• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৪৩. আজকাল বড্ড ভ্রম হয়ে যাচ্ছে

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০৪৩. আজকাল বড্ড ভ্রম হয়ে যাচ্ছে

আজকাল বড্ড ভ্রম হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। এই যে সে বাজারে যাচ্ছে এ-কথাটাই তার দু-চার পা গিয়ে খেয়াল থাকছে না। হঠাৎ অবাক হয়ে ভাবছে, আমি এ যাচ্ছি কোথায়? কী করতে যাচ্ছি? মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে নিতাই-গৌর স্মরণ করে তবে মনে পড়ে। রাস্তাঘাটে চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে নিমাই পট করে লোকটাকে যেন চিনতে পারে না। হাঁ করে চেয়ে থাকে। তারপর ঠাহর করে স্মরণ করতে হয়। খেতে বসে খাবারের স্বাদ পায় না তেমন। ডাল মনে করে ঝোল দিয়ে খেয়ে যায়। বীণাপাণির লুকানো বিলেতি টাকার পুঁটুলিটি পাওয়ার আগে সে ছিল একরকম। আর ওই ঘটনাটির পর এখন নিমাই আর একরকম। মন কেবলই বলছে, বড্ড পাপ হয়ে গেল, বড্ড অন্যায় হয়ে গেল। এ কি আমাদের সইবো?

নিমাইয়ের মনের ভিতরটা কেউ দেখতে পায় না, নিমাই একা পায়। সেখানে সে এক জড়সড় মানুষ। মনের মধ্যে সর্বদা ভয়ের জুজুবুড়ি। ভগবানের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে ফল হয় কি? ভগবান তো সব দেখতে পান। বীণা কি সে কথা বিশ্বাস করে না? বীণার কি পাপের ভয় নেই? ও-টাকার জন্য অন্নদাতা কাকার কত ক্ষতি হল। গোটা তিনেক লাশ পড়ে গেল। ওই টাকার জন্য বীণা এখন বনগাঁ ছেড়ে পালাতে চাইছে। তবু টাকা সে ফেরত দেবে না।

ঝগড়া করে কোনও ফল হয় না। অনেক কথা ভেবে রাখে নিমাই, কিন্তু বীণা যখন মুখ ছোটায় তখন বেনো জলের সব কথা ভেসে যায় নিমাইয়ের। সে কি পারে বীণার সঙ্গে? ছেড়ে যাবে বলেও ভাবে নিমাই। কিন্তু যাবে-যাবে করেও কেন যেন যাওয়া হল না। আজও।

বড় আনমনা হয়ে সে একটা মাঠ পেরোলো। তারপর বটতলার এলাকায় এসে উঠল। হ্যাঁ, বাজারের কথাই বলেছিলেন বটে। শাশুড়ি ঠাকরুন। কিন্তু কী কী কিনতে হবে তা যে বেবাক ভুলে বসে আছে সে!

তবে বাজার-হাট খুব ভাল জায়গা। পাঁচজনের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, শিক্ষালাভ হয়। নানা দুঃখের কথা একটুক্ষণ ভুলে থাকা যায়। বটতলা তেমন বড় জায়গা নয়। দোকানপাট আছে। সব্জী বাজার তেমন নেই। এখানে সেখানে আলু বেগুন কচু-টাচু নিয়ে দু-চারজন বসে আছে। বেলা হয়েছে বেশ, এত বেলায় কি আর ব্যাপারীরা থাকে?

দরদস্তুর করে নিমাই পাঁচশ গ্রাম আলু আর সরু সরু বেগুন কিনল। কয়েকটা। একটু কাঁচা লঙ্কাও। পটলের দামটা বেশী ঠেকল বলে নিতে সাহস পেল না। কয়েকটা উচ্ছে কিনে ফেলল। মাছের বাজার বলে কিছু নেই। একজনকে পেয়ে গেল, জিয়ল মাছের একটা কানা উঁচু গামলা নিয়ে বসে আছে। দুখানা মাগুর মাছ কিনতে শাশুড়ির দেওয়া পয়সা ফুরুৎ তো হলই, নিজের ট্যাকের পাঁচটা টাকাও বেরিয়ে গেল। তা যাক। শ্বশুরবাড়ি তো এসেছে একেবারে শুধু হাতে।

বটতলার তেমাথায় দাঁড়িয়ে নিমাই ভাবছিল, কিছু ভুল হল কিনা। আরও যেন কিছু বলে দিয়েছিলেন শাশুড়ি। মনে পড়ছে না। জরুরি জিনিসই যেন! কিন্তু আজকাল গবেট মাথাটায় নানারকম ভয় আর দুশ্চিন্তার বুজকুড়ি। কোনও কথাই মাথার মধ্যে ভাল করে বসে না।

বটতলা মানে আসল বটতলাই। পেল্লায় একখানা বটগাছ ঝুরিটুরি নামিয়ে মৌরসীপাট্টা গেড়েছে। তারই তলায় শীতলার থান। থানের গা ঘেষেই নানারকম দোকান-টোকান। বনগাঁর মতো জমজমাট নয়, তেমন ঝা-চকচকেও নয়। তবে এখানে কিছু লোকজন আছে। ওরকমই একটা দোকান থেকে একজন ফুলপ্যান্ট আর সবুজ হাওয়াই শার্ট পরা লোক হঠাৎ বেরিয়ে এসে তার দিকে চেয়ে বলে উঠল, নিমাই নাকি হে!

নিমাই হাঁ হয়ে গেল। কে লোকটা?

লোকটা কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বড় অবাক গলায় বলল, কখন এলে হে?

তবু নিমায়ের মনে পড়ছিল না যেন। তবে ভক করে কাঁচা মদের খানিক গন্ধ নাকে এসে লাগল। নিমাই দুপা পিছিয়ে দাঁড়াল বটে, কিন্তু সেজো সম্বন্ধী রামজীবনকে চিনতেও পারল।

এই একটু আগেই এসেছি।

কেলাটা মদ খেলেও মাতাল হয়নি। হাতের থলিটার দিকে চেয়ে বলল, তা থলি নিয়ে এখানে ঘোরাঘুরি করছ কেন? বাড়ি যাও।

নিমাই বিগলিত একটু হেসে বলল, গিয়েছিলাম। মা একটু বাজার করতে পাঠালেন।

রামজীবন অবাক হয়ে বলে, তোমাকে? মায়ের যে দিন দিন কী হচ্ছে! জামাই এসেছে, তাকে কেউ বাজারে পাঠায়?

জিব কেটে নিমাই বলে, আরে না। শ্বশুরমশাই নিজেই আসছিলেন, আমি তাকে আসতে দিইনি। বুড়ো মানুষ।

ছিঃ ছিঃ। বলে রামজীবন থলিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে মুখটা ফাঁক করে দেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, এই কি জামাইভোগ নাকি? মাগুর মাছ তো রুগীর পথ্যি।

নিমাই শশব্যাস্তে বলে, আজ্ঞে, জামাইয়ের যুগ আর নেই। আমিও কি আর তেমন জামাই?

রামজীবন বিরক্ত হয়ে বলে, নিজেকে সবসময়ে অত ছোট ভাব কেন বলো তো! তুমি কমটা কিসে? যত বৈষ্ণববিনয় দেখাবে তত লোকে পেয়ে বসবে। আর দাপে খাপে চলো, সবাই খাতির করবে।

নিমাই কি এই সার সত্য জানে না? খুব জানে। কিন্তু আরও যেটা জানে, তা হল, সকলের আর্ষ থাকে না। সকলে সবকিছুর অধিকারী নয়। সবাইকে মানায়ও না। তাহলে তো দুনিয়াটা অন্যরকম হত। সে মুখ নামিয়ে বলল, যে আজ্ঞে।

তোমার ওই মেনীমুখো স্বভাবের জন্যই তো বীণাটা বখে গেল। যাত্ৰাদলের নটী হয়ে যা খুশি করে বেড়াচ্ছে আর তুমি ঘর সামলে জেরবার হচ্ছ। বুক চিতিয়ে হাঁকডাক মারো দেখবে ভয়ে পেচ্ছাপ করে দেবে।

অভিজ্ঞতাবলে নিমাই জানে, নেশাখোরদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে নেই। যখন টং-এ চড়ে থাকে তখন তারা আর অন্যের কথা নিতে পারে না। নিজেরাই বকে যায়।

নিমাই তাই বিনীতভাবে বলল, চেষ্টা করব।

রামজীবনের অবশ্য নেশা হয়নি। সে এক পাত্র দুপাত্রে কাত হওয়ার লোকও নয়। তবে সব সময়ে একটু চাপান দিয়ে রাখে। তাতে মনটা বেশ চনমনে থাকে। ফুর্তি-ফুর্তি ফুরফুরে খোসমেজাজী একটা ভাবও পেয়ে বসে তাকে।থলেটা একটু নাচিয়ে নিয়ে বলল, এসো, ওদিকটায় মুর্গি পাওয়া যাবে।

মুৰ্গিা! বলে নিমাই যেন আঁতকে ওঠে।

কেন, খাও না নাকি? বৈষ্ণবপানা একটু ছাড়ো তো!

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, সে কথা হচ্ছে না। গরিবের কি বাছাবাছি করলে চলে? সব খাই। কিন্তু মুর্গির বেজায় দাম পড়ে যাবে যে!

রামজীবন হেঃ হেঃ করে হেসে বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না বাপু! শ্বশুরবাড়ি বলে কথা! পয়সা খরচ নিয়ে তুমি মাথা ঘামাবে কেন? এসো এসো। ডিম তো নিশ্চয় খাও?

খাই। তবে দরকার নেই।

দরকার নেই কেন?

অত হজম হবে না।

খুব হবে। ডালের মুখে একখানা ডিমভাজা কেমন ওতরাবে বলো। হজম নিয়ে মাথা ঘামায় পয়সাওলারা। এই তো তুমিই বললে যে গরিবের বাছাবাছি করলে চলে না। আমিও তাই বলি। হজম হলে হল, না হলে না-ই হল, সেঁটে তো দিই। রামজীবন একরকম হাত ধরেই টেনে নিয়ে গেল তাকে। মুর্গিওলার কাছ থেকে দুখানা মুর্গি কিনে ফেলল। দশটা দিশি ডিম। এক সবজিওলার ঘর থেকে কুশি কুশি গুটি চারেক ফুলকপি, বরবটি, কয়েকটা মুলো। বড্ড বেহিসেবী কেনাকাটা হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল নিমাইয়ের। কিন্তু কিছু বলতে সাহস হচ্ছিল না। তবে হঠাৎ তার মনে হল, শাশুড়ি যেন সর্ষের তেলের কথা বলেছিলেন!

গলা খাঁকারি দিয়ে নিমাই বলল, বোধ হয় একটু সর্ষের তেলও লাগবে।

আহা, আগে বলতে হয়! তা শিশি কোথায়? থলিতে তো দেখছি না।

বোধ হয় ভুলে গেছেন। অনেকদিন বাদে মেয়ে আসায় খুব বেসামাল হয়ে গিয়েছিলেন তো!

কথাটা মানল না। রামজীবন। বলল, আরে না, মায়ের মাথাটাই গেছে। দাঁড়াও, একটা বোতল জোগাড় করি।

বলেই হাওয়া হয়ে গেল রামজীবন। কয়েক মিনিট বাদে যে বোতলটা নিয়ে ফিরে এল। তার তলায় তখনও ধেনোর তলানি টলটল করছে। নিমাই কথাটা তুলতে সাহস পেল না, সকলের কি আর্ষ থাকে?

শ্লেষ্ট বোতলেই মুদী যত্ন করে তেল ভরে দিল। রামজীবন তার পর পেয়াজ রসুন কিনল, আদা। কিনল, গরম-মশলাও বাদ দিল না।

একটু ঘি হলে হত, না?

এই গন্ধমাদন কেনাকাটা দেখে নিমাইয়ের বড় লজ্জা হচ্ছিল। সে একটা এমন কি মানুষ যার জন্য লোকে এত আয়োজন করবে? সে মাথা নেড়ে বলল, ঘি আমার লাগবে না।

দুর পাগল! ঘি না হলে মাংসে স্বাদ হয় নাকি?

মাতালের হাত খুব দরাজ হয়, নিমাই জানে। তবে অভিজ্ঞতা ছিল না। লোকটার মেলা পয়সা চলে যাচ্ছে দেখে তার মায়া হচ্ছে। তারা যেমন লোক, এত খরচপাতি করাটা তাদের মানায় না। সে একটা বানানো কথা বলেই ফেলল, ঘিয়ের গন্ধ আমার ঠিক সহ্য হয় না।

রামজীবন তার পিঠে একটা থাবড়া মেরে বলে, আসল ঘি খাওনি তাই বলছি। এখানে গবা ময়রার দোকানে সরবাটা ঘি হয়। একবার খেলে বুঝবে।

অতএব ঘিও হল। তার পর বাড়িমুখে রওনা দেওয়ার আগে রামজীবন বলল, আর কিছু ভুল হল না তো?

আজ্ঞে না। বেলা হয়েছে, দেরি করাটা ঠিক হবে না।

তুমি একটু কেপ্পন আছো, না?

হিসেব করেই বরাবর চলে আসছি তো। হিসেবী না হলে কম পয়সায় সংসার চালানো শক্ত কাজ। মাথাও খাটাতে হয় বিস্তর; কোনটা আজ না হলেও চলে, কোনটা বাদ দিয়েও হয়।

ওসব হচ্ছে মেয়েলী বুদ্ধি। মেয়েমানুষের বসে বসে কেবল হিসেব করে। আমি বাপু, ওরকম কঞ্জস্যপনা সহ্য করতে পারি না। পুরুষমানুষরা কি আর ওসব পোষায়?

রামজীবনের হাতে দড়িবাধা দুদুটো মুগি মাঝে মাঝে ঝটপট করছে, কোক ছাড়ছে। নিমাই চমকে চমকে উঠেছে। কেষ্টর জীব, একটু পরেই মারা পড়বে। মাছ-মাংস সে খায় বটে, তবে এ ব্যাপারটা সইতে পারে না!

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রামজীবন বলল, তা এখন রোজগারপাতি কী তোমার?

ম্লান মুখে নিমাই বলে, দোকানটা দেব-দেব করছিলাম। দেখি।

রামজীবন মুখটা একটু বিকৃত করে বলে, দোকান দিয়ে কী হবে শুনি? ক পয়সা আসলে? অন্য লাইন ধরে যেন হে।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, লাইন তো কত ভাবছি। কিছু মাথায় আসছে না।

গাঁ-গঞ্জে লাইনও বড় একটা নেই। গুচ্ছের সেলামি দিয়ে দোকান যদি করেও ফেল, দেখবে পড়তায় ফেলতে পারবে না। যাদের ঘরে মেলা টাকা আছে, খাওয়া-পরার চিন্তা নেই, তারা দোকান খুলে বসে মাছি তাড়াতে পারে। আমি তো শুনি, বনগাঁয় দুনম্বরীর খুব রবারবা।

দুনম্বরী! সেটা কি রকম?

এই ধরো বাংলাদেশ থেকে মাল এনে বেচলে, নয়তো এদিক থেকেই ওদিকে মাল চালান দিলে। ওসব কারবারে বসে থাকতে হয় না।

নিমাই বিবৰ্ণ মুখে বলে, তা বটে।

আমি বলি কি, চোখ-কান বুজে আগে কিছু পয়সা পিটে নাও। তারপর ধর্মকর্ম করে পাপ কাটিয়ে নিতে পারবে।

নিমাই পাশ-চোখে একবার রামজীবনকে দেখে নিল। বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। সে শুনেছে রামজীবনের রোজগারটা সোজা পথে হয় না। কী করে না-করে তা বাড়ির লোকও জানে না। তবে যা করে তা নিশ্চয়ই ঢাক বাজিয়ে বলার মতো নয়। সে এসব মানুষের সঙ্গ করতে একটু ভয় পায়।

মাঠটা পার হচ্ছিল দুজনে। হঠাৎ রামজীবন তার দিকে ফিরে বলল, না হে, কাজটা ঠিক হবে না।

নিমাই একটু আনমনা ছিল। চমকে উঠে বলল, কোন কাজটা?

তোমাকে যা করতে বললাম ও কাজ তোমাকে মানাবে না।

নিমাই তটস্থ হয়ে বলে আজ্ঞে।

রামজীবন একু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, দু-চারটে তোমার মতো লোকেরও দুনিয়ায় থাকা দরকার। এই যে আমার বাবাকে দেখ, এই বাবাকে দুনিয়াসুন্ধু লোক আহাম্মক বুরবক বলে জানে। লোকটা বাকা পথে যায়নি, তর্জন-গর্জন করেনি, চুরি-চামারি করেনি। গরিব থেকে গেছে। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে আহাম্মকই। কিন্তু বাবার কাছটিতে বসলে আমার যেন মনে হয়। গঙ্গাস্নান হয়ে যাচ্ছে। কেন হয় বলো তো?

উনি বড় ভাল লোক।

রামজীবন মাথা নেড়ে বলে, ভাল বললে হয় না। ভাল মানে কি আহাম্মক? তা তো নয়। এই সেদিন সকালে বাবার কাছে বসেছিলাম। কথা হচ্ছিল, আমাকে আর বড়দাকে নিয়ে কথা। শুনে মনে হল, দেখতে বোকাসোকা হলে কি হয়, বাবা কিন্তু অনেক তলিয়ে দেখে। অনেক বোঝে।

নিমাই সায় দিয়ে গেল।

রামজীবনের গলাটা একটু উদাস হয়ে গেল। হঠাৎ। বলল, বড়দা কত বড় মানুষ সে তো জানো। আমার বড় হিংসে হয় বড়দাকে। বিদ্যেয় তো ছাড়াতে পারব না, তাই পয়সায় ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আর এই দুনিয়ায় পয়সা করতে গেলে তো সাদা রাস্তায় হয় না।

যা বলেছেন।

কিন্তু কী হল জানো? জাতও গেল, পেটও ভরল না। জোচ্চুরি লাইনেও আজকাল জোর কম্পিটিশন। খারাপ লোকদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে করতে পা থেকে ভদ্রলোকের গন্ধটাই উব গেল। কী হল বলো তো লাভটা?

প্রশ্নটা নিয়ে নিমাইও ভাবতে লাগল। সাদায়-কালোয় ভরা দুনিয়া। কোন রংটা গায়ে মাখবে মানুষ? বিশেষ করে গরিব মানুষেরা? নিমাই মাথা নেড়ে বলে, আমিও তো তাই ভাবি ।

আজ বুঝেছি, বড়দাকে হিংসে করতে যাওয়াটা আমার ঠিক হয়নি। সে আমাদের পাত্তা দেয়নি বটে, ভাইবোনকে মানুষ করারও চেষ্টা করেনি, কিন্তু সে দোষ তো তার একার নয়। আমরাই বা কোন মাথাওলা ছিলাম? বড়দার সময়ও ছিল না, পাস করেই চাকরি পেয়ে গেল। সময়টা দেবে কখন? উপরন্তু একটা দজাল বউ জুটল। সে-ই খেয়ে ফেলল মানুষটাকে। আজকাল তাই ভাবি, বড়দাকে হিংসে করাটাই মস্ত ভুল।

নিমাই চুপ করে রইল। ব্যাপারটা সে তেমন কিছু জানে না। তবে শুনেছি, কৃষ্ণজীবনকে এরা ভাইবোন মিলে একবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

বাড়িটা ফটকে এসে পড়েছে দুজন। রামজীবন হঠাৎ তার দিকে ফিরে বলল, না হে, পাপ পথে যেও না। একদিকে এক-আধজন রাশ টেনে না রাখলে চলে না।

বাড়িতে ঢুকে একটা হই-চই হাক-ডাক বাঁধিয়ে বসল। রামজীবন। জামাকাপড় বদল করে একটা লুঙ্গি পরে নিয়ে কামিনী ঝোঁপের নিচে মুর্গি কাটতে বসে গেল। বীণাপাণি মশলা পিষতে বসে গেল। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শাশুড়ি ঠাকরুনও।

নিমাই তার ভার হয়ে থাকা মনটা নিয়ে বারান্দার এক ধারে মোড়ায় বসে রইল। শ্বশুরমশাই স্নান করতে গিয়েছিলেন কুয়োর ধারে। বারান্দায় উঠে এসে ভেজা কাপড় নিংড়োতে নিংড়োতে বললেন, আজ নাকি পেল্লায় সব বাজার হয়েছে! রেমো কেনাকাটা করল বুঝি?

নিমাই মাথা নেড়ে বলল, যে আজ্ঞে। বারণ শুনলেন না।

ওর হাতটা খুব দরাজ, বুঝলে!

সে আর বলতে!

শ্বশুরমশাই ভেজা কাপড়টা উঠোনের তারে টান-টান করে মেলে দিয়ে গায়ে একখানা জামা চড়িয়ে বারান্দায় এসে বসলেন ফের। বললেন, একটা কথা ছিল নিমাই।

আজ্ঞে, বলুন।

বীণা একটা জিনিস আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে চায়।

জানি।

আমরা দুজনায় বুড়ো হয়েছি, বাক্স-প্যাঁটরাও তেমন নেই। তুমি কি জানো বাবা জিনিসটা কী?

নিমাই অধোবদন হল। তারপর ক্ষীণ গলায় বলল, জানি।

কী জিনিস বলো তো!

নিমাই খুব নিরীহ গলাতেই বলল, সে আপনার মেয়েই আপনাকে বলবেখন।

স্পষ্ট করে বলছে না। তোমার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, কোথায় একটা কিন্তু আছে। খোলসা করে না বললে জিনিসটা রাখি কি করে বলো তো!

নিমাইয়ের হঠাৎ কী যে হল কে জানে! মুখ নিচু ছিল। কোলের ওপর। টপটপ করে চোখের জল খসে পড়তে লাগল।

বিষ্ণুপদ। নিমাইয়ের দিকেই চেয়ে ছিল। হঠাৎ বলল, আমার চোখে ছানি আসছে বাবা। চারদিকটা কেমন অস্পষ্ট আর ধোয়া-ধোয়া দেখি। মাঝে মাঝে ভাবি, ছানিটা বোধ হয়। ভগবানেরই আশীৰ্বাদ। স্পষ্ট করে সব না দেখাই ভাল।

নিমাই উঠল। পায়ে পায়ে উঠোনের সীমানা ডিঙিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা যেন বড্ড উথাল-পাথাল করছে। নিজের খামতি, দুর্বলতা, নিজের অপদাৰ্থতা আজ যেন আরও ঘুলিয়ে উঠল তার নিজের চোখে। মাথাটা কাজ করছে না।

সামনেই একটা নর্দমার মতো। পচা জল জমে আছে। কাঁচা রাস্তা গাছপালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে। ওপরে মন্ত আকাশটা যেন রোদের হাসি হাসছে তার দুর্দশা দেখে। নিমাই তার কাতর জলভরা দুখানা চোখ মেলে হাঁ করে চেয়ে রইল শুধু। বড় কষ্ট হচ্ছে তার। এরা আজ ভাল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছে। তার মুখে কিছু রুচিবে না। আজ। তার খিদে মরে গেছে, বাঁচার ইচ্ছে মবে গেছে, বড্ড গ্রানি হচ্ছে মনে।

অনেকক্ষণ বাদে বীণা যখন এসে তাকে স্নান-খাওয়ার জন্য ডাকল তখন নিমাই একটা নিমগাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোলে তখনও জল।

রাতে তারা যখন ঘরে দুজনায় হল তখন বীণা বলল, তুমি এরকম করছি কেন বলো তো!

নিমাই বোধহীনভাবে বীণার দিকে চেয়ে বলল, আমি আমার বশে নেই।

বীণা চাপা হিংস্র গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা বলেই দিই। তুমি যদি আমার টাকা নিয়ে বেশী মাথা ঘামাও তাহলে কিন্তু ভাল হবে না। তুমি ও-টাকার কথা ভুলে যাও। পাপ হোক কি আর যাই হোক, তোমার তাতে কী? এমন সব কাণ্ড করছি যে লোকে টের পেয়ে যাচ্ছে।

নিমাই ভয় পেল না। কিন্তু মেনেও নিল না। চুপ করে রইল।

বাবাকে কিছু বলোনি তো!

নিমাই মৃদু স্বরে বলল, বলতে হয়নি। উনি নিজেই কিন্তু সন্দেহ করছেন।

বাবা কী বলেছে তোমাকে?

কী জিনিস গচ্ছিত রাখতে চাইছ তা জানতে চাইলেন।

তুমি কি বললে?

বললাম তুমিই ওঁকে বলবে।

বীণার ঝংকারে ভরা গলা হঠাৎ কয়েক পর্দা নেমে গেল। বলল, কী বলব তা আমি ভেবে পাচ্ছি না। বাবা তো আর এক আহাম্মক। তোমার মতোই।

নিমাই বিছানার একটি পাশে বসে রইল বাজাহতের মতো।

বীণাপাণি তার দিকে কূট চোখে চেয়ে থেকে বলল, তুমি এর পর এমন বেফাঁস কিছু হয়তো করে ফেলবে যাতে আমি ধরা পড়ে যাবো।

নিমাই আস্তে করে বীণার দিকে মুখ ফেরাল। তারপর বলল, আমাকে এবার বিদায় দাও বীণা। আমার মনে বড় কষ্ট।

বিদায় নেবে তা তার জন্য আমার অনুমতির কি দরকার? নিলে নেবে।

অনুমতিরও দরকার হয়। তুমি আমার ওপর অত রেগে না থাকলে বুঝতে পারতে।

বীণাপাণি বিষ-গলায় বলল, ঢং কোরো না। একে তো তোমার জন্যই বনগাঁয় আমার বসবাস করা বিপদের ব্যাপার হয়ে উঠল, তার ওপর এসব ন্যাকামি আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি কাছে থাকলেই বিপদ।

নিমাই মাথা নেড়ে বলল, সে কথাই ঠিক। ভেবে দেখলাম, আমি বড় অপদার্থ। আমি থাকলেই তোমার অসুবিধে।

ওই লোকটা সেদিন যদি প্যাকেটটা দেখে না যেত তাহলেও ভয়ের কিছু ছিল না। কী যে কাণ্ডটা করলে তুমি!

নিমাই কান্না সামলে ধরা গলায় বলল, কাল সকালে আমি বিদেয় হয়ে যাবো। কিন্তু একটা কথা বলে যাই। হঠাৎ করে উধাও হয়েছ এটা নিয়ে বনগাঁয় কথা হবে।

কেন হবে? আমি তো বাপের বাড়ি এসেছি। কাকাকে বলেওছি, সে কথা।

চিরকাল তো এখানে থাকতে পারবে না। ফিরতে হবে।

আমি তোমার মতো বোকাও নই, আহাম্মকও নই। আমি মাথা উঁচু করেই ফিরব।

নিমাই ক্লিষ্ট মুখে বসে রইল।

কী চাও তুমি বলো তো! তুমি চাও টাকাটা আমি কাকার হাতে তুলে দিই? ও টাকার ওয়ারিশ কি কাকা?

আমি যা বলেছিলাম তা ভুলে যাওয়াই ভাল। ওসব আগড়ম বাগড়ম কথা। আমার মাথায় ওরকম সব বোকা-কথাই আসে।

তার গেঞ্জিটা বুকের কাছে হঠাৎ খামচে ধরে বীণা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ফের ন্যাকামি হচ্ছে!

নিমাই একটা অর্ধস্ফুট যন্ত্রণার আওয়াজ করল। সে দুর্বল মানুষ। বীণা বড় হিংস্র মুঠিতে তার বুকের লোম অবধি খিমচে ধরেছে। ঝাঁকুনিতে তার ঘাড়ে মট করে লাগল। নিমাই জলভরা চোখে বীণার দিকে চেয়ে বলল, আমাকে সত্যিই ছেড়ে দাও বীণা। আমি আর পারি না।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৪২. হেঁচকির শব্দ
পরবর্তী:
০৪৪. লিভিং রুমের ঠিক মাঝখানটায় »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑