• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৩০. গাঁয়ের স্কুলের অডিট

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০৩০. গাঁয়ের স্কুলের অডিট

সেদিন গাঁয়ের স্কুলের অডিট সেরে রশ্মি রায় আর সে একসঙ্গেই ফেরে। এক ট্রেনে, এক কম্পার্টমেন্টে পাশাপাশি বসে এবং একই ট্যাক্সির উষ্ণ, নরম অন্ধকার ও নিকট সান্নিধ্যে। যে কেউ শুনলে বলবে, তবে আর কি, হয়েই তো গেছে।

হয়ে যায়নি, তবে এই এতটা একসঙ্গে থাকার ধকল আজও সামলে উঠতে পারেনি হেমাঙ্গ। আর সেই মাদক গন্ধটা, সেই মারাত্মক বিদেশীসেন্ট মেয়েটার গা থেকে উড়ে এসে কুংফু কারাটে চালিয়ে হেমাঙ্গর হৃদয়কে প্রায় ধরাশায়ী করে ছেড়েছিল। প্রেমের মধ্যে কি গন্ধেরও একটা ভূমিকা আছে। কোনও কোনও সেন্ট কি হৃদয়-বিদারক? কই, সেসব সেন্টের প্রস্তুতকারকরা তো নোবেল প্রাইজ পায় না। তাদের অবশ্যই নোবেল-টোবেল দেওয়া উচিত।

রাস্তা কম নয়। মেয়েটাও কথা বলতে ভালবাসে। ফলে দুজনের মধ্যে একটা কথার জালও শক্তভাবে বোনা হয়েছিল। প্রথম স্কুল নিয়ে, তারপর ভারতবর্ষের এলানো কর্মবিমুখ জীবনদর্শন নিয়ে, প্রশাসনিক পরিকাঠামোর জটিলতা নিয়ে, মানুষের দুরারোগ্য দুনীতি নিয়ে, চিকিৎসার অতীত ধান্ধাবাজি নিয়ে। কথাবার্তা পার্সোনাল লেভেলে এল ট্যাক্সিতে, শিয়ালদা থেকে হাজরার মাঝখানে।

রশ্মি রায় জিজ্ঞেস করল, আমি একটু বেশি কথা বলি, তাই না? অ্যাম আই এ বোর?

না। আপনার কথা খুব ইন্টারেস্টিং। বোধ হয় জমেও ছিল অনেক কথা।

ঠিক বলেছেন তো! রশ্মি মিষ্টি করে হাসল, গত দুবছরের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ, একজসটিং। হাঁফিয়ে উঠছি। কাকে বলব? আজ। আপনাকে পেয়ে ফ্লাড গোটটা খুলে দিলাম। কেন যে দিলাম বুঝতেই পারছি না। হয়তো আপনাকে খুব সিমপ্যাথেটিক মনে হয়েছিল।

হেমাঙ্গ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে চিরকাল অদক্ষ শ্রমিক। সে অনেকটা ভেবে নিয়ে বলল, ঠিকই করেছেন। কথা জমিয়ে রাখলে খুব কষ্ট।

রশ্মি বিষণ্ণ গলায় বলে, বাবা মা আমার এইসব মিণ-টিশন পছন্দ করে না। বাবা তো বলেই দিয়েছিল, গায়ের স্কুলে গিয়ে ত্যাগের মহিমা দেখাতে পারো, কিন্তু কেউ ওর কোনও দাম দেবে না। গান্ধীজী, বিনোবা ভাবে থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন ওসব করতে গিয়েছিল। কিছুই হয়নি। যে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির জোর নেই, সেখানে ত্যাগ-ট্যাগ দেখাতে গেলে কয়েকটা হাততালি আর অনেক টিটকিরি। জুটবে। তার বেশি কিছুই হবে না।

আপনার কি মোহভঙ্গ হয়ে গেছে?

রশ্মি মৃদু হেসে বলে, একরকম তাই। তবে মেয়েগুলো বড্ড ভাল। এত ভালবাসে আমায়। প্রায়ই তরিতরকারি, গাছের ফল এনে দেয়, আর আদরের সেসব দান বয়ে আনতে হয় আমাকে। অন্তত জনা দুই খুব ভাল লোককেও পেয়েছিলাম। কিন্তু ভালদের তো আজকাল ভয়েস থাকে না। আচ্ছা, আপনাকে এত কথা বলছি কেন বলুন তো? ভীষণ টকেটিভ হয়ে গেছি তো আজি!

কথা বলা সরলতার লক্ষণ।

আমি কি সরল?

ওভাবে জিজ্ঞেস করলে বিপদে পড়ে যাই।

রশ্মি খুব হাসল। তারপর বলল, কিন্তু আপনি তো কিছু বললেন না নিজের সম্পর্কে। শুধু একটা জিনিস লক্ষ করলাম, মেয়েদের আপনি ভীষণ লজ্জা পান, আর কোনও মহিলার সামনে খেতে পারেন না!

হেমাঙ্গ লজ্জিত হয়ে বলে, আমি কখনও কো-এড়ুকেশনে পড়িনি, ছেলেবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা বা বন্ধুত্ব রেস্ট্রিকটেড ছিল। বাবার ধারণা, বেশি মেলামেশা করলে নারীজাতির ওপর ছেলেদের শ্রদ্ধা কমে যায়।

রশ্মি অবাক হয়ে বলে, এ তো প্ৰায় মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা!

হয়তো আপনি ঠিকই বলছেন। কিন্তু অভ্যাসটা মজ্জাগত হয়ে গেছে।

রশ্মি খিলখিল করে ছেলেমানুষের মতো হেসে বলে, বেচারা!

এই বেচারা শব্দটাই বুঝি আর এক পা এগিয়ে আসা।

রশ্মি বলল, আচ্ছা, নার শ্রদ্ধাই বা কেন করতে হবে বলুন তো! শ্রদ্ধার চেয়ে অনেক বেশি দরকার বন্ধুত্ব, ভালবাসা। তাই নয়?

আপনি এসব বিষয়ে আমার চেয়ে বেশিই জানবেন। উন্নত সমাজব্যবস্থা দেখেছেন। আমরা তো কূপমণ্ডূক। কীই বা জানি!

রশ্মি তার চশমা, দুল ইত্যাদির একটা বিলিক তুলে অন্ধকার টাক্সিতে তার দিকে ঘুরে তাকাল, এটা কি বিনয়। নাকি একটু হুল?

কী যে বলেন! আমার পরিবারটা বেশ রক্ষণশীল। আমরা অ্যাডাল্ট হওয়ার পরও আমাদের ওপর খবরদারি বজায় রাখা হয়। আমি এখনও একটা পারিবারিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে আছি। অনভিপ্ৰেত কোনও কাজ করলে তার জন্য জবাবদিহি করতে হয়। স্বাধীনতা একদম নেই।

রশ্মি একটা দুঃখের শ্বাস ফেলে বলে, বুঝতে পেরেছি। আপনি সেই পরিবারে মানুষ যেখানে এখনও বর্ণাশ্রম মানা হয়; মারেজকে বরদান্ত করা হয় না, এঁটোকাঁটা বিচার করা হয়, বউদের ঘোমটা দিতে হয়, এটসেটরা, এটসেটরা।

অনেকটা তাই।

আপনি বোধ হয় বাড়ির পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করবেন!

বিয়ে করলে তো! ওই একটা ব্যাপারে এখনও ফ্যামিলি প্রেসারকে ঠেকিয়ে রাখা গেছে।

কিন্তু একদিন ভালমানুষের মতো টোপর পরে তো একটা অচেনা মেয়ের গলাতেই মালা দিতে হবে!

রশ্মির হাসিতে খুব সঙ্কুচিত হয়ে হেমাঙ্গ বলল, ব্যাপার কি জানেন? আমার অভিভাবকরা আমার ভিতরে নারীজাতির মুক্তি মুম্বু শ্ৰদ্ধার সঞ্চার করে দিয়েছেন যে, কোনও নারীকে বিয়ে করার কথাই আমি ভাবতে পারি না। অতিরিক্ত শ্ৰদ্ধার ফলই হবে।

রশ্মি ভীষণ হাসছিল। মুখে রুমাল অবধি চাপা দিতে হল তাকে। তারপর বলল, আপনি কিন্তু খুব বিচ্ছু। মুখে ভালমানুষীর ভাব, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুষ্ট আছেন।

হেমাঙ্গ এ মেয়েটার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে মেশামোশি করছে, সুতরাং তার সঙ্কোচটা খানিকটা কেটেও গেছে। সে খুব সাহস করে বলল, আমার মতো প্রবলেম তো আপনার নেই। আপনি তো ইচ্ছে করলে ঘর-সংসার করতে পারেন।

রশ্মি মিষ্টি করেই বোধ হয় হাসল, অন্ধকারে ভাল বোঝা গেল না। তারপর বলল, মেয়েদের বুঝি ঘর-সংসার করা ছাড়া আর কিছু করার নেই? ঘর-সংসার ঘর-সংসার শুনে শুনে পাগল হওয়ার জোগাড়।

রাগ করলেন নাকি?

না, রাগ করলে বুঝতেই পারতেন। শুনুন, ছেলেদের বিয়ে করা আর মেয়েদের বিয়ে করা কিন্তু এক ব্যাপার নয়। ছেলেদের বিয়ে করা অনেকটা আনন্দের ব্যাপার, একটু ভারমুক্ত হওয়ার ব্যাপার। কারণ তাকে দেখাশোনা করার একজন আসছে। কিন্তু মেয়েদের বিয়ে করা মানেই হচ্ছে ভয়, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা। নিজের পরিবার ছাড়তে হবে, সন্তানধারণ থেকে আরও অনেক কিছুর দায়দায়িত্ব নিতে হবে। এবং তার পরে সংসার ছাড়া তার আর কিছু করার থাকবে না।

হেমাঙ্গ অত্যন্ত সমবেদনার সঙ্গে বলল, ঠিক কথা। মেয়েদের বড়ই কষ্ট।

রশ্মি ফের তার দিকে চেয়ে বলল, মুখটা ভাল দেখতে পাচ্ছি না। খুব সম্ভব এটাও একটা বিচ্ছুমি, তাই না?

বিশ্বাস করুন, বাস্তবিকই মেয়েদের কষ্টটা আমি বুঝতে পারি।

রশ্মি সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, কোনও পুরুষই কখনও মেয়েদের সত্যিকারের কষ্ট বুঝতে পারে না। সিমপ্যাথাইজার হতে পারে, বন্ধু হতে পারে, কিন্তু মেয়েদের আসল সমস্যাটা শুধু মেয়েরাই টের পায়। আপনি কিছুতেই সেটা বুঝতে পারবেন না।

হেমাঙ্গ মৃদু স্বরে বলে, ছেলেদের প্রবলেম কি মেয়েরা বুঝতে পারে?

খুব পারে। ছেলেরা হল ডমিনেটিং, ইগোয়িস্ট আর কেয়ারলেস।

হেমাঙ্গ খুব র বলল, আমারও তাই মনে হয়।

আপনি খুব বিচ্ছু। এমন ভাব করছেন যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না। মনে মনে হাসছেন তো!

হেমাঙ্গ কাচুমাচু হয়ে বলে, না, না, মোটেই হাসছি না। ইদানীং দেখছি মেয়েতে আর ছেলেতে একটা কেমন যেন আকচাআকচি শুরু হয়েছে, অনেকটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো। খুব লেখালেখিও হচ্ছে কাগজে।

রশ্মি খুব হাসছিল, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বুঝি? না মশাই, জীবনটা ফুটবল নয় মোটেই।

ট্যাক্সি হাজরায় ঢোকার পর রশ্মি বলল, মোটে তো সন্ধে। আসুন, এক কাপ কফি খেয়ে যান।

হেমাঙ্গর এর প্রতিবাদে কিছু বলার ছিল না। সে ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। তারপর রশ্মি রায়দের বাড়িখানা দেখে তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইল। ফটক, ফটকের ওপাশে অনেকটা লন, ফুলের বাগান, আর চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে তিনতলা বনেদী একখানা প্রকাও বাড়ি। না, তাদের বাড়ির চেয়ে বড় নয় ঠিকই, কিন্তু তবু বেশ বড়।

বাড়ির ভিতরটাও দেখবার মতো। মেহগনি, আবলুস বা বাৰ্মা সেগুনের সেকেলে মজবুত সব চেয়ার-টেবিলআলমারি-বুককেস। বিশাল বৈঠকখানার এক কোণে একটা মস্ত পিয়ানো অবধি রয়েছে। পেল্লায় বড়লোক, সন্দেহ নেই।

হেমাঙ্গ খুব উজবুকের মতো বলল, আপনি বোধ হয় রোজ গাড়ি করে শিয়ালদায় গিয়ে ট্রেন ধরেন, না?

রশ্মি একটু অবাক হয়ে বলে, কি করে বুঝলেন?

হাত গুনতে জানি যে!

রশ্মি আর অবাক না হয়ে হেসে ফেলে বলে, খুব চালাক, না? কিন্তু কি করব বলুন, এখনও কলকাতার ট্রাম-বাসে ওঠার অভ্যাস হল না। এত ভিড়, আর লোকজনও তো তেমন সভ্যভব্য নয়।

ফেরেনও তো গাড়িতেই?

হ্যাঁ। সন্ধে ছটা থেকে গাড়ি শিয়ালদায় গিয়ে থাকে। আজ ড্রাইভারের ছুটি বলে গাড়ি যায়নি।

আপনি চালাতে পারেন না?

ও বাবা! কলকাতায় গাড়ি চালাবো! ভয়েই মরে যাই যে। লন্ডনে চালাতাম।

রশ্মির বাবা বা মা কেউই বাড়িতে ছিলেন না। ফলে পরিচয়ের ঝামেলাটা ছিল না। হেমাঙ্গ নিশ্চিন্তে বসে এক কাপ কফি খেল। তারপর উঠল।

আজ যাই।

ঠিকানাটা দিয়ে যান তো। আর ফোন নম্বর।

এটা কি আরও এক পী এগিয়ে আসা! হেমাঙ্গ রাশির ডায়েরিতে নিজের ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিল।

রশ্মি ঠিকানাটা দেখেই বলল, গরচা! ওমা, এ তো হাঁটাপথ!

হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলে, অনেক সময়ে সামান্য হাঁটা পথও লক্ষ বছরে পেরোতে পারে না মানুষ।

খুব কথা শিখেছেন!

হেমাঙ্গ দিন তিনেক রশ্মির মুখ মনশ্চক্ষে দেখতে পেত, রশ্মির গলার স্বর শুনতে পেত মনেরই কানে। কফির স্বাদ আর সেই সেন্টও তার জিব। আর নাককে কয়েকদিন দখলে রেখেছিল।

দিন সাতেক বোধ হয় ক্রিয়াটা রইল। তারপর বিস্মৃতির জল মিশতে-মিশতে নেশার জিনিসটা ফিকে হতে লাগল। আর ঠিক সেই সময়েই একদিন একটা ফোন এল।

আমি রশ্মি বলছি। মনে আছে তো আমাকে!

মনে থাকবে না! যা পেল্লায় বাড়ি!

ইস, কী বিচ্ছু লোক! বাড়িটাকে মনে রেখেছেন, আর বাড়ির জন্যই আমাকে?

ঠিক তা নয়। তবে বাড়ি জিনিসটাও কিন্তু একটা ফ্যাক্টর। উপেক্ষা করার জিনিস নয়।

বুঝলাম। বাড়িটা না দেখালে বোধ হয় আমাকে মনেও থাকত না!

তা নয়। আপনার বাড়ির সঙ্গে আপনার যদি একটা কনটেস্ট হয়, তাহলে আপনিই জিতবেন। বলুন, কেমন আছেন।

ভাল।

আপনার স্কুল কেমন আছে?

টিকে আছে এখনও। শুনুন, রবিবারে ফ্রি আছেন?

আমি তো সব সময়ে ফ্রি।

মোটেই নয়। রবিবারে রবিবারে তো আপনি অডিট করেন বলছিলেন।

সেটা সব রবিবারে নয়। এই রবিবারে আমার ছুটি। কেন বলুন তো?

আমাদের বাড়িতে আসবেন বিকালে? ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ?

যেতে পারি। কিন্তু কারণটা কি?

আপনি না সেদিন আমার বন্ধুত্ব মেনে নিয়েছিলেন! এমনিই আসুন।

খাওয়া-দাওয়া আছে?

রশ্মি খিলখিল করে হাসল, কিন্তু আপনি তো মেয়েদের সামনে খান না। কি করবেন তাহলে?

না তাকালে খেতে পারি।

রশ্মি খুব মায়াবী গলায় বলল, একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আছে। আর আমি ফরাসী দেশে রান্না শিখেছি। রাঁধতে ভীষণ ভালবাসি। সেদিন কয়েকটা নতুন রেসিপি এক্সপেরিমেন্ট করব।

ও বাবা! আমি কি গিনি পিগ নাকি?

রশ্মি আবার খুব হাসল, না হয় তাই হলেন।

আচ্ছা। যাবো। মেয়েদের জন্য পুরুষদের কত স্বার্থই তো ত্যাগ করতে হয়।

রশ্মি হাসল, ছাড়ছি। বাই।

হেমাঙ্গ ফোনটা রেখে দিয়ে খুব গভীর একাগ্রতা নিয়ে চিন্তা করতে বসল। মানুষের মন স্বভাবতই এলোমেলো। চিন্তাগুলোকে পৰ্যায়ক্রমে বা পরম্পরায় সাজাতে পারে না বলে তার সিদ্ধান্তে আসতে দেরি হয় না কখনোই আসতে পারে না। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এটা কী হচ্ছে? এটা কি কোনও সঙ্কেত? কোনও পূর্বলক্ষণ?

ফোনটা সে করল অগতির গতি চারুশীলাকে।

কি রে হাঁদারাম, কেমন আছিস?

শোন, আমার একটা প্রবলেম হয়েছে।

তোর তো বরাবরই প্রবলেম। এবার একটা বিয়ে কর। তাহলে আর প্রবলেমে পড়লেই আমাকে ফোন করতে হবে না।

তুই বড্ড সেকেলে।

বিয়ে করতে বললেই বুঝি সেকেলে হয়? তা তুই করতে চাস কী? লিভ টুগেদার করবি নাকি? তোর ভাবসোব আমি একটুও ভাল বুঝছি না।

দেখ, বিয়েটাও একটা লিভ টুগেদার ছাড়া কিছু নয়, সে হিন্দু, খ্ৰীস্টান, মুসলমানি মতে বা রেজিস্ট্রি করলেও হরেদরে কাশ্যপ গোত্র। বিয়ের সুবিধে এই যে, ছাড়াছাড়ি হলে অ্যালিমনি বা কমপেনসেশন পাওয়া যায়।

ও বাবা, এ তো খুব অত্যাধুনিক মতামত হয়েছে দেখছি। জানিয়ে দেবো নাকি বাড়িতে?

তা জানাতে পারিস। কিন্তু তাতে সত্যটা তো বদলে যাবে না। বিয়েকে উদ্দবন্ধন কেন বলে জনিস? ওর মানে হল

বেঁধে মারা।

মোটেই তা নয়। উদবন্ধন মানে বিয়ে নয় মোটেই। বিয়ে হল উদ্বাহ বন্ধন। বাংলাটা তুই কিছু জানিস না।

ওই হল। উদ্বাহটাও এমন কিছু ভাল ব্যাপার নয়। খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে ওটার মানেও খুব খারাপ।

তুই বরং ইংরিজিতে বল না, ভুল একটু হবে।

ইংরেজিতে বললে যে তুই কিছুই বুঝবি না। তোর কাছে ইংরেজি তো গ্ৰীক ভাষা।

তোর কাছে যেমন বাংলা? তোর জন্মদিন কবে যেন! এবার তোর জন্মদিনে একটা ভাল বাংলা ডিকশনারি প্রেজেন্ট করব তোকে।

দিস। ডিকশনারি দিয়েই শুরু কর। হাত আসুক।

ইস! আমি কেপ্পন না তুই কেপ্পন! বিয়ে তো করতে চাস না খরচের ভয়ে। বউ খাবে, পরবে, এটা ওটা চাইবে, তাতে তোর টাকা খরচ হবে। হ্যাঁ রে, তুই এত টাকা চিনলি কবে থেকে? হাড় কঞ্জুস হয়েছিস মাইরি!

রোজগার করলে তুইও টাকা চিনতিস। পরের ঘাড়ে পড়ে দিব্যি লাইফটা কাটিয়ে গেলি। সিন্দাবাদের কাঁধে যে সেই বুড়োটা চেপে বসেছিল, কিছুতেই নামে না, তুই হলি তেমনি। শুধু চেপে বসা? লোকটাকে ছিবড়ে করে দিলি।

আচ্ছা, তুই না একটা গাঁয়ের মেয়ে বিয়ে করবি বলেছিলি! তাই না হয় কর না বাবা। গাঁয়ের মেয়েদের ডিম্যান্ড কম হয়। রুজ লিপস্টিক চাইবে না, ড়ুরে শাড়ি পেলে খুশি, পার্টিটার্টি দেবে না, মোষের মতো খেটে তোর খরচ বাঁচিয়ে দেবে।

গাঁয়ের মেয়ে তুই খুব চিনেছিস দেখছি! গাঁয়ে যাস কখনও? গিয়ে দেখিস তোর মতো আধুনিক গণ্ডায় গণ্ডায় ঘুরে বেড়ায় আজকাল। সেই দিন আর নেই রে নাতি, থাবা থাবা চিনি খাতি।

মোটেই নয়। এখন তোর প্রবলেমটার কথা বলবি?

বি সিরিয়াস। প্রবলেমটা কিন্তু সত্যিই প্রবলেম। নো হাসিঠাট্টা। প্লীজ!

আচ্ছা, মনে থাকবে।

প্রবলেমটা একটা মেয়েকে নিয়েই। টল, ফেয়ার, ইয়ং অ্যান্ড বিউটিফুল। হাইলি এড়ুকেটেড। বিলেতে লেখাপড়া করেছে। পেল্লায় বড়লোক।

বাড়িয়ে বলছিস না তো! প্রেমে পড়লে কিন্তু লোকের মাত্রাজ্ঞান থাকে না। কাণ্ডজ্ঞানও নয়। আগে বল জাতে কি?

ওঃ, তোকে নিয়ে আর পারি না। আমি প্রেমে পড়িনি।

পড়িসানি? এর পরও যদি প্রেমে না পড়ে থাকিস তাহলে এখুনি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখা।

একটু শুনবি চারুদি? একটু পেশেন্স নিয়ে?

বল।

মেয়েটা আদর্শবাদী। একটু নারীমুক্তি ঘেঁষা, অর্থাৎ একটু অ্যাগ্রেসিভ টাইপের।

চারুশীলা ফোঁস করে ওঠে, নারীমুক্তিতে বিশ্বাস করলেই সে অ্যাগ্রেসিভ হয় বুঝি! বেশ কথা তো!

ফের ফোড়ন কাটছিস?

আচ্ছা বল।

পদবী রায়, জাতটাত জানি না।

জানিস না কেন? রায় মে বি এনিথিং।

তা হোক না এনি থিং। আমি তো আর ইন্টারেস্টেড নই।

নোস যদি তবে ফোন করে জ্বালাচ্ছিস কেন?

বলছি। মেয়েটা একটা গায়ের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। চাকরিটা শখের। তবে ওই স্কুলে অডিট করতে গিয়ে আলাপ। এক সঙ্গে ফিরলাম। ওর বাড়িতে কফিও খেয়েছি। দি ম্যাটার শুড এন্ড দেয়ার। কিন্তু মেয়েটা একটু আগে ফোন করে সামনের রবিবার ওর বাড়িতে করেছে। আমি অ্যাকসেপ্ট করেছি।

বেশ তো। তারপর?

তারপরই তো তোকে ফোন করছি। কিছু বুঝতে পারছিস?

এ তো দুইয়ে দুইয়ে চার। সোজা অঙ্ক।

ভ্যাট। এ মেয়ের আমাকে পাত্তা দেওয়ার কথাই নয়।

তবে দিচ্ছে কেন?

সেটাই যদি জানবো। তবে তোকে জিজ্ঞেস করছি কেন? আমি মেয়েদের সাইকোলজি কিছু জানি না। একটু অবাক লাগছে।

আগে জানতে হবে তুই যতটা বলছিস মেয়েটা ততটাই কিনা। তুই তো হাঁদারাম। বয়সটাও ভাল নয়। এ বয়সে যাকে চোখে পড়ে তাকেই উর্বশী বলে মনে হয়।

এ মেয়েটি গ্যারান্টিড সুন্দরী। ঠিকানা দিচ্ছি, দেখে আসিস গিয়ে।

দেখাশোনা তো করতেই হবে বাবা। সেটা না হয়। পরেই হবে। কিন্তু তোর প্রবলেমটা কী?

এটাই তো প্রবলেম। মেয়েটা ডাকছে কেন?

তোকে পছন্দ করছে বলে! বিলেতে কতদিন ছিল?

জিজ্ঞেস করিনি। তবে লেখাপড়া যখন করেছে তখন বেশ কিছুদিন থেকেছে নিশ্চয়ই। সামনের বছর পারমানেন্টলি বিলেতে চলে যাবে।

তুই লন্ডনে কতদিন ছিলি যেন?

বছর খানেক। একটা শর্ট কোর্স করতে গিয়েছিলাম।

তোর তো সেখানে অনেক বন্ধু আছে!

আছে কয়েকজন।

তাদের কাছে চিঠি লিখে খোঁজ নে।

অতদূর করতে যাবো কেন?

খোঁজ নিয়ে দেখ, ওখানে কোনও অ্যাফেয়ার ছিল কিনা।

সেটা জেনেই বা কী হবে?

যা বলছিস তা যদি সত্যি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে এতদিনে তোর মতো একটা হাবাগঙ্গারাম, অপদাৰ্থ, গুড ফর নাথিংকে উদ্ধার করতে ভগবানই ওকে পাঠিয়েছেন।

তুই একদম বোকা। বলছি তো আমি ইন্টারেস্টেড নই।

ঠিক আছে, রোববার ওর বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে ওদের বর্ণটা জেনে নিবি। বুঝেছিস বোকাচণ্ডী?

আমি ওসব পারব না। শুধু জানতে চাইছি, এত অল্প পরিচয়ে এতটা এগোনো কি স্বাভাবিক?

প্ৰেম জিনিসটা এরকমই হয়। তোর অভিজ্ঞতা নেই বলে জানিস না।

তুই বলতে চাস মেয়েটা আমার প্রেমে পেড়েছে?

হাবুড়ুবু যাচ্ছে।

অসম্ভব। এ খুব ধারালো মেয়ে।

ধারালো মেয়েরা আজকাল ইচ্ছে করেই ব্যক্তিত্বহীন, ম্যাদাটে মার্কা, জো-হুজুর টাইপের পুরুষদের পছন্দ করছে। তাতে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বজায় থাকে, যা খুশি করতে পারে, স্বামীকে ইচ্ছেমতো চালাতে পারে।

আমি ম্যাদাটে মার্কা! ব্যক্তিত্বহীন!

তার ওপর পয়সাওলা ঘরের ছেলে, অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশনও ভাল। তোকে তো এ ধরনের মেয়েরা লুফে নেবে।

ক্যাচ উঠলে তো লুফবে! আমি তো ক্যাচ তুলিনি?

তুলেছিস, কিন্তু জানতি পারছিস না।

ইয়ার্কি করিস না চারুদি। তোকে না আগেই বলেছি, বি ভেরি সিরিয়াস!

সরি। ভুলে গিয়েছিলাম। আর ইয়ার্কি করব না। বল।

যা বলার তা বলেছি। এবার ভেবে বল তো ব্যাপারটা কি!

সত্যি বলব?

সত্যি না তো কি বানিয়ে বলবি?

মেয়েটা তোকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইছে। তোর চেহারাটা খ্যাদা বেঁাচার ওপর মন্দ নয়। মুখে একটা বোকাবোকা ভালমানুষী আছে, যা থেকে তোকে অনেস্ট বলে মনে হতে পারে। তবে আমি এটাও বিশ্বাস করছি যে, তুই এখনও ওর প্রেমে পড়িসনি। পড়লে তোর গলা শুনেই আমি বুঝতে পারতাম।

পড়িনি। আর বেশিদূর এগোতেও চাই না। নেমন্তন্নটা কি কাটিয়ে দেবো?

তা কেন? যা না। তবে সব ইনফর্মেশন না নিয়ে কিছু করে বসিস না।

আমি কি সেরকম লোক?

তুই কিরকম লোক? বোকারা কত অকাজ করে ফেলে। মেয়েটার নাম কি?

রশ্মি রায়।

নামটা তো বেশ!

মেয়েটাও বেশ।

তবু তোর পছন্দ নয়?

পছন্দ নয়তো বলিনি! তবে আমি প্রেমে পড়িনি।

চারুশীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোর জন্য এই কারণেই আমার মাঝে মাঝে বড় দুঃখ হয়।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০২৯. ছেলেটাকে ধরেছিল আপা
পরবর্তী:
০৩১. জলকাদায় বৃষ্টিতে গাঁ-গঞ্জের কাঁচা-পাকা রাস্তায় »

Reader Interactions

Comments

  1. Adv Azadi Akash

    January 15, 2019 at 3:52 pm

    অনেক ভাল লাগলো। আমাদের ব্লগে লেখার অনুরোধ রইলো।

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑