রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ

আমাদের শিশুরা ঘনিষ্ঠজনের ছাড়া আর যে-নামটির সঙ্গে গোড়াতেই বিশেষভাবে পরিচিত হয় তা রবীন্দ্রনাথ। আমাদের শিক্ষালয়ে রোজ লক্ষ লক্ষ মুখে যে নামটি উচ্চারিত হয় সে রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তারে-বেতারে যার নাম, সুর ও সংগীত প্রতিদিন পাক-ভারতের ঘাটে-মাঠে, আকাশে-বাতাসে শোনা যায়, তিনি রবীন্দ্রনাথ।

তিনি আমাদের ভাষা দিয়েছেন, কথা যুগিয়েছেন। আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের উন্নয়ন-উপায় ও লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছেন। তার বিভিন্ন ও বিচিত্র ভাব-চিন্তা তাঁর কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে ও রম্য রচনায় প্রমূর্ত ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

আলো-বাতাসের মধ্যেই বেঁচে আছি বটে, কিন্তু এদের দান আমাদের জীবনে কতখানি, সে সম্বন্ধে আমরা যেমন সচেতন নই। তেমনি আমরা যে-ভাষা মুখে বলি, লেখায় লিখি, যে সুরে গান গাই, যে ছন্দে লিখি, যা ভাবি, যা জানি, যা উপলব্ধি করি–তার কতখানি যে রবীন্দ্রাথের, তা মনেও জাগে না। ভাষা ও ছন্দ কিংবা পুরস্কার কবিতায় কাব্য ও কবি সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন তা আমাদের জীবনে আক্ষরিকভাবে সত্য হয়েছে। অন্যের কথা জানিনে, আমার চিত্তাকাশে রবীন্দ্রনাথের রচনার দান অনেকখানি, জীবনের বহু দুঃখ-বেদনার মুহূর্তে অনেক হতাশা-নিরাশার দুর্দিনে, নানা আপদ-বিপদের দুর্যোগে, আর সুখ-সৌভাগ্যের আনন্দিত দিনে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমার জীবনপথের পাথেয় হয়ে আছে। জীবন-রস-রসিক রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মবাদের প্রচ্ছায় মানুষ। তিনি জানতেন, আর সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাসও করতেন সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম এবং বসুদৈবকুটুম্বকম। তিনি নিজেই বলেছেন আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে যে মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদন, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য সেই মহামানবের মধ্যে, যিনি সদা জানানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।

তিনি সর্বত্র সুন্দর ও সুন্দরের প্রশান্ত দান আনন্দকে দেখেছেন, তাঁর সাধনা ছিল এই সুন্দরকে চাওয়া ও পাওয়ার সাধনা। তিনি পরমহংসের মতো সুন্দরকে পেয়েছেন। তাই তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বাসে বলতেও পেরেছেন আমি জীর্ণ জগতে জন্মগ্রহণ করিনি, আমি চোখ মেলে যা দেখলুম, চোখ আমার কখনো তাতে ক্লান্ত হল না, বিস্ময়ের অন্ত পাইনি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত, তাকে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে, মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম।

তাই তিনি আকাশ-জল, বাতাস-আলো আর প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবেসেছেন, যে ভালোবাসায় কোনো ভেদ-বিচার ছিল না। বিশ্বের অণুপরমাণুকে জ্ঞাতি বলে মেনেছেন, যদি জানিবারে পাই ধূলিরেও মানি আপনা। এ প্রসঙ্গে প্রবাসী, বসুন্ধরা, সমুদ্রের প্রতি প্রভৃতি কবিতা স্মরণীয়। তিনি চারদিক থেকে জীবন-রস আহরণ করেছেন, দুহাত ভরে তুলে নিয়েছেন জীবনের প্রসাদ। বলেছেন : এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি। তৃপ্ত হৃদয়ে তাই জীবনসায়াহ্নে তিনি বলতে পেরেছেন :

জীবনের বিধাতার যে দাক্ষিণ্য পেয়েছি জীবনে
তাহারি স্মরণ-লিপি রাখিলাম সকৃতজ্ঞ মনে।

বলেছেন :

যাবার বেলায় এ কথাটি বলে যেন যাই
যা পেয়েছি, যা দেখেছি তুলনা তার নাই।

এবং জীবন-সায়াহ্নে যা সচেতনভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তা-ই তিনি অবচেতন ভাবে তার জীবনে রূপায়িত করেছেন :

এ-কথা যখন জানি,
মানব চিত্তের সাধনায়,
গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ
সেই সত্য সুখ-দুঃখ সবের অতীত,
তখন বুঝিতে পারি,
আপন আত্মায় যারা
ফলবান করে তারে
তারাই চরম লক্ষ্য মানব সৃষ্টির।

জীবন রসের অপূর্বতায় আর জীবন-সত্যে তার প্রত্যয় ছিল দৃঢ়, তাই বলেছেন,

এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি
এ ভালবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে
করিবে অস্বীকার।

আকাশে চন্দ্র-সূর্য একক। কিন্তু তাদের প্রসাদের দাবীদার বিশ্বচরাচর। তাই বলে টুকরো টুকরো করে তাদেরকে ভাগ করার দরকার হয় না। প্রত্যেকেই রুচি ও গরজ মতো চন্দ্র-সূর্যকে অখণ্ড স্বরূপেই পায়। কেউ পথচলার কাজে, কেউ উৎসব-পার্বণের প্রয়োজনে, কেউ সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে এদের প্রসাদ সচেতনভাবে কামনা করে এবং গ্রহণ করে। কবি-শিল্পীর সৃষ্টিও তেমনি। পাঠকের বিদ্যা-বুদ্ধি-রুচি-বিলাস কিংবা গরজ মতো তা কাজে লাগাতে অথবা উপভোগ করতে পারে। এ নিয়ে তর্ক করা বৃথা। রবীন্দ্রনাথ বড় কবি, বিশ্বমানবতার কবি। মানববোধের উচ্চতম ভাব-চিন্তার অধিকারী ছিলেন তিনি–এই হচ্ছে বিদ্বানদের মত। যার যতটুকু সাধ ও সাধ্য তা-ই সে রবীন্দ্র-সাহিত্য-সমুদ্র থেকে গ্রহণ করতে পারে। যার ঘট যত বড়, সে তত বেশি করেই পাবে। যে সে-প্রসাদ নিতে জানল না, সে বনসিব; যে পারল না, তার দুর্ভাগ্য।

সংস্কৃত আলঙ্কারিকেরা কাব্যাস্বাদনকে ব্রহ্মাস্বাদ সহোদর বলেছেন। তেমন মহৎ কাব্যরস রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষায় আমাদের দিয়ে গেছেন। আমাদের এ সৌভাগ্যের তুলনা নেই। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণের ও কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। জয়তু রবীন্দ্রনাথ।