নজরুল ইসলামের ধর্ম

নজরুল ইসলামের ধর্ম

নজরুল ইসলাম দার্শনিক ছিলেন না। বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞানির্ভরও তিনি নন। একান্তভাবে হৃদয়ধর্মী কবি নজরুলের মধ্যে আমরা যে-শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ দেখতে পাই তা নিতান্ত স্পর্শ-চঞ্চলতা ও অনুভূতিপ্রবণতার দুর্বার গতিজাত। এজন্যেই তাঁর কাব্যে সমাজ ও রাষ্ট্রসচেনতার স্পষ্ট ও ঋজু মূর্তি প্রকাশ পায়নি, ভাঙার গানই তিনি গেয়ে গেলেন, জোড়ার কাজে হাত দিতে পারেননি। তাঁর মধ্যে সুন্দর সুষ্ঠু সমাজজীবনের পরিকল্পনা ছিল না। শুধু সমস্যাই তিনি দেখেছেন, সমস্যার সমাধানও তিনি চেয়েছেন আন্তরিকভাবে, কিন্তু পথের সন্ধান তিনি বাতলিয়ে দেননি। রক্তঝরানোই কর্তব্য বলে মেনে নিয়েছেন : রক্তঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা। কারণ যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস তাদের উৎসাদনই হচ্ছে আশু কর্তব্য। সেইজন্যেই কবির অভিলাষ যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ। তিনি চেয়েছেন মানুষ নির্বিশেষের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও কুসংস্কার মুক্তি। এই মুক্তিকামনার উৎস সমাজবোধ নয়, হৃদয়বৃত্তিজাত সহানুভূতি। তাই তার আবেদনে অকৃত্রিম আবেগ আছে, ঐকান্তিক সাধনার নিদর্শন নেই–যে সাধনা গড়ে তুলতে পারত সুন্দর নির্ঘ নির্বিঘ্ন সমাজ, দিয়ে যেতে পারত মহৎ ও বৃহৎ কোনো অবদান। তাঁর মধ্যে প্রচুর আবেগ, সীমাহীন উত্তেজনা রয়েছে। উত্তেজনা সবসময় ক্ষণস্থায়ী এবং মহৎ ও বৃহৎ কর্মের পরিপন্থী। ফলে বিদ্রোহ সার্থকতার পথ খুঁজে পেল না, বিপ্লব পেল না সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন। উত্তেজনায় সংযমের স্বাস্থ্য থাকে না, থাকে না সুপরিকল্পিত কর্মের প্রেরণা। তাই তিনি উত্তেজনা ও প্রাণপ্রাচুর্য বশে তারুণ্যের, যৌবনের, জীবনের, সুন্দরের বন্দনা করে গেলেও তাদের স্বরূপ চিহ্নিত করে দিতে পারেন নি।

যা পারেন নি, যা দেন নি তা নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। কিন্তু তিনি যা দিয়েছেন, তার মূল্যও অপরিসীম। তিনি সত্তা-অচেতন জড় জাতির জীবনে নতুন করে প্রাণ-স্পন্দন দিয়েছিলেন। দারিদ্র দাসত্ব-অশিক্ষা-শোষণ জর্জরিত স্বদেশবাসীর জন্যে তাঁর আকুলতার সীমা ছিল না, ক্ষোভের ছিল না অন্ত। এই ক্ষোভ ও আকুলতাই তাঁকে বিদ্রোহী ও বিপ্লবী করেছিল। সমাজে-রাষ্ট্রে-ধর্মে যেখানেই তিনি অন্যায় দেখেছেন সেখানেই রুখে দাঁড়িয়েছেন, নির্মমভাবে করেছেন আঘাত, নিঃসংকোচে প্রকাশ করেছেন তাঁর উপলব্ধ সত্যকে, নির্ভীকচিত্তে করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তিনি নিজেই বলেছেন যা অন্যায় বলে বুঝেছি অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কারও তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কারো পিছনে পো ধরি নাই। আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই–সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। (জবানবন্দী)।

নির্যাতিত স্বদেশী লোকের দুঃখবেদনায় সমবেদনা জানাতে গিয়ে কবি বিশ্বের দুর্গত জনসাধারণের হয়ে অন্যায়-অত্যাচরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। ব্যক্তি-চেতনা জাগানো এবং ব্যক্তি-সত্তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর সাধনা। স্ব স্ব মর্যাদায় অধিকারে ও বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত থেকে মানুষ তৈরি করবে মিলন-ময়দান-যে ময়দানে সমবেদনায় সকলে হয়েছে ভাই। নির্যাতিত মুমূর্ষ মানুষকে আত্মচেতনা ও আত্মবিশ্বাস দানই ছিল তার ব্রত। এ ক্রন্দন কী আমার একার? না এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল নীরব ক্রন্দসীর সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের প্রলয়-হুঁঙ্কার একা আমার নয়, সে নিখিল আর্তপীড়িত আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার। (জবানবন্দী)

অথবা–বীর কারুর অধীন নয়, ভিতরে বাইরে সে কারুর দাস নয়–সম্পূর্ণ উদার মুক্ত। পরকে ভক্তি করে, বিশ্বাস করে শিক্ষা হয় পরাবলম্বন–আর পরাবলম্বন মানেই দাসত্ব।… বল কারুর অধীনতা মানিনা-স্বদেশীরও না বিদেশীরও না। (দুর্দিনের যাত্রী)।

নজরুলের কাব্য-সাধনা ছিল একান্তভাবে মানবনিষ্ঠ। নজরুলের ধর্মও ছিল তাই মানবনিষ্ঠা। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে প্রেম করাই আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ এবাদত। এ প্রেমে ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠা থাকা প্রয়োজন। সেজন্যে আমরা দেখতে পাই বিবেক, সত্য ও মানবতাকে তিনি সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি বিবেকের নির্দেশ মেনে চলেন। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যে ঘোষণা করেছেন জেহাদ। মানুষ নির্বিশেষের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও প্রেমই তাঁকে ধর্মের গোঁড়ামি, আভিজাত্যবোধ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করেছে :

গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহীয়ান,
 নাই দেশকাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি;
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

অথবা

 দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফুটে তাজা ফুল
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে খুলে দেখ নিজ প্রাণ।

নজরুল ইসলাম কোনো বিশেষ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন বলা চলে না। তিনি দেশ-জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান উদারতায় ভালোবাসতে পেরেছেন। বিবেক-বিধৃত সত্যের উপরে সত্য নেই, এ-ই তাঁর বিশ্বাস —

শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা সত্য-সিন্ধুজলে।
ওরে বেকুব, ওরে জড়, শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়।
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

 বলেছি, নজরুল ইসলামকে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুরাগী বলা চলে না। এতদসত্ত্বেও তিনি ইসলামের প্রতি তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছেন। তার কারণ, কবির জীবনের যা ব্রত তা ইসলামের মতো আর কোনো ধর্ম এত দৃঢ়তার সঙ্গে এমন স্পষ্ট করে বলেনি। কবি বলেন :

চির উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির
ওই শিখর হিমাদ্রির।

কোরআন বলে–আনতুমা খয়ারে উম্মাতীন। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তির কাছে মানুষের শির অবনমিত হবে না। মানুষ আশরাফুল মখলুকাত।

কবি বলেন- এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো কাবা-মন্দির নাই।

 ইসলাম বলে : মানুষের হৃদয় কাবা স্বরূপ।

 কবি বলেন

 মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নাই কিছু মহীয়ান
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি।

 ইসলাম বলে– মানুষ সব এক আদমের সন্তান এবং পরস্পর ভাই ভাই

কবি বলেন- তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।

 অথবা, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হল।

ইসলাম বলে– যে-দুঃখ, যে-বেদনা, যে-লাঞ্ছনা তুমি নিজের জন্যে কামনা করতে পারো না, তা তোমার ভাইয়ের জন্যে কামনা করো না। প্রতিবেশীকে উপবাসী রেখে নিজে ক্ষুধার অন্ন গ্রহণ করো না।

কবি বলেন–সবদেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

 ইসলাম বলে–মানুষকে ভালোবাসাই আল্লার শ্রেষ্ঠ এবাদত।

কবি চেয়েছেন–মানুষের ব্যক্তি-মর্যাদার সাম্য, বিত্ত-বৃত্তি নিরপেক্ষ ভ্রাতৃত্ব, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি; শোষণ, অত্যাচার ও আভিজাত্যবোধের উৎসাদন।

ইসলামের শিক্ষাও হচ্ছে :

নাই ছোট বড়–সকল মানুষ এক সমান,
 রাজা প্রজা নয় কারো কেহ।
সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
 কারো আঁখি জলে কারো ঘরে কী রে জ্বলিবে দীপ।
দুজনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বনসীব?
এ-নহে বিধান ইসলামের ॥

 ইসলামের এ শিক্ষাই কবিকে মুগ্ধ করেছে। এজন্যেই কবি ইসলামকে আঁকড়ে ধরে আছেন। ইসলামের মানবতা ও সমাজ সংজ্ঞা তাঁর আদর্শের সম্পূর্ণ অনুকূল বলেই মানুষ নির্বিশেষের মিলন পীঠ কাবার ছবি তার বক্ষে অঙ্কিত; মানবতা ও সাম্যের বাণী-বাহক হজরত মুহাম্মদের নাম তাঁর জপমালা; এইজন্যেই মর্যাদার পূজারী উন্নতশির কবির হৃদয় কলেমা লাইলাহা ইলল্লাহু মুহম্মদ রসুলাল্লাহ আন্দোলন জাগায়। তাঁর এই ইসলামপ্রীতি ধার্মিকতাপ্রসূত নয়–মানবতা ও ব্যক্তি নিষ্ঠাজাত। ধর্মপ্রাণতা নয়– আদর্শানুগত্য। তাঁর আদর্শের সাধনার অনুকূল উপাদান তিনি যেখানেই পেয়েছেন, গ্রহণ করেছেন। তাই হিন্দুর দেবদেবী, পুরাণ প্রভৃতিও তাঁর কাব্যসাধনায় ও আদর্শানুসরণে প্রেরণা দিয়েছে, আশা জাগিয়েছে, ভাষা যুগিয়েছে। খলিফা ওমর, তার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন শুধু ধার্মিক বলে নয়, ইসলাম ও মুসলমানদের ভাগ্যবিধাতা বলেও নন, মানুষকে ভালোবেসেছেন বলে :

মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু।
 বলিয়াছ ভাই–তাই তো
মারে এখন চোখের পানিতে
স্মরি গো সর্বদাই।

এইরূপে আমপারা, মোহররম, ফাতেহা-দোয়াজদহম মরুভাস্কর প্রভৃতি রচনায় কবি ইসলামের ও হজরতের জীবনের মানবতার দিকটি উদঘাটিত করেছেন। ইসলাম ও রসুলের জীবনের এই সৌন্দর্য ও শিক্ষায় তিনি মুগ্ধ ছিলেন। নিজের জীবনে ও সমাজে এই শিক্ষার বাস্তব রূপায়ণেই তাঁর সাধনা নিয়োজিত ছিল।

অতএব নজরুলের ধর্মবোধ স্বাতন্ত্রবুদ্ধি জাগায় না। এ ধর্ম কল্যাণ ও মিলনকামী। এ ধর্ম মোক্ষের সহায় নয়জীবনের অবলম্বন-ঋজুপথের দিশারী ও স্বস্থ জীবনের পাথেয়।