1 of 3

০৫০. ভাঙনে নদীর ধারে বাড়িঘর

ভাঙনে নদীর ধারে বাড়িঘর করতে আছে বাবু? কাজটা ভাল হল না।

এ কি ভাঙনে নদী?

আগে তো খুব ভাঙত। আজকাল আঁটবাঁধ দেওয়া হয়েছে। এখন ভাঙছে না বটে, তবে নদীকে বিশ্বাস কি?

আমার যে এ জায়গাটাই পছন্দ।

পছন্দের কী আছে। গা-গঞ্জ জায়গা, গরিব দেশ। শখে শখে কিনলেন বটে, কিন্তু টেকা দায় হবে।

কেন, এখানকার লোক কি খুব খারাপ?

বাঁকা মিঞা মাথা চুলকে বলল, খারাপ ভাল নিজেই বুঝে দেখুন। গগন দাস দামখানা কি কম নিল? ঠারোঠোরে আপনাকে কত বললাম, বিশ হাজারের একটি পয়সাও ওপরে উঠবেন না। এ জমির দাম হাজার দশেক হলেই ঢের। তা আপনার তখন বাই চেপেছে, শুনলেন না। গগন দাস চেপে বসে রইল। ত্ৰিশ হাজারটা বড় বাড়াবাড়ি দাম হয়ে গেল কিন্তু একখানা মোটে ঘর আর তিন কাঠা জমির অত দাম হয়? গলাখানা বাড়িয়ে দিলেন বলেই না গগন কোপখানা দিল। খালধারে মহলের জমিটা কত সরেস ছিল, নিলেন না। দামটাও পড়তায় এসে যেত।

বাঁকা মিঞা বুঝবে না, কোনও কোনও জমির দাম শুধু টাকার নিরিখে হয় না। এইখানে নদী একখানা পেল্লায় বাঁক মেরেছে। বাকের একেবারে মুখে জমিখানা। আদিগন্ত থৈ থৈ করছে জল। নদীর দিকটায় একখানা দাওয়া ফুটিয়ে নিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাবে শুধু চেয়ে থেকে। নদী কখনও ক্লান্ত করে না, একঘেয়ে হয় না। হু হু করে পাগুলে হাওয়া বয় এইখানে। যদি ঝড় আসে তবে এইখানে বসে ঝড়ের আদিগন্ত রূপ দেখা যাবে। উথালপাথাল নদী, পাক খাওয়া মেঘ আর জলপ্রপ্রাতের মতো বৃষ্টি। গগন দাস দুপাঁচ হাজার টাকা বেশী নিয়ে থাকলেও হেমাঙ্গ সেটাকে ক্ষতি বলে মানে না। টাকা তত কাগুঁজে ভড়ং, কী দাম তার?

হেমাঙ্গ বাঁকা মিঞার দিকে তাকিয়ে বলে, একখানা বাথরুম করে দিতে পারবে।

বাঁকা মিঞা একটু হাসল, চাইলে পারব না কেন? তবে কলের জল তো পাবেন না। সে বন্দোবস্ত নেই। ডিজেল পাম্প বসালে অবশ্য হয়। তাহলে আবার ওপরে জলের ট্যাংক করতে হয়। অতটা করবেন কি?

না না, অত শহুরে ব্যাপার করলে মজাটাই মাঠে মারা যাবে। বালতির জলেই চলে যাবে। তবে একটা ঘেরা জায়গা না হলে আমার অস্বস্তি হয়।

হয়ে যাবে। মেঝেটা বাঁধিয়ে নেবেন। নইলে এখানে মা মনসার বড় উৎপাত। মেটে ভিটি হলেই গর্ত হবে। তেনারা সেঁধিয়ে বসে থাকবেন। পাকা মেঝে হলে খানিকটা নিশ্চিন্ত।

হেমাঙ্গ একটু বিবর্ণ হয়ে বলে, তাই করো।

বছরে কদিন থাকবেন?

মাঝে মাঝে চলে আসব। সারা বছর তুমিই দেখেশুনে রাখবে।

বাঁকা মিঞা একটা অসন্তোষের শ্বস ছাড়ল। সে গায়ের মাতব্বর লোক। গগন দাসের ঘরটা হেমাঙ্গ কেনায় সে খুশি হয়নি। না হওয়ারই কথা। জমি কতটা সরেস নিরেস তা বুঝবার মতো বিষয় বুদ্ধি তার হেমাঙ্গর চেয়ে কিছু বেশীই আছে। একটু আড়াআড়িও আছে গগন দাসের সঙ্গে।

কিন্তু হেমাঙ্গ খুশি। এইখানে সে এখন দুদিন থাকবে। নদীর মুখোমুখি। একা। আপনমনে। কাজের জঞ্জাল থাকবে না, শহুরে সমস্যা থাকবে না। বেশ থাকবে সে।

গগন দাসের মাটির ঘরখানা যথেষ্ট মজবুত। চালে নতুন টিন লাগানো হয়েছে। একখানা চৌকি ও বিছানার ব্যবস্থাও হয়েছে। টাকায় কি না হয়? বেশ কয়েক বছর আগে হেমাঙ্গদের কয়েকটা ট্রাক ছিল। সেগুলো ক্যানিং অবধি ট্রিপ মারত। সেই ট্রাকগুলোর একটা চালাত বাঁকা মিঞা! ট্রাকের ব্যবসাটা ভাল চলেনি। পরে সেগুলো বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু বাঁকা মিঞার সঙ্গে সম্পর্কটা রয়ে গেছে। বাদা অঞ্চলের লোক। বিচক্ষণ এবং বিষয়ী। এখন ক্যানিং-এর তার একখানা দোকান আর এই গাঁয়ে চাষবাস। দোকান ছেলেরা দেখছে। বাঁকা মিঞা গায়ে মাতব্বর হয়ে বসে একটু-আধটু পলিটিক্স করছে। হেমাঙ্গর কেন এই গাঁয়ে একটা বাড়ি করার দরকার হল তা গত সাতদিন মাথা ঘামিয়েও বাঁকা মিঞা বুঝতে পারছে না। তবে সাহায্য করছে।

আজ রাতে হেমাঙ্গ এখানেই থাকবে জেনে নিজের লোক ডাকিয়ে এনে ঘরদোর সাফ করিয়ে নিকিয়ে দিয়েছে। জল তুলিয়েছে। দুপুরে মাছভাত খাইয়েছে, রাতেও খাওয়াবে।

বিকেলের আলো এখনও যথেষ্ট আছে। লালচে হয়ে এসেছে বটে, তবু আদিগন্ত ফটোগ্রাফের মতো দেখা যাচ্ছে। সামনেই ভটভটির ঘাট। বাঁ দিক থেকে একটা খাল এসে বড় গাঙে মিশেছে। ঘাটে গোটা দুই ভ্যান রিক্সা দাঁড়ানো, সওয়ারি নেই। ইটে বাঁধানো সরু রাস্তার দুপাশে কয়েকটা দীন চেহারার দোকান ঘর। আর একটু ভিতরপানে এগোলে মানুষের অনাড়ম্বর ঘর-গেরস্থালি।

বাদায় কি মানুষ থাকে? আমরা হলাম জানোয়ার।

হেমাঙ্গ মুগ্ধ চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই খালটার ওপারে তার ফিয়াট গাড়িটা গঞ্জের ঘাটে এক দোকানের সামনে পার্ক করা আছে। দুটো দিন পেট্রল আর ডিজেলের গন্ধ নাকে আসবে না। শ্বাসবায়ুর জন্য পরিষ্কার বাতাস পাওয়া যাবে। আর হয়তো বা পাওয়া যাবে শহুরে নানা টানাপোড়েনে খন্ডবিখণ্ড হেমাঙ্গর ছিন্ন অংশগুলি। নিজেকে জুড়ে নেওয়া খুবই জরুরী এখন।

জানোয়ার! না, জানোয়ার হতে যাবে কেন?

তা নয় তো কী বলুন। এখানে মনিষ্যির জীবন আছে আমাদের? বাদার লোকের জন্য কে ভাবে বলুন। সরকারের তো মাথাব্যথাই নেই।

পলিটিক্স বুঝুক না বুঝুঁক-বাঁকা মিঞা সবসময়ে অন্যায় অত্যাচার অবিচার ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে। কথা শুরু হলে থামতে চায় না। হেমাঙ্গর এখন সে সবে দরকার নেই। সে এখন একা হতে চায়। চুপচাপ হতে চায়।

সে বলল, তুমি এসে গিয়ে বাঁকা। আমি ঘরে বসে জিরোই।

তা জিরোন। চা খাবেন কখন?

না হলেও হয়।

না হবে কেন? ভূষণের দোকানে বলে দিয়ে যাচ্ছি, যখন হাক মারবেন ঘরে পৌঁছে দিয়ে যাবে। রাতের দিকে একটু সজাগ থাকবেন, চোর আসে।

আমার সঙ্গে দামী কিছু নেই।

প্যান্টখান শার্টখানা তো আছে। কম্বল আছে, ঘড়ি আছে। চোরের তো বাছবিচার নেই। যা পাবে নিয়ে যাবে। তার লাভ না হোক, আপনার তো ক্ষতি।

ঠিক আছে, সজাগ থাকব।

পাকা বাঁশের একখানা লাঠি পাঠিয়ে দেবোখন, পাশে রেখে ঘুমোবেন। টর্চ আছে তো!

আছে।

তাহলে আপনি জিরোন গিয়ে। রাতে খাওয়ার সময় ডেকে নিয়ে যাবো।

বাঁকা বিদেয় হলে ঘরে এসে বিছানায় বসল হেমাঙ্গ। বড় নতুন আর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। তার। নিঝুম সম্মোহনের মতো কিছু একটা ঘনিয়ে উঠছে তার চারদিকে। জলের অবিরল কলকল শব্দ সৃষ্টি করছে রোমাঞ্চ। ঝাঁপের জানালাটা খোলা। সেইটে দিয়ে তাকালে নদীর প্রসার চোখে পড়ে। এখানে বড় গাঙ খুব চওড়া। কিছুক্ষণ বিছানায় আসনপিড়ি হয়ে বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকে হেমাঙ্গ। নদী তার বড় প্রিয়। নদীর দিকে চেয়ে থাকলে তার ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়।

বেলা আর একটু মরে এলে সে ঘরের বাইরে এসে তার তিন কাঠার সম্পত্তিটা ভাল করে আবার দেখল। চারদিকে বাঁশের নতুন বেড়া দেওয়া হয়েছে। গগন দাসের শখ আহ্রদ বিশেষ ছিল না। কয়েকটা গাদা গাছ লাগিয়েছিল, তাতে মরকুটে ফুল ফুটেছে। একখানা নারকেল গাছ আছে। আর কিছু আগাছা। গগন দাস এখাকার বাস তুলে বসিরহাট চলে গেল গুড়ের ব্যবসা করতে।

হেমাঙ্গকে দেখছিল আরও কয়েকজন। গুটিকয়েক বাচ্চা ছেলেমেয়ে আর একটা বউ-মানুষ। বেড়া ঘেঁষে যে মেটে রাস্তাটা আছে তার ওপাশে একটু ঢাল। সেইখানে তারা দাঁড়িয়ে। কলকাতার এক বাবু এ গায়ে ঘর কিনেছে—এটা একটা খবরের মতো খবর। হেমাঙ্গর একটু লজ্জা হল। সে ঘরে এসে ফের কিছুক্ষণ নদী দেখল। অনবরত ভটভটি, নৌকো আর লঞ্চের যাতায়াত। কত কাজে কত মানুষ কত দিকে যায়, আসে।

এখানে শীত বেশ চড়া। হাওয়াটা কনকন করছে বড়। হেমাঙ্গ জানালার ঝাঁপ ফেলে দিল। কিছুক্ষণ শুয়ে রইল চুপচাপ। এমন কাজহীন, ব্যস্ততাহীন সময় কি করে কাটাতে হয় তা সে এখনও শেখেনি। সময় লাগবে।

গত একমাস তার মন ভাল নেই। সে উদ্বিগ্ন, অশান্ত। তার একা এবং সুখী জীবনে কিছু একটা হানা দিচ্ছে। যেন কড়া নাড়ার শব্দ পাচ্ছে হেমাঙ্গ। সে চাক না-চাক ঘটনাটা হয়তো ঘটেই যাবে।

এটা ঠিক যে, হেমাঙ্গ চায় না। অন্তত তার মস্তিষ্ক চায় না। তার বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে সে প্রত্যাখ্যান করতে চায়। কিন্তু বুকের ভিতর কেন তবু একটা দুর্বলতা-রন্ধ্রপথও তৈরি হচ্ছে?

মাসখানেক আগে শনিবারের এক সকালে টেলিফোন এর, কী করছেন আজ?

কোনও প্রোগ্রাম করিনি তো!

আমি একটু এলে কি কিছু মনে করবেন? আমার একটা কথা আছে।

হেমাঙ্গর বুক নানা আশঙ্কায় একটু দুরুদুরু করে উঠল। কিন্তু বলতেই হল, আসুন।

রশ্মির আসতে ঘন্টা খানেক লাগল। বোধহয় সাজগোজের জন্য। এমনিতে কখনও তাকে সাজতে দেখেনি হেমাঙ্গ। মেদিন খুব ঝলমলে রেশমী শাড়ি পরেছে, চোখে বোধহয় কাজল বা সূৰ্মা জাতীয় কিছু। কিন্তু ভাল করে তাকাতেই পারছিল না হেমাঙ্গ। তার বুক বিট্রে করছিল। একটু শাসকষ্টও কি? কিছু একটা উথলে উঠছিল বুকের ভিতরে? ওই হেমাঙ্গকে তো সে চেনে না।

এ কী! পোশাক পরেননি যে এখনও? শীগগির করুন।

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, আমার কি কোথাও যাওয়ার কথা?

ওঃ, বলিনি বুঝি। আজ যে আমাদের বাড়িতে আপনার ভীষণ নেমন্তন্ন।

আগে বলেননি তো!

মুখটা একটু করুণ করে রশ্মি বলল, সেটা আমার দোষ নয়। নেমন্তন্ন যিনি করেছেন দোষটা তাঁর।

কে করছেন নেমন্তন্ন?

আমার মা। কিন্তু মা ভীষণ ভুলো মনের মানুষ। নেমন্তন্ন করবেন বলে ভেবেছেন, প্রিপ্যারেশনও নিচ্ছেন, কিন্তু আসল কাজটাই করতে ভুলে গেছেন। ভুলটা আজ সকালে ধরা পড়ল। মা ভীষণ লজ্জায় আছেন। আপনি কি কিছু মনে করবেন?

নাঃ। বলে হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ব্যাচেলরদের তো মতামতের দাম নেই। আর নেমন্তন্ন খেতে আমি পছন্দ করি। কিন্তু এখন তো সকাল নটাও বাজেনি। এখনই কি?

নেমন্তন্নটা ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু হবে যে। একদম সেই ডিনার অবধি। ও বাবা!

সেইজন্যই তো বলছিলাম ভীষণ নেমন্তন্ন। সহ্যশক্তির পরীক্ষা। আর শুনুন, ব্যাচেলর বলে কেউ আপনাকে কিন্তু বেশী অপমান করছি না। মায়ের ভুলো মন বলেই এই বিপত্তি।

একটু কাহিল মুখে হেমাঙ্গ বলে, ব্রেকফাস্টটা স্কিপ করলে হয় না? আমার যে সকালে খাওয়ার অভ্যাস বিশেষ নেই।

তাই কি হয়? পারফেস্ট ইংলিশ ব্রেকফাস্টটা তৈরি হচ্ছে দেখে এসেছি। শুধু আপনার জন্যই। ব্রেকফাস্টের পরই একটা আউটিং আছে। খাওয়া-দাওয়া সেখানেই।

কোথায় বলুন তো!

ডায়মন্ডহারবার রোডে। ঠাকুরপুকুর ছাড়িয়ে মাইল দুই গেলে একটা স্পষ্ট আছে। খুব সুন্দর একটা বাগানবাড়ি।

শুনে ভিতরটা নিয়ে ভরে গেল। সেই বাগানবাড়ি, সেই ফিস্টির মতো বিচ্ছিরি ব্যাপার, হয়তো বা সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা তাস খেলার ব্যবস্থা, হয়তো মদের বোতল। সবচেয়ে বড় কথা নানা রঙের, হরেক চরিত্রের একগাদা লোক, সেঁতা হাসি, সাজানো সাজানো কথা।

শঙ্কিত হেমাঙ্গ জিজ্ঞেস করল, বনভোজন নয় তো!

কয়েকজন থাকবে। আপনার অসুবিধে হবে তাতে?

না। অসুবিধে আর কি?

আপনি যে বেশী হুল্লোড় পছন্দ করেন না তা আমি জানি। বেশী লোককে বলা হয়নি। কিছু ক্লোজ রিলেটিভকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। দশ বারোজন। প্লীজ, তৈরি হয়ে নিন।

নিচ্ছি। কিন্তু আপনি একটু বসুন। এক কাপ কফি খান। এর আগে একদিন তো ধুলো-পায়ে বিদায় নিলেন।

রশ্মি বসল। মিষ্টি হেসে বলল, চা বা কফিতে আমি কিন্তু চিনি পাই না।

এই ছুটির দিনটায় এরকমভাবে হুল্লোড়ে বেরোতে একটুও ভাল লাগছিল না হেমাঙ্গর। কিন্তু রশ্মিরশ্মিই তাকে টানছে। ভীষণ টানছে। কফি করতে করতে এই সত্যটা হঠাৎ টের পায় সে। সারা দিন ভিড়ের মধ্যেও রশ্মির সুন্দর মুখখানা মাঝে মাঝে দেখা যাবে—সেই লোভ ফণা তুলছে ভিতরে। সে কি ব্ৰতভ্রষ্ট হচ্ছে। সে কি কামুক বা সংসারমুখী হয়ে যাচ্ছে। সে কি প্রেমে পড়েছে।

এই চিন্তাই তাকে অস্থির করে তুলল।

কফি খেতে খেতে আচমকা রশ্মির আর একটা প্রশ্নও অগাধ জলের দিকে ঠেলে দিল তাকে। রশি খুব মৃদু লাজুক গোয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ইংল্যান্ড জায়গাটা আপনার কেমন লাগে?

ইংল্যান্ড! কেন, ভালই তো।

কতটা ভাল?

খুব ভাল। জিনিসপত্রের দাম একটু বেশী এই যা।

আমি সে কথা জানতে চাইছি না। ইংল্যান্ডে যদি সেটল করতে হয় তাহলে কেমন লাগবে আপনার?

হেমাঙ্গ একটু শিহরিত হয়। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে বলে, ভাল লাগবে না।

কেন?

নিজের দেশ ছাড়া আমার কোথাও ভাল লাগবে না। আমি একটু হোম-সিক।

ইংল্যান্ড থাকারও একটা আলাদা চার্ম আছে। আপনি তো মাত্র কিছু দিন ছিলেন। বেশী দিন থাকলে বুঝতে পারতেন।

গলাটা সামান্য বিষণ্ণ শোনাল কি রশ্মির? কানের ভুলও হতে পারে। খুব সংকোচের সঙ্গে হেমাঙ্গ বলল, হঠাৎ ইংল্যান্ডের কথা বললেন কেন?

রশ্মিও খুব সংকুচিত হয়ে বলল, এমনিই।

অজানা আশংকায় বুকের মধ্যে অস্থিরতাটা একটু বেড়ে গেল হেমাঙ্গর।

রশি কফির কাপটা রেখে বলল, কখনও তেমন দরকার হলেও ইংল্যান্ডে সেটল করতে পারবেন না।

বিস্ময়ের একটা ভান করতে হল হেমাঙ্গকে। বলল, ইংল্যান্ডে সেটল করার কোন দরকার হবে কেন তাই বুঝতে পারছি না। কেউ তো আমাকে ডাকাডাকি করছে না ইংল্যান্ড থেকে।

যদি করে?

হেমাঙ্গ এ প্রশ্নটার কোনও নির জবাব দিতে পারল না। রশ্মির অসাধারণ মুখশ্রী অবলোকন করতে করতে স্তিমিত গলায় বলল, আগে তো ডাকুক। সেখানেই কত লোক বেকার বসে আছে।

আমি শুধু যদি-র কথা বলছি। যদি ডাক পান, যাবেন?

হেমাঙ্গ বুঝতে পারছে, তার সঙ্গে রশ্মির যে খোলামেলা হাসিঠাট্টার সম্পর্কটা ছিল সেটা হঠাৎ বদলে গেছে। দুজনেরই কিছু সংকোচ বোধ করছে। একটা সূক্ষ্ম লজ্জার পর্দা দুজনের মাঝখানে বার বার উড়ে আসছে। রশ্মি যে আর এক বছরের মধ্যেই স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে চলে যাবে তা জানে হেমাঙ্গ। হেমাঙ্গকে কে ডাকবে তাও সে বুঝতে পারছে। চারুদিদি কী যে অঘটন ঘটিয়ে দিল।

নেমন্তন্নটাও ছিল খানিকটা অদ্ভুত। হেমাঙ্গর বুঝতে অসুবিধে ছিল না যে, নেমস্তুন্নের মধ্যমণি সেদিন ছিল সে-ই। রশ্মির মা ব্রেকফাস্ট থেকেই তার ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে শুরু করলেন। রশির রাশভারী বাবা অবধি তার সঙ্গে বেশ কয়েকটা প্রাসঙ্গিক কথা বলে ফেললেন।

বাগানবাড়িতে জড়ো-হওয়া আত্মীয়স্বজনরাও সেদিন সব ফেলে তার ওপর মনোযোগ দিতে লাগল। বহুকাল এরকম তি আই পি ট্রিটমেন্ট পায়নি সে। সবাই যেন তটস্থ, অতি অমায়িক, অতি সতর্ক। আর চারদিক থেকে জোড়ায় জোড়ায় কৌতূহলী চোখ তাকে বিদ্ধ করল সেদিন।

এমন অস্বস্তির মধ্যে যে আর কখনও পড়েনি। ভাল বাদ্যবস্তু তার অতিশয় প্রিয়। কিন্তু সেদিন সে খাবারের স্বাদগন্ধ বুঝতেই পারল না মানসিক উদ্বেগে। শুধু লক্ষ করল, লোকজনের সামনে রশ্মি তার কাছে বেশী আসছে না, কথাও বলছে না। কিন্তু দূর থেকে মাঝে মাঝে তাকে চেয়ে দেখছে। এক-আধবার তারা দুজনে দুজনের দিকে ৫ে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে চেয়েও রইল।

এক ফোঁটা মদও খায়নি হেমাঙ্গ, তবু যখন বাড়ি ফিরল তখন যেন টলোমলো অবস্থা। সে নয়, তার ভিতরটার অচেনা হেমাঙ্গ গলায় একটা ফাঁস আটকে বসে আছে।

সেই রাতেই ফোন করল চারুশীলা, এই গবেট, কেমন হল আজকের পিকনিক?

তোকে পিকনিকের কথা কে বলল?

আমার স্পাই আছে। বল না কেমন হল।

ভালই।

শুধু ভাল? আর কিছু নয়?

পিকনিকের মধ্যে আবার আর কিছু কি থাকবে?

তোকে কি সাধে গবেট বলি! তবু তরে গেছিল।

তার মানে?

যদিও তুই একটি আস্ত হাঁদারাম আর চূড়ান্ত অপদাৰ্থ, তবু কি করে যে পার পেয়ে যাস সেটা ভেবেই অবাক হই। বোকা আর অপদার্থের জন্যই বোধহয় ভগবান খেটে মরেন।

হেমাঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলে, ব্যাপারটা কী খুলে বলবি?

অনেকবার বলেছি। এরপরও না বুঝলে বুঝতে হবে তোর মাথা একদম নিরেট। কি করে সি এ পাশ করলি রে? সি এ পড়তে বুঝি মগজ লাগে না?

বেশীই লাগে। সে কথা থাক। ব্যাপারটা কী ছিল?

ওদের সবারই তোকে দারুণ পছন্দ।

ওরা কারা?

রশ্মির মা বাবা আত্মীয়স্বজন। ওরাও আমাদের মতো একটু ক্ল্যানিশ। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে খুব ভাল-ভালবাসা।

আমাকে পছন্দ করার ওরা কে?

কেন, তুই-ই বা এমন কে যে পছন্দটাও করা যাবে না তোকে?

কথা ঘুরিয়ে দিস না। আসলে কথাটা কী?

আহা, ন্যাকা! সবাই তো বুঝি, তবে অত বোকা সাজছিস কেন? রশ্মির মা-বাবার আগেই পছন্দ হয়েছিল। আজ আত্মীয়রাও দেখল। তাতে কি দোষ হয়েছে।

দোষী জানে না কী দোষ তাহার, বিচার হইয়া গেল? আমাকে পছন্দ করছে, কিন্তু আমার মতামতটাও তো নেওয়া দরকার।

তোর আবার অমতের কথা ওঠে কেন? ওরকম পাত্রী পাচ্ছিস সেই তোর ভাগ্য। তাই তো বলছিলাম, বোকাদের জন্য ভগবান আছেন।

বিয়ে আমি করছি না।

অত তড়পাতে হবে না। রশ্মিকে দেখলে তো চোখ দিয়ে নাল গড়ায়। বিডন স্ট্রিটে খবর হয়ে গেছে। বিয়ে করবি কি না করবি সেটা মামা বুঝবে। তোর ইচ্ছেয় সব হবে নাকি?

ইয়ার্কি করিস না চারুদি। আমার ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।

রশ্মিকে তোর পছন্দ নয়?

রশ্মির কথা উঠছে কেন?

উঠবারই কথা কিনা। ওরকম মেয়ে লাখে একটা পাওয়া যায় না, তা জানিস? অমন চেহারা, ফিগার, কোয়ালিফিকেশন একসঙ্গে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?

কথা এই পর্যন্তই হয়েছিল। সে রাতে হেমাঙ্গ ভাল করে ঘুমোতে পারল না।

পরের সপ্তাহের শনিবার রশ্মিই ফোন করল। রাত দশটার পর। প্রথম প্রশ্নটাই চমকে দিল তাকে।

কী করছো?

বিস্মিত হেমাঙ্গ আমতা আমতা করে বলে, টিভি দেখছি।

একটু কথা বলে আমার সঙ্গে।

কথা! বলে স্তব্ধ হয়ে গেল হেমাঙ্গ। ও তাকে তুমি করে বলছে, তারও কি বলা উচিত? গলা ঝেড়ে হেমাঙ্গ বলল, তোমার বুঝি ঘুম আসছে না?

না। হঠাৎ তোমার কথা মনে হল। একটু কথা বলবে? প্লীজ?

কী বলব বলো তো!

যা খুশি। আবোল-তাবোল।

হেমাঙ্গর মন বার বার ব্ৰেক কষছে। এগোতে পারছে না। কথা হারিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে, বুদ্ধি ও বিবেচনার বিরুদ্ধে এ সে কোন আবেগে ভেসে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *