অন্ন ও আনন্দ

অন্ন ও আনন্দ

ব্যুৎপত্তিগত তাৎপর্যে যা মানুষকে ধরে রাখে অথবা মানুষ যা ধরে বেঁচে থাকে তা-ই ধর্ম। দরাজ অর্থে সৃষ্টিমাত্রেরই ধর্ম রয়েছে। এই কারণে ধর্মের অপর অর্থ স্ব-ভাব। স্ব-ভাবও একপ্রকার বন্ধন, যা ছিন্ন করা অসম্ভব। আবার ধর্ম, দীন কিংবা Religion (< Religare) শব্দের মধ্যেও রয়েছে বন্ধনের ভাব। আধুনিক অর্থেও ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস-সংস্কার, নিয়ম-নীতি, আদর্শ ও পদ্ধতি, ব্যবহাররীতি ও চিন্তাভাবনার নিয়ন্ত্রণ-বিধির সমষ্টি। কাজেই যে-কোনো তাৎপর্যে ধর্ম মানুষকে ধরে রাখে–কিন্তু ভরেও যে তুলতে পারে–তা নিশ্চিত করে বলা চলে না।

অন্য জীব ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ধর্ম প্রাকৃতিক। কিন্তু মানুষের ধর্ম অনেকখানিই স্বসৃষ্ট। সে স্বেচ্ছায় নিয়মের শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধেছে যৌথজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার তাগিদে। এ তার অন্ন, প্রাণ, মন, জ্ঞান ও আনন্দের প্রয়োজনে নির্মিত। প্রাণ-মন-প্রজ্ঞা দিয়ে সে অন্ন ও আনন্দের সুব্যবস্থা করতে চেয়েছে, আবার এই অন্ন আর আনন্দই হয়েছে তার প্রাণ-মন ও প্রজ্ঞার পোষক। তাই উপনিষদ বলেশ্ৰহ্ম হচ্ছেন অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়। ঔপনিষদিক তাৎপর্যে জীবই ব্ৰহ্ম। কাজেই জীবনে প্রাণ, মন ও আনন্দের জন্যে চাই অন্ন। অন্ন উৎপাদনের জন্যে চাই জ্ঞান। পাঁচরুহ বা পঞ্চপ্রাণ তত্ত্বের উৎসবিন্দুতেও হয়তো রয়েছে এ বোধ। এ পঞ্চকোষের সমন্বয়ে মেলে পূর্ণাঙ্গ জীবন। এগুলোর ভারসাম্যে অভিব্যক্তি পায় সত্য ও সমগ্র সত্তা। এ লক্ষ্যেই চিরকাল পরিচালিত হয়েছে মানুষের চেতন ও অবচেতন প্রয়াস।

প্রাণ বাঁচানোর জন্যে অন্ন আর মন রক্ষার জন্যে আনন্দ–এ দুটোর সাধনাই মানুষের কর্ম ও চিন্তার ইতিহাস। মানুষ বাইরে লড়েছে অন্নের জন্যে আর ভেতরে সগ্রাম করেছে তত্ত্ব নিয়ে। জনসংখ্যা বর্ধিষ্ণু, জীবিকা ক্ষয়িষ্ণু– তাই তার সগ্রাম করতে হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, উদ্ভাবন করতে হয়েছে উৎপাদনের নতুন নতুন উপায়, কাড়তে হয়েছে অন্য মানুষের খাদ্য–বেড়েছে তার জ্ঞান-প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতা, ব্যাপক হয়েছে তার ভাব-চিন্তা-কর্ম। এভাবে একদিকে প্রকৃতির প্রায় সবকিছুর উপযোগ সৃষ্টি করে সে বৃদ্ধি করে চলেছে জীবন-জীবিকার উপকরণ; অন্যদিকে জীবিকার সু-উপভোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন-লক্ষ্যে সে তৎপর রয়েছে সমাজ-বিন্যাস চিন্তায়। একদিকে ক্রম সাফল্যে মৃগয়া ও ফলজীবী মানুষ আজ নভোচর, অন্যদিকে Totem-Taboo-Magic ছেড়ে Animist, Pagan ও Religious মানুষ আজ নাস্তিক–Anarchist.

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমবর্ধিষ্ণু জীবন-চেতনা মানুষকে প্রবর্তনা দিয়ে চলেছে নতুন ভাবনায়, মননে, কর্মে ও আবিষ্কারে। অন্ন ও আনন্দের অভাব মিটাতেই হয়। অতএব, মানুষের চলমানতার মূলে রয়েছে অন্বেষা। সে-অন্বেষা : অন্নের ও আনন্দের। আর এ দুটোর জন্যেই চলছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রাম, সৃষ্টি হচ্ছে ন্যায়-নীতি-নিয়ম, উচ্চারিত হচ্ছে সাম্য, করুণা ও মৈত্রীর বাণী, ধ্বনি উঠছে সহযোগিতা-সহ-অবস্থান ও সমদর্শিতার, গড়ে উঠছে জীবিকার রকমারি উপকরণ। এভাবে চলছে সমাধানের মানস ও ব্যবহারিক নানা প্রয়াস। আজ অবধি মানুষের যা কিছু সৃষ্টি ও নাশকতা; যা কিছু লজ্জা ও গৌরবের, যা কিছু চিন্তা ও কর্মে অভিব্যক্ত, তা এই অন্ন ও আনন্দ সংস্থানের জন্যেই।

এ প্রয়োজনের তাগিদেই দেশে দেশে নতুন ধর্মের উদ্ভব। চেতনা যার গভীর, সে-মানুষ সচেতনভাবে উপলব্ধি করে দেশ-কালের প্রয়োজন। তাই সে হয় পিতৃধর্মও সমাজ-দ্রোহী। পরিবর্তিত পরিবেশে মানুষের অন্ন ও আনন্দের চাহিদা মিটিয়ে সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব এই সংবেদনশীল মনীষীর। এমনি করে দেশ-কালের প্রয়োজনেই সেকালে হত নতুন নতুন ধর্মের উদ্ভব,–একালে যেমন হয় নতুন নতুন মত ও রীতি-পদ্ধতির প্রচলন।

কিন্তু দেশ-কালের প্রয়োজন-নিরপেক্ষ কোনো ধর্মের যে উদ্ভব হয়নি এবং কোনো ধর্মই যে, সর্বকালিক, সর্বদৈশিক কিংবা সর্বমানবিক হতে পারে না, ধর্মকে অপরিবর্তিতরূপে আঁকড়ে ধরে রাখলে, তা যে জীবনের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তার যুগোপযোগী সংস্কার কিংবা পরিবর্তন যে দরকার, তা সাধারণ লোক বোঝে না। তাই তারা মনে করে ধর্মনিষ্ঠা ও অধার্মিকতাই মানুষের ব্যক্তিক, সামাজিক, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রিক জীবনে উত্থান-পতনের একমাত্র কারণ। তাদের মতে, মানুষের সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে দুর্দিন ও সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন মানুষ অবহেলা করে ধর্মের বিধি-নিষেধ। সেন্ট অগাস্টাইন, ইবনে খলদুন থেকে শুরু করে আজকের দিনের অনেক ঐতিহাসিক, মনীষী এবং দেশনায়কও পোষণ করেন এ ধারণা।

অথচ এ ধারণা যে কত ভিত্তিহীন তা বলে শেষ করা যায় না। যেহেতু ধর্মমতের উদ্ভবের মূলে রয়েছে দেশ-কালের চাহিদা, সেজন্যে নতুন ধর্মমত মাত্রেই বিদ্রোহজাত এবং আঞ্চলিক মানুষের জীবন-জীবিকার তথা সমাজ-সমস্যার সমাধান। তাই অঞ্চল বহির্ভূত জগতে এ প্রচারিত হয়ে প্রসার লাভ করেছে বটে, কিন্তু মানুষের কোনো প্রয়োজন মিটিয়ে তার ব্যবহারিক কিংবা মানস জীবনে কোনো বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। যদিও ধর্মমাত্রেই তার উদ্ভবক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে জন্ম দেয় নতুন যুগের; চিত্তলোকে নতুন বোধ ও প্রেরণা জাগিয়ে মানুষকে করে কর্মপ্রবণ, দায়িত্ব-সচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ, আর করে বাহুবলে বলীয়ান, নৈতিক চেতনায় মহীয়ান, ব্যবহারিক সম্পদে ঐশ্বর্যবান এবং মানসজীবনে ঋদ্ধ।

হযরত মুসার পাপবোধ সেদিন হয়তো কেনানে-মিশরে মানুষকে পীড়নমুক্ত করেছিল, কিন্তু অন্যত্র তা প্রভাব ছড়ায়নি হয়তো সে-পরিবেশের অনুপস্থিতির দরুনই। ধনলির ক্রুর লোভ ও নিষ্ঠুর পীড়নপ্রবণতার বিরুদ্ধে লড়েছেন হযরত ঈসা। সেকালের প্যালেস্টাইনের সামাজিক পরিবেশে এ দ্রোহের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেশান্তরে রোমা খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেও রোধ করতে পারেনি তাদের পতন কিংবা য়ুরোপে কোনো অঞ্চলের মানুষেরই মানসোকর্ষের কারণ হয়নি যিশুর ধর্ম। এমনকি তা ব্যবহারিক জীবন-প্রয়াসের অথবা নৈতিকজীবন ও মানবিকবোধ বিকাশের সহায়ক হয়েছিল বলেও তেমন দাবী করা চলে না।

বর্ণে বিন্যস্ত সমাজে ব্রাহ্মণ্য পীড়ন-শোষণ থেকে নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করে মানুষের ব্যক্তিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী ছিলেন দেব-দ্বিজ-বেদ-দ্রোহী মহাত্মা বুদ্ধ ও বর্ধমান। তাঁদের বাণী বিপ্লব ঘটিয়েছিল উত্তরপূর্ব ভারতে। তাদের সাম্য, মৈত্রী ও করুণার বাণী সেদিন এ অঞ্চলের মানবিক সমস্যার সমাধান দিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের বাণী দেশান্তরে ভিন্ন পরিবেশে মানুষের মনের ও সমাজের রূপান্তর ঘটিয়ে কোনো নতুন যুগের সূচনা করেনি, মধ্য এশিয়ার রক্তপিপাসু শক-হূন-ইউচিদের চরিত্রে দেয়নি করুণা ও কোমলতার প্রলেপ কিংবা জীবন-রসিক চীনাদের করেনি বৈরাগ্যপ্রবণ।

একক স্রষ্টার নামে হযরত মুহম্মদের সাম্য ও ঐক্যের বাণী যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছিল মক্কা-মদিনায়। এই নবলব্ধ ঐক্য তাদের করেছিল অদম্য অপরাজেয় শক্তির অধিকারী। বন্যার বেগে তারা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। আত্মবিকাশ ও আত্মবিস্তারের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কিন্তু সিরিয়া-ইরাক-ইরানে কিংবা মিশরে-মরোক্কে অথবা মধ্য এশিয়ায় ও ভারতে দীক্ষিত মুসলিম জীবনে সে-প্রাণপ্রাচুর্য, সে-বৈষয়িক উন্নতি, সেই মনোবল কখনো দেখা যায় নি। উল্লেখ্য যে, তুর্কী মুঘলের আত্মপ্রসার ইসলামের দান নয়। শক-হন-ইউচি-মোঙ্গলের এই বংশধরেরা বেঁচে থাকার দায়েই বাহুবল ও মনোবল-সম্বল জীবনযাপন করত। এদের পূর্বপুরুষেরাই কোরআনের ইয়াজুজ মাজুজ, এদের ভয়েই গড়তে হয়েছে চীন-ককেসাসের প্রাচীর। তবু এদের কবল থেকে রক্ষা পায়নি চারদিককার জগৎ। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-আর্মেনিয়া-রাশিয়া-ভারত-চীন চিরকালই যুগিয়েছে এদের পিপাসার রক্ত আর উদরের অন্ন। অনুর্বর মধ্য এশিয়ায় যখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অথবা অনাবৃষ্টির জন্যে চারণভূমির ও খাদ্যবস্তুর অভাব ঘটেছে তখনই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে মরীয়া হয়ে। অনিবার্য আসন্ন মৃত্যু থেকে বাঁচবার গরজপ্রসূত বলেই এই অভিযানে তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য ও অপরাজেয়। কেননা, তারা জানত সামনে তাদের জীবন–পশ্চাতে মৃত্যু।

জীবনে-সমাজে-রাষ্ট্রে যখনই গ্লানি ও বিপর্যয় আসে, তখনই সাধারণ নায়কেরা মানুষকে স্বধর্মে তথা পিতৃপুরুষের ধর্মে নিষ্ঠ হতে উপদেশ দেন, তাঁদের মতে একমাত্র এ পথেই বিপন্মুক্তি সম্ভব। সবদেশে সবযুগেই সাধারণ মানুষের ধারণায় সঙ্কট উদ্ধারের এ-ই একমাত্র উপায়। তারা যদি নতুন ধর্মের প্রবর্তন চাইতেন, অন্তত গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করতেন, তা হলেই সুবুদ্ধির পরিচয় দিতেন। মোহগ্রস্ত চিত্তে পুরোনোই শ্রদ্ধেয়, নতুনমাত্রই অবেজ্ঞয় ও অনভিপ্রেত। অথচ তারা ভেবে দেখেন না যে হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি কোনো যুগের কোনো দেশের কোনো চিন্তানায়ক ও সমাজকর্মীই পিতৃপুরুষের ধর্মে সন্তুষ্ট ও সুস্থির ছিলেন না। তাঁরা সবাই পুরোনো ধর্মদ্রোহী ও নতুন ধর্মের প্রবর্তক। যারা তেমন অসামান্য মননশীল কিংবা সৃজনশীল নন, তাঁরাও reform করেছেন পুরোনো ধর্ম যুগের চাহিদা পূরণের জন্যেই।

কাজেই কোনো জ্ঞানী-মনীষীর কাছেই ধর্ম সর্বকালিক বলে বিবেচিত হয় নি কখনো। আল্লাও দেশ-কালের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বাণী পাঠিয়েছেন তার নবীদের মুখে। সাধারণভাবে দেখতে গেলে ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্র কিংবা বিজ্ঞান-দর্শনের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যা কিছু নতুন হয়েছে, সবকিছুই এই পিতৃপুরুষের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শন প্রভৃতির অস্বীকৃতির তথা অগ্রাহ্যের ফল। এই দৃষ্টিতে যুগে যুগে দ্রোহী-নাস্তিকেরাই বিশ্বমানব ভাগ্যের দিশারী–দেশ-কালের মানবিক সমস্যার সমাধানদাতা। মানব সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে এমনি দ্রোহীদের দানে।

পরিবেশবিরহী ধর্মের সৃষ্টি ও স্থিতি তথা আয়ু যে নেই, তার প্রমাণ পরিবর্তিত পরিবেশে ওগুলো উপযোগ হারিয়ে স্বদেশেই লোপ পায়, যেমন জন্মভূমিতেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে জরথুস্ত্রীয়, ইহুদী, খ্রীস্টীয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম।

কাজেই ধর্মনিষ্ঠাই মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে শক্তি, সম্পদ ও উন্নতির উৎস এবং ধর্মাচারহীনতাই বিপর্যয় ও অবক্ষয়ের কারণ–এ তত্ত্বে তথ্য নেই।

সত্য হচ্ছে এই, যে ক্রমপরিবর্তমান, ক্রমবর্ধমান ও ক্রমঅসমঞ্জস প্রয়োজন-সচেতনতা ও আয়োজন-বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় সামর্থ্য না থাকলে রূঢ়িক কিংবা যৌগিক জীবন সমস্যাসঙ্কুল হয়ই–আর তাতে অভাব-অন্যায়-উৎপীড়ন দেখা দেয় এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত-দ্রোহও এড়ানো যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *