1 of 3

১৯. এনি সার্জারি অন মাই হার্ট

১৯

ওয়াজ দেয়ার এনি সার্জারি অন মাই হার্ট, সিস্টার?

সার্জারি? ওঃ নো স্যার, দেয়ার ওয়াজ নো ওপেন হার্ট সার্জারি। ওনলি মেডিসিনস্‌।

আই ফিল এ সর্ট অফ নাম্বনেস ইন মাই হার্ট। ইজ দ্যাট ও. কে?

ইউ আর নাউ ও. কে স্যার।

মণীশ কিছু অবিশ্বাসের চোখে পবিত্র সাদা পোশাক পরা তরুণী নার্সটিকে দেখছিল। কেরলের মেয়ে। খ্রীষ্টান, কালো, হাস্যময়ী। ব্রেকফাস্টের ভুক্তাবশেষ ট্রে গুছিয়ে নিচ্ছে। ডানদিকের পর্দাটা সরানো। আজও মেঘলা বিষণ্ণ আকাশ। গোমড়া ভোর। মণীশের দিন কি ভাবে কাটছে কে তার হিসেব রেখেছে? গুনতির দিন একরকম। কিন্তু ব্যথার দিনগুলি? সংজ্ঞাহীনতার দিনগুলি? দুশ্চিন্তার দিনগুলি? সব কি একরকম? ব্যথাতুর দিন সবচেয়ে ধীরে কাটে। কাটতেই চায় না। এক একটা সেকেন্ড যেন একটি একটি ঘণ্টা। এক একটি ঘণ্টাই যেন এক একটি দিন বা মাস। আর দিন যেন বছর বা দশক বা কল্পান্ত।

অনেক ঘুমিয়েছে মণীশ। শুধু ঘুম আর ঘুম। জাগলেই ডাক্তার আবার সস্নেহে ঘুম পাড়িয়ে দিত। তার ধারণা হয়েছিল, ওইভাবে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেই তার হৃৎপিণ্ডে ছুরি চালিয়েছে ডাক্তার।

জ্ঞান ফেরার পর সে অবশ্য ভাল করে খুঁজে দেখেছে, তার বুকে কোনও কাটা দাগ নেই। তবে বুকের ভিতরটা অন্যরকম। মাঝে মাঝে খিল ধরে থাকে। মনে হয়, হার্ট থেমে আছে। ধুকপুক নেই।

পৃথিবী হারিয়ে গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। হারিয়ে গিয়েছিল তার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র-কন্যা। তার বউ। তার চাকরি। তার সুখ-দুঃখ-আনন্দ। ওই কটা দিন আর ফিরে পাবে না মণীশ। চিরকালের মতো হারিয়ে রইল।

মে আই হ্যাভ এ নিউজপেপার?

কেরলের মেয়েটি ছোটো করে মাথা নাড়ল, নো স্যার। সরি।

দি ওয়ার্ল্ড ইজ লস্ট টু মি। আই ওয়ান্ট টু বি আপডেটেড।

আস্ক দি ডক্টর স্যার, প্লীজ।

থ্যাংক ইউ।

পৃথিবীর কোনও খবরই রাখে না মণীশ। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে কত কী না জানি ঘটে যাচ্ছে! ঘটে গেছে! অন্তহীন ঘুমের মধ্যে পৃথিবী কতবার পাশ ফিরল! খবরের কাগজে এমন কী থাকবে, যাতে তার হৃৎপিণ্ডে চাপ পড়তে পারে?

মে আই হ্যাভ এ বুক?

এনি বুক স্যার? আই ক্যান গিভ ইউ এ বাইবেল। আই হ্যাভ ওয়ান উইথ মি।

ইউ ডু ক্যারি এ বাইবেল?

মেয়েটি লাজুক হাসে, আই ডু স্যার।

ইউ আর এ রিলিজিয়াস পারসন!

ইট ইজ এ গুড কম্পানি।

দেন, গিভ ইট টু মি। ইট উইল ডু।

মেয়েটি ব্রেকফাস্টের ট্রে নিয়ে চলে গেল। ফিরে এল একখানা কালো মলাটের বাইবেল নিয়ে। এরকম বাইবেল বড় বড় হোটেলের ঘরে ড্রয়ারে রেখে দেওয়া হয়। ইচ্ছে করলে যে-কেউ নিয়েও যেতে পারে। বাইবেল চুরি করলেও দোষ হয় না। পৃথিবীময় বাইবেল ছড়িয়ে দেওয়ার এ এক চমৎকার কায়দা।

মণীশ অবসন্ন হাতে বাইবেলখানা বালিশের পাশে রেখে দিল। একটু জল খেল।

মে আই টক নাউ ফ্রিলি?

নট টু মাচ স্যার। ইফ ইউ উইশ, আই মে রীড দি বাইবেল টু ইউ।

বাইবেল ইজ অ্যান ওল্ড বুক। আই ওয়ান্ট সামথিং নিউ। সামথিং মোর আপ-টু-ডেট।

বাইবেল ইজ নেভার ওল্ড স্যার। ইট ইজ অলওয়েজ নিউ।

অল রাইট। রীড ইট টু মি অ্যানাদার টাইম। ইজ দি সামার ওভার?

নো স্যার। দি মনসুন ইজ দেয়ার। ভেরি হেভী মনসুন।

ডু ইউ নো এনিথিং অ্যাবাউট দি ক্যালকাটা ফুটবল লীগ?

মেয়েটি হাসে, নো স্যার। আই অ্যাম নট স্পোর্টিং এনাফ।

টেল মি হোয়াট হ্যাপনড্‌ ইন দি ওয়ার্ল্ড হোয়েন আই ওয়াজ ইন স্লিপ।

নার্থিং মাচ।

এনি গ্রেট লীডার ডেড অর কিলড্‌?

নো স্যার।

এনি বিগ প্লেন ক্র্যাশ?

নো স্যার।

এনি আর্থকোয়েক?

নো স্যার।

ইউ কেপ্ট দি ওয়ার্ল্ড ইন অর্ডার হোয়েন আই ওয়াজ অ্যাস্লিপ?

মেয়েটি খিলখিল করে হাসে, ইট ওয়াজ ইন অর্ডার।

ওনলি মি আউট অফ অর্ডার?

নট ভেরি মাচ। ইউ হ্যাড এ স্মল অ্যাটাক।

ইউ আর লাইং। আই হ্যাড এ ম্যাসিভ অ্যাটাক।

নো স্যার।

ডিড আই বিহেভ ওয়েল হোয়েন ইন পেইন?

ইউ ওয়্যার নাইস স্যার।

ওয়াজ আই ইন ডেলিরিয়াম?

নো স্যার।

আই হ্যাড ড্রিমস, ইউ নো। ব্যাড ড্রিমস।

ঘরটার দুটো ভাগ। একটা যেন বেডরুম, অন্যটা যেন বসবার। বসবার ঘরে তাজা ফুল সাজিয়ে রাখা, সোফা সেট পাতা। এয়ারকন্ডিশনড ঘরে কোনও শব্দ নেই। ভারি ঝকঝকে তকতকে। তার স্লিপিং স্যুটের বুকপকেটে একটা ভারী যন্ত্র রাখা। রিমোট কন্ট্রোলে চব্বিশ ঘণ্টা ই সি জি হচ্ছে বোধ হয়। কে জানে কী!

চিরকালের অভ্যাস ছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠেই সিগারেট ধরানো। তারপর চা। তারপর খবরের কাগজ। তারপর…

দয়ার দান হিসেবে আয়ু ফিরে পাওয়া গেল। কিন্তু কত দিন? কতদিনের এক্সটেনশন? আবার ব্যথা আসবে। অন্ধকার আসবে। হারিয়ে যাবে পৃথিবী। একদিন মণীশ আর এক্সটেনশন পাবে না।

জানালার গায়ে মৃদু টোকার মত শব্দে চোখ চায় মণীশ। ইস! বৃষ্টি হচ্ছে! ঝাপসা হয়ে গেল কলকাতার আকাশ-রেখা। এই বৃষ্টিতে ভিজিটিং আওয়ার্সে কেউ আসবে কি? বুবকা, ঝুমকি, অনু বা অপর্ণা? সবাই একসঙ্গে আসে না। একে একে, দুইয়ে দুইয়ে আসে। কিন্তু ওদের সবাইকে একসঙ্গে দেখতে বড় ইচ্ছে করে মণীশের।

সিস্টার, ক্যান ইউ টেল মি একজ্যাক্টলি হোয়েন আই উইল বি রিলিজড?

ভেরি সুন স্যার।

আই ওয়ান্ট এ ডেট।

প্লীজ আস্ক দি ডক্টর স্যার।

আজ সকালে কে আসবে? ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল মণীশ।

অনেকদিন আগে এক মেঘলা দুপুরে এক ক্ষিপ্ত জনতার ওপর পুলিস লাঠি চার্জা করছিল। এসপ্ল্যানেড ইস্টে। কার্জন পার্কের ফেনসিং-এ উঠে একজন ফ্রি লান্স ফটোগ্রাফার দৃশ্যটা তুলছিল। একজন পুলিশ হঠাৎ তেড়ে এল তার দিকে। হাঁটুতে খটাং করে এসে পড়ল লাঠি। ফটোগ্রাফারটি ব্যথায় চিৎকার করে পড়ে গেল, তারপর অন্য পায়ে পুলিসটাকে একটা লাথি কষিয়ে দিল। খুবই সাহসের কাজ। পুলিসটা পিস্তলে হাত দিয়েছিল। হয়তো মেরে ফেলত। কিন্তু সেই সময়ে মার-খাওয়া কিছু লোক ছিটকে এল এদিকে। তাদের বেপরোয়া হতচকিত ধাক্কায় পুলিশটা সরে গেল। ফটোগ্রাফারটি উঠে দাঁড়াল। হাঁটুতে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা, চোখে জল আসছে, ঠিক সেই সময়ে দুটো গুলির আওয়াজ। আর্ত চিৎকার।

সেই দুপুরে পুলিশ ঠিক দু রাউন্ড গুলিই চালিয়েছিল। তাতে চলন্ত ট্রামের মধ্যে বসে-থাকা একটি লোক মারা যায়। ফটোগ্রাফারটি তার জল-ভরা চোখেও দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল। অন্য ফটোগ্রাফাররা দেখেছিল একটু দেরিতে।

ফটোগ্রাফারটি তার জখম পা নিয়েই কাছ-ঘেঁষা ট্রামটায় উঠে পড়ল। তখন হুড়োহুড়ি করে যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। আর জখম লোকটা গোঙাচ্ছে, জল! জল! তখনও পড়ে যায়নি। তবে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ট্রামগাড়ির সীট, মেঝে। চকাচক দু-তিনটে ফটো তুলে নিল সে। আর দেখতে পেল, লেডীজ সীটে সাদা মুখে একটি মেয়ে বসে আছে। এত ভয় পেয়েছে যে, পালাতে অবধি পারেনি।

আরে! পালান, পালান! আসুন শিগগির! বলে ফটোগ্রাফার গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিয়েছিল ট্রাম থেকে। বাইরে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া, লোকজন পালাচ্ছে, পুলিস তেড়ে যাচ্ছে যাকে পাচ্ছে সামনে তার দিকে। দমাস দমাস করে লাঠি পড়ছে।

অন্তত তিনজন পুলিশ লাঠি তুলেছিল। সঙ্গে মেয়েটি ছিল বলে বেঁচে গেল ফটোগ্রাফারটি। পুলিশ মেয়ে দেখে মারেনি।

তীব্র টিয়ার গ্যাসে প্রায় অন্ধ চোখে ছুটতে ছুটতে তারা রেড রোডের দিকে চলে যেতে পেরেছিল।

কোথায় থাকেন আপনি?

মেয়েটি কোনও জবাব দিতে পারেনি। শুধু কাঁপছিল। ভয়ে, অবিশ্বাসে।

নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে ঘাসে বসাল ফটোগ্রাফারটি। জিরোতে দিল। দুজনেরই চোখ ফুলে ঢোল। দুজনেই হাঁফাচ্ছে।

অনেকক্ষণ বাদে মেয়েটি তার ঠিকানা বলতে পারল।

একা যেতে পারবেন?

না। ভীষণ ভয় করছে।

কিন্তু আমাকে যে পত্রিকা-অফিসে যেতে হবে। এই ফটো কাল কাগজে বেরোবে।

মেয়েটা কাঁদছিলও। কিছু বলল না।

ঠিক সেই সময়ে আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমেছিল। খুব বৃষ্টি। সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টি।

আরে, ভিজবেন যে! উঠুন! দৌড়োন! ময়দানে কোনও ক্লাবের টেন্টে ঢুকে পড়তে হবে।

মেয়েটি ওঠেনি। ছোটেওনি। বসে রইল মুখ নিচু করে। ক্যামেরা ভিজছিল।

ফটোগ্রাফারটি চলে যেতে পারত। যায়নি শেষ পর্যন্ত। মেয়েটির সঙ্গে সেও ভিজেছিল ক্যামেরা সমেত।

সেই বিকেলে বৃষ্টি আর থামেনি। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আন্দোলন থেমে গেল, পুলিসের হামলা বন্ধ হল, জনসাধারণ পালাল নিরাপদ আশ্রয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই মেয়েটিকে তার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল তরুণ ফটোগ্রাফার। খানিকটা বাসে, খানিকটা হেঁটে।

তার ফটো পরদিন বেরিয়েছিল কাগজে। নাম সমেত। আরো অনেকেই ফটো তুলেছিল সেদিনকার হাঙ্গামার। তবে গুলি-খাওয়া লোকটার অমন নিখুঁত ছবি আর কেউ পায়নি। বেশ নাম হয়েছিল তার। পায়ের জখম সারতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল।

অফিসের ঠিকানায় প্রায় সাত দিন বাদে চিঠিটা এল। মেয়েলি হস্তাক্ষর, আমি সেই মেয়েটি, যে সেদিন চোখের সামনে লোকটাকে মরতে দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় আমার হার্টফেল হয়ে যেত, আপনি আমাকে জোর করে ট্রাম থেকে নামিয়ে না আনলে। আমার বোধ হয় জ্ঞানও ছিল না। কিরকম যে হয়ে গিয়েছিলাম! বৃষ্টিতে ভিজে আমার জ্বর হয়েছিল, জানেন? তবু ওই বৃষ্টিটাও বোধ হয় দরকার ছিল। ভিজে ভিজে মাথা ঠাণ্ডা হয়েছিল, শরীরে সাড় ফিরে এসেছিল। আপনার সঙ্গে আর একবার দেখা হতে পারে কি? আমার যে মুখোমুখি একবার ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার আপনাকে! আর কী অভদ্র আমি। সেদিন তো এক কাপ চাও অফার করা হয়নি আপনাকে?

ফটোগ্রাফারের সময় হয়েছিল আরও সাত দিন বাদে। তারপর আর সময়ের অভাব হয়নি।

আজ সামান্য একটা উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে মণীশ সেই মেয়েটিকে দেখতে পেল। সেই ভয় খাওয়া মুখ! সেরকমই সুন্দর আছে আজও।

কেমন আছো আজ?

মণীশ হাসল, এটা কিরকম থাকা বলো তো? ডাক্তার ছুটি দিচ্ছে না কেন?

এবার দেবে।

সেটাও তো চারদিন ধরে শুনছি। আর কবে?

অপর্ণা খুব কাছ ঘেঁষে চেয়ারে বসল। বড় ভালবাসায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। শান্তিনিকেতন থেকে সেবার একটা গাড়ি ভাড়া করে তাঁতিপাড়া গিয়েছিল তারা। এক জোড়া তসরের থান কিনেছিল অপর্ণা। পরে কাঁথাফোঁড়ের কাজ করিয়ে নেয়। সেই শাড়িরই একটা আজ পরে এসেছে। একটু সেজেও এসেছে।

মণীশ অপর্ণার হাতটা নিজের কপালে চেপে ধরে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, খুব ভয় পেয়েছিলে তোমরা?

পাবো না!

হোয়াট অ্যাবাউট দি ইয়ং রোগস্‌? ওদের কী অবস্থা হয়েছিল?

বুঝতেই তো পারো। বাবা ছাড়া ওদের কি আর অস্তিত্ব আছে?

বুবকা?

পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। নিশুত রাতে অবধি এসে বসে থাকত নিচে। রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে জ্বালাতন করত ওদের।

বড্ড বাচ্চা রয়ে গেছে ছেলেটা। অ্যাডাল্ট হচ্ছে না কেন বলো তো!

তুমি ওকে অ্যাডাল্ট হতে দিচ্ছো কই? এখনও এমনভাবে আদর দাও যেন কোলের ছেলে। আঠারো বছর বয়স হল, এখন ওকে তোমার একটু ছেড়ে দেওয়া উচিত।

মণীশ একটা শ্বাস ফেলে বলে, ছেড়ে তো দিতেই হবে। বড় হচ্ছে, কত দিকে ইন্টারেস্ট দেখা দেবে, বাবা নিয়ে কি পড়ে থাকবে তখন?

মণীশের মনটা প্রশান্তিতে ভরে আছে। বুবকার জগৎ এখনও সে অনেকটা দখল করে আছে। যতদিন পারবে মণীশ ততদিন এই নোংরা পৃথিবীকে অনুপ্রবেশ করতে দেবে না ছেলে এবং মেয়েদের ভিতরে।

কিন্তু পারবে কি মণীশ? আর পারবে কি?

এখানে আমার বড্ড হাঁফ ধরে যাচ্ছে। ডাক্তার কিছু বলছে না এখনও! হয়তো আর দু-এক দিন।

মণীশ সবেগে মাথা নেড়ে বলে, অসম্ভব। আমি আর পারছি না। এখানে থাকলে আমার আবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।

ডাক্তার যদি বারণ করে?

আমি সাবধানে থাকব। এখানে থেকেও তো কিছু হচ্ছে না। শুধু পড়ে থাকা। আমি পারছি না অপর্ণা। ছেলেমেয়ে ছাড়া আমি আর পারছি না।

অপণা নির্লজ্জের মতোই তার মাথাটা নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে। বলে, ওরকম করতে হয় নাকি? আমরাও তো তোমাকে ছাড়া যেন ডাঙার মাছ। ছেলেমেয়েগুলো অর্ধেক হয়ে গেছে দুশ্চিন্তায়।

ওরা কখন আসবে?

অনু আসছে। তুমি গতকাল খবরের কাগজ পড়তে চেয়েছিলে, এরা নাকি দেয়নি। ও চুরি করে খবরের কাগজ দিয়ে যাবে বলে কাগজ কিনতে গেছে।

মণীশ একটু হাসল, খুব বিচ্ছু না?

খুব।

সারাক্ষণ তোমরা কি আমার চিন্তা করো?

শুধু চিন্তা! ধ্যান বলতে পারো।

তাহলে মাঝে মাঝে অসুখ করা তো ভালই। না?

ভাল, তবে পালা করে। এবার আমার হার্ট অ্যাটাক হোক আর তোমরা আমাকে নিয়ে ভাবো, কেমন?

ও বাবা, দরকার নেই। আচ্ছা, মহিলাদের হার্ট অ্যাটাক খুব কম হয়, না? কই, বেশী শুনি না তো!

হয় মশাই, হয়। হার্ট অ্যাটাক হয়, ক্যানসার হয়, সব হয়।

অনু আসছে না কেন?

আসবে।

নার্সটা ঘরে নেই, না?

না তো!

উইল ইউ গিভ মি এ কিস?

এ মা!

ইট উইল বি এ লাইফ সেভিং কিস। প্লীজ!

অপর্ণা সামান্য ঝুঁকে হালকা করে ঠোঁট ছোঁয়াল তার ঠোঁটে। তারপর বলল, তাড়াতাড়ি ভাল হও তো। মনের জোর করে হও। তোমাকে ছাড়া আমিও আর পারছি না। এই পাগলকে ছাড়া আমি যে পাগল হতে বসেছি!

আজ এখনই কি ভাবছিলাম জানো?

কী?

সেই প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাটা। আমি তখন ফ্রি লান্স ফটোগ্রাফার, তুমি কলেজের ছাত্রী। সেই ট্রাম, গুলি, টিয়ার গ্যাস।

মাগো!

অথচ কত রোমান্টিক, তাই না?

অপর্ণা স্মিতমুখে হাসল, কী ভীষণ রোমান্টিক।

কতদিন ফটো তুলি না বলো তো! সেই যে বড় চাকরি পেয়ে গেলাম, ফটোর প্যাশনটা চলে গেল। ক্যামেরা তিনটে পড়েই আছে।

আর ফটো তুলে কাজ নেই। অনেক হয়েছে।

আচ্ছা, আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কারও ফটোগ্রাফিতে আগ্রহ নেই?

সে তো তুমিই জানো। তোমার ছেলেমেয়েকে তুমি ছাড়া আর বেশী কে চেনে?

মণীশ একটু চুপ করে ভাবে। তারপর বলে, বোধ হয় অনুটার হবে। যে ক’বার ফটো তুলেছে চমৎকার হয়েছে। দাঁড়াও ভাল হয়ে ফিরে ওদের তিনজনকে তিনটে ক্যামেরা দিয়ে বলব, ইচ্ছে মতো ছবি তুলে আনো। যারটা ভাল হবে তাকে প্রাইজ দেবো!

আচ্ছা, সে হবে’খন। ভাল হতে না হতেই পাগলামি শুরু হয়েছে তো!

পাগলামি নয়, এটা হল এক ধরনের ইনহেরিটেন্স। আমার প্যাশন, আমার হবি, আমার ট্রেন্ড অফ মাইন্ড সব কিছু ওদের দিয়ে যেতে না পারলে, ওদের ভিতরে আমি বেঁচে থাকব কি করে বলো? ওদের মধ্যে নিজেকে দেখতে না পেলে আমার যে সেটা মরে যাওয়াই হবে।

আমি তো একটুও আপত্তি করছি না। ওরা তোমার মতোই হোক। তুমি ভাল হও, তারপর সব হবে। ওরা তোমার কিছুই নষ্ট হতে দেবে না। বাবা যে ওদের কাছে কী তা তো জানোই!

মণীশ আবার অনুর খোঁজ নিতে মুখ খুলেছিল, অমনি একটা দুষ্টু হাসি মুখে নিয়ে দরজা ঠেলে অনু ঢুকল। একটু যেন পা টিপে। চারদিক চেয়ে দেখল। তারপর ঢোলা পোশাকের বুকের ভিতর থেকে একটা ইংরিজি কাগজ বের করে ছুটে এল মণীশের কাছে।

বাবা, কাগজ!

মণীশ তার দুর্বল দুটি হাতে মেয়েকে জাপটে নিল বুকের ভিতর। পরমুহূর্তেই ককিয়ে উঠল, উঃ!

অপর্ণা আতঙ্কের গলায় বলে, কী হল?

বুক পকেটে যন্ত্রটার কথা মনেই ছিল না।

লেগেছে?

একটু।

অপ্রস্তুত অনু বলল, এ মা, আমারও মনে ছিল না বাবা। কী হবে? যন্ত্রটা বিগড়ে যায় যদি?

আরে দুর! কিছু হবে না।

তোমার হার্টে তো চাপ পড়ল!

মোটেই না। তুই কাছে আয়।

অপর্ণা উদ্বেগের গলায় বলে, কী যে করো না! কিছু ঠিক থাকে না তোমার! আমি তো ভয় খেয়ে গিয়েছিলাম।

আরে না, ভয়ের ব্যাপার নয়। আর বকবে না কিন্তু।

তোমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেও তো এরকমই হুড়ুম দুড়ুম কাণ্ড করবে সব। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হুড়োহুড়ি, লাফ ঝাঁপ, চেচাঁমেচি!

বেঁচে থাকা মানেই তো নিজেকে জানান দেওয়া। নইলে পাথর হয়ে, মমি হয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ বলো!

আগেই বলে রাখছি, এখন কিন্তু কিছুদিন চুপটি করে শুয়ে থাকতে হবে বাড়িতে। ওসব হুড়োহুড়ি চলবে না।

মণীশ অপর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ডাক্তারের বারণ?

হ্যাঁ।

তাহলে কি আমি চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে গেলাম?

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। আচ্ছা বাবা, খুব হুড়োহুড়ি কোরো, কিন্তু একটু সামলে!

মণীশ মেয়ের দিকে ফিরে তাকাল। একটু অচেনা লাগছে কি?

মুখখানা দুহাতে ধরে তৃষিতের মতো চেয়ে থেকে বলল, তুই কি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছিস?

কেন বাবা? তুমি তো মোটে বাইশ দিন হাসপাতালে!

তবু যেন মনে হচ্ছে বাইশ দিনেই তুই আমার চোখের আড়ালে একটু বড় হয়ে গেছিস! কত বয়স হল তোর! তেরো না?

অনু হি হি করে হাসে, মেয়েরা বয়স কমায়, কিন্তু বাবারা মেয়েদের বয়স আরও কমিয়ে দেয়, না বাবা? আমি তো ফিফটিন কমপ্লিট করেছি, তুমি যেন জানো না!

উরে বাবা! ফিফটিন! তার মানে সিক্সটিন হতে তো আর দেরি নেই!

আই অ্যাম রানিং সিক্সটিন।

মাই গড!

ডান কানে অপর্ণা খুব আস্তে করে বলে, ঋতু হয়। বয়স বসে আছে কিনা!

ওঃ ইউ আর ইমপসিবল।

অপর্ণা হেসে ফেলল খিলখিল করে। মণীশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলল, তোমার কাছে ওরা কেউ কখনও বড় হবে না। ছেলেমেয়ে ছোটো নেই, শুধু তোমার কাছে এলেই সব ছোটো সাজে।

মণীশ গম্ভীর গলায় বলে, তার মানে কি অ্যাকটিং করে?

একটু করেও।

শুনে আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে।

মাগো! বলে আর্তনাদ করে ওঠে অপর্ণা, সত্যি নাকি?

মণীশ হাসে, সে ব্যথা নয়। অন্য রকম ব্যথা। দুঃখের ব্যথা।

আচ্ছা বাবা, কান মলছি। আর বলব না।

অনু নিষ্পলক বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছে। মণীশ নিবিষ্ট চোখে কচি মুখখানা দেখল। অনুরও পনেরো! কিংবা—গড ফরবিড—ষোলো! চোখে কি একটু প্রাপ্তবয়স্কার ছায়া?

মণীশ চোখ বুজল। অনেক বয়স হয়ে গেল বুঝি তার?

আবার চোখ চাইল।

অনু?

উঁ।

বড় হোসনি মা। এখনই বড় হোসনি। আর কিছুদিন শিশু থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *