নজরুলের কাব্যপ্রেরণার উৎস

নজরুলের কাব্যপ্রেরণার উৎস

কবি হতে হলে হৃদয়বৃত্তির বিশিষ্ট বিকাশ প্রয়োজন। এতে মন তীব্রভাবে অনুভূতিপ্রবণ ও স্পর্শচঞ্চল হয়ে উঠে। কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে এ বিকাশ পূর্ণমাত্রায় হয়েছিল। যে-বয়েসে মন শুধু গ্রহণ করতে থাকে এবং বিবেচনাহীন উচ্ছ্বাসে পরিচালিত হয়, সেই কিশোর বয়েসে কবি লড়াই-এর ময়দানে গিয়েছিলেন, দূর থেকে দেখেছিলেন বর্বরতার নির্লজ্জ অভিনয়, নিষ্ঠুরতার তাণ্ডব লীলা, পাশব-বৃত্তির নগ্ন আত্মপ্রকাশ, মানবতার অপমৃত্যু। জীবনের গ্লানি আর মৃত্যুর বীভৎসরূপ তাঁর কাছে প্রকট হয়ে ওঠে একান্তভাবে। এতে কবির অনুভূতিপ্রবণ স্পর্শচঞ্চল মন ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়। তার আত্মায় জ্বলে উঠল বিদ্রোহ, বিপ্লব আর মানবতাবোধের অপূর্ব দ্যুতিময় শিখা।

কবি ফিরে তাকালেন তাঁর দেশবাসীর দিকে। দেখলেন–সেখানেও দাসত্ব, দারিদ্র্য ও অশিক্ষায় মানোষের মুমূর্ষ আত্মা ধুকছে। কবির বিক্ষুব্ধ আত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। মারমুখী হয়ে তিনি সংগ্রাম শুরু করলেন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বাহুবল তাঁর ছিল না; তাই শোষণ অনাচারের বিরুদ্ধে চলল বাণীর অভিযান :

রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা।

তার সে কী তীব্রতা! সে কী আশ্চর্য আবেগমুখরতা! ক্ষোভে, জ্বালায়, যুক্তির সারবত্তায়, বাচনভঙ্গির তীক্ষ্ণতায়, উচ্ছ্বাসের দুর্বার গতিবেগে সহস্র বজ্রনিনাদে তাঁর বাণীবর্শা নিপতিত হতে লাগল এটমবোমার মতো সমাজদেহে ও রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর। কবি উদাত্তকণ্ঠে সবিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন তার ব্রত :

আমি সেই দিন হব শান্ত
 যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
 আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খঙ্গ-কৃপাণ ভীমরণভূমে
রণিবে না।

শুরু হল সংগ্রাম–আপোষহীন, বিরামহীন। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ লাভ-ক্ষতির খতিয়ান গেল তলিয়ে। একান্তভাবে ভালোবেসেছিলেন তিনি স্বদেশকে ও স্বজাতিকে। হিংসা, ঘৃণা, দ্বেষ ছিল না কারো প্রতি। কারো ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অন্যায়ের প্রতি তাঁর ছিল না নালিশ। তাঁর সংগ্রাম আদর্শগত; ব্যক্তি, রুচি বা স্বার্থগত নয়। তাই দেশের মানুষ নির্বিশেষকে তিনি ভালোবাসতে পেরেছিলেন হৃদয়-মন দিয়ে, দ্বিধাহীনচিত্তে ক্ষমা করতে পেরেছিলেন ব্যক্তিজীবনের স্থলন-পতন-ত্রুটি। এইজন্যেই নারীপুরুষ, কৃষকমজুর, এমনকি বারাঙ্গনাকেও তিনি সমান উদারতায় মর্যাদা দিতে পেরেছেন। শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছেন মানুষ নির্বিশেষকে অকুণ্ঠচিত্তে।

পতিত স্বদেশ ও নির্যাতিত স্বজাতিকে ভালোবাসতে গিয়ে কবি বিশ্বের সমস্ত নির্যাতিত মানবতাকে ভালোবেসেছেন। স্বদেশ ও স্বজাতির জন্যে ফরিয়াদের হাত উঠিয়ে তিনি দাসত্ব, শোষণ ও অত্যাচার-জর্জরিত বিশ্বমানবের জন্যে আন্তরিকভাবে ফরিয়াদ জানিয়েছেন। এ কারণেই দুর্গত এশিয়ার সমস্ত অনুন্নত, পেষণক্লিষ্ট জাতির সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষায় সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত হতভাগ্য এশীয় জাতিগুলোর সবকটাই মুসলমান। তাই কোনো কোনো পাঠক সমালোচক তাকে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তাবাদী বা pan Islamism-এ বিশ্বাসী ঠাউরেছেন। আমাদের মনে হয়, তাঁদের এ বিশ্বাসে গলদ আছে, কেননা তাঁর মুসলিম দেশ ও বীর-প্রশস্তি বিষয়ক কবিতাগুলো মুসলিম প্রীতির চেয়ে দুঃখীর প্রতি সমপ্রাণতার পরিচয়ই যেন বেশি বহন করছে। যেমন–

ইরাকবাহিনী! এ যে গো কাহিনী
কে জানিত কবে বঙ্গবাহিনী
তোমারও দুখে জননী আমার
বলিয়া ফেলিবে তপ্তনীর?
পরাধীনা! এই একই ব্যথায় ব্যথিত
ঢালিল দু-ফোঁটা অশ্রু ভক্ত বীর। অথবা–

তাই

 মিশরের নহে এই শোক
এই দুর্দিন আজি,
এশিয়া-আফ্রিকা দুই মহাভূমি
বেদনা উঠিছে বাজি।
অধীন ভারত তোমারে স্মরণ
করিয়াছে শতবার।

এরূপ আরো কবিতায় কবি এশিয়ার অনুন্নত দেশসমূহের নব-জাগরণে উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে স্বদেশীয়দের নিষ্ক্রিয়তার জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন;

এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে হে ঋষি
তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল।
চলিতেছে দিবানিশি।

 অথবা

খররোদ পোড়া খর্জুর তরু তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর।
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ভারতের বুকে নাই রুধির!

অপর কয়েকটা কবিতায় তিনি অন্যদেশের ন্যায় স্বদেশেও জাগরণ কামনা করেছেন :

জেগেছে আরব ইরান তুরান।
 মরক্কো আফগান মেছের
 এয় খোদা! এই জাগরণ রোলে।
এই মেষের দেশও জাগাও ফের।

অথবা

মলয় শীতল সুজলা এদেশে
আশিস করিও খালি–
 উড়ে আসে যেন তোমার দেশের
মরুর দু মুঠো বালি!

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলত আত্যন্তিক স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রেমের যে-অভিব্যক্তি বাণীরূপ লাভ করল, তা বৃহত্তর ক্ষেত্রে আচার, সংস্কার, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নক্লিষ্ট মানবসাধারণের মুক্তি-জেহাদের রূপ গ্রহণ করেছে। এ জেহাদ একাধারে ত্রিমুখী : বিদেশী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি-সগ্রাম, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক কুৎসিত মনোভঙ্গির উৎসাদন প্রয়াস এবং ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি প্রচেষ্টা। এ-জেহাদে নজরুল অকপট মুহিদ ছিলেন। সংকল্পের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ ছিল নিবিড়। যে-ব্ৰত তিনি হৃদয়-মন-বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করলেন, তার উদযাপন প্রচেষ্টায়ও তিনি উক্ত বৃত্তিনিচয়ের উদার ও অবাধ সহযোগিতা পেলেন। ফলে তার মুখনিঃসৃত বাণী জ্বালায়, দরদে, ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে তীক্ষ্ণ-তীব্র মধুর হয়ে উঠেছে।

কবি নিজে ছিলেন প্রাণধর্মী। এজন্যে প্রাণধর্মের প্রতীক তরুণ ও তারুণ্যকে কবি সর্বত্র অভিনন্দন জানিয়েছেন :

কুপমণ্ডুক অসংযমীর
 আখ্যা দিয়াছে যারে–
তারি তরে ভাই গান রচে যাই
বন্দনা করি তারে।

কবি জীবনধর্মী অভিযাত্রীও বটে, তাই তিনি বলেছেন :

গাহি তাহাদেরি গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে
যারা আজি আগুয়ান।

এসবও হয়তো বাহ্য লক্ষণ। তার সর্বসংগ্রামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার সম্যক উপলব্ধি। তিনি এজন্যেই বলেছেন :

নাই দানব নাই অসুর? চাইনে সুর, চাই মানব।

কারণ–

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নাই কিছু মহীয়ান।

এহেন মানুষের তিনি প্রেমিক। এই মানুষকে ভালোবেসেই তিনি ধন্য হতে চান– জীবনকে চান সার্থক করে তুলতে। এমন মানুষের দুঃখ-বেদনা লাঞ্ছনায় কী তিনি স্থির থাকতে পারেন? তাই তাঁর ভাষা এত তীব্র, বাণী এমন তীক্ষ্ণ এবং জোরালো? এই ভালোবাসাই তাঁকে সাম্যবাদী করেছে– করেছে বিদ্রোহী, করেছে বিপ্লবী। কিন্তু তাঁর সাম্যবাদকে মার্কসবাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করলে ভুল হবে। কারণ তাঁর সাম্যবাদের গোড়ার কথা হচ্ছে মানুষ এক আদমের সন্তান, সুতরাং মানুষ মাত্রেই ভাই ভাই। মানুষ হচ্ছে আনতুমা খয়ায়ে উম্মাতীন। অতএব এক আল্লাহ ব্যতীত কোনো মর্ত্যশক্তির নিকট তার মাথা নত করতে নেই। মানুষের এ মর্যাদায় তিনি পূর্ণ বিশ্বাসী। সর্বপ্রকার কর্ম ও বৃত্তি যখন জীবন ও সমাজ রক্ষার জন্যে অপরিহার্য তখন কোনো কাজ বা পেশাই ছোট নয় এবং বৃত্তির জন্যে কেউ হেয় হতে পারে না। সেইজন্যেই কবি সাম্যের বাণী প্রচার করেছেন। তবু শ্ৰেণীবিলুপ্তির কথা তাঁর বাণীতে নেই। তিনি চেয়েছেন স্ব-স্ব অধিকার, বিত্ত ও বৃত্তি বজায় রেখে স্বাধিকারে স্বাধীনভাবে ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদার পূর্ণ স্ফুরণ; চেয়েছেন এমন ব্যবস্থা যাতে স্ব স্ব স্বাতন্ত্র, মর্যাদা ও বৃত্তি বজায় রেখেও মানুষ যেখানে আসিয়া সমবেদনায় সকলে হয়েছে। ভাই। আইন করে চাপানো ধনসাম্য নয়–প্রীতি-বন্ধুত্বের সাম্য তথা সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাম্যই কবির কাম্য।

এই আদর্শই ছিল তাঁর কাব্যপ্রেরণার উৎস। এই আদর্শের বাস্তব রূপায়ণই ছিল তাঁর ব্রত। এই উদ্দেশ্যেই তাঁর সাধনা। এই-ই হচ্ছে তাঁর কাব্যের মূলবাণী–গানের মূল সুর। এইজন্যেই এ আদর্শের রূপায়ণে প্রতিবন্ধকস্বরূপ যতকিছু ছিল, সবকিছুর বিরুদ্ধে সর্বত্র তাঁর বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে। তিনি মানবতার পূজারী মহাসাধক, প্রাণ-ও-জীবনধর্মের মূর্ত প্রতীক।

সুতরাং মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অর্জন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। যুগে যুগে সমাজ, সংস্কার, রাষ্ট্র প্রভৃতির অবাঞ্ছিত জঞ্জাল এসে মানুষের এই মৌলিক অধিকারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কবির সংগ্রাম হচ্ছে তাকে সব বাধা ও মালিন্য মুক্ত করে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। সে-সংগ্রাম করতে গিয়েই কবি বাঙালির সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে একযোগে বিপ্লব আনয়ন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিরাট ও মহান। তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটা বাঙালি জাতিকে (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দাঁড় করানো। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, আদর্শে, আচারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ধর্মে, সাহিত্যে কোথাও যেন গ্লানি না থাকে। মনুষ্যত্বের সুউচ্চ সাধনায় যেন তার দেশবাসী আত্মনিয়োগ করে–এই ছিল তাঁর অভিলাষ।

প্রতিভাবানেরা সমসাময়িক যুগের দিশারী ও নিয়ন্তা এবং ভবিষ্যৎকালের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। কাজী নজরুলও এমনি একজন প্রতিভা। তিনি সমাজে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরে নতুন যুগের প্রবর্তন করেছেন। যা অভিলাষ করেছিলেন, তা অনেকাংশে পূর্ণও হয়েছে। ভবিষ্যতে একদিন তাঁর স্বপ্ন হয়তো পুরোপুরিভাবেই সফল হবে। সেদিন তিনি থাকবেন না, কিন্তু তার আদর্শানুসারী লক্ষ লক্ষ প্রবুদ্ধ জন-কণ্ঠে সেদিন নিবেদিত হবে তাঁর প্রতি অকপট শ্রদ্ধা।