দূর্বা

দূর্বা

আমাদের দেশে বরণডালায় ধান ও দূর্বা রাখার রেওয়াজ আছে। দুটোই আদিম অস্ট্রিক সংস্কার। একটি প্রাণের প্রতীক, অপরটি জীবিকার। দূর্বার প্রাণশক্তি দুর্বারই বটে। যতই দলিত হোক, যতই তাপদগ্ধ হোক, একবার পানির স্পর্শ পেলেই জেগে ওঠে। বাসন্তী হাওয়া, বিশেষ করে বৃষ্টির পানি পেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মরা দূর্বা সবুজের সমারোহ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এক ধান জন্ম দেয় শত ধানের। তাই দূর্বা ও ধান হয়েছে আয়ুষ্কামী ও প্রাচুর্য-প্রত্যাশী মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতীক।

সর্বপ্রাণবাদী ও জাদুবিশ্বাসী মানুষের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় থেকেই এ প্রতাঁকের উদ্ভব। প্রকৃতিই মানুষের আদি ও অকৃত্রিম শিক্ষক এবং চিরন্তন জ্ঞানের উৎস। জীবনের মৌল প্রয়োজনবাঞ্ছা কেমন আশ্চর্য ঋজুতায় অভিব্যক্তি পেয়েছে ধানে ও দূর্বায়। এর মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞতা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মনন ও কবিত্বের অনন্য সমন্বয় ও অপরূপ মাধুর্য।

এজন্যে প্রকৃতির মতো শিক্ষক নেই–প্রকৃতির মতো গ্রন্থ নেই। দুনিয়ার বহু মহামানব প্রকৃতি থেকে পাঠগ্রহণ করেই হয়েছেন লোক-শিক্ষক। প্রকৃতির পাঠের আদি অন্ত নেই। এ গ্রন্থ চিরনতুন ও চিরন্তন জ্ঞানের আধার। উৎসুক দৃষ্টিতে কৌতূহল নিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকালেই নব নব তাৎপর্যে প্রকৃতি নতুন হয়ে ধরা দেয়। তার বিচিত্র রহস্য-চেতনা মানুষকে করে জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ।

দূর্বার সুপ্তি আছে–আত্মগুপ্তি আছে কিন্তু মৃত্যু নেই। মানুষেরও প্রয়োজন-চেতনার শেষ নেই। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মানুষের যে-চিন্তা তারও ক্ষয় নেই, নেই মৃত্যু। অন্ন ও আনন্দের অন্বেষা মানুষকেও দূর্বার মতোই দেয় দুর্বারশক্তি। তাই মানুষের চিন্তার উন্মেষ কখনো রোধ করা যায় না। তার বিকাশ প্রবলতর শক্তি সাময়িকভাবে হয়তো ঠেকিয়ে রাখতে পারে; কিন্তু নির্মূল করবার শক্তি নেই কোনো মর্তমানবের। শোনা যায়, চারাগাছের ডগা ছাগলে চিবোলে তা বাড়ে না। তেমনি সমাজের কিংবা শাসকের বিরূপতায় চিন্তাও স্বাভাবিক বিকাশ পায় না। ছাগলের মুখ-লাগা চারার মতোই তা রুদ্ধ-বাড় হয়েই বেঁচে থাকে। আবার উদ্ভিদ জগতে এমন অনেক বৃক্ষ দেখা যায় যাদের গোড়া কেটে দিলেও প্রাণ হারায় না। বরং রক্তবীজের মতোই অসংখ্য হয়ে নব নব কিশলয়ের ধ্বজা নিয়ে আকাশের দিকে মাথা বাড়ায়। সামাজিক-রাষ্ট্রিক পীড়নও তেমনি চিন্তার প্রসার ঘটায়। কেননা নির্ধ-নির্বিঘ্ন পরিবেশে চিন্তার জন্ম নেই। সব প্রয়াসের পশ্চাতেই থাকে অভাববোধ। প্রাপ্তির প্রয়োজন-চেতনা না জাগলে প্রয়াসের প্রেরণা জন্মায় না। কাজেই বাধাই বাধা ছিন্ন করার প্রেরণা যোগায়, বন্দিত্বই জাগায় মুক্তির কামনা, পরাধীনের স্বাধীনতাবাঞ্ছাই যোগায় সংগ্রামের শক্তি। তেমনি চিন্তার স্বাধীনতা যেখানে অস্বীকৃত, চিন্তার প্রয়োজন ও প্রেরণা সেখানেই প্রবল।

জীবন-প্রতিবেশে যখন অসঙ্গতি, অন্যায়, পীড়ন ও অভাব দেখা দেয়, অর্থাৎ যখন জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা নেমে আসে, তখনই তার কারণ নিরূপণ ও কারণ আপসারণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এবং তখন মননশীল, দায়িত্বসচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ মানুষ প্রতিকারের উপায় খোঁজে। এতেই নতুন চিন্তার জন্ম হয় এবং মতরূপে, ধর্মরূপে, নীতিরূপে ও আদর্শরূপে তা কর্মে ও আচরণে অভিব্যক্তি পেতে থাকে। যারা বর্তমান পরিবেশের সুযোগে বড় হয়েছে কিংবা বড় রয়েছে, তারা এ পরিবেশের পরিবর্তনে আতঙ্কিত হয়। কেননা পরিবর্তিত পরিবেশে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কাজেই স্থিতিতে তাদের মঙ্গল, গতিতে অকল্যাণের আশঙ্কাই প্রবল। তাই তারা সর্বপ্রকার নতুন ভাব-চিন্তা-আচার ও রীতিনীতি-পদ্ধতির প্রতিরোধকল্পে মরিয়া হয়ে দাঁড়ায়। তারা ইতিহাসে রক্ষণশীল কিংবা গোড়া অভিধা পায়। তারা সংখ্যায়ও থাকে গরিষ্ঠ। তবু তাদের আপাতপ্রাবল্য পরিণামে তাদের পরাজয়ের পথই মুক্ত করে দেয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য তারা স্বার্থবশে অস্বীকার করে। ফলে নতুনের জয় যে অবশ্যম্ভাবী তা তারা। মানতে চায় না। তারা যতই আঘাত হানে, আহত ততই প্রবল হয়। আপাত পরাজয়ের ছলে জয়ের নিশানই হাতে পায় আহত। হযরত ইব্রাহীম, হযরত মুসা, হযরত মুহম্মদকে পালাতে হয়েছিল, মরতে হয়েছিল হযরত ঈসাকে। এর আগে-পরেও এমনি কত কত ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু জয়ী হয়েছেন পলাতক-পরাজিত-নিহতরাই। কাজেই কোনো প্রতিকূল প্রতিবেশেই নতুন চিন্তার মৃত্যু নেই। সে চিন্তা বরং দূর্বার মতোই হয় দুর্বার–কাটাগাছের অঙ্কুরের মতো জেগে ওঠে স্পর্ধায়, ঔদ্ধত্যে ও প্রাণপ্রাচুর্যে।

যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, প্রতিযোগিতা নেই, সেখানে জীবনের বিকাশ নেই, উল্লাস নেই, প্রেরণা নেই, নেই কোনো প্রয়াস। জীবনের জাগরণের জন্য চাই দ্বন্দ্ব, চাই সংঘাত। আর দ্বন্দ্ব সগ্রামের পূর্বগামী হচ্ছে স্বপ্ন-ভাব-চিন্তা-পরিকল্পনা, সহচর হচ্ছে কর্ম। এ দ্বন্দ্বে-সংঘাতে যারা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে পাপী-অপরাধী-আসামী–পরিণামে জয়ী হয় তারাই। এমনি নতুন চিন্তা আঘাতেই জাগে। তাই এ চিন্তা আঘাতেরই সন্তান। এই অর্থেই আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার।

দূর্বা ক্ষুদ্র ও কোমল। পায়ে দলিত হওয়াই তার নিয়তি। তবু সে অমর ও চিন্ময়–সবুজ ও প্রাণময়। তেমনি মানবদরদী ও মানবতাবাদী মনীষীরা সংখ্যায় নগণ্য বাহুবলে তুচ্ছ। নির্যাতনই তাদের ললাটলিপি। তবু তারাই মানবভাগ্যের নিয়ন্তা। তাঁরা ভাঙেন কিন্তু মচকান না। নিজেরা মরেন কিন্তু দিয়ে যান আবেহায়াত। চিন্তাবিদ বাহ্যত একক ব্যক্তি, কিন্তু আসলে রক্তবীজ। দূর্বার মতোই চিন্তা ও চিন্তাবিদের ধ্বংস নেই। সে মরে মরেই বাঁচে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *