১৬. পুত্রের সাথে ওডিসিয়াসের সাক্ষাৎ

ষোড়শ পর্ব
পুত্রের সাথে ওডিসিয়াসের সাক্ষাৎ

শূকরপালক ইউমেয়াসের কুটিরে যখন উপনীত হলো টেলিমেকাস তখন ওডিসিয়াস ও ইউমেয়াস প্রাতরাশের ব্যবস্থা করছিল। তার আগেই ইউমেয়াসের লোকেরা শূকরের পাল নিয়ে চরাতে গেছে মাঠে। কুটিরদ্বারে যে কুকুরগুলো সাধারণত যে কোন আগন্তুক দেখলেই রাগে চিৎকার করতে থাকে তারা কিন্তু টেলিমেকাসকে দেখে চিৎকার তো করলই না, বরং লেজ নাড়তে লাগল। ওডিসিয়াস বলল, ইউমেয়াস, কে এসেছে দেখ। নিশ্চয় সে তোমার বন্ধু হবে, কারণ কুকুরগুলো চুপ করে আছে।

ওডিসিয়াসের কথা শেষ না হতেই কুটিরদ্বারে টেলিমেকাস এসে উপস্থিত হলো। ইউমেয়াস তখন তার পাত্রে মদ ঢালছিল। টেলিমেকাসকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে পানপাত্রটি তার হাত থেকে পড়ে গেল। ছুটে গিয়ে টেলিমেকাসকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুম্বন করতে লাগল ইউমেয়াস। হারানো পুত্রকে ফিরে পেয়েছে যেন সে। আবেগের সঙ্গে ইউমেয়াস বলল, হে আমার চোখের মণি ফিরে এসেছ? তুমি পাইলসে যাওয়ার পর আমি ভাবছিলাম তোমাকে আর কখনও দেখতে পাব না। তোমাকে তো চোখে দেখতেই পাই না। তুমি সবসময় শহরে থাক।

টেলিমেকাস বলল, আমি শুধু তোমাকে দেখার জন্যেই এখানে এসেছি। আমি জানতে চাই আমার মা কি এখনো প্রাসাদেই আছেন না কি তিনি আবার কাউকে বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন?

ইউমেয়াস বলল, ধৈর্যে বুক বেঁধে তিনি এখনো প্রাসাদেই আছেন। তবে দিনরাত তিনি অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন তোমার জন্য।

টেলিমেকাসের হাত থেকে বর্শাটি নিয়ে ইউমেয়াস রাখতেই ঘরের ভিতরে চলে গেল টেলিমেকাস। টেলিমেকাস ঘরে ঢুকতে ভিক্ষুকবেশী ওডিসিয়াসকে শশব্যস্ত হয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই টেলিমেকাস বলল, আপনি বসুন, এটা আমাদের খামার বাড়ি। আমার বসার অনেক জায়গা আছে। আপনি ব্যস্ত হবেন না।

ওডিসিয়াস বসে পড়লেন। টেলিমেকাসকে বসতে দিয়ে তার খাবার ব্যবস্থা করল ইউমেয়াস। টেলিমেকাস পেট ভরে মাংস রুটি ও মদ খেয়ে তৃপ্ত হয়ে ইউমেয়াসকে বলল, এই অতিথি কোথা হতে এসেছেন?

ইউমেয়াস বলল, ইনি বলেছেন ইনি এসেছেন ক্রীট থেকে। ইনি ভবঘুরের মত পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তারপর আমার কুটিরে এসে একদিন ওঠেন। আমি ভেবেছি ওঁকে তোমার হাতে তুলে দেব। তুমি যাহোক একটা ব্যবস্থা করবে।

টেলিমেকাস বলল, এটা খুবই দুঃখের কথা ইউমেয়াস যে আমি এই অতিথিকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারছি না। প্রথমত আমি বয়সে তরুণ। আমার কেউ বিরোধিতা করলে তার সম্মুখীন হবার মত শক্তি আমার নেই। তার উপর আমার মা অস্থিরচিত্ত অবস্থায় আছেন এবং ঠিক করতে পারছেন না কি করবেন। তিনি পুনর্বার বিবাহ করবেন না তাঁর স্বামীর প্রাসাদেই রয়ে যাবেন সে বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন নি আজও। যাই হোক, এই অতিথিকে যখন তুমি আশ্রয় দিয়েছ তখন আমি ওঁকে উপযুক্ত পোশাক পাদুকা আর দ্বিমুখী এক তরবারি দান করব। তারপর তিনি যেখানে যেতে চান সেখানে যাবার ব্যবস্থা করে দেব। তবে যদি তুমি ওঁকে এখানে রাখ তাহলে আমি ওঁর খাবারের ব্যবস্থা করব। ওঁর ভার তোমাকে বহন করতে হবে না। তবে উনি যেন পাণিপ্রার্থীদের কাছে না যান, কারণ তারা কখন কার সঙ্গে পশুর মত ব্যবহার করবে তার কিছু ঠিক নেই। তারা ওঁকে অপমানসূচক কথা বললে আমি মনে বড় ব্যথা পাব। আর আমি একা কখনো তাদের সকলের সঙ্গে লড়াই করতে পারব না।

ওডিসিয়াস তখন বললেন, আশা করি আমি যদি আপনার ব্যক্তিগত কোন বিষয়ে আলোচনা করি তাহলে আপনাদের তাতে আপত্তি কিছু থাকবে না। আপনাদের মুখে সেই সব দুর্বিনীত পাণিপ্রার্থীদের কথা শুনে এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ সঞ্চারিত হয়েছে। আমার মনে। আচ্ছা, ইথাকার সব লোক কি আপনার শত্রুতে পরিণত হয়েছে? তা না হলে কেন আপনি তাদের অবিচার সহ্য করছেন? আপনার পাশে এই বিপদে দাঁড়াবার মত কি কেউ নেই? আমি যদি নিজে টেলিমেকাস অথবা ওডিসিয়াস হতাম তাহলে এই মুহূর্তে প্রাসাদে গিয়ে তাদের দিনের পর দিন এভাবে অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি করে যেতে না দিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করে দরকার হলে আমার বাড়িতে তাদেরই তরবারিতে প্রাণ দিতাম।

টেলিমেকাস বলল, ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে ইথাকার সব লোকই আমার শত্রু একথা বলতে পারি না। তবে দুলিসিয়াম, সেমি, জ্যাকাইনথাস প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের অধিপতিরা সকলেই আমার মার পাণিপ্রার্থী। আমার মা নিশ্চিত করে কিছু না বলার জন্য তারা আমার অন্ন ধ্বংস করে চলেছে। তারা হয়ত আমাকেও কোনদিন শেষ করে দেবে। যাই হোক এ ব্যাপারে নিষ্পত্তি নির্ভর করবে একমাত্র দেবতাদের উপর। এখন ইউমেয়াস, তুমি গিয়ে মাকে খবর দাও আমি এসেছি। কিন্তু একথা যেন আর কেউ জানতে না পারে।

ইউমেয়াস বলল, আচ্ছা বৃদ্ধ লার্তেসকে খবরটা দেব তো? তুমি পাইলস যাবার পর থেকে তিনি কিছুই খাচ্ছেন না।

টেলিমেকাস বলল, এখন তুমি আমার মাকে খবরটি দিয়েই চলে আসবে। বরং তার একজন দাসীকে নিয়ে খবরটা লার্তেসকে পাঠিয়ে দেবে।

সঙ্গে সঙ্গে শহরের পথে চলে গেল ইউমেয়াস। সে চলে যেতেই দেবী এথেন এক দীর্ঘকারা সুন্দরী নারীর দেহ ধারণ করে ইশারায় ওডিসিয়াসকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেলেন। এথেনকে কিন্তু একমাত্র ওডিসিয়াস ছাড়া আর কেউ দেখতে পেল না। কুটির প্রাঙ্গণে ওডিসিয়াসকে ডেকে নিয়ে দেবী এথেন বললেন, সে লার্তেসপুত্র, এবার টেলিমেকাসকে সব কথা খুলে বল যাতে তোমরা একযোগে সেইসব দুবৃত্ত পাণিপ্রার্থীদের সঙ্গে লড়াই করতে পার। আমি তোমাদের দীর্ঘদিন ছেড়ে থাকব না।

এই কথা বলে এথেন তাঁর স্বর্ণদণ্ডটি দিয়ে ওডিসিয়াসকে স্পর্শ করতেই ওডিসিয়াসের চেহারাটা পাল্টে গেল। উত্তম পোশাক ও দেহবন্ধনীতে ভূষিত হয়ে উঠলেন তিনি। যৌবনোচিত শক্তি ও গাত্রবর্ণ ফিরে এল তাঁর দেহে। এথেন সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেই ওডিসিয়াস কুটির মধ্যে ফিরে গেলেন। তার চেহারার এই আকস্মিক ও আশ্চর্য পরিবর্তন দেখে ভীত বিস্মিত হয়ে পড়ল টেলিমেকাস। বলল, হে অতিথি, আপনার চেহারা আমূল পাল্টে গেছে, মনে হচ্ছে আপনি স্বর্গবাসী কোন দেবতা। আমার উপর সদয় হোন। আমি আপনাকে উপযুক্ত অর্ঘ্যদানে তুষ্ট করব।

ওডিসিয়াস বলল, কেন আমাকে দেবতা ভাবছ? আমি দেবতা নই, আমি তোমার পিতা, যার জন্য তুমি লোকের হাতে এত দুঃখ, এত অত্যাচার সহ্য করেছ। এই কথা বলে পুত্রকে চুম্বন করলেন ওডিসিয়াস। তাঁর চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল। কিন্তু টেলিমেকাস বিশ্বাস করতে পারল না সেকথা। বলল, না আপনি আমার পিতা ওডিসিয়াস নন। আপনি শুধু আমার দুঃখে আরো তীব্র করার জন্য ছলনা করছেন আমার সঙ্গে। দেবতা ছাড়া কোন মানুষ কখনা এভাবে বাইরের কোন সাহায্য না পেয়ে বেশভূষা বা চেহারার পরিবর্তন করতে পারে না। একটু আগে আপনি ছিলেন ছিন্নমলিন পোশাকে আচ্ছাদিত এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক আর এখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোন দেবতা।

ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, টেলিমেকাস, হতবুদ্ধি হয়ো না। তোমার এমন করে বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই। উনিশ বছর পরে আমি ফিরে এসেছি। আমার চেহারা ও বেশভূষার মধ্যে যে আকস্মিক পরিবর্তন দেখতে তার জন্য দেবী এথেনই দায়ী। দেবতারা ইচ্ছামত যেকোন পরিবর্তন সাধন করতে পারেন।

এই কথা বলে বসে পড়লেন, ওডিসিয়াস। কিন্তু টেলিমেকাস তখন তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তাঁরা দুজনেই তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। দুর্বার অশ্রুধারা দুজনেরই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল সমানে। পরে টেলিমেকাস প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা পিতা, আপনি কিভাবে কাদের জাহাজে করে এলেন?

ওডিসিয়াস বললেন, তোমাকে সব কথা বলব বৎস। তুমি ফেসীয় নাবিকদের নাম শুনে থাকবে। তারা বড় অতিথিবৎসল আর নৌবিদ্যায় পারদর্শী। তারাই আমাকে ইথাকার উপকূলে নামিয়ে দিয়ে যায়। আমার সঙ্গে অনেক মূল্যবান উপহার আছে। সেগুলো দেবতাদের কৃপায় লুকিয়ে রাখা রয়েছে। এথেনের নির্দেশে আমি এখানে এসেছি শত্রুদের কিভাবে ধ্বংসসাধন করা যায় তার পরিকল্পনা করতে। তুমি পরিষ্কার করে বল আমাদের শত্রুদের মধ্যে কারা আছে আর তারা সংখ্যায় কত। তারপর স্থির করব আমরা দুজনে তাদের সঙ্গে পেরে উঠব না সাহায্য চাইব কারো কাছ থেকে।

টেলিমেকাস উত্তর করল, হে পিতা, যোদ্ধা হিসেবে আপনার শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার যশোগাথা অনেক শুনেছি। কিন্তু এবার আমাদের শত্রুরা সংখ্যায় এত বেশি যে আপনি একা পেরে উঠবেন না। দুলিসিয়াম পাঠিয়েছেন, বাহান্নজনক যুবক, সেমি থেকে এসেছে চব্বিশজন জ্যাকাইনথাস থেকে বাইশজন আর ইথাকার বারোজন যুবক আছে আমাদের প্রাসাদে। আজ আপনি যদি একা তাদের একদিনের অপরাধের প্রতিশোধ নিতে চান তাহলে আপনাকে হয়ত জীবন বলি দিতে হতে পারে। সুতরাং যদি মিত্রশক্তির কাছ থেকে সাহায্য পান তো চেষ্টা করুন।

ওডিসিয়াস বললেন, তা করব। তবে দেখ এথেন যদি জিয়াসের সঙ্গে আমাদের সহায় হন তাহলেও আমাদের অন্য সাহায্যের দরকার হবে কি না।

টেলিমেকাস বলল, আপনার সাহায্যাকারীরা সর্বশক্তিমান। তারা মেঘের রাজ্যে সকলের অলক্ষ্যে অগোচরে বসে থাকলেও সারা জগতের লোকদের তারাই শাসন করে থাকেন।

ওডিসিয়াস বললেন, যখন আমরা দুজন প্রাসাদে গিয়ে সেই দুবৃত্তদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হব তখন দেবতারাই সে যুদ্ধে আমাদের পরিচলনা করবেন। যাই হোক, সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে তুমি প্রাসাদে চলে যাবে। তারপর শূকরপালক আমাকে পথ দেখিয়ে শহরে নিয়ে যাবে। আমি যাব ভিক্ষুকের বেশে। আমাকে দেখে পাণিপ্রার্থীরা অপমান করলে তুমি চুপ করে তা সহ্য করবে। তুমি শুধু তার আগে আমাদের প্রাসাদের অস্ত্রাগার হতে অস্ত্রগুলো সব অন্য এক ঘরের কোণে সরিয়ে রাখবে। ওরা জিজ্ঞাসা করলে বলবে ঘরে আগুন লেগে যেতে পারে বলে অস্ত্রগুলোকে সরিয়ে রেখেছ। তারপর তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধের সময় আমার নির্দেশে কতকগুলো তরবারি, কতকগুলো বর্শা আর দুটি ঢাল নিয়ে আসবে। এথেন আর জিয়াস পাণিপ্রার্থীদের মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবেন।

আর একটা কথা, যদি তুমি আমার যথার্থ সন্তান হও, এবং এক রক্ত প্রবাহিত হয় আমাদের দেহে তাহলে আমি ফিরে এসেছি একথা কাউকে বলবে না–শূকরপালক, লার্তেস বা তোমার মাতা পেনিলোপ কাউকে না। ভৃত্যদের মধ্যে কারা আমাদের প্রতি অনুরক্ত তাও আমাদের দেখতে হবে।

টেলিমেকাস বলল, আপনি কালক্রমে আমার বুদ্ধির পরিচয় পাবেন পিতা। আমি কখনও হাল্কামাথা নির্বোধের মত কাজ করি না। আপনার দাসদাসীদের মধ্যে কারা আপনার প্রতি আজও অনুরক্ত আছে তা জানা অবশ্যই আপনার দরকার। কিন্তু সেটা পরে জানালেও চলবে। এখন পাণিপ্রার্থীরা প্রাসাদে বসে বসে দিনের পর দিন আমাদের ধনসম্পত্তি নষ্ট করে চলেছে। এখন তার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। খামারবাড়ি বা মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়িয়ে লাভ নেই।

ইতিমধ্যে টেলিমেকাসের নাবিকরা তার জাহাজটি বন্দরের ঘাটে ভিড়িয়ে তার মালপত্রগুলো পীয়েরীয়াসের বাড়িতে রেখে একজন দূতকে রাজপ্রাসাদে পাঠিয়ে খবর দিল, টেলিমেকাস জাহাজ থেকে নেমে গ্রাম্য খামারবাড়ি পরিদর্শন করতে গেছে। বলে পাঠাল রাণীর ভয়ের কোন কারণ নেই। নাবিকদের পাঠানো দূত এবং শূকর পালক ইউমেয়াস একই সঙ্গে রাজপ্রাসাদে পৌঁছাল। দূতটি প্রাসাদের দাসীদের কাছে সংবাদটি দিয়ে চলে গেল। কিন্তু ইউমেয়াস টেলিমেকাসের কথামত একমাত্র রাণী পেনিলাপকেই তাঁর পুত্রের প্রত্যাবর্তন সংবাদ দান করল।

সঙ্গে সঙ্গে পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে সংবাদটা ছড়িয়ে পড়ল। তারা সবাই প্রাসাদের নিচের তলায় হলঘর ছেড়ে প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে এক সভায় মিলিত হলো। ইউরিমেকাস তাদের বলল, টেলিমেকাস যখন এসে গেছে তখন একটি জাহাজ পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের যারা সেখানে গিয়ে টেলিমেকাসের প্রতীক্ষায় বসে আছে তাদের খবর দাও। তারা যেন এখনি ফিরে আসে।

ইউরিমেকাসের কথা শেষ না হতে অ্যাফিনোমান দেখল তাদের দলের লোকদের জাহাজটি ফিরে আসছে। সে তখন আনন্দে হাসতে হাসতে বলল, আর খবর পাঠাতে হবে না। আমাদের বন্ধুরা ফিরে আসছে। হয়ত তারা টেলিমেকাসের জাহাজটিকে ফিরে আসতে দেখেছে।

পাণিপ্রার্থীরা প্রথমে দলবদ্ধভাবে হয়ে বন্দরে গিয়ে তাদের জাহাজটিকে টেনে তুলে আনল। তারপর আবার ফিরে এল প্রাসাদে। ব্যর্থ আক্রমণকারীদলের পক্ষ থেকে অ্যান্টিনোয়াস প্রথমে বলল, নিশ্চয় কোন দেবতার দয়ায় ও বেঁচে গেছে। সারাদিন আমরা জাহাজে উঠে টেলিমেকাসের জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তাকে পেলেই শেষ করে দিতাম।

কিন্তু কোন দেবতার মধ্যস্থতায় সে ফিরে এলেও আমাদের শ্যেনদৃষ্টি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না টেলিমেকাস। এখানে তাকে যাতে আমরা হত্যা করতে পারি তার উপায় ঠিক করতে হবে আমাদের। সে যতদিন জীবিত থাকবে আমরা এ সমস্যার কোন সন্তোষজনক সমাধান করতে পারব না। টেলিমেকাস খুবই বুদ্ধিমান এবং আমাদের এই চক্রান্তের কথা ও শিঘ্রই প্রচার করবে বাইরে। বাইরের রাজ্যের জনসাধারণও আমাদের ভাল চোখে দেখে না। তারা আমাদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করার আগেই টেলিমেকাসকে শহরে অথবা গ্রামে অথবা পথে প্রান্তরে যেখানে পাওয়া যাবে ধরতে হবে। তাকে হত্যা করার পর তার সম্পত্তি আমরা সবাই ভাগ করে নেব নিজেদের মধ্যে আর তার মা যাকে বিয়ে করবে এই প্রাসাদটা সে পাবে। আর আমার প্রস্তাবে যদি সম্মত না হও তাহলে ব্যাপারটা রাণীর উপর ছেড়ে দাও। তিনি যাকে বিবাহ করতে রাজি হবেন সে তাঁকে নিয়ে যাবে তার বাড়িতে।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সবাই। তারপর দুলিসিয়াম হতে আগত রাজা বিয়াসের পুত্র বুদ্ধিমান অ্যাস্ফনোয়াস বলল, বন্ধুগণ, আমি কিন্তু রাজকুমার টেলিমেকাসের রক্তপাতের একান্ত বিরোধী। এ কাজ করার আগে আমাদের জানতে হবে এ ব্যাপারে দেবতাদের সমর্থন আছে কিনা। যদি জিয়াস প্রেরিত কোন দৈববাণী আমাদের এ কাজের পরিকল্পনা সমর্থন করে তাহলে আমি নিজে ঘাতক হব। কিন্তু তা যদি না করে তাহলে আমি তোমাদের এ কাজে বিরত থাকার অনুরোধ করব।

বিনা বিতর্কে সভা ভঙ্গ হল সেদিনকার মত। পাণিপ্রার্থীরা সকলে প্রাসাদের মধ্যে ফিরে গিয়ে আপন আপন ঘরে বসে ভাবতে লাগল। এমন সময় সহসা পেনিলোপ এক অদম্য ক্রোধাবেগের দ্বারা প্রণোদিত হয়ে পাণিপ্রার্থীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রহরী সীডনের মুখ থেকে তাঁর পুত্রহত্যার ষড়যন্ত্রের কথা শুনে তিনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। রাজ্ঞীসুলভ এই গাম্ভীর্য ও আত্মমর্যাদাবোধসহ মাথায় অবগুণ্ঠন টেনে সহচরীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে সেই সুপ্রশস্ত কক্ষে তাঁর পাণিপ্রার্থীদের সামনে একটি স্তম্ভের পাশে দাঁড়ালেন পেনিলোপ। তারপর অ্যান্টিবোয়াসকে সম্বোধন করে বললেন, ইথাকার লোকেরা তোমাকে বয়স অনুপাতে বেশি বিজ্ঞ ও বাগ্মী বলত। কিন্তু তাদের সে ধারণাকে তুমি মিথ্যা প্রমাণিত করেছ অ্যান্টিনোয়াস। আসলে তুমি একজন কপট দুবৃত্ত। পাগল কোথাকার, কোন সাহসে তুমি দেবরাজ জিয়াস সমর্থিত আমাদের দুই বংশের পুরুষানুক্রমিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করতে টেলিমেকাসকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে তোল? তুমি কি ভুলে গেছ তোমার পিতা যখন থ্রেসপ্রোশিয়া আক্রমণকালে তাফিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে যোগদান করার জন্য নিজের দেশের লোকদ্বারা আক্রান্ত হন তখন ওডিসিয়াসই নিরাপদ আশ্রয় দান করে রক্ষা করেন তাকে। আজ সেই ওডিসিয়াসেরই স্ত্রীর কাছে প্রেম নিবেদন করছ তোমরা আর তাঁর পুত্রহত্যার চক্রান্ত করছ। যাই হোক, আমি আদেশ করছি এই মুহূর্তে তোমরা প্রাসাদ থেকে দূরে সরে যাও।

ইউরিমেকাস তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হে আইকারিয়াসকন্যা পেনিলোপ, আপনি মিথ্যা ভয় মন থেকে অপসারিত করুন। আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিন আপনার পুত্র টেলিমেকাসের গায়ে যে হাত দেবে আমার বর্শার আঘাতে তার দেহ থেকে রক্তপাত ঘটবেই। ওডিসিয়াস আমাকেও একদিন আমার বাল্যাবস্থায় যথেষ্ট স্নেহ করেন এবং টেলিমেকাস আমার বন্ধুস্থানীয়।

এইভাবে অন্তরে হত্যার কঠিন ষড়যন্ত্রকে চেপে রেখে উপরে আশ্বাসবাক্য দান করে মাতাকে সান্ত্বনা দান করল ইউরিমেকাস। কিন্তু পেনিলোপ আর না দাঁড়িয়ে উপরতলায় নিজের ঘরে গিয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। এইভাবে অশ্রুবির্সজনরত অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন পেনিলোপ।

সেদিন সন্ধ্যায় শূকরপালক ইউমেয়াস তার কুটিরে ফিরে আসার আগেই দেবী এথেন এসে আবার ওডিসিয়াসের গায়ে তার স্বর্ণদণ্ডটি চুঁইয়ে তাকে পুনরায় ভিক্ষুকে পরিণত করলেন। কারণ ইউমেয়াস তাঁকে চিনতে পারলে পেনিলোপকে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেকথা জানিয়ে দেবে। ইউমেয়াসকে ফিরতে দেখে টেলিমেকাস বলল, এখন শহরের অবস্থা কি? মহাশয়রা ফিরে এসেছেন না সেইখানেই আমার অপেক্ষাতেই বসে আছেন?

ইউমেয়াস বলল, আমি তা খোঁজ করে দেখি নি। তবে হার্মিস পাহাড়ের উপর থেকে দেখলাম একটা জাহাজ বন্দরের দিকে এগিয়ে আসছে। মনে হয় তারাই আসছে। তবে সঠিক বলতে পারব না।

একথা শুনে টেলিমেকাস হাসিমুখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তার পিতার মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু ইউমেয়াস তা দেখতে পেল না। তারা তখন সকলে নৈশভোজন শেষ করে সেই কুটিরেই শুয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *