পূর্বপুরুষ : উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য

পূর্বপুরুষ : উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য

০১.

নির্বোধ যখন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ঘরে-সংসারে তখনই যথার্থ বিপদ নেমে আসে, ক্ষতির ঝুঁকি তখনই বেড়ে যায়। নির্বোধের কোনো স্বকীয় অভিজ্ঞতা থাকে না। পরের জ্ঞানে সে জ্ঞানী, পরের মুখে শোনা যুক্তিপ্রয়োগে সে তার্কিক।

মানুষের সমাজে প্রগতির বড় বাধা এই নির্বোধেরাই। তারা অবশ্য বৈষয়িক ব্যাপারে নির্বোধ নয়। বলতে গেলে তাদের অর্জিত বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, উদ্যম সবকিছুই তারা তাদের বৈষয়িক জীবনের নিরাপত্তা ও প্রসারের জন্যে নিয়োজিত করে। তাই তারা সমাজ–ধর্ম-রাষ্ট্রবিজ্ঞান-দর্শন প্রভৃতির তত্ত্বচিন্তার ভার কয়েকজনের উপরেই ছেড়ে দেয়। এবং নিজেদের পছন্দমতো কারো ভাব চিন্তা ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রতি আনুগত্য রেখে দিব্যি সুখে জীবন কাটায়। কিন্তু তাদের সমর্থিত চিন্তা ও চিন্তানায়কদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী চিন্তা ও চিন্তানায়কদের মত-পথের দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হলে কাক শেয়ালের মতো স্ব স্ব নায়কের পক্ষে হৈ চৈ, মারামারি কিংবা প্রয়োজনমতো হানাহানি শুরু করে দেয়। জীবনের অন্যক্ষেত্রে যতই তাদের দায়িত্ববোধ কিংবা কর্তব্যবুদ্ধির অভাব থাক, এ ক্ষেত্রে তাদের সতর্কতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সঙ্প্রীতি নির্ভেজাল। এভাবে তারা হযরত মুসা-ঈসা-মুহম্মদ প্রমুখ অনেককেই লাঞ্ছিত, বিতাড়িত ও হত্যা করেছে।

.

০২.

তাঁদের বিশ্বাস, যুক্তি ও নীতি একটিই।

আমাদের পূর্বপুরুষ আমাদের ভাবনা ভেবে রেখেছেন। আমাদের তারা ধর্ম দিয়েছেন, আদর্শ দিয়েছেন, রীতি দিয়েছেন, নীতি শিখিয়েছেন, আচার জানিয়েছেন, আচরণ বাতলিয়েছেন, খাদ্যতালিকা দিয়েছেন, পোশাকের আদল দিয়েছেন, হাসি-কাসি-হাই তত্ত্ব রেখে গেছেন, দিন-ক্ষণ মাস-রাশি-নক্ষত্র জানিয়েছেন। আকাশ ও পৃথিবীর তথ্য, ইহ-পরকাল তত্ত্ব পাপ-পুণ্য ও স্বর্গ-নরক চিত্র –এর কোন্‌টি আমাদের আর জানতে বাকি আছে! এতে দর্শন-বিজ্ঞানের কোন্ তত্ত্ব নেই! কী তাঁরা দিয়ে জাননি যে আমরা নতুন করে খুঁজে খুঁজে খেটে খেটে হয়রান হব!

যারা পূর্বপুরুষের গড়া জীবন-ছাঁচ অবহেলা করে তারা পামর। এ সম্পদ, এ রিথ যারা অগ্রাহ্য করে তারা জাহিল। যারা বিদ্রূপ করে তারা নাস্তিক, যারা বিদ্রোহ করে তারা অভিশপ্ত শয়তান। কেননা পুরোনো কালেই বিধাতা নিজে এসে তার নির্বাচিত প্রিয়জনদের পাঠিয়ে শিশু ও পশু মানুষকে জীবনের যা কিছু জ্ঞাতব্য, যা কিছু কর্তব্য, যা কিছু প্রয়োজনীয়, তা শিখিয়ে পড়িয়ে বুঝিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। সেসব ত্রিকালজ্ঞ নবী-ঋষির মতো জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক পৃথিবীতে কখনো হয়নি, কখনো হবে না। কারণ তাঁরা ছিলেন বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি বিশেষ মানুষ– লোক-শিক্ষক।

অতএব আমাদের কর্তব্য প্রদত্ত জ্ঞান আয়ত্ত করা, বিধি-নিষেধ মেনে চলা, তাঁদের প্রদর্শিত জীবন-পদ্ধতি অনুসরণকরা আর নিশ্চিন্তে জীবিকা অর্জনে মনোযোগ দেয়া। আহা তাঁদের দানের তুলনা নেই? আমাদের কাজ কেবল কৃতজ্ঞ ও অনুগত থাকা। নিতান্ত জাহিল অর্বাচীন না হলে কি কেউ এমন নিশ্চিন্ত নীড় ভাঙে, এমন সুখের জীবন পায়ে ঠেলে!

.

০৩.

অপরপক্ষের কথায় তারা কান দেয় না। কারণ তারা বিশ্বাস ও বিস্ময়কে জীবন-যাত্রার পাথেয় করেছে। বিধির ও ভগবানের অর্থাৎ নিয়ম-নীতি ও নিয়ন্তার অনুগত হলে বিবেক থাকে অবহেলিত। নিজেরা চিন্তা করে না, কাজেই নতুন যুক্তি খুঁজে পায় না, তাই নতুন জীবন-দৃষ্টিও লাভ করে না। বিশ্বাসে ও শ্রদ্ধায় তারা অভিভূত। তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন। তাদের মন ভয়-ভরসায় বিমূঢ়। নইলে তারা ভোলা চোখেই দেখতে পেত বিধাতার বরপুষ্ট মানুষ যা ভাবতে-খুঁজতে বুঝতে-করতে পারেননি, আজকের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-মনীষীরা তা পেরেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস দর্শন কিংবা অভিজ্ঞতা ও জীবনের ক্ষেত্রে সেদিন যা ছিল অভাবিত ও অসম্ভব, আজ তা মানুষের আয়ত্তে। আজকের মানুষের এত বড় সর্বাত্মক সাফল্য দেখেও যারা প্রাচীন নবী-ঋষির তুলনায় আজকের জ্ঞানী-মনীষীকে তত্ত্ব ও তথ্যের ক্ষেত্রে নির্বোধ-নির্জন ভাবতে পারে তাদের অন্ধতা ঘুচবার নয়।

আশ্চর্য, ছোটখাটো ব্যাপারেও তারা প্রশ্নহীন। পূর্বপুরুষের নির্ধারিত খাদ্যতালিকাও আমাদের রদবদলের অধিকার নেই। হালাল আর কখনো হারাম হবে না, হারামও হতে পারে না হালাল। পোশাকের পরিবর্তনও দূষণীয়। পৈত্রিক শত্রুকেও বন্ধু করা চলবে না। চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবী, কান্তার মরু-পর্বত-সমুদ্র সম্বন্ধেও আমাদের তাত্ত্বিকজ্ঞানের পরিবর্তন পাপপ্রসূ। কেবল পূর্বপুরুষের কদম মোবারক শরণ ও অনুসরণ করেই মানুষ থাকবে কৃতার্থ ও তৃপ্তমন্য।

তারা অবশ্য জানে, তাদের নবী-ঋষিরা অজ্ঞাতপূর্ব জ্ঞান দিয়েছেন এবং অশ্রুতপূর্ব নতুন কথা বলেছেন, নতুন ধর্মমতও প্রবর্তন করেছেন। এবং তা বিধাতার অভিপ্রায় ও অনুমোদনক্রমেই সম্ভব হয়েছে। কলিকালে ঈশ্বর আর কোনো পরিবর্তন কামনা করেননি। তিনি যে-পাট চুকিয়ে দিয়েছেন কলিকালে শয়তান তা খুলে বসেছে। শয়তানের চেলারাই কেবল পরিবর্তন প্রয়াসী ও নতুনের সন্ধানী। তারা এ-ও জানে তাদের প্রত্যেকেরই পূর্বপুরুষ সুদূর সেকালে কিংবা অনতি অতীত একালে কোনো-না-কোন সমকালীন নতুন ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। এবং তাদের মতে শেষবারের মতো সত্যধর্ম বরণ করে তাদের পূর্বপুরুষরা ঈশ্বর-দত্ত শেষ সুযোগ লাভের অনুগ্রহ লাভ করেছেন। এটিই ছিল বিধাতার সর্বশেষ আনুশাসনিক ও প্রশাসনিক সংস্কার বা পরিবর্তন। এর পরে তো বিধাতা প্রলয় অবধি বিশ্রাম-সুখই লাভ করেছেন।

.

০৪.

বিশ্বাসের অঙ্গীকারে ধর্মবোধের উদ্ভব ও স্থিতি। তাই ধর্মভাব অশিক্ষিত মানুষের ভূষণ, এবং ধর্মাদর্শ তাদের জীবনের দিশারী। ধর্মীয় নীতি ও রীতি তাদের জীবনযাত্রার পথ ও পাথেয়। লেখাপড়া-জানা ধর্মভীরু মানুষেরও মনোভূমি অনাবাদে অপচিত। আর একশ্রেণীর শিক্ষিত অথচ চরিত্রহীন বুদ্ধিমান দুরাত্মা সব জেনেবুঝেও স্বস্বার্থে এই বিশ্বাস-সংস্কার ও স্মৃতিকে প্রশ্রয় দিয়ে, পুঁজি করে মানুষকে শাসন-শোষণের আনন্দ, আরাম, গৌরব ও সম্মান লাভ করে। ধর্ম কিন্তু সব মানুষের সমান উপকার করে না। ধর্মের বিধি-নিষেধ প্রয়োগে বড়লোকের-ছোটলোকের ও নারী-পুরুষের পার্থক্য স্বীকৃত। রাজা যুদ্ধ করেন, পররাজ্য কেড়ে নেন, মানুষ হত্যা করেন –এতে পাপ নেই। সাধারণ লোক না বলে পরের তৃণখণ্ড নিলেও চৌর্যের কিংবা পীড়নের পাপ স্পর্শ করে। তাছাড়া ধর্ম বাধাপথে চলার যান্ত্রিক সুবিধা দান করে বটে, কিন্তু মনুষ্যত্ব বিকাশের কিংবা মানবিক বোধ-বুদ্ধির স্বাধীন প্রয়োগের অধিকার হরণ করে। ধার্মিক মানুষ পোষমানা প্রাণী। কেননা তার মন-বুদ্ধি বিবেকের স্বাধীন প্রয়োগ-পথ থাকে রুদ্ধ। এই মানুষ গোঁড়া, অসহিষ্ণু ও অনুদার না হয়ে পারে না।

অথচ ভাব-চিন্তা-কর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও স্বকীয়তাপ্রসূত নতুন কিছু করতে গিয়ে ভুল করার অধিকারই মানুষের স্বাধীনতার ভিত্তি। কারণ ভ্রান্তি থেকেই সত্যকে ও শ্রেয়সকে চেনা যায়। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করে মানুষের এই মৌল অধিকারই অহরহ হরণ করছে। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র সমাজবদ্ধ মানুষকে শেখায় ফানাতত্ত্ব। অর্থাৎ ব্যক্তি-জীবন হবে সমাজ-স্বার্থের অনুগত যৌথ জীবনের প্রত্যঙ্গ। কারণ তার স্বাতন্ত্র্য সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক। অথচ ব্যক্তিজীবনের স্বাতন্ত্র্য, নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন বিকাশ লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল যৌথ আবাস, আচার ও কর্ম। অবশেষে মুক্তির অবলম্বন হয়ে উঠেছে বন্ধনের শৃঙ্খল। কিন্তু ভৌগোলিক সংহতি ও গণশিক্ষা–ব্যক্তিজীবনে না হোক, সামগ্রিক জীবনে আজ নতুন চেতনা দান করেছে। তাই দুনিয়ার সর্বত্র দেখা দিয়েছে দ্রোহ।

.

০৫.

জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্যেই মানুষ হল যূথবদ্ধ। আর যৌথ জীবনের নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রী শক্তি হিসেবে গড়ে উঠল সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র। এই তিন মনিবের ঘর করে মানুষ, সেবা করে তিন মালিকের, শাসন মানে তিন প্রভুর। মানুষ যেন সেভুইচড, গলে বের হবে, সে সাধ্যও নেই। কিন্তু যাদের কথা বলছি, তারা তা অনুভব করে না, তারা মনে করে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে আসমান ও জমিনের মালিকের হেফাজতে পাখির মতো তারা সোনার টঙ্গীর আশ্রয়ে রয়েছে, লীলাময়ের ইচ্ছে ব্যতীত সেখানে সাপ-বেড়ালের উপদ্রব ঘটে না। অথচ জীবন বিকাশের অবলম্বন হিসেবেই সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের উদ্ভব। জীবনবোধ ও প্রয়োজন বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মবুদ্ধির ও ধর্মনীতির প্রসার ও পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি বলে পুরোনো ধর্ম লোপ পেয়ে নতুন ধর্মের ঠাই করে দিয়েছে। মানুষ অবশ্য কোনোদিন সচেতন ভাবে তা চায়নি। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই তা ঘটেছে। প্রয়োজনের শক্তি অপ্রতিরোধ্য। সেই প্রয়োজন প্রাকৃত শক্তির মতো অমোঘ, নদীর স্রোতের মতো তীরপ্লবী ও কূলগ্রাসী। যে-মানুষের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠা পায়, তিনিও জানেন না তিনি কী কারণে কোন্ অমোঘ শক্তির প্রভাবে কী করছেন।

আজো সে নিয়মেই সব ভাঙছে, হচ্ছে, চলছে। কিন্তু সমকালীন মানুষ তা বুঝতে পারে না। চলন্ত ট্রেনে বসে সে ভাবছে, পাশের বস্তুই চলছে তার ট্রেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মন স্থিতিকামী, তাই তার এ বিভ্রান্তি। তার জীবনে কাজে লাগছে না, তবু সে ধর্ম ও সমাজ-ভূতের ভয়-ভরসা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ধর্ম ও সমাজকে সে ভালোবাসে না, ভয় করে। সে-জুজুর ভয় তার দিবারাত্রির বিভীষিকা। ক্রীতদাসের অসহায়তায় ও আত্মসমর্পণেই তার স্বস্তি। সে কেবলই আত্মরক্ষায় উদ্বিগ্ন, তাই বাঁচার স্বাদ সে পায় না। মৃত্যুভীরু জীবনের মমতায় সদা ব্যাকুল, তাই জীবনের প্রসাদ থেকে সে হয় বঞ্চিত।

.

০৬.

যারা নতুন জীবন কামনা করে, আত্মপ্রত্যয় যাদের প্রবল, তারা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রকে জীবনের অনুগত করে। ওগুলোর পুরোনো নিয়ম-নীতির কাছে আত্মবলি দেয় না। অতীত কারো জীবনের আদর্শ হতে পারে না। কেননা অতীত কখনো ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে না। ঐতিহ্যও প্রেরণার উৎস নয়। তাহলে গ্রীক-রোমান-আরবের পতন হল কেন? এটিলা-চেঙ্গিস-বুদ্ধ-হোমারের কী ঐতিহ্য ছিল? ঐতিহ্য বলে যদি কোনো কিছু মানতেই হয় তাহলে এক মানুষের পক্ষে যা সম্ভব অন্য মানুষের পক্ষেও তা সাধ্যাতীত নয় –এই মানবিক ঐতিহ্যে আস্থাই যথেষ্ট। অতীত যদি কোনো কাজে লাগে তবে তা ধর্ম বা সমাজের নীতি-আদর্শ নয়– ইতিহাসের জ্ঞান ও শিক্ষা।

অতীত ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণা মোটেই পষ্ট নয়। একটা শোনা-কথা আপ্তবাক্য রূপেই আমরা আওড়িয়ে চলছি মাত্র। যা পিছনে ফেলে আসি, যা চুকে-বুকে যায় হারিয়ে যায়, তাই অতীত। সে-স্মৃতি আমাকে কেবল ধরে রাখতে পারে, এগিয়ে দিতে পারে না। মানুষ তার চোখ দিয়ে সুমুখেই কেবল দেখতে পায়, সচেতন প্রয়াসে পাশেও। কিন্তু পিছনে তাকাতে হলে পিছনকে সুমুখ করতে হয়। অতীতকে স্মরণে রাখতে গেলে ভবিষ্যৎকে ভুলতে হয়। চোখের স্থিতি ও পায়ের পাতার বিস্তৃতি দেখে তো মনে হয় স্রষ্টা মানুষকে সুমুখে দেখবার ও এগুবার ইঙ্গিতই দিয়েছেন।

আমার প্রপিতামহের জমিদারি ছিল, আমার পিতার প্রপিতামহ কবিতা লিখেছিলেন, আমার পিতামহ দীঘি দিয়েছিলেন, আমার পিতা বিদ্বান ছিলেন, আমি সামান্য লেখাপড়া শিখে সম্প্রতি ঢাকায় এক দোকানে কর্মচারী। নিবাস তাঁতিবাজারের এক মেস। ঐতিহ্য আমাকে কী দিল?

হোমার-শেকস্পীয়র-টলস্টয়-কালিদাস-সাদী লিখিয়ে হলেন, তাদের কারো পিতৃপুরুষের কেউ লেখক ছিলেন না। আবার রবীন্দ্র-নজরুলের সন্তান কবি হতে পারলেন না। আদম-সন্তান কাবিল হল লম্পট, নূহর সন্তান হল পিতৃদ্রোহী। ঐতিহ্যের প্রভাব কোথায় পড়ল? সভ্যতায় ও শাসনে কালো আফ্রিকার কী ঐতিহ্য আছে? তাই বলে কি তারা আরণ্য থাকছে? আমার চৌদ্দপুরুষের কেউ লেখাপড়া করেননি, বাবা ছিলেন ক্ষেতমজুর; আমি বিদ্বান, বড় চাকুরে, অবশেষে মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হলাম। এ তো হবার কথা নয়।

ভূঁইফোড় লোক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, আর রাজার ছেলে রাজ্য রক্ষা করতে জানেন না। এই বা হবার কারণ কী! ব্যক্তিক কিংবা জাতিক জীবনে ঐতিহ্যই যদি প্রেরণার আকর ও আত্মোন্নয়নের ভিত্তি হত তাহলে সমাজে কিংবা দেশে কোনো মানুষের বা জাতের জীবনে উত্থান-পতন থাকত না। বর্ণে বিন্যস্ত হিন্দুসমাজের মতো জন্মসূত্রেই জীবন ও জীবিকা নিয়ন্ত্রিত হত। কেননা যার ঐতিহ্য নেই, সে তা কখনো অর্জন ও সৃজন করতে পারত না। ঐতিহ্য বলতে আমরা ভালো কৃতিই বুঝি– মন্দকৃতি ঐতিহ্য নয়। মানুষ কি এতই সুবোধ ও সুশীল যে সে কেবল পূর্বপুরুষের ভালটাই গ্রহণ করবে আর মন্দটা পরিহার কবে? ভালোটা শরণ করতে গেলে মন্দটা মনের কোণে উঁকি দেবে– আর ভালটাকে কেউ শরণ করলে মন্দটাও তাকে অনুসরণ করবে। কে না জানে মানুষের মন্দের আকর্ষণই বেশি? কারণ শয়তান অলস নয়।

বস্তুত পূর্বপুরুষের বস্তুগত সম্পদের উত্তরাধিকারই মানুষ পেয়ে থাকে-যা দৃষ্টিগ্রাহ্য ও কেজো। মানস-উত্তরাধিকার বলে কিছু যদি থাকেও তা সামান্য ও প্রয়োগসাপেক্ষ। এবং প্রয়োগের জন্যে চাই প্রয়োজনবোধ। এই প্রয়োজনবুদ্ধি জাগে আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মশক্তি সচেতন ও কাক্ষী মানুষের। আর এ তিনটে গুণই স্বকীয়তার স্বাক্ষর বহন করে। এ মানুষের ঐতিহ্য থাকা না-থাকায় কিছু যায় আসে না। সে হয় স্বসৃষ্ট –এটি ব্যক্তিক ও জাতিক জীবনে উভয়ত সত্য। দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মোন্নয়নের পন্থা এই একটিই। আমার পিতার প্রাথমিক শিক্ষাটাই গৌরবের ও গর্বের হল, আর আমার এম.এ ডিগ্রীটা তুচ্ছ? বাবার কুটিরটারই গর্ব করব, আমার দালানটা কিছুই নয়? সচল ব্যবহারিক জীবনে স্থান-কাল ভেদে আচারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক রীতিনীতি– যতই মন্থর হোক–পরিবর্তিত হয়, কেবল ধার্মিক জীবনের নীতিই থাকবে ধ্রুব এ কেমন কথা। এ ক্ষেত্রে কি জীবনের গতিশীলতার কোনো চাহিদা নেই। কার্যত ধর্মনীতিও লঙ্ঘিত হয়, কেবল স্বীকার করতেই আপত্তি। নইলে একই ধর্মে এত বিভিন্ন মত-পথবাদী সম্প্রদায় গড়ে উঠল কী করে!

তাছাড়া, অর্জন-বিমুখ মানুষ পূর্বপুরুষের ধনে ধনী থাকতে পারে না। সে দরিদ্র হতে থাকে ব্যক্তিক ও জাতিক জীবনে –-এ স্বতেসিদ্ধ তথ্য। এবং রিখথ হিসেবে প্রাপ্ত কোনো বাস্তব সম্পদও সমকালীন জীবনের ব্যবহারিক-বৈষয়িক চাহিদা মিটাতে পারে না। কেননা তার কেবল ক্ষয়ই আছে, বৃদ্ধি নেই। স্বােপার্জিত সম্পদ বাড়তির লাবণ্যে প্রাণপ্রদ। পিতৃসম্পদ জীর্ণতার জনক। জোয়ারভাটার মতো আয়-ব্যয়ে বহমানতা থাকা চাই। প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতে গৌরব নেই। প্রয়াসের মধ্যেই প্রাণের পরিচয় ও বিকাশ। আসলে ঐতিহ্য মানুষকে ধরে রাখে, এগিয়ে দেয় না। স্থিতির জীর্ণতা ও জড়তা তাকে পেয়ে বসে, গতির প্রাণ ও প্রেরণা থাকে অনায়।

এই পুরোনো পৃথিবী প্রতি-মানুষের চোখে নতুন করে দেখা দেয় বলেই পৃথিবী সুন্দর। প্রতিটি জীবন নতুন করে আবিষ্কার করে আপনার ভুবন। নতুন জীবনের চাহিদা মিটাতে দেশগত ও কালগত জীবনের অনুগত করে বদলাতে হয় ধর্মনীতি, সমাজরীতি ও রাষ্ট্রবিধি। প্রাণের সচলতার প্রতীক হচ্ছে সৃজনশীলতা, নতুনের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের দিকে এগুবার আগ্রহ। জরা ও জড়তার ধর্ম হচ্ছে অতীতকে ও স্থিতিকে আঁকড়ে ধরে রাখা। কেননা জরা ও জড়তার ভবিষ্যৎ নেই, কেবল অতীতের স্মৃতিই থাকে। ভবিষ্যতে তার মৃত্যু-ত্রাস, অতীতে তার মধুর স্মৃতি।

পূর্বপুরুষের দানে নয়, মানুষকে বাঁচতে হয় স্বকালে স্বদেশে স্বকীয় সৃষ্টিতে। অন্যের কৃতির ফল ভোগ করার গ্লানির মধ্যে নয়, নিজের কৃতি ও কীর্তির উল্লাসের মধ্যে বাঁচাই যথার্থ বাঁচা। মানুষের এ-ই কাম্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *