০৫. আত্মা ও দেহ

ধ্যায় ৫
আত্মা ও দেহ

বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমুদয় বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম উন্নত বিভাগ হলো মনোবিদ্যা। ব্যুৎপত্তির দিক থেকে মনোবিদ্যা’র ইংরাজি পরিভাষা ‘সাইকোলজি’র আবশ্যিক অর্থ হবে আত্মার তত্ত্ব। কিন্তু আত্মা ধর্মতত্ত্ববিদদের কাছে পরিচিত হলেও এটা একটা বৈজ্ঞানিক ধারণা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। কোনো মনোবিদই বলবেন না যে, তাঁর অধ্যয়নের বিষয় হলো আত্মা। কিন্তু তাঁকে যদি প্রশ্ন করা যায় এটা তাহলে কী? তিনি সহজে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। কেউ কেউ বলবেন যে, মনোবিদ্যা মানসিক বিষয়। সেইসব বিষয় থেকে আলাদা যেগুলোকে পদার্থবিদ্যার তথ্য যোগান দিতে হয়? মৌলিক মনোবিদ্যাজনিত প্রশ্নগুলো দ্রুত আমাদের দার্শনিক অনিশ্চয়তার মধ্যে টেনে আনে। এবং অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে এক্ষেত্রে অনেক কঠিন মৌলিক প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। কাঠিন্যের কারণ মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথার্থ পর্যবেক্ষণজাত জ্ঞানের স্বল্পতা।

এতদসত্ত্বেও কিছুটা প্রাপ্তি ঘটেছে এবং বহু প্রাচীন ভুল পরিত্যক্ত হয়েছে। এসব প্রাচীন ভুলের পরিমাণের অনেকখানি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত ছিল, কারণ কিংবা ফলাফল হিসাবে। কিন্তু এ-পর্যন্ত আমাদের আলোচিত বিষয়গুলো কোনো বিশেষ টেক্সট অথবা বাইবেলীয় ভুলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এগুলো বরঞ্চ অধিবিদ্যক মতবাদের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল। এটা কিংবা সেটার কারণে গোড়া ধর্মবিশ্বাসের অনুশাসনের অঙ্গের সঙ্গে এগুলির সংযুক্তি অপরিহার্য বলে ভাবতে হয়েছিল।

‘আত্মা’র ধারণাটা প্রথমে গ্রিকচিন্তায় জায়গা নিয়েছিল। এই আত্মার একটা ধর্মীয়, কিন্তু খ্রিস্টীয় নয়, এমন একটা উৎস ছিল। মনে হয়, গ্রিসের সংশ্লিষ্টতার জন্য পিথাগোরাসের অনুগামী ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই এটার সূচনা হয়েছে। এই অনুগামীরা পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন। এঁদের লক্ষ্য ছিল অন্তিম নির্বাণ হলো বস্তুর বন্ধন থেকে মুক্তি। এই বস্তুর বন্ধনেই যতদিন দেহের সঙ্গে যুক্ত থাকে ততদিন আত্মা কষ্ট পায়। পিথাগোরাসপন্থীরা প্লেটোকে প্রভাবিত করেছিলেন। এবং প্লেটো প্রভাবিত করেছিলেন গির্জার যাজকদের। এভাবে আত্মার মতবাদ, যে-আত্মা দেহ থেকে পৃথক, খ্রিস্টান মতবাদের অংশ হয়ে পড়ল। অন্যান্য প্রভাব যেগুলো পরে এই খ্রিস্টীয় মতবাদে প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে লক্ষণীয় হলো অ্যারিস্টটল এবং স্টোইকদের প্রভাব। কিন্তু প্লেটোবাদ বিশেষত এর পরবর্তী রূপ খ্রিস্টীয় পৌত্তলিক দর্শনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

প্লেটো থেকে জানা যায় যে, পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টধর্ম কর্তৃক শিক্ষণীয় মতবাদের সমতুল্য মতবাদ তার সময়ে দার্শনিকদের তুলনায় সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। Republic গ্রন্থের একটি চরিত্র বলছে, ‘নিশ্চিত থাকুন সক্রেটিস, যখন একজন মানুষকে বোঝানো যায় যে, তিনি মরতে চলেছেন, ওই মানুষটি তখন আশঙ্কিত হন এবং তাকে আগে-ভাবাতো-না এমন সব বিষয় নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। এর আগে পর্যন্ত মুমূর্ষ মানুষদের সম্পর্কে ওইসব গল্প নিয়ে মানুষটি হেসেছেন। গল্পগুলো আমাদের বলে যে, যিনি এ-জগতে অন্যায় করেছেন তিনি পরলোকে অবশ্যই কষ্ট ভোগ করবেন। কিন্তু এখন ওই মুমূর্ষ মানুষটির মন যন্ত্রণাপীড়িত এটা ভেবে যে, ওসব গল্প সম্ভবত সত্য।’ পুটোর অন্য একটি রচনাংশে দেখতে পাই, যে-আশীর্বাদ মুসিউস এবং তাঁর পুত্র ইউমোলপাস দেবতা- প্রদত্ত হিসাবে পেয়েছেন, সেগুলো এসবের থেকে বেশি প্রীতিকর। (যেমন এ জগতে ধন- সম্পদ)। এর কারণ তারা পাতালপুরীতে এসব নিয়ে আসেন। এদের সম্পর্কে বর্ণনা দেন যে, এরা পুণ্যবানদের ভোজসভায় সোফায় অর্ধশায়িত থাকেন, মাথায় মালা জড়িয়ে সুরাপানে চিরকাল ব্যয় করেন। মনে হয় মুসিউস এবং অরফিউস কেবলমাত্র ব্যক্তিকে বোঝাতেই সক্ষম হননি, পুরো শহরটাকেই এঁরা বোঝাতে পেরেছেন। বুঝিয়েছেন যে, মানুষকে অপরাধ থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় এবং তাদের শুদ্ধ করে তোলাও সম্ভব। মানুষ বেঁচে থাকতেও এটা করা যায়, এবং এটা করা সম্ভব তাদের মৃত্যুর পরেও। এটা করা যায় কতিপয় ত্যাগ এবং আনন্দদায়ক পীড়ন থেকে উদ্ধার করে। এসবের অবহেলার শাস্তি ভয়াবহ অবধারিত ধ্বংস। সক্রেটিস নিজে তার Republic গ্রন্থে বলেছেন যে, পরবর্তী জীবন আনন্দ হিসাবে উপস্থাপিত করতে হবে এই কারণে যে, এটা যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্যকে উৎসাহিত করবে। অথচ তিনি বলেননি যে, এসব সত্য বলে তিনি নিজে বিশ্বাস করেন কিনা।

খ্রিস্টান দার্শনিকদের মতবাদ প্রাচীন পৃথিবীতে প্রধানত প্লেটনীয় ছিল। একাদশ শতকের পরে এটি মূলত অ্যারিস্টটলীয় হয়ে উঠল। টমাস অ্যাকুইনাস (১২২৫-৭৪) যিনি মধ্যযুগীয় পণ্ডিতদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত ছিলেন, তিনি এখনও পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক গির্জার দার্শনিক গোঁড়ামির প্রামাণ্যই রয়ে গেছেন। ভ্যাটিকান নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ, যখন তাঁরা বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করবেন দেকার্ত অথবা লক, কান্ট অথবা হেগেলের ঐতিহাসিক আগ্রহের বিষয়গুলো, তখন তাঁদের স্পষ্ট করে বলতে হবে যে, কেবলমাত্র সত্য পদ্ধতি হলো ‘দেবদূতকল্প ডাক্তার। চূড়ান্ত অনুমোদিত অনুজ্ঞা হলো এটা বলা যে, যেমনটা তার অনুবাদক মনে করেন, তিনি এটা আলোচনা করতে গিয়ে ঠাট্টা করেছেন। আলোচনার বিষয় ছিল, কী ঘটে যখন নরখাদকটির সামনে একটি শরীরের পুনরুত্থান ঘটে, যে-নরখাদকটির পিতা মাতাও নরখাদক? স্পষ্টতই নরখাদক এবং তার পিতা-মাতা যেসব মানুষদের উদরপূর্তি করেছে তাদের তো নিজেদের দেহগুলো পুনরায় গঠন করার অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকের এ-দাবিতে নরখাদক চরম নিঃস্ব হয়ে পড়বে। যারা দেহের পুনরুত্থানে বিশ্বাস রাখেন এটা তাঁদের কাছে একটা বাস্তব সমস্যা। এটি আবার ভগবদবাক্য প্রচারকদের ধর্মবিশ্বাস দ্বারা নিশ্চিতভাবে প্রতিপন্ন। আমাদের যুগে এটা একটা কট্টর ধর্মবিশ্বাসের বৌদ্ধিক শক্তিহীনতার প্রতীক। এই বিশ্বাসটা কত বাস্তব সেটা বোঝা যায় মৃতদেহ সমাহিত করতে আপত্তি জানানোর ঘটনায়। প্রোটেস্টান্ট দেশগুলোর অনেকেই এবং ক্যাথলিক দেশসমূহের প্রায় সবাই ফ্রান্সের মতো মুক্ত হলেও এই আপত্তি জানায়। আমার ভাইয়ের মরদেহ সমাহিত করা হলো মারসেইলিসে। তখন ওখানকার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি আমাকে বললেন যে, এর আগে সমাহিত করার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এটা না ঘটানোর কারণ ধর্মতত্ত্বীয় সংস্কার। স্পষ্টতই এটা ভাবা যায় যে, সর্বশক্তিমানের পক্ষে যে দেহগুলো গ্যাস হয়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো পুনঃসমাবিষ্ট করতে অধিকতর অসুবিধাজনক সেই দেহগুলো থেকে, যেগুলো কবরে পোকা এবং মাটি হয়ে রয়েছে। এ-ধরনের একটা ধারণা, এটা নিয়ে আমাকে বলতে বলা হলে, সেটা বলা আমার পক্ষে একটা ধর্মবিদ্বেষ হবে। বস্তুত এটা প্রচলিত মতবাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে একটা গোঁড়া ধর্মবিশ্বাস।

আত্মা ও দেহ, মধ্যযুগীয় পণ্ডিতম্মন্য দর্শনে (যেটা এখনও রোমে বর্তমান) উভয়ই হলো পদার্থ । পদার্থ’ হলো একটা ধারণা যেটা বাক্যগঠন পদ্ধতি থেকে প্রাপ্ত। পদার্থ হলো একটা ধারণা যেটা আহরিত হয় পদান্বয় (syntax) থেকে। এবং পদান্বয় আহরিত হয়েছে আদিম জনগোষ্ঠীর কম বা বেশি অচেতন অধিবিদ্যা থেকে। এই আদিম জনগোষ্ঠীরাই আমাদের ভাষার গঠনপ্রণালী নির্ধারণ করেছে। বাক্যগুলোকে উদ্দেশ্য এবং বিধেয় এই দু’ভাগে বিশ্লেষিত করা যায়। এবং এটা ভাবা হয় যে, যখন কতিপয় শব্দ আগে উদ্দেশ্য অথবা বিধেয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তখন অন্য শব্দও আছে (কিছু স্পষ্ট অর্থে নয়) যেগুলো উদ্দেশ্য হিসাবে উঠে আসে। এই শব্দগুলো– যেগুলোর ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানগত নাম (proper nouns) হলো সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ এগুলোকেই ‘পদার্থ হিসাবে নির্দেশিত করা হয়। একই ধারণার জনপ্রিয় শব্দটা হলো বস্তু অথবা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলো ব্যক্তি। পর্দাথের অধিবিদ্যক ধারণা হলো সাধারণ জ্ঞানে বস্তু বা ব্যক্তি বলতে যা বোঝায় তার সূক্ষ্মতা প্রদানের চেষ্টা।

একটা উদাহরণের কথা বলা যাক। আমরা বলতে পারি সক্রেটিস জ্ঞানী ছিলেন, সক্রেটিস একজন গ্রিক ছিলেন, সক্রেটিস প্লেটোকে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন এবং এরকম আরো কিছু। এই সবগুলো বর্ণনায় আমরা সক্রেটিসের প্রতি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আরোপ করি। এইসব বাক্যগুলোতে সক্রেটিস শব্দটির একই অর্থ। ব্যক্তি সক্রেটিস এভাবে তার বৈশিষ্ট্য থেকে কিছুটা পৃথক। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভাবা হয় সহজাত। স্বাভাবিক জ্ঞান কেবল একটা বস্তুকে এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে চিনতে সাহায্য করে। সক্রেটিসের যদি একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যমজ থাকত, আমরা তাহলে এঁদের পৃথক বলতে পারতাম না। এতদ্সত্ত্বেও, একটা পদার্থ এর বৈশিষ্ট্যসমূহের যোগফল ছাড়াও অন্য কিছু। ইউক্যারিস্টের মতবাদ থেকে এটা খুবই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। একটা খ্রিস্টীয় ধর্মানুষ্ঠানে রুটির বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে, কিন্তু পদার্থটি খ্রিস্টের শরীরের বৈশিষ্ট্যে বদলে যায়। আধুনিক দর্শনের উত্থানের সময় পর্যন্ত দেকার্ত থেকে লাইবনিজ (স্পিনোজা ব্যতীত) সমুদয় উদ্ভাবক এটা প্রমাণে দারুণ কষ্ট স্বীকার করেছেন যে, তাদের মতবাদ খ্রিস্টীয় ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কর্তৃপক্ষ বহুদিন ধরে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন যে, নিরাপত্তা কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক জ্ঞানচর্চার মধ্যেই খুঁজতে হবে।

এতে এটা মনে হয় যে, উদ্ঘাটিত জ্ঞান ছাড়া আমরা কখনোই নিশ্চিন্ত হতে পারি না যে, একটা সময়ে দেখা একটি বস্তু বা একজন ব্যক্তি অন্য সময়ে দেখা একটি বস্তু বা একজন ব্যক্তির অনুরূপ কিনা। বস্তুত আমরা একটা চিরস্থায়ী ভ্রান্তিবিলাস (comedy of errors)-এর ঝুঁকির মধ্যে থাকি। লকের প্রভাবে তার অনুগামীরা অন্য এক পথ নিয়েছিলেন যে-পথে তিনি নিজে চলেননি। তারা পর্দাথের সম্পূর্ণ উপযোগিতার ধারণাটাই অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে সক্রেটিস সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানি, সেসব জানতে পারি তার বৈশিষ্ট্য থেকে। আপনি যখন বলেছেন, কোথায় এবং কখন তিনি বাস করতেন, তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, তিনি কী করতেন, এবং এমনতর আরও কিছু, তখন তাঁর সম্পর্কে যা বলার সবই আপনি বলে ফেলেছেন। এখন পুরোপুরি অজ্ঞাত তার মর্মস্থলে গিয়ে ধরে নেবার কিছু নেই যে মর্মস্থলে তার বৈশিষ্ট্যগুলো সহজাত হয়ে থাকে, যেমন পিনদানিতে পিন থাকে। যেটা পুরোপুরি এবং বস্তুত অজ্ঞেয় সেটা কখনোই অস্তিত্বশীল বলে জ্ঞাত হতে পারে না। আর সেটার অস্তিত্ব থাকতে পারে, এমনটা ধরে নেবারও প্রয়োজন নেই।

পর্দাথের ধারণা, যার বৈশিষ্ট্য বর্তমান কিন্তু যে-কোনো একটি এবং সবকটি থেকে স্পষ্ট, এই ধারণা রক্ষা করেছেন দেকার্ত, স্পিনোজা এবং লাইবনিজ। হ্রাসপ্রাপ্ত গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করেছেন লক। যাই হোক, এটা হিউম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ক্রমে এটাকে মনোবিদ্যা এবং পদার্থবিজ্ঞান থেকে বাতিল করা হয়েছে। যেভাবে এটা ঘটেছে সেটা এখন আরও বলা হবে। এই মুহূর্তে এই মতবাদের ধর্মতত্ত্বগত তাৎপর্য এবং এই প্রত্যাখ্যান থেকে উদ্ভুত অসুবিধাগুলো অবশ্যই আমাদের চিন্তায় সংশ্লিষ্ট।

প্রথমে দেহের কথা ধরা যাক। যতক্ষণ পর্দাথের ধারণা বজায় রাখা হয়েছে, সে সময় পর্যন্ত দেহের পুনরুত্থানের মানে পৃথিবীতে বাস করার সময়ে-থাকা যথার্থ পদার্থের পুনরায় একত্রিত করা। পদার্থটা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু এর স্বরূপ বজায় রেখেছে। যাই হোক, যদি একটা বস্তু অন্য কিছু না হয়ে বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয় হয়, এবং স্বরূপ হারিয়ে যায়, যখন বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তিত হয় তখন এটা বলা অর্থহীন যে, পুনরুত্থানের ফলে স্বর্গীয় দেহ একই বস্তু যেটা এক সময় ছিল একটি পার্থিব শরীর। যথেষ্ট উদ্ভট এই অসুবিধাটার যথার্থ অনুরূপ একটি সমস্যা রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানে। একটা পরমাণু এর আনুষঙ্গিক ইলেকট্রনসহ হঠাৎ পরিবর্তনের প্রবণতাযুক্ত। পরিবর্তন পূর্ব ইলেকট্রনগুলোকে পরিবর্তন-পরবর্তী ইলেকট্রনের সঙ্গে অভিন্ন বলে চিহ্নিত করা যায় না। প্রতিটি হলো প্রত্যক্ষণীয় ঘটনার কেবল গ্রুপিং করার একটা পদ্ধতি। এবং এর সেই ধরনের বাস্তবতা’ নেই যেটা পরিবর্তনেও স্বরূপ সংরক্ষণে প্রয়োজন।

পদার্থ বর্জনের ফলাফল দেহের চেয়ে আত্মার ব্যাপারে অধিকতর গুরুতর হয়েছে। যাই হোক, এই গুরুতর অবস্থাটা ধীরে ধীরে বোঝা গেছে। এর কারণ বহু প্রাচীন মতবাদের জীর্ণ চেহারা এক সময় রক্ষণীয় মনে হয়েছিল। প্রথমে মন’ শব্দটাকে ‘আত্মা’ শব্দের বিকল্প ধরা হয়েছিল ধর্মতত্ত্বগত তাৎপর্য এড়ানোর জন্য। এর পরে ‘বিষয়’ শব্দটাকে বদল করা হয়েছিল এবং এই শব্দটা এখন চলছে। বিশেষ করে এই বিষয়’ শব্দটার প্রতিতুলনা করা হয়েছে বিষয়গত এবং ‘বিষয়গত’ শব্দ দুটোর সঙ্গে। এখানে তাহলে এই বিষয়’ শব্দটা নিয়ে কিছু বলতে হবে।

গতকাল যে-ব্যক্তি ছিলাম আজও আমি সেই ব্যক্তি, এ-কথাটার স্পষ্টতই ‘কিন্তু বোধ-শক্তি আছে। আরো স্পষ্ট উদাহরণে বলা যায়, আমি যদি একই সঙ্গে একজন ব্যক্তিকে দেখি এবং তাকে কথা বলতে শুনি, তাহলে কিছু ‘বোধশক্তি’ এখানে পেলাম যেখানে একই আমি দেখছি, সেই একই আমি শুনছি। এ-থেকে এই চিন্তা এল যে, যখন আমি কোনো কিছু ধারণা করি তখন আমার এবং বস্তুটির মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি, যে দেখছি, সেই হলো ‘বিষয়ী’ এবং যে জিনিসটা দেখছি সেটি হল ‘বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত এতে এটা দেখা গেল যে বিষয়’ সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না; বিষয়ী সর্বদা অন্য জিনিস দেখছে, কিন্তু নিজেকে দেখতে পারছে না। হিউম দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন যে, বিষয় বলে কিছু নেই, কিন্তু এটা কখনোই গ্রাহ্য হতে পারে না। যদি বিষয় না থাকে, তাহলে এটা কী অমর? এটা কী ছিল, যার স্বাধীন ইচ্ছা ছিল? এটা কী যা, পৃথিবীতে পাপ করে নরকে শাস্তি ভোগ করেছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি। হিউমের কোনো অভিপ্রায় ছিল না এর উত্তর পাবার। কিন্তু অন্যদের তাঁর মতো সাহসিকতার অভাব ছিল।

কান্ট হিউমের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইলেন। তিনি ভাবলেন যে, তিনি একটা পন্থা পেয়ে গেছেন যে-পন্থাটা এর দুর্বোধ্যতার কারণে অতি গভীর বলে বিবেচিত হয়েছিল। সংবেদনশীল ভাবে তিনি বললেন, বস্তু আমাদের উপর কাজ করে কিন্তু আমাদের প্রকৃতি আমাদের প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করে বস্তুগুলো আসলে যা, সেভাবে নয়, অন্যভাবে। এই অন্যভাবে প্রত্যক্ষ করাটা হলো আমরা যে-নানাবিধ ব্যক্তিগত সংযোজন তৈরি করি তার ফলাফল। এই সংযোজনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য হলো সময় এবং স্থান।

বস্তুর অন্তর্ধর্ম (things-in-themselves), কান্টের মতে, স্থান ও কালে (time andspce), নেই, যদিও আমাদের প্রকৃতি আমাদের প্রত্যক্ষ করায় যে, বস্তুগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। অহং (অথবা আত্মা) একটা বস্তুর অন্তধর্ম হিসাবে স্থান ও কালে নেই, যদিও প্রত্যক্ষ করণীয় ঘটনা হিসাবে এটা যেন স্থান ও কাল উভয়ের মধ্যেই রয়েছে। যেটা আমরা ইন্দ্রিয় চেতনায় প্রত্যক্ষ করছি সেটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ‘আত্মা’ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর মধ্যে একটা সম্পর্ক। কিন্তু এই দুটোর পিছনেই রয়েছে একটা প্রকৃত আত্মা এবং একটা প্রকৃত বস্তু, এই দুটোর কোনোটাকেই প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাহলে কেন ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, আত্মা ও বস্তু বাস্তবে রয়েছে? এর কারণ এগুলো ধর্ম ও নৈতিকতার জন্য প্রয়োজন। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা প্রকৃত আত্মার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না। আমরা জানি যে, আত্মার আছে একটা স্বাধীন ইচ্ছা, এটা পুণ্যশীল অথবা পাপযুক্ত হতে পারে (যদিও সময় নিরিখে নয়), এটা অমর এবং পৃথিবীতে ভালো মানুষদের দুঃখ-কষ্টের আপাত অবিচার স্বর্গে আনন্দের দ্বারা প্রতিবিধান করা হবে। এইসব কারণে কান্ট মনে করতেন, বিশুদ্ধ হেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না। তিনি ভাবতেন যে, এটা প্রমাণ করা সম্ভব বাস্তব কারণের জন্য, কারণ এটা ছিল একটা প্রয়োজনীয় পরিণতি যেটা আমরা নৈতিকতার ক্ষেত্রে সজ্ঞাজাত ভাবে জানতে পারি।

দর্শনের পক্ষে এই অর্ধপথে দীর্ঘ বিশ্রাম নেওয়াটা অসম্ভব ছিল। কান্টের মতবাদের সন্দেহপ্রবণ অংশটার স্থায়ী মূল্য প্রমাণিত হয়েছিল তাঁর সেই অংশ থেকে, যেখানে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে উদার করতে চেয়েছিলেন। শীঘ্রই এটা দেখা গেল যে, বস্তুর অন্তর্ধর্মের অস্তিত্ব ধরে নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। বস্তুর অন্তধর্মটা ছিল পুরানো বস্তু, যার অজ্ঞেয়তাকে সবিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। কান্টের তত্ত্বে ঘটনা যা প্রত্যক্ষ করা যায়, সেটা কেবলমাত্র আপাত এবং এর পিছনে বাস্তবতা হলো এমন কিছু যার সম্পর্কে আমাদের শুধু জানতে হবে এর নিছক অস্তিত্ব, যদিও এটা নৈতিকতার পূর্বশর্ত নয়। তাঁর উত্তরসূরীদের কাছে তাঁর চিন্তার পরিণতি দিয়েছেন হেগেল। এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ঘটনার রয়েছে আমাদের জ্ঞাত বাস্তবতা। এবং যা প্রত্যক্ষ করা যায় না তাকে উৎকৃষ্ট বাস্তবতার ছাপ দেবার প্রয়োজন নেই। তবে অবশ্যই এই ধরনের উৎকৃষ্ট বাস্তবতার ছাপ থাকতে পারে, কিন্তু এই ধরনের যুক্তির যে উৎকৃষ্ট বাস্তবতা থাকতেই হবে, এটা অকার্যকর। এবং সম্ভাবনা হলো অসংখ্য সম্ভাবনার মধ্যে এটি একটি যেটা এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ এটা জ্ঞাত বস্তুর পরিধির বাইরে এবং যা জ্ঞাত হওয়া যাবে তারও বাইরে। যা জানা যায় তার পরিধির মধ্যে পদার্থের কোনো ধারণার স্থান নেই অথবা বিষয় এবং বিষয়ীর ফর্মের রূপান্তরের জন্যও নেই। আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি এমন ঘটনাগুলোর এই ধরনের কোনো দ্বৈতবাদ নেই। এবং এরা বস্তু’ অথবা ব্যক্তিকে ঘটনার সমাহার ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কোনো কারণের কথা বলে না।

আত্মা ও দেহের সম্পর্ক বিবেচনায় পদার্থের ধারণাটাই কেবল আধুনিক দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানে অসুবিধাজনক ছিল না, কার্য-কারণ সম্পর্কেও সমান অসুবিধা ছিল।

‘কারণ’-এর ধারণাটা ধর্মতত্ত্বে জায়গা করে নিয়েছে প্রধানত ‘পাপ’-এর অনুষঙ্গে। পাপ ছিল ইচ্ছার নিদর্শন এবং ইচ্ছা হলো কার্যের কারণ। কিন্তু অমান্যতা সর্বদা পূর্ববর্তী কারণের ফলাফল হতে পারে না। যদি এমনটা হত, তাহলে আমরা আমাদের কার্যাবলীর জন্য দায়ী হতাম না। সুতরাং পাপের ধারণাকে রক্ষা করতে এটাও সমানভাবে প্রয়োজন যে ইচ্ছার কোনো কারণ থাকবে না (অন্তত কখনও কখনও) এবং এটাই একটা কারণ হবে। মানসিক ঘটনার বিশ্লেষণ এবং মন ও দেহের সম্পর্ক বিষয়ে এই বিবৃতি বহু সমস্যাকে আবশ্যিক করে তুলল। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে এর কতিপয় বিবৃতি রক্ষা করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে পড়ল।

প্রথম অসুবিধাটা দেখা দিল বলবিদ্যার বিধি আবিষ্কারের মাধ্যমে। সতরো শতকে এটা স্পষ্ট হলো যে, যেসব নিয়মগুলো পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণকে সত্য বলে দেখায় তারা পুরোপুরি পদার্থের সমস্ত ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণ করে। প্রাণী অথবা মানুষের ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম তৈরির সপক্ষে কোনো কারণ নেই। দেকার্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, প্রাণীরা হলো যন্ত্রবৎ ক্রিয়াশীল জীব কিন্তু তবুও তিনি ভাবলেন, মানুষের ক্ষেত্রে ইচ্ছা তার দৈহিক সচলতা ঘটাতে পারে। পদার্থবিদ্যা দ্রুত এটা দেখাল যে, তার আপোসকামিতা অসম্ভব। কান্টের অনুগামীরা এই ধারণা পরিত্যাগ করলেন যে, পদার্থের উপর মনের কোনো প্রভাব নেই। তারা তুলাদণ্ডটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এমনকি এটাও বললেন যে, বিপরীতক্রমে পদার্থেরও কোনো প্রভাব নেই মনের উপর। এই প্রয়াস দুটো সমান্তরাল তত্ত্বের দিকে ওঁদের নিয়ে গেল। এর একটি মানসিক; অন্যটি পদার্থগত। এই দুটোরই নিজস্ব নিয়ম আছে। যখন এক জন ব্যক্তির সঙ্গে আপনার দেখা হবে এবং তাঁকে এটা জিজ্ঞেস করতে আপনি স্থির করলেন, ‘আপনি কেমন আছেন, তখন আপনার সিদ্ধান্তটা হবে মানসিক ধারার। কিন্তু ঠোঁট, জিহ্বা এবং বাক্যন্ত্রের সচলতা যা এর ফলস্বরূপ সচল হলো, সেটা পুরোপুরি যান্ত্রিক কারণ। তাঁরা মন ও দেহকে দুটো ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন, যারা যথাযথ সময় রক্ষা করে। যখন একটা ঘড়ি এক ঘণ্টায় পৌঁছলো তখন দুটো ঘড়িই একসঙ্গে ঘণ্টা বাজায়, যদিও একটা ঘড়ির উপর অন্যটির কোনো প্রভাব নেই। আপনি যদি ঘড়ি দুটোর মধ্যে একটা ঘড়ি দেখতে পান, কিন্তু অন্য ঘড়িটির ঘণ্টাধ্বনিতে সেটাকে জানতে পারেন, তাহলে আপনি ভাববেন যে, যেটি আপনি দেখতে পান সেটিই ঘণ্টা-ধ্বনির কারণ।

এই তত্ত্বটা বিশ্বাস করা কষ্টকর ছিল। তাছাড়া এই তত্ত্বটা স্বাধীন ইচ্ছাকে রক্ষা করতে পারত না, এটা ছিল এর অন্য অসুবিধা। এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, দেহের অবস্থা এবং মনের অবস্থার মধ্যে একটা গোপন যোগাযোগ আছে। যখন এই যোগাযোগের একটা দিক জানা গেল তখন অন্য দিকটার তাত্ত্বিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। যে-ব্যক্তি এই যোগাযোগের নিয়মটা জানতেন এবং এইসাথে জানতেন পদার্থবিদ্যার নিয়মও, এতে তার যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকত। এ-কারণে তিনি মানসিক এবং দৈহিক সংঘটনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। যাই হোক, মানসিক ইচ্ছাশক্তি অকার্যকরী হত যদি না দৈহিক অভিব্যক্তি এর অনুবর্তী হত। পদার্থবিদ্যার নিয়ম সুনিশ্চিত করতে আপনি যখন অন্যকে বলবেন, আপনি কেমন আছেন’ তখন এটা হবে একটা দৈহিক কার্য। এই বিশ্বাস করাটা একটা ছোট্ট সান্ত্বনা হবে যে, আপনি এটা বলতেই ইচ্ছুক ছিলেন বিদায়। যদিও এটা পূর্বনির্দিষ্ট ছিল যে, আপনার বস্তুত উল্টোটাই বলা উচিত।

অতএব, এটা বিস্ময়কর নয় যে, আঠারো শতকের ফ্রান্স কার্টেীয় মতবাদ বিশুদ্ধ বস্তুবাদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছে, যে-বস্তুবাদে মানুষ সম্পূর্ণরূপে পদার্থবিদ্যার নিয়মে পরিচালিত। এই দর্শনে ইচ্ছার কোনো স্থান নেই এবং পাপের ধারণা অদৃশ্য। আত্মা’ বলে কিছু নেই। সুতরাং মানুষের দেহে যে-পৃথক পরমাণুসমূহ সাময়িকভাবে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়, সেটা একটা আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠল। এটা ঘটেছিল সন্ত্রাসের রাজত্বের পরে। প্রথমে এটা আতঙ্কিত করেছিল তাঁদের, যারা ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তারপর ১৮১৪ সালের পরে আতঙ্কিত করে সমুদয় ফ্রান্সবাসীদের, যারা সরকারকে সমর্থন করত। ব্রিটেন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে প্রত্যাবর্তন করল। জার্মানি কান্টের উত্তরসূরীদের ভাববাদী দর্শন গ্রহণ করল। এরপরে শুরু হলো রোমান্টিক আন্দোলন। এই আন্দোলন আবেগকে পছন্দের বিষয় হিসাবে বেছে নিল। এই রোমান্টিক আন্দোলন গাণিতিক ফমূলা দিয়ে মানবিক কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করাটা অপছন্দ করল। ইতোমধ্যে এল মানবীয় শারীরবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানে যারা বস্তুবাদ অপছন্দ করলেন, তারা হয় রহস্যবাদে অথবা ‘জৈবনিক শক্তিতে আশ্রয় নিলেন। কেউ কেউ বললেন যে, বিজ্ঞান কখনো মানব শরীরকে বুঝতে পারে না।

অন্যেরা ঘোষণা দিলেন যে, এটা পারা রসায়নশাস্ত্র এবং পদার্থবিদ্যার নীতি ব্যতীত অন্য মূলনীতি অনুসরণ করলে। জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে এই দুটে মতের কোনোটিরই এখন কোনো জনপ্রিয়তা নেই। পরের নীতিটার এখনও কতিপয় সমর্থক রয়েছে। ভূণতত্ত্ব, জীবরসায়ন এবং জৈবযৌগে অনেক কাজ হয়েছে। এতে এটা অধিকতর সম্ভাব্য যে, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার সংযোগে সজীব বস্তুর বৈশিষ্ট্যসমূহ পুরোপুরি ব্যাখ্যাযোগ্য। বিবর্তনতত্ত্ব অবশ্যই এটা ধরে নেওয়াটাকে অসম্ভব করে দিয়েছে যে, প্রাণীদেহের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নীতিসমূহ মানুষের দেহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

মনোবিদ্যা এবং ইচ্ছাতত্ত্বে ফেরা যাক। এটা সর্বদা স্পষ্ট ছিল যে, আমাদের ইচ্ছাশক্তির অনেক, সম্ভবত বেশির ভাগের কারণ ছিল। কিন্তু গোড়া ধর্মপন্থী দার্শনিকরা মনে করতেন যে, এইসব কারণসমূহ পার্থিব পৃথিবীতে অনুপস্থিত কারণসমূহের মতো, তাদের ফলসমূহকে অপরিহার্য করে তোলে না। সুতরাং তারা মনে করতেন যে, এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী আকাঙ্ক্ষাকেও ইচ্ছার কাজের দ্বারা প্রতিরোধ করা সর্বদাই সম্ভব। এইভাবে এটা ভাবনায় চলে এল যে, আমরা যখন উদ্দীপনা দ্বারা পরিচালিত হই তখন আমাদের কার্যাবলী স্বাধীন নয়। এটা স্বাধীন নয় এই জন্য যে, এদের কারণ বয়েছে কিন্তু একটা মানসিক ক্ষমতা আছে, কখনও সেটাকে ‘হেতু’ এবং কখনো ‘চেতনা’ বলা হয়। এই চেতনার নির্দেশনা আমরা যখন অনুসরণ করি এটা তখন আমাদের মুক্তি দেয়। এভাবে যথার্থ স্বাধীনতাকে মর্জির বিপরীতে নৈতিক নিয়মের প্রতি অনুগত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হেগেলপন্থীরা আরো একটু এগিয়ে গেলেন। এবং নৈতিক নিয়মকে রাষ্ট্রের নিয়ম হিসাবে চিহ্নিত করলেন, যাতে যথার্থ স্বাধীনতার অর্থ হয়ে দাঁড়ায় পুলিশকে মান্য করা। এই মতবাদটা সরকার খুবই পছন্দ করত।

‘ইচ্ছা’ কখনও কখনও ‘হেতুহীন’–এই তত্ত্বটা মেনে নেওয়া কঠিন। এটা বলা যায় না যে, সর্বশ্রেষ্ঠ ধার্মিক ব্যক্তিও উদ্দেশ্যহীনভাবে কাজ করেন। একজন ব্যক্তি ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে চাইতে পারেন, তার নিজের কিংবা তার প্রতিবেশীর অনুমোদন চাইতে পারেন কিংবা অন্যের কষ্ট লাঘব করতে আগ্রহী হতে পারেন। এসবের যে-কোনো একটি অভিলাষ একটা মহৎ কাজের ‘হেতু’ হতে পারে। কিন্তু একজন ব্যক্তির মধ্যে যদি কিছু মহৎ অভিলাষ না থাকে তাহলে নৈতিক নিয়ম অনুমোদিত হলেও তিনি কাজ করবেন না। আমরা অতীতে যতটা জানতাম, এখন তার চেয়ে অভিলাষের কারণসমূহ বেশি জানি। নালিবিহীন গ্রন্থীর কার্যাবলীতে দেখা যায়, কখনও প্রাথমিক শিক্ষায়, কখনও বিস্মৃত অভিজ্ঞতায়, কখনও অভিলাষের অনুমোদনে এই ‘হেতু দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, নানাবিধ উৎসের সংখ্যা একটা অভিলাষের কার্যকারণে দেখা যায়। এটা পরিষ্কার যে, আমরা যখন একটা সিদ্ধান্ত নেই, আমরা এটা করি কতিপয় অভিলাষের ফলস্বরূপ। যদিও একই সময়ে অন্যান্য অভিলাষও আমাদের বিপরীত দিকে টানতে চায়। এসব ক্ষেত্রে, যেমনটা হস্ বলেছেন, ইচ্ছা বা অভিলাষ হলো তর্কবিতর্কের অন্তিম ক্ষুধা। পুরোপুরি হেতুবিহীন ইচ্ছার একটা কাজের ধারণাকে সমর্থনযোগ্য নয়। নৈতিকতার ক্ষেত্রে এর ফলাফল নিয়ে পরের এক অধ্যায়ে আলোচনা করব।

মনোবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যা যতটা বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছে, উভয়ের ঐতিহ্যগত ধারণাসমূহ ততই ক্রমবর্ধমানভাবে নতুন ধারণার কাছে আত্মসমর্পন করেছে। বলা বাহুল্য, এই নতুন ধারণা বৃহত্তর অভ্রান্ততা দিতে পারে। পদার্থবিদ্যা খুব সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ‘পদার্থ’ ও ‘গতি’ নিয়েই তুষ্ট থাকত। পদার্থকে দার্শনিক মুহূর্তে প্রকরণগতভাবে মধ্যযুগীয় ধারণার বস্তু বলেই ধরা হতো। পদার্থ ও গতিকে এখন, এমনকি প্রকরণগত ভাবেও অপর্যাপ্ত বলে ভাবা হয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক দর্শনের দাবি-পরিধির মধ্যে অনেকটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মনোবিদ্যা, ঠিক এভাবেই এটা প্রয়োজনীয় মনে করছেন, এই ধরনের প্রত্যক্ষকরণ এবং চেতনাকে পরিত্যাগ করতে। এর কারণ এটা দেখা গেছে যে, এগুলো যথাযথতার ক্ষেত্রে অক্ষম। এই বিষয়টা পরিষ্কার করতে এই দুটোর প্রত্যেকটি নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। প্রথম পরিচয়ে প্রত্যক্ষকরণ যথার্থভাবে সহজবোধ্য। আমরা প্রত্যক্ষ করি’ সূর্য এবং চন্দ্র, কথিত শব্দে আমরা শুনি, স্পর্শ-করা কোনো বস্তুর কাঠিন্য অথবা কোমলতা অনুভব করি, একটা পচা ডিমের গন্ধ পাই, অথবা সর্ষের স্বাদ পেয়ে থাকি। যে-সব ঘটনার এই ধরনের বর্ণনা দেই, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। কেবলমাত্র বর্ণনা’কে প্রশ্ন করা যায়। আমরা সূর্যকে প্রত্যক্ষ করি, তখন একটা দীর্ঘ কার্য-কারণ পদ্ধতি থাকে। প্রথমত, তিরানব্বই মিলিয়ন মাইল মধ্যবর্তী শূন্যতা, তারপর চোখের অভ্যন্তর, অপটিক নার্ভ এবং মস্তিষ্ক। শেষ পর্যন্ত মানসিক ঘটনা যাকে আমরা সূর্যকে দেখা’ বলি, তার সঙ্গে সূর্যের সাদৃশ্য আছে বলে ধরে নেওয়া যাবে না। সূর্য, কান্টের ‘বস্তুটির অন্তর্ধর্ম’-এর (thing-in itself) ধারণার মতো আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে থাকে, এবং কেবলমাত্র জানতে হয় যে, যদি আদৌ জানা সম্ভব হয়, একটি কঠিন অভিজ্ঞতাপ্রসূত সিদ্ধান্ত থেকে, যেটাকে আমরা সূর্যকে দেখা বলি। আমরা ধরে নেই যে, অভিজ্ঞতার বাইরে সূর্যের একটা অস্তিত্ব রয়েছে। কারণ অনেক মানুষ এটা তৎক্ষণাৎ দেখে থাকেন। সমস্ত ধরনের বস্তু, যেমন চাঁদের আলো, এগুলোকে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয় এটা ধরে নিয়ে যে, যেখানে সূর্যকে দেখা যায় না সেখানেও সূর্যের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই সূর্যকে দেখা এবং সহজ ধারণায় প্রত্যক্ষ করি না, যেভাবে মনে হয় আমরা এটা করি সংবেদনের বিশেষ ভৌত কার্য-কারণ বোঝার আগেই।

একটা ঢিলেঢালা ধারণায় আমরা বলতে পারি যে, আমরা একটা বস্তু প্রত্যক্ষ করি যখন আমাদের কাছে কিছু একটা ঘটে, যেটার ক্ষেত্রে ওই বস্তুটিই প্রধান কারণ। ওটি সেই প্রকৃতির যা আমাদের অনুমতি দেয় ওটিকে বস্তু বলে সিদ্ধান্ত করার। আমরা যখন কোনো ব্যক্তিকে কথা বলতে শুনি, আমরা যা শুনি তার পার্থক্যটা তিনি যা বলেন তার পার্থক্যের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এই দুইয়ের মাঝখানে ঘটা মাধ্যমের ফল মোটামুটি স্থির। এই কারণে কম-বেশি এটাকে এড়িয়ে যাওয়া চলে। অনুরূপভাবে আমরা যখন এক টুকরো লাল এবং এক টুকরো নীল পাশাপাশি দেখি, তখন আমাদের অধিকার থাকে এটা ধরে নেওয়া যে, কিছুটা তফাৎ থাকে দুটো স্থানের মধ্যে, যেখান থেকে লাল এবং নীলের সংবেদনের মধ্যে পার্থক্য ঘটানোর। এভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করার চেষ্টাকে রক্ষা করতে পারি। কিন্তু আমরা কখনোই একে যথার্থতা প্রদান করতে পারি না। বাধা-সৃষ্টিকারী মাধ্যমের সবসময়ই কিন্তু বিকৃতির ফলাফল থাকে। লাল স্থানটিকে লাল মনে হয় কারণ বাধা-সৃষ্টিকারী কুয়াশা। নীল স্থানটিকে নীল দেখায়। কারণ আমরা রঙিন চশমা পরিধান করেছি। যে-ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বস্তুটির সম্পর্কে অবধারণা করি, সেটাকে আমরা স্বাভাবিকভাবে প্রত্যক্ষ করা বলি। এটা করার জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা এবং শারীরবিদ্যার ইন্দ্রিয় যন্ত্রের ধারণা থাকতে হবে। এইসঙ্গে আমাদের এবং বস্তুর মধ্যে বাধা-সৃষ্টিকারী শূন্যতার মধ্যে কী আছে, সে-সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকতে হবে। সমস্ত তথ্য পেলে এবং বাহ্যিক পৃথিবীর বাস্তবতার ধারণা নিয়ে আমরা কতিপয় উন্নত ধরনের বিমূর্ত তথ্য পেতে পারি ‘প্রত্যক্ষ করা’ বস্তু সম্পর্কে। কিন্তু সমুদয় উষ্ণতা আর তাৎক্ষণিকতা যা প্রত্যক্ষ করা’ শব্দটার মধ্যে নিহিত রয়েছে সেসব কঠিন গাণিতিক ফর্মুলার সাহায্যে এই সিদ্ধান্তের পদ্ধতির মধ্যেই হারিয়ে যাবে। সূর্যের মতো দূরবর্তী বস্তুর ক্ষেত্রে এটা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু আমরা যা স্পর্শ করি, যার ঘ্রাণ গ্রহণ করি, সেসবের ক্ষেত্রে এটা সমান সত্য। কারণ এইসব বস্তু আমাদের প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হচ্ছে আমাদের স্নায়ু এবং মস্তিষ্কের মধ্যে চলমান বিশদ প্রক্রিয়ার কারণে।

‘চেতনা’র প্রশ্নটা সম্ভবত আরও বেশি দুরূহ। আমরা বলি যে, আমরা সচেতন। কিন্তু ‘লাঠি’ এবং ‘পাথর’ তা নয়। আমরা যখন জেগে থাকি তখনই বলতে পারি যে, আমরা সচেতন। ঘুমোনোর সময় এটা বলতে পারি না। আমরা যখন এমনটা বলি তখন আমরা নিশ্চয়ই কিছু একটা বোঝাতে চাই। এবং আমরা, এমন কিছু বোঝাতে চাই যা সত্য। কিন্তু যথার্থতার সঙ্গে ব্যক্ত করা যে, এটাই সত্য, এটা কিন্তু একটি কঠিন বিষয়। এটা বলতে ভাষার পরিবর্তন দরকার হয়।

আমরা সচেতন। এই কথাটা বলতে আমরা দুটো জিনিস বোঝাতে চাই। একাধারে, আমরা আমাদের পরিবেশের প্রতি একভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই। পক্ষান্তরে, ভেতরের দিকে তাকিয়ে আমরা সম্ভবত খুঁজি, আমাদের চিন্তা ও অনুভূতিতে কতিপয় গুণ, যেগুলো আমরা অজৈব বস্তুতে খুঁজে পাই না।

পরিবেশের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বলা যায়, এটা হলো কোনোকিছু সম্পর্কে সচেতন হওয়া। যদি আপনি চিৎকার করে বলেন, হাই’ তখন মানুষ চারদিকে তাকিয়ে দেখে, কিন্তু পাথর এমনটা করে না। আপনি জানেন যে, এই ধরনের একটা বিষয়ে আপনি যখন নিজেই চারদিকে দেখেন। এর কারণ আপনি একটা শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যতক্ষণ এটা ধরে নেওয়া। যাবে যে, একজন বাইরের পৃথিবীতে বস্তু নিয়ে প্রত্যক্ষ করেন। তাহলে একজন একথা বলতে পারেন যে, উনি বস্তুনিচয় সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এখন আমরা কেবলমাত্র এটাই বলতে পারি যে, আমরা উদ্দীপনায় সাড়া দেই। পাথরও তাই করে, যদিও যে-উদ্দীপনায় তারা সাড়া দেয় তা সংখ্যায় অত্যল্প। অতএব, বাহ্যিক প্রত্যক্ষকরণ যতটা সংশ্লিষ্ট, একটা পাথর এবং আমাদের মধ্যে পার্থক্য হলো কেবল মাত্রাগত।

‘চেতনা’র ধারণার অধিকতর গুরুত্বের অংশটা, যেটা আমরা অন্তর্দর্শনের সাহায্যে আবিষ্কার করি, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমরা কেবলমাত্র বাহ্যিক বস্তুর প্রতি প্রতিক্রিয়া করি না, কিন্তু আমরা জানি যে, আমরা প্রতিক্রয়া করছি। পাথর, আমরা ভাবি, জানে না কখন এটা প্রতিক্রিয়া করে। যদি পাথর এটা জানত তাহলে বলা যেত যে, পাথরেরও চেতনা আছে। এখানেও, বিশ্লেষণ করে যে পার্থক্য বোঝা যাবে সেটাও মাত্রাগত। আমরা কিছু দেখি, এটা জানা সত্যি সত্যি কোনো কিছু নতুন জ্ঞানের অংশ নয়। সর্বোপরি, দেখাটা যদি না একটা স্মৃতিশক্তি না হয়ে ওঠে। আমরা যদি প্রথমে কিছু একটা দেখি, এবং তারপর, ঠিক পরমুহূর্তেই, ভাবি যে, আমরা এটা দেখছি, এই ভাবনাচিন্তা যেটা অন্তর্দর্শনমূলক, এটাই স্মৃতিশক্তি। এটা বলা যেতে পারে যে, স্মৃতিশক্তি কিছুটা বৈশিষ্ট্যমূলক ভাবে মানসিক। কিন্তু এটাও পুনরায় অস্বীকার করা যায়। স্মৃতিশক্তি হলো অভ্যাসের একটা রূপ। এবং অভ্যাস হলো স্নায়ুকলার বৈশিষ্ট্যমূলক। এটা অন্যত্রও ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কাগজের একটা রোল-কাগজ পুনরায় নিজে থেকেই রোল হয়ে যাবে যদি এই কাগজ আগে গোটানো অবস্থায় থাকে। আমি এটা বলছি না যে, আমরা ভাসাভাসাভাবে যাকে ‘চেতনা’ বলছি, সেটার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা এখানে দিলাম। প্রশ্নটা ব্যাপক এবং এটার আলোচনায় মহাভারত হয়ে যাবে। আমি কেবল এটুকুই বলতে চাইছি যে, যেটা প্রথম দর্শনে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা বলে মনে হয়, সেটা সত্যি সত্যি এমন ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক মনোবিদদের পৃথক পরিভাষা-বিজ্ঞান দরকার। পরিশেষে, এটাই বলতে হবে যে, আত্মা ও দেহের পুরানো পার্থক্য অনেকখানি উবে গেছে। এর ‘কারণ’ ‘পদার্থ’ তার পুরানো কঠিন অবস্থা হারিয়েছে, কারণ ‘মন’ হারিয়েছে এর আধ্যাত্মিকতা। এখনও, কখনও কখনও ভাবা হয় এবং এটা বিশ্বজনীন ভাবেই ভাবা হয় যে, পদার্থবিদ্যার তথ্য সর্বজনবিদিত। এটা এই অর্থে যে, পদার্থ যে কোনো ব্যক্তির কাছে দৃশ্যমান। কিন্তু মনোবিদ্যার তথ্য ব্যক্তিগত কারণ, এটা অন্তর্দর্শনে পেতে হয়। যাই হোক, এই পার্থক্যটা মাত্রাগত। দু’জন ব্যক্তি হুবহু একই বস্তু একই সময়ে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। কারণ তাদের দর্শনগত পার্থক্যটা তারা যা দেখে তার মধ্যে তফাৎ তৈরি করে দেয়। পদার্থবিদ্যার তথ্য যখন নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা হয় তখন দেখা যায় যে, মনোবিদ্যার মতো একই ধরনের গোপনীয়তা রয়েছে। এবং এই ধরনের অর্ধ-প্রসিদ্ধি যা তারা লাভ করে সেটা মনোবিদ্যার ক্ষেত্রেও পাওয়া অসম্ভব নয়।

দুটো বিজ্ঞানের সূচনা যে-ঘটনা দিয়ে তা অন্তত অংশত অভিন্ন। রঙের যে ছোপ আমরা দেখি সেটা সমানভাবে পদার্থবিদ্যা এবং মনোবিদ্যার তথ্য। পদার্থবিদ্যা এক ধরনের প্রকরণ নিয়ে এক প্রকার সিদ্ধান্তের দিকে এগোয়। মনোবিদ্যা অন্য ধরনের প্রকরণ নিয়ে ভিন্নতর সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চায়। কেউ হয়ত বলবেন, এমনভাবে এগোনোটা খুবই অপরিণত। কারণ পদার্থবিদ্যা মস্তিষ্কের বাইরে কার্যকারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট । এবং মনোবিদ্যা মস্তিষ্কের ভেতরের কার্যকারণে সংশ্লিষ্ট। এবং মনোবিদ্যা মস্তিষ্কের ভেতরের কার্যকারণে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, মনোবিদরা মস্তিষ্কের বাহ্যিক অনুসন্ধানে যা আবিষ্কার করেছেন তা বাতিল করতে হবে। পদার্থবিদ্যা এবং মনোবিদ্যা দুটোরই তথ্য হলো ঘটনা, যা কতিপয় ধারণায় মস্তিষ্কে ঘটে চলে। এদের বাহ্যিক কারণের একটা শৃঙ্খল রয়েছে। এই শৃঙ্খলটাই পদার্থবিদ্যা অনুসন্ধান করে এবং আভ্যন্তরীণ ফলাফলের একটা শৃঙ্খল স্মৃতি, অভ্যাস প্রভৃতির অনুসন্ধান করে মনোবিদ্যা। কিন্তু ভৌত এবং মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্যের কোনো সাক্ষ্য নেই। আগে যা ভাবা হয়েছিল যে, আমরা উভয় ব্যাপারেই কম জানি এটা নিয়ে সুনিশ্চিত হতে এটাও আমরা যথেষ্টই জানি যে, আত্মা’ এবং ‘দেহ’-এর কোনোটাই আধুনিক বিজ্ঞানে স্থান পেতে পারে না । অমরত্বে গোঁড়া ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে। তবে এটা এখনও অনুসন্ধানের বিষয় যে, শারীর-বিদ্যা এবং মননস্তত্ত্বের আধুনিক মতবাদ এই বিশ্বাসের বিশ্বাসযোগ্যতার সম্পকে কতখানি প্রাসঙ্গিক।

দেহের মৃত্যুর পর আত্মা বেঁচে থাকে, এই মতবাদটা যেটা এখনও আমরা দেখছি, খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টান, সভ্য এবং অসভ্য মানুষেরা ব্যাপকভাবে মেনে নিয়েছে। খ্রিস্টের সময়ে ইহুদিদের মধ্যে Pharisees(১)- রা অমরত্বে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু Saducees(২)-রা, যারা প্রাচীন ঐতিহ্যে দৃঢ় ছিলেন তারা এটাতে বিশ্বাস করতেন না। খ্রিস্টধর্মে শাশ্বত জীবনে বিশ্বাস সর্বদাই একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসে কেউ কেউ স্বর্গে পরম সুখ উপভোগ করে। এই সুখ উপভোগ করার জন্য নরকে একটা সময় ধরে শুদ্ধিকরণের কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অন্যেরা নরকে অন্তহীন যন্ত্রণা ভোগ করে। আধুনিক সময়ে উদার খ্রিস্টানেরা প্রায়ই এই মতে বিশ্বাসী যে, নরক চিরন্তন নয়। ১৮৬৪ সালে প্রিভি কাউন্সিলের সময় থেকে ইংল্যান্ডের বহু ধর্মযাজক এই ধারণাটাই পোষণ করে আসছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এমন বিশ্বাস তাদের পক্ষে বেআইনি নয়। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত খুব কম খ্রিস্টানই চিরন্তন শাস্তির বাস্তবতায় সন্দেহ পোষণ একটা উৎস যেটা বেঁচে থাকার বিশ্বাসের সুখ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদের নরক থেকে বাঁচাবার মনোবৃত্তি নিগ্রহের ন্যায্যতাকে প্রতিপাদন করতে চেয়েছিল। এর কারণ যদি একজন ধর্মদ্বেষী অন্যদের বিপথগামী করে তাদের নরকভোগ করাতে পারে, পার্থিব অত্যাচারের কোনো মাত্রাই অতিরিক্ত বলে মনে হবে না যদি এই ভয়াবহ ফলাফল নিবারণ করতে নিয়োজিত করা যায়। এখন যাই ভাবা হোক, আগে এটাই বিশ্বাস করা হত, কিছু সংখ্যালঘু মানুষ ছাড়া, বিধর্মিতা মুক্তির সঙ্গে বিসদৃশ। নরক-বিশ্বাস হ্রাসের কারণ কোনো নতুন ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তিধারা নয়, বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাবও নয়, এর কারণ হলো নিষ্ঠুরতার কমতি যা আঠারো এবং উনিশ শতকে ঘটে গিয়েছিল।

এটা একই আন্দোলনের অংশ যেটা ফরাসি বিপ্লবের কিছু আগে পরিচালিত হয়েছে অনেক দেশের বিচার বিভাগীয় অত্যাচারের বিলুপ্তি সাধনে। এটাই আবার উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের আদিম দণ্ডবিধির (Penal Code) সংস্কার সাধনে পরিচালিত হয়েছিল। এই দণ্ডবিধি একসময় ইংল্যান্ডকে কলঙ্কিত করেছিল। বর্তমান সময়ে যারা নরকে বিশ্বাস করেন, নরকের পীড়নে ভোগান্তির জন্য দণ্ডিত, এদের সংখ্যা আগের তুলনায় খুবই কম। আমাদের হিংস্রতার উদ্দীপনা ধর্মতত্ত্বীয় নয়, এটা এখন রাজনৈতিক অভিমুখ গ্রহণ করেছে।

এটা একটা কৌতূহল-জাগানো ঘটনা যে, নরকে বিশ্বাসটা যতটা কম নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, স্বর্গে বিশ্বাসও ততটাই স্পষ্টতা হারিয়েছে। স্বর্গ এখনও খ্রিস্টান গোড়া ধর্মবিশ্বাসের একটি স্বীকৃত অঙ্গ, তবুও আধুনিক আলোচনায় বির্বতনের ঐশ্বরিক সাক্ষ্যের তুলনায় এটা নিয়ে কমই বলা হয়। ধর্মের সপক্ষে যুক্তিধারা এখন পরকালের জীবনের সঙ্গে এর যোগাযোগের চেয়ে বেশি আলোচনা করে এই পৃথিবীতে মানুষের সুখী জীবন সম্পর্কে। পার্থিব জীবন কেবলমাত্র অন্য এক জীবনের প্রস্তুতি, এই বিশ্বাস আগে নৈতিকতা ও আচরণকে প্রভাবিত করত। এখন কিন্তু এই বিশ্বাসটা যারা সচেতনভাবে পরিত্যাগ করেনি, তাদের উপরও বেশি প্রভাব বিস্তারে অক্ষম।

অমরত্ব নিয়ে বিজ্ঞানের কী বলার আছে সেটা এখনও খুব নির্দিষ্ট নয়। মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার সপক্ষে বস্তুত এক ধরনের যুক্তি রয়েছে, যেটা অন্তত অভিপ্রায়ে, পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক। আমি যুক্তির সেই দিকটা নিয়ে বলছি, যেটা ভৌতবিজ্ঞানের গবেষণা-পরীক্ষিত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই বিষয়টা নিয়ে আমার যথেষ্ট জ্ঞান নেই যা দিয়ে আমি ইতোমধ্যে লভ্য সাক্ষ্য বিচার করে দেখাতে পারি । কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় যে, যুক্তিবাদী মানুষকে বোঝাবার মতো সাক্ষ্য থাকতেই পারে। যাই হোক, এর সঙ্গে কতিপয় শর্ত জুড়ে দিতেই হবে। প্রথমত, সাক্ষ্য কেবল বড়জোর প্রমাণ করে যে, আমরা মৃত্যুর পর অস্তিত্বশীল থাকি, যদিও চিরকাল আমরা বেঁচে থাকি না। দ্বিতীয়ত, যেখানে জোরালো ইচ্ছার ব্যাপারটা থাকে সেখানে মজ্জাগতভাবে যথার্থ ব্যক্তির প্রমাণ গ্রহণ করা খুবই কঠিন। এ নিয়ে যুদ্ধের সময় এবং প্রবল উত্তেজনার সময় অনেক সাক্ষ্য ছিল। তৃতীয়, অন্য কারণে এটা অসম্ভবও মনে হয় যে, আমাদের ব্যক্তিত্ব দেহের সঙ্গে মরে যায় না। আমাদের পেতে হবে অনেক বেশি শক্তিশালী সাক্ষ্য, যদি আমরা চিন্তা করি প্রকল্পটা পূর্ববর্তী ঘটনাক্রমে সম্ভব। এমনকি আধ্যাত্মিকতায় উৎসাহী বিশ্বাসীও এমন ভান করতে পারবেন না যে, মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার অনেক সাক্ষ্য তার রয়েছে। যেভাবে ইতিহাসবিদগণ প্রমাণস্বরূপ হাজির করতে পারেন যে, ডাইনিরা শারীরিকভাবেই শয়তানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। তবুও এখন কিন্তু প্রায় কেউই এইসব ঘটনার সাক্ষ্য পরীক্ষার যোগ্য বলে মনে করেন না।

এইঘটনা থেকে বিজ্ঞানের অসুবিধাটা উঠে আসে যে, আত্মা অথবা আত্ম (self), এসবের কোনো সত্ত্বা নেই। যেমনটা আমরা দেখেছি যে, এখন আর আত্মা এবং দেহকে দুটো বস্তু হিসাবে বিবেচনা করা সম্ভব নয়। অথচ এটাই সময়ের সহনশীলতার মধ্য দিয়ে অধিবিদ্যাবিদগণ বিবেচনা করতেন যে, বস্তুর ধারণার সঙ্গে এটা যৌক্তিকভাবে সংবদ্ধ। মনোবিদ্যাতেও এটা ধরে নেবার কোনো কারণ নেই যে, বিষয়ী’কে প্রত্যক্ষকরণে ‘বিষয়’-এর সংস্পর্শে আনা যায়। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এটাই ভাবা হত যে, পদার্থ হলো অমর, কিন্তু এটা এখন আর পদার্থবিদ্যার প্রকরণে ধরে নেওয়া হয় না। একটা পরমাণু এখন কেবল কতিপয় ঘটনাকে দলভুক্ত করার একটি সুবিধাজনক পন্থা। একটা পরমাণু অনুষঙ্গী ইলেকট্রন নিয়ে একটা নিউক্লিয়াস, একটা মাত্রা পর্যন্ত এভাবে ভাবা সুবিধাজনক। কিন্তু এক সময়ের ইলেকট্রনকে অন্য সময়ের ইলেকট্রনের সঙ্গে সনাক্ত করা যায় না। একজন আধুনিক পদার্থবিদ কোনো ক্রমেই এদের বাস্তব’ বলে ভাবেন না। যখন জাগতিক বস্তুকে চিরন্তন বলে ভাবা হয়েছিল, তখন এটা যুক্তি দিয়ে বোঝানো সহজ ছিল যে, মনটাও অবশ্যই সমানভাবে চিরন্তন। কিন্তু এই যুক্তি, যেটা কখনোই শক্তিশালী ছিল না যে, মনটাও অবশ্যই সমানভাবে চিরন্তন। কিন্তু এই যুক্তি, যেটা কখনোই শক্তিশালী ছিল না, এটাকে এখন আর ব্যবহার করা যাবে না। যথেষ্ট কারণ থাকাতে পদার্থবিদগণ পরমাণুকে ঘটনার পরম্পরায় পরিণত করেছেন। একই রকম ভালো যুক্তির কারণে মনোবিদরা দেখছেন যে, একটা মনের একটা একক চলমান বস্তুর পরিচিতি নেই, কিন্তু এটা কতিপয় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বাধা ঘটনার পরম্পরা। অতএব, অমরত্বের প্রশ্নটা এমন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলো একটা জীবন্ত দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাসমূহ এবং অন্যান্য ঘটনাসমূহ যেগুলো ঘটে দেহের মৃত্যুর পর এ দুয়ের মধ্যে বর্তমান থাকে কিনা।

এই প্রশ্নটার উত্তর দেবার আগে, আমাদের প্রথমে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সম্পর্কগুলো কী, যা কতিপয় ঘটনাকে একসঙ্গে বেঁধে ফেলে এমনভাবে যে, সেগুলো একজন ব্যক্তির মানসিক জীবন গঠন করে। স্পষ্টতই, এসব স্মৃতিশক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো : আমি যে-জিনিসগুলো স্মরণ করতে পারি, তাই আমার কাছে ঘটেছিল। এবং আমি যদি একটা নির্দিষ্ট ঘটনা স্মরণ করতে পারি, এবং ওই ঘটনায় আমি যদি অন্য কিছু স্মরণ করতে পারতাম, তাহলে অন্য কিছুও আমার ঘটতে পারত। এটা অবশ্যই আপত্তির যে, দু’জন ব্যক্তি একই ঘটনা স্মরণ করতে পারে, কিন্তু সেটা একটা ভুল হবে। কোনো দু’জন ব্যক্তি কখনো যথার্থ একই জিনিস দেখতে পায় না, কারণ এটা ঘটে তাদের অবস্থানের ভিন্নতার জন্য। কখনই তাদের শোনার অথবা ঘ্রাণ নেবার অথবা স্পর্শ করার অথবা স্বাদ নেবার একই অভিজ্ঞতা হতে পারে না। আমার অভিজ্ঞতা অন্য এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য থাকতে পারে। কিন্তু সর্বদা ওই ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার বেশি কিংবা কম পার্থক্য হবেই। প্রতিটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা কেবল তারই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যখন একটা অভিজ্ঞতা অন্য একটি অভিজ্ঞতাকে স্মরণে আনতে চায়, এই দুটোকে তখন একই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বলে ধরা হয়।

অন্য একটি, কম মনস্তাত্ত্বিক, সংজ্ঞা আছে ব্যক্তিত্বের। ব্যক্তিত্ব এটা লাভ করেছে দেহ থেকে। বিভিন্ন সময়ে একটা জীবন্ত দেহের পরিচিতির সংজ্ঞা জটিল হবে। কিন্তু এই মুহূর্তের জন্য আমরা এটা সুনিশ্চিতভাবে গ্রহণ করব। আমরা এটাও সুনিশ্চিতভাবে গ্রহণ করব যে, আমাদের পরিচিত প্রতিটি মানসিক অভিজ্ঞতা কোনো জীবন্ত দেহের সঙ্গে যুক্ত। আমরা তাহলে একজন ব্যক্তিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি যে, ব্যক্তি হলো দেহের সঙ্গে সংযুক্ত মানসিক ঘটনাবলীর ক্রম। এটা হলো আইনি সংজ্ঞা। যদি জন্ স্মিথের দেহ একটা খুন সংঘটিত করে, এবং পরে এক সময় পুলিশ জন্ স্মিথের দেহটাকে গ্রেপ্তার করে, তাহলে দেহের মধ্যে বাস-করা ব্যক্তি গ্রেপ্তারের সময় একজন খুনি।

একজন ব্যক্তিকে এই দু’ভাবে সংজ্ঞায়িত করাটা বিরোধ তৈরি করে সেই ক্ষেত্রে যাকে বলা হয় দ্বৈত ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের ঘটনায়, বাহ্যিক নিরীক্ষণে একজন ব্যক্তি বিষয়ীগত ভাবে দু’জন ব্যক্তিতে বিভক্ত হয়। কখনও কখনও একজন অন্যজন সম্পর্কে কিছুই জানে না। আবার কখনও কখনও একজন অন্যজনকে জানে। কিন্তু উল্টোটা কখনই নয়। এমন ঘটনায় যেখানে কেউ-ই অন্যজন সম্পর্কে কিছুই জানে না, সেখানে এরা দু’জন ব্যক্তি, যদি স্মৃতিকে সংজ্ঞা হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু দেহকে ধরলে এখানে একজনই ব্যক্তি। অন্যমনস্কতা, সম্মোহন এবং স্বপ্নচারিতা প্রকৃতির মাধ্যমে দ্বৈত ব্যক্তিত্বের (চরম মাত্রার) ধাপ রয়েছে। ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা দেবার ব্যাপারে স্মৃতিশক্তিকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব বিষয়গুলো অসুবিধা সৃষ্টি করে। কিন্তু এটা দেখা যায় যে, হারানো স্মৃতি সম্মোহনে পুনরুদ্ধার করা যায়। অথবা এটা করা সম্ভব মনোবিশ্লষণেও। সম্ভবত অসুবিধাটা অলঙ্ঘনীয় নয়।

যথার্থ স্মরণক্ষমতার সঙ্গে অন্যান্য আরও উপাদান, কম-বেশি স্মৃতিশক্তির সাদৃশ্যে, ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রবেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, অভ্যাস, যেটা অতীতের অভিজ্ঞতার ফল স্বরূপ গঠিত হয়েছে। এর কারণ হলো, যেখানে জীবন সেখানে ঘটনাবলী অভ্যাস তৈরি করতে পারে, একটা অভিজ্ঞতা একটা ঘটনার থেকে পৃথক হয়। একটা প্রাণী, আরও বেশি বলা যায়, একজন মানুষ, এভাবে অভিজ্ঞতার দ্বারা গঠিত। কিন্তু মৃত প্রাণী এভাবে গঠিত হয় না। যদি একটা ঘটনা আকস্মিকভাবে আর একটি ঘটনার সঙ্গে ওই বিশেষভাবে সম্পর্কিত হয়, ওই অদ্ভুতভাবে সেটা অভ্যাস গঠনে করতে হয়, তাহলে দুটো ঘটনাই একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেবলমাত্র স্মৃতিশক্তির সংজ্ঞার চাইতে এটি একটি ব্যাপকতর সংজ্ঞা। এর মধ্যে স্মৃতিশক্তির সংজ্ঞার সবকিছুই থাকছে। এবং থাকছে আরও অনেক কিছু।

দেহের মৃত্যুর পরেও যদি একটি ব্যক্তিত্বের বেঁচে থাকার ঘটনায় বিশ্বাস রাখি, তাহলে আমাদের অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, স্মৃতিশক্তির ধারাবাহিকতা রয়েছে অথবা অন্তত অভ্যাসের। এর কারণ, অন্যথায় এটা ধরে নেবার কোন যুক্তি থাকে না যে, একই ব্যক্তি চলমান থাকছে। কিন্তু এই ব্যাপারে শারীরতত্ত্ববিদ্যা অসুবিধা সৃষ্টি করছে। অভ্যাস এবং স্মৃতি দুটোই দেহের ওপর প্রভাবের কারণে অভ্যাসের গঠনটাকে ছোট নদীর সাদৃশ্যে ভাবা যেতে পারে। এখন দেহের উপর প্রভাব যেটা অভ্যাস এবং স্মৃতিকে সৃষ্টি করে, সেগুলো মৃত্যু এবং অবক্ষয় দ্বারা বিলুপ্ত হয়। এবং এটা বোঝা অসুবিধাজনক যে কীভাবে, রহস্যময়তায়, এরা নতুন দেহে স্থানান্তরিত হতে পারে যাতে ধরে নিতে হয় যে, পরবর্তী জীবনে বাস করা হচ্ছে। যদি আমাদের আত্মাকে অশরীরী করতে হয়, তাহলে শুধু অসুবিধাই বেড়ে যায়। বাস্তবিক, আমি সংশয় প্রকাশ করছি, পদার্থের আধুনিক ধারণা নিয়ে অশরীরী আত্মা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সম্ভব কিনা। পদার্থ হলো ঘটনাবলীতে দলবদ্ধতার একটা সুনিশ্চিত পথ। এই কারণে যেখানে ঘটনা থাকে, সেখানে পাদার্থও থাকে। যেমনটা আমি মনে করি যে, যদি একজন দেহধারী ব্যক্তির গোটা জীবনব্যাপী চলমানতা অভ্যাস গঠনের উপর নির্ভর করে, তাহলে এটা অবশ্যই দেহের চলমানতার উপর নির্ভর করা উচিত। পরিচিতি না হারিয়ে একটা ছোট নদীকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া যত সহজ, ততটাই সহজ একজন ব্যক্তিকে স্বর্গে স্থানান্তরিত করা।

ব্যক্তিত্ব হলো আবশ্যিকভাবে সংগঠনের একটি বিষয়। কতিপয় ঘটনা যেগুলো কতিপয় সম্পর্ক দিয়ে দলবদ্ধ, এরাই গঠন করে একজন ব্যক্তিকে। এই দলবদ্ধতা কার্য-কারণ বিধির সাহায্যে ফলপ্রসু হয়। সেগুলোে অভ্যাস গঠনের সঙ্গে সংযুক্ত, যা স্মৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে, এবং সংশ্লিষ্ট কার্য-কারণ বিধি দেহের ওপর নির্ভর করে। এটা যদি সত্যি হয়, অবশ্য এটা সত্য ভাবার সপক্ষে শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে। মস্তিষ্কে বিভাজন সত্ত্বেও একজন ব্যক্তিত্বের বেঁচে থাকাটা হলো এমন একটি ব্যাপার, যেখানে একটি ক্রিকেট ক্লাবের সব সদস্য মারা যাবার পরেও ক্লাবটির অস্তিত্ব টিকে থাকার মতো। |||||||||| আমি এটা দুঃসাহসে বলছি না যে, এই যুক্তিধারা তর্কাতীত। বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ দূরদৃষ্টি করা অসম্ভব, বিশেষত মনোবিদ্যার, যেটা সবেমাত্র বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠছে। এটা হতে পারে যে, মনস্তাত্ত্বিক কার্য-কারণকে এর বর্তমান দেহ নির্ভরতা থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু মনোবিদ্যা এবং শারীরবিদ্যার বর্তমান অবস্থায়, অমরত্বে বিশ্বাস, যেভাবেই হোক, বিজ্ঞানের কাছ থেকে কোনো সমর্থন দাবি করতে পারে না। এবং এই বিষয়টা সম্পর্কে যতই সম্ভাব্য যুক্তিসম্ভার হাজির করা হোক না কেন, তা সত্ত্বেও মৃত্যুতে ব্যক্তিত্বের বিলুপ্তিই নির্দেশ করে। এমন চিন্তা আমাদের দুঃখ দিতে পারে যে, আমরা বেঁচে থাকব না, কিন্তু এটা ভাবাও স্বস্তির যে, সমস্ত নির্যাতনকারী, ইহুদি-নির্যাতক এবং প্রতারকরাও চিরকাল বেঁচে থাকবে না। আমাদের বলা হতে পারে যে, ওরা যথাসময়ে উন্নতি করবে, কিন্তু এটাকে আমি সন্দেহ করি।

———-
১. আচারনিষ্ঠা ও গোঁড়ামির জন্য প্রসিদ্ধ প্রাচীন ইহুদি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ।–অনুবাদক

২. ইহুদি নাস্তিক্য বিশ্বাসের মানুষ।– অনুবাদক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *