২৩. ওডিসিয়াস ও পেনিলোপ

ত্রয়োবিংশ পর্ব
ওডিসিয়াস ও পেনিলোপ

এবার তার রাণীমাকে খবর দেবার জন্য ছুটে উপরতলায় চলে গেল ইউরিক্লীয়া । ব্যস্ততায় পাদুটো কাঁপছিল তার। পেনিলোপের ঘরের ভিতরে গিয়ে তার পালঙ্কের কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ওঠ বাছা পেনিলোপ, যাকে দেখার জন্য এতদিন ধরে সাধনা করে আসছিলে সে এসে গেছে। আর যেসব দুবৃত্তগুলো এতদিন তার বিষয় সম্পত্তি নষ্ট করে তার পুত্রের সর্বনাশ করেছিল তাদের সবাইকে হত্যা করেছে।

ঘুম থেকে উঠে পেনিলোপ বললেন, হে ধাত্রী, দেবতারা তোমার বুদ্ধিনাশ করেছেন। আগে ভাল থাকলেও তোমার মাথাটা এখন খারাপ হয়ে গেছে। ওডিসিয়াস এখান থেকে যাওয়ার পর এত সুখে আর কোন রাতে আমি নিদ্রা যাই নি। একটা বাজে কথা বলে তুমি আমার সেই সুখনিদ্রা হরণ করলে অকালে। তুমি বয়োপ্ৰবীণা তাই, অন্য কোন দাসী হলে তার কান মুলে তাড়িয়ে দিতাম। তবু ইউরিক্লীয়া আবার বলল, ঠাট্টা করছি না বাছা। যে বিদেশী অতিথিটিকে সবাই বিদ্রূপ করত সেই হচ্ছে ওডিসিয়াস, দিনকতক আগে এখানে আসে। টেলিমেকাস জানত, কিন্তু কথাটা গোপন রেখেছিল।

আনন্দে লাফাতে লাগল পেনিলোপের অন্তরটা। তিনি বিছানায় উঠে বসে ইউরিক্লীয়ার গলাটা জড়িয়ে ধরলেন। অশ্রুপূর্ণ কণ্ঠে আবেগের সঙ্গে বললেন, সত্য কথা বল হে ধাত্রী। যদি তিনি সত্যসত্যই এসে থাকেন তাহলে কেমন করে তিনি একা সেইসব দলবদ্ধ দুবৃত্তদের ধ্বংস করেন?

ইউরিক্লীয়া বলল, এমন আশ্চর্য ঘটনা জীবনে কখনো দেখি নি বাছা। দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে আমরা শুধু আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। অবশেষে টেলিমেকাস আমায় তার পিতার নাম ধরে ডেকে নিয়ে গেলে দেখলাম, মৃতদেহের স্কুপের মাঝে বিজয়ী সিংহের মত রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তুমি নিজের চোখে তা দেখলে ভাল হত। এক মৃতদেহগুলো উঠোনের সদর দরজার কাছে স্থূপাকৃত করা রয়েছে। এখন ঘর দুয়ার সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ওডিসিয়াস তোমাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলল। এখন এস আমার সঙ্গে। এবার তোমরা দুজনে এক নতুন জীবনে প্রবেশ করে সুখশান্তি ভোগ করো। আজ সবচেয়ে সুখের কথা, ওডিসিয়াস ফিরে এসে তার বাড়িতে তার স্ত্রী-পুত্রকে দেখতে পেয়েছে এবং অন্যায়কারী পাণিপ্রার্থীদের উপর প্রতিশোধ নিতে পেরেছে।

বুদ্ধিমতী পেনিলোপ বললেন, এত তাড়াতাড়ি এমন উল্লাস করো না। তোমার কথা এখনো আমার সত্য বলে বোধ হচ্ছে না। আমার মনে হয় কোন দেবতাই দুবৃত্ত পাণি প্রার্থীদের শাস্তি দেবার জন্য মানুষের বেশে তাদের হত্যা করেছে। আসলে বিদেশে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি।

এ কথায় আশ্চর্য হয়ে ইউরিক্লীয়া বলল, একথা কেমন করে বললে বাছা? একটুকু বিশ্বাস তোমার নেই আমার প্রতি? আর একটা প্রমাণের কথা বলি, সেদিন ওডিসিয়াসের পা ধোয়াতে গিয়ে দেখি তার হাঁটুর কাছে সেই ক্ষতটা, যৌবনে একদিন একটা শূকরের দাঁতে যে ক্ষতটা সৃষ্টি হয়। সেদিন সে আমায় সেকথা বলতে নিষেধ করে আমার প্রাণের ভয় দেখিয়ে। তার নিরাপত্তার জন্য সেকথা গোপন রাখার তখন প্রয়োজন ছিল।

পেনিলোপ বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী হলেও দেবতাদের মহিমার গোপন রহস্য বোঝার সাধ্য তোমার নেই। যাই হোক, আমি আমার পুত্রের কাছে যাই। গিয়ে আমার পাণিপ্রার্থীদের মৃতদেহ আর তাদের হত্যাকারীকে অন্তত নিজের চোখে দেখি।

এই কথা বলে দোলায়িত চিত্তে নিজের ঘর হতে বেরিয়ে নিচের তলার সেই ঘরে গিয়ে আগুনের ধারে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলেন। তিনি কোন কথা ওডিসিয়াসকে জিজ্ঞাসা করলেন না অথবা ছুটে গিয়ে আবেগের সঙ্গে তাঁকে চুম্বন করলেন না। ওদিকে ওডিসিয়াস দূরে একটা স্তম্ভের পাশে মাটির দিকে মুখ নিচু করে তাকিয়ে রইলেন স্থির হয়ে। তাঁর স্ত্রী প্রথমে কোন কথা বলে কি না তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে ওডিসিয়াসের ছিন্নমলিন কম্বলের পানে তাকিয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন পেনিলোপ।

একসময় টেলিমেকাস বলে উঠল, তোমার হৃদয় কী নিষ্ঠুর মা। কেন তুমি পিতার কাছ থেকে এত দূরে বসে রয়েছ? দীর্ঘ উনিশ বছর পর তার স্বামীকে ফিরে পেয়ে কোন নারী এভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারে না। পেনিলোপ স্বীকার করলেন, সত্যিই আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। আমি কোন কথা বলতে পারছি না। কিন্তু ওডিসিয়াস যদি সত্যি সত্যি ফিরে আসেন তাহলে আমরা শীঘ্রই চিনতে পারব পরস্পরকে। কারণ আমাদের হাতে এমন প্রতীকচিহ্ন আছে যার কথা কেউ জানে না।

মৃদু হেসে ওডিসিয়াস টেলিমেকাসের দিকে ঘুরে বললেন, ঠিক আছে, তোমার মা আমাকে পরীক্ষা করুন যত খুশি। তিনি অবশ্যই পরে ভুল বুঝতে পারবেন। এখন আমি ছিন্ন মলিন পোশাক পরে রয়েছি বলে তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না। কিন্তু শোন, এখন তোমাতে আমাতে বসে ঠিক করতে হবে আমরা এখন কি করব? কোন লোক যদি তার দেশের কোন নাগরিককে হত্যা করে তাহলে তাকে সমাজবিরোধী বলা হয়, সে তখন দেশ ছেড়ে ফেরার হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমরা ইথাকার নামকরা সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করেছি।

টেলিমেকাস বলল, তুমি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সমস্ত বিপদকে অতিক্রম করতে পেরেছ। তুমি জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবে পিতা। আমরা তোমার নেতৃত্ব সাহসের সঙ্গে মেনে চলব।

ওডিসিয়াস বললেন, এখন নিজে তুমি পোশাক পরো এবং বাড়ির মেয়েদের উত্তম পোশাকে সজ্জিত হতে বল। তারপর আমাদের চারণকবিকে বীণায় আনন্দোৎসবের সুর বাজাতে বল। বাইরে থেকে রাস্তার পথিকরা সে সুর শুনে যেন বুঝতে পারে এ বাড়িতে বিবাহের উৎসব চলছে। ইতিমধ্যে আমরা নিরাপদে আমাদের খামার বাড়িতে যাব। তারপর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

ওডিসিয়াসের কথামত দাসদাসীরা ভাল পোশাক পরিধান করে বীণার সুরের তালে তালে ভোজসভাগৃহে নাচতে লাগল। নৃত্যগীতের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল সমগ্র প্রাসাদ। পথিকরা তা শুনে বলাবলি করতে লাগল, এতদিনে রাণী কাউকে বিয়ে করল। তার স্বামীর ফিরে আসা পর্যন্ত আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারল না। এমনই চপলমতি নারী।

ইতিমধ্যে ওডিসিয়াসকে স্নান করিয়ে তেল মাখিয়ে দিল ইউরিনোম। তারপর তাঁকে উত্তম পোশাক পরিয়ে দিতে দেবী তাঁর দেহসৌন্দর্য অনেক বাড়িয়ে দিলেন আগের থেকে। আগের থেকে ওডিসিয়াসকে লম্বা ও বলিষ্ঠ দেখাচ্ছিল। তাঁর শুভ্রকোমল গ্রীবাদেশের উপর ছড়িয়ে পড়া কেশগুচ্ছগুলো সোনালি ফুলের মেদুর পাপড়ির মত দেখাচ্ছিল। সাক্ষাৎ দেবতাদের মত স্নানের ঘর হতে বেরিয়ে এলেন ওডিসিয়াস। দেখে মনে হতে লাগল দেবশিল্পীর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোন শিল্পী যেন দীর্ঘ সাধনার দ্বারা রৌপ্য ও স্বর্ণখচিত কোন এক শিল্পবস্তুকে নির্মাণ করেছে। এইভাবে স্নানের ঘর হতে বেরিয়ে সেই আগুনের পাশে তার স্ত্রীর বিপরীত দিকে বসলেন ওডিসিয়াস। তারপর স্ত্রীকে বললেন, ঈশ্বর তোমাকে কতখানি নির্মম করে গড়ে তুলেছেন তাই ভাবছি। অন্য কোন স্ত্রী উনিশ বছর পর তার স্বামীকে ফিরে পেয়ে কখনই এমন কঠোরভাবে বসে থাকতে পারত না। ঠিক আছে ধাত্রী, তুমি আমার জন্য পৃথক শয্যা প্রস্তুত করো। আমি একা পোব। আমার স্ত্রীর অন্তর লোহার মত কঠিন।

পেনিলোপ বললেন, তুমিও এক আশ্চর্যের মানুষ। আমি উদাসীন বা অহঙ্কারী নই। তবে অহেতুক আবেগে বিচলিতও নই। তুমি যেদিন ইথাকা ছেড়ে যাও সেদিনকার তোমার ছবি আজও স্পষ্ট আছে আমার মনে। শোন ইউরিক্লীয়া, উনি যে ঘরে নিজের হাতের ওঁর শয্যা প্রস্তুত করে গেছেন সে ঘরের বাইরে ওঁর শয্যা প্রস্তুত করে দাও।

এইভাবে ওডিসিয়াসকে পরীক্ষা করতে চাইলেন পেনিলোপ। ইনি যদি সত্যি সত্যিই আসল ওডিসিয়াস হন তাহলে নিজের বিছানা ঠিকই চিনতে পারবেন। কিন্তু সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ওডিসিয়াস। স্বহস্তনির্মিত তাঁর শয্যাগৃহের বাইরে তাঁর শয্যা প্রস্তুত হলে রেগে গেলেন তিনি। তিনি রাগের সঙ্গে বললেন কে আমার শয্যাটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেছে পেনিলোপ? এ ত যার তার কাজ নয়। আমি উঠোনের একটি অলিভ গাছের ডালপালাগুলোকে হেঁটে তার গুঁড়িটাকে চেঁছে মসৃণ করে তার চারদিকে আমার একটি শোবার ঘর তৈরি করি। সে ঘরে ছাদ ও দরজা সব ছিল। সে ঘর ও বিছানার খাট ছিল সোনা রূপো আর হাতীর দাঁতের কারুকার্যখচিত। এইটাই হলো আমার পরিচিত সম্পর্ক প্রমাণের মূল রহস্য এবং তুমি দেখলে আমি সে রহস্য জানি। তবে আমি জানি না সেই ঘরটা ও আমার সেই শয্যাটা আজও সেখানে আছে, না অন্য কেউ তা সরিয়ে নিয়ে গেছে অন্য কোথাও।

এবার নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন পেনিলোপ, ওডিসিয়াস যা যা বলেছেন তা ঠিক। সঙ্গে সঙ্গে সব কঠোরতা তার গলে জল হয়ে অশ্রু হয়ে অবিরল বেরিয়ে আসতে লাগল। তিনি ওডিসিয়াসের গলাটা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাঁর মাথাটিকে চুম্বন করতে লাগলেন বারবার। বললেন, আমার উপর রাগ করো না ওডিসিয়াস। আসলে দোষ আমাদের নেই। আমাদের যৌবনের সুখ সহ্য করতে না পেরে দেবতারা আজ আমাদের অশেষ দুঃখের মধ্যে দিয়ে বার্ধক্য এনে দিলেন। আমি তোমাকে প্রথম দেখে চুম্বন করি নি। কারণ দুৰ্বত্তের তো অভাব নেই। আর প্রলোভনে পড়াটাও বিচিত্র নয়। জিয়াসকন্যা হেলেনও এক দেবীর ছলনায় ভুলে এমন এক ভুল করে বসে যা জগতে বহু দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, তুমি আমাদের সেই শয্যার রহস্য বলে তোমার স্ত্রীর অবিশ্বাসী মনকে বোঝাতে পেরেছ, যে রহস্য একমাত্র আমার বাপের বাড়ির দাসী অ্যাকটোরিয়াস ছাড়া আর কেউ জানে না।

পেনিলোপের এই আকুল আত্মসমর্পণে চোখে জল এল ওডিসিয়াসের। স্ত্রীকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কাঁদতে লাগলেন ফুঁপিয়ে। কোন নির্দয় সমুদ্র দেবতার দ্বারা উথিত প্রবল ঝড় ও উত্তাল তরঙ্গমালার দ্বারা ভগ্ন বিধ্বস্ত কোন জাহাজের নাবিকরা দীর্ঘকাল অকূল সমুদ্রে সাঁতার কাটার পর সহসা দ্বীপের মাটিতে পা দিলে যে আনন্দ পায়, ঠিক সেই আনন্দ পেনিলোপও লাভ করলেন। দীর্ঘকাল পরে স্বামীকে ফিরে পেয়ে তাকে বাহুদ্বারা সর্বক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইলেন পেনিলোপ। এদিকে পুনর্মিলনের আনন্দে ভরা সেই রাত্রিটিকে দীর্ঘায়িত করার জন্য নিশাদেবীকে পশ্চিম দিগন্তে এবং ঊষাদেবীকে পর্ব দিগন্তে ওসিয়ান নদীতে আটকে রাখলেন দেবী এথেন। ফলে ল্যাম্পাস ও ফীটন নামে দুটি দেবাশ্বকে দিবালোকের রথে সংযোজিত করে সে রথ চালনা করতে পারলেন উষাদেবী।

কিন্তু মিলনের এই নিবিড়তম আনন্দের মাঝেও একটা কথা স্ত্রীকে না বলে পারলেন না ওডিসিয়াস। তিনি বললেন, দেখ প্রিয়তমা, আরও এক দুঃখময় আর দুঃসাহসিক অভিযান বাকি আছে আমার জন্য। যত দূরেই হোক সে অভিযান আমার করতেই হবে মৃত্যুপুরীতে মৃত জ্যোতিষীদের তিয়েরিসিয়ামের আত্মা আমাকে একথা বলেছে। সুতরাং এস, যতক্ষণ পারি দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে সুখে নিদ্রা যাই।

পেনিলোপ বললেন, এটা তোমার নিজের বাড়ি, যখনি খুশি হবে তখনই শয্যা প্রস্তুত হবে তোমার জন্য। কিন্তু নতুন যে দুঃখময় অভিযানের কথা বললে তার সবকিছু খুলে বল।

মৃদু তিরস্কারের সুরে ওডিসিয়াস বললেন, সেকথা কেন শুনতে চাইছ? সে কথা আমার মত তোমারও ভাল লাগবে না। তিয়েরিসিয়াস বলেন, একটি ভাল জাহাজ নিয়ে আমাকে আবার পৃথিবীর বিভিন্ন নগরে ঘুরে বেড়াতে হবে। তারপর এমন একটা আশ্চর্য দ্বীপে আমি উপনীত হব যেখানকার মানুষদের জাহাজ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নেই এবং যারা লবণের ব্যবহার জানে না। সেই দ্বীপে আর একজন পথিকের দেখা পাব আমি। সেখানে আমাকে আমার জাহাজের দাঁড়টিকে কবর দিয়ে পসেডনের উদ্দেশ্যে একটি ভেড়া, একটি বলদ আর একটি গর্ভবতী শূকর বলি দিতে হবে। তারপর বাড়ি ফিরে আবার আমাকে সমস্ত দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি দিতে হবে। আমার মৃত্যু সম্বন্ধে তিনি বলেন, সমুদ্রের মাঝেই কোন এক দ্বীপে এক বন্ধুভাবাপন্ন জাতির লোকেদের দ্বারা পরিবৃত অবস্থায় বৃদ্ধ বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু হবে আমার। সে শপথ করে বলেছে এসব সত্য হবে।

পেনিলোপ উত্তর করলেন, যদি বৃদ্ধ বয়সে সুখ থাকে তোমার তাহলে তার আগে । সব বিপদ কাটিয়ে উঠবে তুমি।

এবার ইউরিনোম তাঁদের জন্য শয্যা প্রস্তুত করে মশাল হাতে তাঁদের পথ দেখিয়ে শয়নগৃহে নিয়ে গেল। তাঁরা ঘরে প্রবেশ করলে চলে গেল ইউরিনোম। ওদিকে টেলিমেকাস, ইউমেয়াস ও ফিলোরিয়াসও নৃত্য গীত বন্ধ করে সেই সভাগৃহেই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু উত্তম শয্যায় শয়ন করলেও ওডিসিয়াস বা পেনিলোপ ঘুমোতে পারলেন না। কেউ। তাঁরা দুজনেই গল্প বলতে লাগলেন। বলতে লাগলেন আপন আপন অভিজ্ঞতার কথা। পেনিলোপ বললেন তার পাণিপ্রার্থীদর স্বেচ্ছাচারিতার কথা। কি ভাবে দিনের পর দিন তারা কত খাদ্য কত পানীয় নষ্ট করেছে। আবার ওডিসিয়াসও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে তাঁর বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রার মাঝে মাঝে বিভিন্ন দ্বীপে গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তার কথা সব বললেন একে একে।

ওডিসিয়াস প্রথমে বললেন সিকোনদের কথা। সেখানে তাঁর অভিযান সফল হয়েছিল। তারপর যান পদ্মভোজীদের দেশে। সেখানকার মানুষরা পদ্মের মধু খেয়ে বেঁচে থাকত। তারপর বললেন, সাইক্লোপের কথা। কিভাবে ভীষণাকার দৈত্য সাইক্লোপ তাঁর সামনে তার লোকগুলোকে ধরে ধরে খায় তা বললেন। আর এক নরখাদক জাতি হলো ল্যাস্ট্রিগোনিয়ার লোকরা। এরপর তিনি বললেন জাদুকরী দেবীর কথা, বললেন, তাঁর নির্দেশমত মৃত্যুপুরীতে যাবার কথা। জাদুকরী দেবীর কাছে একটি বছর অতিবাহিত করতে হয় তাঁকে। সিল্লা ও চ্যারিবডিস নামে দুটি ভয়ঙ্কর সর্বগ্রাসী জলজ প্রাণীর কথাও বললেন, ওডিসিয়াস যাদের কাছে কোন সমুদ্র-নাবিক গিয়ে পড়লে তার মৃত্যু অবধারিত। সে গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাগল হয়ে ছুটে যায় নিশ্চিত মৃত্যুর কবলে ধরা দিতে, সাইরেনদের সেই মায়াময় গানের কথাও বললেন ওডিসিয়াস। এরপর তিনি বললেন জলপরী ক্যালিপসোর কথা। ওগিজিয়া দ্বীপের এক পার্বত্য গুহাবাসিনী যে জলদেবী তাঁকে অমরত্ব আর অনন্ত যৌবনদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে বিবাহ করতে চেয়েছিল। তারপর তিনি যান ফেসীয়দের রাজার কাছে যিনি তাকে যথেষ্ট সাহায্য ও ধনরত্ন দান করে অবশেষে ইথাকা দ্বীপ পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন।

যতক্ষণ পর্যন্ত না স্ত্রীর প্রেমালিঙ্গনের মধ্যে আবদ্ধ এক গভীর সুখনিদ্রা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করে তৃপ্ত হলেন ওডিসিয়াস ততক্ষণ রাত্রি প্রভাত হতে দিলেন না দেবী এথেন। ততক্ষণ ওসিয়ান হতে উঠে এসে স্বর্গে মর্তে আলোর পশরা ছড়াতে দিলেন না ঊষাদেবীকে। অবশেষে নিদ্রাশেষে উঠে ওডিসিয়াস স্ত্রীকে বললেন, প্রিয়তমে, আমরা দুজনেই প্রচুর দুঃখ ভোগ করেছি। তুমি এখানে ঘরে বসে আর আমি বিদেশে বিধিনির্দিষ্ট নির্বাসনে। যাই হোক, অবশেষে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত মিলনানন্দ লাভ করেছি, আমরা অনন্ত একটি রাত্রি যাপন করেছি পরস্পরের প্রেমালিঙ্গনের মাঝে। এবার আমি আমার এই ঘরবাড়ি ও বিষয়সম্পত্তির সব ভার তোমার হাতে দিয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছি অজানার পথে। দুবৃত্তরা আমার যে ব্যাপক পশুহানি করেছে তা আবার পূরণ হতে যাবে। উপস্থিত আমি আমাদের গ্রাম্য বাগানবাড়িতে গিয়ে আমার বৃদ্ধ পিতা লার্তেসের সঙ্গে দেখা করব। সকাল হলেই সকলে জানতে পারবে আমি পাণিপ্রার্থীদের সকলকে হত্যা করেছি। তোমাকে বলার কিছু নেই। আমি যাবার পর তুমি তোমার সহচরীদের নিয়ে উপরতলায় ঘরে বসে থাকবে। কারো সঙ্গে দেখা করবে না বা কাউকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করবে না।

নিজে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে টেলিমেকাস, ইউমেয়াস ও ফিলোতিয়াসকে জানালেন ওডিসিয়াস। তারাও তাঁর আদেশমত অস্ত্র ধারণ করল। তারপর দরজা খুলে একযোগে সকলে বেরিয়ে পড়ল ওডিসিয়াসের নেতৃত্বে। তখন এক উজ্জ্বল দিবালোকে সারা পৃথিবী পরিপ্লাবিত হলেও এক মায়াময় অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে এগিয়ে চলল, হার্মিসের পিছু পিছু। একে একে তারা ওসিয়ান নদী, তুষারশুভ্র এক পাহাড়, সূর্যদেবতার স্বর্ণতোরণদ্বার, মায়াময় স্বপ্নপুরী সব পার হয়ে অবশেষে উপনীত হলো বিদেশী আত্মাদের আবাসভূমি এক উন্মুক্ত প্রান্তরে।

সেই প্রান্তরমাঝে এসে তারা দেখতে পেল অ্যাকেলিস, প্যাট্রোক্লাস, অ্যান্টিলোকাস ও এসিয়াসের আত্মাকে। পরে সেখানে এসে উপনীত হলো আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমননের আত্মা। তাঁর সঙ্গে তাঁর মৃত সহকর্মীদের আত্মাও ছিল। অ্যাকেলিস একসময় জিজ্ঞাসা করলে অ্যাগামেমননকে, হায় অ্যাগামেমনন, আমরা ভাবলাম তুমি দেবরাজ জিয়াসের অনুগ্রহভাজন। কারণ ট্রয়যুদ্ধে তুমি সমগ্র গ্রীকজাতিকে নেতৃত্ব দান করো এবং সৈন্য পরিচালনা করো। কিন্তু সেই তুমিই অকালে শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করো এখানে এসে। যদি তুমি ট্রয়যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করতে তাহলে তোমার সম্মানার্থে এক স্মৃতিসম্ভ নির্মিত হত আর তোমার যশোগাথা প্রচারিত হত যুগ যুগ ধরে।

আত্রেউস পুত্রের আত্মা তার উত্তরে বলল, হে অ্যাকেলিস তুমি ট্রয়যুদ্ধে বড় এক গৌরবময় মৃত্যুবরণ করো। মৃত্যুতেও অক্ষুণ্ণ থাকবে তোমার মহিমা। তোমার মৃতদেহটি লাভ করার জন্য কত গ্রীক ও ট্রয়সৈন্য প্রাণবলি দেয়। আরও অনেকে দিত যদি না দেবরাজ জিয়াস এক প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি করে আমাদের তখন প্রতিনিবৃত্ত করতেন। আমরা তখন তোমার মৃতদেহটি জাহাজে নিয়ে এসে সেটিকে ধৌত করে উত্তম শয্যায় শায়িত করি। তোমার দেশবাসীরা তোমাকে ঘিরে শোক করতে থাকে। তোমার মৃত্যুর কথা জানতে পেরে তোমার মাতা জলপরীদের নিয়ে এসে শোকাকুলা হয়ে এমনভাবে চিৎকার করতে থাকেন যাতে গ্রীকসেনারা ভীত হয়ে পালাতে থাকে জাহাজ ছেড়ে। অবশেষে বিজ্ঞ নেস্টর তাদের শান্ত করেন। নয়জন সঙ্গীতের দেবতা তোমার অন্তিম সঙ্গীত গাইতে থাকেন। সেই করুণ সঙ্গীতের অলৌকিক মূছনায় অশ্রুতে আপ্লুত হয়ে উঠে উপস্থিত সকলের চক্ষু। এইভাবে সতের দিন সতের রাত তোমার জন্য শোক বিলাপ করার পর আঠার দিনের দিন তোমার মৃতদেহ দাহ করা হয় এক সুসজ্জিত চিতার অনলে। তোমার সম্মানার্থে অনেক পুষ্টল মেষ বলি দেওয়া হয়। এবং গ্রীকবীরেরা পদব্রজে অথবা রথারূঢ় হয়ে শোভাযাত্রা করে তোমার চিতাটিকে প্রদক্ষিণ করেন। চিতানলে তোমার দেহ ভস্মীভূত হবার পর তোমার শুভ্র অস্থিগুলো তোমার মায়ের দেওয়া এক পবিত্র পাত্রে প্যাট্রোক্লাসের অস্থির সঙ্গে সংরক্ষিত হয়। অবশেষে সেই হেলেসপন্ট উপসাগরের তীরে একটি জায়গায় তোমার বিরাট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় যা যুগ যুগ ধরে সমুদ্রগামী নাবিকরা দেখতে পাবে। তারপর তোমার অন্ত্যেষ্টিক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের যে পুরস্কার তোমার মাতা থেটিস দান করেন তা এমনই মূল্যবান যে সে ধরনের পুরস্কার কেউ কখনো দেখে নি। সুতরাং দেখ অ্যাকেলিস, মৃত্যু তোমার গৌরব বিন্দুমাত্রও হানি করতে পারে নি। অথচ দেখ ট্রয়যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সে যুদ্ধে জয়লাভ করেও আমি কি পেলাম? আমার স্বদেশের ফিরতে না ফিরতেই বিশ্বাসঘাতক এজিসথাস ও আমার অবিশ্বস্ত স্ত্রীর দ্বারা শোচনীয়ভাবে নিহত হলাম।

অ্যাকেলিস ও আত্রেউসপুত্রের কথাবার্তা শেষ না হতেই হার্মিস মৃত পাণিপ্রার্থীদের আত্মাগুলো সেখানে নিয়ে এলেন। তাদের মধ্যে অ্যাফিমীডনের আত্মাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন অ্যাগামেমননের আত্মা। অ্যাগামেমনদের আত্মা বলল, কীভাবে তোমার মৃত্যু ঘটল অ্যাম্ফিমীডন? ভূকম্পনদেবতা পসেডনের নির্দেশে কোন মত্ত প্রভঞ্জন কি সমুদ্রবক্ষে তোমার জাহাজ ডুবিয়ে দেয়? আচ্ছা আমি যখন রাজা মেনেলাসের সঙ্গে তোমাদের বাড়ি ইথাকায় গিয়ে রাজা ওডিসিয়াকে আমাদের স্বপক্ষে ট্রয়যুদ্ধে যোগদান করার জন্য অনুরোধ করতে যাই তখনকার কথা কি মনে আছে তোমার?

অ্যাম্ফিমীডনের আত্মা বলল, সেকথা আমার ভালই মনে আছে রাজন। আমাদের এই সকরুণ মৃত্যুর পূর্ণ বিবরণ আপনাকে দান করব।

ওডিসিয়াসের দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে আমরা তাঁর স্ত্রীর প্রতি প্রেম নিবেদন করি। কিন্তু তিনি সরাসরি আমাদের নিরাশ না করে বা কোন স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে গোপনে আমাদের ধ্বংসের পরিকল্পনা করতে থাকেন। প্রথমে তিনি এক ছলনার আশ্রয় নিয়ে তিন বছর আমাদের ঠেকিয়ে রাখেন। তিনি বৃদ্ধ লার্তেসের জন্য এক শিল্প কার্যমণ্ডিত শবাচ্ছাদন বয়ন করতে করতে রোজ রাতে সারাদিনের সেলাইগুলো খুলে দিতেন। পরে আমরা জানতে পারি তিনি সত্যি সত্যিই কাজটি শেষ করতে থাকেন। কিন্তু সে কাজ শেষ হতেই বহু বিদেশ ঘুরে ভিক্ষুকের বেশে একদিন ইথাকায় এসে উপস্থিত হলেন ওডিসিয়াস। তাঁর সেই বেশেই প্রাসাদে আসেন। আমরা তাঁকে ভিক্ষুক ভেবে কিছু শক্ত কথা বলি এবং দুই একটি জিনিস ছুঁড়ে মারি। তিনি ধৈর্য ধরে সব সহ্য করেন। পরে কৌশলে অস্ত্রগুলো সরিয়ে এক ধনুর্বিদ্যা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন স্ত্রীর মাধ্যমে। আমরা তাঁর সেই বিরাট ধনুকে ছিলা পরাতে পারি নি, সে শক্তি আমাদের ছিল না। কিন্তু ওডিসিয়াস তাতে শরযোজনা করে অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করেন। পরে সেই তীর ধনুক দিয়েই আমাদের অনেককে হত্যা করেন। নিশ্চয় কোন দেবতা তখন তাঁকে সাহায্য করেন। এইভাবে আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হই। অ্যাগামেমনুন, আমাদের মৃতদেহগুলো এখনো ওডিসিয়াসের প্রাসাদ প্রাঙ্গণের এক স্থানে স্থূপীকৃত করা আছে। এখনো আমাদের বাড়ির লোকেরা জানতে না পারার জন্য আমাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় নি।

অ্যাগামেমননের আত্মা উত্তর করল, সত্যিই অপরাজেয় ওডিসিয়াস। বিবাহিত স্বামীর প্রতি যিনি সারাজীবন সততবিশ্বস্ত সেই পেনিলোপের মত স্ত্রীর লাভ করে তিনি কতই না সুখী। সতী পেনিলোপের গৌরবগাঁথা চিরদিন ঘোষিত হবে পৃথিবীতে, কোনদিন ম্লান হবে না সে গৌরব। অথচ দেখ আমার স্ত্রী ক্লাইতেমেস্ত্রা তার কত বিপরীত। সে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার বিবাহিত স্বামীকে হত্যা করে। সে সমগ্র নারীজাতিকে কলঙ্কিত করেছে তার জঘন্য পাপকর্মের দ্বারা।

মৃত্যুপুরীতে যখন এইভাবে কথাবার্তা বলছিল মৃত আত্মারা, ওডিসিয়াস তখন লার্তেসের গ্রাম্য খামারবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি টেলিমেকাসকে। মধ্যাহ্নভোজনের জন্য কিছু শূকরমাংসের ব্যবস্থা করতে বলে নিজে লার্তেসের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ডোলিয়াস প্রমুখ ক্ষেত মজুররা যখন আঙ্গুরক্ষেতে বাধ দেওয়ার জন্য পাথর সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত ছিল তখন তাদের এড়িয়ে ওডিসিয়াস তাঁর অস্ত্রগুলো খুলে রেখে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ লার্তেসের কাছে। লার্তেস তখন একটি চারা গাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল একটি চামড়ার টুপি, তাঁর হাতে ছিল মলিন দস্তানা আর গায়ে ছিল একটি সাধারণ দেহবন্ধনী। তার দ্বারা পরিহিত সব বস্তুই ছিল দারিদ্র্য আর দুর্দশার পরিচায়ক। অদূরে একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ওডিসিয়াস ভাবতে লাগলেন তিনি সরাসরি পিতার কাছে গিয়ে পরিচয় দান করবেন না আপাতত আত্মপরিচয় গোপন রাখবেন।

অবশেষে তিনি লাৰ্তেসের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, হে বৃদ্ধ, এই উদ্যানবাটিকাটি এমনই সযত্নলালিত যে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এমন কোন কৃষিসম্পর্কিত কোন কাজ নেই তা তুমি জান না। এ উদ্যানের প্রতিটি বৃক্ষই তোমার নিষ্ঠা ও যত্নশীলতার পরিচয় দান করছে। কিন্তু নিজে দেহের প্রতি যত্ন নাও না। তোমার পোশাক পরিচ্ছদ ছিন্নমলিন হলেও তোমাকে দেখে রাজবংশজাত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একদিন তুমি প্রচুর সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করেছ। যাই হোক বল তুমি কার ভৃত্য এবং কার উদ্যানই বা দেখাশোনা করছ? আর একটা কথা আমাকে খুলে বল, এটা কি ইথাকা? একটা লোক আমাকে এই কথাই বলল, কিন্তু লোকটাকে দেখে তেমন বুদ্ধিমান বলে মনে হলো না। আমি তাকে আমার এক বন্ধুর কথা প্রশ্ন করতে সে তা ঠিক বলতে পারল না। কিছুকাল আগে আমাদের দেশে একজন ইথাকাবাসী অতিথি আমার বাড়ি যেতে আমি তাকে আতিথ্য দান করে বহু উপহার দান করি। তিনি ছিলেন আর্সেইসিয়াস পুত্র লার্তেসের পৌত্র। আমি তাকে সাতটি পাকা সোনার মোহর, একটি রৌপ্যনির্মিত পানপাত্র, বারোটি মূল্যবান পোশাক, বারোটি দেহবন্ধনী ও চারজন কলাকুশলী নারী প্রদান করি।

বৃদ্ধ লার্তেস অপূর্ণ চোখে বললেন, তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছ। কিন্তু এ দেশ এখন দুবৃত্তদের কবলে। যাকে তুমি এইসব উপহার দিয়েছিলে সে আজ ইথাকায় থাকলে তোমাকে তার প্রতিদান দিত। কিন্তু বল কতদিন আগে তুমি তাকে দেখেছ। কারণ তোমার সেই অতিথি আমারই হতভাগ্য পুত্র। সে হয়ত দূর বিদেশে কোন হিংস্র জীবজন্তুর কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। বৃথাই তাকে মানুষ করেছি। তার মৃত্যুকালে তার সতীলক্ষ্মী স্ত্রী পেনিলোপও কোন শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারল না।

এবার বৃদ্ধ লার্তেস বললেন, তুমি কে? তোমার জন্মভূমি কোথায়? আর কি করেই বা এলে এখানে?

ওডিসিয়াস আত্মপরিচয় গোপন রেখে বললেন, সব কথা বলছি। আমি আসছি আলিবাস থেকে। আমার পিতার নাম রাজা অ্যাফেইদাস। আমার নিজের নাম এপারিটাস। সিকানিয়া থেকে আমি যখন যাত্রা করি, আমার তখন এখানে আসার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ঝড়ে আমার জাহাজ অকূলে ভেসে যাওয়ায় স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে পড়ি আমি। আজ হতে চার বছর আগে ওডিসিয়াসকে আমার দেশে বিদায় দিই। তখন আমার ডান দিক দিয়ে একটি পাখি উড়ে যায়। সুতরাং সেই সুলক্ষণ দেখে আমরা আশা করি আবার আমরা মিলিত হব।

লার্তেস তখন গম্ভীর হতাশায় আর্তনাদ করতে করতে মাটি তুলে মাথায় সাদা চুলের উপর চাপাতে লাগলেন। তাঁর দুঃখ ও কাতরোক্তি দেখে ওডিসিয়াস আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি তখন বৃদ্ধ লার্তেসকে জড়িয়ে ধরে আবেগের সঙ্গে বললেন, পিতা, যাকে তুমি খুঁজছিলে সেই আমি আজ তোমার সামনে এসেছি। আমি দীর্ঘ উনিশ বছর পর ফিরে এসে আমার প্রাসাদে সেই পাণিপ্রার্থীদের সকলকে হত্যা করে তাদের সব অপরাধের শাস্তি দিয়েছি।

লার্তেস বললে, যদি তুমি সত্য সত্যই আমার পুত্র হও তাহলে তার প্রমাণ দাও।

ওডিসিয়াস তখন সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁটুর কাছে ক্ষতস্থানটি দেখিয়ে বললেন, এই দেখ সেই ক্ষত যৌবনে যখন তোমরা একবার আমায় অটোলিকাসের কাছে পাঠিয়েছিলে তখন একটি বন্য শূকরের দাঁতে আমার পায়ে এই ক্ষত হয়। তাছাড়া আমার বাল্যকালে এই বাগানে তুমি আমাকে যে সব গাছ দিয়েছিলে তাদের কথা সব মনে আছে আমার।

লার্তেস দেখলেন ওডিসিয়াসের দেওয়া প্রমাণ যথার্থ। তখন তিনি তাঁর প্রিয়তম পুত্রকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে পরম পিতা জিয়াস ও অন্যান্য দেবতারা তোমরা যথার্থই স্বর্গে বিরাজ করো। যদি সত্য সত্যই পাণিপ্রার্থীরা তাদের সকল অপরাধের সমুচিত শাস্তি পেয়ে থাকে তাহলে সেটা তোমাদের দয়া। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে তাহলে ইথাকার সামন্তরা আমাদের আক্রমণ করবে এবং সেফানেলিয়ার বিভিন্ন শহরে সাহায্য চেয়ে পাঠাবে।

বুদ্ধিমান ওডিসিয়াস বললেন, ভয় করো না পিতা। এখন এস এই বাগানবাড়িতে সেখানে টেলিমেকাসকে আমাদের জন্য মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করতে বলেছি। তার সঙ্গে ইউমেয়াস ও ফিলোতিয়াসও আছে।

দুজনে বাগানবাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। লার্তেস প্রথমে স্নান করে তেল মাখলেন। ইথেনের ইচ্ছায় তারা চেহারা আগের থেকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আরও। তা দেখে অবাক হয়ে গেলেন ওডিসিয়াস। বললেন, নিশ্চয় কোন দেবতার আশীর্বাদে এত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তোমার স্বাস্থ্য।

লার্তেস তখন বললেন, যখন একদিন সেফানেলিয়ার রাজা হিসেবে পেরিকাসের দুর্গ জয় করি সেদিনকার মত শক্তি আজ যদি আমার থাকত তাহলে আমি একাই পাণিপ্রার্থীদের সকলকে ধ্বংস করতে পারতাম।

ভৃত্যরা তখন খাদ্য ও পানীয় পরিবেশন করতে লাগল। এমন সময় ডোলিয়াস ও তার পুত্র এসে ওডিসিয়াসকে প্রথমে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। ডোলিয়াস টেলিমেকাসের একটা হাত ধরে তাঁর চিবুক চুম্বন করে বলল, আমাদের মনিব তাহলে ফিরে এসেছে। রাণী জানেন তো?

ওডিসিয়াস বললেন, তোমার রাণীমা আগেই শুনেছেন।

ডোলিসিয়াসের পুত্ররাও অভ্যর্থনা জানাল ওডিসিয়াসকে।

খামারবাড়িতে বসে ওডিসিয়াস যখন মধ্যাহ্নভোজনে ব্যস্ত ছিলেন তখন পাণিপ্রার্থীদের মৃত্যুসংবাদ ক্রমে গুজবের আকারে সারা নগর মধ্যে ছড়িয়ে যায়। মৃতদের আত্মীয়-স্বজনেরা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে মৃতদেহগুলো সকারের জন্য নিয়ে যায়। যাদের বাড়ি দূরে, জাহাজে করে সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার মানসে ইথাকাবাসীরা এক সভাস্থলে মিলিত হলো। অ্যান্টিনোয়াসের পিতা এপেইথেন সকলকে সম্বোধন করে অশ্রুপূর্ণ চোখে বললেন, বন্ধুগণ, আমি এতদ্দারা ঘোষণা করছি ওডিসিয়াস আমাদের জাতির শত্রু। তার দ্বারা সকল পাণিপ্রার্থীরাই নিহত হলো। এতদিন পর বাড়ি ফিরেই তিনি সেফালেনিয়ার বিশিষ্ট লোকদের বধ করলেন। তোমরা দেখ সে কোথায় যায়। পাইলস ও এজিসে পালিয়ে যাবার আগেই ধরে আনতে হবে তাকে। আমরা যদি তার উপর প্রতিশোধ না নিই তাহলে আমাদের বংশধরেরা ক্ষমা করবে না আমাদের। সুতরাং অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়।

তার এই অশ্রুসিক্ত ও আবেগপূর্ণ ভাষণে শ্রোতাদের মনে দয়া হলো। এমন সময় রাজপ্রাসাদের প্রহরী মিডন ও চারণকবি এসে উপস্থিত হলো সভায়। তাদের দেখে অনেকেই আশ্চর্য হলো। মীডন বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি ওডিসিয়াস যখন লড়াই করেছিলেন তখন মেন্টরের বেশে একজন দেবতা আবির্ভূত হয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন তাঁকে।

একথা শুনে মলিন হয়ে গেল অনেকের মুখ। এমন সময় ভবিষ্যদ্বক্তা হ্যাঁলিসার্থেস উঠে বললেন, ইথাকাবাসিগণ, আমার কথা শোন। তোমাদের অনেকেই আজকের ঘটনার জন্য দায়ী। তোমরা একদিন আমার ও মেন্টরের কথা শোন নি। আমরা তোমাদের নির্বোধ পুত্রদের দমন করার জন্য বারবার অনুরোধ করেছিলাম। তোমাদের দুবৃত্ত পুত্ররা অপরের ধনসম্পত্তি নষ্ট করে ও তার স্ত্রীকে অপমান করে তারা এক চরম অপরাধী করে তুলেছিল নিজেদের। আমার কথা শোন, আর প্রতিশোধ নিতে যেও না। তাহলে তোমাদেরও অনেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে অকালে।

বৃদ্ধ হ্যাঁলিসার্থেসের সরল সত্য কথা অনেকের ভাল লাগল না। তারা চিৎকার করতে লাগল ক্ষুব্ধ হয়ে। তবে বেশিরভাগ শ্রোতা চুপ করে বসে রইল। যাই হোক, অ্যাপেইথেসের কথামত একদল লোক অস্ত্র ধারণ করে তার নেতৃত্বে পথে নেমে পড়ল।

অলিম্পাসে তখন এথেন দেবরাজ জিয়াসকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে পিতা, তোমার মনে কি আছে তা ব্যক্ত করো আমার কাছে। তুমি কি যুদ্ধের বিভীষিকা আরো বাড়াতে চাও না সকল দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে চাও?

এ কথায় জিয়াস বললেন, একথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? ওডিসিয়াস বাড়ি ফিরে তার শত্রুদের নাশ করবে এটা তো তোমারই ইচ্ছা ছিল। তোমার যা খুশি করতে পার। তবে আমার ইচ্ছা যে যেহেতু ওডিসিয়াস পাণিপ্রার্থীদের উপর প্রতিশোধ নিয়েছে তখন ইথাকাবাসীরা তার সঙ্গে সব ভুলে সন্ধি করুক। তাকে তাদের রাজারূপে প্রতিষ্ঠিত করুক আবার।

জিয়াসের কাছ থেকে সাহস পেয়ে অলিম্পাস হতে মর্ত্যভূমিতে চলে গেলেন দেবী এথেন। এদিকে খামারবাড়িতে তৃপ্তিসহকারে আহার করার পর ওডিসিয়াস বললেন, একজন কেউ নগরে গিয়ে দেখে এস, আমাদের শত্রুরা সজাগ হয়ে উঠছে কি না।

এই আদেশ পেয়ে ডোলিয়াসের এক পুত্র বাইরে গিয়ে দেখল শত্রুরা বেশি দূরে নেই। সে ফিরে এসে খবর দিল, ‘প্রস্তুত হোন।‘ সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে উঠলো সকলে। ওডিসিয়াসরা ছিলেন চারজন। ডোলিয়াসের পুত্র ছিল ছয়জন। তাছাড়া ডোলিয়াস ও লার্তেস বৃদ্ধ হলেও যুদ্ধের পোশাক পরে প্রস্তুত হলেন। অবশেষে সকলে ওডিসিয়াসের নেতৃত্বে খামারবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল।

তারা সকলে বাইরে আসতেই দেবী এথেন মেন্টরের বেশ ধারণ করে যোগদান করলেন তাদের সঙ্গে। ওডিসিয়াস তাঁকে দেখে চিনতে পেরে আনন্দিত হলেন। পুত্রকে সম্বোধন করে ওডিসিয়াস বললেন, টেলিমেকাস, যুদ্ধকালে তুমি যেন এমন কিছু করো না যাতে তোমার পিতার গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় বা তোমার পূর্বপুরুষেরা লজ্জা পায়।

টেলিমেকাসও সাহসের সঙ্গে বলল, তুমি নিজে দেখ পিতা, আমার কোন কাজে লজ্জার কিছু থাকবে না।

সেকথা শুনে খুশি হয়ে লার্তেস বললেন, হে ঈশ্বর আজ কি আনন্দের দিন। আজ আমার পুত্র ও পৌত্র এক বীরত্বের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ।

দেবী এথেন তখন বৃদ্ধ লার্তেসের কাছে বললেন, হে আমার বন্ধু লার্তেস, দেবরাজ জিয়াস ও দেবী এথেনের কাছে প্রার্থনা করে বর্শা নিক্ষেপ করা শত্রুদের উপর।

একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বর্শা নিক্ষেপ করলেন লার্তেস। আর এই বর্শাটি এপেইথেসের বর্ম ভেদ করে তার বক্ষস্থল বিদ্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে ওডিসিয়াস ও টেলিমেকাস শত্রুদের প্রথম সারির লোকদের তরবারি ও দ্বিমুখী বর্শা দিয়ে আক্রমণ করলেন। এথেন যদি ইথাকাবাসীদের যুদ্ধ থামাতে আদেশ না দিতেন তাহলে তাদের সকলকে হত্যা করতে ওডিসিয়াস ও টেলিমেকাস। এথেন দৈববাণী করলেন, ইথাকাবাসীগণ এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ত্যাগ করো, যাতে আর রক্তপাত না ঘটে তার ব্যবস্থা করো।

এথেনের কথায় ভীত হয়ে ইথাকাবাসীরা অস্ত্র ত্যাগ করে শহরের দিকে পালিয়ে গেল। কিন্তু তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে শুরু করলেও শিকার-লোলুপ ঈগলের মত তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওডিসিয়াস। কিন্তু এমন সময় একটি জ্বলন্ত বজ্রাগ্নি বিচ্ছুরিত হলো জিয়াসের হাত থেকে। তা থেকে এথেন ওডিসিয়াককে এই গৃহযুদ্ধ থামাতে বললেন। তা না হলে ক্রুদ্ধ হবেন দেবরাজ জিয়াস।

সানন্দে সে আদেশ মেনে নিলেন ওডিসিয়াস। সঙ্গে সঙ্গে জিয়াসকন্যা দেবী প্যালাস এথেন মেন্টরের ছদ্মবেশ ধারণ করে দু পক্ষের মধ্যে এক স্থায়ী শান্তি স্থাপন করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *