অশান্ত

অশান্ত

জগদ্দল।…

অসংখ্য গলি, আর ঘন ঠাসা বস্তি, আর প্রকাণ্ড বড় বড় চটকলগুলোকে দু পাশে রেখে বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড চলে গেছে। তারই এক অংশের নাম জগদ্দল।

জগদ্দলের ছেলে লাল্লু। অনেক সময় লোকে ওকে ডাকে বদমাশ, কিছু ফেরেববাজ, সেটা ওর খুব খারাপ লাগে না। কারণ ওগুলো ঠিক গালাগাল নয় ওর কাছে। আর এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি করতে গেলে ওর তো এখানে বাস করাই চলে না। লোকে যা বলে ওর মা বাবাও তাই বলত ওকে। এখন মা বাপ নেই, অপরের মা বাপ বলে।

সম্ভবত লাল্লুর বয়েস পনেরো হবে। কিন্তু বয়সকে ছাড়িয়ে সে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। বয়স্ক মানুষের মতোই গাল ঝরে যাওয়া পাকা পাকা মুখ। জোয়ান আর শৌখিন তাঁতি স্পিনারের মতো বড় বড় ঘাড় কামানো চুল। বাড়তে না পাওয়া শরীরটা শক্ত আর রোগা। মনে হয় সার না পাওয়া ছাইগাদার জংলা গাছগুলো যেমন মরকূটে হয়ে যায় ওর যেন খানিকটা তেমনি। গায় পরে নীল রং-এর হাতকাটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর চেষ্টা করে যে কোনও জোয়ান তাঁতির মতোই বুক ফুলিয়ে একটা বাহাদুরি চালে চলতে। এরাই ওর আদর্শ। একজন ভাল তাঁতি হওয়ার আশা করে সে, এমনকী একটা লাইন সর্দারির কথাও মাঝে মাঝে ভাবতে আরম্ভ করে। দাপট আর দৌলতের নেশায় এরকম মাঝে মাঝে পেয়ে বসে তাকে। তবে নিজে সে একতিল বিশ্বাস করে না যে কোনওদিন সর্দার হতে পারবে। কারণ সর্দার হতে গেলে বাবু আর সাহেবদের যে মুঠো মুঠো টাকা দিতে হয় তা তো সে কোনওদিনই রোজগার করতে পারবে না!

পান খায় সে অনবরত যেমন খায় একজন বয়স্ক লোক, আর ঠোঁটের কোণে সারাক্ষণই প্রায় বিড়ি চেপে ধরা থাকে যেমন থাকে যুবকদের ঠোঁটে।

কাজ করে সে চটকলের নলিঘরে মেয়েদের সঙ্গে। অত্যন্ত অপছন্দ করে সে মেয়েদের সঙ্গে কাজ করতে। তার পোরুষ এতে আঘাত পায়। তার সমবয়সিদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটিতে তাকে হার মানাবার একমাত্র বুলি হল তুই তো জেনানার কাজ করিস! ব্যস জোঁকের মুখের নুন পড়ার মতো লাল্লু একেবারে চুপ হয়ে যায়।

চাকরির পর বাদবাকি সময়টা সে সিনেমা হলে চা বিক্রি করে কাটিয়ে দেয়। এটা ঠিক পয়সা রোজগারের জন্য নয়। দোকানের মালিকের কৃপায় মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে পায় আর চা খেতে পায়। তা ছাড়া আর দোস্ত ইয়াররা সব সিনেমার আশেপাশেই আড্ডা জমায়। সন্ধ্যাবেলা মাথায় গাদাখানেক তেলজল মেখে আর রুমালটা গলায় বেঁধে এখানেই ঘোরাফেরা করতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে সিনেমা শুরু হওয়ার আগে কয়েকটা মারপিটের ছবির কোনও কোনও অংশ নিজেদের মধ্যে অভিনয় করে দর্শকদের দেখায় দর্শকরাও তাদের উৎসাহ দেয়। কোনও কোনওদিন অভিনয় দাঙ্গায় পরিণত হয়। তখন দারোয়ানের লাঠির ঘায়ে ঠাণ্ডা হয় সব। দর্শকদের কাছে নিজেকে তুলে ধরার নানান কায়দাকানুনের একটা বিশেষ বাতিক আছে তার। বিশেষ করে যেদিন সিনেমার ম্যানেজার বাবুর ছেলেমেয়েরা আসে, সেদিন চাওয়ালা ছোকরাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার হিড়িক লেগে যায় কে কতটা তাদের চোখে লাগতে পারে। নিজেদের মধ্যে পরে তারা এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি ও হিসেব নিকেশ করে। যে যতটা বাড়িয়ে বলতে পারে, সে ততটাই প্রাধান্য লাভ করে। এ বিষয়ে লাল্লুর কৃতিত্বই বেশি। কিন্তু সে জানে ম্যানেজার বাবুর ছেলেমেয়েদের সুন্দর আর স্বপ্নভরা চোখগুলো একবারের জন্যও পড়েনি তার ওপর। কেন না ম্যানেজারের সামনে বাহাদুরের কায়দাকানুন করার মতো দুঃসাহস তাদের কারুরই নেই। কখনও কখনও হয়তো তাদের লাল্লুদের চোখে পড়ে। কচি কচি লাল ঠোঁটে লজেন্স আর চকোলেট চুষতে চুষতে অচেনা আর অবজ্ঞার চোখে তারা দেখে। কিন্তু লাল্লুর ভাল লাগে। কী সুন্দর নরম আর ঝকঝকে ওরা। মাঝে মাঝে ওদের কাছ দিয়ে একটু ঘুরেফিরে আসে সে। কেমন একটা সুগন্ধ যেন ঘিরে থাকে তাদের চারপাশে যে গন্ধটা প্রাণ ভরে নিতে ইচ্ছে করে।

রাত্রে হোটেলে ফিরে খেয়ে হোটেলওয়ালির কাছ থেকে যখন তার ছোট বোন লীলাকে নিয়ে ঘরে ফিরে যায় তখন গল্প করে সে সব কথা তার বোনের কাছে। জানিস একদম ছবির মতো আর গন্ধ শুকলে তোর দিমাক খারাপ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, বহুৎ ভারী ঘরের লেড়কা লেড়কি কিনা। আমাকে খুব পেয়ার করে!…হ্যাঁ? দাদার পাশে চলতে চলতে হোটেলওয়ালির হাতে বেড়াবিনুনি বাঁধা ছোট্ট লীলার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে ওঠে। তারও ইচ্ছে করে একদিন দেখতে। কিন্তু দাদা তাকে কোনওদিনই নিয়ে যায় না। তা হলে হয়তো দাদার মতো তাকেও ওরা পেয়ার করত।

কিন্তু পরমুহূর্তেই লাল্লুর মনটা নিজের উপর বিরক্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে বোনকে এরকম মিথ্যে বলার জন্য। দুনিয়ায় কাকে কে কবে পেয়ার করেছে? এ দুনিয়ার পেয়ার কোথায় আছে?

ঘরে শুয়ে বোনকে পাশে টেনে নিজেই সে পেয়ার করে। চুপি চুপি বলে; তোকে আমি লেখাপড়া শেখাব, ওদেরই মতো তোকেও বানিয়ে দেব। হাঁ!

ওদের মতো? লীলার চোখে ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে দেখা মিল সাহেবের ফুটফুটে বেণি দোলানো পুতুলের মতো ছেলেমেয়েদের চেহারা। পরীর মতো সুন্দর আর মধুর! সেইরকম সে হবে! দাদার বুকে মুখ ঢেকে কান্না রোধ করে সে। না, ওরকম সে হতে চায় না। বড় ডর লাগে। ভারী মিঠা লাগে ওদের, কিন্তু তার থেকে বেশি ডর লাগে তার। চায় কালী ভুজাওয়ালির নাতনির মতো হতে। ইয়াবড় বুকের পাটা আটা দেওদার গাছের মতো লম্বা আর ভীষণ খাণ্ডার। যে একদিন বে-ইজ্জত করতে চেয়েছিল বলে এক ডিপার্টমেন্ট ওভারসিয়ারকে মেরে আধমরা করে ফেলেছিল। হাঁ, ঠিক সেইরকম।

লাল্লুও বুঝতে পারল আবার সে বোনকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছে। পান খেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতে দাঁত ঘষে ভাবল সে তার তো পয়সাই নেই। কেমন করে সে তার বোনকে সুন্দর শিক্ষিত করবে। তার হপ্তার টাকা আট আনা বাদে সবই হোটেলওয়ালিকে দিয়ে দিতে হয় খাওয়া খরচের জন্য। ওই টাকা থেকেই হোটেলওয়ালিই মাসে দুটাকা ঘরভাড়া মিটিয়ে দেয় তাদের।

এ ঘরটা ওদের খুব পেয়ারের ঘর। এ ঘরেই ওরা দুভাই বোন জন্মেছে আর ওর বাপ মা মরেছে। এ ঘরের কাঁচা মেঝেয় শুয়ে বসে মানুষ হয়েছে ওরা। এ ঘরেই রয়েছে ওদের অনেক বছরের ইতিহাস আর চিহ্ন। ঘরের ডান দিকের কোণটাতে নিয়ে গিয়ে লাল্লুর বাবা লাল্লুকে মারত। কারণ ওখান থেকে পালানো যেত না। হপ্তার চারদিন ছিল মার খাওয়ার পালা। সোমবার থেকে বৃহস্পতি বার। শুক্রবার হপ্তার টাকা পাওয়ার পর থেকে রোববার পর্যন্ত বাপের কোনও সাড়াশব্দ বড় একটা পাওয়া যেত না। সেইজন্য ওই চারদিন লাল্লু একটু সাবধানে আড়ালে থাকত। কোনওদিন ওর মাকে ধরেও মারত ওর বাবা। তখন লাল্লু অযথা লীলার সঙ্গে একটা খুনসুটি বাঁধিয়ে ঝটাপটি চেঁচামেচি শুরু করে দিত। অমনি ওর বাবা মাকে ছেড়ে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু লাল্লু তো একছুটে পালিয়ে যেত। ধরা পড়ত লীলা। কিন্তু লীলাকে বড় ভালবাসত তার বাবা। কখনও মারত না তাকে। বরং লীলাকে বুকের কাছে নিয়ে খুব আদর করত গালাগাল দিত লাল্লুকে।

এ রকম না করলে তার বাবা মার ঝগড়া থামতে চাইত না। বাবা মার ঝগড়া আর অত্যন্ত জঘন্য গালাগালি কটুক্তি। বস্তিবাসীদের সঙ্গে নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে ঝগড়া ঠাট্টা তামাশা এ সব লাল্লু কখনও পছন্দ করত না। হাঁ, একদিক থেকে তার মা খুব শান্ত আর হিসেবি ছিল। কিন্তু বাপের বেপরোয়া দুর্ব্যবহারে মাকেও জড়িয়ে পড়তে হত। লাল্লু তাই মনে মনে বলত; হে রামজি, বাবাকে মার ডালো!…এখন কিন্তু সে কথা মনে হলে বড় কষ্ট হয় তার। মনে করে তার অভিশাপেই বুঝি বাপের অকাল মরণ হল।

নিজে সে কখনও লীলার সঙ্গে ঝগড়া করে না। যতটা সম্ভব মিলে মিশে শান্ত হয়ে থাকা যায় তাই সে চেষ্টা করে। বাবার মতো নিশ্চয়ই সে হবে না–ওইরকম মাতাল আর ঝগড়াটে। সে চায় শান্ত সুখী ঘর।…ভাইয়া, ও ভাইয়া। ভোরবেলা লাল্লুর গায়ে ঠেলা দেয় লীলা।–ওঠ, ওঠ, পয়লা বাঁশি হয়ে গেল।

রোজকার মতো কয়েক ধাক্কায় লাল্লু উঠে চোখ ঘষতে থাকে এক কোণে বসে। লীলা ঝাঁটা দিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে আরম্ভ করে। তারপর দুজনে ঘরের শিকল তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গলি থেকে বড় রাস্তায় এসে জলকলে হাতমুখ ধুয়ে হোটেলে গিয়ে ওঠে। হোটেলে তখন চায়ের খদ্দের গিজ গিজ করে।

ওরা দুজনেও চায়ের গ্লাস নিয়ে বসে পড়ে। আরও অন্ধকার রাস্তার দিকে চেয়ে চেয়ে পাশাপাশি দুজনে চা খাওয়া শেষ করে লাল্লু ঠোঁটের কোণে চেপে ধরে বিড়ি জ্বালায়। দু-চার টান দিয়ে খুব খানিকটা কেশে অস্বাভাবিক মোটা আর বুড়োটে গলায় সাবধান করে লীলাকে! ঝুটমুট কারুর সঙ্গে ঝগড়া করিসনি, আর না বলে কোথা যাসনি বুঝলি?

বলে পকেট থেকে চিরুনি বের করে মাথাটা ভাল করে আঁচড়ে পাশে বুড়ো তাঁতি আনোয়ারকে একটা খোঁচা দেয় কনুই দিয়ে।–চলো হে।

আর একটু হলে আনোয়ারের চা ছলকে পড়ে যেত। সে রেগে ধমকে ওঠে; আরে শালা লওণ্ডা, মারব দো ঝাপ্পড়।

এক ঝলক হেসে উঠে পড়ে লাল্লু।

লীলা করুণ চোখে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর একটু কুণ্ঠার সঙ্গে মিনতি করে ঠিক যেন লায়েক ছেলের মায়ের মতো; ভাইয়া, কারুর সঙ্গে ঝগড়া কোরো না।…

-হাঁ হাঁ। খুব গম্ভীর হয়ে বেরিয়ে যায় লাল্লু।

রোজই তারা দুজনে দুজনকে এমনি সাবধান করে। বিদায় নেয়।

সেকসনে ঢুকে দমে গেল লাল্লু। রোজকার মতো কেউ তাকে ডেকে কথা বলল না। কাজ কর্মও কেউ বিশেষ করছে না। কেবল এধার ওধার জটলা করছে। এমনকী পদ্মিনীরও পাশ দিয়ে ঘুরে আসা সত্ত্বেও রোজকার নেই সোহাগের ডাক শুনতে পেল না।

পদ্মিনীকে লাল্লু ভালবাসে। জোয়ান ঘোড়ার মতো শক্ত সবল মেয়েমানুষ। লাল্লুর চেয়ে অবশ্য সে অনেক বড়, প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়স হবে, লাল্লুর মার সঙ্গে কাজ করত সে। নিজে সে সন্তানহীনা বলেই বোধহয় লাল্লুকে আদর সোহাগ করতে ভালবাসে। কিন্তু লাল্লু অন্যরকম ভাবে। সে পদ্মিনীকে মনে মনে বিয়ে করার কথা ভাবে। লজ্জায় ভয়ে সে কথাটা বলতে পারে না। শুধু নির্বিবাদে আদরটুকু খেয়েই নীরব থাকে। জানলে পরে পদ্মিনী যদি আর পেয়ার না করে এই ভয়েই কিছু বলে না সে। মাঝে মাঝে পদ্মিনীর প্রাণখোলা ঠাট্টা আর প্রগলভতায় লাল্লুর মনে বাঁধ ভেঙে যেতে চায়। কিন্তু যা পেয়েছে তাই হারাবার ভয়ে কিছু বলতে পারে না।

পদ্মিনী তাকে দেখলেই রোজ বলে ওঠে, এ হামারা বাবুসাহাব আয়া হ্যায়!…কিন্তু আজ সে কিছুই বলল না। এমনকী একবার তাকিয়েও দেখল না!…

বুকের মধ্যে নিশ্বাস চেপে সেকসনের এধার ওধার ঘুরে নিল সে। আস্তে আস্তে আন্দাজ করল, নলিঘরের কিছু একটা বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, তাই সকলে কাজ ফেলে জটলা করছে, গালাগালি দিচ্ছে, শাপমন্যি করতে শুরু করেছে জেনানার দল।…

পদ্মিনীর আঁচল ধরে টান দিল সে। কী হয়েছে?

–আড়াইশ অওরত ছাঁটাই হবে। পদ্মিনী চেঁচিয়ে জবাব দিল। তার চেঁচানিতে অনেকেই তার দিকে ফিরে তাকাল। বুড়ি রিজিয়া দাঁতহীন মাড়ির পাশ দিয়ে জিভটাকে বের করে ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এল। যেন জিভ দিয়েই শুনছে সে।

হয়তো তুইও আছিস বাবুসাহেব। লাল্লুকে বলল পদ্মিনী। এখুনি ওরা কাগজ দিয়ে যাবে।

তুইও আছিস? কথাটা বিশ্বাস করতে সাহস করল না লাল্লু। তার এ পনেরো বছরের ক্ষয়ে যাওয়া বুকটা কেঁপে উঠল। মনে হল সিনেমার পরদায় যেন কোনও দম আটকানো সাংঘাতিক আতঙ্কজনক দৃশ্য দেখছে সে!…আস্তে আস্তে দম ফেলবার চেষ্টা করে সে।…না এ হতে পারে না। সে তো বুড্ডা আদমি নয় যে কাজ কাম ঠিক চালাতে পারে না। আর মানিজার সাহাব তো জানে অলগু স্পিনারের লেড়কার দুনিয়ায় কেউ নেই।…হাঁ, তার বাপকে নাকি মানিজার সাব খুব পেয়ার করত। বাবা মরে গেছে শুনে তার মাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে বলেছিল সাহেব, তোমার মরদ খুব ওস্তাদ আর খাঁটিয়ে লোক ছিল, বহুৎ বাচ্চা বয়স থেকে কাজ চালিয়েছে এখানে। তোমার মরদের নামে বিশটা টাকা ইনাম দিলাম।

সেই সময়েই লাল্লুর মা লাল্লুর জন্য সাহেবের কাছ থেকে এ নোকরিটা ভিখ মেগে নিয়েছিল।…সেই নোকরি!….

তখনও সে পদ্মিনীর আঁচলটা ধরে ছিল। বুড়ি রিজিয়া তাকে ঠেলে দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পদ্মিনীর গায়ের উপর।আমার নামও আছে?

পদ্মিনী জবাব দেওয়ার আগেই লাল্লু রিজিয়াকে এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিয়ে ভেংচে উঠল; আমার নামও আছে? বুড়ি, ধাক্কা মারলি কেন? তোর নাম পয়লা আছে!

আর যায় কোথায়! রিজিয়া রাগে দুঃখে নেচেকুদে কেঁদে চেঁচিয়ে গালাগাল দিয়ে সেকসনটাকেই মাথা করে তুলল। রাজ্যের গালাগাল আর খিস্তিতে ফেটে পড়ল সে।

ওদিকে লাল্লুও ফেটে পড়ল হাসিতে। আরও অনেকেই রিজিয়ার কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল সামনে বিপদ জেনেও… পদ্মিনী ধমকে উঠল লাল্লুকে। এ ক্যায়া বাবুসাহাব। একটা বুড়িকে তুই…।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রিজিয়া তাকেও গালাগাল দিতে আরম্ভ করল অশ্রাব্য ভাষায়, তারপরে সেকসনের সবাইকে, তারপরে বোধহয় হঠাৎ ছাঁটাইয়ের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় চৌদ্দ গুষ্টিকে উদ্ধার করতে লাগল ম্যানেজার আর লেবার বাবুর।

কিন্তু কাগজ এল না, ঘুরে ঘুরে গুলতান আর জটলা করে টিফিন পর্যন্ত কেটে গেল।

টিফিনের পর ফিরে এসে সবাই দেখল মেশিনের উপর প্রত্যেকের জায়গায় একটা করে কাগজ রয়েছে। আসবার সময় তারা সকলেই দেখে এসেছে মিলের ফটকে মেলাই পুলিশ জড়ো হয়েছে। সেকসনের কেরানি বাবুটিও ভেগে গেছে।

লাল্লুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। দেখল তার জায়গাতেও একটা কাগজ রয়েছে। কী লেখা আছে তা সে পড়তে পারল না। কাগজটা হাতে নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না কী করবে। তার চোখের সামনে খালি বোন লীলার মুখটা ভেসে উঠল। আর হোটেলওয়ালির মুখটা যে তাদের দুবেলা খেতে দেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই অওরতের দল ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করল। বিশেষ করে বুড়ি মেয়েমানুষের দল। অন্যান্য মরদেরাও কাজ ছেড়ে ওদের সঙ্গে গোলমালে ভিড়ে গেল।

লাল্লু কাগজটা হাতে নিয়ে পদ্মিনীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যেন মৃত্যুর পরোয়ানা তার হাতে। তার চোখে আতঙ্ক আর হতাশা। নিতান্ত বাচ্চা আর নিঃসহায়, কিন্তু কেউ একটু দরদ দেখাচ্ছে না তাকে। একমাত্র পদ্মিনীই তাকে কাছে টেনে নিল।

কালীভুজাওয়ালির নাতনি সবাইকে হাঁকডাক শুরু করল। মা কালীর মতো খ্যাপা মূর্তি হয়ে উঠেছে তার। সে সবাইকে বলল: ফিরিয়ে দাও এ কাগজি নোটিশ। ম্যানেজারের নাকের উপর ছুঁড়ে দাও।

কালীভুজাওয়ালির নাতনির পেছন পেছন গেল সবাই ম্যানেজারের দরজায়।

লাল্লুর কী রকম ভয় করল প্রথমটা। একটা কাগজকে ততখানি বিপজ্জনক মনে করতে তার ব্যস্ত কিশোর মন পারছে না। হয়তো..হয়তো তাকে শেষ পর্যন্ত রেখে দেবে মানিজার সাহেব। অলগু স্পিনারের ব্যাটা তো সে!

এখুনি এগিয়ে যেতে দ্বিধা করল সে। এমনকী পদ্মিনীকে পর্যন্ত আঁচল ধরে টেনে রাখল।

–মৎ যাও। পদ্মিনীকে সে নাম ধরে ডাকে। মৎ যাও পদ্মিনী!…

 –এই সেরেছে। পদ্মিনী হেসে উঠে ওকেই বরং টেনে নিয়ে চলল।তবে কি তুই ছাঁটাই চাস?

 পদ্মিনীর দীপ্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল একটু বিহ্বল ভাবে লাল্লু। প্রগলভ আর সোহাগি পদ্মিনীর চেয়ে এখন আরও রহস্যজনক মনে হয় পদ্মিনীকে। লিখাপড়া জানা সিনেমা ম্যানেজারের বহুর মতো বড় ঘরের গম্ভীর আর ভারী (বিদুষী) অওরত। রাগে, খ্যাপে কিন্তু কালীভুজাওয়ালির নাতনির মতো খাণ্ডার আর ঘোড়ার মতো মেয়েমানুষ নয়।

তবু বলল সে, কিন্তু এমন ডাঁটের মাথায় গরম দেখালে পরে দুসরা কোনও ফিকির থাকবে না। আমাদের সবাইকে হয়তো নাও ভাগিয়ে দিতে পারে।

পদ্মিনী এত দুঃখেও হাসল।–বুডবক কাঁহিকে। মানিজার কি তোর মওসা লাগে? বাঘ খুন না খেয়ে ছেড়ে দেয়? ভাগিয়ে তোকে দেবেই যদি জোর করে তুই না থাকতে পারিস। ওরা কোনও বাত চায় না।

লাল্লু বুঝল পদ্মিনী দৃঢ়। দরজার আড়াল থেকে সে দেখল ভুজাওয়ালির নাতনি লম্বা চেহারাটা নিয়ে ম্যানেজারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা কোনও দুর্ঘটনার জন্য সে যেন পল গুনতে লাগল।

–কেয়া মাংতা? সাহেব জিজ্ঞেস করল।

যেমনি বলা, ভুজাওয়ালির নাতনির মুখ থেকে অমনি যা তা গালাগালি বেরুতে লাগল। ম্যানেজারকে মারে আর কী! কাগজটা ছুঁড়ে ফেলল সে সাহেবের মুখের উপর। তারপর বোধহয় আসতে আসতে বলল–মুণ্ডপাত করব তোর সাদা শয়তান।

আড়াইশো মেয়েমানুষ ঠিক অমনি করে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এল। টেবিলের উপর ভরে উঠল ছাঁটাই নোটিশের কাগজে।

….এবার ধীরে ধীরে ঢুকল লাল্লু। ঢুকে একটা মস্তবড় সেলাম ঠুকল সাহেবকে। সালাম হুজুর। সাহেব সন্দেহে আর বিস্ময়ে তাকাল তার দিকে। কেয়া মাংতা?

ওর বাবার মতো কপালে হাতটা ঠেকিয়েই বলল লাল্লু; আমি অলগু স্পিনারের ব্যাটা। কিন্তু এখন কেউ নেই। একটা ছোট বহিন আছে। ছাঁটাই হোগা তো মর যায়গা সাব।…

–কোনও এক্তিয়ার নাই আমার। সাহেব মাথা নাড়ল।–আলু গুদামকা হুকুম, ছাঁটাই জরুর করতে হবে। কিন্তু লাল্লু নড়তে পারল না।

সাহেব একটু চুপ করে থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে ধরল তার দিকে অলপ্ত বহুত ভাল আদমি ছিল। এ পাঁচটা রুপেয়া ইমাম নিয়ে নাও তুমি…

কোনও দয়ামায়ার চিহ্নই দেখতে পেল না লাল্লু সাহেবের মুখে! অলগুর লেড়কা বলে পাঁচটা টাকা দিতে চায় কিন্তু ছাঁটাই করবেই। বোনটাকে আর ওকে মেরে ফেলবেই। মরে যাবে তবু একটু দরদ দেখাবে না! আর সে কিনা…! তার ঝরে যাওয়া গালে চোয়ালের হাড় দুটো শক্ত হয়ে ফুটে উঠল। ঠিকই বলেছে পদ্মিনী।…

কাগজটা রেখে দিল সে ম্যানেজারের টেবিলের উপর। তারপর বহুত ভাল অলগুর কৃপাপ্রার্থী ছেলেটা কপালের উপর থেকে ঝাঁকড়া চুলগুলো এক ঝাঁকিতে পেছনে সরিয়ে দিয়ে বলল, ভিখ চাই সাব।

তারপর একজন জোয়ান লায়েক তাঁতির মতো হাড় বের করা বুকটাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে হন হন করে পদ্মিনীর কাছে এসে দাঁড়াল।

তার বুকের মধ্যে ভয় আর ক্ষোভ একসঙ্গে আলোড়ন তুলল। তার কান্না পেতে লাগল, তার ইচ্ছে করতে লাগল কামড়ে খামচে ছিঁড়ে ফেলতে কাউকে। বাবাকে আর মাকে মনে পড়তে লাগল তার। যে কোনও কারণে দুখ তখলিখ হলেই বাবা মাকে মনে পড়ে তার। কিন্তু কোনও সান্ত্বনা পেল না সে।

মেয়েরা সব গোলমাল করেই চলেছে। জাতীয় আঞ্জুমানের (ইউনিয়ন) লিডর বাবুরা এসে কী বোঝাবার চেষ্টা করছে ওদের। কেবলি শান্ত হতে বলছে সবাইকে। ভুজাওয়ালির নাতনি মারমুখী হয়ে কথা বলছে তাদের সঙ্গে! সবচেয়ে বেশি ফালতু গোলমাল করছে বুড়িগুলো। আর ঘন ঘন সন্দেহে আর ভয়ে গেটের পুলিশগুলোর দিকে তাকাচ্ছে।

–পদ্মিনী। লাল্লু বলল আকুলভাবে।–হোটেলওয়ালি আমাদের জরুর ভাগিয়ে দেবে, লীলাটা মরে যাবে।….

হাঁ, পদ্মিনীর বুকটার মধ্যেও হাহাকার করে উঠল। কোনও সান্ত্বনা স্তোকবাক্য খুঁজে পেল না সে, ছেলেটাকে বলবার মতো। লাল্লুর শুকনো পাকা মুখটা চেপে ধরল সে তার বন্ধ্যা রিক্ত বুকটাতে তার বুকটা মুচড়ে চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না চেপে বলল সে, কোনও উপায় নেই বাবুসাহেব। মরে বেঁচে থোক লড়ে আমাদের এ ছাঁটাই রুখতেই হবে।..

অত্যন্ত সহজ আর সরল মনে হল লাল্লুর পদ্মিনীর কথা। বাঁচতে হলে লড়া ছাড়া কোনও গতি নেই। পদ্মিনীর উত্তপ্ত নিশ্বাস তার ক্ষয়ে যাওয়া বুকটায় যেন আগুন ছড়িয়ে ছিল। তার কিশোর সুলভ পুরুষত্ব তাকে কেবলি ধিক্কার দিতে লাগল–সবাইকে ছেড়ে কেমন করে সে দয়া চাইতে গিয়েছিল।

পদ্মিনীকে ছেড়ে সে ভিড়ের মধ্যে ঢুকল। সকলেই খুব মারমুখী হয়ে উঠেছে। তারা জলদি ফয়সালা আর নোটিশ উঠিয়ে নেওয়ার কথাই বারবার চেঁচিয়ে বলতে লাগল। দু-একজনের হাতে ঝাঁটা লাঠিও উঠেছে।

লাল্লু দেখল লেবার অফিসে তালা পড়েছে। বাবুটা ভেগে গেছে। মানিজারটাও চলে যাচ্ছে।

-তোমরা শান্ত হও। আঞ্জুমানের লিডর লোক ধমকাতে লাগল।

 বড় তাজ্জব লাগে লাল্লুর। কেমন করে শান্ত হব আমরা? কেমন করে? কাঁদব না, চেঁচাব না তো কারা কাঁদবে চেঁচাবে? মিসিপালটির চারমান আঞ্জুমানের লিডর তো আর অলগুর ব্যাটা লাল্লুর হাল জানে না! ওর লেড়কিটা আমার বোন লীলার গায়ে থুথু দেয় কাছে গেলে, আর দোতলার উপর থেকে ওরা শান্ত হতে বললে কেন শুনব আমরা।….কিন্তু ওরা হুকুমতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, আলুগুদামের খবর রাখে, ওরা লিখে পড়ে একটা বুঝ সময় ফয়সালা করতে পারে না কি।

কিন্তু আর সকলের মতো তারও সংশয় ও সন্দেহ। প্রাণ-খুলে বিশ্বাস করতে পারে না। আচমকা তাদের পথের মাঝে দেখা দেওয়া এ সব বাবুসাহেব লিডরদের তারা বোঝে না, চিরকাল এড়িয়ে চলা তাদের অভ্যাস। তাদের নির্মম নিষ্ঠুর দরিদ্র দুখীজীবনে এরা বিপদই এনে দেয়। তাই যে কোনও ভাল বাবুলোককেও দূরে সরিয়ে রাখে ওরা।

কোনও রকমেই যখন মাথা গরম অওরতগুলো ঠাণ্ডা হল না, তখন লিডররা একটা সভা ডাকল মিলের লাইন ময়দানে।…কিন্তু সেখানে মাগিগুলো আরও গোলমাল করতে লাগল।

লাল্লু ওর দু-চার জন দোস্তের সঙ্গে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গালাগালি আর হাসাহাসি করতে লাগল। অর্থাৎ তাদের কাছে অত্যন্ত অর্থহীন আর ফালতু লাগছিল এ সভাটা। লাল্লুর সময়বয়সি দোস্ত কাটা মোটামত রামু নিজের শুকনো কপালটা ঘাম ঝাড়ার মতো হাত দিয়ে ঝাড়তে লাগল, খক খক করে কাশতে লাগল, গাল দুটো ফুলিয়ে চোখ দুটো বড় করে হাঁফাতে হাঁফাতে পেটটা আলগা করে কাপড়টা টেনে টেনে বুকে তুলতে লাগল আর কুঁজো হয়ে হায় রাম হায় করে উঠল।

অর্থাৎ মিসিপালটির চারমান আঞ্জুমানের লিডরটাকে অনুকরণ করে ভ্যাংচাচ্ছে সে। ব্যাপার দেখে দোস্তরা হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। রামুর খুব রাগ লোকটার উপর। লোকটা যেহেতু জানত কোন ছোকরাটা তাকে ভ্যাংচায় সে হেতু একদিন তাকে অনেক লোকের সামনে একটু ঝুটা বদনাম দিয়ে বড় রাস্তায় নাকে খত দিইয়েছিল।

এদিকে সভাতে গোলমাল বাড়তেই লাগল। ভুজাওয়ালির নাতনি খাড়া হয়ে উঠে বলল, তবে কি হুকুমত কালা? তারা কি ছাঁটাইয়ের কথা জানে না। কার কাছে তোমরা আর্জি পেশ করবে?…

সভা ভেঙে গেল। সকলেই চেঁচামেচি করতে লাগল। আমরা শুনতে চাই না। জোর করে কাজ চালাব আমরা।

সরকারি ঝাণ্ডা উঁচু করে ওরা চেঁচাতে লাগল তোমরা শান্ত হও।

কেউ শান্ত হল না।

সে হোটেলের দিকে এগিয়ে চলল।

লীলা দরজার কাছ থেকে ছুটে এসে লাল্লুর হাত ধরল। কিন্তু লাল্লুর গুম খাওয়া ক্রুদ্ধ আর শুকনো মুখটা দেখে চট করে কিছু বলতে পারল না।

লাল্লু চেঁচিয়ে বলল: একটা চা দাও গো মাসি। হোটেলওয়ালিকে সে মাসি বলে। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো সিনেমায় চা বিক্রি করতে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করল না সে। লীলার সঙ্গে একটা কথাও বলল না।

লীলা নিজেই ছুটে গিয়ে হোটেলওয়ালির কাছ থেকে চা নিয়ে এসে দাদাকে দিল। অনেকদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে লাল্লু এরকম গুম খেয়ে এসে বসেছে তাই লীলা ব্যাপারটাকে তেমন কিছু মনে করল না। পাশে বসে তার সারাদিনের কথা বকে যেতে লাগল সে। শেষে লাল্লুর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল: একটা কিতাব কিনে দেবে আমাকে আমি পড়তে শিখব।

আর একটু হলেই ঠাস করে একটা চড় মেরে বসত লাল্লু লীলাকে। কিন্তু খুব জোর চেপে গেল নিজেকে। একবার শুধু চেয়ে দেখল লীলাকে।

লীলার মনে পড়ল তার বাবার কথা। কোনও গোলমাল বিপদের সময় তার বাবা ঠিক এমনি চিন্তিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে বসে থাকত। মনে হল দাদা যেন ঠিক বাবা হয়ে গেছে।

–নোকরিটা চলে গেলে কী করবি? হঠাৎ লাল্লু লীলাকে জিজ্ঞেস করে।

 শিশু হলেও এর মধ্যেই লীলা অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। দাদার কথায় ঘাবড়ে গেল সে। নোকরি কেন যাবে?

শালারা ছাঁটাই করবে। বলেই স্তব্ধ পাথর হয়ে গেল আবার লাল্লু।

লীলা আতঙ্কে চোখ দুটো বড় বড় করে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ, পরে দাদার শুকনো গালে হাত দিয়ে বলল সে; তবে কী হবে? মাসি আমাদের তাড়িয়ে দেবে?

কিশোর লাল্লু মনে মনে যেন সত্যি লীলার বাপ হয়ে উঠল। চোখে জল আসতে চাইল তার বোনটার কথা শুনে। শুধু ঘাড় নেড়ে জানাল হাঁ।

তারপরে লীলা যেন দাদার মনের কথা বুঝতে পেরেছে এমনিভাবে বলল, তা হলে…আমাদের ভিখ মেগে খেতে হবে না?..পরমুহূর্তেই এটাকেই স্থির সিদ্ধান্ত করে নিয়ে লাল্লুর হাঁটুতে হাত রেখে বলল সে, কিন্তু রঘুনাথের দোকানে কোনওদিন ভিখ আনতে যাবে না। রোজ দেখি, ভিখ মাগতে গেলে ও বড় মারে।…।

না–! চেঁচিয়ে উঠল লাল্লু বোনের মুখের উপর। বিষ খাওয়ার মত বিকৃত দেখাল তার মুখটা আর চোখের কোণে দু ফোঁটা জল। মুঠি পাকিয়ে ফিস ফিস করে আপন মনে বলল সে; আমরা লড়াই। করব, হাঁ লড়াই!…।

তারপর শুকনো ঠোঁটের কোণে একটা বিড়ি চেপে ধরে জ্বালিয়ে খক খক করে কাশতে লাগল সে।

লড়াই কথাটা শুনে ঘাবড়ে গেল লীলা। লড়াই আবার কীসের আর কার সঙ্গে? ক্রমাগত দাদার ভাবভঙ্গি দেখে ওর ছোট্ট বুকটা দুশ্চিন্তায় ভারী হয়ে উঠল।

বাইরে একটা মোটা গম্ভীর গলা ভেসে বেড়াচ্ছে। লাল্লু বুঝল ওটা একটা হাওয়াগাড়ির ভিতর থেকে যন্ত্র দিয়ে একটা লোক বলছে। প্রত্যেকবার ছাঁটাই গোলমাল হলে ওরা সবাইকে শান্ত হতে বলে, ঘরে ফিরে যেতে বলে। বলে, তোমাদের কিছু করতে হবে না, আমরা সব দেখছি। লাল্লু হোটেলের আলো আঁধারির কোণে বসে বিড়বিড় করে গালাগাল দিতে থাকে। যত সেই মোটা গলায় বলতে থাকে শান্ত হও, শান্ত হও, তত তার বুকের মধ্যে যেন একটা ক্ষিপ্ত অজগর পাকিয়ে পাকিয়ে গর্জাতে থাকে। যতবার সে আশা করে এবার বন্ধ হবে, ততবার সেই যন্ত্র যেন তাকে দাবিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত হতে বলছে।

একবার লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। কিন্তু আবার বসে পড়ল।

 কিন্তু যন্ত্র একই ভাবে উপদেশ দিয়ে চলেছে, মাথা গরম কোরো না, কারখানায় গোলমাল করলে দেশের ক্ষতি হবে।…শান্ত হও!….

এবার স্থির হয়ে উঠে এসে লাল্লু হোটেলের বাইরে দাঁড়াল। খানিকটা দূরেই সেই মোটরটাকে দেখে গালাগাল দিতে লাগল সে।…লীলা তার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়িটাকে দেখতে লাগল।  

কিন্তু যন্ত্রের গলা থামল না…শান্ত হও।

আবার একবার চুপচাপ হোটেলে ঢুকে যাবে ভেবে হঠাৎ সে রাস্তার পাশ থেকে ভাঙা থান ইট তুলে গাড়িটার মাথার যন্ত্রটায় ঝটপট মারতে শুরু করল।

ভাইয়া ভাইয়া হো একী করছ?

কিন্তু বুকের মধ্যে একটা অবোধ রাগে আর দুঃখে তখন খ্যাপা পাগল হয়ে উঠেছে লাল্লু। সে অস্থিরভাবে হাতের কাছে যা পেল তাই ছুঁড়ে মারতেই লাগল, আর মুখে শব্দ হতে লাগল চুপ কর, বলছি। বক্তৃতা অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সে দেখতে শুনতে চাইল না কিছু। দেখল না কারা আসছে তার দিকে। তারপর মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে হোটেলের নর্দমার ধারে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে।

লীলা চেঁচিয়ে উঠে দাদাকে জড়িয়ে ধরল। লাল্লুর শরীরটা তখন থর থর কাঁপছে। মুঠি পাকানো হাতটাকে মাটিতে ঘসে ঘসে তখনও রক্তাক্ত শুকনো ঠোঁটদুটোর ফাঁকে ফিস ফিস করে বলছে সে, চুপ কর, চুপ কর। আর শুনতে পেল তার বোনটা ঠিক তেমনি মিনতি করে বলছে; কত বলেছি, কারুর সঙ্গে তুমি ঝগড়া কোরো না দুষ্টোমি কোরো না।

তারপর সমবেত উত্তেজিত লোক আর পাগড়িবাঁধা পুলিশগুলোর দিকে তাকিয়ে ঠিক তার মায়ের মতো পাকা গিন্নির মতো বলল, এখন আমি কী করি।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *