ঐক্যসূত্র

ঐক্যসূত্র

০১.

প্রাণী হিসেবে মানুষ একটা Species বা প্রজাতি। এ কারণে মানুষ মাত্রেরই জীবন- চেতনায় কতগুলো মৌলিক ঐক্য রয়েছে। ঘৃণায় ও ভালোবাসায়, লোভে ও ত্যাগে, ক্ষমায় ও প্রতিহিংসায়, সমাজবোধে ও সহযোগিতায়, দায়িত্বচেতনায় ও কর্তব্যবোধে, দ্বন্দ্বে ও সংগ্রামে মানুষ প্রায় সর্বত্রই অভিন্ন। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বোধের তারতম্য বা মাত্রাভেদ আছে মাত্র।

আবার প্রাচীন গোত্রীয় সমাজভুক্ত মানুষে কিংবা পরবর্তীকালের ধর্মীয় মতভুক্ত সমাজেও একপ্রকার আচারিক ঐক্য মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেছে।

তাছাড়া, ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীগত অভিন্নতাও মানুষের জীবনযাত্রায় ঐক্যদান করে।

কাজেই মানবিক ঐক্য, গোত্রীয় ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য ও ভাষিক ঐক্য মানুষের মনে, মননে ও ব্যবহারিক জীবনযাত্রায় তাদের স্ব স্ব প্রভাব রাখে।

এদের প্রত্যেকটিরই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। কখনো অভিন্ন ভাষার প্রভাবে কখনো অভিন্ন ধর্মের প্রেরণায়, কখনো ভৌগোলিক জীবনের প্রয়োজনে, কখনো গোত্রীয় আকর্ষণে অতীতে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনে ও জীবিকায় বিকাশ, প্রসার ও সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। এখনো যে তা একেবারে অবলুপ্ত তা বলা যাবে না।

অতএব দেখা যাচ্ছে চিন্তার ও জীবিকার অভিন্নতা তথা মতের ও স্বার্থের ঐক্যই মানুষকে দিয়েছে সজ্ঞাবদ্ধতা, দিয়েছে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যৌথ প্রয়াসের প্রেরণা। কেননা সাধারণ মানুষের জীবনচেতনা ও অধিকারবোধ তখনো সূক্ষ্ম হয়ে ওঠেনি। স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মপ্রত্যয়প্রসূ জ্ঞানের ও সামর্থ্যের অভাবে তারা তখনো সর্দার বা গোত্রপতি-নির্ভর জীবনে স্বস্তি খুঁজেছে। বৈষয়িক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য তখনো নিজের হাতে নেবার উপায় ছিল না পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীগত কারণেই। তাই গ্রীক City state থেকে অত্যাধুনিক কাল অবধি প্রবল দুরাত্মারাই জনগণের জীবন-জীবিকা নিয়ন্ত্রণের তথা শাসন-শোষণের নির্বিঘ্ন অধিকার পেয়ে এসেছে। তারাই অজ্ঞ ও দুর্বল জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে রাজার সুখেই প্রজার সুখ, রাজার গৌরবেই রাজ্যের গৌরব, রাজার ঐশ্বর্যই জাতির সম্পদ, রাজার যশই দেশের যশ, রাজার বিলাসেই গণ-সংস্কৃতির বিকাশ। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা, রাজা ও রাজপার্ষদ–দু-ই দেশ ও জাতির প্রতিভূ এবং তাঁদের যশ-মান-সম্পদই জাতীয় সমৃদ্ধি ও গৌরবের প্রতীক। আর মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ তার নিয়তি-নির্ধারিত। রাজার কেবল শাসন-শোষণের বিধিদত্ত অধিকারই আছে, পোষণের দায়িত্ব কিংবা দুঃখমোচনের কর্তব্য তার নয়। তাই কোনো রাজা যদি দীঘি-সড়ক-সরাই দিতেন, তিনি হতেন মহানুভব, মহামতি বদান্য রাজর্ষি।

.

০২.

সে-দিন ও সে-মন আর নেই। আবিষ্কৃত যন্ত্রের প্রয়োগে আজকের দিনে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে। ভাব-চিন্তা-কর্মেও এসেছে বক্রতা ও বৈচিত্র্য। পণ্য উৎপাদনের সহজতা, জনসংখ্যাবৃদ্ধি, জনসংখ্যার অসম সংস্থিতি এবং যন্ত্রবিজ্ঞানে অধিকারের রাষ্ট্রিক তারতম্য প্রভৃতি অসামান্যরূপে জটিলতর করেছে মানুষের জীবিকার সমস্যা। ফলে মানুষ মরিয়া হয়ে খুঁজেছে বাঁচার পথ। সে-বাঁচার পথ এক-এক জনের চোখে এক-এক রকম। মেরে বাঁচা, কেড়ে বাঁচা কিংবা বন্টনে বাঁচা যেমন, তেমনি সহযোগিতায়, সহ-অবস্থানে ও সমদর্শিতায় বাঁচাও সম্ভব। কাজেই নানা বিরুদ্ধ-পথের বিভ্রান্তি ও বিবিধ বিপরীত মতের সংঘর্ষে মানুষের বৈষয়িক ও মানসিক তথা জৈবিক ও মানবিক সমস্যা জটিল ও বিপুল হচ্ছে। আর আনুপাতিক হারে মানুষ কখনো স্বাতন্ত্রে, কখনো সহযোগিতায়, কখনোবা জাতীয়তায়, কখনো মানবতার আদর্শে, কখনো আত্মরক্ষার নামে এসবের সমাধান খুঁজেছে। তাই দুনিয়াব্যাপী সমস্যা-পীড়িত দুর্বলরাষ্ট্রে নানা আনুষঙ্গিক উপসর্গও দেখা দিয়েছে। ফলে আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র মতাদর্শের হট্টগোল উঠেছে। গরজ ও সুবিধেমতো গলাবাজি করেই জয়ী হতে চায় সবাই।

কোনো কোনো রাষ্ট্র যেমন ধর্মীয় ঐক্য, ভাষার ঐক্য, রাজনীতিক মতবাদের ঐক্য, গোত্রীয় ঐক্য কিংবা ভৌগোলিক ঐক্যের নামে জন-সংহতি রক্ষণে ও গণ-বিদ্রোহ ঠেকাতে ব্যস্ত; তেমনি কোথাও আবার আর্থিক, ভৌগোলিক কিংবা গোত্রীয় স্বাতন্ত্রের নামে বা মতবাদের অনৈক্যের অজুহাতে একরাষ্ট্র ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গড়ে উঠছে।

উভয়ক্ষেত্রেই বিবেকহীন বড় শক্তিগুলো নির্লজ্জভাবে–এমনকি U NO-ও–নিজেদের স্বার্থানুসারে পরস্পর বিপরীত যুক্তিপ্রয়োগে কখনো সমর্থন, কখনো বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য, জার্মানি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি ভাঙতে যেমন তারা উৎসাহী ছিল, কঙ্গো-কাশ্মীর-বায়াফ্রা কিংবা নাগাভূমের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করতে তারা তেমনি কুণ্ঠিত। কিংবা তিব্বত-সাবাহ-বর্ণিও-সাইপ্রাস ব্যাপারে তাদের অন্যনীতি। আবার দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়া কিংবা আরব-ইসরাইল সমস্যা সম্পর্কে তারা দার্শনিক।

রাজনীতিক খেল ও আর্থনীতিক চাল গোপন রেখে তারা দেশ বা রাষ্ট্র ভাঙাগড়ার ব্যাপারে তিনটে আদর্শের স্লোগান আওড়ায়–সাংস্কৃতিক ঐক্য বা স্বাতন্ত্র, অভিন্ন বা ভিন্ন জাতীয়তা এবং মতবাদের ঐক্য বা পার্থক্য। স্বাৰ্থিক গরজে কখনো ঐক্যের কথা বলে তারা মিলন ঘটায়, কখনোবা স্বাতন্ত্রে গুরুত্ব দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে। সংহতি ও বিচ্ছেদ দুটোই তাদের সমান প্রিয়। এবং প্রয়োজনমতো প্রয়োগে তারা রীতিমতো সব্যসাচী।

ম্যাকিয়াভেলীই এ যুগের রাষ্ট্রপতি ও দেশনায়কদের গুরু। ছলনা, প্রতারণা ও বাকচাতুরীই তাদের পুঁজিশক্তির উৎস ও ভিত্তি এবং নীতি ও অস্ত্র। এই নীতি ও অস্ত্র প্রয়োগে তাদের আপন পর, ঘর-বাহির ভেদ নেই। এই শাস্ত্র ও শস্ত্রের ব্যবহারে তাদের সমদর্শিতা অতুল্য। নতুন ও পুরোনো, ছোট ও বড় সব রাষ্ট্রেরই একরূপ।

.

০৩.

সংস্কৃতিতেও থাকে স্থান-কাল-পাত্রভেদ। সংস্কৃতি তাই কোনো রাষ্ট্রভুক্ত মানুষের ব্যক্তিক বা সামষ্টিক জীবনে অবিমিশ্র ও অভিন্ন হতে পারে না। কেননা ভৌগোলিক আবহাওয়া, জীবিকা, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, ধর্মমত, গোত্রীয় সংস্কার, ভাষিক প্রভাব, নৈতিক চেতনা, আচারিক প্রথা এবং উন্নততর বিদেশী ভাব-চিন্তা-আচার প্রভৃতির প্রত্যেকটির প্রভাবে রূপ পায় সংস্কৃতি। এজন্যেই একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও জার্মান-ফরাসি-ইংরেজের কিংবা আরব-ইরান-তুরস্কের সংস্কৃতি এক নয়, জাতীয়তাও নয় অভিন্ন।

গোত্রীয় ঐক্য বা নৃতাত্ত্বিক অভিন্নতাও এক সংস্কৃতি কিংবা এক জাতি গড়ে তোলে না– যেমন আর্য, সামীয় অথবা মঙ্গোলীয় মাত্রই এক জাতি ও এক সংস্কৃতিভুক্ত থাকেনি। আবার গোত্র, ভাষা, দেশ, ধর্ম, ঐতিহ্য প্রভৃতি অভিন্ন হলেও এক সংস্কৃতি ও এক জাতি থাকে না–শিক্ষা সম্পদ, মত, আদর্শ ও স্বার্থভেদে সংস্কৃতি ও জাতি-চেতনায় স্বাতন্ত্র্য আসে–যেমন আরব রাষ্ট্রগুলো, যেমন কোরিয়া, জার্মানি ও ভিয়েতনাম। বস্তুত জাতীয়তাবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যচেতনা আধুনিক উপসর্গ এবং তাই কৃত্রিম। রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার রূপেই এ দুটোর উদ্ভব, প্রসার ও স্থিতি এবং রাষ্ট্রগঠন ও রক্ষণকর্মেই কেবল এগুলো প্রযুক্ত। তা ছাড়া আজকের বিশ্বে ও-দুটোর আর কোনো উপযোগ নেই। প্রাগ্রসর বিবেকবান মানবকল্যাণকামী মানুষ যখন আন্তর্জাতিকতায় ও বিশ্বমানবতাবোধের স্বপ্নে আনন্দিত ও আশ্বস্ত, তখন এ দুটো আদর্শ প্রতিক্রিয়াশীলতারই নামান্তর। তা ছাড়া রাষ্ট্র গঠন ও রক্ষণ ব্যাপারে জাতীয়তা ও সাংস্কৃতিক অভিন্নতাও যে কেজো নয়– হৃতউপযোগ, তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আসলে সমস্বার্থের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র আর সমস্বার্থের স্বীকৃতিতে সহযোগিতায় ও সমদর্শিতায় টিকে থাকবে রাষ্ট্র। এর থেকে দৃঢ় ঐক্যসূত্র, এর থেকে বড় বন্ধন দুনিয়াতে কখনো ছিল না, কখনো হবেও না। পরিবারে-গোত্রে সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বত্রই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে স্বার্থ। এজন্যেই দস্যু-তস্করের মতো দুশ্চরিত্র লোকও সমস্বার্থের ভিত্তিতে দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। এরা দায়িত্ব-চেতনা, কর্তব্য-বুদ্ধি, সততা, আনুগত্য ও পারস্পরিক আস্থার প্রমূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রচলিত অর্থে অমানুষ এই দস্যু-তস্করের চরিত্রে এক অর্থে সুনাগরিকের সবগুণই বর্তমান। তাঁদের স্বাদল্য, কমরেডীভাব ও নীতিনিষ্ঠা তথা অঙ্গীকারনিষ্ঠতা অনুকরণীয়। মূলত স্বার্থবুদ্ধির সঙ্গে সৌজন্য ও সহৃদয়তার মিশ্রণ ঘটিয়ে, পরিবারে ও সমাজে পারস্পরিক ব্যবহারে প্রীতির মাধুর্য ও শোভনতার লাবণ্য দান করেই সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়েছে মানুষ। এরই নাম ন্যায়-নীতি-আদর্শ তথা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবতা। অতএব সমস্বার্থের ভিত্তিতে সহ-অবস্থান, সহযোগিতা ও সমদর্শিতাই এ যুগে রাষ্ট্ৰান্তৰ্গত মানুষের ঐক্যের ও সংহতির একমাত্র সূত্র। ঠকাঠকিতে বাপ ভাইয়ের সঙ্গেও ঠোকাঠুকি অনিবার্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *