২২. প্রাসাদে খণ্ডযুদ্ধ

দ্বাবিংশ পর্ব
প্রাসাদে খণ্ডযুদ্ধ

এবার দেহগাত্র হতে সেই ছিন্ন মলিন কম্বলটি খুলে ফেলে সেই কাঠের তক্তার উপর উঠে দাঁড়ালেন ওডিসিয়াস। একহাতে ধনুকটি ধরে আর একটি হাত দিয়ে তূণটি হতে সব তীরগুলো ঝেড়ে ফেললেন। তারপর পাণিপ্রার্থীদের লক্ষ্য করে চিৎকার করে বললেন, প্রতিযোগিতার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এবার আর এক খেলা শুরু হবে, তাতে শুধুই আমি অংশগ্রহণ করব।

এই বলে বিষাক্ত তীর ধনুকে সংযোজিত করে অ্যান্টিনোয়াসকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করলেন। অ্যান্টিনোয়াস তখন মদের পাত্র হতে তাতে চুমুক দিতে যাচ্ছিল। সে এই ধরনের উৎসবের পরিবেশে মৃত্যু ও রক্তপাতের ঘটনা ঘৃণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। কিন্তু ওডিসিয়াসের অব্যর্থ তীরটি তার গলদেশ বিদ্ধ করল। পানপাত্র হাতেই পড়ে গেল অ্যান্টিবোয়াস। তার টেবিলে যেসব খাদ্যদ্রব্য ছিল তা রক্তরঞ্জিত হয়ে উঠল।

পাণিপ্রার্থীরা তা দেখে ক্রোধের আবেগে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল সবাই। তারা হাতের কাছে অস্ত্রের খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোন বর্শা বা ঢাল পেল না। তারা ভাবল ঘটনাক্রমে তীরটা অ্যান্টিনোয়াসের গায়ে লেগে গেছে। বিদেশী তাকে মারতে চায় নি। তবু তারা একযোগে বলতে লাগল, শোন বিদেশী তোমার শেষ খেলা এবার শেষ হয়েছে। এবার তোমার মরতে হবে। তুমি ইথাকার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে হত্যা করেছ।

এবার অপরাজেয় বীর ওডিসিয়াস গর্জন করে বলে উঠলেন, শোনরে কুকুরের দল, তোরা কখনই ভাবতে পারিসনি যে আমি ট্রয় থেকে কোনদিন ফিরে আসব। তাই তোরা আমার ধনসম্পত্তি নষ্ট করেছিস, আমার স্ত্রীর প্রতি প্রেম নিবেদন করেছিস এবং আমার দাসীদের শ্লীলতা হানি করেছিস। এবার তাদের শেষ সময় এসে গেছে।

ভয়ে মলিন হয়ে গেল সকলের মুখ। আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য সকলেই মুখ ঘুরিয়ে নিরাপদ স্থানের অনুসন্ধান করতে লাগল। ইউরিমেকাস তখন বলল, ইথাকার ওডিসিয়াস যদি সত্যই বাড়ি ফিরে আসে এবং তুমি যদি সেই মানুষ হও তাহলে তুমি যা যা বললে তা সব যথার্থ। কিন্তু যে ব্যক্তি ছিল এবিষয়ে অগ্রণী এবং সব কাজের জন্য দায়ী সেই অ্যান্টিনোয়াস এখন মৃত। সুতরাং আমাদের এখন মুক্তি দাও। আমরা বরং তোমার যে ধন-সম্পত্তি নষ্ট করেছি তা সকলে মিলে পূরণ করে দেব।

ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, ইউরিমেকাস, যদি তুমি তোমার সমস্ত ভূসম্পত্তি দান করো আমায় তা হলেও আমি তোমাদের সকলকে সব অপরাধের শাস্তি না দিয়ে ছাড়ব না। এখন হয় সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করো অথবা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে কিন্তু মনে হয় তা কেউ পারবে না।

একথা শুনে পাণিপ্রার্থীদের হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল। তাদের পায়ের তলার মাটি বসে যেতে লাগল। ইউরিমেকাস তখন বলল, বন্ধুগণ, কোন উপায় নেই। ও এখন তীর ধনুক পেয়েছে হাতে। ঐ মঞ্চ থেকে আমাদের সকলকে হত্যা করবে। এখন মুক্ত তরবারি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে চল। ওকে এখান থেকে বাইরে তাড়িয়ে নিয়ে চল।

এই বলে তরবারি হাতে ওডিসিয়াসের দিকে ইউরিমেকাস এগিয়ে যেতেই ওডিসিয়াসের একটি তীর তার বক্ষস্থল বিদ্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পা ছুঁড়তে লাগল ইউরিমেকাস। মৃত্যুর করাল অন্ধকার নেমে এল তার চোখে।

এরপরে মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে ওডিসিয়াসের দিকে ছুটে গেল আফিনোমাস। কিন্তু মাঝপথেই টেলিমেকাস তার বর্শাটি তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল। অ্যাফিনোমাস পড়ে যেতে পারে পিঠে গেঁথে যাওয়া বর্শাটি খুলে নিয়ে দ্রুত তার পিতার কাছে চলে এল টেলিমেকাস। তারপর বলল, শোন পিতা, এবার আমি কিছু অস্ত্র নিয়ে আসি আমাদের জন্য।

ওডিসিয়াস বললেন, তাড়াতাড়ি যাও।

টেলিমেকাস ছুটে গিয়ে সেই অস্ত্রাগার থেকে চারটি ঢাল চারটি শিরস্ত্রাণ, আটটি বর্শা তার পিতার কাছে নিয়ে এল। যতক্ষণ তীর ছিল তূণে ওডিসিয়াস একের পর একে করে পাণিপ্রার্থীদের বধ করলেন। কিন্তু সব তীর এবার ফুরিয়ে গেলে ওডিসিয়াস ধনুকটি ফেলে দিয়ে বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে হাতে বর্শা ধারণ করলেন। ঘর হতে বাই যাবার একটিমাত্র দরজা ছিল। ওডিসিয়াস ইউমেয়াসকে বললেন, সশস্ত্র অবস্থায় ঐ দরজাতে পাহারা দাও। কেউ যেন ওখানে যেতে না পারে।

এজলাস বলল, আমাদের কেউ ঐ দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে তোক ডাকতে পারে না?

মেলানথিয়াস টেলিমেকাসের অস্ত্রাগার হতে বারোটি শিরস্ত্রাণ ও বারোটি বর্শা নিয়ে এসে পানিপ্রার্থীদের হাতে দিল। তা দেখে ভীত হয়ে ওডিসিয়াস তাঁর পুত্রকে বললেন, এ বোধ হয় প্রাসাদের কোন দাসীর কাজ অথবা মেলানথিয়াসের কাজ।

টেলিমেকাস বলল, দোষটা আমারই পিতা। আমি অস্ত্র নিয়ে আসার সময় ঘরের দরজাটা খুলে রেখে এসেছিলাম আর সেটা ওরা লক্ষ্য করেছিল। যাই হোক, ইউমেয়াস শীঘ্রই গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দাও আর দেখ এর মধ্যে কোন দাসীর হাত আছে কি না অথবা এটা মেলানথিয়াসের কাজ।

তাদের এইভাবে কথা বলার সময় মেলানথিয়াস আবার অস্ত্র আনার জ্ন্য প্রাসাদের মধ্যে ছুটে গেল। ইউমেয়াস তা দেখতে পেয়ে ওডিসিয়াসকে বলল, প্রভু আমরা যাকে সন্দেহ করেছিলাম সেই পাজিটা আবার অস্ত্র আনতে গেছে। যদি তাকে জব্দ করতে পারি তাহলে তাকে হত্যা করব না এখানে বেঁধে আনব?

ওডিসিয়াস বললেন, আমি আর টেলিমেকাস এখানে থাকব। তুমি আর ফিলোতিয়াস দুজনে চলে যাও। ওকে ধরতে পারলে কোমরে দড়ি বেঁধে কড়িকাঠে ঝুলিয়ে রাখবে।

ইউমেয়াসরা অস্ত্রাগারে গিয়ে দেখল মেলানথিয়াস আগেই সেখানে গিয়ে অস্ত্র নিচ্ছে। সে বুঝতে পারে নি তার পিছনে কারা আসছে। যৌবনে একদিন যে ঢাল নিয়ে যুদ্ধ করতেন রাজা লার্তেস সেই ঢালটি যখন মেলানথিয়াস তুলে নিচ্ছিল তখন তাকে ধরে ফেলল ইউমেয়াস। তারপর তাকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখল ঘরের কড়িকাঠে। বলল, থাক এইখানে সারারাত। আর সকালের আলো তোমাকে এখানে দেখতে পাবে না, আর তোমাকে ভোজসভায় টেবিলের জন্য ছাগলের মাংস সরবরাহ করতে হবে না।

এদিকে দেবী এথেন মেন্টরের ছদ্মবেশে আবির্ভূত হলেন ওডিসিয়াসের সামনে। তাকে দেখে ওডিসিয়াস বললেন, পুরাতন বন্ধুর কথা স্মরণ করে তার অতীত উপকারের কথা স্মরণ করে তাকে আজ উদ্ধারের চেষ্টা করো মেন্টর।

যেন দেবীকে সম্বোধন করে এইভাবে কথাগুলো বললেন ওডিসিয়াস। এদিকে মেন্টরকে ঘরে ঢুকতে দেখে বিদ্রূপ ও গালাগালি করতে লাগল পাণিপ্রার্থীরা। এজলাস চিৎকার করে বলল, যদি তুমি ওডিসিয়াসকে সাহায্য করো তাহলে আমি তোমাকে ও তোমাদের সকলে হত্যা করব। তোমার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করব এবং তোমার স্ত্রীপুত্রদের বাদ দেব না, সব হত্যা করব।

এজলাসের এই আবেগপূর্ণ ভীতিপ্রদর্শনের কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মেন্টরবেশিনী এথেন। তিনি ভর্ৎসনার সুরে ওডিসিয়াসকে বলতে লাগলেন, তোমার সেই তেজ কোথায় ওডিসিয়াস? তোমার সব শক্তি কি আজ অপগত? সুন্দরী হেলেনের উদ্ধারের জন্য তুমি নয় বৎসরকাল ট্রয়বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে কত লোককে হত্যা করেছ, যুদ্ধের জন্য কত আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের পরিকল্পনা করেছ। আজ যেন তুমি আর সে মানুষ নেই। আজ তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে এসেছ, তবু কেন ওদের সম্মুখীন হতে ভয় পাচ্ছ? এস বন্ধু, আমার পাশে এসে দাঁড়াও। দেখ অ্যালসিনোয়াসপুত্র মেন্টর তোমার অতীতের দয়ার প্রতিদান দেয় কি না।

এথেন কিন্তু তখন তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চূড়ান্ত জয়ের গৌরব দান করলেন না ওডিসিয়াসকে। তিনি শুধু শক্তি ও সাহস সঞ্চার করলেন পিতা-পুত্রের মনে। তারপর একটি চাতক পাখি হয়ে সেই ঘরের কড়িবরগায় উড়ে বেড়াতে লাগলেন। এদিকে যে ছয়জনের নেতৃত্বে অবশিষ্ট পাণিপ্রার্থীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ওডিসিয়াসের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো তারা হলো এজলাস, ডিমোটলেমাস, ইউরিনোমাস, অ্যামিডন, পীসাভার ও পলিবাস। তাদের মধ্যে এজলাস যুদ্ধ পরিচালনার ভার গ্রহণ করে তাদের বলল, বন্ধুগণ, দেখ ওডিসিয়াসের শক্তি এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে কত। মেন্টর তাকে ছেড়ে চলে গেছেন ওরা এখন মাত্র চারজন, তোমরা কিন্তু একসঙ্গে আক্রমণ করো না। আমরা ছয়জন ওডিসিয়াসকে আঘাত করে ঘায়েল করব। তার পতন ঘটলে অন্যেরা সব কোথায় চলে যাবে।

এবার পাণিপ্রার্থীদের ছয়জন নেতা ওডিসিয়াসকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করলে তাদের মধ্যে তিনজনের বর্শা দরজা ও দেওয়ালে লাগল। তখন অক্ষত ওডিসিয়াস তাঁর দলের লোকদের বললেন, এবার আমাদের পালা। যারা অন্যায় করেও আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করে আরও অন্যায় করছে তাদের সকলকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ কর তোমরা।

ওডিসিয়াসের কথার সঙ্গে সঙ্গে চারজন বর্শা নিক্ষেপ করতেই সে বর্শাগুলো চারজন পাণিপ্রার্থীকে আঘাত করল। ওডিসিয়াসের অব্যর্থ বর্শার আঘাতে নিহত হলো ডিমোটলেমাস, টেলিমেকাসের বর্শার আঘাতে নিহত হলো ইউরিএডস। ইলেটাস ও পীসান্ডার নিহত হলো যথাক্রমে ইউমেয়াস ও ফিলোতিয়াসের বর্শায়। ভীতসন্ত্রস্ত পাণিপার্থীরা এককোণে সরে গেল আর ওডিসিয়াসের দল তখন এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহগুলোতে গেঁথে যাওয়া বর্শাগুলো তুলে টেনে নিয়ে এল।

এবার অবশিষ্ট পাণিপ্রার্থীর দল আবার বর্শা নিক্ষেপ করল ওডিসিয়াসকে লক্ষ্য করে। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলা তাদের আক্রমণ। শুধু অ্যাম্ফিমীডনের বর্শার আঘাতে টেলিমেকাসের এক হাতের কব্জির কাছে চামড়াটা একটু ছিঁড়ে গেল আর টেসিপ্লাসের বর্শায় ইউমেয়াসের কাঁধের কাছে একটু কেটে গেল। কিন্তু এবার ওডিসিয়াসের দল যখন আবার বারোটি তীক্ষ্ণ বর্শা সমবেত শত্রুদের লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করল, তখন তাতে চারজন শত্রুই নিহত হল আবার। এবার ওডিসিয়াস ইউরিডেমাসকে, টেলিমেকাস অ্যাম্ফিমীডনকে, ইউমেয়াস পলিবাসকে আর ফিলোতিয়াস টেসিপ্লাসক তাদের বর্শার আঘাতে নিহত করল। ফিলোতিয়াস মুমূর্ষ টেসিপ্লাসকে লক্ষ্য করে বলল, একদিন তুমি রাজা ওডিসিয়াসকে গরুর ক্ষুর উপহার দিয়েছিলে আজ প্রতিদান পেলে

অতঃপর ওডিসিয়াস এগিয়ে গিয়ে এজলাসকে এবং টেলিমেকাস এগিয়ে গিয়ে ইউনরকে বর্শার দ্বারা আঘাত করে ধরাশায়ী করলেন। এবার হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো পাণিপ্রার্থীরা। তারা গ্রীষ্মের বড় বড় মাছির দ্বারা আক্রান্ত পশুপালের মত ছুটে বেড়াতে লাগল ঘরময়। এদিকে ছোট ছোট পাখির উপর ঝাঁপিয়ে পড়া শকুনির মত অবশিষ্ট পাণিপ্রার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওডিসিয়াসের দল। তাদের আক্রমণের ফলে আহত পাণিপ্রার্থীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠল সমস্ত ঘর। পাণিপ্রার্থীদের অন্যতম লিওডেস ওডিসিয়াসের পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাতরভাবে বলল, আমি ছিলাম তাদের পুরোহিত। আমি তাদের কতবার নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু তারা শোনে নি আমার কথা। সুতরাং আমাকে মুক্তি দিন।

ওডসিয়াস বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তুমি ছিলে তাদের পুরোহিত। সুতরাং নিশ্চয়ই তুমি কতবার এই ঘরে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেছ আমি যেন কখনো ফিরে না আসি আর তুমি যেন আমার স্ত্রীকে বিবাহ করতে পার। এই কথা বলে লিওডেসের ঘাড়ে তরবারি দ্বারা আঘাত করতে তার মাথাটি ধড় থেকে পড়ে গেল।

চারণকবি ফেমিয়া এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। সে সকলের অলক্ষ্যে পালাবে না ক্ষমা চাইবে ওডিসিয়াসের কাছে তা ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। অবশেষে সে ওডিসিয়াসের কাছে গিয়ে বলল, আমি আপনার কৃপাপার্থী ওডিসিয়াস। আপনি আপনার পুত্র টেলিমেকাসকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন আমি স্বেচ্ছায় এখানে আসি নি। পাণিপ্রার্থীরা জোর করে আমায় টেনে এনেছে। তবে যে গান আমি গাই তা স্বতস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে আমার কণ্ঠ থেকে।

একথা শুনতে পেয়ে টেলিমেকাস দ্রুত তার পিতার কাছে এসে বলল, ওঁকে ছেড়ে দাও পিতা, উনি নির্দোষ। আর প্রহরী মীডনকে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ ও আমার বাল্যকালে অনেক দেখাশোনা করত। অবশ্য ফিলোতিয়াস বা ইউমেয়াস তাকে যদি এর আগেই হত্যা না করে থাকে।

মীডন এতক্ষণ একজায়গায় গোপনে লুকিয়ে ছিল। টেলিমেকাসের কথা শুনে ছুটে এসে টেলিমেকাসের পা ধরে কাতরভাবে বলতে লাগল, তোমার পিতাকে বলে আমার প্রাণরক্ষা করো টেলিমেকাস। যেসব পাণিপ্রার্থীর দল তাঁর এত ক্ষতি করেও তাঁর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে নি তাদের জন্য ক্রোধে উন্মত্ত তিনি।

ওডিসিয়াস মীডনকে আশ্বাস দিয়ে হাসিমুখে বললেন, ভয় করো না। আমার পুত্র তোমায় মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছে। তবে একটা কথা শিখে রেখো, পাপ থেকে পুণ্য সত্যিই বড় এবং ভাল। এখন তুমি ও চারণকবি দুজনে বাইরে উঠোনে গিয়ে আমার সব কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

তারা দুজনে ভয়ে ভয়ে বাইরে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে গিয়ে বসল। তখনো, মৃত্যুর শঙ্কা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাদের মন। এদিকে ওডিসিয়াস তখন প্রাসাদের চারদিকে খুটিয়ে দেখছিলেন পাণিপ্রার্থীদের কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। কিন্তু শত্রুপক্ষের কাউকে জীবন্ত দেখতে পেলেন না। দেখলেন তারা সকলেই মৃত। সমুদ্র থেকে ধরে আনা মৃত মাছগুলো যেমন বেলাভূমির উপর গাদা করে থাকে তেমনি পাণিপ্রার্থীদের রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো স্তূপকৃত হয়ে উঠেছিল।

ওডিসিয়াস টেলিমেকাসকে বললেন, তুমি একবার ধাত্রী ইউরিক্লীয়াকে ডেকে আন আমার কাছে, তাকে কিছু কথা বলব।

সঙ্গে সঙ্গে দাসীমহলে গিয়ে টেলিমেকাস ইউরিক্লীয়াকে বলল, তার পিতা তাকে ডাকছে। সেই সঙ্গে তাকে প্রাসাদের প্রধানা দাসী হিসেবে তার কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিল টেলিমেকাস।

টেলিমেকাসের কথা শুনে এক ভীতিবিহ্বল বিস্ময় হতবাক হয়ে উঠল ইউরিক্লীয়া। তবু সে ঘরের দরজা খুলে ভয়ে ভয়ে এসে হাজির হলো ওডিসিয়াসের সামনে। দেখল গোভক্ষণরত সিংহের মত রক্তাক্ত হয়ে উঠেছ ওডিসিয়াসের সর্বাঙ্গ। পাণিপ্রার্থীদের মৃতদেহগুলো দেখে বিজয়োল্লাসে চিৎকার করে উঠলো ইউরিক্লীয়া। কিন্তু ওডিসিয়াস তার উচ্ছ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাদের দুষ্ট প্রকৃতির জন্য লোকগুলো এই শোচনীয় পরিণতি লাভ করলো, কোন মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে গর্ব করতে নেই। এখন প্রাসাদের দাসীদের খবর দাও। বল তাদের মধ্যে কারা সৎ এবং আমার প্রতি অনুরক্ত।

ধাত্রী ইউরিক্লীয়া উত্তর করল, আমি সব বলব বাছা। তোমার প্রাসাদে আছে পঞ্চাশজন দাসী। আমি তাদের নিজের হাতে সব শিখিয়েছি। তাদের মধ্যে মাত্র বারোজন আমাকে ও পেনিলোপকে অগ্রাহ্য করে কুপথ বেছে নেয়। টেলিমেকাস এতদিন ছোট থাকায় সে দাসীদের কোন আদেশ দিতে বা শাসন করতে পারত না। এখন আমি অন্দরমহলে গিয়ে আমার রাণীমাকে খবর দেব কি? তিনি হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন।

ওডিসিয়াস বললেন, না এখন তাকে জাগিও না। এখন সেই অন্যায়কারিণী দাসীদের পাঠিয়ে দাও এখানে।

ইউরিক্লীয়া দাসীদের খবর দিতে গেলে ওডিসিয়াস টেলিমেকাস ও ইউমেয়াসকে আদেশ দিলেন, তোমরা এখন মৃতদেহগুলো সরিয়ে ফেল। দাসীরা তোমাদের সাহায্য করবে। তারপর ঐসব দাসীদের উঠোনে নিয়ে গিয়ে তরবারি দিয়ে তাদের মাথাগুলো কেটে ফেলবে যাতে তাদের মৃত প্রেমিকদের জন্য হতাশ্বাস করতে না পারে।

অপরাধিনী দাসীরা কাঁদতে কাঁদতে নেমে এসে তাদের জন্য নির্দিষ্ট কাজগুলো করল। তারপর টেলিমেকাস তাদের প্রাসাদের উঠোনে এক সংকীর্ণ জায়গায় দাঁড় করিয়ে বলল, তোমরা যে অন্যায় আমার ও আমার মার উপর করেছ তার জন্য তোমাদের খুব একটা সুখের মৃত্যু দান করব না। এই বলে তাদের সকলের গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করল তাদের টেলিমেকাস।

এরপর মেলানথিয়াসকে উপর তলার অস্ত্রাগার হতে টেনে আনা হলো। একটি ধারাল ছুরি দিয়ে নাক কান, হাত পা ও পুরুষাঙ্গটি কেটে কুকুরদের দিয়ে খাওয়ানো হলো।

এবার ওডিসিয়াস ধাত্রী ইউরিক্লীয়াকে বললেন, আমার জন্য একটু আগুন জ্বাল আর কিছু বীজাণুনাশক গন্ধক নিয়ে এস। তারপর পেনিলোপকে তার সহচরীদের নিয়ে এখানে আসতে বল।

বৃদ্ধা ইউরিক্লীয়া বলল, যা বলেছ তা আমি ঠিক করব। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা ভাল পোশাক আর একটা দেহবন্ধী এনে দিই। তোমার এই খালি গা আর ছেঁড়া কম্বল দেখে লোকে কি বলবে?

ওডিসিয়াস বললেন, প্রথমে এই ঘরে আগুন জ্বাল।

ইউরিক্লীয়া সেই আদেশমত গন্ধক নিয়ে এসে আগুন জ্বালাল। হত্যার স্থানগুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হলে ওডিসিয়াস সেখানে গন্ধক ছড়িয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে ইউরিক্লীয়া দাসীদের মহলে গিয়ে খবর দিতেই মশাল হাতে পুরনো দাসীদের সকলে ছুটে এসে ওডিসিয়াসকে জড়িয়ে ধরে স্নেহভরে চুম্বন করতে লাগল। তাদের প্রত্যেকে চিনতে পারল ওডিসিয়াস। তাদের আনন্দাবেগ দেখে তিনিও বিচলিত হয়ে উঠলেন। চোখে জল এল তাঁর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *