জীবিকা
ঘটনাটা বাস্তব। তবু গল্প করেই বলা যাক।
.
দৃশ্যটি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য নয়। মেয়েটি অন্ধকার মাঠের উপর দিয়ে চলেছে, এবং বুকের উপর আঁচল ঢাকা আড়ালে, ডান হাতে যেটি মুঠি পাকিয়ে ধরে আছে, সেটি একটি জীবন্ত সাপের মাথা। মাথা নয়, গলার কাছে ধরে আছে। অন্ধকারেও, সাপের কালো চকচকে রং দেখে বোঝা যায়, ভয়ংকর কালী গোখরো। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। স্ফীত নাসারন্ধ্রের নীচেই, তার চেরা জিব চিকুর হানার মতো লকলক করে।
মেয়েটির হাতে একটা প্যাঁচ দিয়ে, বাকি অংশটা ডানার নীচে দিয়ে, পিঠে বেয়ে কোমর জড়িয়ে আছে। যেমন করে আলগা কষি চেপে ধরে রাখা হয়, মেয়েটি সেই ভাবেই নাভির কাছে বাঁ হাত দিয়ে সাপের ল্যাজের অংশ ধরে আছে। মাঝে মাঝে গায়ের কাপড় খুলে পড়ায়, বাঁ হাত দিয়ে মেয়েটি কোমরসুদ্ধ গা ঢেকে নিচ্ছে। যেন সে সাপটাকে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যাতে কেউ দেখতে না পায়। এমনকী, সাপটা থেকে থেকে ফোঁস ফোঁস করে উঠলে, সে হাতের ঝাপটা দিচ্ছে আর ধমকের সুরে শব্দ করছে, আহ, চুপ।
মেয়েটির গায়ে জামা নেই। একটা সস্তা দামের ডুরে শাড়ি ছাড়া গোটা গায়েই কিছু নেই। বয়স সম্ভবত বাইশ-চব্বিশের বেশি নয়। আপাতদৃষ্টিতে, দুদিন আগে বাঁধা রুক্ষু খোঁপায় ময়লা কাপড়ে শুকনো মুখে যতটা দুর্ভাগ্য ফুটে উঠেছে, ওর শক্ত উদ্ধত শরীর যেন ঠিক সেই দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতে পারেনি। তেলে জলে চিকন চাকন না হলেও, ওর ধুলা রুক্ষু শরীরে একটা দীপ্তি আছে। সধবার চিহ্ন আছে ওর সিথেয়। বাসি সিঁদুরের দাগ তেমন উজ্জ্বল নয়। কপালের ফোঁটা প্রায় মুছেই গিয়েছে। আভাস লক্ষিত হয় মাত্র। হাতে লোহা আর একগাছা কাচের চুড়ি। অলংকারের মধ্যে, আর আছে একমাত্র কাঁচ বসানো একটি পিতলের নাকছাবি। চোখা নয়, বোঁচা হলেও নাকছাবিটা যেন ওর নাকে হিরার চেয়ে দামি হয়ে উঠেছে। কারণ ওর বোঁচা বোঁচা নাকখানিকে ওতেই যেন শাণিত করেছে। ডাগর ভাসা ভাসা চোখ, কালো মেয়ে। বাংলা দেশের গাঁয়ে ঘরে দুর্দশাগ্রস্ত আর দশটা মেয়েকে যেমন পথে ঘাটে দেখা যায়।
চৈত্র মাস। মাঠের হাওয়ায় একটা শন শন শব্দ বাজে। বর্ধমানের এই দুর গ্রাম সীমার মাঠে, চৈত্রের হাওয়ায় বেশ গা জুড়োনো আমেজ। এমনকী, একটু বা শীত শীতও লাগে। ধান কাটার পরে, এখন অনেক মাঠই এরকম শূন্য। বৃষ্টির তৃষ্ণায়, দিনে দিনে মাঠ শত মুখ খুলছে। চারদিকে ফাটাফুটি বাড়ছে। আকাশ পরিষ্কার। তারাগুলোকে দেখে মনে হয়, নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকার, তাই, দিনের বেলা হলে দেখা যেত মাটি ধুলা ভারী, মেয়েটির পায়ে পায়ে উড়ছে।
মেয়েটি যে মাঠ ভেঙে আসছে, তার পিছনে একটা গ্রাম অন্ধকারের মধ্যে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। সামনে আর একটা গ্রাম ক্ৰমে স্পষ্ট হচ্ছে। সামনের গ্রামে, কোথায় যেন একটা আলো দেখা যায়। একটা কুকুর দূর থেকে অনবরত ডাকছে। কিন্তু অন্য কোনও কুকুর সাড়া দিচ্ছে না।
মেয়েটির দৃষ্টি ইতিউতি, ত্রাসে চমকানো। যেন ও কিছু চুরি করে নিয়ে চলেছে। দূরের এদিকে ওদিকে বারে বারে চায়, যেন কেউ দেখতে না পায়। কালী গোখবোর মাথাটা প্রায় ওর বুকের কাছে, আঁচলের মধ্যে। চেরা জিভ প্রায়ই ওর কোমল উদ্ধত বুকে চেটে দিচ্ছে। তাতে মেয়েটির কোনও বিকার নেই। কিন্তু সাপটা যখনই, মেয়েটির হাতের মুঠির মধ্যে ফুলে ফুলে ঠেলে উঠতে চাইছে বা ফোঁস ফোঁস করে উঠছে, মেয়েটি তখনই জোরে টিপে ঝাঁকুনি দেয়, আর রুখে বলে, দেখবি, দেব দু ঘা।
সাপটা, ভীষণ কালী গোখরোটা এ সব কথা বোঝে কিনা কে জানে, তবে ধমক বা ঝাঁকুনি খেলেই শান্ত হয়ে যায়।
এবার মাঠের শেষ, সামনে একটা খালের মতো। জল নেই, শুকনো খাল বলা যায়। অনেকটা শুকনো নয়ানজুলির মতো। এপারে ওপারে কোমর সমান বাবলার জঙ্গল। মেয়েটি এখানে একবার থমকে দাঁড়ায়। ওপারের গ্রামটার দিকে তাকায়।
দূর থেকে যে আলোটা দেখা যাচ্ছিল, সেটা এখন আরও স্পষ্ট দেখা যায়। এই মাঠের দিকে মুখ করা একটা ঘরের নিচু দাওয়ায় আলোটা রয়েছে। আলোর কাছে, অস্পষ্ট হলেও একজন মানুষ দেখা যায়। একটু বোঝা যায় না। কথা বললেও এতদূর থেকে শোনবার উপায় নেই। বাড়িটার সামনে পুকুর, পুকুরের পরে পোড়ো জমি। গুটিকয় গাছ। তারপরে একটা ছোট মাঠ এই খাল ধারে এসে ঠেকেছে।
মেয়েটির ডাইনে পুকুর এবং আলো। ও বাঁয়ে তাকাল। সামনে গ্রামের প্রান্তে বাঁশঝাড় এবং একটা মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। মেয়েটির চোখে চকিত চিন্তা দেখা গেল। তার পরেই যেন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবলাবন দিয়ে কাঁটা বাঁচিয়ে নেমে গেল। শুকনো খাল পার হয়ে, মাথা নিচু করে, হনহনিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। বাঁশঝাড়ের কাছে, মন্দিরের আড়ালে ও একটু দাঁড়াল। বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা কুপির শিখা দেখতে পেল।
কুপিটা জ্বলছে, মাটির দেয়ালের গায়ে একটা জানালায়। এমনকী সেখান থেকে রান্নার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দও পাওয়া যায়। ওটা কোনও বাড়ির রান্নাঘর। অন্য কোথাও, কাছেই কে যেন খুঞ্জনি বাজিয়ে অনেকটা ঘুম ঘোরে ঢুলে ঢুলে, অস্পষ্ট স্বরে গান করছে। গানের কথা বোঝা যায় না।
মেয়েটি ঠোঁটে ঠোঁট টিপল। বুকের কাছে ধরা কালী গোখরাকে দুবার ঝাঁকুনি দিল। চোখ ঘুরিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর মন্দিরের আড়াল থেকে বেরিয়ে, বাঁশঝাড়ের বাঁ দিক ঘুরে একটা ছোট পুকুরের ধারে এল। পুকুরটাকে ঘিরে গুটিকয় বাড়ি। বোঝা যায়, পুকুরটি কয়েকটি বাড়িরই খিড়কির দিকে পড়েছে। সব বাড়িগুলোতেই, কান পাতলে মেয়ে পুরুষ শিশুর গলা শোনা যায়। মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সব বাড়ির খিড়কি দরজাই বন্ধ। বর্ধমানে খিড়কিকে নাচ দুয়ার বলে।
মেয়েটি তাড়াতাড়ি হেঁটে, পাঁচিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জঙ্গল সর্বত্রই। বাবলা বা আসশ্যাওড়া। লুকোবার অসুবিধা নেই। মেয়েটি পাঁচিলের ধার দিয়ে যেতে যেতে, তৃতীয় বাড়িটির সামনে দাঁড়াল। যেখানে দাঁড়াল সেখানে পাঁচিল নিচু, ভিতরের উঠোন দেখা যায়। উঠোনেরই এক পাশে মরাইয়ের পাশেই উঁচু দাওয়ায় একজন মধ্যবয়েসি পুরুষ বসে আছেন। সামনে হ্যারিকেন জ্বলছে। একটি ছোট ছেলে বই সামনে নিয়ে পড়ছে।
মেয়েটি কালী গোখবোর মাথাটি মুখের কাছে তুলে নিয়ে এল। চুপিচুপি বলল, এখানে দিয়ে যাচ্ছি, কেমন?
সাপটা চেরা জিভ দিয়ে মেয়েটির মুখে বুলিয়ে দিল। মেয়েটি বলল, নককি সোনা আমার।
বলে কোমরের পাঁচ খুলে, ল্যাজ ধরে সাপটাকে ঝুলিয়ে দিল। তারপর দড়ির মতো ধরে পাঁচিল টপকে ফেলে দিল। দিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়াল।
ছেলেটি পড়ছে। মাঝবয়সি লোকটি ঝিমোচ্ছে। রান্নাঘরে বউ ঝিদের গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়েটি পিছন ফিরে যে পথে যেভাবে এসেছিল, সেই পথে সেইভাবেই ফিরে গেল।
ঘণ্টাখানেক পরের ঘটনা। শশীকান্ত বাঁড়ুজ্জে আঁতকে ওঠেন। সবেমাত্র খেয়েদেয়ে একটু দাওয়ায় বসেছেন। ছেলেটি পড়াশুনো করে খেয়ে শুতে গিয়েছে। ওঁর সামনে হ্যারিকেনের আলোয় তিনি দেখতে পেলেন, তাঁর হাত তিনেক দূর দিয়ে, কালান্তক যমের মতো একটি সুদীর্ঘ কালো সাপ ঘরের দিকে যাচ্ছে। তিনি লাফ দিয়ে উঠোনে পড়েই চিৎকার দিলেন, ওরে খেলে রে। খেলে রে। এ যে মস্ত কালী গোখরো।
সঙ্গে সঙ্গে একটা হইচই। ঘরের ভিতর থেকে ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে এল। বাড়ির লোক সব উঠোনে জড়ো হয়ে চিৎকার আরম্ভ করল। আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও ছুটে এল। সকলের হাতেই লাঠিসোঁটা বর্শা শাবল। যে যা পেয়েছে নিয়ে এসেছে।
সাপটা গোলমাল ও ছুটোছুটি দেখে, ফোঁস করে গর্জন করে ফণা তুলল। পঞ্চা বাউরি লাঠি তুলতেই, শশী বাঁড়ুজ্জে তার হাত চেপে ধরলেন। আরও সবাই বারণ করল, যেন হঠাৎ আঘাত করা না হয়। কারণ ঠিকমতো আঘাত না লাগলে, এ নাগ কার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলা যায় না।
বাড়ির মেয়েরা তো প্রায় কান্নাকাটিই শুরু করল। কী হবে এখন, কে জানে। সাপটা খানিকক্ষণ ফণা ধরে স্থির হয়ে রইল। লক্ষ তার হ্যারিকেনের দিকে। মারা হবে কি হবে না, এই তর্কে সবাই যখন ব্যস্ত, সহসা সাপটা ফণা গুটিয়ে, কিলবিল করে একেবারে চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল।
সবাই আবার চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ঘরে যাবার সাহস কারুর হল না। তখন দুঃসাহসী পঞ্চা বাউরি লাফ দিয়ে দাওয়ায় উঠে ঘরের শিকল তুলে দিল। ঘরে কেউ ছিল না, অতএব কিছুটা নিশ্চিন্ত। কারণ ঘর থেকে সাপের বেরুবার আর কোনও রাস্তা নেই। দাওয়ার দিকে একটিমাত্র জানালা সেটাও বন্ধই ছিল। এখন ভাবনা হল, এ সাপের গতি কী করা যায়।
প্রথমে এটা বাস্তুসাপ কি না, এ সিদ্ধান্তে আসা গেল না। এবং ঘরে ঢুকে যাওয়ায় কেউই আর সাপ মারার সাহস পেল না। তখন পাশের গাঁয়ে হিদে মালকে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। এ তল্লাটে হিদে মালই একমাত্র সাপুড়ে আছে। যে কোনও ভয়ংকর সাপ নাকি সে ধরতে পারে। কিন্তু এতবড় একটা কালী গোখরো চোখের সামনে দেখে, উত্তরের মাঠ ডিঙিয়ে, এই রাতের বেলায় কেউ হিদে মালকে ডাকতে যেতে চাইল না। সামান্য একটা ছায়া নড়ে উঠলেও, সবাই চমকে চমকে উঠছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
বাড়িতে আরও দুটি ঘর রয়েছে। সেই সব ঘরেও কেউ সাহস করে ঢুকতে চায় না। যতগুলো বাতি ছিল, সব জ্বালিয়ে শশীকান্ত বাঁড়ুজ্যের গোটা পরিবার প্রায় উঠোনে বসেই রাত কাটাবার মনস্থ করল।
ছোট ছেলেমেয়েদের ঘোষালদের পাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। একা একটি সাপেই গোটা বাড়িটাকে যেন শ্মশানের থেকে ভয়ংকর করে তুলল।
পরের দিন ভোরবেলা, কাক ডাকতে না ডাকতে পঞ্চা বাউরি, কার্তিক রাখালকে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে চলে গেল হিদে মালকে ডাকতে। চৈত্রমাসের সকাল, দেখতে দেখতে রোদ উঠে যায়। রোদ ওঠার পর হিদে মাল এল। মাল বলতে অনেক সময় এ অঞ্চলে সাপুড়েই বোঝায়। তবে সাপে কাটলে এরা ওঝা ধন্বন্তরীর কাজও করে। হিদে, অর্থাৎ হৃদয় মালর এ অঞ্চলে বেশ সুনাম আছে। হিদে মাল এসে উঠোনে দাঁড়াল। বৃত্তান্ত সব শুনল। কালো কুচকুচে হিদে মালর বয়স বছর তিরিশের কাছাকাছি। এক মাথা রুক্ষু চুল। মোটা ঠোঁটগুলো ফাটা ফাটা। খালি গা। পরনে একটা ময়লা ছোট কাপড়। গোটা গায়ে খড়ি উঠেছে। যেন পেটে দানা নেই, রাতে ঘুম নেই। হাতে একটি দু হাত পরিমাণ সরু গাছের ডাল। ডালটির সামনের দিকে মুখ বিভক্ত। অনেকটা গুলতি কাঠের মতো।
সব শুনে, সবাইকে দূরে সরিয়ে দিল। বাঁড়ুজ্যে মশাইকে ডেকে বলল, একটা ধোয়া পাত্রে পোটাক কাঁচা দুধ দিতে বলেন।
সকাল বেলা কাঁচা দুধের অভাব নেই। দুধ এল। হিদে মাল দুধ সামনে নিয়ে কী সব বিড়বড় করল। তারপরে দুধের ঘটি আলগা করে ধরে, ঢক ঢক করে সব দুধটুকু খেয়ে নিল। নিয়ে দাওয়ায় উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলল, দ্যাখ মা, তোর কাজ তুই করবি, আমার কাজ আমি। ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করা, এখানে তোমার থাকা চলবে না। পেটে আমার মায়ের দুধ।
বলেই সে ঝনাৎ করে শিকল খুলে ফেলল। উঠোনে আতঙ্কগ্রস্তদের ভিড়। শিকল খুলে ফেলতেই কেউ কেউ পিছিয়ে গেল। আর তখনই সবাই শুনতে পেল, ঘরের মধ্যে হিল হিল শব্দ হচ্ছে।
হিদে মাল আগে গাছের ডালটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, নিচু হয়ে বসল। বসে, হামা দিয়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল, ফোঁস ফোঁস করলে হবে কী, তোমার জায়গা অন্যত্তর মা।
বলে সে চিৎকার করে জানালে। ওই গো বাবু। এ যে পেকাণ্ড একটা কালী গোখরো, এ যে গোটা গাঁ সুদ্ধ খেয়ে ফেলতে পারে।
উঠোনের সব থর থর করে কাঁপছে। হিদে মালের গলা আবার শোনা গেল, তাড়াতাড়ি একটা নয়া হাঁড়ি সরা আনতে বলেন বাবু, আর একখানা নয়া গামছা।
তৎক্ষণাৎ হুকুম হয়ে গেল। কয়েকজন ছুটল হাঁড়ি সরা গামছা সংগ্রহে।
এ বিবরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। সবাই সভয়ে দেখল, প্রায় ঘণ্টাদেড়েকের চেষ্টায় হিদে মাল কালী গোখরোকে প্রথমে ঘরের বাইরে ধাওয়া করে নিয়ে এল। নিয়ে আসতেই সবাই যখন সেই গোখরো দেখে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল, হিদে মাল তখনই তার ল্যেজ চেপে একেবারে উঁচু করে ধরল। কিন্তু সাপের ফোঁসানি যায় না, সে কোমর বেঁকিয়ে উঠতে চায়। হিদে মালর সর্বাঙ্গে দরদর ঘাম তার চোখ দুটিও সাপের মতো দপদপ করে জ্বলছে। বলেন দ্যাখেন বাবু কত বড় সাপ। এর নিশ্বাসে বিষ।
শশী বাঁড়ুজ্যে হাঁকলেন, আর দেখবার দরকার নেই, তুমি তাড়াতাড়ি ওটা হাঁড়িতে পুরে ফ্যালো।
হিদে সেই কালো নাগের সঙ্গে অনেক কথা বলে, ছড়া কেটে হাঁড়িতে পুরে সরা ঢাকা সুদ্ধ নতুন গামছা দিয়ে গোটা হাঁড়ি বেড়ে মুখ বেঁধে দিল।
তারপরে এল হিদে মালর জলখাবার। বাঁড়ুজ্যে মশাই দুপুরে খেয়ে যেতে বললেন। হিদে জানাল, খেয়ে আর যাব না বাবু মা মা ঠাকুরুনেরা যা ভাল মন্দ রান্না করবেন, সব পাতায় বেঁধে বাড়ি নিয়ে যাব। ঘরে আরও দুটো পেরাণী আছে তো।
অর্থাৎ ভাল মন্দ রান্নার পরিমাণ একটু বাড়িয়েই দিতে হবে। ঘরে আরও দুটি প্রাণীর উল্লেখ সেইজন্যেই। তা ছাড়াও, হিদে মাল বলতে ভুলল না, ঠাকুরমশাই, এ যা সাপ গো দেবতা, একটু ছুঁলে আর চোখ তাকাতে হত না আমার। দশটা টাকা দেবেন, আর একখানা ধুতি।
বাড়ুজ্যে মশাইয়ের কাছে সেটা একটু বেশি মনে হওয়াতে, তিনি নগদ পাঁচ টাকা আর ধুতিতে রাজি হয়ে গেলে। তবে ধুতিটা দিতে দু-একদিন দেরি হবে। এ ছাড়া নয়া গামছাটা তো মাল ভায়া পাবেই।
.
এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্তই। সাপের হাঁড়ি নিয়ে, উত্তরের মাঠ পেরিয়ে প্রায় পড়ন্ত বেলায় হিদে মাল ঘরে এসে পৌঁছল। গ্রামের প্রান্তে, ডোমপাড়ার কাছেই তার ঘর। সেখানে তার বউ স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করছিল। কোলে বছর তিনেকের বাচ্চা। স্বামীকে দেখেই বলল, এসেছ? ছেলেটা খিদেয় একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।
হিদে বউকে বলল, তোর হাল তো তার চে ভাল নয় দেখছি। নে, হাঁড়িটা ধর!
বলে সে সাপের হাঁড়িটা নিজেই নিয়ে ঘরে ঢোকে।
বউ সাপের হাঁড়ি রেখে, নতুন গামছাটা একবার দ্যাখে। ছেলেকে ঝাঁকিয়ে জাগায়, বলে, ওঠ সোনা দ্যাখ বাবা ভাত নিয়ে এসেছে।
বাপ আর ভাত শুনেই ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে তাকায়। তাকে বসিয়ে দিয়ে, বউ খাবারের হাঁড়ি খোলে। তা মন্দ না। প্রায় হাঁড়ি ভরতি ভাত আছে। মাটির ভাঁড়ে ডাল, অম্বল, নিরিমিষ কুমড়োর তরকারি। দু টুকরো চারা মাছের ঝাল। হাঁড়িটাকে জড়িয়ে যে কলাপাতা ছিল, তাই সাব্যস্ত করে পেতে, বউ ভাত বেড়ে দিল স্বামীকে আর ছেলেকে। ইতিমধ্যে হিদে বউয়ের তুলে রাখা জলে হাত মুখ ধুয়ে আসে।
হিদে মালের ঘরও সেইরকম। চালের খড় ঝুর ঝুর করছে। আকাশ দেখা যায়। দেয়ালের ফাটল, মাটি পড়েনি কতদিন। বাতাস দিলে ধুলা আসে ঘরে।
তা আসুক। হিদে মাল খায়। বউ গিয়ে নতুন গামছা বাঁধা হাঁড়িটা খোলে। সরা তুলতেই সাপ ফণা তুলে দাঁড়ায়। বউ ফণার নীচেয় ধরে। সাপটাকে গালের কাছে নিয়ে আসে। এখনও তার গায়ে সেই ডুরে শাড়িটাই আছে। সাপটা যেন তার জিভ দিয়ে চেটে চেটে দেখে নেয়, এ সেই কাল রাত্রের মানুষটিই কি না। যে তাকে বাঁড়ুজ্যেদের বাড়িতে পাঁচিলের পাশে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল।
বউ সাপটাকে বুকের কাছে নিয়ে এসে স্নেহ নিবিড় চোখে দ্যাখে। স্বামীর সামনে তার বুক খোলা। সাপ সেই বুকেও জিভ দিয়ে লেহন করে। নককি সোনা, আজ তোমাকে দুটো ইঁদুর ধরে দেব আমি, তুমি মেরে খেয়ো।
হিদে মাল ভাত চিবুতে চিবুতে এই দৃশ্য দেখে। বলে, বামুনকে ঠকিয়ে এলাম। তা কী করব। এক ফোঁটা জমি নাই। কাজ কাম পাই না। মা মনসায় পেট বাঁচায়।
তারপরে যেন হঠাৎ মনে পড়ে। কষি থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বউকে বলে, নে রাখ ঠাকুর দিয়েছেন।
বউ সাপটিকে সরা ঢাকা দিয়ে রেখে, স্বামীর কাছে এসে নোটটি নিয়ে আঁচলে বাঁধে। বলে, তা হতে পারে পাপ। রাত করে যখন ছুটে যাই, পাপের কথা মনে থাকে না। ছেলেটাকে বাঁচাতে তখন তো।
হিদে মাল বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, নে, এখন আর চোখের জল ফেলিস না। দুটো খেয়ে নে।…
Leave a Reply