০৩. বিবর্তন

অধ্যায় ৩
বিবর্তন

বিজ্ঞান তো একটা নিয়ম মেনে বিকশিত হয়েছে। এর বিপরীত বিষয়টাও প্রত্যাশিত হতে পারত। যা কিছু আমাদের থেকে দূরে ছিল সেসব প্রথমে একটা গণ্ডির মধ্যে এনে ফেলা হলো। তারপর কাছাকছি যেসব ছিল, প্রথমে স্বর্গ, পরে পৃথিবী এবং পর পর প্রাণী ও উদ্ভিদজীবন, মানবদেহে এবং সবশেষে মানবমনকে নিয়মের সীমায় এনে ফেলা হলো। যদিও মানবমন এখন অসম্পূর্ণভাবেই গণ্ডিবদ্ধ রয়েছে। এসবের ক্ষেত্রে কোনোটাই ব্যাখ্যাতীত নয়। এগুলোর সঙ্গে বিশদে পরিচয় এসবের বিশাল পরিধিটা বুঝতে অসুবিধা ঘটায়। যেমনটা হয়, উড়োজাহাজ থেকে রোমের পথ-ঘাট সহজেই চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু মাটি থেকে তা এত ভালোভাবে করা যায় না। একজন মানুষের বন্ধুরা জানেন ওই মানুষটি যা করে তার চেয়ে আরও ভালো তার কী করা দরকার। এদের কথাবার্তার একটা বাকে এরা আগে বুঝতে পারে এদের পছন্দসই একটা সত্যকাহিনী বলাটা অপরিহার্য। কিন্তু ওই লোকটির নিজের কাছে মনে হয় স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণায় সে কাজটা করে চলেছে। নিবিড় অভিজ্ঞতা থেকে-পাওয়া বিশদ পরিচিতিতে জ্ঞানের কোনো সাধারণ সূত্র পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান তো এই সাধারণ সূত্রেরই খোঁজ করে। কেবলমাত্র সরল প্রাকৃতিক নিয়মের আবিষ্কারই নয়, যে-পৃথিবীকে আমরা জানি তার ক্রমবিকাশের মতবাদও জানা দরকার। এই জানার চেষ্টা শুরু হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যা থেকে। কিন্তু পৃথিবীর ক্রমবিকাশের মতবাদ জ্যোতির্বিজ্ঞানের চেয়ে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগের বিষয়টা এই গ্রহে জীবনের বিকাশ থেকে বেশি জেনেছি। বিবর্তনের মতবাদ, আমাদের বিবেচনায়, জ্যোতির্বিদ্যা থেকে শুরু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব পেয়েছে ভূবিদ্যা এবং জীববিদ্যায়। কোপার্নিকাসের আবিষ্কারের বিজয়ের পর এই ভূবিদ্যা ও জীববিদ্যার এগিয়ে থাকার ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিদ্যার লড়াইয়ের থেকে বেশি লড়তে হয়েছে বেয়াড়া ধর্মতত্ত্বীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। একটা আধুনিক মনের পক্ষে এটা বোঝা কঠিন যে, বিকাশ এবং ক্রম অগ্রগতির ধারণায় বিশ্বাস’ সাম্প্রতিক একটা বিষয়। আসলে এটা নিউটনের পরের ঘটনা। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে ছ’দিনে। এবং স্বর্গীয় সবকিছু, সব ধরনের জীবজন্তু এবং গাছপালা যা এখনও বর্তমান, এবং যা মহাপ্লাবনে হারিয়ে গেছে, সব কিছুই পৃথিবীতে রয়েছে সেই সৃষ্টির সময় থেকে। প্রগতি একটা বিশ্বনিয়ম। এটা এখন বেশিরভাগ ধর্মতাত্ত্বিকরা মানেন। এই ধর্মতাত্ত্বিক এবং সমুদয় খ্রিষ্টনরাও বিশ্বাস করেন যে, আদম ও ইভের মহাপতনের সময় থেকে একটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সন্নিবেশ ঘটেছে। ঈশ্বর আদম এবং ইভকে একটা বিশেষ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। এই নিষেধ সত্ত্বেও ওঁরা নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন অবশ্যই। পরিণতিতে ঈশ্বর বিধান দিলেন যে, ওঁরা দুজন এবং ওঁদের উত্তর পুরুষ মরণশীল হবে। এবং মৃত্যুর পরে এঁদের দূরতম প্রজন্মও নরকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করে চলবে। শাস্তির ব্যাপারে অবশ্য কতিপয় ব্যতিক্রমও থাকবে। এই ব্যতিক্রম হবে একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী। এই পরিকল্পনা নিয়েও বেজায় বির্তক ছিল। আদমের পাপের মুহূর্ত থেকেই প্রাণীরা একে অন্যকে শিকার করতে শুরু করল। জন্মাতে শুরু করল কাটাযুক্ত গাছ। ঋতুর বৈচিত্র্য এল। মাটি অভিশপ্ত হলো। মাটির এই অভিশাপের কথা, এই মাটি অনায়াসে মানবজাতিকে ভরণ-পোষণ যোগাবে না। মাটি থেকে এসব পেতে হলে কষ্টসাধ্য পরিশ্রম করতে হবে। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ঘটনার পরেই মানুষ ভীষণ পাপী হতে শুরু করল। এতটাই যে, নোয়া, তার তিন পুত্র এবং তাদের ভার্যাগণ ব্যতীত সবাইকে মহাপ্লাবনে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা বলে এটাও ভাবা হয়নি যে, সেই থেকে মানুষ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রভু প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, আর কোনো মহাপ্লাবন তিনি পাঠাবেন না পৃথিবীতে। তবে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়েই তিনি পরিতৃপ্ত থাকবেন।

আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, এসব কিছু আক্ষরিক ঐতিহাসিক ঘটনা। এগুলো ঘটে, বাইবেলে বলা হয়েছে অথবা সেখানে যা বলা হয়েছে তা থেকে এমনটা নিরূপিত হয়েছে। পৃথিবীর সৃষ্টির দিনটা সৃষ্টিতত্ত্বের কুলজিবিদ্যা থেকে বুঝে নেওয়া যায়। এই কুলজি আমাদের জানায় যে, প্রতিটি গোষ্ঠীপতি কত প্রাচীন ছিল যখন তাদের জ্যেষ্ঠপুত্র জন্মগ্রহণ করেছিল। এসব ব্যাপারে বির্তকের কিছু সুযোগ অনুমোদিত হয়েছে। কী কারণে? কারণ সেপটুয়াজিন্ট(১) এবং হিব্রুগ্রন্থের মধ্যে কিছু পার্থক্য এবং দ্ব্যর্থতা ছিল। পরিশেষে, প্রোটেস্টান্ট খ্রিষ্টজগৎ সাধারণভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০৪ সালটাকে গ্রহণ করল। এই সালটাকেই আর্চবিশপ আশার স্থির করেছিলেন পৃথিবীর সৃষ্টির সাল হিসাবে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. লাইটফুটও সৃষ্টির এই সালটা মেনে নেন।

তাঁর মতে, সৃষ্টিতত্ত্বের আরও সযত্ন অধ্যয়নে খুবই সুনির্দিষ্টভাবে সময়টা বলা সম্ভব। তিনি বললেন ২৩ অক্টোবরের সকাল ৯টা এই সুনির্দিষ্ট সময়। এটা অবশ্যই কখনোই বিশ্বাসের বিষয় হয়ে থাকেনি। বিধর্মী হবার কোনো ঝুঁকি না নিয়েই আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, আদম ও ইভের জন্ম হয়েছিল ১৬ অথবা ৩০ অক্টোবর। এটা আপনার বিশ্বাসে থাকবে যদি এই বিশ্বাসের কারণটা আপনি সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে জেনে থাকেন। এবং সৃষ্টি সপ্তাহের দিনটা অবশ্যই শুক্রবার বলে ধরতে হবে। কারণ ঈশ্বর শনিবার বিশ্রাম নিয়েছেন। এই সংকীর্ণ কাঠামোর মধ্যে বিজ্ঞানকে আটকে রাখার চিন্তা করা হয়েছিল। যারা এমন প্রশ্ন তুলতেন যে, এই দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্বের পক্ষে ৬০০০ বছরটা নিতান্তই কম সময়, তাদের অপবাদ দেওয়া হত। এই অপবাদের পরিণতিতে তখন হয়তো প্রশ্নকারীদের পুড়িয়ে মারা কিংবা কারারুদ্ধ করে রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ধর্মতত্ত্ববাদীরা অন্য যা যা করা সম্ভব সবই করেছেন এঁদের জীবনকে বিড়ম্বিত করে তুলতে। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রশ্নকারীদের মতবাদ যাতে বিস্তারলাভ না করে।

ইতিমধ্যে কোপার্নিকাসের মতবাদ গৃহীত হয়েছে। কিন্তু নিউটন ধর্মীয় গোঁড়ামি নাড়িয়ে দিতে তেমন কিছুই করেননি। তিনি নিজেই ছিলেন গভীরভাবে এক ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। তিনি বাইবেলের আক্ষরিক অনুপ্রেরণায় বিশ্বাস করতেন। তার বিশ্বাসের পৃথিবীতে বিকাশের স্থান ছিল না। তার শিক্ষণের কথা, সবকিছু একটা বস্তুনিচয়ে সৃষ্ট। গ্রহসমূহের মূর্ত গতিবেগের জন্য এগুলো সূর্যের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এই ব্যাপারটাতে তাঁর ধারণা ছিল যে, গ্রহগুলোকে ঈশ্বর প্রথমে নিজ হাতে সবেগে ছুঁড়ে দিয়ে পৃথক করে দিয়েছেন। তারপর থেকে গ্রহগুলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মেনে চলেছে। এটা সত্য যে, বেন্টলের কাছে এক ব্যক্তিগত চিঠিতে নিউটন একটা পথের কথা বলেছেন যে-পথে সৌরজগৎ বিকশিত হয়ে থাকবে। তাঁর মতে এই পথটা ছিল পদার্থের একটা আদিম প্রায় সম-বিভাজন। কিন্তু তার পদমর্যাদাগত এবং প্রকাশ্য ঘোষণায় এই মতটাই প্রকাশ পেত যে, আমরা যেমন জানি, সূর্য এবং গ্রহগুলোর সৃষ্টি হয়েছে আচম্বিতে। এবং এসব সৃষ্টির ক্ষেত্রে মহাজাগতিক বিবর্তনের কোনো স্থান নেই।

নিউটনের কাছ থেকে আঠারো শতক একটা অদ্ভুত ঈশ্বরভক্তি লাভ করেছিল। এতে ঈশ্বর ছিলেন আবশ্যিকভাবে আইনপ্রণেতা। এই ঈশ্বরই প্রথমে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তারপর আইন প্রণয়ন করেছেন। এই আইনই পরে ঈশ্বরের বিশেষ হস্তক্ষেপ ছাড়া অন্য সব কিছু নির্ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে প্রথাসম্মত ধর্মবিশ্বাস অবশ্য ব্যতিক্রম মেনে নিয়েছে। এমন একটি ব্যতিক্রম হলো ধর্মের সঙ্গে যুক্ত অলৌকিকতা। কিন্তু যৌক্তিক একেশ্বরবাদীরা ব্যতিক্রমকে মানেননি। তাঁদের মতে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। এই দুটো ধারণাই আলেকজান্ডার পোপের Essay on Man-এ স্থান পেয়েছে। পোপের এই রচনার একাংশে রয়েছে–

শুরুতে সর্বশক্তিমান কারণ
তিনি কাজ করেন, সাধারণ নিয়মে;
ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে কিছু।
কিন্তু ধর্মগোড়ামির দাবি যখন ভুলে যাওয়া হয় তখন ব্যতিক্রমগুলো অদৃশ্য হয়:
প্রকৃতির বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী যে নিয়ম-শৃঙ্খলের একটি আংটায় আঘাত কর
তা সে আংটা প্রথম থেকে দশম হোক কিংবা দশসহস্রতম
সে আঘাতে সমগ্র শৃঙ্খলাটি ভেঙে পড়বে।
কেননা এই শৃঙ্খলের প্রতিটি অংশ একটা ক্রমবিন্যাসের পর্যায় হিসাবে
ওই আশ্চর্য সমগ্রের অপরিহার্য অঙ্গ,
একটি আংটার বিশৃঙ্খলা গোটা শৃঙ্খলাবর্তের বিপৰ্যর ঘটায়।
পৃথিবী কক্ষপথের বাইরে চলে গেলে
গ্রহসমূহ ও সূর্যরাও নিয়ম ভেঙে অসংযত বেগে ধাবমান হবে।
ব্ৰহ্মাণ্ড শাসন-করা দেবদূতেরা স্ব স্ব স্থানচ্যুত হলে,
সর্বস্তরের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
জগৎ চরাচরের স্বর্গীয় পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুই স্থানচ্যুত হবে।
এর প্রভাবে পরিব্যাপ্ত প্রকৃতি এমনকি তার চূড়ায়
ঈশ্বরের আসন পর্যন্ত আন্দোলিত হবে, টলে যাবে।

Queen Anne-র সময় থেকে সম্ববত আইনের রাজত্ব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত হলো। যুক্ত হলো এই বিশ্বাসও যে, বিপ্লবের যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। মানুষ যখন পুনরায় পরিবর্তন চাইল তখন প্রাকৃতিক কার্যাবলী সম্পর্কে তাদের ধারণা কম নিশ্চল হয়ে পড়ল।

১৭৫৫ সাল। প্রকাশিত হলো কান্টের একখানা বই। বইখানার নাম General Natural History and Theory of the Heavens, or Investigation of the Constitution and Mechanical Origin of the Whole Structure of the Universe, treated according to Newtonian Principles। এই পুস্তকেই প্রথম সূর্য, গ্রহসমূহ এবং নক্ষত্রের বিকাশের বৈজ্ঞানিক মতবাদ তৈরির ঐকান্তিক প্রয়াস শুরু হলো। এই কাজটা খুবই অসাধারণ। এই কাজটা কতক পরিমাণে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার ফলাফল আগে থেকেই আঁচ করেছে। এই মতবাদ এভাবে আলোচনা শুরু করেছে যে, আমাদের খালি-চোখে-দেখা সমুদয় নক্ষত্রমণ্ডলী একটা সিস্টেমের অন্তর্গত। এটা হলো দুগ্ধসরণি বা ছায়াপথ। এই সমুদয় নক্ষত্রগুলো প্রায় একটা সমতলে অবস্থান করে। কান্ট বলছেন যে, এদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য রয়েছে যা অবশ্য সৌরজগতের ঐক্যের মতো নয়। অসাধারণ কাল্পনিক দূরদৃষ্টিতে তিনি নেবুলাকে এরকমই কিন্তু বহু, বহু দূরের আর একটি নক্ষত্রগোত্র বলে ভেবেছেন। তাঁর এই মতটা কিন্তু এখনও সাধারণভাবে স্বীকৃত। তাঁর তত্ত্বটা অবশ্য গাণিতিকভাবে অসমর্থনীয়। কিন্তু বিশদভাবে-করা পরবর্তী পর্যবেক্ষণে বলা হয় যে, নেবুলা, ছায়াপথ, নক্ষত্রসমূহ, গ্রহসমূহ এবং উপগ্রহগুলো সবেরই উৎপত্তি হয়েছে মূলত বিক্ষিপ্ত পদার্থের ঘনীভূত অবস্থা থেকে। এক্ষেত্রে এই সৃষ্টি সেইসব এলাকা থেকে হয়েছে যেখানে ঘনত্ব অন্য এলাকা থেকে বেশি। কান্ট বিশ্বাস করেন যে, জড় ব্রহ্মাণ্ড অসীম। স্রষ্টার অসীমত্ব মেনে নিতে এটাই একমাত্র ধারণা। তিনি মনে করেন যে, বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে শৃঙ্খলায় ক্রম উত্তরণ ঘটেছে। এটা শুরু হয় ব্রহ্মাণ্ডের ভরকেন্দ্রে। ধীরে ধীরে এই সূচনা থেকে দূরবর্তী স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এটা এমন একটা পদ্ধতি যা ক্রিয়াশীল হতে প্রয়োজন অসীম পরিসর এবং অসীম সময়।

কান্টের এই কাজটার অসাধারণত্বের প্রথম কারণ হল, এটা সামগ্রিকভাবে ব্রহ্মাণ্ডের একটা ধারণা দেয়। এই জড় বিশ্বলোকে ছায়াপথ এবং নেবুলা হলো দুটো সংঘটক উপাদান। অন্য কারণটা হল, এমন ধারণা যে, ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মহাশূন্যে পদার্থের অপৃথকীকৃত আদিম বিতরণ। আচম্বিতে সৃষ্টিতত্ত্বের বিকল্প হিসাবে এটাই প্রথম ঐকান্তিক প্রয়াস। লক্ষ্যণীয়ভাবে এটা মজার ব্যাপার যে, পৃথিবীতে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিটা শুরু হলো, জীবন নিয়ে নয়, স্বৰ্গতত্ত্ব হিসাবে।

যাই হোক, নানা কারণে কান্টের এই কাজ সীমিত মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই পুস্তক প্রকাশের সময় কান্ট নিতান্তই যুবক। বয়স তখন তাঁর মাত্র একত্রিশ। তাছাড়া এসময় পর্যন্ত তিনি কোনো যশলাভ করতে পারেননি। তাঁর কোনো বিশাল খ্যাতি ছিল না। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক। পেশাগত গণিতবিদ কিংবা পদার্থবিদ তিনি ছিলেন না। গতিবিজ্ঞানে যোগ্যতার অভাব ছিল তার। সেটা বোঝা গেছে তার একটা ধারণা থেকে। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, স্ব-অন্তর্ভূক্ত পদ্ধতি একটা ঘূর্ণন আয়ত্ত করতে পারে, যে-ঘূর্ণন মুলত তার থাকে না। তাছাড়া, তার তত্ত্ব অংশত কল্পনাপ্রসূত। উদাহরণে বলা যায়, তিনি ভেবেছিলেন যে, সূর্য থেকে দূরে-থাকা গ্রহের অধিবাসীরা তুলনামূলকভাবে ভালো। এটা এমন একটা ধারণা, মানবজাতির অনুষঙ্গে এর শালীনতা প্রশংসনীয়। কিন্তু বিজ্ঞানের পরিচিত কোনো বিবেচনাতেই এটা সমর্থনীয় নয়। এসব কারণে তার থেকে পেশাগতভাবে যোগ্যতর ল্যাপল্যাসের তত্ত্বটা বিকশিত হওয়া পর্যন্ত কান্টের কাজটা প্রায় অলক্ষ্যেই থেকে গেছে।

ল্যাপল্যাসের বিখ্যাত নেবুলার প্রকল্প প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৯৬ সালে। এটি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর Exposition du Systime du Monde নামক বইয়ে। এটা প্রকাশের সময় ল্যাপল্যাসের জানা ছিল না যে, এই প্রকল্পটা অনেকটা পরিমাণে কান্টের ধারণাতেও ছিল। ল্যাপল্যাসের কাছে এটা একটা প্রকল্পের চাইতে বেশি কিছু ছিল না। একটা নোটে তিনি জানিয়েছেন, অবিশ্বাসটা অবশ্যই সবকিছু দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে যা পর্যবেক্ষণ অথবা ভাবনাচিন্তার ফল নয়। কিন্তু এই মত এখন অচল। তবুও এক শতক ধরে এই ভাবনাচিন্তা প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। তিনি এই মত পোষণ করতেন যে, বর্তমানে সৌর এবং গ্রহদের যে-সিস্টেম সেটা মূলত ছিল একটা একক বিক্ষিপ্ত নেবুলা। এটা ধীরে ধীরে সংকুচিত হলো এবং পরিণামে দ্রুত ঘুরতে লাগল। কেন্দ্রাতিগ শক্তি পিণ্ডগুলোকে বিক্ষিপ্ত করে দিল। এগুলোই গ্রহ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এবং একই পুনরাবৃত্ত পদ্ধতিতে উপগ্রহগুলো সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্স বিপ্লবের ঐতিহাসিক যুগের মানুষ ছিলেন বলে তিনি ছিলেন পুরোপুরি মুক্তচিন্তক। সৃষ্টিতত্ত্বকে তিনি পুরোপুরি বাতিল করে দেন। নেপোলিয়ান বুঝেছিলেন যে, স্বর্গীয় রাজাধিরাজে বিশ্বাস পার্থিব সম্রাটের প্রতি মানুষের সম্মানকে উৎসাহ যোগাবে। তিনি তখন বললেন যে, ল্যাপল্যাসের সেলেসৃটিয়াল মেকানিকস্-এর মহান কাজের মধ্যে ঈশ্বরের কোনো উল্লেখ নেই কেন? উত্তরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ল্যাপল্যাস বলেন, স্যার, আমার ওই ধরনের কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। ধর্মতত্ত্বীয় জগৎটা এমন উত্তরে ব্যথিত হলো বটে, কিন্তু ল্যাপল্যাসের প্রতি এদের অপছন্দটা নাস্তিকতার আতঙ্ক এবং বৈপ্লবিক ফ্রান্সের বেয়াড়াপনার মধ্যে মিশে গেল। যাই হোক, জ্যোতির্বিদদের বিরুদ্ধে লড়াইটা হঠকারী বলে মনে হয়েছিল।

ভূবিদ্যার একটা বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটেছিল জ্যোতির্বিদ্যায় এমনতর দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতভাবে। অপার্থিব বস্তুনিচয় অপরিবর্তনশীল, জ্যোতির্বিদ্যার এই বিশ্বাস, বস্তুনিচয়ের ক্রমবিকাশ তত্ত্বকে জায়গা ছেড়ে দিল। কিন্তু ভূবিদ্যার ধারণা এই যে, পূর্ববর্তী সময়ে একটা মহাপরিবর্তনের ব্যাপার ছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এই ধারণাটা দাঁড়াল, পরিবর্তন সর্বদাই ঘটে চলেছে তবে ধীরে। প্রথমে এটা ভাবা হয়েছিল যে, পৃথিবীর গোটা ইতিহাসটা ছয় হাজার বছরের সময়সীমার মধ্যে সংকুচিত করতে হবে। পাললিক শিলা এবং লাভার অবক্ষেপ এবং অন্যান্য সাক্ষ্যকে এই সময়সীমার মধ্যে আনার জন্য বলতে হলো যে, এর আগে মহাপরিবর্তন ঘটত ঘন ঘন। বৈজ্ঞানিক বিকাশে ভূবিদ্যা জ্যোতির্বিদ্যা থেকে কতটা পিছিয়ে ছিল সেটা নিউটনের সময়ে এর অবস্থা থেকে বোঝা যায়। ১৬৯৫ সালে উডওয়ার্ড পাললিক শিলার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, গোটা পার্থিব জগতটা মহাপ্লাবনে টুকরো টুকরো হয়ে থাকবে এবং গলে গিয়ে থাকবে। স্তরসমূহ এই প্রস্তরীভূত পিণ্ড থেকে তৈরি হয়ে থাকবে, যেমনটা ঘটে তরল থেকে মৃন্ময় পললের ক্ষেত্রে। লায়েলের বক্তব্য এই যে, ল্যাপল্যাস শেখাতেন ‘পৃথিবীর ভূত্বকে থাকা প্রস্তরীভূত স্তরের গোটা বস্তুনিচয় কয়েক মাসের মধ্যে জমে গেছে। চোদ্দো বছর আগে ১৬৮১-তে রেভারেন্ড টমাস বার্নেট চার্টার হাউসের মাস্টার ছিলেন। তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর Sacred Theory of the Earth; containing on Account of the Original of the Earth, and of all the general Changes which it hath already undergone, or is to under go, till the Consummation of all things। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নিরক্ষরেখা মহাপ্লাবনের আগে পর্যন্ত ক্রান্তিবৃত্তের সমতলে ছিল। পরে এটা এর বর্তমান তির্যক অবস্থানে সরে গেছে। (ধর্মতত্ত্বগতভাবে সঠিকতর ধারণাটা ছিল মিল্টনের। তাঁর মতে এটা ঘটেছে মহাপতনের সময়ে।) মিল্টনের ধারণায় সূর্যের তাপ ভূপৃষ্ঠকে ফাটিয়ে দিয়েছে। এই ফাটলের পথে পাতাল থেকে জল উঠে এসে তৈরি করেছে ভূগর্ভস্থ জলাধার। এভাবে মহাপ্লাবনটা ঘটেছে। তাঁর কথায়, বিশৃঙ্খলার দ্বিতীয় ঘটনার সূচনা হবে সহস্রাব্দে। তাঁর মতামতটাকে সতর্কভাবে বুঝতে হবে। কারণ তিনি চিরন্তন শান্তিতে বিশ্বাস করতেন না। আরও ভয়াবহ কথা হচ্ছে, মহাপতনের ঘটনাটাকে তিনি একটা রূপক বলে মনে করতেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা আমাদের জানায় যে, রাজা তাঁকে খাসকামরার করণিক পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নিরক্ষরেখাসহ অন্যান্য বিষয়ে তার ভুল হুইটস এড়িয়ে গেছেন। ১৬৯৬ সালে হুইটসনের একখানা বই প্রকাশিত হয়। বইয়ের নাম A New Theory of the Earth: wherein the Creation of the World in Six Days, the Universal Deluge, and the General Conflagration, as laid down in the Holy Scriptures, are shown to be perfectly agreeable to Reason and Philosophy। ১৬৮০ সালের ধূমকেতুর আবির্ভাব এই বই লেখার আংশিক অনুপ্রেরণা হতে পারে। এই ধূমকেতু আবির্ভাবের ঘটনা তাঁকে এভাবে ভাবিয়েছে যে, ধূমকেতুই হয়তো মহাপ্লাবন ঘটিয়ে থাকবে। একটা বিষয় তাঁর শাস্ত্রনিষ্ঠ বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। সেটা হলো, তার চিন্তায় সৃষ্টির ছয় দিন সাধারণ দিনের সময়সীমা থেকে বেশি ব্যাপক।

এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, উড়ওয়ার্ড বার্নেট এবং হুইটস্ন তাঁদের সময়ের অন্যান্য ভূবিদদের থেকে যোগ্যতায় পেছিয়ে ছিলেন। পক্ষান্তরে, তারা তাদের সময়ে সর্বশ্রেষ্ঠ ভূবিদ ছিলেন। অন্ততপক্ষে হুইটস তো লক্ কর্তৃক উচ্চ প্রশংসিত ছিলেন।

আঠারো শতকটাকে দুটো মতবাদের বিতর্ক আকড়ে ধরেছিল। নেপচুনবাদীরা(২) প্রায় সবকিছুই জলপ্রসূত বলে মনে করতেন। ভালকানবাদীরা(৩) প্রবল গুরুত্ব আরোপ করতেন অগ্ন্যুৎপাত এবং ভূমিকম্পের উপর। নেপচুনবাদীরা অবিরাম মহাপ্লাবনের সাক্ষ্য সংগ্রহ করতেন। তাঁরা পাহাড়ের শীর্ষ উচ্চতায় প্রাপ্ত সামুদ্রিক জীবাশ্মকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এঁরা ছিলেন ভীষণভাবে গোড়াপন্থী। ফলে এই গোঁড়াপন্থার শত্রুরা স্বীকার করতেন যে, জীবাশ্ম প্রাণীদের খাঁটি অবশেষ নয়। ভল্টেয়ার ছিলেন বিশেষভাবে সংশয়বাদী। তিনি যখন এসবের জৈব উৎস অস্বীকার করতেন না তখন বলতেন যে, এসব তীর্থযাত্রীরা ফেলে গেছে। এই নিদর্শনে বোঝা গেল যে, অন্ধ মুক্তচিন্তা গোড়া ধর্মবাদী মতের চেয়ে বেশি অবৈজ্ঞানিক।

বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ বাফন ১৭৪৯ সালে প্রকাশিত তাঁর Natural History বইয়ে সাধারণের জ্ঞানের জন্য চোদ্দোটি বক্তব্য রেখেছেন। এগুলো প্যরিসের সোরবোর্ন ধর্মতাত্ত্বিক ফ্যাকাল্টি কর্তৃক ধিকৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, এগুলো ‘নিন্দার্য এবং খ্রিষ্ট ধর্মমত বিরোধী। এগুলোর মধ্যে জীববিদ্যা সংক্রান্ত একটি ঘোষণা, পৃথিবীর বর্তমান পর্বত এবং উপত্যকাগুলো গৌণ কারণে গড়ে উঠেছে। এসবগুলো যথাসময়ে অনুরূপ এক গৌণ কারণে ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং এ ধরনের পর্বত ও উপত্যকা পুনরায় তৈরি হবে। এখানে গৌণ কারণ’ মানে ঈশ্বরের সৃষ্টিমুখীন আদেশ ছাড়া অন্য কোনো কারণ। ফলে ১৭৪৯ সালে গোড়া ধর্মবাদীদের পক্ষে এমন বিশ্বাস প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল যে, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে একই পাহাড়-পর্বত-উপত্যকাসহ। ভূমি এবং সমুদ্রের বিতরণ, যেমনটা আজ আমরা দেখছি, এসব পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে অলৌকিক কারণে। একমাত্র ব্যতিক্রম ডেড সী’র ক্ষেত্রে।

সোরবার্নের সঙ্গে বির্তকে যাওয়া ঠিক হবে না ভাবলেন বাফন। তিনি তার আগের মতামত পরিহার করলেন এবং এই স্বীকারোক্তি দিলেন, আমি ঘোষণা করছি যে, বাইবেলের বক্তব্যের বিরোধিতা করার কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। সময়ের ক্রম এবং ঘটনার বিবরণে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সবই আমি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বিশ্বগঠন সম্পর্কে আমার পুস্তকে যা কিছু বলা হয়েছে সবই আমি প্রত্যাখ্যান করছি এবং সাধারণভাবে বাতিল করছি আমার সে সব বক্তব্যও যেগুলো মোজেসের বর্ণনার বিরোধী।” এটা স্পষ্ট যে, জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানের বাইরে ধর্মতাত্ত্বিকরা গ্যালিলিওর সঙ্গে বিরোধের ফলে উদ্ভূত জ্ঞান থেকে তেমন কিছুই শেখেননি।

ভূবিদ্যায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রচলন করেন হাটন। এঁর Theory of the Earth প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৮৮ সালে। এই বইখানাই বর্ধিত আকারে পুনঃপ্রকাশিত হয় ১৭৯৫তে। তিনি বললেন যে, যে-সব কারণে অতীতে ভূপৃষ্ঠে পরিবর্তন ঘটেছে সেগুলো আজও সমান ক্রিয়াশীল। এটা ধরে নেবার কোনো কারণ নেই যে, অতীতের কারণগুলো বর্তমানের কারণসমূহ থেকে বেশি সক্রিয় ছিল। যদিও প্রধানত এটি একটি যুক্তিপূর্ণ সূত্র, হাটন এই সূত্রকে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত করেন। মহাদেশগুলোর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণটাকে তিনি ভূপৃষ্ঠের অবক্ষয়ের ওপর আরোপিত করলেন। এই অবক্ষয়ের ফলে সাগরের তলদেশে পলি জমা হয়। কিন্তু নতুন মহাদেশগুলোর উত্থানের কারণ হিসাবে তিনি প্রচণ্ড আলোড়নের কথা বলেন। তিনি ভূমির হঠাৎ নিমজ্জন এবং এর ক্রমউত্থানের বিষয় দুটো যথেষ্ট পরিমাণে বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু তাঁর সময় থেকে সমুদয় বৈজ্ঞানিক ভূবিদগণ বর্তমানের সাহায্যে অতীতকে ব্যাখ্যা করার সাধারণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। মেনে নিয়েছেন তার আরও কতিপয় মতবাদ। বর্তমানে দেখা যে-সব কারণগুলোর জন্য ধীর গতিতে উপকূল রেখার পরিবর্তন ঘটছে, পর্বতের উচ্চতা বৃদ্ধি অথবা হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং সমুদ্রতলের উচ্চতা উঠে আসা কিংবা নিচু হওয়া–এসব কারণ দিয়ে তিনি ভূতাত্ত্বিক কালের বিশাল পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। প্রধানত ইহুদি ধর্মগুরু মুসার কালপঞ্জি অনুসরণের কারণে প্রথম দিকে মানুষ এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেনি। সৃষ্টিতত্ত্বের প্রবক্তারা হাটনের এবং তার শিষ্য প্রেফেয়ারের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ নামিয়ে আনেন। লায়েলের(৪) ভাষায়, ‘হাটনীয় মতবাদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা দলীয় মনোবৃত্তির আকার ধারণ করে।’

ওই সময় ইংরেজদের মনোভাব অ-স্থিত উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। অনেক বছর ধরে ফ্রান্সের এক শ্রেণির লেখক প্রবল পরিশ্রম করেছিলেন ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের প্রভাব কমিয়ে আনতে। এটা তারা করেছিলেন খ্রিষ্টবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে। তাঁদের এই সাফল্য এবং ফরাসি বিপ্লবের পরিণতি খ্রিষ্টবিশ্বাসে অনমনীয় মানুষদের আতঙ্কিত করেছিল। তুলনায় ভীত মানুষদের কল্পনাকে ক্রমাগত ভয়ঙ্কর প্রথার তাড়না দিয়ে চালানো হতে থাকল। এইসাথে যুক্ত হলো কতিপয় ভয়ার্ত স্বপ্নের ভৌতিকতা। ১৭৯৫ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের সম্পন্ন নাগরিকরা দেখলেন প্রতিটি বাইবেলবিরোধী মতবাদকে আক্রান্ত হতে। এ আক্রমণ নামানো হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের আগে বিট্রিশ জনমত যতটা উদার ছিল, পরে অনেক বছর ধরে ইংল্যান্ড তুলনামূলক কম উদারতা দেখিয়েছে।

ভূবিদ্যার আরও উন্নতি জীববিদ্যার উন্নতির সঙ্গে জড়িয়ে গেল। এটা হবার কারণ ইতিমধ্যে বিলুপ্ত অসংখ্য জীবাশ্মতে বদলে গেছে। সংরক্ষণ করেছে। জীববিলুপ্তির রেকর্ড। পৃথিবীর প্রাচীনত্ব যতটা সংশ্লিষ্ট তাতে ভূবিদ্যা এবং ধর্মতত্ত্ব একটা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারত যদি ছয় দিন ছয়টা যুগ বলে ব্যাখ্যা করতে সম্মত থাকত ধর্মবাদীরা। কিন্তু প্রাণীদের জীবনচক্র সম্পর্কে ধর্মতত্ত্বের সুনির্দিষ্ট অনেক ধারণা ছিল। এসব ধারণাগুলো বিজ্ঞানে খাপ খাওয়ানো খুবই অসুবিধাজনক মনে হলো। মহাপতনের আগে পর্যন্ত কোনো প্রাণী অন্য প্রাণী শিকার করত না। এই সময় পর্যন্ত টিকে-থাকা সমস্ত প্রাণীকুল নোয়ার আর্কে(৫) থাকা প্রজাতিগুলোর প্রতিনিধি। আর বর্তমানে যে-সব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত, সে-সব মহাপ্লাবনে ডুবে গেছে। প্রজাতিসমূহ অপরিবর্তনশীল। এবং প্রতিটি প্রজাতি এসেছে সৃষ্টির পৃথক কাজ থেকে। এসব বিবৃতির একটিকে প্রশ্ন করার অর্থ ধর্মতাত্ত্বিকদের বিরূপতা ডেকে আনা।

নয়া দুনিয়া আবিষ্কারের পর অসুবিধা দেখা দিতে শুরু করল। আমেরিকা তো আরারত পর্বত থেকে অনেক দূরে। অথচ আমেরিকায় বহু প্রাণী রয়েছে, যারা মধ্যবর্তী স্থানে নেই। কীভাবে এসব প্রাণী এতটা দূরে এল? এতটা দূরে আসতে গিয়ে কেন তাদের কেউ পথিমধ্যে রয়ে গেল না? কেউ কেউ ভাবলেন, নাবিকরা এদের নিয়ে গেছেন।

কিন্তু এমন প্রকল্পের অসুবিধাও রয়েছে। এই বিষয়টা ধর্মবিদ জেসুইট যোশেপ অ্যাকসটা, যিনি ইন্ডিয়ানদের ধর্মান্তরকরণে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন, তিনি নিজের ধর্মবিশ্বাসও ধরে রাখতে অসুবিধায় পড়েছিলেন। ১৫৯০ সাল। প্রকাশিত হল তাঁর বই Natural and Moral History of Indies। এই বইয়ে তিনি যথেষ্ট গভীর ধারণায় বিষয়টা আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, ‘কে এটা কল্পনা করবে যে, ভ্রমণের এতটা পথে মানুষ কষ্ট করে খেকশিয়ালকে পেরুতে নিয়ে আসবে? বিশেষত খেকশিয়ালের সেই জাত, যারা সব থেকে নিকৃষ্ট। যাদের ওঁরা অ্যাসিয়াস (Acise) বলে। কেই-বা এভাবে বলবে যে, তারা বাঘ এবং সিংহদেরও বহন করে এনেছে? সত্যি বলতে গোটা ব্যাপারটা এমনই যে ভাবলে হাসি পায়। এতটা দীর্ঘ ও অচেনা সমুদ্রযাত্রায় মানুষ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঝড়ের দাপটে চালিত হয়েছে? নিজেদের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই তারা নেকড়ে এবং খেকশিয়াল বহন করবে না, সমুদ্রপথে(৬) ওদের দেখভালও করবে না। এসব সমস্যার কারণে ধর্মতাত্ত্বিকরা এমন বিশ্বাসে বদল ঘটালেন। তারা বললেন যে, নোংরা অ্যাসিয়াস এবং এ-ধরনের অন্যান্য বিদঘুঁটে পশুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সূর্যের কাজের দ্বারা তৈরি কাদামাটি থেকে জন্মেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব কথার কোনো ইঙ্গিত নোয়ার আর্কে ছিল না। অথচ প্রশ্ন থাকল, কীভাবে চলনে বড় শ্লথ অলস জন্তুগুলো আররত পর্বত থেকে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছালো? আর একটা সমস্যা দেখা দিল প্রাণীবিদ্যার অগ্রগতিতে প্রজাতির সংখ্যা জানতে পারার কারণে। যে-সংখ্যা এখন জানা গেছে তা তো লক্ষ লক্ষ। এত সংখ্যক প্রাণীর এক জোড়া করেও যদি নোয়ার আর্কে থেকে থাকে, তাহলে তো ওই আর্ক প্রচণ্ড ভিড়ে ঠাসা ছিল। সব প্রাণীদের ওই আর্কে জায়গা দেওয়া সম্ভব ছিল কী? অধিকন্তু, আদম, এত প্রাণীর নামকরণ করেছেন। সেটাও তো তাঁর জীবনের শুরুতে করে ওঠা এক সাংঘাতিক কঠিন প্রচেষ্টা। অষ্ট্রেলিয়া আবিষ্কার এক নতুন অসুবিধার সৃষ্টি করল। প্রশ্ন উঠল, কেন সব ক্যাঙ্গারু লাফিয়ে টোরস, প্রণালী পেরিয়ে গেল? কেন এদের এক জোড়াও পেছনে পড়ে রইল না? ইতিমধ্যে জীববিদ্যায় প্রভূত অগ্রগতি ঘটে গেছে। ফলে এটা ধরে নেওয়ার অসুবিধা দেখা দিল যে, সূর্য আর কাদামাটি এক জোড়া ক্যাঙ্গারুর জন্ম দিয়েছে। তবুও এই সময়ে এমন একটা তত্ত্বের বড়ো বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।

গোটা উনিশ শতক জুড়ে এই ধরনের সমস্যা ধর্মবিশ্বাসীদের মন তোলপাড় করেছিল। এসব জানতে আপনারা পড়ে নিন একখানা ক্ষুদ্র বই। শিরোনাম The Theology of Geologists as exemplified in the casess of Hugh Miller, and Orther। এই বইয়ের লেখক উইলিয়াম গিলেসপি যিনি The Necesssary Existence of God etc. etc বইয়েরও লেখক। একজন স্কটিশ ধর্মতাত্ত্বিকের লেখা এই বই প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। এই একই বছরে প্রকাশিত হয় ডারউইনের Origin of Species। স্কটিশ ধর্মতাত্ত্বিকের বইখানায় বলা হয়েছে, ভূবিদদের ভয়াবহ স্বীকৃত সত্যের কথা। প্রধান যে-সমস্যাটা নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন সেটাই উত্থাপন করেছিলেন হাগ মিলার। Testimony of the Rocks বইয়ে মিলার বলেছেন, মানুষের আবির্ভাবের পূর্বে অকথিত যুগে পাপ এবং ভোগান্তি ঘটেছে। জীবজন্তুর সৃষ্টি যথাযথভাবে এর বর্তমান লড়াইয়ের অবস্থাটা দেখিয়েছে। কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে মিলার সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন মৃত্যু এবং অত্যাচারের হাতিয়ারগুলোর কথা। মানুষের আবির্ভাবের পূর্বে এগুলো এক প্রজাতির জন্তু অন্য প্রজাতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এসব জন্তুরা মানুষের আবির্ভাবের পূর্বেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মিলার নিজে প্রবলভাবে ধার্মিক ছিলেন। তবুও তিনি এটা বুঝতে বেশ অসুবিধায় পড়েছিলেন যে, স্রষ্টা কেন পাপ করতে অপারগ জন্তুদের উপর এই যন্ত্রণা আরোপ করবেন! মি. গিলেস্‌পি সাক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও, গোঁড়া ধর্মমতকে পুনরায় নিশ্চিত করে বলেছেন। তিনি বলেছেন, নিম্নবর্গীয় জন্তুরা মানুষের পাপের জন্যই ভোগে এবং মারা যায়। তিনি বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দেন, ‘মানুষের দ্বারা মৃত্যু এল।’ এই উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে, আদম আপেল(৭) খাওয়ার আগে পর্যন্ত কোনো প্রাণীই মারা যায়নি। বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে লড়াইয়ের মিলার প্রদত্ত বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেন যে, একজন দয়ালু স্রষ্টা এ-ধরনের দানব সৃষ্টি নাও করতে পারতেন। এ-যুক্তিতে আমরা তাঁর সঙ্গে একমত। কিন্তু তার পরবর্তী যুক্তিগুলো কৌতূহল উদ্দীপক। মনে হয়েছিল যে, তিনি সম্ভবত ভূবিদ্যার সাক্ষ্যগুলোকে অস্বীকার করতে চাইছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সাহসে কুলোয়নি। এ ধরনের দানব তাঁর বক্তব্যের আগেও ছিল। কিন্তু এসব দানব সরাসরি ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়। আদিতে ওরা নির্দোষ প্রাণীই ছিল। শয়তান ওদের পথভ্রষ্ট করেছে। অথবা, বোধহয়, গ্যালারিন শূকরদের মতো ওরা বস্তুত জন্তুর দেহে দানবের আত্মাবিশেষ।

এই ব্যাপারটাই ব্যাখ্যা করে, বাইবেলে কি কারণে গ্যালারিন শূকরের গল্পটা রয়েছে। এই গল্প বিশ্বাসের ব্যাপারে অনেককে বিশ্বাসে দ্বিধাগ্রস্ত করে।

জীববিদ্যার ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে বাঁচাতে একটা অদ্ভুত চেষ্টা চালালেন প্রকৃতি পর্যবেক্ষক গস। ইনি ছিলেন একমণ্ড গসের পিতা। পৃথিবীর প্রাচীনত্বের অনুকূলে হাজির-করা সব সাক্ষ্যই তিনি পুরোপুরি স্বীকার করলেন। কিন্তু এই বিশ্বাসটা বজায় রাখলেন যে, যখন সৃষ্টি চলছিল তখন সবকিছু এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে বোঝা যায় যে, এর একটা অতীত ইতিহাস রয়েছে। যুক্তি অনুসরণ করে এই তত্ত্বকে অসত্য বলে প্রমাণ করা অসম্ভব। ধর্মতাত্ত্বিকরা এমন সিদ্ধান্ত করেছেন যে, আদম এবং ইভের নাভিস্থল ছিল। এতে বোঝা যায় যে, তারা সাধারণভাবেই জন্মগ্রহণ(৮) করেছিলেন। অনুরূপভাবে সবকিছু, যা সৃষ্ট হয়েছে, এসব এমনভাবে সৃষ্ট হতে পারে যে, এগুলো সব বিকশিত হয়েছে। শিলার মধ্যে জীবাশ্মভরা হয়ে থাকতেই পারে। এসব এভাবে তৈরি হবার ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির কাজ অথবা পাললিক শিলার জমাট এমন সৃষ্টির কারণ হতে পারে। কিন্তু একবার এই ধরনের সম্ভাবনা স্বীকার করে নিলে পৃথিবীর সৃষ্টিকে অন্য মুহূর্ত ছাড়া একটা বিশেষ মুহূর্ত বলে ভাবার কোনো কারণ থাকে না। যদিও এটা একটা যৌক্তিক সম্ভাবনা তবুও কেউ এটা বিশ্বাস করতে পারেন না। গস নিজেও তাঁর তিক্ত হতাশা নিয়েই বুঝেছিলেন যে, কেউ তার ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানের তথ্যের মিটমাটের যৌক্তিকভাবে প্রশংসনীয় উদ্যোগ বিশ্বাস করেন না। ধর্মতত্ত্ববিদরা তাকে এড়িয়ে তাঁদের আগেকার অনেকখানি দখল ছেড়ে দিলেন। বাকি যেটুকু রইল সেটুকুতে নিজেরা গেড়ে বসতে চাইলেন।

অবতরণ ও ভিন্নতার পথে গাছপালা এবং প্রাণীর ক্রমবিবর্তনের মতবাদ জীববিদ্যায় এসেছে অনেকটাই ভূবিদ্যার মাধ্যমে। এই মতবাদকে তিনটে অংশে ভাগ করা যায়। এক, প্রথম মতবাদটা হলো ঘটনা। দূরবর্তী যুগের ঘটনা যতটা নিশ্চিত হবার আশা করা যায়, ঘটনা ততটাই। জীবনের সরল আকারই হলো প্রাচীনতর। অধিকতর জটিল গঠনের জীবন প্রথম দেখা গেল পরবর্তী পর্যায়ে। দুই, এমন একটা তত্ত্ব রয়েছে যে, পরবর্তী এবং অধিকতর সংগঠিত আকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়নি। এগুলো আগের আকার থেকে ক্রম রূপান্তরের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে।

এটাকেই জীবিদ্যায় বিশেষভাবে ‘বিবর্তন’ বলা হয়। তিন, এখনও সম্পূর্ণতা থেকে দূরবর্তী বিবর্তনের কার্যকারিতার ব্যাখ্যা নিয়ে গবেষণা চলছে। এই কার্যকারিতার ব্যাখ্যা মানে ভিন্নতার কারণ এবং অন্য অনেকের মূল্যে কতিপয় ধরনের প্রাণীদের বেঁচে থাকা। বিবর্তনের সাধারণ মতবাদ এখন জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। তবুও এর কার্যকারিতার ব্যাখ্য নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। ডারউইনের মুখ্য ঐতিহাসিক গুরুত্ব হলো তিনি একটা কার্যকারিতার ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন। এটা হলো প্রাকৃতিক নির্বাচন। এটাই বিবর্তনের সম্ভাব্যতাকে তুলে ধরে। তার এই যুক্তি এখনও স্বীকার্য। তবুও এটা তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরীদের কাছে যতটা সন্তোষজনক ছিল, বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানীদের কাছে ততটা নয়।

বিবর্তনের মতবাদকে প্রথম যে-জীববিজ্ঞানী গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তিনি হলেন ল্যামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯)। তাঁর মতবাদটা অবশ্য গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এর কারণ, কেবলমাত্র প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তার প্রতি পূর্বসংস্কার নয়। উপরন্তু তিনি কার্যকারিতার যে-ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেটাও বিজ্ঞানবাদীরা গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি প্রাণীর মধ্যে একটি নতুন অঙ্গ তৈরি হয় প্রাণীটির ওই অঙ্গের নতুন চাহিদা থেকে। তাঁর আরও বিশ্বাস ছিল যে, একটি প্রাণীর জীবদ্দশায় যে-অঙ্গটি সংগৃহীত হলো সেটি তার সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত হয়। দ্বিতীয় প্রকল্পটি ছাড়া প্রথমটি অকার্যকারী বিবর্তনের আংশিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও। ডারউইন নতুন প্রগতির বিকাশে প্রথম প্রকল্পটি প্রত্যাখ্যান করেন। তবুও তিনি দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেন যদিও ল্যামার্কের তুলনায় তাঁর পদ্ধতিতে এর গুরুত্ব কম। দ্বিতীয় প্রকল্পটি, যেটি অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার, সেটি ওয়েইসম্যান কর্তৃক বলিষ্ঠভাবে অস্বীকৃত হয়েছে। এটা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। যে-সাক্ষ্য এখনও প্রবল তা হলো সম্ভাব্য বিরল ব্যতিক্রমসহ কেবলমাত্র অর্জিত বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারে বর্তায় যেগুলো জননকোষকে প্রভাবিত করে। এগুলো অবশ্য খুবই কম। এই কারণে ল্যামার্কের বিবর্তনের কার্যকারিতার ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যায় না।

লায়েলের Principles of Geology প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৩০ সালে। এই বইয়ে তিনি পৃথিবী ও প্রাণের প্রাচীনত্ব নিয়ে জোরালো সাক্ষ্যমূলক ঘোষণা রাখেন। এতে গোড়া ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়। এসব সত্ত্বেও তাঁর বইয়ের আগের সংস্করণগুলো জৈবিক বিবর্তন প্রকল্পের অনুকূলে ছিল না। আলোচ্য বইখানায় ল্যামার্কের তত্ত্বের খুব সতর্ক আলোচনা রয়েছে। এবং বৈজ্ঞানিক কারণেই তিনি ল্যামার্কের তত্ত্ব বাতিল করেছেন। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হলো ডারউইনের Origin of Species। এই বই প্রকাশের পরে লায়েলের বইয়ের পরবর্তী সংস্করণগুলোতে বিবর্তনতত্ত্বকে ক্রমপোষকতা করা হয়েছে।

ডারউইনের তত্ত্বের আবশ্যিক বিস্তার ছিল প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগতের অর্থনীতির অবাধ বাণিজ্য তত্ত্বের আদল পর্যন্ত। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বও ডারউইনের তত্ত্বকে পোষকতা দিয়েছে। সমস্ত সজীব বস্তু এত দ্রুত নিজেদের পুনরুৎপাদিত করে যে, এদের প্রত্যেকটি প্রজম্মের বেশি সংখ্যক উত্তরাধিকার রেখে যাবার বয়সে পৌঁছোনার আগেই মারা যায়। একটা স্ত্রী কডফিস্ বছরে প্রায় ৯,০০০,০০০ ডিম পাড়ে। এরা সবাই যদি পূর্ণবয়স্কে পৌঁছোয় এবং কড়ফিস্ জন্ম দেয় তাহলে সমুদ্র, কয়েক বছরে, কড়ফিসে ভরে যাবে। এতে ভূভাগেও নতুন মহাপ্রলয় শুরু হবে। এমনকি মানুষের জনসংখ্যা, যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার, হাতি ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে কম, তাও পঁচিশ বছরে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই জন্মহার আগামী দুই শতকে পৃথিবীব্যাপী চলতে থাকলে পরিণামে জনসংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ হাজার লক্ষে। কিন্তু ঘটনা হিসাবে আমরা দেখছি যে, প্রাণী এবং উদ্ভিদের সংখ্যা কার্যত মোটামুটি স্থিতিশীল। বেশিরভাগ সময়ে মানুষের জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও এটা সত্য বলে দেখা গেছে। সুতরাং প্রতিটি প্রজাতির নিজেদের মধ্যে এবং বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে একটা স্থায়ী ধারবাহিক প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের শাস্তি হলো মৃত্যু। এ থেকে বলা যায় যে, একটি প্রজাতির সদস্যরা অন্যদের থেকে কেমনভাবে আলাদা হলে, এটা তাদের বেশি সুযোগ দেয়, এটা বুঝলে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা অধিকতর হয়। এই পার্থক্য অর্জিত হলে সেটা এদের উত্তরপুরুষে রূপান্তরিত হবে না। কিন্তু এটা যদি সহজাত হয়, তাহলে এটার অন্তত অনেকাংশ তাদের উত্তরপ্রজন্মে পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা থাকে। ল্যামার্ক ভেবেছিলেন যে, উঁচু ডালে পৌঁছোনোর চেষ্টায় গলা বাড়িয়ে দেবার কারণে জিরাফের গলা লম্বা হয়। এবং এই গলা বাড়িয়ে দেবার প্রবণতা বংশানুক্রমিক। ডারউইনের ধারণা হলো যে, অন্তত ওয়েইজম্যানের রূপান্তরে, জন্ম থেকে জিরাফের প্রবণতা হলো লম্বা গলাপ্রাপ্তি, এর ফলে অন্যদের তুলনায় এদের অনাহারে থাকার সম্ভাবনা কম। এ কারণে এরা বেশি সংখ্যক উত্তরসূরী রেখে গেছে। এই উত্তরসূরীদের লম্বা গলা থাকার সম্ভাবনা। এদের মধ্যে কারো কারোর তাদের পিতামাতার লম্বা গলা থেকেও অধিকতর লম্বা গলা থাকতে পারে। এভাবে জিরাফ ক্রমে তার অদ্ভুত ধরনের বিকাশ ঘটাবে। এটা ঘটতে থাকবে সেই পর্যন্ত যখন বিকাশের দ্বারা গলা আর লম্বা করা যাবে না।

ডারউইনের তত্ত্ব নির্ভর করে আকস্মিক ভিন্নতার ঘটনার উপর। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, এর কারণ তিনি জানেন না। এটা একটা পর্যবেক্ষণজাত ঘটনা যে, একজোড়া প্রাণীর উত্তরপুরুষ হুবহু একরকম নয়। গৃহপালিত পশুদের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে কৃত্রিম নির্বাচনের ফলে। মানুষের হস্তক্ষেপে গরু বেশি বেশি দুধ দেয়, রেসের ঘোড়া দ্রুততর বেগে ছোটে, ভেড়া বেশি উল দেয়। এসব ঘটনা ডারউইনকে খুবই প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য জুগিয়েছে। নির্বাচন এই কাজগুলো করে থাকতে পারে। এটা সত্যি যে, প্রজননবিদ একটা মাছকে উপ-জঠরীতে রূপান্তরিত করতে পারেন না। অথবা একটা উপ-জঠরী প্রাণীকে একটা বাঁদরেও বদলে দিতে পারেন না। কিন্তু এ ধরনের বিশাল পরিবর্তনের জন্য অগণন যুগব্যাপী সময়সীমা দরকার। অধিকন্তু, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ বংশধারার সাক্ষ্যও ছিল। জীবাশ্ম এটা দেখিয়েছে যে, বর্তমানের ব্যাপক পৃথক প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রাণীর অতীতেও অস্তিত্ব ছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, টেরাডেকটাইল ছিল অর্ধ-পাখি, অর্ধ-সরীসৃপ। ভ্রূণবিদ্যাবিদগণ আবিষ্কার করেছেন যে, বিকাশের গতিধারায় অপরিণত প্রাণীরা আগের প্রাণীদের আকারের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। একটা স্তন্যপায়ীর ভূণের একটা বিশেষ স্তরে একটা মাছের কানকোর প্রাথমিক পর্যায়টা বর্তমান থাকে। স্তন্যপায়ীর জ্বণের পক্ষে এটা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। তবুও এটা থাকার বিষয়টাকে প্রাচীন বংশধারার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিভিন্ন ধরনের অনেক যুক্তিধারা যুক্ত হয়ে জীববিজ্ঞানীদের প্রত্যয় জাগিয়েছে। এ-প্রত্যয়ের মূল কথা বিবর্তনের ঘটনা এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনই প্রধান কারক, যার দ্বারা এসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

কোপার্নিকাসের মতবাদের মতো ডারউইনবাদও ধর্মতত্ত্বের প্রতি এক তীব্র আঘাত। এই আঘাতে বরবাদ করতে হয়েছে অনেক কিছু। প্রজাতির স্থায়িত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্ব ঘোষিত সৃষ্টির পৃথক কারণসমূহ বাতিল করতে হয়েছে। প্রয়োজন হয়েছে জীবনের সূচনা থেকে সময়ের বিরতির ধারণা গ্রহণ করা। এটা গোড়া ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে ছিল এটা শোকাবহ ব্যাপার। বাতিল করার প্রয়োজন হয়েছিল বিধাতার বদান্যতার শত যুক্তি। পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীদের নিখুঁত অভিযোজন, যেটা এখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ বলে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু উপরে-বলা একটি কিংবা সবকটি থেকে বিপর্যয়কারী কথা হলো বিবর্তনবাদীদের এই সোচ্চার ঘোষণা যে, নিম্নতর প্রাণী থেকে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। ধর্মতত্ত্ববিদরা এবং অশিক্ষিত মানুষেরা বস্তুত এই তত্ত্বটার একটা দিকের উপর সব জোর দিলেন। দিকটা হলো, ডারউইন বলছেন যে, ‘মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে বাঁদর থেকে।’ এ কথায় বিশ্ব আতঙ্কে সচকিত হয়ে উঠল। বিকৃত ভাষায় এটা বলা শুরু হলো যে, ডারউইন এটা বিশ্বাস করেন কারণ তিনি নিজে দেখতে একটা বাদরের মতো। (তিনি দেখতে তেমন ছিলেন না।) আমি যখন বালক ছিলাম আমার এক গৃহশিক্ষক নিরতিশয় গাম্ভীর্য নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, তুমি একজন ডারউইন পন্থী হলে আমি তোমাকে করুণা করি, কারণ একই সময়ে ডারউইনবাদী ও খ্রিস্টান হওয়া অসম্ভব।’ আজও পর্যন্ত আমেরিকার টেনিসি রাজ্যে বিবর্তন মতবাদ শিক্ষা দেওয়া বেআইনি। এর কারণ এই মতবাদকে ঈশ্বরের বক্তব্যবিরোধী বলে ভাবা হয়।

প্রায়শই যেমনটা ঘটে, ধর্মত্ত্ববিদরা এই মতবাদের প্রবক্তাদের তুলনায় দ্রুত এই নতুন ডারউইনি মতবাদের পরিণতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। প্রবক্তাদের অনেকেই ছিলেন ধর্মবাদী মানুষ। ডারউইনের হাজির-করা সাক্ষ্য থেকে প্রত্যয়ী হলেও এঁরা আগেকার বিশ্বাস যতটা সম্ভব ধরে রাখতে চাইছিলেন। প্রগতিকে, বিশেষত উনিশ শতকে এর প্রবক্তাদের মধ্যে, অনেকটাই সহজসাধ্য করার চেষ্টা হয়েছে। অন্য একটা পরিবর্তন গ্রহণ করানোর আগে অন্য আর একটা পরিবর্তনে তাদের অভ্যস্ত করানো হয়েছিল। নতুন কোনো উদ্ভাবনের সমুদয় যুক্তিগুলো একসঙ্গে হাজির করা হলে, মানুষের অভ্যাসটা এতটাই আঘাত পায় যে, মানুষ গোটা বিষয়টাকেই প্রত্যাখ্যান করে। পক্ষান্তরে,তাদের যদি প্রতি দশ অথবা বিশ বছরে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হত, তাহলে বেশি প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তারা প্রগতির পথে এগিয়ে যেত। বৌদ্ধিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে উনিশ শতকের মহান মানুষেরা সবাই বিপ্লবী ছিলেন না। কিন্তু কোনো সংস্কার প্রবলভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলে তারা এর সপক্ষে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন।উদ্ভাবকদের সতর্ক মানসিক অবস্থা উনিশ শতককে চূড়ান্ত দ্রুততায় প্রগতির জন্য বিশিষ্ট করে রেখেছে। ধর্মতত্ত্ববিদরা সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি বুঝতে পেরেছিলেন, কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা নির্দিষ্টভাবে বললেন, মানুষের অমর আত্মা রয়েছে যা বাঁদরের নেই। যিশুখ্রিস্ট মানুষদের উদ্ধারের জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন, বানরদের জন্য নয়। মানুষের মধ্যে ঐশ্বরীয়ভাবে সঞ্চারিত ভালো ও মন্দের একটা ধারণা আছে। পক্ষান্তরে, বাঁদরেরা পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি পরিচালিত। মানুষ যদি বোধাতীতভাবে বানর থেকে বিকশিত হয়, তাহলে ঠিক কোন্ মুহূর্তে আচম্বিতে তারা এসব ধর্মতত্ত্বীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করল? The Origin of Species বইটির প্রকাশের পরের বছর ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে বিশপ উইলফোর্স ডারউনবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন। উচ্চকিত কণ্ঠে বললেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতি ঈশ্বরের বাণীর সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু তার সমুদয় বাগ্মিতা ব্যর্থ হলো। সাধারণভাবে ভাবা হলো যে, ডারউইনবাদের প্রবক্তা হাক্সলি যুক্তিবিন্যাসে বিশপকে পরাজিত করেছেন। মানুষ তখন আর গির্জার অসন্তোষে ভীত নন। জীববিজ্ঞানীরা দ্রুত প্রাণী ও উদ্ভিদের বিবর্তন মতবাদ গ্রহণ করছেন। যদিও চিচেস্টারের (Chichester) ডিন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মোপদেশ সভার অক্সফোর্ডকে বললেন, যারা আমাদের প্রথম পিতা-মাতার সৃষ্টির ইতিহাস, এর স্পষ্টত আক্ষরিক অভিপ্রায় অনুযায়ী গ্রহণে অসম্মত এবং বিবর্তনের আধুনিক স্বপ্নকে এর স্থলাভিষিক্ত করতে চান, তারা মানুষের মুক্তির পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে দিতে উদ্যত। কার্লাইল কট্টরপন্থীদের গোড়া ধর্মমত নয়, কিন্তু প্রশ্রয় দিতেন কট্টরপন্থীদের অসহিষ্ণুতাকে। ডারউইন সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘নোংরা পুজোর বাণী প্রচারক।’

সাধারণ খ্রিস্টানদের অবৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গি বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন গ্লাডস্টোন। তখন তো উদারতার যুগ। যদিও এই উদারমনা নেতা তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এটাকে একটু ভিন্নতর করার। ১৮৬৪ সালে দু’জন যাজককে চিরন্তন শাস্তির ব্যাপারে তাঁদের অবিশ্বাসের জন্য শাস্তির চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কারণ প্রিভি কাউন্সিলের জুডিশিয়াল কমিটি এঁদের দু’জনকে মুক্তি দিয়েছিলেন। গ্লাডস্টোন আতঙ্কিত হলেন। তিনি বললেন যে, যদি বিচারের রায় অনুসৃত হত তাহলে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস এবং এর অস্বীকৃতির মধ্যে একটা সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত। ডারউইনের তত্ত্ব প্রথম প্রকাশের সময় শাসনে অভ্যস্ত মানুষের মতো সহানুভূতিশীল অনুভূতি প্রকাশ করে বললেন, “যে-প্রত্যয়ে বিবর্তনের কথা বলা হয় তাতে ঈশ্বর সৃষ্টির পরিশ্রম থেকে স্বস্তি পেলেন; অপরিবর্তনীয় বিধানের নামে তিনি বিশ্বশাসনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন। গ্লাডস্টোনের অবশ্য ডারউইনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত বিরোধিতা ছিল না। পরে তিনি ডারউইনবাদের বিরোধিতার রূপান্তরও ঘটিয়েছেন। ১৮৭৭ সালে অন্তত একবার তিনি ডারউইনের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বুলগেরীয় নিষ্ঠুরতা নিয়েই বিরামহীনভাবে কথা বলেছেন। তিনি চলে যাবার পরে ডারউইন সর্বিক সফলতায় মন্তব্য করলেন, কী দারুণ সম্মানের বিষয় যে, এরকম একজন বিখ্যাত মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন! ইতিহাস কিন্তু আমাদের জানালো না যে, গ্লাডস্টোন ডারউইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নিয়ে গেলেন কিনা।

আমাদের সময়ে ধর্ম নিজেকে বিবর্তনের মতবাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এমনকি এই মতবাদ থেকে নতুন নতুন যুক্তিও আহরণ করেছে। এখন আমাদের বলা হচ্ছে, যুগ যুগ ধরে একটা বর্ধিষ্ণু উদ্দেশ্য প্রবাহমান রয়েছে। এবং এটাও বলা চলছে যে, বিবর্তন হলো ঈশ্বরের মনোজগতে চিরকাল ধরেই বজায়-থাকা একটা ধারণার প্রকাশ। এটা মনে হচ্ছে যে, ওইসব যুগে হাগ মিলারকে যে-সব ঘটনা অস্বস্তি দিয়েছে সেসব হলো এইরূপ। প্রাণীগুলো ওদের নৃশংস শিং আর যন্ত্রণাদায়ক শৃঙ্গ-হুঁল নিয়ে একে অন্যের উপর অত্যাচার চালাচ্ছিল। সর্বশক্তিমান এসব দেখেও নীরবে অপেক্ষা করছিলেন শেষ পর্যন্ত মানুষের আবির্ভাবের জন্য। আর এই মানুষের আবির্ভাব ঘটলো নিপীড়নের আরও সূক্ষ্ম ক্ষমতা এবং অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত নিষ্ঠুরতা নিয়ে। স্রষ্টা তাঁর এই লক্ষ্যে সরাসরি না পৌঁছে একটা পদ্ধতিকে বেছে নিলেন কেন? আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদরা এ-লক্ষ্যে সরাসরি না পৌঁছে একটা পদ্ধতিকে বেছে নিলেন কেন? আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদরা এ-কথার কোনো উত্তর আমাদের জানান না। পরিসমাপ্তির এই গৌরব নিয়ে আমাদের সংশয় নিরসনে তারা বেশি কিছু বলেনও না। এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যেমনটা একটি বালকের মনে হয়। বালকটিকে বর্ণমালা শেখানোর পর তার মনে হয়, এটুকু পাবার জন্য এতটা কষ্ট করার প্রয়োজন ছিল না। যাই হোক, এটা একটা রুচির ব্যাপার।

আর একটি গুরুতর আপত্তি হলো, বিবর্তনের উপর ভিত্তি-করা যে-কোনো ধর্মতত্ত্ব। ষোল ও সতের শতকে মতবাদটি প্রথম প্রচলিত হয়। তখনই প্রগতি একটা বিশ্ববিধি বলে গৃহীত হয়। আমরা কী বছর বছর জ্ঞানে সমৃদ্ধশালী হচ্ছি না? এবং হ্রাসপ্রাপ্ত কর ব্যবস্থা সত্ত্বেও বাজেটের উদ্ধৃত্ততা কি ভোগ করছি না? আমাদের যন্ত্রপাতি-ব্যবস্থা কি বিশ্বের বিস্ময় ছিল না? আলোকপ্রাপ্ত বিদেশিদের অনুকরণের জন্য আমাদের পার্লামেন্টারি সরকার কি একটা মডেল ছিল না? এবং কেউ কি সন্দেহ করতে পারে যে, প্রগতি অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতেই থাকবে? বিজ্ঞান এবং যান্ত্রিক উদ্ভাবন যারা সৃষ্টি করেছে তাদের নিশ্চিন্তভাবেই বিশ্বাস করা চলে যে, তারা আরও অঢেল পরিমাণে এসব করতে পারবেন। এমনই একটা বিশ্বে বিবর্তনকে মনে হয় প্রাত্যহিক জীবনের একটা সামান্যীকরণ।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও, আরও বেশি চিন্তাশীলের কাছে অন্য একটা দিক প্রতীয়মান হয়। একই নিয়ম যেটা বিকাশকে সৃষ্টি করে, সেটা অবক্ষয়কেও তৈরি করতে পারে। একদিন সূর্য শীতল হয়ে যাবে এবং পৃথিবীর জীবনও থেমে যাবে। প্রাণী ও উদ্ভিদের গোটা ঐতিহাসিক কালটাই তীব্র তাপ এবং বেজায় ঠাণ্ডার যুগসমূহের একটা মধ্যবর্তী সময়। মহাজাগতিক অগ্রগতির কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু কেবল একটা ঊর্ধ্বমুখীন এবং নিম্নমুখীন দোদুল্যমানতা রয়েছে। এই দোদুল্যমানতার একটা ধীর প্রবণতা ভারসাম্যের উপর শক্তির ব্যাপনক্রিয়ার কারণে নিম্নমুখীন। এটাকে অন্তত বিজ্ঞান এখন খুবই সম্ভাব্য বলে মনে করে। এবং বর্তমানে আমাদের মোহমুক্ত প্রজন্মে এটা বিশ্বাস করা সহজ। আমাদের বর্তমান জ্ঞান যতটা সংশ্লিষ্ট তাতে বিবর্তন থেকে শেষ পর্যন্ত আশাবাদী-দর্শন সম্পর্কে কোনো যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছে না।

—–
১. আনুমানিক ২৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৭০/৭২ জন অনুবাদক কর্তৃক অনুদিত বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রীক অনুবাদ।–অনুবাদক

২. নেপচুনবাদী, তারা যারা বিশ্বাস করতেন জলের অবক্ষেপ থেকে অ-স্তরীভূত কঠিন শিলা গড়ে উঠেছে। ওয়ার্নার (১৭৪৯-১৮৭১) ছিলেন একজন কট্টর নেপচুনবাদী।–অনুবাদক।

৩. ভালকানবাদী তারাই, যারা বলতেন প্রাচীন আগ্নেয়গিরির লাভা জমাট বেধে শিলার সৃষ্টি।–অনুবাদক

৪. Principles of Geology. একাদশ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৭৪

৫. এই মতামত অসুবিধামুক্ত ছিল না। সেন্ট অগাস্টিন মাছি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের কারণটা বোঝার ব্যাপারে নিজের অজ্ঞতাকে স্বীকার করেছেন। লুথার, আরও সাহসিকতার সাথে সিদ্ধান্তে এলেন যে, মাছিগুলো সব শয়তানের সৃষ্টি। শয়তান এদের সৃষ্টি করেছে তার ভালো ভালো বই লেখার কাজে মনোযোগ নষ্ট করতে। পরের মতটা অবশ্যই আপাত-যুক্তিগ্রাহ্য।

৬. হোয়াইটের Warfare of Science with Theology বই থেকে উদ্ধৃত ।

৭. এই ধারণাটা সব সম্প্রদায়ের ছিল। এভাবে ওয়েসলে বলেন যে, মহাপতনের আগে, সব মাকড়সাই মাছির মতো নিরীহ ছিল এবং রক্তের জন্য ওত পেতে সে থাকত না।

৮. সম্ভবত এই কারণেই গস তার বইখানার নাম দেন Omphalos — লেখক
* Omphlos কথাটার দুটো অর্থ। (১) গ্রীসের ডেফিতে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু বলে অনুমিত স্থানে প্রোথিত শঙ্কু আকৃতির প্রস্তরফলক। (২) নাভি। এখানে নাভি অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *