চেতনার অন্ধকারে

চেতনার অন্ধকারে

সকলের মুখে এক কথা।

সকলের মুখে একই প্রশ্ন। একী, ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

কী রকম দেখাচ্ছে? ললিতাকে কি আর চেনাই যাচ্ছে না? দেড় মাসের মধ্যে একটা মানুষের একটি মেয়ে কতখানি বদলে যেতে পারে, কত পরিবর্তন হতে পারে যে, সকলের, সবাইয়ের মুখে কেবল এক কথা, একই জিজ্ঞাসা, লিলিতাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? দেড় মাস বাদে বেড়িয়ে ফিরল। যাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল, তাদের সবাইয়েরই রীতিমতো চেহারা ফিরে গিয়েছে। ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

বাড়ির সবাই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলল। ললিতাকেও জিজ্ঞেস করল। ললিতা সকলের সামনেই হাসল। হেসে অবাক হয়ে, ভুরু বাঁকিয়ে পালটা প্রশ্ন করল, কেমন আবার দেখাচ্ছে। আমি যেমন ছিলাম, তেমনিই আছি। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

কথাটা কেউ বিশ্বাস করল না। বাড়ির সবাই ওর মুখের দিকে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। ললিতার হাসির মধ্যে গভীর কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে কিনা, বোঝবার চেষ্টা করল ওর মুখের দিকে চেয়ে। কিন্তু সকলের মুখ দেখেই বোঝা গেল, কেউ কোনও রহস্য উদ্ধার করতে পারছে না।

এমনকী, ললিতা যাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল, বড় দাদা আর বড় বউদি, তারাও অবাক। তাদেরও একই জিজ্ঞাসা। ওর বড়দা, একমাস আগে, বাইরে থাকতেই জিজ্ঞাসা করেছিল, হ্যাঁ রে ললু, তোর কি শরীর-টরীর খারাপ হয়েছে নাকি?

ললিতা জবাব দিয়েছে, না তো।

বউদি বলেছে, কিন্তু তোমাকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

 ললিতা হেসে বলেছে, কোথায়?

বড়দা বলেছে, না না, হাসির কথা নয় ললু, শরীর যদি খারাপ হয়ে থাকে, বলবি তো। তোর বউদি বলছিল, কদিন ধরে তোকে যেন কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। চুপ করে বসে যেন কী ভাবিস?

মনে পড়ছে, ললিতা তখন দাদা বউদির সঙ্গে, বম্বে ছেড়ে হায়দ্রাবাদের দিকে চলেছে। চলেছে মানে, বম্বে থেকে যেদিন অওরঙ্গাবাদ যাওয়া হবে, তার আগের দিন রাত্রে, হোটেলের ঘরে বসে এই সব কথাবার্তা চলছিল।

দাদার কথা শুনে ললিতা আবার তেমনি করে হেসেছিল। বলেছিল, বউদি ভুল দেখেছে।

ললিতা টের পেয়েছিল, বউদি ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল। বউদি যেন ওর মুখ আর শরীরের দিকে দেখে, কিছু আবিষ্কার করতে চাইছিল। বলেছিল, সেটা না হয় ভুল দেখেছি ভাই, প্রায় দিন তিনেক ধরে তুমি মোটেই ভাল করে খাচ্ছ না, সেটাও কি ভুল দেখেছি?

ললিতা তখন শব্দ করেই হেসে উঠেছিল। বলেছিল, কী যে বলো তুমি বউদি, তার ঠিক নেই। হঠাৎ আমি কম খেতে যাব কেন?

দাদা বউদি দুজনেই ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে, খানিকক্ষণ চুপ করে ছিল। তখনকার মতো, বউদি আর কোনও কথা না বলে, সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। চলে যাওয়ার ভঙ্গি থেকেই বোঝা গিয়েছিল, বউদি রাগ করেছে। করাটাই স্বাভাবিক, কারণ বউদির সঙ্গে ওর যথেষ্ট সখিত্ব। বউদির একটা দাবি আছে, ললিতার কিছু হয়ে থাকলে, ও তা নিশ্চয়ই তাকে বলবে।

দাদা আবার জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যাঁ রে, বেড়াতে বেরিয়ে মন-টন খারাপ হয়নি তো?

ললিতা বলেছিল, কেন?

কেন আবার কী, হয়তো যে কোনও কারণেই তোর ভাল লাগছে না। আমাদের সঙ্গে বেড়াতে হয়তো ভাল লাগছে না।

ললিতা বলেছিল, কী যে বলো তুমি দাদা। খারাপ লাগলে তোমাদের সঙ্গে আমি বেরোতাম নাকি।

দাদা বলেছিল, তখন হয়তো বুঝতে পারিসনি।

ললিতা বলেছিল, মোটই না। আমার সে সব কিছুই হয়নি। তোমরা মিছিমিছি ভাবছ। আমি বেশ ভালই আছি।

দাদা একটু চুপ করে থেকে, গলা নামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেছিল, মায়া কিছু বলে টলেনি তো?

মায়া মানে বউদি। ললিতা তখন সত্যি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, কী যে বলো তুমি দাদা।

তখন দাদার মুখেও হাসি ফুটে উঠেছিল। একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

 কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। অওরঙ্গাবাদ গিয়ে, অজন্তা ইলোরা দেখে, কয়েকদিন পরে হায়দ্রাবাদ গিয়ে, আবার একই প্রসঙ্গ উঠেছিল। না উঠে পারেনি, কারণ ললিতার চেহারাটা সত্যি খারাপ দেখাচ্ছিল। ওর দাদাও তখন নিশ্চিত হয়েছিল, ললিতার মধ্যে কেমন যেন একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ললিতা যে অন্যমনস্ক হয়ে একলা একলা কিছু ভাবে বা প্রায়ই একলা থাকতে চায়, সেটা আর লুকোনো যাচ্ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যে অমনোযোগী হয়ে উঠেছিল, সেটাও দাদার চোখে পড়েছিল।

হায়দ্রাবাদে ওরা কোনও হোটেলে ওঠেনি। সেখানে ললিতার মেজদা থাকত, হায়দ্রাবাদই তার চাকুরিস্থল। সেখানে মেজোবউদিও ছিল। মেজদা-মেজোবউদি অবিশ্যি, সেরকম কিছু বুঝতে পারেনি। কারণ তারা দুজনেই অনেকদিন পরে ললিতাকে দেখেছিল। কিন্তু সব কথা শোনার পরে, তাদের মনেও একটা সন্দেহ জেগেছিল, তা হলে হয়তো কিছু ঘটেছে। যদিও ঘটনা ঘটবার মতো কিছু থাকতে পারে না, বা কোনও অবকাশই ছিল না। কিছু ঘটলে, বড়দা-বড়বউদি নিশ্চয়ই জানতে পারত।

মেজোবউদি একটু চপল প্রকৃতির। সে বলল, পথের মাঝে উড়ো প্রেম করে বসনি তো?

 ললিতা ঠোঁট টিপে হেসে বলেছিল, হতে পারে, তোমরা যখন বলছ।

মেজদা একটু সাদাসিধে সরল ধরনের মানুষ। বলেছিল, বলেই ফ্যাল না বাপু, যদি কিছু ঘটে থাকে।

ললিতা বলেছিল, কী আশ্চর্য, বলব আবার কী। কিছুই তো ঘটেনি।

মেজদা বলেছিল, আমি অবিশ্যি সেরকম কিছুই বুঝতে পারছি না। বড়দাবউদি বলছে, তাই জিজ্ঞেস করছি।

বড়দা মেজদাকে বলেছিল, তুই কিছু জানিস না। ললু যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, তখন বেশ তাজা হাসিখুশি। তারপরে দিন পনেরো যেতে না যেতে দেখি, কেমন যেন সব সময়েই মুষড়ে আছে। চোখের কোল বসে যাচ্ছে। ওর মুখের চেহারা দেখে বুঝতে পারছিস না কিছু?

মেজদা ললিতার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ললিতা হেসে উঠেছিল। মেজদা বলেছিল, ও সব তুমি বুঝবে না বড়দা। মেয়েদের মনে মনে কী সব হয়। অত বুঝতে গেলে চলে না, ছেড়ে দাও।

বড়দা বলেছিল, মেয়েদের কোনও ব্যাপার হলে তোর বউদি বুঝতে পারত না?

বড় বউদি মনে মনে অভিমান পুষেই রেখেছিল। বলে উঠেছিল, না না, এখনই কিছুই বুঝতে পারি না।

মেজদা বলেছিল, তা হলেই বোঝ, ও সব যার যার ব্যাপার, সে বুঝবে। বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তবে দেখিস ললু, কোনও বাজে অসুখ-বিসুখ বাধিয়ে বসিস না। আর যা খুশি তা-ই কর গে যা।

হায়দ্রাবাদের দিনগুলো যা তোক এক রকম কেটে গিয়েছিল। কিন্তু কলকাতায় ফিরে এসে আর মুক্তি পাওয়া গেল না। বিশেষ করে মায়ের চোখকে কোনও রকমেই ফাঁকি দেওয়া গেল না। মা ললিতাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রেললু, চেহারাটা এমন খারাপ করে ফিরলি কী করে?

ললিতাকে মায়ের কাছে একটু বিশেষভাবে সাবধান হতে হল। মুখের স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখে বলল, খারাপ কোথায় দেখছ মা?

মা অবাক হয়ে বললেন, খারাপ কোথায় দেখব আবার, তোমার চেহারায় দেখছি। মুখের সেই ঢলঢলে ভাব নেই, যেন চোপসানো। চোখের কোলে কালি।

ললিতা বলল, আমি তো কিছু দেখতে পাই না।

মা বললেন, তা হলে বলব, তোমার চোখের দৃষ্টিও নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এ সব কথা বলে তো কোনও লাভ নেই। তোমরা লেখাপড়া শিখেছ, দশ জনের সঙ্গে মেলামেশা কর। তোমাদের এভাবে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? মনের দিক থেকে বা শরীরের দিকে কিছু হয়ে থাকলে, সে কথা বলতেই

ললিতা জানে, মা রেগে গেলে সবাইকে তুমি বলেন, তা না হলে তুই। মায়ের কথা শুনে, ললিতার বুকের মধ্যে এবার যেন গুর গুর করে উঠল। একটা ভয় যেন ছায়া ফেলল ওর মনে। তথাপি ও নিজেকে শক্ত রাখল। বলল, কিন্তু কিছু না হলে, কী বলব মা।

মা কয়েক মুহূর্ত ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও কারণে যেন তোমার আহার-নিদ্রা ঘুচে গেছে। কেন, আমি সেটাই জানতে চাইছি। দাদা বউদির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?

ললিতা বলল, মোটেই না।

মা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, তবে? প্রবীর চিঠিতে সে রকম কিছু লিখেছিল?

এক মুহূর্তের জন্য, ললিতার মুখে কথা আটকে গেল। ওর মুখ একটু লাল হয়ে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না না, কী আবার লিখবে?

মা ললিতার মুখের প্রতিটি অংশে চোখ বুলিয়ে দেখছিলেন। বললেন, কত কী লিখতে পারে, মন্দ যে কোনও কথা।

ললিতা বলল, না।

প্রবীর চিঠি লিখেছিল তো?

ললিতা বুঝতে পারছে, সংশয় আর সন্দেহ, মাকে কোন উৎকণ্ঠার কূলে টেনে নিয়ে গিয়েছে। বলল, দিয়েছিল। ও সব কিছু ভাবতে হবে না মা।

মায়ের মুখে যেন একটি নিশ্চিন্ত ভাব দেখা গেল, কিন্তু জিজ্ঞাসা শেষ হল না। বললেন, তা হলে কী ভাবতে হবে, বলবে তো।

ললিতা বলল, কিছুই ভাবতে হবে না।

কিন্তু মায়ের চোখ থেকে সন্দেহের ছায়াটা একটুও সরল না। তিনি কয়েক মুহূর্ত ললিতার মুখের দিকে চেয়ে থেকে, হঠাৎ একটি নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, তোমরা যথেষ্ট বড় হয়েছ, বলবার কিছুই নেই। নিজেদের ভাল-মন্দ বোঝবার মতো বিদ্যা বুদ্ধি তোমাদের আছে। কিছু বলতে না চাও, বোলো না। কিন্তু সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা মায়েদের সবসময়েই থাকে।

মা আস্তে আস্তে ললিতার সামনে থেকে চলে গেলেন। মায়ের বক্তব্য বুঝতে ললিতার কোনও অসুবিধা হল না। ললিতা যা-ই বলুক, মায়ের দুশ্চিন্তা ঘুচবে না। মা সে কথাটাই জানিয়ে দিয়ে গেলেন।

ললিতা নিজের ঘরে এল। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করল। তারপরে হঠাৎ রুদ্ধ নিচু স্বরে বলে উঠল, আমি কী করব, আমি কী করব। উহ, আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে, আমি যেন তিলে তিলে মরে যাচ্ছি। আর সহ্য করতে পারছি না।

বলতে বলতে ললিতা ছুটে গিয়ে ওর বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিছানায় মুখ গুঁজে সহসা উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল। সারা শরীর ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। কান্নার মধ্যে একটা মুক্তি আছে, যেন অনেক জমানো অন্ধকার ধুয়ে মুছে দিয়ে যায়। কিন্তু সেই অঝোরে কান্নাটা কাঁদা হল না। ললিতার কান্নার বেগটা যেন সহসাই থেমে গেল, ও উঠে বসল। লাল ফোলা চোখ, জলে ভেসে যাচ্ছে। অথচ ললিতা যেন একটা চকিত উৎকণ্ঠায় উঠে বসল। উৎকণ্ঠা ফুটে উঠেছে ওর চোখে। গালের পাশে, কপালে রুক্ষ চুল ছড়িয়ে পড়েছে। গা থেকে আঁচল লুটিয়ে পড়েছে বিছানায়। স্থির চোখের দৃষ্টি মেঝের দিকে।

অনেকক্ষণ এক ভাবে পাথরের মতো বসে রইল। তারপর এক সময়ে নিজেরই নিশ্বাসের শব্দে যেন চমকে উঠল। প্রথমেই বন্ধ দরজাটার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর নিজের এলোমলো কাপড়, কোলের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। এখন ওকে কেমন আচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। ওর চোখে যেন নিশির ঘোর। ঘরের এক পাশে বড় আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রাখল।

ললিতা যেন নিজেকে চিনবার চেষ্টা করছে। নিজের চোখে চোখ রেখে, ও নিজেই যেন অবাক হয়ে ভুরু কোঁচকাল। ওর চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। ফিসফিস করে বলে উঠল, তুমি সেই ললিতাই তো। ললিতা! ললিতা!…

সেই ললিতাই, কিন্তু যেন সেই ললিতা নয়, দেড় মাস আগে যে মেয়েটি এ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। সেই ফরসা উজ্জ্বল স্বাস্থ্যবতী মেয়েটি। যার হাসিতে মুক্তা, ডাগর কালো চোখে হিরার দ্যুতি। ললিতার রূপের বর্ণনা দিতে গেলে প্রাচীন শব্দগুলো ব্যবহার করা যায়। গৌরাঙ্গী, সুবর্ণের ছটা যে অঙ্গে দেখা যায়। ক্ষীণ কটি, প্রশস্ত নিতম্বিনী, রোমহীন-নাভিস্থল, পীন বক্ষ। মধ্যোন্নত নাসা, বিঘোষ্ঠা, মৃগনয়না।

ললিতার রূপের খ্যাতিটা স্বাভাবিক ভাবেই ওর স্কুল কলেজের সীমানা পেরিয়ে আরও বহুদূরে বিস্তৃত। যে কারণে দাদাদের বন্ধু থেকে শুরু করে আরও অনেকেই ওকে ঘিরেছিল, বর্ণালী গ্রীবাদ্ধোত পায়রাদের মতো যাদের বকবক শুনে শুনে রূপসীর কান পচে গিয়েছিল। এখনও যায়, কিন্তু প্রবীর নামে একজনের সঙ্গে মালাবদলের কথাটা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যাবার পরে অনেকে সরে পড়েছে।

আয়নার সামনে এখন কি সেই ললিতাই দাঁড়িয়ে আছে? সত্যবাদী কেবল ললিতা, আর সকলেই মিথ্যুক? সকলের চোখই কি বন্ধ? ললিতা আয়নার সামনে আরও এগিয়ে গেল, এত কাছে, এত কাছে যেন আয়নার গায়ে নিজেকে ঠেকিয়ে ধরল। নিশ্বাস লেগে আয়নার গায়ে একটু ঝাঁপসা দাগ লাগল। ললিতা নিজের মুখ দেখতে লাগল। চোখের কোলে সুবর্ণের ছটা নেই, যেন কালি লেগেছে মুখে। সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই, মুখ যেন শীর্ণ হয়ে উঠেছে। চোখের কালো তারার সেই দ্যুতি নেই, হাসিটা নিতান্ত কাচের ঝনঝনানি। পঁচিশ বছরের রূপসী ললিতার প্রাণের শব্দে তা বাজে না।

নিজেকে দেখতে, হাত তুলে আঙুল দিয়ে মুখের সব জায়গায় বুলিয়ে দেখল। দেখতে দেখতে ঠোঁটে এসে থামল। রক্তোষ্ঠের সেই ঝলক কোথায় গেল। দুহাত তুলে সামনে নিয়ে দেখল। ডানার দিকে দেখল, গলার দিকে দেখল, তারপরে হঠাৎ বুকের জামার বোতাম একটা একটা করে খুলে ফেলল। ভিতরে কোনও অন্তর্বাস নেই, আয়নায় প্রতিবিম্বিত মুক্ত বক্ষ। পীন বক্ষ। সহসা মনে হয় বুকে এখনও সুবর্ণের ছটা, উদ্ধত নয়, নও নয়, যেন প্রকৃতি! তার আপন মহিমায় স্বপ্নের ঘোরে রয়েছে। নির্লোম রক্তিম বৃন্ত।

ললিতা চেয়ে দেখল, যেন কিছু খুঁজে পেতে চাইছে। কী খুঁজছে ললিতা? কোনও কাম তপ্ত নখরের দাগ, দংশনের চিহ্ন? কোনও দাগ নেই, নিষ্কলঙ্ক। রঙের পরিবর্তন অথবা ভার? কিছুই বোঝা যায় না। নিজেকে তো এমনি যেন দেখে এসেছে। নতুনের কোনও দাগ লেগেছে বলে তো মনে হয় না।

বুকের নীচে পেটের দিকে তাকাল। কোমরের শাড়ির বন্ধনীতে হাত রাখল। ললিতা কি নিজেকে একেবারে নগ্ন করে দেখবে? নিজেকে তন্ন তন্ন করে দেখবে?

তারপরে হঠাৎ যেন কিছু মনে হয়, আবার মুখ তুলে চোখে চোখে তাকায়। তাকাতেই সহসা দমকা ঝাপটা লেগে যেন ওর ঠোঁট কেঁপে ওঠে, দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে যায়, চোখের কোণে জল জমে ওঠে। বুকের ওপর দু হাত চেপে, বারে বারে ঘাড় নাড়তে থাকে, অস্ফুট স্বর শোনা যায়, না না না।..

.

সন্ধেবেলায় প্রবীর এল।

ললিতার সঙ্গে দেখা হবার আগেই, নীচের তলায় তার গলার স্বর শোনা গেল। একটু পরেই প্রবীর ৬৩২ ওপরে আসবে। এখন তো প্রবীরের আর কোনও বাধা নেই। অনেক দিন ধরেই, কোনও বাধা নেই। ললিতার কাছে তার অবারিত দ্বার। বাড়ির সকলে শুধু মেনে নেয়নি, এখন সকলের কাছে প্রার্থিত। প্রবীর ওপরে যাবে, ললিতার সঙ্গে দেখা করবে, কথা বলবে।

প্রথাসিদ্ধ ভাবেই সব ব্যবস্থা হয়েছে, যেমন হয়ে থাকে। যদিও প্রথম দিকে প্রবীর সম্পর্কে বাড়ির প্রায় সকলের আপত্তি ছিল। প্রথম কারণ, প্রবীর এ বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত না। বলতে গেলে সকলের কাছে অপরিচিত ছিল। প্রবীর সেজদার বন্ধু, সেই সুবাদে দু-একবার এসেছিল। প্রাথমিক পরিচয় ছাড়া তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানত না।

দ্বিতীয় কারণ, ললিতার স্বয়ংবর সভায়, অর্থাৎ বাড়িতে নিয়মিত যারা আসত তাদের তুলনায় বিত্তের দিক থেকে খাটো। তার মানে এই নয়, ললিতাদের বিত্তের থেকে খাটো। যারা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ললিতার পাণিপ্রার্থী ছিল তাদের তুলনায় খাটো শুধু বিত্তে না, দামের সঙ্গে নামটাও দরকার। প্রবীরের সেরকম কোনও নাম ছিল না। ওর বাবা একজন নামকরা সাংবাদিক ছিলেন। কিন্তু বিত্তবান ছিলেন না। প্রবীরের কোনও নাম নেই, যাতে বললেই সবাই এক কথায় চিনতে পারে। কিন্তু বাকিদের তা ছিল। ব্যবসায়ে বা চাকুরির পদগরিমায় তাদের এক কথাতেই চেনা যেত।

প্রবীর নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। বলতে গেলে, ব্যবসায়ের জগতে সেটা একটা মরা ঘোড়া। তাকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছে। প্রথম যখন নিয়েছিল তখন ওর বন্ধুবান্ধবেরা সবাই হরিবোল ধ্বনি দিয়েছিল। তার মধ্যে ললিতার মেজদাও ছিল।

প্রায় এক বছর পরে সেই মরা ঘোড়াটা যখন চোখ পিট পিট করে তাকিয়েছিল, একটু ল্যাজ নাড়ানোর চেষ্টা দেখা দিয়েছিল, তখনও সকলেই প্রবীরকে বলেছিল, ওটা প্রেতাত্মার ভর হয়েছে। যারা ওর ঘাড়ে এতদিন সওয়ার হয়ে চেপেছিল এবং অনেকদিন পটল উৎপাদন করেছে, তারা হঠাৎ জেগে উঠেছে। ঘোড়াটার জাগবার কোনও লক্ষণ নেই।

দ্বিতীয় বছরে প্রবীরের বন্ধুরা একটু চোখ মিটমিট করে তাকিয়েছিল। দেখেছিল ঘোড়াটা উঠে দাঁড়িয়েছে। কেবল দাঁড়ায়নি, ঘাড়ের কেশরে এবং লাঙুলেও বেশ ঝাপটা লাগছিল। মাঝে মাঝে পা ঠুকতেও দেখা যাচ্ছিল।

তবু সবাই নিশ্চিন্ত ছিল, আর যাই হোক, দাঁড়ানো পর্যন্ত। ও ঘোড়া ছুটবে না। ওই রূপ দেখানো পর্যন্তই সার। যা পাবে তা খেয়ে বসে থাকবে।

কিন্তু ছুটেছিল। এবং এখন বেশ ভালই ছুটছে। ব্যবসার জগতে যারা বিচক্ষণ রেসুড়ে তাদের বেশ ভালভাবেই লক্ষ পড়েছে। বলেছে, জাতটা তো ভাল। একবার যখন ছুটেছে তখন ভালই ছুটবে।

চৌত্রিশ বছরের প্রবীরকে এখন অনেকটা সার্থক এবং যাকে বলে সেলফমেড ম্যান, তাই বলা যায়।

দুবছর আগে, প্রবীরের ঘোড়াটা যখন উঠে দাঁড়িয়েছে, একটু-আধটু পা ঠুকছে অর্থাৎ প্রবীরের মতে, সব থেকে ক্রুসিয়াল সময়, সে সময়েই নতুন করে ললিতার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল।

এখনও ললিতার স্পষ্ট মনে আছে। আকাশের কোণে মেঘ দেখেও কালবৈশাখীর সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিয়ে একলা পথ চলছিল মধ্য কলকাতার এক রাস্তায়। দেখতে দেখতেই ঝড় উঠেছিল। প্রথমে ধুলোর ঝড়। লোকজনের দৌড়োদৌড়ি, গাড়িঘোড়ার ছোটাছুটি। তথাপি এখনও ললিতার আশা, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কোনও রকমে ট্যাক্সি ধরে ঝড়ের মধ্যেই বাড়ি ফিরে যাবে।

কিন্তু ট্যাক্সি আসেনি, মুষলধারে বৃষ্টি এসেছিল। তখন হাতের সামনে ছিল বাস স্টপের মাথায় চাল দেওয়া ঢাকনা। সেখানে একগাদা মানুষ দাঁড়িয়েছিল। ছুটে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল সেখানেই। সেখানে আকাশের বৃষ্টির থেকে, মুখের বাক্যবৃষ্টিও কম ঝরছিল না। সংসারে সব পুরুষমানুষেরা একরকম, ললিতা কদাচ তা বিশ্বাস করে না। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষরাই মেয়েদের সম্পর্কে একটু বেশি উৎসাহী। মেয়েরাও নিশ্চয়ই, তবে পুরুষদের মতো স্থূল নয়। ও বুঝতে পারছিল, সেই বৃষ্টির মধ্যে, সামান্য একটি মাথা-ঢাকা বাস স্টপে, পুরুষদের চাপের মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। তা ছাড়া বৃষ্টির ছাট থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল না। সমানে ভিজে যাচ্ছিল। অতএব রাস্তায় নেমে পড়াই ভাল।

ভাবতে ভাবতেও প্রায় দশ মিনিট কেটে গিয়েছিল। বৃষ্টি অঝোরে ঝরছিল। সেই সময়ে একটি পুরনো মডেলের অষ্টিন বাস স্টপ ঘেঁষে, এসে দাঁড়িয়েছিল। বাইরে থেকে চেহারাটা নিতান্তই বিবর্ণ। বর্ষা বাদলায় মোটেই ভরসা করবার মতো না।

বাইরে থেকে, জলের ছাট লাগা কাচের ভেতর দিয়ে, গাড়ির চালকের মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা লেগেছিল। চালক সরে এসে, দরজা খুলে দিয়ে ডেকেছিল, ললিতা, উঠে এসো।

প্রবীর! মেজদার বন্ধু। দু একবার দেখলেও, চেহারাটা মনে ছিল। তবু ললিতা এক মুহূর্ত চিন্তা করছিল। এরকম দুর্যোগের মধ্যে, হঠাৎ একজনের গাড়িতে উঠে পড়াটা ঠিক হবে কিনা। ইতিমধ্যে, ভিড়ের ভিতরে, যাকে বলে বক্রোক্তি, শুরু হয়ে গিয়েছিল। ললিতা উঠে পড়েছিল গাড়ির মধ্যে। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর ভেজা কাপড়ে গাড়ির সিট ভিজে গিয়েছিল।

প্রবীর গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, সোজা বাড়িতে তো?

ললিতা একটু বিব্রত লজ্জায় বলেছিল, হ্যাঁ, কিন্তু

 প্রবীর ঠোঁট টিপে হেসে বলেছিল, কিন্তু মানে কী। তুমি আমাদের শিবেনের বোন তো?

ললিতা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ।

তোমার নাম ললিতা। ওদিক দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ তোমাকে চোখে পড়ল। চোখে পড়তেই চিনতে পারলাম, আর কেমন যেন মনে হল, এভাবে দেখেও চলে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। অবিশ্যি আমার একটু ভয় ছিল। উপকার করতে গিয়ে হয়তো বেইজ্জত হতে হবে। তুমি হয়তো আমাকে রিফিউজ করবে।

ললিতা বলে উঠেছিল, না না, তা কেন?

প্রবীর বলেছিল, নানান কারণেই। ধরো, হয়তো, তুমি আমাকে চিনতেই পারলে না, আর সেটা খুব অসম্ভব ছিল না। দু-একদিন তো দেখেছ।

ললিতা বলল, আমি প্রথমেই চিনতে পেরেছিলাম।

সেটা খুব ভাল। তা ছাড়া, তোমার সঙ্গে হয়তো কোনও বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারত, আমি তো বুঝতে পারছিলাম না।

ললিতা কোনও জবাব দেয়নি। প্রবীরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একটু হেসেছিল। প্রবীর সেটা লক্ষ করেছিল কিনা বোঝা যায়নি। সে আবার বলেছিল, তারপরে ভাবলাম, যা-ই হোক। আমার মন যখন বলেছে, একবার বলাটা আমার কর্তব্য। তারপর যা হয় দেখা যাবে। না হয় যেচে উপকারের একটা ভিন্ন অর্থ হবে, একটু হাসাহাসি হবে। কিন্তু সেটা আমার গায়ে লেগে থাকবে না।

ললিতা মিটিমিটি হাসছিল। বলেছিল, গায়ে না লেগে থাকলে আপনি বুঝি কিছু মানেন না?

 প্রবীর বলেছিল, গায়ে মানেই মনে। মন থেকে ওটা আমি অনায়াসেই ঝেড়ে ফেলতে পারতাম।

একটু চুপচাপ প্রবীর গাড়ি চালাতে চালাতে আবার বলেছিল, তোমাকে তুমি বলছি বলে কিছু মনে করছ না তো?

ললিতা হেসে বলেছিল, না না, মনে আবার কী করব?

হ্যাঁ, বন্ধুর বোন তোআই মিন ছোট বোন। তাকে তুমি বলা যায়। তা ছাড়া, তুমি আমার থেকে অনেক ছোট।

ললিতা মুখ ফিরিয়ে একবার প্রবীরকে দেখেছিল। শ্যামবর্ণ শক্ত সমর্থ লম্বা চেহারা। পোশাক অতি সাধারণ। ট্রাউজার আর হাওয়াই শার্টের বুকের বোতাম কয়েকটা খোলা। চওড়া কবজিতে ঘড়ি। গোঁফ দাড়ি নেই। চওড়া কপালের ওপর রুখু চুল উড়ে এসে পড়েছে। শক্ত চিবুকের মাঝখানে ছোট খাঁজ কাটা। নাকটা উঁচু কিন্তু একটু মোটা, চোখ দুটো বড় আর কেমন যেন মেয়েলি মেয়েলি।

ললিতা বলেছিল, শুধু বয়সে বড় বলে কেউ তুমি বললে আমার ভাল লাগে না।

প্রবীর হেসে বলেছিল, তাই নাকি? বেশ, তবে শিবেনের বোন বলেই বলেছি।

ললিতা একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল, আপনাকে বলিনি। কেউ যখন শুধু বয়সের জন্য, একজনকে তুমি বলে, সেটা যেন কেমন শোনায়। উচিত কি?

প্রবীর একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল, মোটেই না।

ললিতা আবার প্রবীরের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তারপরে সামনে তাকিয়ে দেখেছিল, প্রবীর সোজা দক্ষিণ কলকাতার পথ ধরেছে। ললিতা বলেছিল, আপনার সিট একদম ভিজিয়ে দিলাম।

তা আর কী করা যাবে। ও ঠিক সময়ে শুকিয়ে যাবে।

ললিতা লক্ষ করছিল, যেচে উপকার করতে চাইলেও, প্রবীর যেচে কথাবার্তা বলতে চায়নি। একটু পরে ললিতা নিজেই বলেছিল, ভাগ্যিস আপনি চিনতে পেরেছিলেন!

প্রবীর বেশ সহজ ভাবেই বলেছিল, তোমাকে চেনা তো খুব কঠিন না।

কেন?

আর দশটা মেয়ের থেকে, তোমার চেহারা তো একটু আলাদা–অর্থাৎ সুন্দরী হলে যা হয়। চেহারাটা আমার মনে ছিল।

গাড়ি চালাতে চালাতে, বেশ সহজভাবেই, প্রবীর ললিতার রূপের প্রশংসা করেছিল। অথচ তার জন্য অনেক কথা বলতে হয়নি। এ সব লোকের মনোভাব সহজে বোঝা যায় না। যেন ললিতার রূপ আছে বলেই তাকে মনে ছিল। কী মনে হয়েছে, সে কথা বোঝা যায় না। ললিতা হেসে যে প্রতিবাদ করবে, তা পারেনি। সেটা হয়তো ন্যাকামি করা হবে বলে ওর মনে হয়েছিল।

ললিতা তাই অন্য কথা বলেছিল, আপনি কি সাউথে যাচ্ছেন শুধু আমার জন্য? না কি আপনার বাড়ি ওদিকেই?

প্রবীর বলেছিল, আমি থাকি যাদবপুরে। তবে আপাতত, তোমাকে পৌঁছোবার জন্যেই এদিকে এসেছি। আমাকে আবার সেন্ট্রালে ফিরতে হবে।

ললিতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই প্রবীর হাত তুলে বলল, সে জন্য তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। এমনিতেও রাত নটা-দশটার আগে, কোনও দিনই আমার কাজ শেষ হয় না।

ললিতা অবাক হয়ে বলেছিল, রাত্রি নটা-দশটা?

হ্যাঁ, সকাল নটা-দশটা থেকে রাত্রি নটা-দশটা বলতে পারো।

ললিতার তখন মনে পড়ে গিয়েছিল প্রবীরের ব্যবসার কথা। মেজদার মুখে অনেক ঠাট্টাও শুনেছে। শুনেছিল, একদা কোনও সময়ে, একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এক বিত্তবান ভদ্রলোক দাঁড় করিয়েছিলেন। পার্টনারশিপে সেটাকে আরও বড় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় আর হয়নি, একেবারেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। সেই মৃত প্রতিষ্ঠানটিকে প্রবীর আবার বাঁচিয়ে তোলার জন্য লড়াই করছিল। যদিও নাকি কোনও আশাই ছিল না।

ললিতা জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার ব্যবসা এখন কেমন চলছে?

 প্রবীর হেসে বলেছিল, কিছু শুনেছ নাকি?

মেজদার কাছে শুনেছিলাম।

 প্রবীর বলে উঠেছিল, তা হলে তো জানই।

আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি।

আমি আর কী বলব। তবে এটুকু বলতে পারি, যে শুয়েছিল সে উঠে দাঁড়িয়েছে। চলবে কেমন বলতে পারি না।

চেষ্টা যখন করছেন।

প্রবীর বলেছিল, হ্যাঁ, এবং তার ফলও যখন কিছু পেয়েছি, মনে হয় নিরাশ হব না। আমার বন্ধুরা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। দেখা যাক কী হয়।

ললিতা দেখেছিল, প্রবীরের চোখেমুখে বেশ আত্মপ্রত্যয়ের ভাব। দেখেছিল, একটা মানুষ যেন দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে। প্রবীরের সমস্ত চেহারার মধ্যে সেই ছাপটা ফুটে উঠেছিল।

.

গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল ললিতাদের দরজার কাছে। ললিতা বলেছিল, আপনি নামবেন না?

 প্রবীর অনুরোধের সুরে বলেছিল, আজ না, আর একদিন।

 এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যান।

 অসম্ভব, তোমাকে তো বললাম, আমাকে আবার এখুনি ফিরতে হবে।

আপনি আমাদের বাড়ি আসেন না কেন?

 কখন আসব বলল। জীবিকার দায়েই দিন কেটে যায়।

তবু কাজ ছাড়াও তো মানুষের অন্য জীবন আছে।

 প্রবীর হেসে বলেছিল, আমার আছে বলে মনে হয় না। তবুবলছ যখন নিশ্চয় চেষ্টা করব। তবে–।

তবে?

 যে সব বিগ গাই তোমাদের বাড়িতে আড্ডা বসায়, সেখানে।

সেখানে কী?

কিছু না, আসব একদিন।

প্রবীর ললিতার দিকে তাকিয়েছিল। ললিতার সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, প্রবীরের তাকানো এবং হাসির মধ্যে একটা বিশেষ কী কথা লুকিয়ে রয়েছে। ললিতা বলেছিল, লিটল গাই, একটু দয়া করে এসেই দেখুন না।

প্রবীর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হেসে বলেছিল, আসব। শিবেনকে বোলো।

ললিতা দাঁড়িয়ে ছিল। প্রবীরের গাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। ললিতার হঠাৎ মনে হয়েছিল, প্রবীর ওকে যেন কিছু বলে গেল, এবং সেটা খুব অস্পষ্ট না। কেবল যে কাজের ব্যস্ততার জন্যই প্রবীর ললিতাদের বাড়ি আসতে চায়নি, তা না। বিগ-গাইদের ব্যাপারটাই বোধহয় আসল। আর সে সব বিগ গাই কারা? ললিতাকে যারা ঘিরে ছিল, তারা! আর তা ছাড়া বিগ গাই বলতে কাদের বোঝাতে চেয়েছিল প্রবীর? নিশ্চয় ললিতার বাবার বন্ধুদের নয়?

কিন্তু সেই ঝড়-বাদলের দিনে, আলাপ একটু সময়ের জন্যই, প্রবীর যেন কেমন একটু দাগ রেখে গিয়েছিল। বাড়ি ঢুকে, জামাকাপড় বদলাবার পরেও প্রবীরের কথা চিন্তা করেছিল ললিতা। ভেবেছিল বিগ-গাইরা আচ্ছা না বসালে কি প্রবীর নিয়মিত ললিতাদের বাড়ি আসত? তা হলে বুঝি সে তার কাজের মধ্যেও সময় করতে পারত?

প্রবীর কি আসলে অভিযোগ করেছিল, আত্মাভিমান প্রকাশ করেছিল? যা-ই করে থাক, কঠিন পরিশ্রমী, ব্যস্ত, সহজ এবং সাবলীল প্রবীরকে, আর সকলের থেকে একটু আলাদা লেগেছিল। ললিতা ওর মেজদার কাছে শুনেছিল, কী অসম্ভব পরিশ্রম করে প্রবীর। তার মধ্যেও, ললিতার চেহারা তার স্পষ্ট মনে ছিল, এবং কেন মনে ছিল সে কথাও স্পষ্টই বলেছিল, এবং ললিতার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, প্রবীর আসতে চায় ওদের বাড়িতে। কিন্তু ললিতাকে যারা ঘিরে ছিল, তাদের মাঝখানে নয়।

ললিতা ভেবেছিল, আর কি প্রবীর আসবে?

আসেনি। প্রায় দু সপ্তাহ বাদে একদিন সন্ধের সময় টেলিফোন করেছিল। ললিতা নেহাত টেলিফোনের কাছে ছিল, তাই জানতে পেরেছিল। অন্য কেউ হলে শুধু মেজদা বাড়ি নেই বলেই ছেড়ে দিত। টেলিফোনের মধ্যেও গলার স্বরটা শুনে ললিতার ভুরু কুঁচকে উঠেছিল সন্দেহে। জিজ্ঞেস করেছিল, কে বলছেন আপনি?

জবাব এসেছিল, আমি শিবেনের বন্ধু। ও কি অফিস থেকে ফিরেছে?

ললিতা প্রথমেই বলেছিল, আমি ওর বোন ললিতা বলছি। আপনার নামটা জানতে পারি?

টেলিফোনের অপর প্রান্তে এক মুহূর্তের নীরবতা, পরমুহূর্তেই যেন অবাক স্বর ভেসে এসেছিল, ও, ললিতা বলছ নাকি? আমি প্রবীর বলছি।

ললিতা বলেছিল, সেটা সন্দেহ করেছিলাম বলেই, নামটা জানবার আগ্রহ হল। আপনি যে এলেন না?

কোথায়?

কোথায় আবার, আমাদের বাড়িতে।

ও হ্যাঁ, যাব একদিন।

প্রবীর অন্য কিছু বলবার আগেই ললিতা বলে উঠেছিল, কবে, দিন ঠিক করে বলুন।

প্রবীর ওপার থেকে হেসেছিল। বলেছিল, দিনক্ষণ বলাই তো মুশকিল, শিগগিরই যাব একদিন। শিবেন কি এখনও অফিস থেকে ফেরেনি?

না। কিন্তু আপনি একটা দিন বলুন, কবে আসবেন।

যেদিন সুযোগ পাব।

আজকেই সেই সুযোগটা করে নিন না।

প্রবীর টেলিফোনে হেসেছিল। বলেছিল, তোমার ব্যস্ততা দেখে…।

কী?

মানে, হাসি পাচ্ছে।

হাসি পাচ্ছে কেন? আমি কি মিথ্যে ব্যস্ততা দেখাচ্ছি?

না না, তা কেন। আমি বলছি–মানে ছেলেমানুষের মতো বলছ।

ললিতার মনে হয়েছিল, প্রবীর সেটা সত্যি কথা বলেনি, কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ও বলেছিল, তা হতে পারে। আপনি তো আবার আমার থেকে অনেক বড়।

প্রবীর যেন একটু অবাক হয়ে বলেছিল, তার মানে?

ললিতা হেসে বলেছিল, তার মানে, তাই। আপনিই বলেছিলেন, আপনি আমার থেকে অনেক বড়, তাই আমার কথা ছেলেমানুষি মনে হতেই পারে।

প্রবীর আবার হেসেছিল। বলেছিল, আচ্ছা আজই তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি, শিবেনকে একটু বলে রেখো।

ললিতা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। ভেবেছিল, আপাতত টেলিফোনে কথা চাপা দেবার জন্য প্রবীর আসতে রাজি হয়েছিল। তাই বলেছিল, সত্যি বলছেন তো?

আমি মিথ্যে কথা বলি না।

প্রবীর লাইন কেটে দিয়েছিল। কিন্তু কথা রেখেছিল। আসলে মেজদার সঙ্গে তার বিশেষ দরকার ছিল, আসবার সেটাই বড় কারণ। ললিতার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করেছিল। বাড়িতে তখন আরও কয়েকজন ছিল, যারা মোটামুটি সবাই প্রবীরকে চেনে। যাদের প্রবীরের ভাষায় বলা যায় স্বয়ংবর সভার পাণিপ্রার্থী রাজা-মহারাজা। কথাটা নেহাত মিথ্যে ছিল না। ওরা কেউ-ই প্রবীরের সঙ্গে ভালভাবে কথা বলেনি। যেটুকুও বলেছিল, তার সবটাই প্রবীরের ব্যবসা নিয়ে হাসি মেশানো বক্রোক্তি।

ললিতার ভাল লেগেছিল প্রবীরের জবাবগুলো। প্রবীর একটুও রাগ করেনি, হাসতে হাসতে সকলের বিদ্রুপে মাখানো কথার জবাব দিয়েছিল। ওর জবাবের মধ্যেও যথেষ্ট বিদ্রুপের ধার ছিল, কিন্তু জ্বালা ছিল না।

তারপরে যখন ললিতার সঙ্গে আলাদা বসে কথা বলেছিল, তখন প্রবীর বলেছিল, এদের দেখে আমার শুধু একটা কারণেই হিংসা হয়।

ললিতা জিজ্ঞেস করেছিল, কী কারণ?

 প্রতিটি সন্ধ্যা এরা একটা কারণে ব্যয় করতে পারে। এদের হাতে অঢেল সময়।

ললিতার ভুরু কুঁচকে উঠেছিল, তার মানে?

প্রবীর বলেছিল, তার মানে এরা রোজ তোমাদের বাড়ি এসে গল্প করার সময় পায়, আমি পাই না। পেলে বেশ হত।

ললিতা বুঝতে পেরেছিল, প্রবীর ঠিক কথাটা বলেনি। ও প্রবীরের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, কথাটা পরিষ্কার হল না।

প্রবীর বলেছিল, তা হলে আরও পরিষ্কার করে বলছি। ওদের প্রেম করার সময় আছে, আমার তাও নেই।

ললিতার মুখ একটু লাল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, সবাই প্রেম করতেই আসে, এ কথা আপনাকে কে বলল?

প্রবীর একটুও দ্বিধা না করে বলেছিল, প্রেম করার আশা নিয়েই আসে। তোমার মেজদার মুখেই শুনেছি। তুমি মুখ খুলে একজনের নাম বললেই সব মিটে যায়।

ললিতা বলেছিল, মেজদার কথাই ওরকম।

প্রবীর চুপ করে ছিল, কোনও জবাব দেয়নি।

ললিতা আবার বলেছিল, ওরা কেউ প্রেমিক না।

প্রবীর বলেছিল, তা-ও জানি। উদ্দেশ্য একটাই, কার যেন গান শুনেছিলাম, বুলবুলি শিস দেয় কেতকীর কানে। অনেকটা সেইরকম।

ললিতা বলেছিল, ভুল করলেন। ওরা কেউ বুলবুলি না, কেউ শিস দিতে জানে না।

 ওদের ধারণা, ওরা তাই। তবে একটা কথা বলব। ওরা সকলেই যথেষ্ট ধনীদের ঘরের ছেলে, কিন্তু বড় গোবেচারা।

ললিতা হেসে উঠেছিল, গোবেচারা কেন?

প্রবীর বলেছিল, দেখ তো কেমন প্রতিটি সন্ধেয় এসে বসে থাকে। কত ধৈর্য এবং অধ্যবসায় থাকলে এরকমটা হয়।

ললিতা বলেছিল, কেবল আপনারই সেই ধৈর্য এবং অধ্যবসায় নেই!

মাফ করো, সত্যি নেই।

তা হলে আর ওদের হিংসে করে লাভ কী। সময় থাকলেও, আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রবীর হঠাৎ ললিতার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে যেন একটা অপার কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা। ললিতার মুখে রং লেগে গিয়েছিল। চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

প্রবীর কী ভেবে বলেছিল, সময় থাকলেও এরকম একটা পরিবেশে আসতে আমার অস্বস্তি হয়। আর এটাও আমি বুঝি, এখানে আমার আসাটা সকলের বোধহয় ভাল লাগবে না।

প্রবীর কথাটা কেন বলেছিল, ললিতা জানে। ললিতার মা তখন অন্য সকলের সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন। কিন্তু প্রবীরকে দেখেও যেন দেখেননি, একটা কথাও জিজ্ঞেস করেননি। মেজদার তখনও বিয়ে হয়নি। বড় বউদিও মায়ের সঙ্গে বসে, অন্যদের সঙ্গেই কথা বলছিল।

ললিতা বলেছিল, মেজদা আপনাকে খুব ভালবাসে।

প্রবীর বলেছিল, তাতে এ বাড়িতে নিয়মিত আসা যায় না।

ললিতা বলেছিল, আমি তো আছি, আমাকে বাদ দিচ্ছেন কেন। আমার কাছেও তো আসতে পারেন।

প্রবীর আবার ললিতার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। ললিতার চোখের পাতা নেমে গিয়েছিল। প্রবীর বলেছিল, তোমার সঙ্গে যদি মিশতে হয় তোমাকে এ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাব। তোমার যদি কোনওদিন আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে আমাকে টেলিফোনে যেখানে খুশি ডেকো, আসব। আমি কাজ ভালবাসি, কারণ আমি একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজে নেমেছি। তার মানে এই নয়, জীবনকে বাদ দিয়ে কাজকে সম্বল করেছি। আমি জীবনের জন্যই কাজকে ভালবাসি।

প্রবীর কথাগুলো বলেই খুব ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়েছিল, আমি আজ যাই।

বলেই চলে গিয়েছিল। প্রবীর তার কথাগুলোর জবাব চায়নি। জবাব চাইবার কিছু ছিলও না। সে সব কিছুই ললিতার ওপর ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। তার কথার মধ্যে অস্পষ্ট কিছুই ছিল না। তার শেষের কথাগুলো ললিতার মনে যেন গাঁথা হয়ে গিয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে ললিতা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। প্রতিটি সন্ধেয় বাড়িতে একই পরিবেশ, একই যুবকদের আনাগোনা এবং চোখের দৃষ্টিতে, কথাবার্তায় সকলের একটাই বক্তব্য। একটাই আকাঙ্ক্ষা। কারওকে ও আলাদা করতে পারত না। সবাইকে ওর একরকম মনে হত। একমাত্র অর্থবান হওয়া ছাড়া কারোর মধ্যে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্য ওর চোখে পড়েনি। ললিতার প্রতি সকলে কেবল মুগ্ধ। সকলেই অত্যন্ত ভাল, সকলেই অত্যন্ত মাপজোক করা মানুষ। কারোর সঙ্গে একটার বেশি কথা বলা যায় না।

প্রবীর চলে যাবার পরে, সকলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। প্রবীরের সঙ্গে আলাদা এক কোণে বসে কথা বলায় কেউ খুশি হয়নি। বরং বিস্মিত আর বিরক্ত হয়েছিল। মা তো রীতিমতো রেগেই গিয়েছিলেন। মেজদাকে সকলের সামনেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওই প্রবীর না কী নাম, ছোকরা কী চায় তোমার কাছে?

মেজদা বলেছিল, একটা দরকারে এসেছিল। ও তো আমাদের বাড়ি বিশেষ আসে না।

মা রাগ চাপতে না পেরে, চকিতে একবার ললিতার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আজ তো অনেকক্ষণ বসেছিল।

মেজদার পরিষ্কার জবাব, ওই ললু বসিয়ে রেখেছিল বোধহয়।

ললিতা বলেছিল, হ্যাঁ, আমি একটু অপেক্ষা করছিলাম।

মেজদা আবার বলেছিল, তবে প্রবীরকে বোধহয় আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। যেভাবে উঠছে, ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে ছাড়বে।

মেজদার সে কথার কেউ জবাব দেয়নি।

ললিতা তারপরে আর প্রবীরকে বাড়িতে ডাকেনি। কিন্তু প্রবীরের সঙ্গে ওর নিয়মিত দেখা হত। ললিতার জীবনে সেই প্রথম, গোপনে একজনের সঙ্গে দেখা করার পালা শুরু হয়েছিল। সেই প্রথম, বাড়ির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তার কারণ, রূপসী ললনাটির সেই প্রথম প্রেম। ললিতা অনেক ছেলের সঙ্গে মিশেছিল, অনেক ছেলের সঙ্গে বোজ কথা বলত, কিন্তু একজনের জন্য ব্যাকুলতা বা আকর্ষণ কখনও বোধ করেনি। প্রবীর সেই মানুষ, যে ওর জীবনে নতুন দিক দেখিয়েছিল।

ওদের সেই বাইরে মেলামেশা ঘনিষ্ঠতার কথা বেশি দিন চেপে রাখা যায়নি। ফলে, বাড়িতে আরম্ভ হয়েছিল অশান্তি। মেজদা তেমন না। কিন্তু বাবা, বড় দাদা, মা সকলের দিক থেকেই নানারকম আপত্তি উঠেছিল। প্রথমে অনুরোধ, তারপর বকুনি, তারপরে নানারকম বাধা।

 কিন্তু কোনও কিছুই ওদের আটকে রাখতে পারেনি। আটকে রাখতে পারেনি শুধু না, ক্রমেই প্রবীরের ব্যবসার উন্নতি হচ্ছিল। নিশ্চিত প্রতিষ্ঠার পথে, প্রবীর ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সবাই প্রবীরের বিস্মিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিল। এমনকী ললিতার মেজদাও।

দু বছরের মধ্যে, প্রবীরের প্রতিষ্ঠা এবং ললিতার সঙ্গে তার বিয়ে, সবই স্থির হয়ে গিয়েছিল। সেই দুবছরের মধ্যে, ললিতার মেজদার বিয়ে হয়েছিল, হায়দ্রাবাদে ট্রান্সফার হয়ে চলে গিয়েছিল। প্রবীরও ললিতাদের পরিবারে স্বীকৃত হয়েছিল, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বিয়ের আর দু মাস বাকি। বিয়ের আগে, বাপের বাড়ির লোকের সঙ্গে এই শেষ বেড়ানো।

কিন্তু এই শেষ বেড়ানো ললিতাকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল। প্রবীরকে ও কী বলবে? কেমন করে বলবে?মুখ ফুটে একটি কথাও ললিতা বলতে পারবেনা। যে প্রবীরকে পাবার জন্য ও বাড়িতে বিদ্রোহ করেছিল, যাকে ও ভালবেসেছে, যার সঙ্গে ও ইতিমধ্যেই নিজেকে অচ্ছেদ্য ভেবেছে, যার সঙ্গে সারা জীবন কাটাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তাকে ও কী বলবে?

না, প্রবীরকে ও কিছুই বলতে পারবে না। বলা যায় না। সংসারে সমস্ত কিছুরই একটা যুক্তি আছে। বিশ্বাস্য অবিশ্বাস্য বলে একটা কথা আছে। যাকে আজ পর্যন্ত জীবনের কোনও কথাই গোপন করেনি, তাকেও এমন কথা কী করে বলবে, যার কোনও যুক্তি নেই।

প্রবীরের জুতোর শব্দ শোনা গেল। প্রবীর ওপরে আসছে। ললিতা তৈরি হল।

.

প্রবীর কাছে এসে ললিতার দিকে একবার তাকিয়েই বলল, একী, সত্যি দেখছি চেহারাটা খুব খারাপ করে দিয়েছ। আমি ভাবলাম, সবাই বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে বলছে।

ললিতা হাসল। বলল, বাড়াবাড়ি তো নিশ্চয়ই করছে। তুমিও তাদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করলে যে।

প্রবীর অবাক হয়ে বলল, তার মানে?

ললিতা বলল, তার মানে, তুমিও সকলের মতো এক কথাই বলছ।

প্রবীর ললিতার আরও কাছে এসে, ললিতার মুখের দিকে চোখ রেখে বলল, বলব না? সত্যি যে চেহারাটা খারাপ করে দিয়েছ। কী হয়েছে বলো তো?

ললিতা ঘাড় নেড়ে বলল, কী আবার হবে। কিছু হয়নি তো।

প্ৰবীর বলল, তাই কখনও হয়। রংটা রীতিমতো চাপা দেখাচ্ছে। চোখের কোল বসা, যেন রোগে ভুগে উঠেছ। মুখটা তো বেশ রোগা।

ললিতা হেসে বলল, বাজে কথা।

প্রবীর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ললিতার বুকের মধ্যে যেন কেঁপে উঠল। প্রবীর ওকে চেনে, বুঝতে পারে। সে বুদ্ধিমান, দেখবার এবং বোঝবার চোখ তার আছে। ললিতা একবার ভাবল, প্রবীরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিলেই ধরা পড়তে হবে। প্রবীর ভাববে, নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে।

ললিতা সহজভাবেই হাসবার চেষ্টা করল। বলল, কী দেখছ?

প্রবীর বলল, তোমাকে।

আমাকে বুঝি আগে কখনও দেখনি?

দেখেছি, কিন্তু এমনটি কখনও দেখিনি।

 কেমনটি?

প্রবীর জবাব না দিয়ে, ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রবীর কথা না বলে, তাকিয়ে থাকতেই ললিতার অস্বস্তি বেড়ে উঠছে। ও বলল, আমার এই চেহারার কথা বলছ?

প্রবীর বলল, চেহারা তো বটেই, তার সঙ্গে আরও কিছু।

ললিতা মনে মনে শিউরে উঠল। কিন্তু যেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা আবার কী, বুঝলাম না তো।

প্রবীর বলল, সেটা হল এই, তুমি আমাকেও বলতে পারছ না, তোমার কী হয়েছে। তুমি যেন আমার কাছে নিজেকে ঠিক খুলে ধরতে পারছ না।

ললিতা তেমনি ভাবেই হাসবার চেষ্টা করল, বলল, কী বলব বলল। কিছু না হয়ে থাকলে, তোমার কাছে কী মুখ খুলব। একটা মিথ্যে কথা তো বানিয়ে বলতে পারি না।

প্রবীর ললিতার প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, মুখের দিকে চেয়ে বলল, সত্যি কিছু হয়নি?

 কী আবার হবে, আশ্চর্য!

আমি বলছি না তোমার জীবনে বিরাট কোনও ঘটনা ঘটে গেছে। তোমার দাদা, বউদির সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিলে। যদি কিছু ঘটত তাঁরা তা জানতে পারতেন। আমি জিজ্ঞাসা করছি, তোমার কোনও মানসিক ব্যাপার ঘটেছে কিনা।

ললিতা মাথা নেড়ে হাসল। বলল, মানসিক ব্যাপার কিছু ঘটলেও, বাস্তবে কোনও ঘটনা চাই তো। আর শুধু শুধু আমার মানসিক কিছুই বা ঘটতে যাবে কেন বলল। আমি যাবার আগের দিনও তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

প্ৰবীর বলল, তাইতেই তো আরও আশ্চর্য হচ্ছি ললিতা। এমনকী ঘটতে পারে যে তোমাকে প্রায় রুগ্ন দেখাচ্ছে। কোথায় বেড়াতে গেলে, চেহারা আরও সুন্দর করে ফিরবে, তার বদলে একেবারে উলটো!

ললিতা বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। এত ভাবছ কেন?

প্রবীর জিজ্ঞেস করল, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? অনেক সময় রুগি নিজেই বুঝতে পারে না তার কী হয়েছে।

ললিতা যেন তবু একটা কৈফিয়ত পেল। বলল, তা অবিশ্যি বলতে পারি না। এমনিতে তো আমি কিছু ফিল করছি না।

প্ৰবীর বলল, সেরকম হলে, আমার মনে হয় রক্ত উক্ত পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

ললিতার বুকের মধ্যে যেন রক্ত হিম হয়ে গেল। এক মুহূর্ত দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইল। তারপরে বলল, আমার মনে হয় না সেরকম কিছু হয়েছে। তবু যদি মনে করো, তা হলে দেখানো যেতে পারে।

প্ৰবীর বলল, শুধু শুধু তো আর কিছু হতে পারে না। একটা কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। আমার মনে হয়, অবহেলা না করাই ভাল।

প্রবীর কথা বলতে বলতে বারে বারেই ললিতার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। তাতে বোঝা যাচ্ছিল, প্রবীর মনে মনে স্বস্তি পাচ্ছে না, সন্তুষ্ট হতে পারছে না। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ললিতার কাছ থেকে সে আশানুরূপ জবাব পায়নি। তার বুদ্ধিদীপ্ত ধারালো চোখে কেমন একটা সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা লেগে রয়েছে।

তা ছাড়া ললিতা বুঝতে পারছে, ওর নিজের ব্যবহারও যথাযোগ্য হচ্ছে না। এত দিন পরে দেখা, ওর দিক থেকে নিশ্চয় আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা উচিত ছিল। যারা নিজেদের মধ্যে একদিন দেখা না পেলে, অন্তত টেলিফোনেও কথা বলে, তারা দেড় মাস পরে সামনা-সামনি, কাছাকাছি হয়েছে, তবু তেমন কোনও কিছুই উত্তেজনা বা উচ্ছ্বাস ঘটল না ললিতার মনে। প্রবীরও হয়তো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারত, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু একটা মাত্র ব্যাপার নিয়েই সেটা সম্ভব হল না। ইদানীং প্রবীর সুযোগ-সুবিধে পেলেই, ললিতাকে একাধিক চুম্বন না করে ছাড়ত না। বিশেষ করে যখন থেকে ওদের নিজেদের মধ্যে কথা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছে, যখন থেকে ওরা নিজেদের নিজেরা স্বীকার করে নিয়েছে। আজও প্রবীরের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। হয়তো প্রবীর তাই আশা করে এসেছিল। কিন্তু ললিতার মুখের দিকে তাকিয়েই, তাকে থমকে যেতে হল। সে দেখল নিজে, সকলের মুখে যে কথা শুনে এসেছে, তা সত্যি। অতএব তার পক্ষে আর উচ্ছ্বসিত হওয়া সম্ভব হল না।

প্রবীর ললিতার একটি হাত ধরে, নিজের বুকের কাছে টেনে নিল। ললিতার মনে হল ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। প্রবীর হয়তো ওর বুকের ধক ধক শব্দ শুনতে পাবে। ওর মুখের ভিতরটা শুকিয়ে উঠছে। এখন আর সোজাসুজি প্রবীরের মুখের দিকে তাকাতেও পারছে না।

প্রবীর ললিতার চিবুক ধরে, মুখ তুলে ধরল। ললিতা হাসল। প্ৰবীর বলল, সত্যি বলো তো লক্ষ্মীটি, তোমার কী হয়েছে। কোনও কারণে কি তোমার মন খারাপ হয়েছে?

ললিতার মুখে কোনও জবাব না দিয়ে, ঘাড় নাড়ল।

প্রবীর আবেগের সুরে জিজ্ঞেস করল, তবে? তবে ললিতার সেই আলোর ঝলক কোথায় গেল? তাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তোমাকে কেউ মনে কষ্ট দিয়েছে?

ললিতা আবার ঘাড় নাড়ল। কিন্তু প্রবীরের মুখের সামনে ও যেন আর মুখ তুলে ধরে রাখতে পারল না। ওর চোখে যেন জল আসছে। হঠাৎ ও প্রবীরের বুকের মধ্যে মুখ রাখল। জোরে মুখটা চেপে ধরে, চুপ করে রইল।

প্রবীর কিছু বলল না। সে ললিতাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রইল। একটু পরে, বুকের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে নিয়ে, ললিতা বলল, দিনটা আরও এগিয়ে দেওয়া যায় না?

প্রবীর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোন দিনটা?

ললিতা কিছু না বলে, প্রবীরের বুকের জামার বোতাম খুঁটতে লাগল। প্রবীর হঠাৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বিয়ের দিন?

ললিতা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

প্রবীর যেন আরও অবাক হল। জিজ্ঞেস করল, তোমার তাই ইচ্ছা?

ললিতা নিচু স্বরে বলল, হ্যাঁ। আমি তোমার সঙ্গে কোথাও চলে যাব। আমার কিছুই ভাল লাগছে না।

প্রবীর সহসা কিছু বলল না। কয়েক মুহূর্ত ললিতার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপরে বলল, বেশ, তোমার যদি ইচ্ছে হয়, তাই হবে।

ললিতা আবার প্রবীরের বুকের ওপর মুখ চেপে রাখল। আসলে প্রবীরের কাছ থেকে ও নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইছে। প্রবীরের সঙ্গে চোখে চোখে তাকাতে চাইছে না। কিন্তু ও বুঝতে পারছে, প্রবীর ওর আচরণকে সহজভাবে নিতে পারছে না। তার মতো বুদ্ধিমান ছেলের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। অবিশ্যি প্রবীর সে কথা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। যাবার আগে কেবল বলল, আর কিছু নয়, আমার ভয় তোমার শরীরটার জন্য। সে রকম যদি কিছু বোঝ, তা হলে তুমি নিজে থেকেই বোলো।

ললিতা বললে, বলব।

.

প্রবীর চলে যাবার পরে, নীচে নেমে, যে ঘরে টেলিফোন, সেই ঘরে উঁকি দিল। দেখল কেউ নেই। ললিতা প্রায় চোরের মতো এদিকে ওদিকে তাকিয়ে, ঘরের মধ্যে ঢুকল। দরজাটা বন্ধ করে দিল। টেলিফোনের রিসিভার তুলে, দ্রুত ডায়াল ঘোরাল। কয়েক সেকেন্ড পরেই, ওপার থেকে সাড়া পেয়ে বলল, স্বাতী আছে নাকি?..আমি ওর বন্ধু ললিতা।…আচ্ছা, ধরে আছি।

ললিতার চোখেমুখে একটা উত্তেজনা। ও পিছন ফিরে বন্ধ দরজার দিকে দেখল। তারপরেই স্বাতীর গলার আওয়াজ পেল, কী রে ললিতা, কবে ফিরলি? আজ সকালে। শোন স্বাতী, বেশি কথা বলবার সময় নেই। কাল সকালে তুই একবার আমাদের বাড়িতে আসবি। আমি তোকে আসতে বলেছি, তা যেন বলিস না। তুই আমার সঙ্গে এমনি দেখা করতে এসেছিস, খোঁজ নিতে এসেছিস, আমি এসেছি কি না।

ওপার থেকে প্রশ্ন এল, ব্যাপার কী?

 ললিতা বলল, কাল বলব, আজ নয়। ছেড়ে দিচ্ছি, কেমন, আসিস কিন্তু।

বলেই ললিতা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। মনে হল, ওর যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবু দাঁড়াতে সাহস পেল না। তাড়াতাড়ি মুখের অবস্থা স্বাভাবিক করে ধীরে-সুস্থে দরজা খুলল। সামনে কেউ নেই। ললিতা একটু স্বস্তি বোধ করল। যদিও ওর বুকের মধ্যে যেন থর থর করছে। অসম্ভব দুর্বল বোধ করছে।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে, মাঝপথে বড় বউদির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বউদি জিজ্ঞেস করল, প্রবীর চলে গেল নাকি?

ললিতা বলল, এই তো গেল।

ললিতা বুঝতে পারছে, বউদির ধারণা, ও প্রবীরের সঙ্গে নীচে নেমে এসেছিল। তবু যা তোক রক্ষা। বউদি বলল, মা প্রবীরের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন। আমাকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন।

ললিতার মনে একটা খটকা লাগল। প্রবীর সাধারণত মায়ের সঙ্গে দেখা না করে যায় না। আজ দেখা না করেই চলে গিয়েছে। স্বাভাবিক, প্রবীরের পক্ষে আজ এটা খুবই স্বাভাবিক। তার মনে আজ নানা প্রশ্ন জেগে উঠেছে। নিশ্চয়ই অনেক অশান্তি অস্বস্তি আর অনেক জিজ্ঞাসু ভাবনা নিয়ে সে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু ললিতার কোনও উপায় নেই। ললিতা ওর নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। উপুড় হয়ে, বিছানায় মুখ গুঁজে দিয়ে, বারে বারে বলে উঠল, আমাকে ক্ষমা করো প্রবীর, আমাকে ক্ষমা করো।

ঘণ্টাখানেক বাদে খাবার ডাক পড়ল। খাবার ইচ্ছা না থাকলেও, ললিতা খেতে গেল। কারণ না গেলেই, নতুন কৌতূহল, নতুন প্রশ্ন দেখা দেবে। আবহাওয়া যত স্বাভাবিক রাখা যায় ততই ভাল।

পরের দিন সকাল বেলা-ই স্বাতী এল। ললিতা তাকে যেমন করে বলে দিয়েছিল, তেমনিভাবেই এল। খোঁজ নিল ললিতা এসেছে কিনা। তারপর বন্ধু দর্শনে, দোতলায় ছুটে এল। সেও এসেছে তীব্র কৌতূহল নিয়ে। কিন্তু ললিতার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক চোখে ললিতার দিকে। তাকাল।

ললিতা হেসে বলল, কি, চেহারার কথা বলবি তো?

স্বাতী বলল, হ্যাঁ। তোর কি কোনও অসুখ করেছে নাকি?

 ললিতা বলল, হ্যাঁ, আমাকে মরণ ব্যাধিতে ধরেছে। সারাবার জন্য তোর সাহায্য দরকার।

কী ব্যাপার বল তো?

ওইটি জিজ্ঞেস করিস না। সাহায্য যদি করিস, তা হলে একটাই কন্ডিশন, এখন কিছুই জানতে চাইবি না।

স্বাতী জিজ্ঞাসু অবাক চোখে ললিতার দিকে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে ললিতার সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নিল। বলল, কী বলছিস, কিছু বুঝতে পারছি না।

ললিতা বলল, পরে বুঝিয়ে বলব। আপাতত যা বলছি, তা করতে পারবি কি না বল? সেটা শুনি আগে।

দিন তিনেকের জন্য আমি তোদের বাড়ি থাকতে যাচ্ছি। অর্থাৎ তুই আমাকে কয়েকদিন তোদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখতে চাইছিস, এটাই বলতে হবে। যদিও

ললিতা কথাটা শেষ করল না। স্বাতী জিজ্ঞেস করল, যদিও?

যদিও আমি তোদের বাড়িতে থাকব না।

 কোথায় থাকবি?

 সে কথা এখন না। পরে বলব।

 স্বাতী কয়েক মুহূর্ত ললিতার দিকে চেয়ে থেকে বলল, প্রবীরের সঙ্গে কোথাও যাবি?

ললিতা করুণভাবে একটু হাসল, প্রবীরের সঙ্গে আজ আমি কোথাও গেলে আমাকে বাধা দেবার কেউ নেই, লুকোবারও দরকার নেই।

তবে?

 সেটা আমি তোকে পরে বলব।

স্বাতী আবার কয়েক মুহূর্ত ভাবল। বলল, কিন্তু, তোদের বাড়ি এমন কিছু দূরে না, কলকাতা শহরের মধ্যেই। যদি জানাজানি হয়ে যায়, তুই আমাদের বাড়িতে নেই?

ললিতা বলল, সে ভার তোকেই নিতে হবে, যাতে জানাজানি না হয়।

স্বাতীর চোখেমুখে অস্বস্তি। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, কবে যাবি?

ললিতা বলল, আজ, এখনই। তুই গিয়ে মাকে বল, আমাকে কয়েকদিনের জন্য তোদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাস। বলবি, আমি রাজি আছি। মা রাজি হয়ে যাবে।

স্বাতী তবু একটু ভাবল। তারপরে বলল, ঠিক আছে, আমি মাসিমার সঙ্গে কথা বলে আসছি।

স্বাতী বেরিয়ে গেল, এবং একটু পরেই ললিতার মায়ের সঙ্গে দেখা করে ফিরে এল। মা ললিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বাতী তোকে ওদের বাড়িতে কয়েকদিন নিয়ে রাখতে চাইছে। যাবি নাকি?

ললিতা বলল, যাব।

মা বললেন, প্রবীরকে তা হলে খবরটা দিতে হয়।

 ললিতা বলল, আমিই দিয়ে দেব।

 মা স্বাতীর দিকে একবার দেখলেন। বললেন, তা হলে ঘুরে আয়।

স্বাতীর দিকে ফিরে বললেন, স্বাতী, তুমি একবার আমার সঙ্গে এসো।

স্বাতী মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। ললিতা তাড়াতাড়ি তৈরি হতে লাগল। একটা ছোট স্যুটকেসে কয়েকটি জামাকাপড় ইত্যাদি ভরে নিল। চেক বইটাও নিল। ব্যাঙ্কে ওর অ্যাকাউন্ট আছে, কিছু টাকাও আছে।

একটু পরেই স্বাতী এল। ললিতা জিজ্ঞেস করল, মা কী বললে?

মাসিমা বললেন, আমার কাছে কয়েকদিন থাকলে তোর ভালই হবে, তোর কী হয়েছে না হয়েছে, সে সব আমাকে বলতে পারবি। তাতে তোর মন ভাল হয়ে উঠবে।

ললিতার বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল। হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারল না। চুপ করে রইল। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মা যে এরকম বলবে, আমি তাই ভেবেছিলাম। চল তা হলে আর দেরি করব না।

বাড়ির বাইরে এসে, ট্যাক্সিতে উঠে, ললিতা ড্রাইভারকে একটা রাস্তার নাম বলল। স্বাতী জিজ্ঞেস করল, সেখানে গিয়ে কী করবি?

ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলব।

 স্বাতী তেমনই অবাক জিজ্ঞাসু চোখে ললিতার দিকে চেয়ে রইল। ললিতা স্বাতীর দুহাত ধরে বলে উঠল, রাগ করিস না স্বাতী। এখন কিছু জানতে চাসনে, পরে তোকে সবই বলব।

স্বাতী বলল, রাগ করছি না, আমার কেমন যেন ভয় করছে ললিতা।

ললিতা বলল, ভয়ের কিছু নেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক। তুই শুধু আমার এই কয়েক দিনের অ্যাবসকন্ড করা দিনগুলোকে বাঁচিয়ে দে।

দুজনে ব্যাঙ্কে এল। ললিতা টাকা তুলল। স্বাতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, দু হাজার টাকা দিয়ে কী করবি?

ললিতা বলল, সঙ্গে থাকা ভাল। চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

স্বাতীকে বাড়ি পৌঁছে দিতে ট্যাক্সিতে উঠল। বলল, মনে হয়, পরশু সকালেই তোর কাছে চলে আসব। তুই মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলিস, জানাস আমি তোদের বাড়িতে বেশ ভাল আছি, যেন চিন্তা না করে।

শেষ মুহূর্তে স্বাতী তার আবেগ আর উদ্বেগ চেপে রাখতে পারল না। তার চোখে জল এসে পড়ল। বলল, শোন ললিতা, তুই কোনও বিপদ-আপদ ঘটাবি না তো?

ললিতা বলল, না, বিপদ যাতে না ঘটে তার জন্যই চেষ্টা করছি। তুই ভাবিস না।

 স্বাতী ট্যাক্সি থেকে নেমে গেল। ললিতা চলে গেল।

.

ললিতা দক্ষিণ থেকে এল উত্তর কলকাতায়। উত্তর কলকাতায় যতটা ভাল সম্ভব, তেমনি একটি নার্সিং হোমে এসে ঢুকল। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

ডাক্তারটি যুবক। একবার ললিতাকে দেখল, ওর সুটকেস দেখল। নার্সকে ডেকে বলল, এঁকে আমার ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।

নার্সিংহোমের ভিতরে, অন্য একটি ঘরে ললিতাকে নিয়ে গেল নার্স। সেখানে কেউ নেই। একটু পরেই ডাক্তার এল। চেয়ারে বসে বলল, বলুন, হোয়াটস য়ুর ট্রাবল।

ললিতা ডাক্তারের দিকে চোখ তুলে একবার দেখল, তারপর বলল, আমার-আমার।

কথাটা বলতে পারছে না। ললিতার অসুস্থ মুখে রক্তের ছাপ পড়ল। ডাক্তার খুব সহজভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনার বোধহয় পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেছে?

ললিতা যেন নিষ্কৃতি পেল, বলল, হ্যাঁ।

কত দিন?

দু মাস।

আপনি তো অবিবাহিতা মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ।

দেন, হোয়াট ইজ দ্য স্টোরি ইন বিহাইন্ড?

ললিতা ডাক্তারকে আবার দেখল, টেবিলে আঙুল ঘষল। বলল, সেটা কি জানা খুব দরকার?

ডাক্তারের কাছে কিছু না লুকোনোই ভাল।

 ললিতা বলল, লুকোবার কিছু নেই, বলবারও কিছু নেই। এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র—

 যথা?

ঘটে গেছে।

ডাক্তার একটু হাসল। জিজ্ঞেস করল, আগেও এরকম ঘটেছে নাকি?

ললিতার কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল অপমানে। ওর মুখ একটু শক্ত হল, বলল, না!

ডাক্তার বললে, আমার কথাটা অন্যভাবে নেবার দরকার নেই। কথাটা আমার জানা দরকার। কেন না, মনে হচ্ছে, আপনি একেবারে তৈরি হয়েই এসেছেন, এবং একেবারে একলা। এতটা সাহস পেলেন কী করে?

ললিতা বলল, অবস্থার চাপে। তা ছাড়া আমার এক বন্ধুর ব্যাপারে আমি এ সব জানি।

ডাক্তার একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনার আসল নাম ঠিকানা দিতে পারবেন তো?

সেটা কি দরকার আছে?

নিশ্চয়ই। আপনার কোনও বিপদ-আপদ হলে, আমি কার কাছে জানাব?

সে সম্ভাবনা কি আছে?

নেই বলেই মনে হচ্ছে। তবু আমার জানা থাকা দরকার। আপনার আসল নাম, ঠিকানা এবং বয়স। আপনাকে শুধু এটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি, প্রয়োজন না হলে, ও সব কিছুই জানাজানি হবে না। এমনকী রেকর্ডও থাকবে না।

ললিতা ডাক্তারের মুখের দিকে তাকাল। লোকটিকে ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল। বলল, বেশ, আমি সবই বলব।

ডাক্তার একটি কাগজ আর কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, এতে লিখে দিন।

ললিতা তার নাম, স্বাতীর বাড়ির ঠিকানা এবং বয়স লিখে দিল। ডাক্তার দেখল, একটু হাসল। জিজ্ঞেস করল, ইতিমধ্যে কোনওরকম বাজে ওষুধ-বিষুধ খাননি তো?

কিছুই না।

ভেরি গুড। চলুন, আপনাকে একবার দেখে নিই।

 ডাক্তার বেল টিপে নার্সকে ডাকল। বললে, এঁকে আমি একটু দেখব। ও. টি-তে নিয়ে যাও।

ডাক্তার যা পরীক্ষা করবার করল। বলল, আজ সারা দিনে কিছুই করবার নেই। ভোরে কুরেট হবে। রাত্রে খাবার পরে অবিশ্যি দরকার।

ললিতা জিজ্ঞেস করল, আমি এখানেই থাকতে পারি তো?

 হ্যাঁ, পারেন। চলুন, ফর্মালিটিগুলো সেরে নেবেন।

 আবার আগের ঘরে ফিরে এল। ফর্মালিটি আর কিছুই না। ডাক্তার কোনও দ্বিধা না করেই বলল, পাঁচশো টাকা দিন। তা ছাড়া পার ডে কেবিন চার্জ কুড়ি টাকা। আজ আর কাল থাকতে হবে। ওষুধ ইনজেকশন যা লাগবে, সব আপনারই এক্সপেন্স। বাকি যা কিছু, নার্স আপনাকে বলে দেবে।

ললিতার ভয় ছিল, হয়তো আরও অনেক বেশি টাকা লাগবে। ও সমস্ত টাকাটাই একসঙ্গে দিয়ে দিল। তারপরে নার্স ওকে নিয়ে গেল কেবিনে। ছোট ঘর, কিন্তু তেমন অপরিচ্ছন্ন না। অসুবিধা একমাত্র, এ্যাটাচড বাথরুম নেই। না থাক, ঘরের বাইরে, দু পা গেলেই বাথরুম। নার্স সব দেখিয়ে দিল। এবং নার্সটি যে ওকে বারেবারেই চেয়ে দেখছে, সেটা ও লক্ষ করেছে। দেখুক, কিছু করবার নেই। হয়তো ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেছে, অনেক কিছু ভেবেছে। তাতেও আপত্তি নেই। নার্সরা এরকম ঘটনা রোজই হয়তো দেখে থাকে। হেসে থাকে, ভেবেও থাকে, আবার ভুলেও যায়। ললিতা কৃতজ্ঞতা বোধ করছে শুধু ডাক্তারটির ওপরে। লোকটি ওকে আর যাই হোক, বাজে কথা জিজ্ঞেস করে বিপদে ফেলতে চায়নি।

সারাটা দিন প্রায় শুয়ে শুয়ে কেটে গেল। দুপুরে ভাল করে খেতে পারেনি। খাবার কোনও ইচ্ছে ছিল না। রাত্রেও বিশেষ খেতে পারল না। রাত্রি সাড়ে নটার সময় আর একবার ও.টি-তে যেতে হল। জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এখানে লজ্জা আর সংকোচের কোনও প্রশ্ন নেই। তবু নার্সের হাতে সেফটি রেজার দেখে ওর যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। চোখ বুজে পড়ে রইল। ডাক্তারও যা করণীয় তা করল। এই প্রথম ললিতা যন্ত্রণা বোধ করল। মনে হল, ওর তলপেটে একটা আড়ষ্ট ব্যথা ধরে রইল। বুঝতে পারল, শরীরের অভ্যন্তরে কোনও ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে।

সারাটা রাত্রি কেটে গেল। ঘুম এল না, একটা নিঝুম ভাব নিয়ে বিছানায় পড়ে রইল। ভোরবেলা নার্স এসে ওকে ডাকল। নিয়ে গেল অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখল, ডাক্তার সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত। ডাক্তারের সঙ্গে আর একজন রয়েছে, সেও যুবক। ললিতা টেবিলের ওপর শুয়ে পড়বার পরে সে-ই এসে ওর হাত ধরে নাড়ি দেখল। স্টেথিসকোপ দিয়ে হার্ট পরীক্ষা করল।

নার্স ইতিমধ্যে ইনজেকশনের সিরিঞ্জে ওষুধ ভরে নিয়েছিল। নতুন ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিল। বোঝা গেল, এ ডাক্তার অ্যানেসথেটিক। সে অন্য ডাক্তারের দিকে একবার তাকাল। ডাক্তার ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক আছে।

অ্যানেসথেটিক ললিতাকে ইনজেকশন ফুড়ল, বলল, এক দুই করে গুনে যান।

ললিতা গুনতে লাগল, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ এগারো বারো তে– রো…চৌ….অন্ধকার…অন্ধকার…সমস্ত চেতনা জুড়ে গভীর অন্ধকার নেমে এল। দৃষ্টি আর মন বলে কিছুই রইল না।

.

 কিন্তু অন্ধকার চেতনার মধ্যে একটা আলোর বৃত্ত ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোর বুকে ললিতা নিজেকে দেখতে পেল। দেখল চলন্ত ট্রেন। ফার্স্ট ক্লাসের করিডরে ও আর বড় বউদি জানলার দিকে ঝুঁকে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওদের পাশ ঘেঁষে, অন্যান্য যাত্রীরা চলাফেরা করছে।

ললিতা বাইরে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর মনটা পড়ে আছে ঠিক পিছনেই সিঙ্গল কূপে-এর ওপরে। সিঙ্গল কূপে-এর দরজাটা খোলা। সেখানে একজন মাত্র যাত্রী। চোখের সামনে তার বই খোলা। দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত তার সঙ্গে ললিতার অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু প্রতি বারেই ললিতার বুকের মধ্যে চমকে উঠেছে। কেন, ও তা জানে না।

লোকটির বয়স কত হবে? বোধহয় চল্লিশের মধ্যে। দীর্ঘ দেহ, শ্যাম বর্ণ। বড় বড় কোঁচকানো কালো চুল, কপালের ওপরে একটি বিন্দু থেকে যেন সিংহের কেশরের মতো পিছনদিকে নেমে গিয়েছে। আয়ত টানা চোখ, খড়ঙ্গ নাসা, চিবুকের মাঝখানেতে একটা ঢেউ। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি।

এই বর্ণনাটা এমন কিছু না। কিন্তু মানুষটির চোখে কী আছে? বিষণ্ণতা? ব্যথা? অথবা ক্ষুধা? ললিতা কিছুই বুঝতে পারছে না। কেবল যতবারই তার সঙ্গে চোখোচোখি হয়েছে, ওর বুকের মধ্যে চমকে উঠেছে। মুখে রঙের ছোপ লেগে গিয়েছে। চোখের পাতা নেমে গিয়েছে। কিন্তু আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে দেখতে ইচ্ছা করেছে।

কেন? লোকটি কি ওর পরিচিত? মনে পড়ে না। এ মুখ যেন ভাস্করের তৈরি পাথরের মূর্তির মতো। এ মুখ যেন অনেকটা ঈশ্বরের বিগ্রহের মতো। কেন এ কথা মনে হচ্ছে? ললিতা কি সম্মোহিতা নাকি! ওর যেন নিশির ডাকের ঘোর লাগছে। বউদি দাদা পরিবার-পরিজন, সর্বোপরি প্রবীর কোনও কিছুই ওর মনে আসছে না। কামরার মধ্যে ঢুকে বউদি দাদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারে বারে বাইরের করিডরে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে। কেন? এ কি বিভ্রম। ঘুরে ফিরে মানুষটির মুখ ভেসে উঠছে। লোকটি একলা কেন? একটা কুপের মধ্যে দুজন থাকবার কথা। কিন্তু একজন যাচ্ছে, কে লোকটি? লোকটির ছবি দেখেছে নাকি কখনও।

ললিতার ভিতরে যেন তোলপাড় করছে। বারে বারে বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। সন্ধের মুখে সেও বেরিয়ে এল। দীর্ঘদেহ মানুষটি করিডর দিয়ে হেঁটে, ললিতার পাশ ঘেঁষে যাবার সময়ে মুহূর্তের জন্য যেন দাঁড়াল। ললিতার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু সে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। তখন গাড়ি একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে চলেছে, নীচে স্রোতস্বিনী তরঙ্গায়িত নদী।

ললিত দরজা দিকে তাকাল। লোকটির দৃষ্টিতে কী আছে? বিষণ্ণতা, ব্যথা না ক্ষুধা? তার দৃষ্টি যেন ললিতার বুকের গভীরে গিয়ে বিদ্ধ হচ্ছে। অথচ তার চোখে কোনও তীব্রতা নেই, ঝলক নেই। অন্য কী যেন আছে।

সে দরজা বন্ধ করে আবার ফিরে এল। আবার ললিতার পাশ দিয়ে গেল। কূপে-এর মধ্যে গিয়ে ঢুকল। একটু পরে ললিতা আস্তে আস্তে পিছন ফিরে দেখল। চোখাচোখি হল। ললিতা চোখ সরিয়ে নিজের কামরায় ঢুকে গেল। কে ও?না, ললিতা আর বাইরে যাবে না। আর তার চোখের দিকে তাকাবে না।

রাত্রি নটা পর্যন্ত ললিতা কামরার মধ্যে বসে রইল। খাবার এল, সকলে মিলে খেল। হাত ধুতে বাইরে গেল। দেখল পাশের সিঙ্গল কুপে-এর দরজা অর্ধেক বন্ধ। ভিতরে তাকে দেখা যাচ্ছে। সে গেলাসে চুমুক দিচ্ছে। গন্ধেই টের পেল, সে ড্রিঙ্ক করছে। ললিতার চোখের কোণ কুঁচকে উঠল। তাড়াতাড়ি বাথরুমে চলে গেল। হাত ধুয়ে ফিরে আসবার সময় আবার তাকাল। অর্ধেক খোলা দরজা দিয়ে এবার চোখাচোখি হয়ে গেল। লোকটি কি কাঁদছে নাকি। কেমন যেন অসহায় দেখাল চোখের দৃষ্টি। যেন ব্যথায় ভরে গিয়েছে।

ললিতা নিজের কামরায় ঢুকল! দাদা ওপরের বার্থে উঠে পড়েছে। নীচের একটা বার্থে বউদিও শাবার ব্যবস্থা করছে। অন্য একটি ওপরের বার্থে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তিনি অনেক আগেই শুয়ে পড়েছেন। ললিতা একটা ম্যাগাজিন খুলে বসল। বউদি জিজ্ঞেস করল, শোবে না?

পরে। তুমি শোও।

 বউদি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। করিডরে যাত্রীদের আনাগোনা আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। এক সময়ে সব চুপ হয়ে গেল। গাড়ির শব্দ আর ঘুমন্ত নিশ্বাসের শব্দ। ললিতা উঠে দাঁড়াল। বাতি অফ করল। দরজা খুলে বাইরে গেল। করিডর ফাঁকা। পাশের কুপে-এর দরজা তেমনি সরে এল, ললিতা। মটনে বন্ধ করে দিল। ললিতা রামগয়ে ঢুকল। শুয়ে পা আধ-খোলা। ললিতা দেখল, সেই দীর্ঘদেহ মুর্তি, উপুড় হয়ে গদির ওপরে পড়ে আছে। প্রায় অর্ধেক শরীর গদির বাইরে। যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।

কী ব্যাপার? মাতাল হয়ে গিয়েছে নাকি? নাকি ওভাবেই ঘুমোচ্ছে? ললিতা দুদিকে দেখল। কেউ নেই। ও দরজার কাছে এগিয়ে, ভিতরে উঁকি দিল। সিটের পাশে, ছোট টেবিলের মতো জায়গায়, বোতল আর গেলাস। লোকটির মাথার কাছে একটা বই। আলো জ্বলছে। কোনও রকম বিছানাপত্র নেই। ওপরের বার্থে বড় একটা স্যুটকেস।

সরে এল ললিতা। বাথরুমের দিকে এগোল। কন্ডাক্টর গার্ড এগিয়ে এল। এসে, সেই সিঙ্গল কুপে-তে উঁকি দিল। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। ললিতা বাথরুমে না গিয়ে ফিরে এল। এখন আর কিছু দেখবার নেই। দরজাও খোলা যাবে না। ও নিজের কুপে-তে গিয়ে ঢুকল। শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুম এল না।

পরের দিনও, সারাদিন একই নিঃশব্দ, চোখে চোখে দেখা হল। কিন্তু আজ যেন তার চোখে নতুন দৃষ্টি। কেমন একটা করুণ হাসি মেশানো আহ্বান তার চোখে। আজ ওর বুকে চমকের থেকে কাঁপন বেশি। বউদি দাদা ওর পরিবর্তন কিছুই ধরতে পারল না। কিন্তু যার পিরবার সে ঠিক পেরেছে। দুপুরে সমস্ত গাড়ি যখন দিবানিদ্রা আর বিশ্রামে মগ্ন, ললিতা তখন করিডরে। সে বেরিয়ে এল, একেবারে পাশে এসে দাঁড়াল। ললিতা তখন বেতস লতার মতো কেঁপে উঠল। চোখ বুজে রইল। চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেল না। সহসা ও মাথায় স্পর্শ পেল। ওর সারা গায়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল। যেন সূর্যের স্পর্শ লাগল কুন্তীর শরীরে।

পরমুহূর্তেই সে তার কুপে-তে ফিরে গেল। ললিতা প্রায় ছুটে ওর কুপে-তে ঢুকে, বার্থের ওপর শুয়ে পড়ল। ওর বুকের মধ্যে কাঁপছে।

কিন্তু সেই কাঁপুনি, সন্ধেবেলায় যেন একটা ঢেউয়ের দোলায় দুলতে লাগল। রাত হল। ললিতা খেতে পারল না। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে, ও বাইরে এল। দেখল, পাশের কুপের দরজা খোলা। কিন্তু ভিতরে অন্ধকার। ললিতা দুদিকে দেখে নিয়ে, অন্ধকারে উঁকি দিল। তৎক্ষণাৎ দুটি বলিষ্ঠ সাগ্রহ হাত ওকে ভিতরে টেনে নিয়ে গেল। ঠোঁটে স্পর্শ পেল। ললিতা এই অন্ধকার কুপে-এর বাইরের সমস্ত জগৎটা একেবারে ভুলে গেল। ও নিজেও দুহাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল।

তারপরে কেমন করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, কখন আবার ও সেখান থেকে বেরিয়ে এল, কিছুই মনে করতে পারে না, কেমন করে নিজের কুপে-তে এল, শুয়ে পড়ল। কেবল ওর সারা দেহ জুড়ে, একটা তীব্র দহনের অনুভূতি।

সকালবেলা ট্রেন থেকে নামবার আগে দেখল, পাশের সিঙ্গল কুপ ফাঁকা। কেউ নেই, কিছু নেই।

.

বেলা দুটো। ললিতার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ও অঝোরে কাঁদছে। নার্স ওকে থামাবার চেষ্টা করছে, পারছে না। ললিতা বলল, ডাক্তারবাবুকে ডেকে দিন।

ডাক্তার এল। ললিতা একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলল, এই নাম্বারে ফোন করে, প্রবীরকে ডেকে দিন, বলুন ললিতা তাকে ডাকছে।

প্রবীর না আসা পর্যন্ত দুহাতে মুখ ঢেকে পড়ে রইল।

প্রবীর এল আধঘণ্টার মধ্যেই। ললিতার চোখে জল, কিন্তু ভেজা স্বরে বলল, বসো প্রবীর। কোনও কিছু বলবার আগে, আশা করি কিছু আন্দাজ করতে পারছ?

প্ৰবীর বলল, পারছি।

তারপরে?

 তারপরে তুমিই বলো।

বলব বলেই এখানে ডেকে এনেছি। তোমাকে ফাঁকি দিতে পারব না। তারপরেও যদি তোমার দরজা আমার জন্য খোলা থাকে…

কথা শেষ করার আগেই, ললিতার সারা শরীর মথিত করে কান্না ছুটে এল। প্রবীর ওকে দুহাতে ধরে বলল, দরজা খোলার কোনও প্রশ্ন নেই। আমরা অন্য যুগে বাস করছি। তুমি আমাকে এখানে ডেকে এনেছ, তাতেই সব বলা হয়ে গেছে। তোমার মন এখনও আমাকেই চায়, আমি আছি। কেননা আমি তোমাকে এখনও চাই।

প্রবীর!

 ললিতা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। প্রবীরের দুটো হাত টেনে নিয়ে নিজের মুখে চাপা দিল।

প্রবীর আরও নিবিড় হয়ে বলল, শান্ত হও ললিতা, চুপ করো।

 প্রবীর ললিতার অ্যানাসথেসিয়ার গন্ধে ভরা উষ্ণ ঠোঁটের ওপর মুখ নামিয়ে নিয়ে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *