২. মধ্যযুগ : প্রাক-মুঘল আমল

মধ্যযুগ : প্রাক-মুঘল আমল
(তেরো শতক থেকে ১৬৬৫ খ্রীস্টাব্দ অবধি)

ত্রিপুররাজ ছেঙগুম ফা সম্ভবত ১২৪০-৬০ খ্রীস্টাব্দের দিকে রাজত্ব করতেন। তার আমলেই পার্বত্য ভোটচীনা তিপরা জাতি চট্টগ্রাম জয়৬৮ করে বালঙার রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হয়। সম্ভবত ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর চট্টগ্রাম বিজয়ের পূর্বে দামোদর দেব বংশীয়গণ স্বাধীনভাবে কিংবা আরাকান অথবা ত্রিপুরার সামন্ত হিসাবে চট্টগ্রাম শাসন করতেন। মনে হয়, তাদের কারো হাত থেকে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ চট্টগ্রামের অধিকার ছিনিয়ে নেন (১৩৩৮ ৩৯ খ্রী.) চট্টগ্রামের কিংবদন্তিতে এবং শিহাবুদ্দীন তালিসের বর্ণনায় এর সমর্থন আছে। আমাদের ধারণায় ইবন বতুতাও (১৩৪৬ খ্রী.) সদকাউন (Sadkawan) নামে ফখরুদ্দীনের আমলের এই চট্টগ্রামকেই নির্দেশ করেছেন। কবি মুহম্মদ খানের মঞ্জুল হোসেন-এর ভূমিকা ভাগ থেকে জানা যায় ফখরুদ্দীনের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন কদর বা কদল খান গাজী। তাঁর নামে একটি গ্রাম আজো কদলপুর বলে পরিচিত। এই কদর খানের আমলেই পীর বদরুদ্দীন আলাম ও কবির পূর্বপুরুষ মাহিআসোয়ার আরব বণিক হাজী খলিলের সঙ্গে চট্টগ্রামে উপনীত হন। ফখরুদ্দীন শায়দা নামের এক দরবেশকে চট্টগ্রামের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এ ভণ্ড সাধু ফখরুদ্দীনের পুত্রকে হত্যা করার অপরাধে নিহত হয়। কবি মুহম্মদ খান গৌড় সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহর (১৪৫৯-৭৬ খ্রী.) চট্টগ্রামস্থ কর্মচারী বা প্রতিনিধি রাস্তি খানের বংশধর। তিনি তার পূর্বপুরুষের তালিকা দিয়েছেন :

রাস্তি খানের বংশধর

বদর আলাম, সিলেটের জালালউদ্দীন কুনিয়া, কদর খান, ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ এবং ইবন বতুতা (১৩৪৬ খ্রী.) চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রায় সমসাময়িক। দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে আরাকান ও পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ অবধি উপকূল-লগ্ন বিস্তৃত অঞ্চলের বদরমোকামগুলো স্থানীয় জনগণের উপর পীরবদরের প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করছে। চট্টগ্রামের ধর্মীয় ইতিহাসে বদরের স্থান গুরুত্বপূর্ণ।

সম্ভবত বিহারের পীর বদরউদ্দীন বদরই আলাম (মৃত্যু ১৩৪০ খ্রী. বর্ধমানের কালনায় যার নকল সমাধি রয়েছে) আর চট্টগ্রামের পীর বদর অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু অন্য অনেকের মতে, ১৪৪০ খ্রীস্টাব্দে বদর আলামের মৃত্যু হয়। ইতিহাস ও মুক্তল হোসেন কাব্য সূত্রে জানা যায় রাস্তি খানের বংশধরগণ ইব্রাহিম ওর্ষে বিরহিম অবধি (ইনিও উজির ছিলেন) গৌড় আরাকান ও ত্রিপুরা রাজার অধীনে (চট্টগ্রাম যখন যে রাজ্যভুক্ত থাকত) চট্টগ্রামের শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। রাস্তি। খান স্বয়ং রুকনুদ্দীন বারবক শাহর (১৪৫৯-৭৬ খ্রী.) কর্মচারী ছিলেন।

পরাগল খান ও ছুটিখান ছিলেন আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রী.) ও নুসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২ খ্রী.) আমলে ফেনী নদী ও রামগড় মধ্যবর্তী সীমান্ত রক্ষী সেনানী বা লস্কর। হামজা খান, নসরত খান ও জালাল খান গৌড়, ত্রিপুরা ও আরাকান রাজের অধীনে শাসনকার্যে নিযুক্ত ছিলেন।

শিহাবুদ্দীন তালিস ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রামে মুঘলবিজয় বর্ণনা প্রসঙ্গে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর চট্টগ্রাম বিজয় ও চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর অবধি রাস্তা নির্মাণের কথা বলেছেন। তালিস স্বচক্ষে সে রাস্তার ভগ্নাবশেষ দেখেছেন।৭৭ এখনো ফখরুদ্দীনের নামের ফখরুদ্দীনের পথ (ফঅরদ্দীনের অদ) নিশ্চিহ্ন হয়নি। এ রাস্তাও লালমাই অঞ্চল দিয়ে প্রসারিত ছিল।

সেনানী কদর খানের সৈনাপত্যে চট্টগ্রাম বিজয়ও স্বীকার করা চলে।৭৮ (ইনি মালিক পিণ্ডার খান খালজী ওফে কদর খান নন। তিনি নিহত হওয়ার আগে যে কয়মাস সোনারগাঁয়ে ছিলেন, সে সময় বর্ষাকাল ছিল। কাজেই তিনি চট্টগ্রাম জয় করেননি।)

সম্ভবত ১৩৩৮ থেকে ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম গৌড় শাসনে ছিল। পনেরো শতকের গোড়া থেকে ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দ অবধি যে চট্টগ্রাম গৌড়-সুলতানদের অধিকারভুক্ত ছিল তার প্রমাণ বহু :

ক. চীনা দূতের ইতিবৃত্ত ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৫।

খ. আরাকানরাজ নরমিখলের বা মঙ সাউ মঙের গৌড় দরবারে আশ্রয় গ্রহণ (১৪০৪-৩৩ খ্রী.)

গ. চট্টগ্রামে তৈরি দনুজমর্দনদেব গণেশ (১৪১৭), মহেন্দ্র (১৩১৮) ও জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহর (১৪১৫-১৬,১৪১৮-৩১) প্রাপ্ত মুদ্রাই তার সাক্ষ্য। চীনা দূতেরা চট্টগ্রাম হয়েই গৌড়ে গিয়েছিলেন।

আবার চৌদ্দ শতকের রাজনৈতিক খবরও একেবারে বিরল নয়। ১৩৫২ খ্রীস্টাব্দের দিকে ফখরুদ্দীনের পুত্র ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ থেকে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ চট্টগ্রাম সমেত পূর্ববাঙলার অধিকার লাভ করেন। এর পরে সিকান্দর শাহ (১৩৫৯-৮৯খ্রী.) ও তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪১০ খ্র.) পনেরো শতকের প্রথম দশক অবধি রাজত্ব করেন। আযম শাহর আমলেই আরাকানরাজ নরমিখলে বা মঙ সাউ মঙ গৌড়ে আশ্রিত হন (১৪০৪ খ্রী.) এবং জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৫-১৬, ১৪১৮-৩১ খ্রী.) ১৪৩০ খ্রীস্টাব্দে তাকে আরাকান সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন। অবশ্য আরাকানী বিদ্বানদের মতে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহই (১৪৩৩-৫৯) মঙ সাউ মঙকে সিংহাসন পাইয়ে দিয়েছিলেন (বর্মা রিচার্স সোসাইটিস এ্যানিবারর্সারি ভলিউম ১৯৬০)। গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) যে চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন তা কেবল মঙ সাউ মঙের আশ্রয় গ্রহণ থেকেই নয়, বিহারের দরবেশ মুজাফফর শামস বলখী হজ যাত্রার সময় চট্টগ্রাম থেকে তার কাছে যে-সব চিঠি লিখেছিলেন তা হতেও জানা যায়। গিয়াসুদ্দিন চীনদেশে দূত পাঠিয়েছিলেন। চীনা সূত্রেও ধারণা হয় যে চট্টগ্রাম আযম শাহর অধীনে ছিল। তার পর সইফুদ্দীন হামজা শাহ, শিহাবুদ্দীন বায়াজিদ শাহ, আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ, গণেশ, মহেন্দ্র, জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ, শামসুদ্দীন আহমদ শাহ এবং নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৩-৫৯) প্রভৃতি সুলতানের আমলেও চট্টগাম গৌড়রাজ্যভুক্ত ছিল। মঙ সাউ মঙের সিংহাসনে আরোহণ (১৪৩০) থেকে আরাকানে মুসলমানদের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রবল হয়। রাজার মুসলিম নাম, মুদ্রায় কলেমা ও আরবি হরফ তার প্রমাণ। ইলিয়াস শাহ বংশীয় সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর রাজত্বকালে মঙ সাউ মঙের ভাই মঙ খ্রী ওফে আলি খান (১৪৩৪-৫৯) রামুর কিছু অংশ অধিকার করেন। এবং সে সূত্রে আরাকানরাজ গৌড়সুলতানের প্রভাবমুক্ত হন। রামুর যে-অংশ আরাকানরাজের অধীনে গেল সে-অংশ রাজারকুল আর যে-অংশ চাকমা সামন্তের(?) অধিকারে রইল তা চাকমারকুল নামে আজো পরিচিত। মাহমুদ শাহর রাজত্বের শেষ বছরেই (১৪৫৯ খ্র.) চট্টগ্রাম গৌড় সুলতানের হস্তচ্যুত হয়। মঙ খ্রী-পুত্র বসউ পিউ কলিমা শাহ (১৪৫৯-৮২) ১৪৫৯ সনে উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কিন্তু তার অধিকার দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। তাই রাস্তিখানের উৎকীর্ণ মসজিদ লিপিতে (১৪৭৩-৭৪ খ্রী.) মাহমুদ শাহর পুত্র রুকনুদ্দীন বারবক শাহকে চট্টগ্রামের অধিপতি দেখি।৮৫ এর পরে এক সময় চট্টগ্রাম আরাকান অধিকারভুক্ত হয়।

চট্টগ্রামের নিযামপুর ও ফেনী অঞ্চলে শাহজাদা খান্দানী সংক্ষেপে শাহজাদখানী বলে এক সম্ভ্রান্ত বংশের ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায়, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর আমলে মাতুল কিংবা পিতৃব্য কর্তৃক সিংহাসনে বঞ্চিত হয়ে এক শাহজাদা গৌড়ে এসে মাহমুদ শাহর কন্যা বিয়ে করে চট্টগ্রামের আধুনিক নিযামপুর অঞ্চলে বসতি নির্মাণ করেন। এক দরবেশ তাকে বলেছিলেন তার হাতী যেখানে লুটিয়ে পড়বে সেখানেই যেন তিনি বসতি করেন। এখানেই হাতী লুটে পড়েছিল বলে স্থানটির নাম হাতী লুটাগাঁ এবং শাহজাদার নাম মাহমুদ ছিল বলে অঞ্চলটি মাহমুদাবাদ নামে অভিহিত হয়। এটিই কি মাহমুদ শাহ কিংবা রুকনউদ্দীন বারবকের টাকাশাল অঞ্চল মাহমুদাবাদ! অবশ্য যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলও মাহমুদাবাদ্য নামে পরিচিত ছিল (হিসটরী অব বেঙ্গল ঢাকা ইউনিভারসিটি ভলিয়ম ২য় পৃ: ১৮৯)। এই শাহজাদার সঙ্গে সাতটি খান্দানী পরিবার আর এদেরই কারো জামাতারূপে বিবাহ-সূত্রে একটি অর্ধ অভিজাত পরিবার এই সাড়ে সাত ঘর আলোচ্য অঞ্চলে বসতি নির্মাণ করে বলেও লোকশ্রুতি আছে। এদের একজন উসমান কাজি। এদের বংশধরগণ নিযামপুর ও ফেনীর আমিরাবাদ পরগনার বিভিন্ন গায়ে ছড়িয়ে আজো বাস করে। এই শাহজাদা বংশীয় শেখ মুহম্মদ ভূঁইয়া শমসের গাজীর মিত্র ছিলেন। তার কথা শেখ মনোহরের শমসের গাজীনামায় বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এইকিংবদন্তি সম্ভবত গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর জামাতা খিজির খান–তুর্কী সংপৃক্ত অথবা শের শাহর ভাগিনেয় মুরারিজ খান ওর্কে সুলতান মুহম্মদ শাহ আদিল কর্তৃক ইসলাম শাহ সুরের পুত্র ফিরোজপুরের হত্যাকাহিনীর সঙ্গে জড়িত।৮৭ এই ফিরোজ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহর পুত্রও হতে পারেন। এ সূত্রে উল্লেখ্য যে পরাগল খান-বংশীয়রাও উক্ত সাড়ে সাত ঘরের একঘর এবং তাঁরা নিজেদের এক উজির জুজার খানের বংশধর বলে দাবী করেন, যদিও পরাগলী মহাভারত সূত্রে আমরা পরাগল খাকে রুদ্র-বংশীয় তথা স্থানীয় দীক্ষিত মুসলিম বংশজ বলে জানি। অবশ্য কবি-প্রযুক্ত রুদ্র অর্থে যোদ্ধা বা বীর ধরলে রাস্তি খান পরাগল খানকে তুর্কী বা আফগান বংশীয় বলেই মানা যাবে।

দ্বিজ ভবানী নাথের রামাভিষেক বা লক্ষ্মণ দিগ্বিজয় কাব্য ষোলা শতকের প্রথম দশকে জয়ছন্দ বা জয়চান্দ রাজার আগ্রহে রচিত। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে জয় ছন্দ ১৪৮২-১৫২৩ অবধি কর্ণফুলী ও শঙ্খনদ মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজা ছিলেন এবং তিনি ছিলেন আরাকান সামন্ত।৮৮ এ তথ্য নির্ভুল হলে বুঝতে হবে শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহর (১৪৭৬-৮২) সময়ে বা তার পরে চট্টগ্রাম গৌড়-সুলতানের হস্তচ্যুত হয়।

অতএব শামসুদ্দীন ইউসুফ কিংবা জালালউদ্দীন ফতেহ শাহর আমলে চট্টগ্রামে আরাকান অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় এবং ১৫১২ খ্রীস্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম আরাকান শাসনে থাকে।  মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের উক্তিতে যদি কিছু সত্য থাকে, তাহলে বলতে হবে চট্টগ্রাম ফতেহ শাহর শাসনাধীনে ছিল না। বিজয় গুপ্ত প্রস্তাবনায় বলেছেন–মুলুক ফতেয়াবাদ বাঙ্গরোড়া তক্‌ সীম। পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূর্বে ঘণ্টেশ্বর। মধ্যে ফুল্লশী গ্রাম পণ্ডিত নগর। ফতেহ শাহ হোসাইনীর আমলে ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন। সুলতান শাহজাদা ওর্ফে খোঁজা সেরা, সইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ কিংবা শামসুদ্দীন মুজফফর শাহর রাজত্বকালে চট্টগ্রাম আরাকানরাজার শাসনে ছিল। তারপর ১৫১২ সনে ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্য আরাকানীদের হাত থেকে চট্টগ্রামের উত্তরাংশ কর্ণফুলী নদী অবধি ছিনিয়ে নেন। এই সময় গৌড়-সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ আলফা হোসাইনী বা আলফা খান নামের এক বণিকের সহায়তায় চট্টগ্রাম দখল করলেন। এরূপে ধন্য মাণিক্যের সঙ্গে হোসেন শাহর বিবাদ উপস্থিত হল। বন্যমাণিক্য আবার সৈন্য পাঠিয়ে ১৫১৩ সনে হোসেন শাহর বাহিনীকে পরাজিত করে চট্টগ্রামে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুদ্রা তৈর করান :

তারপরে শ্রীধন্য মাণিক্য নৃপবর :
চাটিগ্রাম জিনিলেক করিয়া সমর।
চৌদ্দশ পাঁচত্রিশ শাকে সমর জিনিল
চাটিগ্রাম জয় করি মোহর মারিল।
গৌড়ের যতেক সৈন্য চট্টলেতে ছিল
শ্রীধন্য মাণিক্য তাকে দূর করি দিল।

 অথবাঃ চাটিগ্রাম হতে ভঙ্গ দিল গৌড় সেনা। মারণে কাটনে ভঙ্গ দিন গৌড় সেনা।

হোসেন শাহ প্রতিশোধ নেবার জন্যে ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করলেন তাঁর সেনাপতি হৈতন খান (হায়াতুন্নবী) ও গৌড়মল্লিক (গৌর মল্লিক) ধন্যমাণিক্যের হাতে পরাজিত হন বটে, কিন্তু তার আগেই তিনি মেহেরকুলাদি অঞ্চল দখল করে মোয়াজ্জমাবাদ শিকভুক্ত করেন। ইতিমধ্যে এ বিবাদের সুযোগে আরাকানরাজ চট্টগ্রাম পুনর্দখল করেছিলেন। গৌড় মল্লিককে পরাজিত করে ধন্যমাণিক্যের সাহস বেড়ে গিয়েছিল, তিনি নারায়ণ ও চয়াগের নেতৃত্বে বিপুল বাহিনী নিযুক্ত করলেন। ধন্যমাণিক্য নিজেও এদের সহগামী ছিলেন। (শ্রীধন্যমাণিক্য চলে চাটিগ্রাম লৈতে– রাজমালা)। নারায়ণ রামু অবধি জয় করে রোসাঙ্গ-মর্দন খেতাব লাভ করেন। কিন্তু সম্ভবত কয়েক মাসের মধ্যেই আরাকানরাজ চট্টগ্রাম পুরাধিকার করেছিলেন। আরাকানীদের হাত থেকেই নুসরৎ খান পরাগল খানাদির সহায়তায় উত্তর চট্টগ্রাম জয় করেন। আরাকানরাজ কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদের মধ্যবর্তী চক্রশালায় ঘাঁটি করে গৌড়- সুলতানের বাহিনীর সঙ্গে সম্ভবত ১৫২৫ সন অবধি দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন। এ ব্যাপারের আভাস আছে কবি শাহ বারিদ খানের একটি পদবন্ধে।৯২ নুসরৎ খান পরবর্তী কোনো অভিযানে শঙ্খনদ অবধি দক্ষিণ চট্টগ্রামও দখল করেন। দ্য বারোজের বর্ণনায় প্রকাশ Joao de Silviera ১৫১৭ সনে চট্টগ্রাম বন্দরকে গৌড়-সুলতানের দখলে এবং আরাকানরাজকে গৌড়-সুলতানের সামন্ত বলে জেনেছিলেন। আরাকানরাজ মঙইয়াজা বা মঙ রাজা (১৫০১-২৩) এ বিপর্যয়েও আশা ছাড়লেন না। তিনি সেনাপতি ছেদুইজা, মন্ত্রী ছাঙ্গেগ্রী ও রাজকুমার ইরে মঙের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম পুনরাধিকারের জন্যে ১৫১৭ সনে এক বিপুল বাহিনী প্রেরণ করেন। পরাজিত হয়ে চক্রশালার মুসলিম সেনানীশাসক মুরাসিন বা মীর ইয়াসীন ভয়ে পালিয়ে গিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে (সম্ভবত চাঁদপুর হয়ে সোনারগাঁয়ে) আশ্রয় নেন। (রাজোয়াং-রাজবংশ ৯৪)। এরূপে চক্রশালা আরাকান অধিকারে চলে গেল। আরাকানরাজের এই দিগ্বিজয়ী বাহিনী চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, লক্ষ্মীপুর ও ঢাকা জয় করে লক্ষ্মীপুরে শাসনকেন্দ্র স্থাপন করে এবং ১৫১৪-১৮ সনে আরাকানরাজ ঢাকা ভ্রমণ করেন। কিন্তু আরাকানের এই দিগ্বিজয় স্থায়ী হয়নি। উত্তর চট্টগ্রামেও আরাকান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল না এ যুদ্ধে। তবু কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর অবধি গোটা অঞ্চল আরাকান শাসনে রয়ে গেল। ১৫২২ সনে ত্রিপুরারাজ দেবমাণিক্য উত্তর চট্টগ্রাম জয় করেন। এর ফলে উত্তর চট্টগ্রামবাসী মঘেরা আরাকানে পালিয়ে যায় বলেকিংবদন্তি আছে। একে মঘধাওনী বা মঘ পলায়নী বলে। এ অভিযানে ত্রিপুরার সেনাপতি ছিলেন রায় চাগ। সম্ভবত তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামও আক্রমণ করেন (রাজমালা)। দেবমাণিক্যও চট্টগ্রামে অধিকার প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারেন নি। এদিকে আরাকান সিংহাসনের তখন নিরাপত্তা ছিল না। গজপতি (১৫২৩-২৫) মঙ সাউ (১৫২৫), থাতাসা (১৫২৫-৩১) প্রভৃতি জ্ঞাতিরা আট বছরের সময় পরিসরে সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন। এই দুর্বলতার সুযোগে নুসরৎ শাহ ১৫২৫ খ্রীস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামে স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় থেকে উত্তর চট্টগ্রাম ১৫৫৩ সন অবধি গৌড়–সুলতানের শাসনাধীন ছিল।

হোসেন শাহ কিংবা নুসরৎ শাহ নাকি বিজিত চট্টগ্রামের নাম ফতেয়াবাদ রেখে ছিলেন।  কিন্তু ফতেয়াবাদ নামের কোনো উল্লেখ কবীন্দ্র পরমেশ্বর বা শ্রীকর নন্দীর মহাভারতে নেই। তবে ষোলোশতকে চট্টগ্রাম শহর তথা রাজধানী যে ফতেয়াবাদ নামে পরিচিত ছিল, তা দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু কাব্যে পষ্ট উল্লেখ আছে এবং রাজধানীর নামানুসারে পুরো অঞ্চলটিও ফতেয়াবাদ রূপে পরিচিত ছিল হয়তো। এখনকার চট্টগ্রাম শহরের সাত মাইল দূরে ফতেয়াবাদ গ্রাম আছে। এখানে পুরোনো রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আজো বিদ্যমান।

ষোলোশতকের মাঝামাঝি কোনো এক নিযাম উত্তর- চট্টগ্রামে জাফরাবাদ গাঁয়ে প্রতাপশালী জমিদার বা আরাকানরাজের সামন্ত ছিলেন। তার প্রমাণ মেলে দৌলত উজিরের উক্তি থেকে :

নগর ফতেয়াবাদ দেখিয়া পূর এ সাধ
চাটিগ্রাম সুনাম প্রকাশ।
 চাটিগ্রাম অধিপতি হইলেন্ত মহামতি
নৃপতি নিযাম শাহা শূর
একশত ছত্রধারী সভানের অধিকারী
ধবল অরুণ গজেশ্বর।

 ধবল অরুণ গজেশ্বর আরাকানরাজ চট্টগ্রামের সার্বভৌম রাজা, এবং তার অধীনে নিযাম শাহ প্রশাসক–এই অর্থই সঙ্গত। কেননা নৃপতি, শাহ ধবল অরুণ গজেশ্বর প্রভৃতি স্তোক-জ্ঞাপক শব্দের আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করা অনুচিত। ফাজিল নাসির, কবি চুহর, এতিম কাসেম, তমিজী, লোকমান প্রভৃতি কবি উচ্চবিত্তের সাধারণ লোককেও তোয়াজের ভাষায় নৃপতি, সুলতান, অধিপতি বলে অভিহিত করেছেন। কবি মুহম্মদ খানও তার পূর্বপুরুষগণকে স্বাধীন নৃপতিরূপেই বর্ণনা করেছেন। নিামের নামের পরগনা নিযামপুর এখনো বর্তমান। বাহারিস্তান গায়েবীতেও নিযামপুর পরগনার জমিদারের উল্লেখ আছে।

এদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরাকানরাজ মঙ বেঙের ( যৌবক শাহ ১৫৩১-৫৩) আমলে ত্রিপুরার সৈন্যেরা পার্বত্য পথে আরাকানের চট্টগ্রামস্থ অধিকারে ঘন ঘন হানা দিয়ে লুটপাট করত। ১৫৫৩ সনে কয়েক মাসের জন্যে উত্তর চট্টগ্রামও মঙ বেঙের দখলে ছিল, তা চট্টগ্রামে তৈরি তাঁর নামাঙ্কিত প্রাপ্ত মুদ্রা থেকে প্রমাণিত। আবার গৌড়ের সুর-বংশীয় সুলতান শামসুদ্দিন মুহম্মদ শাহ গাজীরও উক্ত সনে চট্টগ্রামে তৈরি মুদ্রা মিলেছে। অতএব ১৫৫৩-৫৪ সনে চট্টগ্রামে কিছুকাল আরাকানী আর কিছুকাল গৌড় শাসন ছিল।

গৌড় ও পর্তুগীজ সূত্রে জানা যায়, ১৫৩৯-৪০ সনে গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর চট্টগ্রামস্থ প্রতিনিধি খুদাবখশ খান ও হামজা খানের (আমীরজা খান) বিবাদের সুযোগে নোগাজিল (নওয়াজিস, নিযাম, খিজির?) শেরশাহর হয়ে চট্টগ্রাম দখল করেন। অতএব ১৫৫৩ সনে মঙ বেঙই সম্ভবত উত্তর চট্টগ্রামে হানা দিয়ে তা কিছুকাল দখলে রাখেন।

আরাকান রাজ মঙ বেঙের সময়েই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মঘী কানি ও দ্রোনে জমির পরিমাপ পদ্ধতি এবং মঘী সন চালু হয়। মঘী সন বাঙলা সন থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরে কম।

মুহম্মদ খানসুর ওর্ষে শামসুদ্দীন মুহম্মদ খান গাজী চট্টগ্রাম পুনর্দখল করে আরাকান আক্রমণ করেন। কিন্তু সম্ভবত আরাকান বেশিদিন তার দখলে থাকেনি। যদিও আরাকানে তৈরি তাঁর মুদ্রা (৯৬২ হিজরি ১৫৫৩-৪ খ্রী.) মিলেছে। ১৫৫৬ সনে ত্রিপুরারাজ বিজয় মাণিক্য (১৫২৮ ২৯-১৫৭০ খ্রী.) চট্টগ্রাম অবরোধ করেন:

আট মাস যুদ্ধ করে পাঠানের সনে
লইতে না পারে গড় চাটিগ্রাম স্থানে। (রাজমালা)

এই সময় বিজয় মাণিক্যের পাঠান সৈন্যেরা বিদ্রোহ করলে, তাদের হত্যা করা হয়। গৌড়ের পাঠান সুলতান এতে ক্রুদ্ধ হয়ে তার শ্যালক মুবারকের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে এক বাহিনী প্রেরণ করেন :

এই সব বৃত্তান্ত তাতে পাঠান শুনিল।
 ক্রোধে গৌড়েশ্বর বহু সৈন্য দিল রণে
 মমারক খাঁ সৈন্য সমে চাটিগ্রামে গেল।
ভঙ্গ দিল ত্রিপুর সৈন্য মগলে জিনিল। (রাজমালা)

 কিন্তু সম্ভবত পুনরাক্রমণে মুবারক পরাজিত ও ধৃত হয়ে কালী কিংবা চতুর্দশ দেবতার বেদীমূলে বলিরূপে প্রাণ হারান। বিজয়মাণিক্য ব্রহ্মপুত্র নদ অবধি জয় করে তথায় স্নান করেন। এই ঘটনার স্মারক-মুদ্রা মিলেছে : শ্রী শ্রী লক্ষ্যায়ী বিজয় মাণিক্য দেব] (১৪৮১ শক ১৫৫৯ খ্রী.) মুবারক সম্ভবত মুহম্মদ শাহ গাজীরই শ্যালক। মনে হয়, ১৫৭০ সন অবধি চট্টগ্রাম বিজয়মাণিক্যের শাসনে ছিল। উক্ত সনে সম্ভবত সোলমান কররানী চট্টগ্রাম জয় করেন। 

অতএব উপরের আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি তথ্য পাচ্ছি :

ক. শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৪৭৬৮২ বা জালালুদ্দীন ফতেহ শাহর ( হোসাইনী) আমলে কিংবা তাদের পরের কার গৌড়-সুলতান খোঁজা সেরা, সইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ অথবা শামসুদ্দীন মুজাফফর শাহ–এ কয়জনের যে-কোনো কারো সময়ে চট্টগ্রাম আরাকান-শাসনভুক্ত হয়। শাহ বারিদ খানের পদবন্ধ ও দ্বিজ বা পণ্ডিত ভবানীনাথের লক্ষ্মণ দিগ্বিজয় এ ধারণার পরিপূরক।

খ. হোসেন শাহ ১৫১২ সনে উত্তর চট্টগ্রাম দখল করেন। ধন্যমাণিক্য ১৫১৩ সনের গোড়ার দিকে চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেন:

চৌদ্দশ পাঁচতিস শকে নিজ বাহুবলে
চাটি গ্রাম বিজই বলি মোহর মারিল  (রাজমালা, সাহিত্য পরিষৎ পুথি)

 এই বিজয়ের স্মারক চট্টগ্রামজয়ী স্বর্ণমুদ্রা মিলেছে। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই ধন্যমাণিক্য সে অধিকার হারান। ১৫১৩ সনের শেষের দিকে হোসেন শাহর সৈন্য চট্টগ্রাম দখল করে। এতে হোসেন শাহর সঙ্গে ধন্যমাণিক্যের বিবাদ বাধে। গৌরমল্লিক, হৈতন খান ও হোসেন শাহর নেতৃত্বে তিনবার যুদ্ধ হয়। প্রথম দুই যুদ্ধে হোসেন শাহর পরাজয় ঘটে। তৃতীয় যুদ্ধে হোসেন শাহ ত্রিপুরার রাজধানী রাঙ্গামাটি অবধি হানা দিলেন এবং মেহেরকুল অবধি অঞ্চল মোয়াজ্জমাবাদ পরগনাভুক্ত করে খাওয়াজ খানকে প্রশাসক নিযুক্ত করেন।

গ. হোসেন শাহর সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে জয়ী হয়েই ধন্যমাণিক্য পুনরায় নারায়ণ, রায় কছম ও রায় কচাগের ( রায় চাগ) নেতৃত্বে চট্টগ্রামে এক বিপুল বাহিনী প্রেরণ করেন-চৌদ্দশ ছত্রিশ শকে চাটিগ্রাম গেল ১৫১৪-১৫ খ্রী.) এবার গৌড়-সুলতানের উত্তর চট্টগ্রাম এবং আরাকানরাজের দক্ষিণ চট্টগ্রাম অধিকার করে ত্রিপুরা সৈন্যেরা আরাকানেও হানা দেয়। নারায়ণ এই কৃতিত্বের জন্যে রোসাঙ্গ-মর্দন উপাধি লাভ করেন। কিন্তু হোসেন শাহর পুত্র নুসরৎ খান অচিরে শঙ্খনদ অবধি পুনরুদ্ধার করেছিলেন (১৫১৭ সনের গোড়ার দিকে)। দ্য সিলবেরিয়া তাই ১৫১৭ সনে চট্টগ্রামকে গৌড়-সুলতানের অধিকারে এবং আরাকানরাজকে তার সামন্ত বলে জেনেছিলেন।

ঘ, শ্রীকর নন্দীর উক্তিতে প্রকাশ–ছুটি খান ত্রিপুরাগড় অবধি জয় করে সেখানে সন্নিধান করেছিলেন :

তান এক সেনাপতি লস্কর ছুটিখান
 ত্রিপুর নৃপতি যার ডরে এড়ে দেশ।
পর্বত গহ্বরে গিয়া করিল প্রবেশ। (ছুটিখানী মহাভারত)।

 তাহলে আরো একবার ত্রিপুরা বিজিত হয়। আরাকানরাজ মঙরাজা বিপুল বাহিনী পাঠিয়ে সম্ভবত ১৫১৮ খ্রীস্টাব্দে উত্তর চট্টগ্রাম নুসরৎ খানের হাত থেকে কেড়ে নেন। এবং সন্দ্বীপ, হাতিয়া, যুগদিয়া, লক্ষ্মীপুর ও ঢাকা জয় করেন। এদিকে দেবমাণিক্য ১৫২২ সনে চট্টগ্রাম দখল করেন। কিন্তু রাখতে পারেন নি। সম্ভবত ১৫২৫ সনের দিকে নুসরৎ শাহ আরাকানের ঘরোয়া বিবাদ ও শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম পুনর্দখল করেন। এবং খুদাবখশ খানকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সামন্ত শাসক নিযুক্ত করেন, চকরিয়া ছিল তার শাসনকেন্দ্র। এরপর তা গিয়াসুদ্দীন মুহম্মদ শাহর রাজত্বকাল অবধি (১৫৩৮ খ্র.) স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু রামু প্রভৃতি দক্ষিণ চট্টগ্রামের অবশিষ্টাংশ তখনো আরাকান অধিকারে যে ছিল তার প্রমাণ রয়েছে চান্দিলা রাজার মন্দিরলিপিতে (১৫৪২ খ্রী.)

ঙ. গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর আমলের চট্টগ্রামস্থ শাসক খুদাবখশ খান ও হামজা খানের ( আমীরজা খান) বিবাদের সুযোগ নিয়ে শেরশাহর পক্ষে নোগাজিল চট্টগ্রাম দখল করে নেন। কাজেই ১৫৩৮-এর পরে চট্টগ্রাম ১৫৫৩ খ্রীস্টাব্দ অবধি শেরশাহ বংশীয়দের হাতে ছিল। তাই দ্য বারোজ চট্টগ্রামকে বাঙলা রাজ্যের ঋদ্ধ বন্দররূপে দেখেছিলেন। ১৫৫৩ সনে মঙ বেঙ সাময়িকভাবে চট্টগ্রাম দখল করে চট্টগ্রাম থেকে মুদ্রা বের করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই বিজয়মাণিক্য মঙবেঙ থেকে উত্তর চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেন। পর বৎসর ১৫৫৪ সনে গৌড়-সুলতান মুহম্মদ খান সুর ওরফে শামসুদ্দীন মুহম্মদ শাহ গাজী বিজয়মাণিক্য থেকে উত্তর চট্টগ্রামের অধিকার কেড়ে নিলেন এবং আরাকান অবরোধ কিংবা অধিকার করে সেখান থেকে মুদ্রা বের করেন (১৫৫৪ খ্রী.) রাজমালার সাক্ষেও প্রমাণ বিজয়মাণিক্য থেকেই পাঠানেরা চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নিয়েছিল।

চ. কিন্তু বিজয়মাণিক্যও দাবী ছাড়েননি। ১৫৫৪-৫৫ সনে কালানাজিরের নেতৃত্বে বিপুল বাহিনী চট্টগ্রামে প্রেরিত হয়, আট মাসেও জয়-পরাজয় নির্ধারিত হল না। অবশেষে গোপনে সুড়ঙ্গ খনন করে সেই সুড়ঙ্গপথে ত্রিপুরার সৈন্যরা চট্টগ্রামের পাঠান দুর্গে প্রবিষ্ট হয়ে পাঠান-সৈন্যদের অতর্কিতে পর্যুদস্ত করে এবং মুবারককে বন্দী করে নিয়ে চন্তাইয়ের পরামর্শে চতুর্দশ দেবতার কাছে বলি দেয়। ত্রিপুরার এ বিজয় সম্ভবত ১৫৫৬ সনে ঘটেছিল। তখন থেকে ১৫৭৩ সন অবধি চট্টগ্রাম ত্রিপুরার দখলে ছিল। চট্টগ্রাম জয় করে বিজয়মাণিক্য লক্ষ্যা নদী অবধি পূর্ববঙ্গও জয় করেন। (মুদ্রা : ১৪৮১ শক, ১৫৫৯ খ্র.)। শ্রী শ্রী লক্ষ্যায়ী বিজয়মাণিক্য দেব: চাটিগ্রাম জয়ী। বিজয় মাণিক্যের এই সুযোগ জুটেছিল মুহম্মদ শাহ গাজী ও তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর (খিজির খান) মুহম্মদ শাহ আদিল ও তাঁর সুবাদার শাহবাজ খানের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলেন বলেই (১৫৫৫-৫৭)।

ছ, ১৫৭০ খ্রীস্টাব্দে বিজয়মাণিক্যের মৃত্যুর পর অনন্ত মাণিক্য সম্ভবত দেড় বছর রাজত্ব করেন (১৫৭১-৭২)। তাকে নিহত করে সেনাপতি উদয় মাণিক্য সিংহাসনে বসেন (১৫৭২)। চৌদ্দশ চুরানব্বই শকে উদয় রাজন। (রাজমালা ২য় খণ্ড পৃ. ৬৯)। এ সময় সোলেমান কররানীরও মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র বায়াজিদ কয়েক মাস মাত্র রাজত্ব করেন। কাজেই দাউদ খান কররানীই (১৫৭৩ ৭৬) ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রাম কেড়ে নেন (১৫৭৩)। দাউদের সৈন্যেরা বাধা পেল ত্রিপুরার কাছাকাছি খণ্ডলে। কিন্তু ত্রিপুরা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে চলল পাঠান বাহিনী। এর পরে ফিরোজ আন্নী আর জামাল খান পন্নীর নেতৃত্বে দাউদ আরো একদল সৈন্য পাঠালেন চট্টগ্রামে। এই দল মেহেরকুলে ত্রিপুরা বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হল। সম্ভবত পাঁচ মাস ধরে এই যুদ্ধ চলে; পঞ্চ বৎসর যুদ্ধ ছিল জামাল পন্নীর সনে। ১৫৭৬ সনে গৌড়ে মুঘল বিজয় ঘটে। কাজেই পাঁচ বৎসর যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। পাঁচ মাস হওয়াই সম্ভব। এবারেও দাউদ খাঁর জয় হয়।

আইন-ই আকবরীতে চট্টগ্রামের শেখপুর মহলের অপর নাম সোলায়মানপুর বলে উল্লেখ আছে। আইন-ই-আকবরীতে বর্ণিত সাতটি মহলের কোনোটিই শঙ্খনদের দক্ষিণ তীরে ছিল না; এতে বোঝা যায় দাউদ কররানীও শঙ্খনদ অবধি উত্তর চট্টগ্রামই দখল করেছিলেন। গৌড়ে মুঘল বিজয়ের সুযোগেই সম্ভবত আরাকানরাজ ও মঙ ফালঙ (১৫৭১-৯৩) উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন। চট্টগ্রাম মুঘল অধিকারভুক্ত হওয়ার আগেই কররানীর রেকর্ড থেকেই চট্টগ্রামের মহলগুলো তোডড়মল মুঘল তৌজিভুক্ত করেন। শিহাবুদ্দীন তালিস তা স্পষ্টভাবেই বলেছেন :

When Bengal was annexed to the Mughal Empire. Chatgaon was entered in the papers of Bengal as one of the defaulting and unsettled districts. When the Mutasaddis did not really wish to pay any man whose salary was due, they gave him an assignment on the revenue of Chatgaon.
দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকেন্দ্র ছিল রামু। ম্যানরিক ও রালফ ফিচ রামুকে শাসনকেন্দ্র দেখেছেন। রামকোটে তার ধ্বংসাবশেষ আছে।

রাজোয়াঙে বর্ণিত যে রনবী দ্বীপে আরব জাহাজ ভেঙে ছিল, তাও সম্ভবত রামু। সম্ভবত উত্তর চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে ত্রিপুরা ও আরাকানে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদ চলছিল। এই যুদ্ধে সৈনাপত্য পান ত্রিপুরার রাজকুমার রাজ্যধর। ইনি রামু অবধি অগ্রসর হন। উঁকিয়ার শাসনকর্তা আদমের এলাকার সীমায় আরাকানীরা তাকে বাধা দিল। রসদ যোগাড়ে অসমর্থ হয়ে রাজ্যধর চট্টগ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হন। আরাকান পক্ষ উঁকিয়ার সামন্তের মধ্যস্থতায় সন্ধির প্রস্তাব পাঠালে অমর মাণিক্য তা গ্রহণ করেন। রাজ্যধর ত্রিপুরায় চলে গেলে সন্ধিভঙ্গ করে আরাকানীরা চট্টগ্রাম দখল করে। অমর মাণিক্য আবার রাজ্যধরকে পাঠালেন। আরাকানরাজ চালাকি করে গজদন্ত নির্মিত মুকুট উপহার দিয়ে সন্ধির জন্যে দূত প্রেরণ করলেন। রাজ্যধরের সঙ্গে আরো দুইজন রাজপুত্র এসেছিলেন। মুকুটের দাবী নিয়ে তিনজনের মধ্যে বিবাদ শুরু হল। আর আরাকানরাজ এ সুযোগে তাদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করলেন। সেনাপতি রাজ্যধর শামুক ফুটে পঙ্গু হলেন। অপর রাজপুত্র যুঝামাণিক্য নিজের মত্ত হাতীর আক্রমণে প্রাণ হারালেন।

এ কাহিনীতে সত্য আছে কিনা জানিনে। তবে ১৫৮৫ সনে রালফ ফিচ চট্টগ্রামকে আরাকান অধিকারে দেখলেও ত্রিপুরার সঙ্গে আরাকানের স্থায়ী সংগ্রামের কথাও শুনেছিলেন। অবশ্য রাজমালা মতে অমর মাণিক্য (সম্ভবত ১৫৮৫ সালে) আরাকানরাজ থেকে চট্টগ্রাম ছিনিয়ে নেন। আবার আরাকানী সূত্রে জানা যায় ১৫৮৬ সালে রাজা মঙ ফাল ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রাম জয় করে নেন। আইন-ই-আকবরীর সমাপ্তিকাল ১৫৯৮ সন। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে : To the south-east of Bengal is a considerable Tract called Arakan which possesses the port of Chittagong। কাজেই ১৫৯৮ সাল অবধি অন্তত চট্টগ্রাম আরাকান অধিকারে যে ছিল, তা নিশ্চিত।

জ. আগেই বলেছি রাস্তিখানের সন্তান মীনাখান ও তার বংশধরগণ অন্তত ১৬৬৫ সাল অবধি চট্টগ্রামের শাসনকার্যে উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন। মীনা খার পৌত্র হামজা খান (মসনদ-ই-আলা– মছলন্দ) গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর আমলে (১৫৩৮ খ্রী. অবধি) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। খুদাবখশ খান নামে অপর ব্যক্তিও তার সহকারী বা তার সমকক্ষ অপর পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই হামজা খানকে পর্তুগীজরা আমীরজা খান বলে উল্লেখ করেছে। গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহর সময়ে এ দুইজনের মধ্যে সদভাব ছিল না একজন ছিলেন পর্তুগীজদের বশে, অপরজন পর্তুগীজ-বিদ্বেষী। দুইজনের দ্বন্দ্বের সুযোগে শেরশাহ প্রেরিত নোগাজিল ( নিয়াম; খিজিরঃ) সহজেই চট্টগ্রাম দখল করে নিলেন। এ সময় পর্তুগীজ কেপ্টেন সেমপাউ মনস্থির করে কিছুই করতে পারলেন না, ফলে চট্টগ্রাম স্বাধিকারে পাওয়ার সুযোগ হারালেন : Castanheda তাই বলেছেন …through the folly and indiscretion of Sampayo, the king of Portugal lost Chittagong which could easily have been taken possession of considering that Sher Shah was busily engaged on the other side of bengal.

হামজা খান সম্বন্ধে মঞ্জুল হোসেন গ্রন্থে বলা হয়েছে যে তিনি ত্রিপুরা জয় করেন এবং তিনি পাঠান বিজয়ীও। এতে কিছু সত্য নিহিত রয়েছে বলে মনে করি। হামজা খান শের শাহর সেনাপতি চট্টগ্রাম বিজেতা নোগাজিলের ( নিযাম খিজির?) সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, তাই বোধ হয় গৌরব-গর্বী উত্তরপুরুষ মুহম্মদ খানের বর্ণনায় লীলায় পাঠানগণ জিনি পাচ্ছি। আর ১৫৫৩-৫৫ সালে বিজয় মাণিক্যকে বিতাড়িত করেন বলেই কবি করিয়া বিষম রণ জিনিয়া ত্রিপুরাগণ লিখেছেন। এতে বোঝা যায় নোগা- জিলের বিজয়ের পরেও তিনি স্বপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। হামজা খানের পর তাঁর পুত্র নসরত খানও পিতৃপদ প্রাপ্ত হন। আরাকানী সূত্রে জানা যায়, নসরত খান গৌড়ের পাঠান সুলতানের তথা শামসুদ্দীন বাহাদুর শাহর (ওফেঁ খিজির খান ১৫৫৬-৬০) আমল থেকে সোলায়মান কররানীর (১৫৬৫-৭২) আমলের মাঝামাঝি কাল অবধি (১৫৬৯-৭০) চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন। কিন্তু নসরত খানের সময় চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধিকারে ছিল–গৌড়ের নয়। ত্রিপুরারাজের উজির নসরত খান আরাকানরাজ সউলাহর (১৫৬৩-৬৪) কাছে আত্মরক্ষামূলক সাময়িক বশ্যতা স্বীকার করে সউলাহকে ভেট পাঠিয়ে তুষ্ট রাখেন। কিন্তু সউলাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র মঙসিইটা বা মঙসিতা (১৫৬৪-৭১) সম্ভবত নসরত খানের আনুগত্য দাবী করেন। তখন দেয়াঙ্গ ও চট্টগ্রামের পর্তুগীজেরা ছিল আরাকানরাজের বশে। আরাকানরাজের ইঙ্গিতেই নসরত খানের সঙ্গে পর্তুগীজদের বিবাদ বাধে এবং পর্তুগীজদের হাতেই ১৫৬৯-৭০ সালে তিনি প্রাণ হারান। উদয় মাণিক্যের (১৫৮৫-৯৬) সময়ে ঈসা খান সম্ভবত ত্রিপুরা রাজ্যের সৈনাপত্য গ্রহণ করেন এবং চট্টগ্রামে কিছুকাল অবস্থান করে সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তাঁর বাসভূমি আজো ঈসাপুর নামে পরিচিত। আগেই উল্লেখ করেছি ১৫৮৫-৮৬ সনে আরাকানের ও ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে ত্রিপুরার রাজকুমার রাজ্যধরের সৈনাপত্যে কয়েকটি যুদ্ধ ঘটে। রামু-চকরিয়ার আরাকানী সামন্ত আদম আরাকানরাজের বিরাগভাজন হয়ে আশ্রয় নিলেন অমর মাণিক্যের। আরাকানরাজ আদমকে ফিরিয়ে দেবার দাবী জানালে অমর মাণিক্য আশ্রিতকে সমর্পণ করতে অস্বীকার করেন। এতে তৃতীয়বার ত্রিপুরা বাহিনী চট্টগ্রামে প্রেরিত হয়। এবার ত্রিপুরা বাহিনীতে পাঠান সৈন্যও (সম্ভবত ঈসা খানের নেতৃত্বে) নিযুক্ত ছিল, তারা দুই লক্ষ আরাকানী সৈন্যের বাহিনী দেখে ভয় পেয়ে গেল এবং বিশ্বাসভঙ্গ করে ত্রিপুরা সৈন্যদের সম্পদাদি লুট করে পালিয়ে যায়। অমর মাণিক্য এ আকস্মিক বিপর্যয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ঈসাপুর থেকে ধুমঘাট হয়ে পালিয়ে যান এবং অপমানে আত্মহত্যা করেন (১৫৮৬)। মঘেরা রাজধানী উদয়পুর লুট করে সেখানে পনরো দিন অবস্থান করে। তার পর আরাকানরাজ মঙ ফালঙ (১৫৭১-৯৩) যুগদিয়া, আলমদিয়া প্রভৃতি জয় করে ঢাকাও দখল করেন। এভাবে ঢাকা-ত্রিপুরা ও নোয়াখালীর কতেকাংশ ও চট্টগ্রাম অধিকৃত হওয়ায় আরাকানরাজের গৌরব বৃদ্ধি পেল। এ যুদ্ধে আরাকানের চট্টগ্রামস্থ উজির (শাসক) নসরত খান-পুত্র জালাল খান গোপনে ত্রিপুরা রাজের সহায়ক ছিলেন। অমর মাণিক্যের পরাজয়ে ও আত্মহত্যার সংবাদে তিনি নাকি ভয়েই প্রাণ হারান (১৫৮৬)। ১৫৮৫ সালে মুঘল সেনাপতি শাহবাজ কামুও চট্টগ্রাম জয়ের চেষ্টা করেন।

জালাল খানের পুত্র, কবি মুহম্মদ খানের পিতৃব্য বিরহিম বা ইব্রাহিম খান চট্টগ্রামে আরাকানী উজির হন (১৫৮৬)। ১৬০৭ সনে Francois pyvard প্যাগানরাজের (আরাকান রাজের) অধীনে চট্টগ্রামে মুসলিম শাসনকর্তা দেখেছেন। ইনি সম্ভবত ইব্রাহিম খান।

কহে ফতে খানে, সখি উপায় আছ নাকি
শ্রীযুক্ত ইব্রাহিম খান
ভব কল্পতরু জানহ আমার
পীর মীর শাহ সুলতান।

এই ইব্রাহিম যদি উজির ইব্রাহিম খান হন, তবে কবি সৈয়দ সুলতান ও তিনি সমসাময়িক ছিলেন। ফতে খানের অপর পদে আলাউল খানের নাম আছে। এতে মনে হয় ফতে খানের পীর ছিলেন সৈয়দ সুলতান। উজির ইব্রাহিম খান ছিলেন ফতে খানের জ্যেষ্ঠ সমসাময়িক অর আলাউল ছিলেন তার প্রায় সমবয়সী। ১৫৮৬-১৬০৭ সনের মধ্যে লায়লী মজনু কাব্যোক্ত নিযাম শাহসুর চট্টগ্রামে আরাকানী শাসনকর্তা ছিলেন বলে ডক্টর যে অনুমান করেছেন, তা যদি মানতে হয় তাহলে উজির হিসেবে ইব্রাহিম খানের স্থিতি অস্বীকার করতে হবে। জালাল খানের বিশ্বাসভঙ্গের পর থেকে আরাকানরাজের পুত্র কিংবা ভ্রাতা চট্টগ্রামে প্রধান শাসকরূপে নিযুক্ত হতে থাকেন। এবং এটি রেওয়াজে পরিণত হয়। ম্যানরিক (১৬২৯-৩৫) বলেন : The principality of Chittagong belonged by hereditary right to the second son. আরাকানরাজ মঙরাজাগী বা মঙইয়াজাগীর মুসলিম নাম ছিল সলিম শাহ (১৫৯৩-১৬১২)। তিনি নিজেকে আরাকান, বাঙলা ও ত্রিপুরার নরপতি বলে অভিহিত করতেন। চট্টগ্রামে তৈরি তাঁর মুদ্রায় আরবি, বর্মী ও নাগরী হরফ উত্তীর্ণ করান।

এ যুগটা চট্টগ্রামে পর্তুগীজ প্রাবাল্যের কাল। পরে বিস্তৃতভাবে পর্তুগীজ ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হবে।

ঝ. ১৬১৬ সালে বাঙলার মুঘল সুবাদার কাসিম খান চট্টগ্রাম বিজয়ে অগ্রসর হন। তিনি নিজে ভুলুয়া অবধি গিয়ে আবদুন নবীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন। আবদুন নবী নিযাম-পুরের জমিদারকে বশে এনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আরাকানী সৈন্যেরা বাড়বকুণ্ডের নিকটে কাঠের দুর্গ তৈরি করে তাকে বাধা দিলেন। এ স্থান এখন কাঠগড় নামে পরিচিত। দুই দিন যুদ্ধ হল, মুঘলেরা সুবিধা করতে না পেরে ঢাকার দিকে চলে এল। এ যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা মেলে বাহারীস্তান গয়বী গ্রন্থে।

ঞ. ১৬২১ সনে মুঘল সুবাদার ইব্রাহিম খানও চট্টগ্রাম বিজয়ে অগ্রসর হন। তিনি ত্রিপুরা থেকে জঙ্গল পথে (রামগড় পাহাড় হয়ে) এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পথের বন্ধুরতার অভিজ্ঞতা তার ছিল না বলে অভিযানের চেষ্টা ত্যাগ করে তাকে ফিরতে হল। ১৬২৪ সালে শাহজাদা খুরম যখন সুবাদার ইব্রাহিম খানকে হত্যা করে ঢাকা দখল করেন, তখন আরাকানরাজ সুধর্মার সঙ্গে খুরমের মৈত্রী হয় এবং মৈত্রীর নিদর্শনস্বরূপ উপহার বিনিময় হয়। ১৬২৫ সালে বাঙলার সুবাদারের প্ররোচনায় চট্টগ্রামে আরাকানরাজের বিরুদ্ধে সামন্ত-বিদ্রোহ ঘটে। এ বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে এলেন। স্বয়ং সুধর্মা রাজা (১৬২২-৩৮)। তিনি চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করে ভুলুয়ায় হানা দেন (১৬২৬) এবং আরো এগিয়ে গিয়ে দোলাই খাল বেয়ে খিজিরপুর ও ঢাকা লুণ্ঠন করে বহু ধন-রত্ন ও বন্দী নিয়ে ফিরে যান। সুবাদার মহব্বত খান কিংবা তার সন্তান খান জাদ খান কোনো বাধাই দিতে পারলেন না (Campos)। ভুলুয়ার থানাদার মির্জা বুগীস ৭০০ অশ্বারোহী ৩০০ রণতরী নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ফল হয়নি।

ট. ১৬৩৮ সালে চট্টগ্রামস্থ আরাকানী শাসনকর্তা মুকুটরায় (Magat Re–সেনাপতি, ফিল্ড মার্শাল) আরাকানরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। লোকশ্রুতি এই যে, মুকুটরায়ের পিতা গৌড়েশ্বর রায়ের নিবাস ছিল খণ্ডল পরগনায়। তিনি নাকি চট্টগ্রাম অধিকারের ব্যাপারে ত্রিপুরা রাজের বিরুদ্ধে আরাকানরাজকে সাহায্য করেন এবং চট্টগ্রামের কদুরখিল গায়ে বসতি নির্মাণ করেন। অপর মতে, সুধর্মা রাজার মৃত্যুর পর তার রাণির প্রেমিক নরপতিণি যখন সিংহাসন দখল করেন, তখন চট্টগ্রামের আরকানী শাসক Magat Re বিদ্রোহী হন। Magat Re আরাকানে হানা দেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ভুলুয়ার মুঘল থানাদারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর পিছু নিয়ে আরাকানী সৈন্যেরাও যুগদিয়া অবধি অগ্রসর হয়। এখানে সুবাদার ইসলাম খান মসৌদির নৌবাহিনীর সঙ্গে আরাকানীদের যুদ্ধ হয়। আরাকানীরা এ যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। কিছুকাল পরে পর্তুগীজদের প্ররোচিত করে এবং নিজেও সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়ে আরাকানরাজ মুঘল শাসিত বাঙলার নানাস্থানে মানুষ ও ধনসম্পদ লুট করাতে লাগলেন। ইসলাম খানের সঙ্গে আরাকানরাজের নৌযুদ্ধও হয়। মুঘলেরা মগ হার্মাদের ধ্বংসকার্য প্রতিরোধ করতে পারেনি। ১৬৬৫ সাল অবধি জলপথে বাঙলা দেশের সর্বত্র অবাধে পীড়ন ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। এরা। ১৬৬৫ সালের পরেও মগ-ফিরিঙ্গী দস্যুদের হামলা বন্ধ হয়নি, তবে কমে ছিল।

ঠ. আওরঙজীব কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সুজা আরাকান-রাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন (১৬৬০)। তরুণ রাজা চন্দ্র সুধর্মা সুজা-কন্যার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অভিজাত ও মুসলমান সুজা সে-প্রস্তাব চরম অবজ্ঞায় প্রত্যাখ্যান করলে রূপমুগ্ধ, অপমানিত রাজা সুজার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেন। তিনি সুজাকে দেশত্যাগের ইঙ্গিত দেন, কিন্তু মক্কা পাঠাবার জন্যে প্রতিশ্রুত নৌকা দিতে অসম্মত হন। সুজা আসন্ন বিপদের শঙ্কায় মরিয়া হয়ে উঠলেন এবং আরাকানী মুসলমান ও বাঙালিদের নিয়ে তিনি আরাকান সিংহাসন দখলে প্রয়াসী হন। যথাসময়ে চন্দ্র সুধর্মা এ খবর পেয়ে সানুচর সুজাকে আক্রমণ করেন। সুজা পালিয়ে যান, তার অধিকাংশ অনুচর নিহত হন। তার পরিবার বন্দী হয়। সুজাও পরে ধৃত হয়ে নিহত হন। সুজার দুই মেয়ে আত্মহত্যা করে। এক মেয়ে রাজপরী হওয়ার পর রাজার প্রাণনাশের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে প্রাণ হারান। সুজার তিন পুত্র বন্দী থাকে। বাংলার মুঘল সুবাদার মীর জুমলা সুজার পুত্রদের প্রত্যর্পণের দাবীতে এক ওলন্দাজ বণিককে রোসাঙ্গে দূত পাঠান। সুধর্মা সে দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এবং মীর জুমলার হুমকিতে বিরক্ত হয়ে সুজার পুত্রদের হত্যা করেন (১৬৬৩)। সুজার পুত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল বহু বাঙালি মুসলমানকেও রুষ্ট রাজা নির্বিচারে হত্যা করান। সুজা ও সুজা-কন্যার করুণ পরিণতির কাহিনী নিয়ে রচিত গাথা পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সংকলিত রয়েছে।

আওরঙজীব এ সংবাদে সম্ভবত অপমানিত বোধ করেন। তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ বাঞ্ছায় শায়েস্তা খানের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৬৬৬ সনে ২৭ শে জানুয়ারি শায়েস্তা খানের পুত্র বুজর্গ উমেদ খান চট্টগ্রাম দখল করেন। অবশ্য মুঘল বাহিনী এগিয়ে যেয়ে রামু অবধি গোটা চট্টগ্রামই অধিকার করেছিল। কিন্তু বর্ষাকাল উপস্থিত হওয়ায় জল-কাদার জীবনে অনভ্যস্ত মুঘল বাহিনী চট্টগ্রামে ফিরে আসে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আবার আরাকান- অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অধিকার ১৭৫৬ সাল অবধি বহাল থাকে। আবদুল করিম খোন্দকার রচিত দুল্লা মজলিসে রামুর আরাকানী শাসকের প্রশস্তি আছে। সহস্রেক সাথে শতেক সাত মঘীসনে তথা (১১০৭+ ৬৩৮) ১৭৪৫ খ্রীস্টাব্দে এই গ্রন্থ রচিত। তখনো মাতামুহুরী নদীর দক্ষিণতীর তথা আধুনিক কক্সবাজার মহকুমা অঞ্চল আরাকান অধিকারে ছিল। সম্ভবত মুঘল সীমান্ত সেনানী আধু খাঁ-ই চট্টগ্রামেরদক্ষিণ প্রান্তে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।

ড. ঈসা খান :কিংবদন্তি অনুসারে ভূঁইয়া-শ্রেষ্ঠ ঈসা খান চট্টগ্রামে কিছুকাল আত্মগোপন করে ছিলেন। চট্টগ্রামে তার বাসস্থান ঈসাপুর নামে খ্যাত হয়। এটি এখনো একটি সমৃদ্ধ গ্রাম এবং ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত। ঈসাপুরের পাশেই আছে কবি শা বারিদ খানের পূর্বপুরুষ নানুরাজা মহল্লিকের নামের নানুপুর। ঈসা খান যে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন এবং সদর জাহাকে পীর কিংবা বন্ধু করেছিলেন, তা মুক্তল হোসেন কাব্যেও রয়েছে। এমনও অনুমতি হয় যে মুঘল সেনাপতি শাহবাজ কামু কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ঈসা খান (১৫৮৩) ত্রিপুরা রাজ্যান্তৰ্গত উত্তর চট্টগ্রামে বসতি-বিরল এক গ্রামে বাস করতে থাকেন।কিংবদন্তি অনুসারে ১৫২৫ সালে যখন নুসরৎ শাহ উত্তর চট্টগ্রাম দখল করেন, তখন এই অঞ্চলের আরাকানী মগেরা আরাকান অধিকারে চলে যায়। একে মগ ধাওনী তথা মগ-ধাওয়া বলে উল্লেখ করা হয়। ফলে উক্ত স্থানটি জনবিরল হয়েছিল। রাজামালা মতে অমর মাণিক্যের সৈনাপত্য করেছেন ঈসা খানই। ঈসা খান চট্টগ্রামে সংগৃহীত সৈন্য দিয়েই সোনারগাঁয়ে মুঘলদের এবং কোচবিহারের রাজাকে পরাজিত করেন।

চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের ভূমিকা

১৪৯৮ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর। এই বছরেই ভাস্কো-ডা-গামা ভারতের উপকূলের সন্ধান পান। তখন থেকেই ভারতের সম্পদে রিক্ত আর অন্তরে ঋদ্ধ হওয়ার পালা শুরু। ১৪৯২ সনে স্পেন থেকে মুসলিমরা বিতাড়িত হয়, আর সঙ্গে সঙ্গেই পর্তুগীজরা সুদূরের ডাকে মুক্ত-পক্ষ বিহঙ্গের মতো দিকবিদিকে ছুটে চলল চোখে তাদের আনন্দিত দিনের স্বপ্ন, বুকে তাদের হিম্মত, মাটি তাদের পায়ের নিচে, সমুদ্র তাদের দাঁড়ের আঘাতে বিক্ষত, বাতাস তাদের পালে ধরা, আকাশ তাদের মাথার ছাতা। আরব-ইরানের নামনিশানা রাখবে না তারা নীলসমুদ্রে। কেবল তাদের জাহাজই পাল তুলবে সাতসাগরে। হাঁসের মতো তারাই হবে জলচর। এ উদ্দেশ্য সাধনে তারা দৃঢ়পণ। তাদের নিয়ন্তা হবে লোভ, পাথেয় হবে বাহুবল ও মনের জোর। ন্যায়-নিয়ম-নীতির পরওয়া তারা করবে না। তাই

On reaching portugal the next spring (1499) da Gama advised the king that provided sufficiently strong force were sent, the Moslems could be driven off the sea and the Trade divcerted from the Persian Gulf to the cape route. Emanuel accepted this advice and in the following years put it into operation… built fortresses from Africa to Malacca …

পর্তুগীজরা গোড়া থেকেই এ লক্ষ্যে কাজ করেছে এবং প্রায় আড়াইশ বছর ধরে সর্বপ্রকার অপকর্মে লিপ্ত ছিল। বাঙালির কাছে পর্তুগীজ তথা হার্মাদ ( Armadan) নামটি ত্রাস ও বীভৎসতার প্রতীক। এমন পুরুষানুক্রমিক ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে আচরণের নজির ইতিহাসে বিরল। আরো আশ্চর্যের কথা, এর মধ্যেও নাকি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল- There was religious zeal to enslave people and convert them to christianity. Their, abduction, ruin, enslavement, degradation were spiritually an extra-ordinary piece of good fortune for them .. .. Manriqe gives statistics : 3400 persons were kidnapped annually and brought to Dianga. Of these he was able to baptize some 2000 a year. He goes on to say these that it was easier to convince these wretched beings than the residents in the Chittagong Province among whom the annual average of conversion was not more than 400. Their (kidnapped persons) misery and despair did not shock Manriqe because his mind was fixed on saving their soul by baptizing.

এমনিভাবে পর্তুগীজদের কেউ পার্থিব, কেউ অপার্থিব সম্পদ লাভের লোভে পড়ে সহজ স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব হারিয়ে আড়াইশ বছর ধরে মানুষের দেহ-মনের উপর সীমাহীন পীড়ন চালিয়েছে।

গামা ভারতের উপকূলেই নৌকা ভিড়িয়েছিলেন বটে, কিন্তু খবর নিয়ে গিয়েছিলেন তিন সাগরের। বাঙলা সম্বন্ধে (১৪৯৯) রাজার কাছে তার প্রতিবেদন ছিল এরূপ :

Bengal has moorish king and mixed population of Christians and moors, Its army may be about 24000 strong, 10000 being cavlry and the rest infantry with 400 war elephants. The country could export quantities of wheat and very valuable cotton goods, clothes which sell on the spot for 225-6d fetch 90 s. in calicut. It abounds in silver.

পূর্বদেশীয় পর্তুগীজ গভর্নর Albuquerque ১৫১৩ সালে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েলকে জানান Bengal requires all our marchandise and is in need of it. কিন্তু আসলে বাঙলার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য-সম্পর্ক গড়ে উঠে আরো আঠারো-উনিশ বছর পরে।

১৫১৪ সনের উড়িষ্যার পিপলি বন্দরে পর্তুগীজেরা বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করে। সেখান থেকেই তারা মেদিনীপুরের হিজলী বন্দরে যাতায়াত করত। ১৫১৭ সনে জোয়াও দ্য সিলভীরার নেতৃত্বে প্রথম বাণিজ্যবহর চট্টগ্রাম বন্দরে উপস্থিত হয়। জোয়াও দ্য সিলভীরা বাণিজ্যের অনুমতি লাভের দৌত্য নিয়ে এসেছিলেন। এসেই কিন্তু দুটো স্থানীয় বাণিজ্যতরী লুট করেন। এ নিয়ে চট্টগ্রামের শাসনকর্তার সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। কাজেই কুঠি নির্মাণের জন্যে রাজ-অনুমতি লাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি ফিরে যান। ১৫২৮ সন অবধি দ্য সিলভীরা সমুদ্রে অন্যদের বাণিজ্যতরী লুট করতে থাকেন। এর ফলে এদেশের বাণিজ্যে বিপর্যয় ঘটে। এত অপকর্ম করেও পর্তুগীজেরা বাঙলার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের আশা ছাড়েনি। প্রতি বছর তাদের অন্তত একখানা বাণিজ্য জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসত। আর গোয়র পর্তুগীজ গভর্নর নুনো দ্য কুনহা অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রামে পর্তুগীজের বাণিজ্যাধিকার লাভের জন্যে। ভাসকো ডা গামা যেমন প্রথমবারেই কালিকটে জেলেদের বেঁধে রেখে রাজার থেকে সুবিধে আদায় করে নিয়েছিলেন, এখানেও সে উপায় অবলম্বিত হল।

১৫২৮ সনে পর্তুগীজ কেপ্টেন আফোনসো দ্য মেলোর জাহাজ চট্টগ্রাম ও আরাকানের মাঝামাঝি স্থানে ঝড়ের মুখে পড়ে ভেঙে গেল। জেলেরা তাদের উদ্ধার করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসক খুদাবখশ খানের নিকট নিয়ে এল। খুদা বখশ মেলোর সাহায্যে তাঁর এক প্রতিপক্ষকে দমন করেন, এবং ভবিষ্যতে এ প্রকার কাজে সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে মেলোকে বন্দী করে রাখেন। গোঁয়ার পর্তুগীজ শাসনকর্তা নুনো দ্য কুনহার কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি অরমুজের বণিক খাজা শাহাবুদ্দীনকে পর্তুগীজ কর্তৃক লুণ্ঠিত তার জাহাজ ও পণ্য ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে বশ করেন। এবং ৩০০০ কুজুওডুস বা টাকা মুক্তিপণ নিয়ে দ্য মেলোকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে খাজা শাহাবুদ্দীনকে দূত করে পাঠালেন গৌড় দরবারে। এ দৌত্য সাময়িকভাবে সফল হল।

১৫৩৩ সনে মেলো আবার পাঁচখানা জাহাজ ও দুইশ অনুচর নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এলেন। এলেন পথে পথে দেশী ও আরব বাণিজ্যতরী লুট করে করেই। বন্দরে এসে তিনি গৌড়-সুলতান। গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহর কাছে Duarte-de-Azevdo-র নেতৃত্বে বারোজন লোক মারফত বহুমূল্য উপহার পাঠালেন। উপহার সামগ্রীর মধ্যে বাঙালির জাহাজ থেকে লুটকরা গোলাপজলের পিপাও ছিল। সুলতান লুণ্ঠিত দ্রব্য শনাক্ত করতে পেরে দরবারে প্রেরিত পর্তুগীজদের বন্দী করলেন। সানুচর মেলোকে বন্দী করার জন্যেও নির্দেশ পাঠালেন। ইতিমধ্যেই শুল্ক-ব্যাপারে মেলোর বিবাদও বাধল চট্টগ্রামের শুল্ক-কর্মচারীদের সঙ্গে। সুলতানের নির্দেশ আর এই বিবাদের সুযোগে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা Mello-র সঙ্গে সংঘর্ষ বাধালেন। তাতে পর্তুগীজদের বিপুল ক্ষতি হল ধনে-প্রাণে। এ সংবাদ পেয়ে পর্তুগীজ শাসনকর্তা প্রতিশোধ নেবার জন্যে ৩৫০ জন লোক নিয়ে আনতেনিও দ্য সিলভা মেনজিস-এর নেতৃত্বে এক নৌবহর পাঠালেন। মেনজিস চট্টগ্রামে পৌঁছে বন্দীদের মুক্তি দাবী করলেন। মাহমুদ শাহ পর্তুগীজ কারিগর প্রাপ্তির শর্তে–অপর মতে ১৫০০০ পাউন্ড মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু শর্তারোপে রুষ্ট হয়ে মেনজিস চট্টগ্রাম বন্দরে আগুন লাগিয়ে দেন এবং বহু লোক হত্যা করেন ও বন্দী করে নিয়ে যান। করমণ্ডলের পর্তুগীজ অধ্যক্ষ Diego Rebello ১৫৩৫ সনে সশস্ত্র অনুচর নিয়ে সপ্তগ্রামে আসবার। পথে দুটো আরব বাণিজ্য-জাহাজকে বঙ্গোপসাগর থেকে বিতাড়িত করেন।

তবু শেরশাহর আক্রমণে বিপর্যস্ত মাহমুদ শাহ পর্তুগীজদের হাত করতে প্রয়াসী হলেন। ফলে মেলো ও রেরেলোকে শেরশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে লাগালেন। এই সুযোগে রেবেলো চট্টগ্রাম বন্দরের পূর্ণ অধিকার লাভ করলেন এবং এরূপে আরব ইরানী ও অন্যান্য জাতির চট্টগ্রামের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক ছিন্ন হল। Villalobos ও জোয়াও কোরিয়ার নেতৃত্বে শেরশাহর বিরুদ্ধে মেলো দুটো নৌবাহিনী দিয়েছিলেন। এই কৃতজ্ঞতায় মাহমুদ শাহ মেলোকে ৪৫০০০ রী (Reis) এবং পর্তুগীজ সৈন্যদের মাথাপিছু দৈনিক ১০ টাকা করে ভাতা দেন এবং চট্টগ্রামে ও সপ্তগ্রামে তারা কুঠি নির্মাণ ও শুল্কালয় প্রতিষ্ঠার অধিকার পায়। এমনকি নুনো ফারনানডেজ Freire এবং জোয়াও কোরিয়া যথাক্রমে চট্টগ্রামে ও সপ্তগ্রামে শুল্ক বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এর পরে বাঙলায় এলেন কেপ্টেন আফনসো দ্য ব্রাইটো। মাহমুদ শাহর সাহায্যার্থ গোয়া থেকে ভাসকো-ডা সেম্পাও-র নেতৃত্বে নয়টি রণতরী প্রেরিত হয়। এ সময় মাহমুদ শাহর চট্টগ্রামস্থ শাসনকর্তা খুদাবশ খান ও হামজা খানের মধ্যে বিরোধ চলছিল। পর্তুগীজ শুল্কাধ্যক্ষ Fernandez হামজা খানের পক্ষাবলম্বন করেন। এ বিরোধের সুযোগে শেরশাহর সেনাপতি খিজির খান চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকার পান। কিন্তু শীঘ্রই সেম্পাও-এর বাহিনী খিজির খার প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করেন। তখন শেরশাহর পক্ষ থেকে পর্তুগীজদের আশ্বাস দেয়া হল, তারা আগের মতো সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা পাবে। এতে পর্তুগীজ-অধ্যক্ষ ফারনানডেজ হামজা খানের পক্ষ ত্যাগ করে খিজির খানের তথা শেরশাহর পক্ষ নিলেন। কিন্তু তখনো সেম্পাওর প্রেরিত পর্তুগীজ সৈন্যেরা হামজা খানের পক্ষে ছিল। তারা খিজির খানের অফিসারদের ধরে নিয়ে সেম্পাওর জাহাজে বন্দী করে রাখল। এ বিরোধের ফলে ১৫৪০ সালের দিকে খিজির খানের হাতে পর্তুগীজদের ধন-প্রাণের ক্ষতি হল বিস্তর। এরূপে সেম্পাওর অবহেলা এবং ফারনানডেজের অপরিণামদর্শিতার ফলে চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিকার প্রাপ্তির সুযোগটি পর্তুগীজদের হারাতে হল। অবশ্য পর্তুগীজরা বাণিজ্য ও দস্যুবৃত্তি দুটোই সমান চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তবু ষোলো শতকের শেষাবধি পর্তুগীজেরা বাঙলা দেশে দুর্গাদি নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। যদিও চট্টগ্রামে (Porto Grando) ও হুগলীতে (galin or porto pequino) তারাই প্রায় একচেটিয়া বাণিজ্যের উপায় করে নিয়েছিল। চট্টগ্রামে পর্তুগীজ ভূমিকার প্রধান ঘটনাগুলো এই:

ক. ১৫৬৯ সনে Ceasar Frederick সন্দ্বীপে মুসলিম বাসেন্দা ও মুসলিম সুশাসক রাজা দেখে ছিলেন।

খ. ডক্টর জেমস ওয়াইজ-এর মতে ফাদার ম্যানরিক ১৬৩০ সনে চট্টগ্রামে উপস্থিত হন।

গ. ফ্রানসিস ফারনানডিজ নামে গোয়ানিজ পাদ্রীর বন্দী হিসেবে ১৬০২ সনে চট্টগ্রামের কারাগারে মৃত্যু হয়। আরাকানরাজের পীড়নেই তার মৃত্যু হয়।

ঘ. ১৬০১ সনে যশোরে ও চট্টগ্রামে দুটো জেসুইট মিশন আসে। তখন দেয়াঙ্গে এক গীর্জাও ছিল।

ঙ. ১৬০২ সনে পর্তুগীজেরা চট্টগ্রামে আরাকান শাসক কর্তৃক উৎপীড়িত হয়ে সন্দ্বীপে ঘাঁটি করে। সন্দ্বীপ আগে বাকলারাজের শাসনে ছিল, কিন্তু পরে গৌড় শাসনভুক্ত হয়। ১৫৬৫-৮৬ সনের দিকে সন্দ্বীপের মুসলমানেরা পর্তুগীজদের প্রতি প্রীতি ও সৌজন্য রাখত।

চ. বাকলারাজের অনুগত Dominique Carvalho এবং Manuel-de-Mallos–এর যুক্তবাহিনী সন্দ্বীপ দখল করল। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই আরাকানরাজ তাদের বিতাড়িত করে সন্দ্বীপ পুনরাধিকার করে বাকলা জয় করেন (১৬০২), যশোরে হানা দেন এবং বাংলাদেশ জয়ের হুমকি হাকেন। তখন কারভালহু কিছু অনুচরসহ পালিয়ে শ্রীপুরে আশ্রয় নেন।

ছ. ১৬০৭ সনে আরাকানরাজ দেয়াঙ্গ দখল করেন। দেয়াঙ্গের পর্তুগীজ বাসেন্দাদের কিছু নিহত হয়, কিছু মেঘনার দ্বীপাঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। এক মুঘল নৌ-অধ্যক্ষ ফতেহ খান সন্দ্বীপ দখল করে মুঘলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। তিনিও পর্তুগীজ আর খ্রীস্টান দাসদের হত্যা করে উচ্ছেদ করেন। এ সময় সাবসটিয়ান গনজালিস টিবাও এবং কিছুসংখ্যক পর্তুগীজ দেয়াঙ্গ থেকে পালিয়ে গিয়ে দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করে। এদিকে ফতেহ খান ১৬৬৫ সনে মুঘল সেনা ইবন হোসেনের হাতে পরাজিত ও বন্দী হন।

জ. দস্যু গনজালিস ক্রমে শক্তিশালী হয়ে সন্দ্বীপের স্বাধীন রাজা হন। তিনি চন্দ্রদ্বীপের রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বিশ্বাস ভঙ্গ করেন। আবার আরাকানরাজ-ভ্রাতা আনোপোরমকে বশ করে তার ভগ্নীকে বিয়ে করেন এবং কিছুকাল পরে তাকে হত্যা করে বহু ধনরত্নের মালিক হন। গনজালিস সন্দ্বীপে নয় বছর রাজত্ব করার পরে আরাকানরাজের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যান (১৬১৬) 4016 I (Gongales s) sovereignty passed like a shadow. his pride was humbled and his villainies punished. পর্তুগীজরা এরপরে আর কোনোদিন রাজনৈতিক প্রতিপত্তি লাভ করেনি, তবে উপকূলাঞ্চলে অপ্রতিহতভাবে দৌরাত্ম্য করতে থাকে। হার্মাদদের জালিয়া দেখলে মুঘল নওয়ারাও ত্রস্ত হয়ে উঠত।

ঝ, বানিয়ার বলেছেন–(১৬৬৮) St Augustine সম্প্রদায়ের এক ভিক্ষু Fra goan কয়েক বছর ধরে স্বাধীনভাবে সন্দ্বীপে রাজত্ব করেছেন।

ঞ. বহু পর্তুগীজ শাহ সুজাকে (১৬৬০) আরাকানরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সহায়তা করেছে। সুজার পরাজয়ে এরা আরাকান থেকে পালিয়ে এসে বাঙলার উপকূলাঞ্চলে (সুন্দরবন, বাকলা ও হুগলী অবধি) ডাকাতি করে বেড়াত।

ট. ফ্রায়ার ম্যানরিক–এর (১৬২৮-৪৩) বর্ণনায় পাই:

১. পর্তুগীজরা আরাকানরাজের অনুমতি নিয়েই দেয়াঙ্গে বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করে। বন্দর করবার জন্যেই পর্তুগীজরা আরাকানরাজ থেকে দেয়াঙ্গ ইজারা নেয়।

২. আরাকানরাজ মুঘলশক্তিকে প্রতিরোধ করবার অভিপ্রায়েই পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহায়তা করতেন, এমনকি এ কার্যে ওদেরকে তিনিই নিযুক্ত করতেন এবং লুণ্ঠিত দ্রব্যের ও দাসের অর্ধেক পেতেন তিনি।

৩. দেয়াঙ্গে ও তার চারপাশের গায়ে খাঁটি ও সঙ্কর পর্তুগীজের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাতশ। এসব লোক কয়েকটি কম্পানী বা দলে বিভক্ত ছিল। আরাকানরাজ তাদের জায়গীর দিয়েছিলেন। ১৬১৬ সনে সন্দ্বীপের রাজা গনজালিস টিবাও আরাকানে হানা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। দেয়াঙ্গের পর্তুগীজদের উপর গোঁয়ার গভর্নর-এর কোনো কর্তৃত্ব চলত না। গনজালিস ও ব্রাইটো নিজেদেরকে গভর্নরের সমকক্ষ বলে দাবী করতেন।

৪. ম্যানরিক যখন দেয়াঙ্গে আসেন, তখন চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন সুধর্মার ভাই। তাঁর মৃত্যুতে নতুন এক শাসক প্রেরিত হন। ১৬০০-১৭ সাল অবধি পর্তুগীজ প্রতাপ অপ্রতিরোধ্য ছিল। তখন The portuguese had dreams of making and unmaking the rulers of Arakan। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেবার জন্য আরাকানরাজ দেয়াঙ্গে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে আওরঙ্গজীব দেয়াঙ্গের পেশাদার পর্তুগীজদের ঘুষে ও হুমকিতে বশ করেছিলেন।

ঠ. শিহাবুদ্দীন তালিসের বর্ণনায় আরো কিছু তথ্য মেলে :

১. চট্টগ্রাম দুর্গের ভেতরে একটি টিলায় একটি সমাধি আছে। ঐটি পীর বদরের আস্তানা নামে পরিচিত। মঘেরাও এ সমাধিকে তীর্থরূপে মানে কয়েকখানি গ্রাম এই সমাধির জন্যে ওয়াকফ করে দেয়া হয়েছে।

২. কর্ণফুলীর অপর তীরে চট্টগ্রাম দুর্গের বিপরীত দিকে একটি সুদৃঢ় ও উঁচু দুর্গ আছে। এখানে প্রতিরক্ষার সব উপকরণ মজুত থাকে। আরাকানরাজের বিশ্বস্ত আত্মীয় বা জ্ঞাতি চট্টগ্রামে শাসনকর্তা থাকেন। ১৫৮৬ সন থেকে এ ব্যবস্থা চালু হয়। আরাকানরাজ নিজের নামে চট্টগ্রামে স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করান।

৩. অতীতে বাঙলার সুলতান ফখরুদ্দীন চট্টগ্রাম জয় করে চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর অবধি রাস্তা (আল) তৈরি করিয়েছিলেন, এ রাস্তা শ্রীপুরের বিপরীত দিকে নদীর অপর পার থেকে শুরু। ফখরুদ্দীনের সময়ে নির্মিত মসজিদ ও সমাধি ছিল চট্টগ্রামে। এগুলোর ভগ্নাবশেষই তার প্রমাণ।

৪. বাঙলার সুলতানদের রাজত্বের শেষের দিকে এবং মুঘল শাসনের প্রথমদিকে বাঙলা দেশে বড় বিশৃঙখলা বিরাজ করত।

Chatgaon again fell into the hands of the Maghs who did not leave a bird in the air or a beast on the land (from Chatgaon) to Jagdia, the frontier of Bengal increased the desolation. Thick-kened the jungles, destroyed the Al and closed the road so well that even the snake and wind could not pass through. They built a strong fort and left a large fleet to guard it. Gaining composure of mind from the strength of the place they turned to Bengal and began to plunder it.

ইব্রাহিম ফতেহ জঙ্গ ব্যতীত কোনো মুঘল সুবাদারই শায়েস্তা খানের আগে এদের দমন করবার চেষ্টা করেননি। ফিরিঙ্গি ও মগ সমন্বিত আরাকানী জলদস্যুরা জলপথে বাঙলাদেশের ভুলুয়া, সন্দ্বীপ, সংগ্রামগড়, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, বাকলা, যশোর, ভূষণা ও হুগলী লুণ্ঠন করত। তারা হিন্দু মুসলিম, নারী-পুরুষ ও বড়-ছোট নির্বিশেষে ধরে নিয়ে যেত। হাতের তালু ফুঁড়ে বেত চালিয়ে গরু ছাগলের মতো বেঁধে নৌকার পাটাতনে ঠাই দিত। মুরগীকে যেভাবে দানা ছিটিয়ে দেয়া হয়, তাদেরকেও তেমনি চাউল ছুঁড়ে দেয়া হত খাবার জন্যে। এ অবহেলা ও পীড়নের পরেও যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে ভাগ করে নিত মঘে-পর্তুগীজে। মঘেরা অপহৃত লোকদের অবমাননাকর ও শ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত করত এবং পর্তুগীজেরা অপহৃত ব্যক্তিদের ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসি বেনেদের কাছে দাক্ষিণাত্যের বন্দরগুলোতে, এমনকি তমলুক আর বালেশ্বরেও দাসরূপে বিক্রয় করত।

৫, কর্ণফুলীর মোহনাস্থিত নদীর দক্ষিণতীরে পর্তুগীজ দস্যুঘটির নাম ছিল ফিরিঙ্গি বন্দর। আরাকানরাজ দস্যুবৃত্তির জন্যে নিজের জাহাজ পাঠাতেন না। তিনি ফিরিঙ্গিদের তার চাকুরে মনে করতেন. এবং লুণ্ঠিত দ্রব্য ও দাসের অর্ধেক নিজে নিতেন।

৬. মঘ-ফিরিঙ্গি দস্যুরা এমন ত্রাস সৃষ্টি করেছিল যে মুঘল নওয়ারা বা নৌ-বাহিনীও এদের দেখলে ভয়ে ছুটে পালাত এবং হার্মাদের কবলে পড়ার চাইতে ডুবে মরাই শ্রেয় মনে করত। পর্তুগীজ দস্যুরা হার্মাদ (আরমাদা দেশীয়) নামে পরিচিত ছিল।

৭. ১৬৬৫ সনে আরাকানরাজ ও চট্টগ্রামের পর্তুগীজদের মধ্যে বিবাদ বাধে। পীড়নের ভয়ে পর্তুগীজেরা মুঘলদের আশ্রয়ে চলে আসে। যুগদিয়া ও নোয়াখালির থানাদার ফরহাদ খান এদের সবাইকে সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করলেন। শায়েস্তা খান পর্তুগীজ কেপ্টেনকে হাত করবার জন্যে ২০০০ টাকা ইনাম এবং মাসিক ৫০০ টাকা বেতন ধার্য করে দিলেন। এদের সহায়তা শায়েস্তা খানের চট্টগ্রাম বিজয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বাঙলাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাস ও ইতিহাসের উপকরণ বিরল। ঐতিহাসিক যুগে চট্টগ্রামের কোনো রাজা-বাদশাহ রাজত্ব করেননি। তাই এর কোনো একক ইতিহাস লিখিত হয়নি। শাসকদের ইতিহাসে কেবল প্রাসঙ্গিকভাবেই চট্টগ্রাম সম্বন্ধে ছিটেফোঁটা খবর মেলে। এসব খবর জড়ো করে চট্টগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের কাঠামো তৈরি করা কঠিন কাজ।

চট্টগ্রাম সম্বন্ধে যে-কয়টি ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তার কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও তথ্য সমাবেশের প্রয়াস আছে বটে, কিন্তু ধারাবাহিক ইতিহাস রচিত হয়নি।

এই ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাস বিস্তৃত আলোচনা-সাপেক্ষ হয়েছে। গৌড়ের সুলতানের, ত্রিপুরার হিন্দুরাজার, আরাকানের বৌদ্ধ নৃপতির এবং খ্রীস্টান পর্তুগীজদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক-ক্ষেত্র, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবন্দর এবং বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান ও খ্রস্টান–এ চারটি ধর্মবিশ্বাসীর আবাসভূমি চট্টগ্রামের মানুষ বিভিন্ন পরিবেশের, নানা সমস্যার ও বিচিত্র সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এ সবকিছুই তাদের মন, মেজাজ ও মননের উপর প্রভাব রেখে গেছে। এমনি বিচিত্র আবহে লালিত চট্টগ্রামী মানুষ ধর্মীয় কোন্দল, জাতিবৈরকে তুচ্ছ জেনে এক উদার অথচ স্বধর্ম ও সংস্কৃতি-নিষ্ঠ মনোভঙ্গির অধিকারী হয়েছিল বলে অনুমান করি। কেননা, মধ্যযুগে চট্টগ্রামে হিন্দু ও মুসলমান রচিত গ্রন্থের সংখ্যা কম নয়, এসব গ্রন্থে কোথাও বিদ্বিষ্ট মনের পরিচয় নেই। স্বধর্মী রাজার সঙ্গে সাযুজ্যবোধে কেউ বিধর্মী প্রতিবেশীর প্রতি পীড়ন প্রবণ হয়নি– অন্তত সে-প্রমাণ নেই। স্বতন্ত্র থেকেও তারা সদ্ভাব ও সদিচ্ছা বজায় রাখতে জেনেছে। বৈচিত্র্যের মধ্যেও যে ঐক্য থাকে–এই তত্ত্ব ও আপ্তবাক্য মনে হয়, তাদের জীবনে বাস্তবরূপ লাভ করেছিল। পরবর্তী অধ্যায়ে এর আভাস মিলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *