১৭. ওডিসিয়াসের নগরযাত্রা

সপ্তদশ পর্ব
ওডিসিয়াসের নগরযাত্রা

সকাল হতেই টেলিমেকাস কুটির ত্যাগ করে নগর মধ্যে যাবার জন্য পোশাক। পরিধান করে প্রস্তুত হয়ে ইউমেয়াসকে বলল, আমার মা আমাকে সশরীরে না দেখলে অশ্রু বিসর্জন বন্ধ করবেন না। তাই আমি প্রাসাদে যাচ্ছি। তুমি এই অতিথিকে পথটি দেখিয়ে দেবে। উনি উদার ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য চাইবেন। এখন আমি ওর জন্য কিছু করতে পারব না। তাতে উনি যদি কিছু মনে করেন তাহলেও কোন উপায় নেই।

ওডিসিয়াস তখন বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি তাতে কোন অস্বস্তি বা অসাচ্ছন্দ্য বোধ করব না। ভিক্ষুকদের পক্ষে শহরই সবচেয়ে বাঞ্ছনীয় স্থান। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। আমি একটু বেলা হলে তুষারপাত বন্ধ হলে যাব। আমার শীতের পোশাক নেই। আর শহরের পথটাও বেশ দীর্ঘ।

ওদিকে পাণিপ্রার্থীদের উপর প্রতিশোধবাসনা দ্রুত চরিতার্থ করার জন্য টেলিমেকাস প্রাসাদে গিয়ে দেখল ইউরিক্লীয়া বাইরের ঘরের চেয়ারগুলো আসন দিয়ে ঢেকে রাখছে। টেলিমেকাসকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ইউরিক্লীয়া ছুটে গিয়ে প্রাসাদের ভিতরে খবর দিতে প্রাসাদের সমস্ত দাসীরা ছুটে এল। তারপর রাণী পেনিলোপ এসে অপূর্ণ চোখে তার পুত্রের গলা জড়িয়ে ধরে তার গালে চুম্বন করলেন। আর্তেমিস বা অ্যাফ্রোদিতের মত স্বর্ণপ্রতিমাসম রূপ নিয়ে পেনিলোপ বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে কিছু না বলে তুমি তোমার পিতার অনুসন্ধান করতে গেলে আমি ভেবেছিলাম তোমাকে আর কোনদিন দেখতে পাব না।

টেলিমেকাস বলল, হে মাতঃ, যখন এতবড় একটা বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি তখন আর আমাকে আবেগের দ্বারা বিচলিত করে তুলো না। আমি এখন বরং তোমার ঘরে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে দেবতাদের নিকট প্রার্থনা কর। আমি পীয়েরীয়াসের কাছে আমার এক অতিথিকে রেখে এসেছি। তাকে আনার জন্য আমি যাচ্ছি।

অন্তরের মধ্যে তীব্র হিংসার বিষ পোষণ করে রেখে টেলিমেকাসকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে লাগল পাণিপ্রার্থীরা। মুখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করল তারা। দেবী এথেনের কৃপায় টেলিমেকাসের চেহারাটি এমনই মনোহর হয়ে উঠেছিল যে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে কেউ পারছিল না। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে টেলিমেকাস যখন বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল তখন মেন্টর, অ্যান্টিফাস, অ্যান্টিয়াস, হ্যাঁলিসার্থেস প্রমুখ টেলিমেকাসের বন্ধুভাবাপন্ন লোকেরা তাকে নানারকম প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল তার সঙ্গে। এমন সময় পীয়েরীয়াস টেলিমেকাসের অতিথি থিওক্লাইমেনাসকে সঙ্গে করে সামনে এসে দেখা করল টেলিমেকাসের সঙ্গে। তারাও প্রাসাদের দিকেই আসছিল। পীয়েরীয়াস টেলিমেকাসকে বলল, আমার কাছে মেনেলাসের দেওয়া আপনার যেসব মূল্যবান বস্তু আছে তা আপনি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন।

টেলিমেকাস বলল, বুঝতে পারছি না ঘটনার গতি কোনদিকে যাবে, পাণিপ্রার্থীরা যদি আমাকে প্রাসাদ মধ্যে হত্যা করে তাহলে ওসব বস্তু তোমার কাছেই থাকবে। তুমিই ভোগ করবে। আর যদি তাদের কোনরকমে মৃত্যুপুরীতে পাঠাতে অথবা বিতাড়িত করতে পারি প্রাসাদ থেকে তাহলে ওসব আমি নিয়ে যাব তোমার কাছ থেকে।

এই কথা বলার পর অতিথি থিওক্লাইমেনাসকে সঙ্গে করে প্রাসাদে নিয়ে গেল টেলিমেকাস। প্রাসাদের দাসীরা অতিথিকে স্নান করিয়ে পোশাক পরিয়ে পান ও আহাৰ্যবস্তুর দ্বারা তৃপ্ত করলে পর পেনিলোপ টেলিমেকাসকে বললেন, তোমার পিতার কি সংবাদ পেলে বললে না তো আমায়।

টেলিমেকাস বলল, আমি অবশ্যই তা তোমায় বলব মা। আমি প্রথমে পাইলসে রাজা নেস্টরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে পুত্রস্নেহে সমাদর করেন এবং আমার মুখ থেকে সবকথা শুনে মেনেলাসের কাছে রথে করে পাঠিয়ে দেন। মেনেলাসের কাছে গিয়ে আমি অনিন্দ্যসুন্দরী রাণী হেলেনকে দর্শন করি, যার জন্য ট্রয় ও গ্রীকজাতির লোকেরা এক সর্বধ্বংসী যুদ্ধে মত্ত হয়ে ওঠে। সেখানে মেনেলাস বললেন তিনি সমুদ্রের এক সুপ্রাচীন দেবতার কাছ থেকে শুনেছেন আমার পিতা ওডিসিয়াস নাকি কোন এক দ্বীপে জলদেবী ক্যালিপসোর হাতে বন্দী আছেন, কোন নাবিক ও জাহাজ না পেয়ে আসতে পারছেন না।

একথা শুনে বিশেষভাবে বিচলিত হয়ে পড়লেন রাণী পেনিলোপ। থিওক্লাইমেনাস তখন বললেন, শুনুন রাণীমা, আমি জিয়াস ও অন্যান্য দেবতাদের নামে শপথ করে বলছি, রাজা ওডিসিয়াস এই মুহূর্তে এই নগরমধ্যেই কোথাও না কোথাও অবস্থান করছেন এবং তিনি এইসব পাণিপ্রাথীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করার পরিকল্পনা করছেন। জাহাজে আমরা যে সুলক্ষণ দেখতে পাই তা টেলিমেকাসকে আগেই বলেছি।

পেনিলোপ বললেন, আপনার কথা যদি সত্য হয় তাহলে দেখবেন আপনাকে এমন সব উপহারদানে ভূষিত করব যা দেখে ঈর্ষান্বিত হবে লোকে আপনার ভাগ্যে।

অন্যদিনকার মত পাণিপ্রার্থীরা যথন প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বর্শাক্ষেপণ প্রভৃতি অস্ত্রক্রীড়ায় মত্ত ছিল। সীডন গিয়ে তাদের ডাকতেই তারা সবাই প্রাসাদমধ্যে চলে এসে শূকর কেটে ভোজসভায় আয়োজন করতে লাগল।

ওডিসিয়াস তখন ইউমেয়াসের কুটির মধ্যে নগরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইউমেয়াস প্রথমে বলল, আমার ইচ্ছা ছিল আমি তোমাকে এখানে রেখে কৃষিকার্য দেখাশোনা করি। কিন্তু তাহলে আমার মনিব আমাকে তিরস্কার করবেন। তাই চল। তোমাকে শহরের পথ দেখিয়ে দিয়ে আসি। এখন দিন শেষ হয়ে আসছে এবং শীঘ্রই ঠাণ্ডা পড়বে।

ওডিসিয়াস বললেন, আমাকে একটি লাঠি দাও। তোমরা বলছিলে পথটা নাকি খারাপ। আমাকে কিন্তু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা পথটা দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

কুকুর আর তার লোকজনদের হাতে তার খামারবাড়ির ভার দিয়ে ওডিসিয়াসকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল ইউমেয়াস। ছিন্ন মলিন পোশাকপরিহিত ওডিসিয়াসকে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল।

পার্বত্য পথটা পার হয়ে ওরা ঝোঁপজঙ্গলে ঘেরা একটা ঝর্ণা দেখতে পেল। সেইখানে মেলানথিয়াস নামে একটা লোকের সঙ্গে দেখা হলো। মেলানথিয়াস পাণিপ্রার্থীদের জন্য গোটাকতক ছাগল নিয়ে যাচ্ছিল দুজন রাখালের সাহায্যে। ছদ্মবেশী ওডিসিয়াসকে দেখে মেলানথিয়ান বিদ্রূপ ও গালাগালি করতে লাগল। সে ইউমেয়াসকে লক্ষ্য করে বলল, এই নোংরা ভিখারিটাকে তুমি রাজপ্রাসাদের ভোজসভায় নিয়ে যাচ্ছ? সব আনন্দ মাটি করে দেবে লোকটা। লোকটা বড় কুঁড়ে, ভিক্ষে করে ওর মোটা পেটটা ভরাবে, তবু কাজ করবে না। আমার হাতে ছেড়ে দাও ওকে। আমি ওকে নিয়ে খামারের কাজ করাব। রাজপ্রাসাদে গেলে ওর মাথায় জুতোবৃষ্টি হবে আর ওর পাজরা ভেঙ্গে যাবে।

এই বলে ওডিসিয়াসর পাছায় একটি লাথি মেরে চলে গেল মেলানথিয়াস। ওডিসিয়াসের ইচ্ছা হচ্ছিল উনি তাকে লাঠি দিয়ে তার মাথাটা গুঁড়িয়ে দেন। কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন। ইউমেয়াস জিয়াসকন্যা জলদেবীদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে বলল, ওডিসিয়াস যদি আপনাদের কখনো কিছু উৎসর্গ করে থাকেন তাহলে যেন এর শাস্তি মেলোনথিয়াস আমাদের হাতে একদিন পায়।

মেলানথিয়াস যেতে যেতে বলল, ওডিসিয়াস আর আসবে না। টেলিমেকাসকে হয় অ্যাপোলোর তীরে অথবা পাণিপ্রার্থীদের হাতে মরতেই হবে। আমি তখন এই লোকটাকে জাহাজে করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেব।

এই বলে পা চালিয়ে প্রাসাদে চলে গেল মেলানথিয়াস। সেখানে পাণিপ্রার্থীদের সঙ্গে মিলিত হলো।

এদিকে শূকরপালক ইউমেয়াসের সঙ্গে প্রাসাদদ্বারে উপনীত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য থামলেন ওডিসিয়াস। তিনি বললেন, ইউমেয়াস, এটা নিশ্চয়ই ওডিসিয়াসের প্রাসাদ। কত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা, গবাক্ষপথসমন্বিত সুরক্ষিত দুর্গপ্রাকার। ভিতরে নিশ্চয় ভোজসভা চলছে। কে যেন মধুর স্বরে গান গাইছে।

ইউমেয়াস বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। এখন কি করবে বল। তুমি কি নিজেই ভিতরে যাবে ওদের কাছে না তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমি গিয়ে খবর দেব? কি করবে ঠিক করো।

ওডিসিয়াস বললেন, বুঝতে পেরেছি। প্রথমে তুমি ভিতরে যাও। জলপথে ও স্থলপথে দীর্ঘদিন পরিভ্রমণ করে দেহ আমার খুব শক্ত হয়ে উঠেছে, ফলে আমি ওদের সম্ভাব্য যেকোন অপমান ও অত্যাচার সহ্য করতে পারব। আসল কথা মানুষের সব দুঃখ ও অন্যায়ের কারণ এই অভিশপ্ত পেট। এই পেটের সমস্যার জন্য সবকিছু অপমান ও বিপদের ঝুঁকি নিতে হয় মানুষকে, এমন কি দূর অজানা সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে দিতে হয়।

প্রবেশদ্বারের কাছে প্রাঙ্গণের একপাশে অনেক গোময়ের স্তূপ জমা ছিল। জমিতে সার হিসেবে সেগুলো তখনো ফেলে দেওয়া হয় নি, সেই গোবরের স্কুপের উপর একটি বৃদ্ধ শিকারী কুকুর শুয়ে ছিল। সে ওডিসিয়াসকে দেখে চিনতে পেরে লেজ নাড়তে লাগল। কুকুরটির নাম আর্গস। ওডিসিয়াস নিজের হাতে একদিন তাকে শিকারের কাজ শেখান। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর কেউ তার দিকে নজর দেয় নি। ওডিসিয়াস ইউমেয়াসকে বললেন, দেখ এই সুন্দর কুকুরটার কী অবস্থা হয়েছে।

ইউমেয়াস বলল, যার মনিব বিদেশে প্রাণ ত্যাগ করে সে কুকুরের এমনি দুর্দশাই হয়। দাসদাসীরা তাদের মনিবের অবর্তমানে ঠিকমত কাজ করে না। আমার মনে হয় দেবরাজ জিয়াস কোন মানুষ অন্য কোন মানুষের দাসরূপে নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার থেকে ভাল গুণগুলোর অর্ধেক কেড়ে নেন।

এই বলে প্রাসাদের মধ্যে পাণিপ্রার্থীদের কাছে চলে গেল ইউমেয়াস। এদিকে উনিশ বছর পর তার প্রভুকে একবার চোখের দেখা দেখেই অপূর্ণ চোখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলে প্রভুভক্ত আর্গস।

সেই প্রশস্ত হলঘরে ইউমেয়াস ঢুকতেই একপাশে বসে থাকা টেলিমেকাস তাকে ডাকল। তার পিছু পিছু লাঠিহাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওডিসিয়াসও ঘরে ঢুকে একটা কাঠের তক্তায় বসলেন। ছিন্নভিন্ন পোশাকগুলো গায়ে ঝুলছিল তার। টেলিমেকাস তখন রুটির ঝুড়ি থেকে একটি গোটা রুটি আর কিছু মাংস নিয়ে ইউমেয়াসের হাতে দিয়ে বলল, এই নাও, আগন্তুককে এটা দাও। তারপর ওকে সকলের কাছে ভিক্ষে করতে বল। ভিক্ষুকের কখনো লজ্জা করলে চলবে না।

ইউমেয়াস ওডিসিয়াসকে রুটি ও মাংস দিয়ে টেলিমেকাসের কথাটি জানাতে ওডিসিয়াস তা খেতে লাগলেন। যতক্ষণ চারণকবির গানটি গীত হচ্ছিল ততক্ষণ ধরে একমনে তা খেলেন ওডিসিয়াস। তারপর তিনি প্রত্যেকের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে লাগলেন। দেবী এথেন তাঁকে এই নির্দেশই দান করেছিলেন। এতে তিনি কে কেমন তা জানার সুযোগ পাবেন। ওডিসিয়াসের ভিক্ষুকবেশী অদ্ভুত চেহারার পানে তাকিয়ে সকলেই বলাবলি করতে লাগল, কে এই ভিক্ষুক। মেলানথিয়াস যখন বলল, আমি প্রাসাদে আসার সময় দেখেছি ইউমেয়াস এই লোকটিকে পথ দেখিয়ে আনছিল।

অ্যান্টিনোয়াস তখন ইউমেয়াসকে বলল, যারা তোমার প্রভুর অন্ন ধ্বংস করছে রোজ, তুমি কি তাদের সংখ্যায় সন্তুষ্ট নও? তাই যত সব ভিখারিকে ধরে আনছ?

ইউমেয়াস বলল, অ্যান্টিনোয়াস, তুমি অভিজাতবংশীয়, কিন্তু তোমার কথার মধ্যে উদারতা বলে কোন জিনিস নেই। কোন মানুষই কখনো অতিথিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় না। আসল কথা, তোমাদের মত যতসব পাণিপ্রার্থীরা রাজা ওডিসিয়াসের ভৃত্যদের বিশেষ করে আমাকে দেখতে পারে না। তবে যতদিন আমার রাণীমা আর কুমার টেলিমেকাস জীবিত আছেন ততদিন আমিও তোমাদের গ্রাহ্য করি না।

টেলিমেকাস বলল, ঠিক আছে চুপ করো। অ্যান্টিনোয়াস সবসময় মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বললো।

এবার অ্যান্টিনোয়াসের দিকে মুখ ঘুরিয়ে টেলিমেকাস বলল, তুমি আমার স্বার্থরক্ষার জন্য যেকথা বলেছ তার জন্য তোমায় ধন্যবাদ। তবে ভিখারিকে কিছু দাও।

অ্যান্টিনোয়াস ছাড়া আর সকলেই কিছু কিছু খাদ্য দান করল ওডিসিয়াসকে। রুটি ও মাংসে তার কম্বলের আঁচলটি ভরে গেল। কিন্তু যেখানে প্রথমে বসেছিলেন তিনি সেখানে ফিরে যাবার আগে অ্যান্টিনোয়াসের কাছে গিয়ে তিনি বললেন আপনার ভিক্ষা মহাশয়, আপনাকে দেখে তো রাজার মতই মনে হচ্ছে এবং সবার থেকে বেশি আপনারই দেওয়া উচিত। আমিও একদিন ধনীর ঘরেরই সন্তান ছিলাম। আমার ছিল অনেক দাসদাসী। আমার মত ভবঘুরেদের একদিন আমিও অনেক দান করেছি। কিন্তু জিয়াসের অভিশাপে আমি একবার মিশর দেশে গিয়ে সবকিছু হারাই। মিশরের রাজা আমার লোকজনদের সব হত্যা করে আমাকে সাইপ্রাসে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকেই এখানে এসেছি।

অ্যান্টিনোয়াস বলল, হা ভগবান! আমাদের ভোজসভার আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল। খবরদার বলছি, আর একটি কথাও বলবে না। তুমি আমার টেবিলের সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। যারা তোমাকে ভিক্ষা দিয়েছে তারা সবাই পরের ধনে উদারতা দেখিয়েছে।

ওডিসিয়াস কিছুটা সরে গিয়ে বললেন, আমি আপনার চেহারা দেখে আপনাকে ভাল ভেবে ভুল করেছিলাম। যেখানে আপনি পরের খাদ্য খাচ্ছেন সেখানে তার থেকে এককণা দান করতে পারছেন না।

অ্যান্টিনোয়াস তখন গিয়ে তার পাদানি টুলটা রেগে টেবিলের তলা থেকে বের করে ছুঁড়ে দিল ওডিসিয়াসের বুকের উপর। কিন্তু সেটি তার ঘাড়ে লাগলেও তিনি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তখন ধীর পদক্ষেপে সেই কাঠের তক্তাটার কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের রাণীর নিকট প্রেমনিবেদনকারী মহাশয়গণ, শুনুন আমার কথা। মানুষ যখন তার সম্পত্তির অধিকার নিয়ে ঝগড়া করে তখন দু-একটা এমন আঘাত আশ্চর্যজনক কিছু না। কিন্তু আমি শুধু আমার উদরপূর্তির জন্য অ্যান্টিবোয়াসের কাছ থেকে এই আঘাত লাভ করেছি। যদি স্বর্গে দেবতা বলে কেউ থাকেন তাহলে অ্যান্টিবোয়াস যেন তার বিবাহের আগের দিন মারা যায়। অ্যান্টিনোয়াসের ব্যবহারে অন্যান্য পাণিপ্রার্থীরা রেগে গেল। বলল, অনেক সময় ভিক্ষুকের বেশ ধরে স্বর্গের দেবতারা ছলনা করে আসেন মানুষের কাছে। তা যদি হয় তাহলে অ্যান্টিনোয়াস এই ভবঘুরেকে আঘাত করে অন্যায় করেছে।

অ্যান্টিনোয়াস কিন্তু কর্ণপাত করল না কারো কথায়। ওডিসিয়াসের উপর এই আঘাত আপন দেহে অনুভব করল টেলিমেকাস। কোনরকমে সে সংযত করল নিজেকে। অ্যান্টিনোয়াস একজন ভিক্ষুককে তাঁর প্রাসাদে বসে আঘাত করেছে একথা শুনে রাণী পেনিলোপও অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, আমি ওদের সকলকেই ঘৃণা করি, কিন্তু অ্যান্টিনোয়াস হলো ওদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য শয়তান। একজন দরিদ্র নিরীহ ভিখারী ওদের কাছে কিছু ভিক্ষা চাইতে সকলেই কিছু কিছু দিল আর ও একটা কাঠের টুল ছুঁড়ে মারল।

ওডিসিয়াস তখন তার ভিক্ষালব্ধ খাদ্যবস্তু নিয়ে নৈশভোজন করছিলেন। এমন সময় পেনিলোপ ইউমেয়াসকে ডেকে পাঠালেন। শূকরপালক ইউমেয়াসকে দেখে পেনিলোপ বললেন, এখনি গিয়ে তুমি সেই বিদেশী ভবঘুরেকে নিয়ে এস আমার কাছে। আমি তার সব কথা শুনব। আমার স্বামী সম্বন্ধে তিনি কোন কথা জানেন কি না তাও শুনব।

ইউমেয়াস বলল, কি বলব রাণীমা, লোকটি আমার কাছেই প্রথমে এসে ওঠেন। ইউমেয়াস বলল, হে আমার রাণীমা, ওরা যদি আপত্তি না করে তাহলে লোকটির গল্প বলার ক্ষমতায় আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। আমার কাছেই যদি প্রথমে এসে ওঠেন এবং তিন রাত্রি আমার কুটিরে থেকে চারণকবির মধুর কণ্ঠের যে গান মানুষের হৃদয় গলিয়ে দেয়, ওঁর মুখ থেকে বলা কাহিনী সে গানের মতই মধুর। সেই কাহিনী যে শুনবে সেই বিস্মিত হবে, মুগ্ধ হবে। উনি বলেন ওডিসি ওঁর পরিবারের সঙ্গে পরিচিত এবং উনি ক্রীট দেশের অধিবাসী। তারপর উনি ক্রীট দেশ থেকে যাত্রা শুরু করে বহু দেশ ঘুরে বহু সকরুণ অভিজ্ঞতা লাভ করে আমার কুটিরে এসে ওঠেন। উনি আরও বলেন ওডিসিয়াস এখন থ্রেসপ্রোশিয়ায় আছেন এবং শীঘ্রই বহু ধনরত্ন নিয়ে এসে হাজির হবেন।

রাণী পেনিলোপ বললেন, ওঁকে এখনি এখানে ডেকে আন। আমি ওঁর মুখ থেকে সব কথা শুনব। ওরা যা খুশি করুক। নিজেদের ঘরের খাদ্যবস্তু ওরা খরচ না করে দিনের পর দিন ওরা অপরের অন্ন ধ্বংস করে চলেছে। একমাত্র ওডিসিয়াসই ফিরে এসে তাঁর পুত্রের সাহায্যে ওদের এই বেয়াদবির অবসান ঘটাতে পারেন।

পেনিলোপর কথা শেষ হতেই টেলিমেকাস খুব জোরে হেঁচে উঠল। পেনিলোপ হেসে ইউমেয়াসকে বললেন, যাও বিদেশী অতিথিকে ডেকে নিয়ে এস। আমার পুত্র আমার কথাকে হেঁচে সমর্থন জানাল। এর অর্থ হলো, একজন পাণিপ্রার্থীও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবে না, তাদের প্রত্যেকেকেই মরতে হবে। আর যদি আমি তার কাহিনী শুনে প্রীত হই তাহলে আমি তাকে নতুন পোশাকে সাজিয়ে দেব।

ইউমেয়াস সোজা অতিথিবেশী ওডিসিয়াসর কাছে গিয়ে বলল, বন্ধু টেলিমেকাসের বুদ্ধিমতী মাতা পেনিলোপ তোমাকে ডাকছেন। যদি তার কাছে তোমার বলা কাহিনী সত্য বলে বোধ হয় তাহলে উনি তোমাকে ভাল পোশাক ও দেহবন্ধনীতে সাজিয়ে দেবেন। তাহলে তুমি সহজে শহরে গিয়ে ভিক্ষা করতে পারবে এবং দয়ালু লোকেরা তোমাকে ভিক্ষা দেবে।

ওডিসিয়াস বললেন, ইউমেয়াস, আমি আইকারিয়াসকন্যা বুদ্ধিমতী পেনিলোপকে যা জানি তা সানন্দে বলব। আমি নিজে ওডিসিয়াসের সঙ্গে একযোগে বহু দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছি, তাই তাঁর সম্বন্ধে অনেককিছু জানি। কিন্তু যে অসৎ ও অদ্র কুকুরগুলো প্রাসাদে রয়েছে তাদের হিংস্র ও দুর্বিনীত স্বভাব দেখে ভয় পাচ্ছি। প্রাসাদের মধ্যে যখন সেই লোকটা আমায় বিনা দোষে আঘাত করল তখন টেলিমেকাস বা অন্য কেউ আমাকে রক্ষা করার জন্য সামান্য অঙ্গুলি সঞ্চালনও করল না। সুতরাং পেনিলোপকে গিয়ে বল তিনি যেন সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তখন তিনি তাঁর ঘরে আমার সামনে বসে সব কথা শুনতে পারবেন।

ইউমেয়াস রাণী পেনিলোপের কাছে ফিরে যেতেই পেনিলোপ আগ্রহ সহকারে বললেন, কই তাঁকে আনলে না?

ইউমেয়াস তখন তাঁকে সব কথা বলা বলতে পেনিলোপ বললেন, এই বিদেশী তাহলে নির্বোধ নন। তাঁর দূরদর্শিতা আছে এবং কিভাবে একদল দুর্বত্তের দ্বারা আমি পরিবৃত হয়ে আছি তা উনি বুঝতে পেরেছেন।

শূকরপালক ইউমেকাস টেলিমেকাসের কাছে গিয়ে কানে কানে বলল, আমি আমার শূকরদের দেখাশোনা করার জন্য চলে যাচ্ছি। ওরা তোক ভাল নয়, আপনি খুব সাবধানে থাকবেন। নিজের নিরাপত্তার প্রতিযত্ন নেবেন।

টেলিমেকাস বলল, ঠিক আছে, নৈশভোজন এখানে সেরে তুমি চলে যাও কাকা। কাল সকালে মাংসের জন্য কিছু ভাল দেখে পশু নিয়ে আসবে। আমার ভাগ্যে যা আছে আর দেবতারা যা করবেন তাই হবে।

নৈশভোজন শেষ করে নৃত্যগীতাদির আনন্দোল্লাসে ফেটে পড়া প্রাসাদস্থ ভোজসভাটিকে ত্যাগ করে গ্রামাঞ্চলে আপন কুটিরে চলে গেল ইউমেয়াস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *