্ষেত্রগুলো সেই আদিমযুগের মতো একই রকম রয়ে গেছে, যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা সর্বপ্রথম বর্তমান আকৃতির মস্তিষ্কের অধিকারী হয়েছিল। আমি মনে করি না, সুসভ্য জীবনচর্যার সঙ্গে আদিম প্রবৃত্তিসমূহের সমন্বয়সাধন কোন অসম্ভব ব্যাপার, এবং নৃতাত্ত্বিকদের সমীক্ষা থেকে এঘটনাও প্রমাণিত যে, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও লোকাঁচারের সঙ্গে মানবিক প্রকৃতি ব্যাপকভাবে অভিযোজনপন্থী। কিন্তু আমি এও মনে করি না যে, মূল প্রবৃত্তিকে বাদ দিয়ে এটা করা সম্ভব। রোমাঞ্চবর্জিত জীবন সম্ভবত অতৃপ্তিজনক, কিন্তু যে জীবনে রোমাঞ্চকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সেই রোমাঞ্চ যদি যথেচ্ছ রূপ পরিগ্রহ করে- সেই জীবনও সংক্ষিপ্ত হতে বাধ্য।

আমি মনে করি, এই বিষয়টির নির্যাস নিহিত রয়েছে রেড ইন্ডিয়ানের সেই উক্তিটির মধ্যে, যা আমি কিছুক্ষণ আগে উদ্ধৃত করেছি, যে পুরনো জীবনের এই স্মৃতিচারণা করে দুঃখ প্রকাশ করেছিল-”আগের জীবনে ছিল অনেক গরিমা। যে কোন উদ্যোগী মানুষই এমন কিছু কামনা করে থাকে। একে চিহ্নিত করা যায় ‘গৌরব’ রূপে, এটা করায়ত্ত করতে পারে এমন মানুষও রয়েছে-চিত্রতারকা, বিখ্যাত খেলোয়াড়, সামরিক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, এবং এমনকী কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদও, কিন্তু তারা খুবই সংখ্যালঘু, এবং বাকিদের সম্বল হল দিবাস্বপ্ন- চলচ্চিত্রের দিবাস্বপ্ন, বন্য পশ্চিমী রোমাঞ্চকাহিনীর দিবাস্বপ্ন, কল্পচারিতার নির্ভেজাল ব্যক্তিগত দিবাস্বপ্ন। আমি সেই দলে নই, যারা মনে করে দিবাস্বপ্ন মানে জিনিসটা আদ্যোপান্ত খারাপ; কল্পিত জীবনের অপরিহার্য অংশ হল এই দিবাস্বপ্ন। কিন্তু একটা দীর্ঘ জীবনে যখন এগুলোকে কোনভাবেই বাস্তবের সঙ্গে মেলানো সম্ভব হয়ে ওঠে না, তখন সহজেই এগুলো হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর এবং এমনকী প্রকৃতিস্থতার পক্ষে বিপজ্জনক। বর্তমানে অলীক ও অবাস্তবতার রাজ্যে বন্দী প্রবৃত্তিসমূহের কিছুসংখ্যক প্রকৃত নির্গমন-পথ খুঁজে বের করা এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে বোধ হয় এখনও সম্ভব হতে পারে। সুস্থিতির স্বার্থে সর্বতোভাবে এই আশা লালন করতে হবে যে, এটা সম্ভব হতে পারে, কারণ এরকম আশাবাদ যদি পোষণ না করা হয়, তাহলে বিভিন্ন সময়ে ধ্বংসাত্মক দর্শনসমূহ মানবিক কৃতিত্বের শ্রেষ্ঠ বিষয়গুলোকে ধুয়েমুছে সাফ করে দেবে। এটা যদি প্রতিরোধ করতে হয়, তাহলে আমাদের প্রত্যেকের অন্তর্লীন আদিমতাকে কিছু নির্গম-পথ খুঁজে নিতেই হবে, সভ্য জীবনধারা ও তারই মতো সম-আদিম প্রবৃত্তিবাহী প্রতিবেশীর সুখের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হয়ে উঠবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *