সৌন্দর্যবুদ্ধি ও রবীন্দ্রমনীষা

সৌন্দর্যবুদ্ধি ও রবীন্দ্রমনীষা

০১.

রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য মানুষ। জীবন-প্রভাত থেকে মৃত্যু-মুহূর্ত অবধি তিনি নব নব রাগে বিচিত্র অনুভবে নিজেকে রচনা করে গেছেন। চিন্তার ও কর্মের বহুধা ও বর্ণালি অভিব্যক্তিতে তার জীবন বিপুল, বিচিত্র ও জটিল হয়ে প্রকটিত হয়েছে। বয়স তার যতই বেড়েছে, তার মনের দিগন্তও ততই হয়েছে প্রসারিত। বেড়ে গেছে তার ভাবাকাশের উচ্চতা ও পরিধি এবং সেহেতু হয়তো সরে গেছে সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই বলাকা-পূর্ব কাব্যের, গোরা-পূর্ব উপন্যাসের, অচলায়তন-পূর্ব নাটকের এবং গল্পসপ্তক-পূর্ব ছোটগল্পের পাঠকসংখ্যা যত বেশি, তার পরবর্তী রচনার সমজদার তত কম।

অতএব রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের শুরু আর শেষ একভাবে হয়নি। কোনো সত্যিকার প্রতিভাই ধ্রুবতায় অবসিত হয় না– হতে পারে না। কেননা অভাবিতকে ভাববদ্ধ করা, অচিন্ত্যকে চিন্তাগোচর করা, নিরবয়বকে অবয়ব দান করা প্রতিভার কাজ। প্রতিভা যুগের দান নয়– যুগের স্রষ্টা; অর্থাৎ প্রতিভা যুগের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, যুগকে প্রভাবিত করে। আমরা রবীন্দ্রনাথকে প্রতিভা বলে মানি। তাই তাঁর বক্র, বিপুল ও বিচিত্র সৃষ্টিপ্রবাহ যে-কোনো ঋজু সিদ্ধান্তের প্রতিকূল। আবার ভক্তি ও বিদ্বেষ–দু-ই যথাযথ ধারণা লাভের অন্তরায়। তাই কবির তিরোভাবের পঁচিশো বছর পরে রবীন্দ্র-বিচারে সতর্কদৃষ্টি ও অবিচলিত মন-মননের প্রয়োজন।

.

০২.

রবীন্দ্রনাথ আশৈশব সৌন্দর্যপিপাসু। এ পিপাসায় অনন্যতা আছে। কেননা এ সৌন্দর্যবোধ প্যাগান নয়, গ্রীক নয়, আধ্যাত্মিকও নয়। শৈশবে চাকর নির্দিষ্ট খড়ির গণ্ডি তার শারীর- বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করত বটে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিবাহী মানস-বিহার রোধ করা যায়নি। ফাঁক-ফুকরে প্রকৃতি-নিসর্গ তার হৃদয়দুর্গ দখল করে নিয়েছিল। বাধা ছিল প্রবল, তাই আগ্রহ হল তীব্র, অনুভূতি হল তীক্ষ্ণ। ফাটা দেয়ালের গুল্মফুল, পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছ, আকাশে মেঘের লীলা আর তারার অব্যক্ত বাণী শৈশবে-বাল্যে কবির মন ও হৃদয় হরণ করেছে। তাই আকাশচারিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের শুরু। আকাশ থেকে তিনি মাটিতে নেমেছেন, ভূমি থেকে ব্যোমযাত্রা করেননি। গোড়া থেকেই অবশ্য মেশামেশি হয়ে গেছে ভূম আর ভূমায়, মাখামাখি ছিল জীবনে আর জগতে। কবি একেই জেনেছেন সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধন বলে। এ বোধের অনুগত ছিল বলেই বিহারীলালের কাব্য বালক-কবির মন জয় করেছিল। আর এ উপাদানের অভাবে মধূসূদনের কাব্য পেল তাঁর অবজ্ঞা।

.

০৩.

প্রকৃতি ও নিসর্গের সৌন্দর্যে মানুষ মাত্রই অম্লাধিক মুগ্ধ। কবিরা অনুভূতিপ্রবণ বলে তাদের উপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রভাব প্রবল। কিন্তু সাধারণ কবিতে তা যতখানি অর্জিতচেতনা, ততখানি অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যানুভূতি নয়। কিন্তু কোনো কোনো কবি-মনে সেরূপ চেতনা গভীর, ব্যাপক ও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। যে প্রকৃতি-চেতনা Words-worth-এর মনে বেদনাবোধ জাগিয়েছে, যে রূপ-অন্বেষা ও প্রেমানুভূতি শেলীকে আকাশচারী করেছে, যে সৌন্দর্যানুভূতি Keats-কে আনন্দিত করেছে, যে রূপমুগ্ধতা বিহারীলালকে তাত্ত্বিক করেছে, সেই সৌন্দর্যচেতনা রবীন্দ্রনাথে এনেছিল এক অনন্য অনুভূতি, একপ্রকারের মুগ্ধতা বা অভিভূতি, সারা জীবনেও কবি যার সীমা-শেষ খুঁজে পাননি। সে রূপ-মাধুরীর অনুভব কবিকে তিলে তিলে নতুন করে তুলেছে।

কৈশোরে কবির একদিন সত্যি সত্যি সৌন্দর্যে সচেতন দীক্ষা হয়েছিল। এক ঊষালগ্নে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়ে গেল, দেখিলাম একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দ ও সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল, তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। [জীবনস্মৃতি] –এই সৌন্দর্যানুভূতি তাঁর চারদিন ছিল–এমনি অনুভূতি জেগেছিল আরো একদিন পূর্ণিমা রাতে–সৈকতে, তখন তিনি আমেদাবাদে।

আমার শিশুকালেই বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে আমার খুব একটি সহজ ও নিবিড় যোগ ছিল। বাড়ির ভিতরের নারিকেল গাছগুলি প্রত্যেকে আমার কাছে অত্যন্ত সত্য বলিয়া দেখা দিত।… সকালে জাগিবামাত্রই সমস্ত পৃথিবীর জীবনোল্লাসে আমার মনকে তাহার খেলার সঙ্গীর মতো ডাকিয়া বাহির করিত, মধ্যাহ্নে সমস্ত আকাশ এবং প্রহর যেন সুতীব্র হইয়া উঠিয়া আপন গভীরতার মধ্যে আমাকে বিবাগী করিয়া দিত এবং রাত্রির অন্ধকার যে মাঝপথের গোপন দরজাটা খুলিয়া দিত, সম্ভব-অসম্ভবের সীমানা ছাড়াইয়া রূপকথার অপরূপ রাজ্যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করিয়া লইয়া যাইত। এবং গঙ্গার পালতোলা নৌকায় যখন-তখন আমার মন বিনা ভাড়ায় সওয়ারি হইয়া বসিত এবং যে সব দেশে যাত্রা করিয়া বাহির হইত ভূগোলে আজ পর্যন্ত তাহার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নাই।

কি মাটি, কি জল, কি গাছপালা, কি আকাশ সমস্তই তখন কথা কহিত, মনকে কোনো মতেই উদাসীন থাকিতে দেয় নাই। –[জীবনস্মৃতি]।

আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালোবাসি(ছিন্ন পত্রাবলী ১৩)। পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। (ছিন্ন পত্রাবলী ৯৩)। সৌন্দর্য যখন একেবারে সাক্ষাত্তাবে আত্মাকে স্পর্শ করতে থাকে, তখনই তার ঠিক মানেটি বোঝা যায়, আমি একলা থাকি, তখন প্রতিদিনই তার সুস্পষ্ট স্পর্শ অনুভব করি, সে যে অনন্ত দেশ কালে কতখানি জাগ্রত তা বুঝতে পারি। (-ছিন্ন পত্রাবলী ১৯৭)।

সৌন্দর্য আমার পক্ষে সত্যিকার নেশা। আমাকে সত্যি ক্ষেপিয়ে তোলে।…. সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ার শক্তিরও অতীত; কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাকে, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না। (ছিন্ন পত্রাবলী ২৫)।

শৈশবে-বাল্যে তার মন-আত্মা সৌন্দর্য-সমুদ্রে অবগাহন করে করেই পুষ্ট হতে থাকে। তাঁর নিজের জবানীতে এমনি আরো উদ্ধৃতি দেয়া সহজ, কিন্তু অশেষের পথে এগুব না। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে এমনি রূপদর্শী ও রসগ্রাহী ছিলেন, ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী তার সাক্ষ্য।

.

০৪.

প্রকৃতি বা নিসর্গ অখণ্ড কোনো বস্তু নয়– খণ্ড, ক্ষুদ্র ও বিচিত্র বস্তু ও বর্ণের সমষ্টি মাত্র। কিন্তু তার সৌন্দর্য অখণ্ড সত্তার স্বীকৃতিতেই লভ্য। অতএব, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যানুভূতিই এ সৌন্দর্যবোধের উৎস। শৈশব-বাল্যেই এ বোধে অবচেতন দীক্ষা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

খণ্ড-ক্ষুদ্রকে সামষ্টিক সমগ্রতায় উপলব্ধি করার জন্যে দৃষ্টি ও মননের যে-প্রসার প্রয়োজন, অন্যের পক্ষে যা পরিশীলনেও সম্ভব হয় না–রবীন্দ্রনাথে তা প্রায় অনায়াসলব্ধ। অন্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : The first.stage of my realization was through my feeling of intimacy with nature. (Religion of man). apfo fesat fantas সবকিছুই সুন্দর নয়—হ্রস্ব-দীর্ঘ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সুগন্ধী-দুর্গন্ধী, মরা-তাজা, ভাঙা-মচকানো, ঋজু-বাঁকা, বর্ণালি-বিবর্ণ সব রকমই আছে। কিন্তু সৃষ্টির কিছুই তুচ্ছ নয়, নিরর্থক নয়–এ বোধের বশে যদি কেউ প্রকৃতি-নিসর্গের দিকে তাকায়, তাহলে সর্বত্র একটা রহস্য, একটা কল্যাণচিহ্ন প্রত্যক্ষ করা সহজ হয় :

এ মাঝে কোথাও রয়েছে কোনো মিল
নহিল এত বড় প্রবঞ্চনা।
পৃথিবী কিছুতেই সহিতে পারিত না।

–এই আস্তিক্যবুদ্ধিই মানুষকে জীবন-রসরসিক করে তোলে তখন বিষ আর অমৃতের আপাত বৈপরীত্য ঘুচে যায়–দু-ই জীবনের অনুকূল বলে অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের মুখে তাই শুনি আমি স্বভাতই সর্বাস্তিবাদী–অর্থাৎ আমাকে ডাকে সকলে মিলে, আমি সমগ্রকে মানি। গাছ যেমন আকাশের আলো থেকে আরম্ভ করে মাটির তলা পর্যন্ত সমস্ত কিছু থেকে ঋতু পর্যায়ের বিচিত্র প্রেরণা দ্বারা রস ও তেজ গ্রহণ করে তবেই সফল হয়ে ওঠে– আমি মনে করি আমার ধর্মও তেমনি–সমস্তের মধ্যে সহজ সঞ্চরণ করে সমস্তের ভিতর থেকে আমার আত্মা সত্যের স্পর্শ লাভ করে সার্থক হতে পারবে। (রবীন্দ্র-জীবনী-৩: পৃ. ২৯৪)। জগতের সঙ্গে সরল-সহজ সম্বন্ধের মধ্যে অনায়াসে দাঁড়িয়ে যেন বলতে পারি, আমি ধন্য। যা কল্যাণকর তা-ই সুন্দর, তা-ই শ্রদ্ধেয় এবং তা-ই প্রিয়। এ অনুভবের গভীরতাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর সঙ্গে একত্ব ও একাত্মবোধ জন্মায়। তখন সহজেই বলা সম্ভব যদি জানিবারে পাই ধূলিরেও মানি আপনা। যাকে বিষ বলে জানি, সুপ্রয়োগে তা-ই প্রাণ বাঁচায়, অপপ্রয়োগে অমৃত হতে পারে জীবনঘাতী। দুর্ব্যবহারে ভাইও হয় প্রাণের বৈরী, আবার প্রীতি দিয়ে অরিকেও মিত্র করা সহজ। এ তত্ত্ব একবার উপলব্ধ হলে বিশ্বজগতের প্রাণী ও প্রকৃতির আপেক্ষিকতা তথা জীবনধারণ ব্যাপারে পারস্পরিক উপকরণাত্মকতা হৃদয়-গোচর হয়। তখনই বলা চলে, আমি আছি এবং আমার সঙ্গে আর সমস্তই আছে, আমাকে ছেড়ে এই অসীম জগতের একটি অণুপরমাণুও থাকতে পারে না (ছিন্ন পত্রাবলী ২৩৮)। বোধের এমনি স্তরে প্রাণী, প্রকৃতি ও মানুষকে অভিন্ন সত্তার অংশ বলে না-ভেবে পারা যায় না। এরই নাম বিশ্বানুভূতি, এ তত্ত্বের ধর্মীয় নাম অদ্বৈতবাদ। এমনি করে রবীন্দ্রনাথে বিশ্বানুভূতি বা বিশ্বাত্মবোধ জাগে। প্রভাত উৎসব, বিশ্বনৃত্য, অহল্যার প্রতি, বসুন্ধরা, সমুদ্রের প্রতি, মধ্যাহ্ন, প্রবাসী, মাটির ডাক প্রভৃতি কবিতায় তা সুপ্রকট।

এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে
ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে।

অতএব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-চেতনাই রবীন্দ্রচিত্তে বৈচিত্র্যে ঐক্য-তত্ত্বেরও বীজ বুনেছিল। এরই বিকাশে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একত্ব ও একাত্ম অনুভব করেছেন; আর এরই বিস্তারে তার ব্যবহারিক জীবনে তথা সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় বোধে মানবিকতা, মানবতা, সর্বমানবিকবাদ বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা পায়। তাঁর এই মানবধর্মের সমর্থন রয়েছে বলেই উপনিষদ তাঁর প্রিয়। আর ঐক্যতত্ত্বের বিরলতার দরুনই স্মৃতি, পুরাণ ও গীতায় তাঁর অনুরাগ সীমিত।

এই সৌন্দর্যবুদ্ধি কীভাবে তার স্বদেশ, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে ও নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে, তার পরিচয় নেয়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

.

০৫.

স্বদেশের ও য়ুরোপের এক যুগসন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। এদেশে তখন বুর্জোয়া আদর্শে নগরকেন্দ্রী জীবনচর‍্যা শুরু হয়েছে। আমি এসেছি যখন … নতুন কাল সবে এসে নামল। ওদিকে সামন্ততন্ত্রী সমাজ ও নৈতিক জীবনবোধ গায়ে গায়ে তখনো অটল। কেননা তখনো গাঁয়ের নিয়তি নির্দিষ্ট জীবনে ইংরেজিশিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি।

বৃটিশ তখন দেশের মালিক, গ্রেট বৃটেনই তখন আমাদের বিলেত। সে বিলেতে শিল্পবিপ্লবের ফলে ফিউডেল সমাজ লুপ্ত; গড়ে উঠেছে বুর্জোয়া সমাজ এবং এই ধনিক সভ্যতা তখন সাম্রাজ্যবাদে পরিণত। সামন্ত ও বুর্জোয়া সমাজে পার্থক্য সামান্য নয়–সামন্তরা ছিল সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু দেশের মানুষের ধন-প্রাণের মালিক, শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক, মান ও ঐশ্বর্যের প্রতিভূ, তারাই সব; আর সব তাদের প্রজা ও মজুর-ক্ষেতমজুর ও আফিসি মজুর।

আর বুর্জোয়াদের আছে বৃত্তি, বিত্ত ও বেশাত। তাদের মুখে হাসি, বুকে বল আর সংকল্পে ভরা মন। তারা আত্মরচনায় ও আত্মপ্রসারে ব্যাকুল। তারা ধনে কেবল ধনী নয়, মানস-সম্পদেও ঋদ্ধ। তারা জিজ্ঞাসু এবং বিজ্ঞান ও যন্ত্রপ্রিয়; কিন্তু কলারসিক, সংস্কৃতিপ্রাণ, কল্যাণকামী, সেবাধর্মী আর মহৎ ও বৃহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ। সামন্ত ছিল কয়েকজন, বুর্জোয়া হল কয়েক লক্ষ। তাদের ঐশ্বর্যের সীমা নেই, তাদের সৌজন্য অতুলনীয়।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ হচ্ছে বুর্জোয়া জীবনের ও ঐশ্বর্যের সোনার যুগ। দ্বিতীয়ার্ধ এর ক্ষয়ের যুগ– আত্মধ্বংসী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও হানাহানির কাল। য়ুরোপে বুর্জোয়া জীবনের অবক্ষয়কালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। কিন্তু বাঙলাদেশে সে অবক্ষয়ের সংবাদ তখনো পৌঁছেনি। বুর্জোয়া সমাজের আত্মিক ও আর্থিক ঐশ্বর্যের পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ লালিত। বুর্জোয়ার এই প্রাণময়তা, উদারতা, সংস্কৃতিবানতা ও বিলাস-বাঞ্ছ শহুরে বাঙালির হৃদয়-মন হরণ করেছিল।

রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এঁদের মধ্যে প্রধান। এঁরা উভয়েই চাকরি ও ব্যবসা করে সম্পদ অর্জন করেন এবং সবটা সদুপায়েও নয়। এঁরা দুজনেই ছিলেন সাহেব-ঘেঁষা এবং ইংরেজ-প্রীতি এঁদের মজ্জাগত হয়ে উঠেছিল। তবু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল। রামমোহন ছিলেন বিদ্বান ও প্রজ্ঞাবান–এই বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রাণের বাণীটি তিনি বুঝেছিলেন। তাঁর উদারতা, গ্রহণশীলতা ও আন্তর্জাতিক চেতনা তা-ই ছিল সে-যুগে অতুলনীয়।

দ্বারকানাথ বিদ্বান না হলেও বুদ্ধিমান ছিলেন। নতুন যুগের বৈষয়িক প্রসাদে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। তাই শৌখিনতায়, বিলাসিতায়, দানশীলতায় ও সাহেব-প্রীতিতেই তাঁর নতুন জীবনচেতনা অবসিত। মনের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বর্জনশীল, গ্রহণশীল ছিলেন না। তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও আমরা এই রক্ষণশীলতাই কেবল লক্ষ্য করি, তার অধ্যাত্মবুদ্ধি তাকে ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ করেছিল, কিন্তু উদার করেনি। এই অনুদারতার জন্যেই তিনি সাহেবদের এড়িয়ে চলতেন, ব্রাহ্ম হয়েও ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যের ধারক ছিলেন; রামমোহন চরম তাচ্ছিল্যে যে-পৈতার শিকল ছিড়লেন, তিনি নতুন করে সেই পৈতার-বন্ধন স্বীকার করেই গর্ববোধ করলেন। অতএব, রবীন্দ্রনাথ পিতা থেকে উদারতার কিংবা প্রতীচ্য প্রাণময়তার দীক্ষা পাননি।

দ্বিজেন্দ্রনাথ অনেকটা বাপের মতোই ছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বাজাত্যবোধ তাকে অনুদার রেখেছিল, অতএব পারিবারিক প্রভাব রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীনতা বা সর্বমানবিক বোধের অনুকূল ছিল না। তাই ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম পঁয়তাল্লিশ বছর কেটেছে অন্যের প্রভাবে। এ সময়েও অবশ্য কাব্যের ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্ববোধের প্রকাশ ও বিকাশ নির্দ্বন্দ্ব ও নির্বিঘ্ন ছিল। যদিও কালিদাসের প্রভাবে প্রাচীন ভারত, তপোবন আর ব্রাহ্মণ্য মহিমায়ও তিনি প্রায় সমভাবেই মুগ্ধ ছিলেন, তবু তাতে বিরোধ ঘটেনি, কেননা সেখানেও তিনি ঐশ্বর্যের মধ্যে ত্যাগ; ভোগের মধ্যে সংযম এবং প্রেমের মধ্যে তপস্যার বীজ ও মহিমা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে স্বাদেশিক, স্বাজাতিক ও স্বধর্মীয় গোঁড়ামি তারও প্রশ্রয় পেয়েছে। কৈশোরেই তিনি সঞ্জীবনী সভার সদস্য, হিন্দুমেলার উৎসাহী কর্মী, স্বজাতির ঐতিহ্যগর্বী ও গানের মাধ্যমে স্বদেশপ্রীতি প্রচারে ব্রতী। পারিবারিক জীবনেও অশিক্ষিতা বালিকাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণে কিংবা নিজের বালিকা কন্যার বিবাহদানে কোনো সংকোচ ছিল না তার। তার এই ব্যবহারিক ভুবনে তাঁর চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে–তাঁর পিতা ও তাঁর অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-তিলক প্রমুখ উগ্র স্বাজাত্যগর্বীদের প্রভাবে।

এ প্রভাব থেকে মুক্ত হতে তাঁর সময় লেগেছে। জীবনের পঁয়তাল্লিশটি বছর কেটে গেছে দেশ-জাত-ধর্মের খোলসমুক্ত হতে। অবশ্য এর মধ্যেও যে তার বিদ্রোহ দেখা দেয়নি তা নয়। এ সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক স্মরণীয়। এ যেন বাল্যের সেই খড়ির গণ্ডি থেকে বাইরের পানে তাকানো। তাঁর নিজের উক্তিতে প্রকাশ: নানা কাজে আমার দিন কেটেছে, নানা আকর্ষণে আমার মন চারিদিকে ধাবিত হয়েছে। সংসারের নিয়মকে জেনেছি, তাকে মানতেও হয়েছে, মূঢ়ের মতো তাকে উচ্ছখল কল্পনায় বিকৃত করে দেখিনি। কিন্তু এই সমস্ত ব্যবহারের মাঝখান দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আমার মন যুক্ত হয়ে চলে গেছে সেইখানে, যেখানে সৃষ্টি গেছে সৃষ্টির অতীতে। এই যোগে সার্থক হয়েছে আমার জীবন। (আত্মপরিচয়)।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে সত্যই প্রতিভাসুলভ কোনো উচ্ছলতা কিংবা বৈচিত্র্য নেই। সেদিক দিয়ে তার নিতান্ত সাধারণ জীবন। ব্যারিস্টার হবার চেষ্টা, জমিদারি কাজে নিষ্ঠা, ব্যবসায়ে প্রবণতা, সমিতির কর্মে আগ্রহ, শিক্ষকতায় ও স্কুল পরিচালনায় উৎসাহ, গার্হস্থ্য কর্তব্যে প্রযত্ন প্রভৃতি তার বৈষয়িক জীবন-নিষ্ঠার পরিচায়ক–প্রতিভার সাক্ষ্য নয়। এমনকি প্রেমের ব্যপারে তার চিত্ত বিভ্রান্তির পরিচয়ও দুর্লভ। যদিও তিনি বলেছেন, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি। (রবীন্দ্র জীবনকথা, পৃ. ২৬)। অতএব তিনি প্রতিভা-দুর্লভ অসামান্য স্থিতধী এবং আত্মিক শক্তিসম্পন্ন ছিলেন, এমন অবলীলায় আত্মনিয়ন্ত্রণের নজির প্রতিভাবানদের চরিত্রে দুর্লক্ষ্য। কাজেই রবীন্দ্রনাথের ভাবের জীবনে ও বাস্তব জীবনে সুস্পষ্ট সীমারেখা ছিল। একটি অপরটিকে কখনো লঙ্ঘন করেনি, করেনি আচ্ছন্ন।

.

০৬.

স্বাজাত্য ও স্বাদেশিকতার নির্মোক মুক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৌন্দর্যবুদ্ধি-প্রসূত বিশ্বচেতনা দিয়ে তাঁর কাব্যজগৎ যেমন রচনা করেছিলেন, তেমনি করে তার ব্যবহারিক ভুবন নির্মাণে মনোনিবেশ করলেন। বিশ্বপ্রকৃতিতে তিনি বৈচিত্র্যের মধ্যে যে-ঐক্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, মানব-জগতেও পেলেন সে-তত্ত্বের সন্ধান। যে-তত্ত্বচিন্তা প্রকৃতির মধ্যে কল্যাণচিহ্ন ও সুষম সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছিল, সে-তত্ত্ববুদ্ধিই দ্বন্দ্ব-সংঘাত-স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও মানুষের একত্বে ও একাত্মতায় বিশ্বাস রাখতে অনুপ্রাণিত করেছিল; এ অভিন্ন সত্তাবোধে উৎসাহিত হয়েই তিনি বিশ্বমানব ঐক্যে আস্থা রেখেছিলেন। অবশিষ্ট জীবনে তাঁর চিন্তা ও কর্ম এ-বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। একালে ঔপনিষদিক বিশ্বচিন্তা আর গৌতমবুদ্ধের করুণা ও মৈত্রীতত্ত্ব তাঁকে বিশেষ করে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ বোধের অঞ্জন চোখে মেখেই তিনি প্রাচীন ভারতের দিকে তাকিয়েছিলেন, ফলে সেকালের সমাজে দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-দ্রোহ কিছুই তার চোখে পড়েনি; তিনি দেখেছেন বহুত্বেও একের অবয়ব, স্বাতন্ত্রেও সামঞ্জস্য, শ্ৰেণীসমন্বিত ও বর্ণেবিন্যস্ত সমাজে প্রীতিপ্রসূত কর্তব্য ও দায়িত্ব-সচেতন ব্যষ্টি। তার এ দৃষ্টিতে ইতিহাস চেতনা নেই, কিন্তু সৌন্দর্যবুদ্ধিজাত আদর্শিক প্রেরণা আছে। তার মতে :

‘আসল কথা, মানুষের ইতিহাসে মানুষের মনটা সবচেয়ে বড় জিনিস (মনস্তত্ত্বমূলক ইতিহাস), ইতিহাস কেবলমাত্র তথ্যের ইতিহাস নহে, তাহা মানব-মনের ইতিহাস, বিশ্বাসের ইতিহাস’ (ঐতিহাসিক চিত্র)। ‘ইতিহাস কেবল জ্ঞান নহে, কল্পনার দ্বারা গ্রহণ করলে তবেই তাহাকে যথার্থভাবে পাওয়া যায়’ (ইতিহাস কথা)।

আজকের ভারতের রাষ্ট্ৰিক Secularism-এ এ-বোধের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। এ বোধই প্রবর্তিত ও প্রচারিত আচারিক ধর্মের প্রতি তাঁকে বীতরাগ করেছে; মানুষের ধর্ম বলতে তিনি বুঝেছেন মানুষের চিত্তোথিত কল্যাণবুদ্ধি ও আত্মাজ প্রীতি– যে-প্রীতি চরাচরের সবকিছুকে আপন বলে গ্রহণ করতে প্রেরণা দেয়, যে-প্রীতি কর্তব্য ও দায়িত্ববুদ্ধি জাগিয়ে রাখে।

অদ্বৈতবাদী তথা বিশ্ব-ঐক্যে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের এসব মৌলিক চিন্তা। এ চিন্তা থেকেই তাঁর স্বাদেশিকতা বিশ্বচিন্তায় এবং তার জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতায় পরিণত, আর ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিশ্বভারতীতে উন্নীত। এজন্যেই দেশের স্বাধীনতার চেয়ে সমাজ-গঠনকে তিনি জরুরি ভেবেছেন, সরকারি সাহায্যের চেয়ে আত্মশক্তির প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন, আর ঐশ্বর্যের চেয়ে মর্যাদাবোধের এবং সচ্ছলতার চেয়ে সতোর দাম তার কাছে বেশি ছিল। এজন্যেই খেলাফত আন্দোলনকালে গোঁজামিলে হিন্দু-মুসলিম মিলন প্রতিষ্ঠার নিন্দা করেছেন তিনি, গান্ধীর যন্ত্র ও যন্ত্রশিল্প-বিমুখতা পছন্দ করেননি, পারেননি য়ুরোপীয় শিক্ষা বর্জনে সায় দিতে। কেননা য়ুরোপের রেনেসাঁসের দানকে তিনি মানব-নির্বিশেষের জন্যে আশীর্বাদ বলে মনে করতেন, একে গ্রহণ করেছিলেন মানুষ অবিশেষের ঐতিহ্য বলে। একে মানুষের আত্মার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে জানতেন ও মানতেন। তাই আধুনিক য়ুরোপ ও ঔপনিষদিক ভারত তার মন হরণ করেছিল।

ফাঁকির দ্বারা কোনো ফাঁক পূরণ ছিল তাঁর আদর্শ-বিরোধী। কেননা তিনি গৌতমবুদ্ধের মতো কারণ নিরূপণ ও উপায় নির্ধারণ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, অর্থাৎ যে-কোনো কিছু গোড়া থেকেই শুরু করতে হবে। এটি তার সেই সৌন্দবুদ্ধিজাত ঐক্যতত্ত্বেরই প্রভাবের ফল। তাঁর শেষজীবনে ইতিহাস-চেতনা, বিজ্ঞানবুদ্ধি, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা প্রবল হয়। এখানেও তিনি সমাধান খুঁজেছেন। সৌন্দর্যবুদ্ধিপ্রসূত একত্ব ও একাত্মতত্ত্বে তথা বিশ্বজনীনবোধের স্বীকৃতিতে। অতএব এখানেও তিনি অধ্যাত্মবাদী ও অদ্বৈতবাদী। তাই কামনা করেছেন মহামানবের আবির্ভাব, মিশু-বুদ্ধের মতো প্রেম ও মৈত্রীবাদীর নেতৃত্ব। তাঁর এ অধ্যাত্মবুদ্ধি বিজ্ঞান-বর্জিত নয়। তাই ঔপনিষদিক জ্যোতির্মান পুরুষস্বরূপ সবিতা আর বিজ্ঞানীর জগৎ-কারণ সূর্য তাঁর চিন্তায় অভিন্ন হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবনের শেষ দশকের রচনা তাই সবিতা-কেন্দ্রী। তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানবুদ্ধি ও ইতিহাস-চেতনা এখানে প্রজ্ঞার স্তরে উন্নীত; এই প্রজ্ঞার আলোকে তিনি সমাধান খুঁজেছেন বর্তমানের বিশ্বমানব সমস্যার।

রবীন্দ্রজীবনের অন্তিম মুহূর্তে বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের মরণ কামড় আবার শুরু হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রবাদ প্রসার লাভ করেছে। ধনিক সভ্যতার অবসান-প্রায় সোনার যুগে তার আবির্ভাব আর সমাজতন্ত্রের বিকাশ মুহূর্তে তার তিরোভাব–তাই ইতিহাস ও বিজ্ঞান-সচেতন না হয়ে পারেননি তিনি।

তাঁর ধারণায় : যেখানে symmetry, harmony ও symphony নেই, সেখানে সত্যও নেই। সত্য ও কল্যাণের পথ দুরূহ কিন্তু গন্তব্য নিশ্চিত শান্তির। সত্য যে কঠিন–সে কখনো করে না বঞ্চনা।

কিন্তু সাধারণ লোক যতটা আপাত-প্রয়োজন-সচেতন, ততটা দূরদর্শী নয়–আশু ফল প্রাপ্তিই তাদের লক্ষ্য। এ কারণেই কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্যে তিনি যা-কিছু করেছেন ও করতে চেয়েছেন, তা কৃষকদের মধ্যেও সমাদৃত হয়নি। তাঁর রাজনৈতিক মতও উপহাস পেয়েছে, তার সমাজচিন্তা পেয়েছে অবহেলা।

.

০৭.

আজকের দিনে কে না স্বীকার করে যে, খণ্ড-ক্ষুদ্র হয়ে এ-যুগে কেউ বাঁচতে পারে না। বাঁচবার পক্ষে সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য-ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র সম্বন্ধে এ সত্য সমভাবে প্রযোজ্য। জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে যৌথ রাষ্ট্রব্যবস্থা অবধি সংহতি ও সহযোগিতা লক্ষ্যে গঠিত অসংখ্য সংস্থায় দুনিয়া ভরে গেছে। এ তো সেই বিশ্বানুভূতিরই ফল–সেই বৈচিত্র্যে ঐক্য সন্ধানের, স্বাতন্ত্রে সমন্বয় সাধন প্রয়াসের ও সর্বমানবিকবাদের স্বীকৃতি। অথচ অর্ধশতাব্দী আগে এ তত্ত্ব উচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথ উপহাসই পেয়েছেন। একটি মহাযুদ্ধের তুর্যধ্বনিতে আজ যুগারম্ভের দ্বার খুলেছে।… মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্বন্ধ এক মহাদেশে ব্যাপ্ত, তার মধ্যে সত্যের সামঞ্জস্য যতক্ষণ না ঘটবে ততক্ষণ এই কারণের নিবৃত্তি হবে না। এখন থেকে যে-কোনো জাত নিজের দেশকে একান্ত স্বতন্ত্র করে দেখবে, বর্তমান যুগের সঙ্গে তার বিরোধ ঘটবে, সে কিছুতেই শান্তি পাবে না। এখন থেকে প্রত্যেক দেশকে নিজের জন্যে যে-চিন্তা করতে হবে, সে-চিন্তার ক্ষেত্র হবে জগৎজোড়া। চিত্তের এই বিশ্বমুখী বৃত্তির চর্চা করাই বর্তমান যুগের শিক্ষার সাধনা। (সত্যের . আহ্বান)।

অতীতে আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিত্বকে মনীষা আর মনীষাকে কবিত্ব বলে জেনেছি। তাঁর বিশ্বচেতনা ও অদ্বৈতবোধ Mysticism বলে অবহেলা পেয়েছে আমাদের। তার যুগচেতনা ও যুগসমস্যার সমাধান প্রয়াস কবির স্বাপ্নিক-কাক্ষা বলে হয়েছে উপেক্ষিত। ফলে রবীন্দ্রচিন্তা তাঁর স্বদেশেও গুরুত্ব পায়নি।

আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, নানা বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তাঁর ঔপনিষদিক বসুবৈধ কুটুম্বকম-বাদ আজকের দুনিয়ায় কবি-কল্পিত তত্ত্বমাত্র নয়, অতি গুরুতর তথ্য এবং মানবজীবনের নিরেট সত্য। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের সেই মানবতা, সর্বমানবিকতা বা বিশ্বজনীনতা ও সেই মৈত্রীধর্ম আজ জয়ের পথে, দেখতে পাই।

.

০৮.

পৃথিবীর কোনো একক ব্যক্তির রচনার এমন বিপুল ও বিচিত্র বিস্তার আর দেখা যায়নি। এমন সর্বতোমুখী ও সর্বত্রগামী ভাব-চিন্তা-কর্মও অদৃষ্টপূর্ব। অবশ্য গল্পে-উপন্যাসে-নাটকে-প্রবন্ধে তার সমকক্ষ কিংবা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখক য়ুরোপখণ্ডে বিরল নয়, কিন্তু কাব্যজগতে বিশেষ করে গীতিকবিতার ও গানের ভুবনে তার তুলনা বিরল। অনুভূতির সূক্ষ্মতায়, বৈচিত্র্যে, চিত্রায়ণে, মাধুর্যে, তাৎপর্যে, উৎকর্ষে আর অনেকতায় তাঁর গান ও গীতিকবিতা প্রায়-অনুপম। তাঁর স্বভাষী তার কাছে পেয়েছে সৌন্দর্য দেখার চোখ, সুরুচির পাঠ, মানবতার বোধ ও বিশ্বজনীনতায় দীক্ষা। তার কাছে পেয়েছে তারা মুখের ভাষা, কণ্ঠের সুর, প্রাণের প্রীতি, চরিত্রের দার্ট, আত্মসম্মান বোধ, আনন্দের কাক্ষা ও জীবনে প্রত্যয়। আজকের সংস্কৃতিবান মানবতাবাদী বাঙালি মাত্রই রবীন্দ্রনাথের মানস সন্তান।