তত্ত্ব-সাহিত্যের গোড়ার কথা

তত্ত্ব-সাহিত্যের গোড়ার কথা

শোনা যায় আর্যরা ঋগ্বেদ সঙ্গে নিয়ে ভারতে এসেছিল। কিন্তু ভারতে প্রবেশ করে আর্যরা স্বধর্মে স্থির থাকতে পারেনি। দৈশিক ও কালিক প্রভাবে, ও অনার্য সংশ্রবে আর্যধর্ম বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে। অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্রাদি দেবতার স্থানে শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার পূজা চালু হতে লাগল। এরূপে আর্যধর্মে প্রচুর অনার্য সংস্কার এবং বহু অনার্য দেবতা প্রবেশ করে তাকে এতই বিকৃত করেছেন যে, বৈদিক ধর্ম বলতে যা বুঝায়, তার আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট রইল না। বৈদিক ধর্ম বলে যে কথাটি আছে তা নাম সার, কথার কথা মাত্র। মূল আর্যধর্মের অনার্য উপাদানে পুষ্টি ও রূপান্তরের ইতিহাস অতি জটিল ও বহুবিস্তৃত। সে বিচার করতে গেলে লোেম তুলতে কম্বল উজাড় হবার কথা। ধর্ম-দর্শনের বহুধা বিস্তৃতি, সংস্কারের কলেবর বৃদ্ধি ও তেত্রিশ কোটি দেবতার উদ্ভবে দিশাহারা জনগণের পক্ষে ধর্মের পূর্ণরূপ হৃদয়ঙ্গম করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। তাই উপায়ান্তর না দেখে তারা যে কোনো একক দেবতার পূজা-প্রথা প্রচলন করতে বাধ্য হল। এভাবে শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এই ধর্মশাস্ত্রের বিকাশে ও প্রসারে মুসলমান-পূর্ব যুগে কোনো বিদেশী প্রভাব ছিল না। অনার্য মানস-সংস্কার আর্য-মানসের উপর জয়ী হল। অনার্য-সভ্যতা যে আর্য-সভ্যতার চেয়ে উন্নত ছিল তার প্রমাণ মেলে আর্যদের এই সাংস্কৃতিক পরাজয়ে। তবু আর্যগণ বিজেতা এবং শাসক, তাই তারা গায়ের জোরেই সমাজে প্রধান রয়ে গেল। এ অনার্য অবদান আর্য- সংস্কৃতি নামে প্রচারিত ও প্রচলিত হল। শাসক ও অভিজাতশ্রেণী চিরকাল বিষয়-বুদ্ধি সম্পন্ন, তারা উচ্ছ্বাস বা হুজুগের বশে কিছু একটা করে বসে না। গরজ ও সুযোগ বুঝে তারা এমনিভাবে চলে যে, অন্যের কৃতির দ্বারা নিজেরাই লাভবান হয়, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বও বজায় থাকে। কিন্তু মানুষের অন্ধ ধর্মানুগত্যের সুযোগে আর্যগণ যখন শাসন-শোষণ ও ভয়ঙ্কর উৎপীড়ন শুরু করল, তখন বর্ধমান মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে অনার্য অধ্যুষিত পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রবল বিদ্রোহ দেখা দেয়। বেদ-ব্রাহ্মণদ্বেষী জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন একান্তভাবে অনার্য সংস্কার-প্রসূত। বুদ্ধের নির্বাণবাদ ও অহিংসবাদ বলিপ্রিয় ও ত্রিলোকে বিশ্বাসী আর্য-মানসের সম্পূর্ণ বিপরীত। শঙ্করের মায়াবাদ ও অনার্য–মানস সম্ভুত। কৃষ্ণ মিত্রের (১০ শতক) প্রবোধ চন্দ্রোদয়ের দ্বিতীয় অঙ্কে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ অহঙ্কার কাশীতে বেদান্ত চর্চার বাহুল্য দেখে অবজ্ঞা করে বলেছে : প্রত্যক্ষাদিপ্রমাসিদ্ধাথিরুদ্ধর্থববেধিনঃ। বেদান্তাঃ যদি শাস্ত্রনি বৌদ্ধে কিমপরাধ্যতে।

বাঙলা দেশে বৌদ্ধধর্মের বিকৃতি যে প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কারগ্রস্ত অশিক্ষিত অনার্য মানসের প্রভাববশত ঘটেছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। শিব ও নারীদেবতাগুলো একান্তভাবে অনার্যদের দ্বারা পরিকল্পিত। শিবের সম্ভ, আদিনাথ, মহাদেব প্রভৃতি গুণ-নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে–তিনি অনার্য দেবতা। পুরাণ বর্ণিত দক্ষযজ্ঞ কাহিনীটি আর্যগণ কর্তৃক অনার্য দেবতা শিবের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার প্রচেষ্টার আভাস দিচ্ছে। বাঙলার বৌদ্ধধর্মে শিবের স্থান হয়েছিল। ধর্মপালের প্রপৌত্র নারায়ণ পাল শিবভক্ত ছিলেন। শিব সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে। এই শিব হচ্ছেন আদিনাথ, তারও আগে পরমাপ্রকৃতি আদ্যা। এর থেকেই সৃষ্টি পত্তন। এ শিব ও তাঁর পত্নী শিবানীকে (তৃতীয় জন্মে আদ্যা শক্তিই শিবপত্নী) কেন্দ্র করেই বিকৃত বৌদ্ধধর্মে যোগশাস্ত্র, দেহত্ত্ব (কায়াসাধন) সহজ সাধন, গুরুবাদ প্রভৃতির উদ্ভব হয়। এসব যোগতান্ত্রিক বৌদ্ধমতকে নাথপন্থ ও সহজিয়ামার্গ বলা হয়। এর অপর একটি শাখা ধর্মপূজা। এ সবই বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবিত অনার্য ধর্ম। তন্ত্রমতও শিবেপ্রাক্ত। ভক্তিবাদটা আসলে অনার্য-মানস প্রসূত। গোটা ভারতবর্ষে ভক্তিধর্মের উন্মেষ ও বিকাশ অনার্যদের মধ্যেই হয়েছিল। এর উদ্ভবক্ষেত্র দাক্ষিণাত্য-অনার্য অধ্যুষিত উত্তরভারতের নিম্নশ্রেণীর (অনার্যদের) মধ্যে ভক্তিভাব প্রথম বিকশিত হয় এবং বাঙলাদেশেতো বটেই। ইতিহাস-পূর্ব যুগেও নারদ, প্রলোদ, শুক প্রভৃতি যারা ভক্তিবাদী ছিলেন, তাঁরা হয় অনার্য অথবা অনার্য রক্ত সম্পর্কিত ছিলেন। মাংসাশী আর্যগণের নিরামিষাশী হওয়াও অনার্য আচারের ব্যাপক প্রভাবের ফল।

এবার বাঙলার কথায় আসা যাক। বাঙলা দেশে ভক্তিধর্মের উদ্ভব সম্বন্ধে ডক্টর সুকুমার সেন বলেন, মহাযানের উপাস্য নরদেবতা অবলোকিতেশ্বর বাংলা দেশে লোকনাথ নাম নিয়ে বিষ্ণুর রূপান্তরে পরিণত হয়েছিলেন। এবং উত্তরাপথে বাসুদেব কৃষ্ণকে অবলম্বন করে যেমন ভক্তিপরায়ণ ভাগবত মত উদ্ভূত হয়েছিল, বাংলা দেশে তেমনি লোকনাথকে আশ্রয় করে ভক্তিধর্মের অঙ্কুর উদ্গত হয়েছিল। বাংলা দেশে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী বহুকাল থেকে প্রচলিত থাকলেও এই কাহিনীকে অবলম্বন করে অত সহজে ভক্তিধর্মের বিকাশ হয়নি, যত হয়েছিল অবলোকিতেশ্বর লোকনাথকে আশ্রয় করে।–বৌদ্ধ মতের ভক্তিভাবের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের কথাশিত বৈষ্ণব ভক্তিভাবের একটু তফাৎ আছে। বৈষ্ণব মতে ভক্তি জ্ঞানশূন্য এবং লীলাস্মরণ সাধনার একটা প্রধান অঙ্গ, কিন্তু বৌদ্ধমতে ভক্তি জ্ঞানেরই অঙ্গ। এখানে নাথ ও সহজপন্থ স্মরণীয়। সদগুরু থেকে জ্ঞান (মহাজ্ঞান) না পেলে সাধনায় সিদ্ধি নেই। বৌদ্ধভক্তিবাদ চৈতন্য ও তার আগের যুগে জয়দেব মিশ, চণ্ডীদাস, মাধবেন্দ্র পুরি প্রভৃতিকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে। (প্রত্যক্ষ প্রভাব এসেছিল সুফী মত থেকে এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারত থেকে)। তেরো শতকের বৌদ্ধ রামচন্দ্র কবিভারতীর ভক্তিশতক ও বৃত্রমালার প্রভাবও হয়তো চৈতন্যদেবের উপর পড়েছিল।

সুতরাং বাঙলার বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, মুর্শিদা, নাথপন্থ ও বৌদ্ধ সহজিয়া মত প্রভৃতি অনার্য মনোভঙ্গিরই প্রকাশ। ডক্টর সুকুমার সেন (প্রাচীন বাংলা ও বাঙালি) বলেন : বাংলা দেশে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে যেমন পূর্বেকার ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ভক্তিবাদের যুক্তবেণী প্রবাহিত হয়ে এসেছে, তান্ত্রিক বৈষ্ণব অর্থাৎ বাউল সহজিয়া ইত্যাদি মতের মধ্যে তেমনি পূর্ব যুগের শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতবাদের পরিণতি দেখা যায়। অষ্টম শতাব্দী কিংবা তারও পরে থেকে বাঙলা দেশে অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে তান্ত্রিক ভাবের দুটি ধর্মমত চলিত ছিল–শৈব-নাথ মত এবং বৌদ্ধ সহজিয়া মত (নাথ পন্থ ও চর্যাপদের সহজিয়া)। এই দুই মতের সাধনায় ও দর্শনে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। নাথ সন্ন্যাসীরা নিজেদের যোগী বা কাঁপালিক বলত। এরা কানে নরাস্থি কুণ্ডল, কণ্ঠে নরাস্থি মালা, পায়ে নূপুর ও হাতে নরকপাল ধারণ করত এবং গায়ে ছাই মাখত। এদের আহার বিহার ছিল কদর্য, তাই গ্রামের বাইরে ছিল এদের কুঁড়েঘর। যোগীদের নামের শেষে শব্দ হত নাথ। বর্তমান সময়ে যুগী জাতির (তাঁতি) মধ্যে নাথ পদবি ও পূর্বেকার আচার-অনুষ্ঠান কিছু কিছু চলিত আছে। শৈব ও বৌদ্ধ সহজ সাধকেরা দেহতত্ত্বের সাধনা করত এবং আবশ্যক হলে যোগিনী বা অবধূতী অর্থাৎ সাধন-সঙ্গিনী গ্রহণ করত। এদের সাধনার সঙ্কেত নিহিত আছে চর্যাপদে। চর্যাপদগুলো বাঙলা পদাবলীর আদিরূপ। ধর্মপূজাকেও আমরা হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভাবিত অনার্য ধর্ম বলেছি। সমাজের নিম্নস্তরে তখন অনার্য প্রথামতো স্থানীয় দেবদেবী প্রভৃতি উপ-দেবতার পূজা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। জাঙ্গুল, বাসুকী বজ্রতারা চণ্ডিকা মনসা ক্ষেত্রপাল শিব ষষ্ঠী যক্ষ (মদ্য-মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে–চৈ, ভা.) শীতলা ওলা ধর্মঠাকুর প্রভৃতি সে-কালীন দেবতা। অধিকাংশ দেবতার উদ্ভব ও প্রভাবক্ষেত্র রাঢ় অঞ্চলেই ছিল বলে মনে হয়। চণ্ডীমঙ্গলে তাই দেখতে পাই—-ব্যাধ গোহিংসক জাতিতে চোয়ার। কেহ না পরশ করে লোকে বলে রাঢ়। এ ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুর কথা। সদুক্তি কর্ণামৃতের একটি শ্লোকে এইরকম গ্রাম্যপূজার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে :

তৈস্তের্জীবোপহারৈর্গিরিকুহরশিলাসংশয়ামচয়িত্ব
দেবীং কান্তার দুর্গা রুধিরমুপতরু ক্ষেত্র পালায় দত্ত্বা।
তম্বীবীণা বিনোদব্যবহৃতসরকামচিহ্ন জীর্ণে পুরাণীং
হালাং মালুরকোষৈষু বতিনাহচরা বর্বঃ শীলয়ন্তি।

অনেকগুলো আর্য ও অনার্য দেবতা মিলে ধর্মঠাকুর হয়েছেন। বৈদিক বরুণ ও রথারোহী সূর্য, অবৈদিক কূর্মাবতার, ঈরাণীয় বুটপরা ঘোড়াচড়া সিপাহী মিহির, ভবিষ্য বা পৌরাণিক কল্কি অবতার ও অনার্য পাষাণ, তাম্রধাতু ও বৃক্ষদেবতা–এই সব মিলে ধর্মঠাকুরের উদ্ভব।

ধর্মঠাকুরের ধ্যানে তাঁকে শূন্যমূর্তি বলা হয়েছে। এই শূন্য বৌদ্ধ মহাযান মতের শূন্য নয়। এখানে শূন্য মানে নিষ্কলঙ্ক শুভ্র। ধর্মদেবতা নিষ্কলঙ্ক সবশ্বেত তাঁর বাহন উলুক বা উল্লুক হচ্ছে পেঁচা বা শাদা কাক। রূপকচ্ছলে ধর্মঠাকুরকে শাদা হাঁস কল্পনা করা হয়েছে। সিপাহী মূর্তিতেও তাঁর বাহন শ্বেত-অশ্ব। ধর্মপূজার মন্ত্রে সূর্যকে নিরঞ্জন শূন্য দেহ বলা হয়েছে। ধর্মঠাকুরের প্রতীক যা পূজা করা হত, তা হচ্ছে কূর্মাকৃতি পাষাণ খণ্ড অথবা পাষাণ নির্মিত কূর্মবিগ্রহ। কূর্ম-প্রতিমার পৃষ্ঠে সাধারণত ধর্মঠাকুরের পাদুকাচিহ্ন আঁকা থাকত। এই পাদুকাচিহ্নই ধর্মঠাকুরের আসল প্রতীক। ধর্মপণ্ডিত অর্থাৎ ধর্মপূজার যারা পুরোহিত তারা সর্বদা গলায় ধর্মঠাকুরের পাদুকা ঝুলিয়ে রাখতেন। ধর্ম ছিলেন আদিতে যোদ্ধা ডোম জাতির দেবতা, তাই ডোমেরাই ধর্মপূজার প্রধান অধিকারী ছিল। এখন কৈবর্ত, বার্মাদ, ধোপা, পুঁড়ি ইত্যাদি নানাজাতির ধর্মপণ্ডিত দেখা যায়। যেখানে ধর্মঠাকুর শিব বা বিষ্ণু হয়ে গেছেন সেখানে পৌরোহিত্য ব্রাহ্মণে গ্রহণ করেছে (সুকুমার সেন–প্রাচীন বাংলা ও বাঙ্গালী)।

উপরের মন্তব্যগুলি বোধ হয় বিশদ করবার প্রয়োজন আছে। আমাদের মৌল বক্তব্য ভারতীয় আর্যদের উপর অনার্যদের প্রভাব। এ এত বেশি এবং সুদূরপ্রসারী যে, তা সহজে হৃদয়ঙ্গম করা একরূপ অসম্ভব। আর্যগণ শুধু ঋগ্বেদ সম্বল করে ভারতে এসেছিলেন এবং সংখ্যায়ও খুব বেশি এসেছিলেন বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। সুতরাং বৈদিক ধর্মশাস্ত্রের যে ক্রমপরিণতি ও প্রসার ঘটেছে তাতে অনার্য অবদান তুচ্ছ নয়। অথর্ব বেদ পুরো এবং সাম বেদের কোনো কোনো সূক্ত এদেশেই রচিত হয়। ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক দুটোও এখানেই রচিত। আরণ্যক বিধিতে যে ভাববাদী দ্রাবিড় প্রভাব পড়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা ক্রিয়াসর্বস্ব বৈদিক ধর্মের সহসা কল্পনাশ্রয়ী হবার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

বৈদিক ধর্ম একান্তভাবে অনুষ্ঠান-প্রধান। এ ধর্মের আদি দেবতা প্রকৃতি-প্রতীক। যেমন বরুণ, অগ্নি, ইন্দ্র প্রভৃতি। যাগযজ্ঞই ধর্মাচরণে একমাত্র পন্থা। এক কথায় বেদের কর্মকাণ্ড অবিমিশ্র আর্যধর্ম। ব্রাহ্মণ এবং জৈমিনির পূর্ব-মীমাংসাও আর্যসৃষ্টি। সাংখ্য ও যোগ কিন্তু অনার্যদর্শন।

বেদান্ত আর্য-অনার্য উপাদানে রচিত। এগুলোর রচনাকাল খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ থেকে খ্রীস্টীয় বৌদ্ধ শতক অবধি। কতগুলো উপনিষদের তাৎপর্য নিয়ে ব্রহ্মসূত্র ও গীতা কবে রচিত হয়, তা কেউ বলতে পারে না। ব্ৰহ্মসূত্রের আদি রচয়িতা বলে কথিত ব্যাসদেবের সূত্র পাওয়া যায়নি। আবার সব সূত্রই ব্যাসদেব রচনা করেছিলেন কিনা তাও নিঃসংশয়ে বলা যাবে না। গীতা ও মহাভারত দুটোই ব্যাসের নামে চলে, সুতরাং মনে করা যেতে পারে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে এগুলো রচিত হয়। বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র থেকেই বেদান্ত দর্শনের উৎপত্তি। এটা সম্ভবত খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত হয়। আর্যগণ কবে থেকে তাঁদের আদিম ইষ্টদেবতাগুলোকে পরিত্যাগ করে এদেশের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতার আরাধনা শুরু করেন ইতিহাস তা বলতে পারে না। কবে থেকে পূর্ব-মীমাংসা ও তৎসংপৃক্ত স্মৃতিতে অর্বাচীন দেবতাগণের স্থান হল তাও অজ্ঞাত।

সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্ত দাঁড়াচ্ছে এই : কর্মকাণ্ড-সর্বস্ব ঋগ্বেদ নিয়ে যখন আর্যগণ ভারতে আসেন তখনো তাদের ধর্ম পরিণত রূপ গ্রহণ করেনি। প্রকৃতি-প্রতীক দেবতাগণের তুষ্টিবিধান করে ঐহিক অভিষ্ট সিদ্ধি করাই তাদের ধর্মাচরণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আবার তা-ও ভক্তি ও জ্ঞানসাপেক্ষ নয়, কর্মসর্বস্ব। অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঈশ্বর বা অন্য কোনো ব্যক্তি বেদ রচনা করেন নাই। বেদ অনাদিকাল হইতে আকাশে নিত্য হইয়া রহিয়াছে। বিভিন্ন ঋষিদের মনে আবির্ভূত হইয়াছে মাত্র।–মীমাংসকেরা জগৎকে সত্য বলিয়া মানেন এবং তাহারা কোনো ঈশ্বর মানেন না এবং জগৎ যে কোনো সময়ে সৃষ্ট হইয়াছিল এবং কোনো সময়ে যে ইহা ধ্বংস হইবে তাহাও তাহারা জানেন না। কাজেই ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো আলোচনা মীমাংসার বিষয় নহে। যাগযজ্ঞে নানা দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু মীমাংসকেরা সেই সমস্ত দেবতার স্বতন্ত্র সত্তা মানেন না। উচ্চারিত মন্ত্রের মধ্যে তাঁহাদের সত্তা; যথাযথভাবে মন্ত্র উচ্চারিত হইলে এবং যথাযথভাবে যজ্ঞীয় অনুষ্ঠান সম্পাদিত হইলে সেই অনুষ্ঠানের ফলে যজ্ঞফল–যথা স্বর্গলাভ, পুত্রলাভ ইত্যাদি লাভ করা যায়। কোনো দেবতার অনুগ্রহে ও বিদ্বেষে কোনো সুফল বা কুফল হয় না। কাজেই স্বতন্ত্র দেবতা মানিবার কোনো প্রয়োজন নাই। (ভারতীয় দর্শনের ভূমিকা–ড. সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত)

এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য; (১) বৈদিক সাধন-ভজন যজ্ঞের মারফতই চলত। (২) কোনো বিশেষ দেবতার প্রতি আনুগত্য বা ভক্তি প্রদর্শন আবশ্যিক ছিল না, যেমন দেবতাগণ যজ্ঞ মারফত ভোগ পেলেই মূল-স্বরূপ অভিষ্ট বরদানে বাধ্য হতেন (৩) ভক্তিমার্গ ও জ্ঞানমার্গ তখনো প্রচলিত হয়নি, শুধু কর্মমার্গই ছিল। (৪) সৃষ্টি ও স্রষ্টা, জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে গভীরতর জিজ্ঞাসা তখনো প্রবল হয়নি। (৫) তখনো পৌত্তলিকতা প্রশ্রয় পায়নি। এর পরের স্তরে বৈদিক আর্যধর্মের মিশ্র বিকাশ হয় অনার্য সাংখ্য ও যোগদর্শন অবলম্বন করে। পরবর্তী যোগশাস্ত্রে সম্ভবত আর্যপ্রভাবই বেশি। এবং কালিক বিকাশের ধারায় তা জটিল ও বিভিন্নমুখী হয়ে উঠেছে, কপিল সাংখ্য বা পাতঞ্জল যোগের কিছুই এখন অবশিষ্ট রয়েছে বলে মনে হয় না। কপিল-সাংখ্যসূত্র বোধ হয় খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতকে রচিত হয় আর খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি যোগসূত্র রচনা করেন। খ্রীস্টীয় প্রথম শতকের চরক ও আড়াঢ় ঋষি সাংখ্যমত নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক স্যাংখ্যমতের ভিত্তি হচ্ছে খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতকে রচিত ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্য-কারিকা। সুতরাং সাংখ্য ও যোগ যে বৌদ্ধ-জৈন প্রভাবিত তাতে সন্দেহ নেই। কাজেই আলোচনা নিরর্থক। সাংখ্য সিদ্ধান্ত প্রকৃতি ও পুরুষ তত্ত্ব-ভিত্তিক। যোগ ঈশ্বরবাদী, সাংখ্য নিরীশ্বর।

বেদান্ত দর্শনের ভাস্কর বা শঙ্কর সিন্ধুদেশে মুসলমান বিজয়ের পরে আবির্ভূত হন। জ্ঞানমার্গ শঙ্করেরই সৃষ্টি। প্রজ্ঞা দ্বারাই মুক্তি বা মোক্ষলাভ ঘটে। তজ্জন্য কোনো প্রকার যাগযজ্ঞ, সন্ধ্যা বন্দনাদি নিত্য কর্ম; গ্রহণ প্রভৃতিতে স্নান, দান প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম; কিম্বা নানা পূজা-অর্চনাদি কার্যকর্ম করিবার প্রয়োজন নাই। যাহারা বেদবিধি নিষেধাদি মানিয়া চলিবেন তাহারা তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী নন।১ শঙ্করের মায়াবাদ ভাববাদী বৈরাগ্যপ্রবণ দ্রাবিড় প্রভাবের ফল। আনুষ্ঠানিক ধর্মে অস্বীকৃতি বৈদিক প্রভাবমুক্তির পরিচায়ক। জীব ও জগৎ প্রাতিভাসিক সত্যমাত্র–পূর্ণজ্ঞানে অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে এর বিলুপ্তি–এই মায়াবাদ বৈরাগ্যবাদের জন্ম দেয়। শঙ্করের মতবাদকে অদ্বৈতবাদ বলে-ব্ৰহ্ম ছাড়া কিছুই নেই; আর সব মিথ্যে; অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার দরুন জীব বা জগৎ সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে মাত্র। কাছেই ব্ৰহ্ম ছাড়া আর সব মিথ্যে—-একেম মেবা দ্বিতীয়ম শঙ্কর জ্ঞান-প্রজ্ঞালাভের সাধনা ছাড়া অন্য আরাধনা স্বীকার করেন না। শঙ্করের অদ্বৈতবাদ ও জ্ঞানমার্গ প্রবর্তনের মূলে যে ইসলামের প্রভাব রয়েছে–আজকাল তা আর অস্বীকৃত হয় না।

গীতায় ঋগ্বেদের কর্মবাদ স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে অদৃষ্টবাদ–যা বেদে ছিল না, যুক্ত হয়েছ। ফলে ধর্মের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভক্তির রেশ মিশ্রিত হয়েছে। কর্মণ্যে বাদিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন-এ নিশ্চিতভাবে অবৈদিক। স্মরণ রাখা দরকার যে, গীতা অনার‍্যা মেছুনীর গর্ভজাত সন্তানের রচিত।

তারপর মুসলমান বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং তার আগেও ইরানী সূফীতত্ত্বের প্রভাবে ভারতে ভক্তিবাদের উদ্ভব হয়। বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী রামনুজ, দ্বৈতবাদী মাধ্ব ভেদাভেদবাদী নিৰ্ষাকচার্য, শঙ্করের মায়াবাদবর্জিত অদ্বৈতবাদ, চৈতন্যদেবের অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ এর প্রভাবেই উদ্ভূত হয়। এই ভক্তিবাদের মধ্যে অন্তঃ সলিলা ফন্ধুর মতো বৈরাগ্যবাদই জয়ী হল–মূলত শঙ্করের মায়াবাদে ব্যবহারিক জীবনের অর্থাৎ পার্থিব জীবনের যে অসারতা ঘোষিত হয়েছে, তাই ভক্তিবাদের আবরণে স্বীকৃত হল– জগৎ সত্য হলেও নিত্য নয়, সুখময় নয়। কাজেই যা নিত্য, যা চরম, যা পরম, যা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া চলে, নির্ঘ হওয়া সম্ভব হয়–তাকে পাওয়ার সাধনাই জীবনের চরম ও পরম ব্রত হওয়া উচিত। কাজেই অনিত্য সংসারের প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন করাই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞাবানের লক্ষণ।

গীতায় কর্মের কথা আছে, শঙ্করে জ্ঞানের কথা রয়েছে। এই কর্মবাদের সঙ্গে আর্যদের মানস সম্পর্ক গভীরতম, জ্ঞানমার্গের সঙ্গেও যোগ সুদৃঢ়। তাই বর্ণহিন্দুগণ গীতা ও অদ্বৈতবাদ সহজে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ভক্তিবাদের প্রসার অনার্যদের মধ্যেই বেশি। প্রজ্ঞালব্ধ মুক্তি সবার পক্ষে সম্ভব নয়, কর্মলব্ধ মুক্তিও কি সহজ! তাই ভক্তিবাদ আভিজাত্যহীন জনসমাজে সাদরে গৃহীত হল। মানস বৈরাগ্যজাত এই ভক্তিবাদ। নয় শতক থেকেই রাধাবাদের তথা রাধাকৃষ্ণ লীলাতত্ত্বের উদ্ভব। রাধাকৃষ্ণ সম্ভবত দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণ নাপ্পিনাই লীলার প্রভাবে পরিকল্পিত। আর চৈতন্য সমকালে (মুখ্যত চৈতন্যের দান) ভক্তিবাদ প্রেমবাদে পরিণতি পায়।

এদিকে যোগ ও সাংখ্যের প্রভাবে তান্ত্রিক ও যোগ সাধনার বহুল প্রচলন হল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে গীতার কর্মবাদ ও শঙ্করের জ্ঞানবাদ উচ্চশ্রেণী অনার্যদের মধ্যে ভক্তিবাদ এবং নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যে যোগ ও তন্ত্র প্রাধান্য লাভ করেছিল। বৌদ্ধ বজ্রযানীদের থেকেই নাথ-সহজিয়া মতের বিকাশ। এর জের রয়েছে বাউল মতে ও বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বে এবং শৈব সাধনায়।

অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর। এসব ধর্ম ও দর্শন সংস্কার তাদের অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে রয়েছে। তাতে আবার শরীয়তের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয়নি অশিক্ষা ও সূফীমতের প্রবাল্যের দরুন। কাজেই সূফীতত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখা গেছে সেখানেই মুসলমানেরা অংশগ্রহণ করেছে। এভাবে বৌদ্ধ নাথপন্থ সহজিয়ার তান্ত্রিক-সাধনা শাক্ততন্ত্র, যোগ, ইউনানী-দর্শন প্রভৃতি তাদের আকর্ষণ করেছে এবং এভাবে তারা মিশ্র-দর্শনও খাড়া করেছে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেন, আধ্যাত্মিক বা মারফতী সাহিত্যে ইরানের সূফী প্রভাব, বাঙলার বৈষ্ণব প্রভাব এবং হিন্দুর যোগশাস্ত্র ও দেহতত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাব পড়েছে। বৌদ্ধ নাথ ও সহজিয়া পন্থের প্রভাবও রয়েছে এবং বাউল-মুর্শিদা সাহিত্য ছাড়াও নিছক দার্শনিক তত্ত্ব এখানে কম মেলে না। এসব বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ের কারণ বোধ হয় এই যে, মানুষের হৃদয়ানুভূতিতে ও মননে এমন একটি স্তর আছে যেখানে সব ভেদাভেদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমাদের দেশের সাধকগণ অতিমাত্রায় আচারবর্জিত ও মর্মনিষ্ঠ। তাই এমন নির্বিচার সমন্বয় সম্ভব হয়েছে। হরগৌরী সম্বাদ, সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ, জ্ঞান-প্রদীপ, যোগকলন্দর, আগম, জ্ঞানসাগর, আবদুল্লাহর সাওয়াল, মুসার সওয়াল মল্লিকার সওয়াল, ইউনান দেশের পুথি, গোরক্ষ বিজয়, সিরাজ সবিল, নুরজামাল প্রভৃতি গ্রন্থ এ শ্রেণীর। ১

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাঙালি মুসলমান মরমীয়ারা যে সাধনপন্থ আবিষ্কার করেছেন তা একান্তভাবে ইসলামী নয়। বস্তুত ভারতীয় সূফীমতবাদও একান্তভাবে আরব্য-পারসিক নয়। এতে যেমন ভারতীয় দর্শনের প্রচুর প্রভাব পড়েছে তেমনি বাঙালি মরমীয়াদের দর্শনে ও ধর্মে প্রচুর দেশজ তথা ভারতীয় উপাদান রয়েছে। ফলে এদেশে চিরকাল হিন্দু-মুসলমান হাতে হাত মিলিয়ে ও মনে মন মিশিয়ে অধ্যাত্মসাধনা করেছে। এভাবেই বাঙলা দেশে হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত সাধনায় মরমীয়াদের উপমতগুলো সৃষ্ট হয়েছে। অবশ্য নিরক্ষর জনগণের ধর্ম ও দর্শন বলে এগুলো আশানুরূপ পুষ্ট হয়নি। এবং এ-কথাও স্বীকার্য যে বৈষ্ণব মতই প্রথম হিন্দু-মুসলমানকে একই সাধন-ক্ষেত্রে আনয়ন করে। অতএব এগুলো কোনো বিশেষ ধর্মবিশ্বাস বা সংস্কারের পরিচয় বহন করে না। জগৎ ও জীবনের রহস্য সম্বন্ধে মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসা এবং তার রহস্য-উদঘাটনের চির কৌতূহল থেকেই এর জন্ম। এ প্রয়াস তাই ধর্মনিরপেক্ষ। যে স্তরের অনুভূতিতে মানবমনে দেশ-কাল, পাত্র ও বিশ্বাসের ভেদাভেদ ঘুচে যায়-এগুলো সে স্তরের অনুভূতি ও উপলব্ধির অভিব্যক্তি। তাই সৈয়দ সুলতান, মোহাম্মদ খাঁ, শেখচান্দ প্রভৃতি ইসলাম ও নবীকাহিনী যেমন শুনিয়েছেন, তেমনি আবার এসব মরমীয়াবাদও প্রচার করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *