জাতিবৈর ও বাঙলা সাহিত্য

জাতিবৈর ও বাঙলা সাহিত্য

আদিম মানুষের মন-বুদ্ধির বিকাশের ফলে তাদের মধ্যে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই প্রয়োজন-বুদ্ধিই তাদের সংহতি দান করে। সেদিনকার হাতিয়ার-বিরল অজ্ঞ মানুষ জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সংহতি ও সহযোগিতার মধ্যেই সন্ধান পায় নতুন শক্তির ও সম্ভাবনার। স্বনির্ভর অসহায় জীবনে এভাবে নতুন ভরসা ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে প্রসারিত জীবন সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হল মানুষ।

তখন জনসংখ্যা ছিল কম। পৃথিবী ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। মানুষের জীবন ছিল অঞ্চলের সীমায় আবদ্ধ। এভাবে তাদের এক একটি দল নিজেদের খণ্ড ক্ষুদ্র জগতে যাপন করত স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর জীবন। কুলপতিই ছিল তাদের নেতা–শাসন-পোষণ ও দণ্ডমুণ্ডের মালিক—-ভয়-ভরসার আকর।

এই গোত্রীয় সংহতি এককালে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের ছিল শ্রেষ্ঠ উপায়। তারপর ক্রমে বেড়ে গেছে জনসংখ্যা। জীবনবোধ হয়েছে প্রসারিত। প্রয়োজন গেছে বেড়ে। জীবিকা হয়েছে দুর্লভ। প্রয়োজনের তাগিদে তখন অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করতে শিখেছে মানুষ। তখন গোত্রে গোত্রে জীবিকার অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হল শুরু। কেননা তখনও জাগেনি গোত্রীয় সহঅবস্থান এবং সহযোগিতার সুবিধা ও সুফলের চেতনা। কাজেই অন্য গোত্রের প্রতি বিরূপতা ও বিমুখতা এবং বিগ্রহই আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের একমাত্র উপায় বলে হত বিবেচিত। অনেক কাল হল সেই গোত্রীয় গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তার ঠাই নিয়েছে ধর্মীয় সম্প্রদায়। স্বাধৰ্ম গোত্রীয় চেতনারই আর এক রূপ। তাই গৌত্রিক বিরোধ-বিদ্বেষের ঠাঁই নিয়েছে ধর্মমতবাদীর বিরোধ, বিদ্বেষ ও স্বাতন্ত্র চেতনায়। এজন্যে আজো মানুষের সেই আদিম মনোভাবের ও জীবন-চেতনার পরিবর্তন দুর্লক্ষ্য। ধর্মীয় ঐক্য সংহতি দেয় আর অনৈক্য বিরোধ ও হানাহানি ঘটায়–এ-ই হচ্ছে মানুষের কয়েক হাজার বছরের ব্যবহারিক জীবনের ইতিহাসের সারকথা। কাজেই পাক-ভারতের হিন্দু-মুসলানের সম্পর্কের ইতিহাসও স্বতন্ত্র হতে পারেনি। তার উপর সম্পর্কটি বিজিত-বিজেতার বলেই বিদ্বেষ বিরূপতাও ছিল তীব্রতর।

বাঙলা দেশেও হিন্দু-মুসলমানে যে আন্তরিক সম্প্রীতি ছিল না, তার প্রমাণ রয়েছে বাঙলা সাহিত্যে। এতে কিন্তু অস্বাভাবিক বা নিন্দনীয় কিছু দেখতে পাইনে আমরা। কেননা সাধারণ মানুষের জীবন চিরকালই ধর্ম নিয়ন্ত্রিত। ধর্ম হচ্ছে সাধারণের জন্যে বিধি-নিষেধের সমষ্টি; ইহলোকে পরলোকে প্রসারিত জীবনের দিশারী। স্থূলবুদ্ধি ও অজ্ঞ সাধারণ মানুষ যুক্তি ও চেতনা দিয়ে জীবনোপভোগ করে না–লব্ধ নিয়ম-নীতির অনুসরণেই সে যাপন করে জীবন। বিধি নিষেধের বেড়ার সীমিত পরিসরে বিবেক-বুদ্ধিকে সে-সব নীতির অনুগত রেখে সে থাকে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত। সে হয়ে উঠে পোষমানা প্রাণী–তার জীবনও তাই যান্ত্রিক। সেজন্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে ধার্মিক তথা আস্তিক মানুষের একটিমাত্র মতই আছে–তা হচ্ছে ধর্মমত। ধর্ম তার ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে কল্যাণ ও শ্রেয়সের উৎস। এর বাইরে কোনো ভাল থাকতে পারে কিংবা তার ধর্মবিধানে কোনো ত্রুটি থাকা সম্ভব, তা সে ভাবতেও পারে না। এমনকি তা ভাবা পাপও। যেহেতু মানুষের ধর্মবুদ্ধি গোত্রীয় সংহতি ও কল্যাণ চেতনায় আচ্ছন্ন, সেহেতু ভিন্ন ধর্মের লোককে সে পর ও শত্রু না ভেবেই পারে না। এবং শক্রর প্রতি প্রীতি কেবল আত্মধ্বংসী অকল্যাণই যে আনে তা নয়, সে-কারণে স্বধর্মে নিষ্ঠাহীনতার পাপও স্পর্শ করে। তাই পরধর্ম ও বিধর্মী বিদ্বেষ বা ঘৃণাই ধার্মিক মানুষের স্বধর্ম নিষ্ঠার এবং আদর্শজীবনের লক্ষণ। এজন্যেই সাধারণত ধার্মিকেরা গোড়া, অনুদার ও বিবেক-বুদ্ধিহীন। স্বাধীন চিন্তা, উদার দৃষ্টি ও নিরপেক্ষ বিচার-বুদ্ধি কিংবা বিশুদ্ধ মানবতাবোধ জন্মাতেই পারে না তাদের রুদ্ধদ্বার মনে।

বাঙলা সাহিত্যেও তাই দেখতে পাই, ধার্মিক মানুষেরাই বিধর্ম ও বিধর্মী বিদ্বেষী। এক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকদের সমভাবেই উৎসাহী দেখি। মধ্যযুগে নিরঞ্জনের রুম্মাতেই প্রথম বৌদ্ধ-হিন্দুর বিদ্বিষ্ট সম্পর্কের সংবাদ পাই। বিজয়গুপ্ত প্রভৃতির মনসামঙ্গলে, বৃন্দাবনদাস, জয়ানন্দ, লোচনদাস প্রভৃতির চৈতন্যচরিত গ্রন্থে, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, কৃষ্ণরামের অন্নদামঙ্গলে, সহদেব চক্রবর্তীর অনিল পুরাণ প্রভৃতিতে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। আবার জায়নুদ্দীনের রসুলবিজয়ে, শাবারিদ খানের রসুলবিজয়ে ও হানিফার দিগ্বিজয়ে, সৈয়দ সুলতানের জয়কুম রাজার লড়াই-এ, গরীবুল্লাহর সোনাভানে, সৈয়দ হামজার জৈগুনের কিস্সাতে এবং কোনো কোনো পীরপাচালীতে হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর, কাফের ও পৌত্তলিকতার প্রতি অবজ্ঞা অসৌজন্য সুপ্রকট।

আধুনিক কালে প্যারীচাঁদ মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, যোগীন্দ্রনাথ বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ অনেকের রচনায় যেমন মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ (অমিয় ধারার তিনটে কবিতায় অশ্লীল ভাষায় হিন্দুর নিন্দা করা হয়েছে), ইসমাইল হোসেন শিরাজী, ডাক্তার আবুল হোসেন, শেখ ইদরিস আলী প্রভৃতির রচনায় হিন্দু বিদ্বেষ সুপ্রকট। এছাড়া প্রায় সব হিন্দু ও মুসলমান লেখকের রচনায় প্রতিবেশী বিধর্মীর প্রতি কটাক্ষ, অশ্রদ্ধা কিংবা অবহেলা দৃশ্যমান।

এসব লেখকদের কেউ নাস্তিক নন, তাঁরা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী। তাঁদের জীবন গোত্রীয় সংহতি চেতনার আধুনিক রূপান্তর ধর্মীয় ঐক্যবোধে নিয়ন্ত্রিত। তাই বাঙালি হিন্দু প্রেরণা খুঁজেছে উত্তর ভারতের আর্য ও রাজপুত ঐতিহ্যে এবং বাঙালি মুসলমানের প্রেরণার উৎস হয়েছে আরব ইরানীর ঐতিহ্য। দেশগত জীবন ও ঐতিহ্য বিশেষ শ্রদ্ধা পায়নি কারো। এই মনে বিধর্মী-বিদ্বেষ না থেকেই পারে না, কেননা তাদের স্বাজাত্য দেশগত নয়, ধর্মগত। কাজেই তাদের স্বাজাত্য স্বাধর্মেরই নামান্তর। মনের দিক দিয়ে কোনো আস্তিক মানুষই স্বাধীন ও স্বস্থ নয়। তাই বিবেক, বুদ্ধি ও বিচারশক্তির স্বাধীন ও যৌক্তিক তথা নিরপেক্ষ মানবিক প্রয়োগ তাদের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই এঁদের এই মানস অভিব্যক্তির মধ্যে নিন্দনীয় কিছু নেই–মোহপাশবদ্ধ মানুষের আত্মিক অপমৃত্যুর জন্যে আমরা কেবল বেদনাবোধ করতে পারি, তাদের জড় বিবেকে চেতনা সঞ্চারের চেষ্টাও হয়তো করা সম্ভব, কিন্তু সাফল্যের আশা সামান্য। গোত্রীয় উত্তন্মন্যতা, ধর্মীয় জাতীয়তা, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা কিংবা আধুনিক মতবাদ প্রসূত ঐক্যবোধ তথা গোষ্ঠী-চেতনা আজ বিশ্বমানবের স্বস্তি ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে এক মারাত্মক হুমকি। আজ পৃথিবীব্যাপী এ সমস্যা দুষ্ট ক্ষতের মতো বিরাজমান। বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্র-চেতনা এই তিনটেই মানবিকতা ও মানবতার দুশমন। আজকের দুনিয়াব্যাপী খুনোখুনি ও কাড়াকাড়ির মূল কারণ। অধিকাংশ মানুষ এই বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্যবোধের ঊর্ধ্বে না উঠলে অর্থাৎ এসব ব্যাপারে স্বাতন্ত্র্যবোধ পরিহার না করলে অশান্তি ও বিপর্যয় থেকে আজকের পৃথিবীর মুক্তি নেই।

মানুষের এই শোচনীয় অবস্থায় সব দেশেই কিছু সংখ্যক মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিক, মানবতাবাদী ও মানবদরদী জ্ঞানী-মনীষী ও কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক কল্যাণের পথে, শ্রেয়সের দিকে, উদারতার খোলা প্রাঙ্গণে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন শান্তি, প্রীতি ও মানবতার নামে। কিন্তু তাদের প্রভাব দুর্লক্ষ্য।

সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে কেউ কেউ অনুযোগ করছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিবেশী মুসলমান সমাজকে অবহেলা করেছেন (এমনকি মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগও আছে)। শরৎচন্দ্র সম্বন্ধেও অনুরূপ কথা শোনা যায়। যারা এই নিন্দা উচ্চারণ করেন, তাঁরা কবি-সাহিত্যিক। তারাই আবার দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারক। তাহলে হিন্দুর কাছে তাঁরা এই দাবী করছেন কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এঁরা মুসলমানকে গালি দেননি, এটাই কি যথেষ্ট সৌজন্য ও উদারতা নয়? এদিকে তারা নিজেরা গত বিশ-ত্রিশ বছর ধরে হিন্দু-বিদ্বেষ প্রচার করেছেন। তাঁদের কোনো লেখায় হিন্দু-প্রীতি কিংবা সহিষ্ণুতার আভাস মাত্র নেই। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানীর শতকরা দশজন হিন্দুর নাগরিকত্ব তারা মুখে স্বীকার করেন বটে, কিন্তু ওদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক অধিকারও কার্যত অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই তাদের। নইলে ভাষা বদলাও, হরফ বদলাও, আরবি-ফারসি শব্দ বসাও কিংবা বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ বর্জন করো প্রভৃতি যখন তারা বলেন তখন তাঁরা দেশী হিন্দুর কথা ভাবেন না। সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে মুসলমানদের যা বর্জনীয়; হিন্দুর তাই বরণীয়। কাজেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিজের স্বার্থে অন্যের অধিকার হরণ কিংবা অন্যকে সমসুযোগ থেকে বঞ্চিত করা নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক অবিচার। আশ্চর্য, সর্বক্ষণ হিন্দু-বিদ্বেষ ও হিন্দুভীতি মনে পোষণ করেন যাঁরা, তাঁরাই রবীন্দ্রনাথের কাছে আশা করেছেন উদারতা ও প্রতিবেশীসুলভ প্রীতি, অথচ নিজেরা সে-উদারতা, সৌজন্য ও প্রীতির সুনশীলনে অনিচ্ছুক। মানুষের অবিবেচনারও একটা সীমা আছে। এ অনুযোগ যেন তাও অতিক্রম করছে। আমার বাড়ি যেতে কী নিয়ে যাবে আর তোমার বাড়ি গেলে কী খাওয়াবে-ন্যায়ের মতো এটিও একপেশে ন্যায়। রবীন্দ্রনাথেরা যে-ভুল ও অন্যায় করেছেন বলে তাঁরা মনে করেন, নিজেদের সে-ক্রটি থেকে মুক্ত রেখে ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে আদর্শ স্থাপন করাই ছিল তাদের কর্তব্য। কিন্তু সে-ঔচিত্যবোধের আভাস নেই তাঁদের চিন্তনে কিংবা বচনে।

আরো একটি অপযুক্তি তারা প্রয়োগ করে থাকেন। তারা বলেন নজরুল এ ব্যাপারে আদর্শ। তিনি অসূয়ামুক্ত থেকে হিন্দু-মুসলমান ও তাদের ঐতিহ্যকে সমভাবে ভালবেসেছেন। তারা ভুলে যান যে মুসলমানেরা দেশগত পরিবেষ্টনীর প্রভাব এড়াতে পারেননি, তাই মুসলমানমাত্রেরই রচনায় দেশীয় ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটেছে। মধ্যযুগ থেকে বিশ শতকের প্রথম পাদ অবধি মুসলমানদের রচনায় এ মিশ্রণ দৃশ্যমান। হিন্দুর দেশ ও ধর্ম অভিন্ন অঞ্চলের, তাই যা দেশী তা ধর্মীয়ও বটে। এইজন্যেই হিন্দুর রচনা পুরোপুরি হিন্দুয়ানী বলে চিহ্নিত করা যেমন সহজ; তেমনি কঠিন নয় মুসলিম মনের উদারতা ও গ্রহণশীলতা প্রমাণ করাও। উভয়েই ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে মানবতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও নজরুল ইসলামের অবচেতন উদারতার কারণ এই তত্ত্বেই নিহিত এবং রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির হিন্দুয়ানীর রহস্যও এ-ই। অতএব একের সৌজন্য ও উদারতা এবং অপরের সংকীর্ণচিত্ততা ও অনুদারতার সাক্ষ্য নয় এসব।

কাজেই আস্তিক মানুষের মধ্যে স্বধর্মনিষ্ঠ কেউ যদি প্রকাশে বিজাতি-বিদ্বেষ ব্যক্ত না করে থাকে–হোন না তিনি প্রতিবেশীর প্রতি অবহেলাপরায়ণ, তাহলেও তাকে উদার-হৃদয় সহিষ্ণু-সুজন বলে তারিফ করা উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *