মধুসূদনের অন্তর্লোক

মধুসূদনের অন্তর্লোক

মধুসূদন আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে এক আশ্চর্য জ্যোতিষ্ক। উনিশ শতকের দ্বিতীয় পদে তাঁর জন্ম। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব সে শতকের তৃতীয় পদে। ভৌগোলিক হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানেরই সন্তান।

ধনী ও মানী রাজনারায়ণ মুন্সীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন আজন্ম সর্বপ্রকার প্রশ্রয়ে লালিত। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দম্ভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছোটকে তুচ্ছ করা আর বড়র বন্দনা করা ছিল তাঁর স্বভাবজ। জীবনে ও মননে ছিল তাঁর বিলাসপ্রবণতা ও আভিজাত্য। ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতাকে তিনি আবাল্য এড়িয়ে চলতেন। এটি তাঁর জীবনে আদর্শ ও লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। ধন, যশ ও মানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁর জীবনের শুরু। আর এ তিনটের সাধনায় ও সন্ধানে তার জীবন অবসিত! ধনী, মানী ও জীবনবিলাসী বুর্জোয়া ইংরেজ ছিল তাঁর আদর্শ। ইংল্যান্ড ছিল তাঁর স্বপ্নের জগৎ–আকাক্ষার স্বর্গলোক। তাই ধনী, মানী ও যশস্বী হবার বাসনায় কৈশোরেই বরণ করলেন খ্রীস্টধর্ম, শিখলেন ইংরেজি, হতে চাইলেন ইংরেজ কবি। ফলে যা কিছু দেশী তা পেল তার তাচ্ছিল্য এবং যে-কিছু য়ুরোপীয় তা হল তাঁর বন্দ্য। বিয়ে করলেন য়ুরোপীয় মহিলা, পোশাক পরলেন য়ুরোপীয়, বাসা নিলেন সাহেব পাড়ায়, মদ খেলেন তাও সাহেবের মতো। কিন্তু কোনোটাই তার উচ্ছলতা জাত নয়, জীবন রচনার ও সাধনায় সিদ্ধির অবলম্বন মাত্র। এজন্যেই মধুসূদনের প্রতি আমাদের অবজ্ঞা নেই, রয়েছে গাঢ় মমতা ও সহানুভূতি।

আজীবন মধুসূদন ছিলেন এক স্বাস্থ্যবান প্রাণধর্মী দুরন্ত শিশু। শিশুর মতোই তিনি প্রাণধর্মের প্রেরণায় চালিত হয়েছেন, হৃদয়াবেগই তাঁর সম্বল। সে-আবেগ তাঁকে সংকল্পে দৃঢ়তা এবং লক্ষ্যে অটলতা দিয়েছিল, তাই প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতে তার আস্থা ছিল না। ধন উপার্জনের জন্যে সে-যুগের সর্বোচ্চ যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন–ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, কবি হয়ে যশ লাভ করবার জন্যে সে-যুগের শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলোর সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। মধুসূদনের মতো বহুভাষাজ্ঞ সাহিত্যপাঠক এদেশে আজো দুর্লভ। আর কলকাতার সম্ভ্রান্ত উকিল ধনী রাজনারায়ণের যোগ্য ছেলে বিদ্বান ও ব্যারিস্টার এম. এম. ডাট-এর সম্মানে ছিল সহজ-অধিকার।

কিন্তু জীবৎকালে ধন, যশ ও মান কোনোটাই মধুসূদনের ভাগ্যে জোটেনি। এত বড় বিড়ম্বনা মানুষের জীবনে বেশি দেখা যায় না। ধন তিনি উপার্জন করেছিলেন কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না; যশ তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু তা আশানুরূপ ছিল না; আর তাঁর প্রাপ্য সম্মানও তিনি পাননি। রোজগার করতে চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ, তার হাজারে হাজারেও হয়নি। হতে চেয়েছিলেন ভুবন-বন্দ্য ইরেজি কবি, হলেন স্বল্পপ্রশংসিত বাঙলা-কবি। আশা করেছিলেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতাপ, কিন্তু রইলেন সমাজচ্যুত হয়ে। জীবকালে বাঁচার মতো বাঁচতে পারেননি, মরে হলেন অমর।

মধুসূদনের এই চরিত্র, এই আকাঙ্ক্ষা ও হতবাঞ্ছই তার সৃষ্ট-সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত। যে-পার্থিব জীবনপ্রীতি মধুসূদন-চিত্তে চাঞ্চল্য, আবেগ ও জ্বালা সৃষ্টি করেছিল, সেই চাঞ্চল্য ও আবেগ, ভাগেচ্ছা ও হতবাঞ্ছার যন্ত্রণাই মধুসূদনের কাব্য-নাটকে অভিব্যক্তি পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর প্রত্যেকটিই জীবনবাদী, ভোগপ্রিয়, আবেগপ্রবণ ও হতবার বেদনায় কাতর ও দিশাহারা। সেখানে রূপানুরাগী সুন্দ-উপসুন্দ নারীর রূপবহ্নিতে আত্মাহুতি দেয়, ভীমসিংহ কন্যার জীবনের বিনিময়ে রাজ্যভোগ করতে চায় এবং পুত্রের বিক্রমগবী রাবণ হতমান হয়ে হাহাকার করে, পুত্র-গর্বিত চিত্রাঙ্গদা পাগল হয়, পতি-গর্বিতা সীতা রোদন করে, স্বামী-সোহাগিনী প্রমীলা সহমরণেও গর্ববোধ করে, বলবীর্যগর্বী ইন্দ্রজিতের জীবনও ক্ষোভে-অপমানে অবসিত হয়। সেখানে কৈকেয়ী-জনা-দ্রৌপদী হতবাঞ্ছার ক্ষোভে-জ্বালায় আগুন ছড়াতে চায়, অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তারা-সুর্পণখা হৃদয়ের আবেগে বিচলিত ও তার জন্যে লাঞ্ছিত। তার গোপবালা অতৃপ্ত বাসনার বেদনায় ব্যাকুল। শর্মিষ্ঠা-পদ্মাবতীও প্রমূর্ত আবেগ। তাঁর Captive lady-ও বন্দী আত্মার কান্না। তার সনেটগুলোতেও একটি বেদনাবোধ–একটি দীর্ঘশ্বাস যেন প্রচ্ছন্ন।

বেদনাহত নির্যাতিত মানবাত্মার যন্ত্রণা ও কান্নাই মহৎ সাহিত্যের অবলম্বন। মধুসূদনের কবি মনে এ সত্যটি সহজেই ধরা দিয়েছিল। কোথাও তাই তাঁর কবিদৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত জীবনে ক্ষোভ, হতবাঞ্ছার কান্না, নির্যাতিতের যন্ত্রণা, নির্দোষের লাঞ্ছনা প্রভৃতিকেই মধুসূদন তাঁর রচনার অবলম্বন করেছিলেন। অতএব, মহৎ শিল্পের কোনো উপকরণেই তাঁর অবহেলা ছিল না। বলেছি, মধুসূদনের নিজের জীবনও ছিল একটি প্রমূর্ত কান্না একটি প্রচণ্ড হাহাকার–তাঁর আত্মবিলাপে তাঁর অন্তরাত্মারই আর্তনাদ শুনতে পাই,আত্মবিলাপ কবিতাটিই তাঁর আত্মজীবনী।

তাঁর জীবনবোধ ও জগৎ-চেতনায় ছিল গ্রীক নিয়তিবাদের ও পুরুষকারের দ্বান্দ্বিক প্রভাব। তাই গ্রীক-ট্র্যাজেডির ভাব-সত্য যেমন তিনি গ্রহণ করেছেন, তেমনি Paradise Lost-এর শয়তানের স্বাতন্ত্রবুদ্ধি ও মর্যাদাবোধজাত দ্রোহকেও অভিনন্দিত করেছেন, অনুগতের শান্ত-নিশ্চিন্ত জীবনের চেয়ে দ্রোহী জীবনের মহিমময় পরাজয় এবং মহৎ-মৃত্যু তাঁর কাম্য ছিল।

আমাদের সৃজনশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদনই প্রতীচ্যের প্রথম চিত্তদূত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের য়ুরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিই ছিল তাঁর অনুধ্যানের বিষয়। তিনি ছিলেন grand and Sublime-এর অনুরাগী। grandeur ও grandoise উনিশ শতকী য়ুরোপে ছিল বিরল, তাই তাঁর মানস-পরিক্রমের ক্ষেত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগেই রইল সীমিত। আধুনিক য়ুরোপ কিংবা ভারত তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।

তবু য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব তার মধ্যেও দেখি—-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতিপ্রেম, স্বদেশপ্রীতি, পুরুষকারে আস্থা; ঐহিক জীবনবাদ, বিদ্রোহানুরাগ, ব্যক্তিসত্তায় ও মানবপ্রীতিতে গুরুত্ব এবং হৃদয়াবেগে মর‍্যা দান প্রভৃতি তাঁরও রচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। ফলে আঙ্গিকে তিনি ক্লাসিক হলেও প্রেরণায় পুরোপুরি রোমান্টিক। আমরা জানি, মধুসূদন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংরেজিতে কাব্যরচনা করে অমর হবার বাসনায়। বাজি রেখে বাঙলা রচনায় হাত দিলেন, এজন্যে তার প্রস্তুতি ছিল না। সে বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। বাঙালিকেও জিইয়ে ছিলেন নিস্পন্দ ধড়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে বাঙলার সমাজে ও সাহিত্যে, মননে ও মেজাজে মধুসূদনই প্রথম সার্থক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী, পথিকৃৎ ও যুগস্রষ্টা। ভাবে ও ভাষায়, ভঙ্গিতে ও ছন্দে এবং রূপে ও রসে অপরূপ করে তিনি নতুন জীবন ও জগতের পরিচয় করিয়ে দিলেন বাঙালির সঙ্গে। এ দক্ষতা সেদিন আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি, যদিও ইংরেজি শিক্ষিত গুণী-জ্ঞানীর সংখ্যা নেহাত নগণ্য ছিল না সেদিনকার কলকাতায়।

মধুসূদনের জন্মের আগে থেকেই য়ুরোপে এবং তাঁর সমকালে এদেশেও শিক্ষিত সমাজে বিজ্ঞানবুদ্ধির প্রভাবে জীবনবোধ ও জগৎচেতনা দ্রুত রূপান্তর লাভ করছিল। এজন্যে মধুসূদনের প্রভাব বাঙলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিশেষ করে তার সমকালীন য়ুরেপীয় জীবনচেতনার স্বরূপ তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। এ-যুগের মর্মবাণী গীতিকবিতায় অভিব্যক্তি পেয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারেননি–তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষ।

তবু আমাদের দেশে তিনি নতুনের বাণীবাহক, নতুনের ধ্বজাধারী যুগস্রষ্টা চিন্তানায়ক। আমরা তাঁকে ভুলিনি, ভুলতে পারবও না। জয়তু মধুসূদন!