১৫. টেলিমেকাসের প্রত্যাবর্তন

পঞ্চদশ পর্ব
টেলিমেকাসের প্রত্যাবর্তন

ইতিমধ্যে প্যালাস এথেন ল্যাসিডীমন উপত্যাকায় অবস্থিত স্পার্টা রাজ্যে গিয়ে রাজা ওডিসিয়াসের পুত্রকে সতর্ক করে দিলেন এই বলে যে, তার গৃহে ফেরার সময় হয়েছে।

দেবী এথেন সেই রাত্রিতেই মেনেলাসের প্রাসাদে গিয়ে দেখলেন ঝুলবারান্দার উপরতলায় একটি ঘরে টেলিমেকাস ও নেস্টরপত্র পীজেসটোস গভীরভাবে নিদ্রাসুখ উপভোগ করছিল, কিন্তু তার পিতার জন্য এক গভীর উদ্বেগবশত মোটেই ঘুমোতে পারছিল না টেলিমেকাস। দেবী এথেন টেলিমেকাসের বিছানার কাছে গিয়ে বললেন, আর তোমার বিদেশে থাকা উচিত হবে না টেলিমেকাস। সেইসব দুবৃত্তরা তোমার সব সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলবে। যদি তুমি তোমার মাতাকে প্রাসাদে গিয়ে দেখতে চাও তাহলে অবিলম্বে সেখানে যাবার জন্য রাজা মেনেলাসের অনুমতি চাও। কারণ তোমার মাতার পিতা ও ভ্রাতা দুজনেই পাণিপ্রার্থীদের বিবাহ করার জন্য তোমার মাতার উপর চাপ দিচ্ছেন। তোমার অবর্তমানে তোমার মাতা তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর জন্য প্রাসাদ থেকে অনেক ধনরত্ন নিয়ে যেতে পারেন। নারীরা সাধারণত তাদের প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তার কথা বা তার সন্তানের কথা ভাবে না।

তোমার আর এক বিপদ হলো এই যে, পাণিপ্রার্থীরা তোমাকে হত্যা করার জন্য এক গোপন চক্রান্ত করে ইথাকা আর সামস দ্বীপের মাঝখানে এক প্রণালীতে লুকিয়ে বসে আছে। অবশ্য তারা তোমায় মারতে পারবে না, কারণ তার আগেই স্বাধিকারপ্রমত্ত সেই সব দুবৃত্তদের অনেকেরই প্রাণ যাবে। যাই হোক, সেদিকে তুমি না গিয়ে সারারাত ধরে সমুদ্রযাত্রা করবে। কিন্তু ইথাকায় পৌঁছে তুমি প্রথমে শহরে না গিয়ে তোমাদের বিশ্বস্ত শূকরপালকের কুটিরে রাত্রির মত বিশ্রাম করবে। বল তুমি পাইলস থেকে নিরাপদে ফিরে এসেছ।

টেলিমেকাসকে স্বপ্নের মধ্যে এই কথা বলে অলিম্পাসে চলে গেলেন দেবী এথেন। টেলিমেকাস পীজেসটোসাকে জাগিয়ে বললেন, রথ প্রস্তুত করো, আমরা এখনি রওনা হব।

পিজেস্ট্রেটাস বলল, গৃহস্বামী মেনেলাস অতিথিদের প্রতি যে সদ্ব্যবহার করেছেন সেকথা আমরা অতিথি হয়ে ভুলতে পারি না। সুতরাং তাকে না জানিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া এখন রাত্রিকাল।

ভোর হতেই মেনেলাস শয্যা হতে উঠে নিজেই তাদের কাছে এসে পড়লেন। তাঁকে দেখে টেলিমেকাস তাড়াতাড়ি রাজপুত্রের মত পোশাক পরিধান করে বলল, মহাশয় এবার আমি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে চাই।

মেনেলাস বললেন, তুমি যদি একান্তই যেতে চাও আমি তাহলে তোমাকে বাধা দেব না। কোন অতিথিকে যেমন জোর করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ি থেকে যেতে বলতে নেই তেমনি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে আটকে রাখতেও নেই। তবে তোমাকে কিছু উপহার দেবার মত আমাকে সময় দাও। আমার বাড়ির মেয়েরা তোমার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করবে। দীর্ঘ পথযাত্রার পূর্বে তোমাকে ভোজনে তৃপ্ত করা আমাদের উচিত। যদি তুমি হেলাস হয়ে যাও তাহলে আমাকে পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নিতে পার। আমরা যেখানে যার ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করব সেখানেই কিছু না কিছু উপহার পাব।

টেলিমেকাস ব্যস্ত হয়ে উত্তর করল, হে রাজন মেনেলাস, আমি অতি শীঘ্রই দেশে ফিরতে চাই। কারণ আমি আসার সময় আমার সম্পত্তি রক্ষার জন্য কোন রক্ষক নিযুক্ত করে আসি নি। আমরা পিতার অনুসন্ধান করতে এসে যাতে আমার ধনসম্পত্তি সব নষ্ট হয় না হয় তা আমার দেখা উচিত।

একথা শুনে মেনেলাস হেলেনকে ওঠালেন এবং তার ভৃত্য এতিওনিয়াসকে টেলিমেকাসের জন্য কিছু মাংস রান্না করে তার খাদ্য প্রস্তুত করতে বললেন। তারপর তিনি হেলেনকে সঙ্গে করে অন্তঃপুরে গিয়ে উপহার নিয়ে এলেন। মেনেলাস একটি রৌপ্যনির্মিত পানপাত্র আর হেলেন নিয়ে এলেন কারুকার্য খচিত এক মূল্যবান পোশাক। মেনেলাস এসে টেলিমেকাসকে বললেন, জিয়াসের কাছে প্রার্থনা করি তোমার যাত্রাপথ যেন শুভ হয়। রাজা সিডনের কাছ থেকে পাওয়া হিফাস্টাসনির্মিত এই রৌপ্য পানপাত্রটি তোমাকে দিলাম।

মেনেলাসের কথা শুনে তাঁর পুত্র মেগাপেনথেস পানপাত্রটি এনে টেলিমেকাসের সামনে রাখল। এরপর হেলেন বললেন, আমি তোমাকে আমার নিজের হাতে প্রস্তুত এই পোশাকটি দান করছি। এটি তোমার স্ত্রী পরিধান করবে। যতদিন তোমার বিবাহ না হয় ততদিন এ পোশাক তোমার মার কাছে থাকবে। পরিশেষে আমিও তোমার যাত্রা যাতে শুভ হয় তার জন্য প্রার্থনা করি দেবতাদের কাছে।

পীজেসটোস উপহারগুলো নিয়ে গিয়ে রথে চাপিয়ে রাখল। তারপর বিভিন্ন খাদ্য বস্তুসহকারে তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করল টেলিমেকাস। রাজা মেনেলাস, তাঁর পুত্র ও এতিওনিয়াস দেখাশোনা করত লাগল। টেলিমেকাস ও পীজেসটোস আহারকার্য সম্পন্ন করে রথে গিয়ে চাপতেই মেনেলাস একপাত্র মদ নিয়ে টেলিমেকাসের হাতে দিলেন। তাই দিয়ে রওনা হবার আগে দেবতাদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করল সে। যাত্রাকালে মেনেলাস তাদের বললেন, রাজা নেস্টরকে আমার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবে। ট্রয়যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন আমাদের পিতার মত।

টেলিমেকাস উত্তর করল, যদি আমি বাড়ি গিয়ে আমার পিতা ওডিসিয়াসকে দেখতে পাই তাহলে তাঁকেও বলব আপনার কাছে কত মধুর আতিথেয়তা ও মূল্যবান উপহার লাভ করেছি।

এমন সময় দেখা গেল টেলিমেকাসের মাথার উপর ডান দিক দিয়ে একটি ঈগল পাখি তার মুখে করে একটি রাজহাঁসকে নিয়ে যাচ্ছে। কতকগুলো লোক ঈগল পাখিটাকে তাড়া করতে থাকায় ঈগলটা রথের কাছে তার মুখের শিকারটা ফেলে দিল। তাই দেখে পীজেসস্ট্রেটাস বলল, হে রাজন, এই সুলক্ষণটি কি দেবতারা আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন, না আপনার জন্য?

মেনেলাস কিন্তু এর উত্তর দিতে পারলেন না। তাঁর সুন্দরী স্ত্রী হেলেন বললেন, শোন আমি ব্যাখ্যা করছি এই লক্ষণের। কোন পবর্তনিবাসী ঐ ঈগল পাখি যেমন বিদেশ থেকে এসে আমাদের এ দেশের গৃহপালিত একটি রাজহাঁসকে আক্রমণ করে তেমনি ওডিসিয়াসও বহু বিদেশ ঘুরে এসে তার ঘরে শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। তিনি হয়ত ইতিমধ্যেই এসে পড়েছেন তাঁর বাড়িতে।

টেলিমেকাস চিৎকার করে উঠল আনন্দে, বজ্ৰাধিপতি জিয়াসের কৃপায় আপনার কথা যেন সত্যে পরিণত হয়। তাহলে আমি দেশে ফিরে আমার প্রার্থনার দেবীর মত আপনার নাম করব।

এই বলে রথের অশ্বগুলোকে টেলিমেকাস চাবুক মারতেই তারা তীরবেগে ছুটতে লাগল। সারাদিন রথ চলার পর সূর্য অস্ত যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফেরায় উপনীত হয়ে ওর্সিলোকাসপুত্র ডাওকলস-এর বাড়িতে রাত্রির মত আতিথ্য গ্রহণ করল এবং যথাযোগ্য সমাদর লাভ করল। পরদিন তারা পাইলসে উপনীত হলো। এই সময় টেলিমেকাস একবার নেস্টরপুত্রকে বলল, পীজেসস্ট্রেটাস আমাদের পিতার পারস্পরিক বন্ধুত্ব আমাদের ঘনিষ্ঠ করে তুলেছে। তার উপর আমাদের এই একযোগে ভ্রমণ। আমাদের মধ্যে এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সেই বন্ধুত্বের খাতিরে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে আমার জন্য। তুমি যেন আমাকে আবার তোমাদের প্রাসাদে নিয়ে যেও না, আমাকে জাহাজের কাছে নামিয়ে দাও। তোমার পিতা তা না হলে তার অতিথিবাৎসল্যের বসে আমাকে আটকে রাখবেন তাঁর প্রাসাদে।

নেস্টরপুত্র অনেকক্ষণ ভাবার পর টেলিমেকাসকে তার জাহাজের কাছেই নামিয়ে দিল। তার সব মালপত্র জাহাজে নিজের হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে জাহাজে উঠে জাহাজ ছেড়ে দাও। আমি প্রাসাদে উপনীত হবার আগেই যেন তোমরা অনেক দূরে চলে যাও। তা না হলে তিনি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন।

পীজেসটোস চলে গেলে টেলিমেকাস আবার উঠে দেবী এথেনের প্রার্থনা করতে লাগলেন। এমন সময় একজন বিদেশী অতিথি তার সম্মানে তাকে অভিবাদন জানাল। এই লোকটি হলো মেলাম্পাসের বংশধর এবং একজন জ্যোতিষী। জনৈক জ্ঞাতি ভাইকে হত্যা করে সে তার দেশ আর্গস থেকে পালিয়ে এসেছে। বহুকাল আগে মেলাম্পাস পাইলসে বাস করতেন। কিন্তু নেলেউসকন্যার প্রেমে পড়ে তার পাণিপ্রার্থী হবার জন্য নেলেউস তার ভূসম্পত্তি সব বাজেয়াপ্ত করে নেন এব তাঁকে ফাইলেসাসের প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন। পর তিনি আর্গসে পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করেন এবং এ্যান্টিফেটস ও মেরিতাস নামে তার দুটি পুত্রসন্তান হয়। পলিফেদিস ও ক্রীটাস নামে মেরিতাসের দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ক্রীটাস দেখতে এত সুন্দর ছিল যে ঊষাদেবী স্বয়ং তাঁর প্রেমে পড়ে দেবলোকে তুলে নিয়ে যান। এ্যাপোলোর বরে পলিফেদিক জ্যোতিষবিদ্যায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। থিওক্লাইমেনাস নামে যে লোকটি টেলিমেকাসের কাছে এসে তাকে অভিনন্দন জানায় সে হলো পলিফেদিসের পুত্র।

থিওক্লাইমেনাস প্রার্থনার ভঙ্গিতে টেলিমেকাসের কাছে গিয়ে বলল, বন্ধু, আমি তোমার ও তোমার সহচরদের জীবনের বিনিময়ে জানতে চাইছি তুমি কে এবং কোথা হতে আসছ?

টেলিমেকাস উত্তর করল, আমার দেশ হচ্ছে ইথাকা। আমার পিতার নাম ওডিসিয়াস। মনে হয় তিনি কোন অজানিত স্থানে এক শোচনীয় পরিণত লাভ করেছেন। তাই আমি জাহাজ নিয়ে তাঁর অনুসন্ধান করতে এসেছি।

থিওক্লাইমেনাস বলল, তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। আমি আমার কোন এক স্বজাতিকে হত্যা করে আর্গস থেকে পালিয়ে আসি। সেই মৃত লোকটির আত্মীয় স্বজনরা আমার খোঁজ করছে এবং পেলে হত্যা করবে। তুমি আমাকে তোমার জাহাজে আশ্রয় দিয়ে তাদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।

বুদ্ধিমান টেলিমেকাস উত্তর করল, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। ইথাকায় তুমি গেলে আতিথেয়তার কোন অভাব হবে না।

থিওক্লাইমেনাসের হাত থেকে ব্রোঞ্জের বর্শাটি নিয়ে জাহাজের একটি জায়গায় নামিয়ে রেখে নিজের পাশে তাকে বসাল টেলিমেকাস। নাবিকরা জাহাজ ছেড়ে দিল। দেবী এথেন পাঠিয়ে দিলেন এক অনুকূল বাতাস। ক্রৌণি ও চ্যালমিল নদীর মোহনা পার হয়ে জাহাজ ছুটে চলল দূর সমুদ্রের পানে। ক্রমে স্কীয়া ও এলিস দ্বীপও পার হলো। তখন অন্ধকার ঘন হয়ে এল সুর্যাস্ত শেষে। এবার টেলিমেকাস এথেনের দ্বারা নির্দিষ্ট সেই সামস দ্বীপে অপেক্ষা করতে লাগল যেখানে তার শত্রুরা লুকিয়ে আছে তাকে হত্যা করার জন্য।

এদিকে ওডিসিয়াস সেই রাত্রিতে শূকরপালকের কুটিরে নৈশভোজনের পর বললেন, শোন ইউমেয়াস, আমি আর তোমাদের বোঝা হয়ে এখানে থাকব না। সকাল হলেই আমি শহরে যাব। তবে তোমরা পথটা আমায় দেখিয়ে দেবে। আমি ওডিসিয়াসের প্রাসাদে গিয়ে তার খবর যা জানি রাণী পেনিলোপক বলব। আমি পাণিপ্রার্থীদের কাছেও ভিক্ষে চাইব। তারা কোন কাজ দিলে আমি তা করব। যে দেবদূত হার্মিসের দয়ার উপর মানুষের সকল কর্মের স্বাচ্ছন্দ্য ও সাফল্য নির্ভর করে, সেই হার্মিসের দয়ায় আমি যে কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারব।

কিন্তু ইউমেয়াস রাগতভাবে বলল, কি কারণে এ চিন্তা তোমার মাথায় এল? যাদের হিংসাত্মক অসদাচরণ দেবতাদেরও ক্রুদ্ধ করে তুলেছে তাদের কাছে গেলে তুমি শুধু তোমার মৃত্যুকেই ডেকে আনবে। তাদের ভৃত্যরা তোমার মত নয়। তারা বয়সে যুবক আর তাদের চেহারাগুলো সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও চকচকে থাকে। আমি বা আমার লোকেরা কেউ তোমার বোঝা হিসেবে মনে করবে না। ওডিসিয়াসের পুত্র এসে তোমাকে উত্তম পোশাক দিয়ে তোমার গন্তব্যস্থলে পাঠিয়ে দেবেন।

ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, পরম পিতা জিয়াস তোমাকে দয়া করুন। একজন ভবঘুরে ভিখারীকে যতরকমের দুঃখ দুর্দশা আছে তার অবশ্যই সহ্য করতে হবে। তবে তুমি যখন এত করে বলছ আমি ওডিসিয়াসের পুত্রের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। কিন্তু দয়া করে ওডিসিয়াসের বৃদ্ধ পিতামাতার কথা আমাকে বল। তাঁরা কি এখনো জীবিত আছেন না মৃত্যুপুরীতে গমন করেছেন।

ইউমেয়াস বলল, আমি সানন্দে সেকথা বলব। বৃদ্ধ লার্তেস এখনো জীবিত আছেন। কিন্তু তিনি প্রতিদিন দেবরাজ জিয়াসের কাছে মৃত্যু কামনা করেন। তাঁর পুত্রকে হারিয়ে তিনি যে দুঃখ লাভ করেছেন সে দুঃখে কোন সান্ত্বনা কেউ তাকে দিতে পারে নি। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু সেই দুঃখকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। তাঁর স্ত্রীও পুত্রের মত স্নেহ করতেন। ছোটবেলায় তিনি আমাকে তাঁর পালিত কন্যা আমার সমবয়সী ক্রিমেনের সঙ্গে লালন পালন করেন। একসঙ্গে লেখাপড়া করি। ক্রিমেন বিবাহযোগ্য হলে তার বিবাহ দেন এবং আমাকে পাঠিয়ে দেন খামার বাড়িতে। কৃষিকার্য দেখাশোনার জন্য। আমি অবশ্য সুখেই আছি এখানে। তোমার দয়ায় কোন কষ্ট নেই। কিন্তু একটা দুঃখ, আমার বর্তমান মনিব রাণীমার সঙ্গে কোন কথাবার্তা বলার সুযোগ নেই।

ওডিসিয়াস বললেন, যখন তুমি তোমার বাবা মার কাছ থেকে এখানে আস তখন। তুমি খুব ছোট ছিলে। আচ্ছা, কিভাবে তুমি এখানে আস? তোমাকে কি দুস্যরা চুরি করে এনে এখানে ফেলে দেয়?

শূকরপালক ইউমেয়াস উত্তর করল, তাহলে এখানে বসে মদ্যপান করতে করতে সেকথা সব শোন। এই রাত্রি যেন শেষ না হয় আর তোমার শুতে যাবারও কোন প্রয়োজন নেই। এস আমরা দুজনে দুজনের মনের কথা, দুঃখের কথা সব বলাবলি করে সব দুঃখকে ভুলে যাই। দেখবে দীর্ঘ ভ্রমণের দুঃখময় অভিজ্ঞতার কথা পরে মনে করে মানুষ সত্যিই আনন্দ পায়।

এবার আমার ছেলেবেলার কথা শোন। ওলিজির ওপারে পিরি নামে এক দ্বীপের কথা শুনে থাকবে। পশুপালন ছাড়াও প্রচুর আঙ্গুর ও শস্য ফলে সে দেশে। দুর্ভিক্ষ দুঃখ বা কোন রোগ সেখানে নেই বললেই চলে। কোন রোগ কখনো আক্রমণ করতে পারে না সেদেশের লোককে। মানুষ যখন স্বাভাবিকভাবেই অতি বৃদ্ধ হয়ে পড়ে তখন একদিন অ্যাপোলো আর্তেমিসের সঙ্গে এসে তাকে শরবিদ্ধ করে মৃত্যুপুরীতে পাঠিয়ে দেন। আর্মেনাসপুত্র আমার পিতা ছিলেন সেই দেশের রাজা।

একবার আমাদের সেই দেশে একজন ফিনিশীয় নাবিক আসে। জনৈক ফিনিশীয় রমণী আমার পিতার কাছে কাজ করত। সে একদিন নদীর ঘাটে কাপড় ধুতে গেলে জনৈক ফিনিশীয় তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। মেয়েটি তখন বলে, ব্রোঞ্জের ব্যবসাকেন্দ্র সিকন আমার বাড়ি। আমার পিতার নাম এ্যামাইবাস। একজন জলদস্যু আমাকে ধরে এখানকার রাজবাড়িতে আমাকে মোটা টাকায় বিক্রয় করে।

তখন ফিনিশীয় নাবিকটি বলল, তুমি কি আমাদের সঙ্গে তোমার দেশে তোমার পিতার কাছে ফিরে যেতে চাও? তোমার পিতামাতা আজও বেঁচে আছে। মেয়েটি তখন বলে, যদি তোমরা আমাকে নিরাপদে সেখানে নিয়ে যাবার শপথ করো তাহলে অবশ্যই যাব।

ফিনিশীয় নাবিকটি তখন শপথ করে প্রতিশ্রুতি দিল তাকে। মেয়েটি তখন বলল, কিন্তু রওনা হবার আগে যেন কোন জায়গায় আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমার একথা কারো কাছে প্রকাশ করবে না। তোমাদের ব্যবসার কাজ হয়ে গেলে আমাকে গোপনে খবর পাঠাবে। আমি তাহলে যে শিশুটির ধাত্রীরূপে কাজ করি তাকে ও কিছু সোনা নিয়ে চলে আসব। তোমরা অন্য কোন বন্দরে সেই শিশুটিকে বিক্রি করে মোটা টাকা পাবে।

এই বলে রাজপ্রাসাদে তখনকার মত ফিরে গেল মেয়েটি।

প্রায় একটি বৎসর ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ করতে লাগল ফিনিশীয়দের। এক বছর পর সেই ফিনিশীয় নাবিকটি সোনার হার বিক্রি করার ছলনা করে আমাদের প্রাসাদে যায়। আমার মাতা ও তার দাসীরা যখন হার পছন্দ করছিল তখন সেই লোকটা সেই ফিনিশীয় রমণীকে ইশারা করে। তার ইশারার কথা বুঝতে পেরে সন্ধে হতেই আমার হাত ধরে কয়েকটি সোনার পানপাত্র নিয়ে পালিয়ে আসে প্রাসাদ হতে। সে আমাকে নিয়ে তাদের জাহাজে চাপতেই তারা জাহাজ ছেড়ে দিল। রাত্রির অন্ধকারেই জাহাজ ছুটে চলল দূর সমুদ্রের দিকে। বাতাস অনুকুলেই ছিল। ছয় দিন ছয় রাত্রি নির্বিঘ্নেই কাটাল। কিন্তু সাত দিনের দিন দেবী আর্তেমিসের এক তীরে প্রাণ হারাল আমার ধাত্রী। জাহাজের উপর থেকে তার মৃতদেহটি নাবিকেরা ফেলে দিল জলে। আমি অসহায় বোধ করতে লাগলাম আরও। পরে সেই ফিনিশীয় নাবিকরা ইথাকায় এসে রাজা লাৰ্তেসের কাছে আমাকে বিক্রি করে। এইভাবেই আমি এসে পড়ি এখানে।

রাজা ওডিসিয়াস বললেন, ইউমেয়াস তোমার দুর্ভাগ্যের সকরুণ কহিনী আমাকে সত্যিই বিচলিত করেছে। কিন্তু এ কথা তোমার স্বীকার করতেই হবে ঈশ্বর তোমায় যত দুর্ভাগ্যই দিন না কেন, তুমি একজন উদার ও সৎ মালিক লাভ করেছ। তোমার খাওয়া পরার দুঃখ নেই। আর আমি এখানে আসার আগে গোটা পৃথিবীর আধখানা কত কষ্ট করে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছি।

এইভাবে গল্প করার পর তারা যখন শুল বিছানায় তখন রাত্রি আর বেশি বাকি ছিল না। এদিকে সে রাত্রির সমুদ্রযাত্রা শেষ করে ভোর হতেই ইথাকার উপকূলে এসে উপনীত হলো টেলিমেকাস। টেলিমেকাস তার নাবিকদের বলল, জাহাজ ঘুরিয়ে নিয়ে যাও। আমি এখন আমাদের খামারবাড়িতে যাচ্ছি। সন্ধের সময় শহরে যাব। আগামীকাল সকালে তোমাদের সমুদ্রযাত্রার প্রাপ্য বেতন দেব।

থিওক্লাইমেনাস হল বলল, তাহলে আমার কি হবে বৎস? আমি তোমাদের প্রাসাদে গিয়ে উঠব না কি অন্য কোন সামন্তর ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেব?

টেলিমেকাস বলল, অন্য সময় হলে তোমাদের আমাদের প্রাসাদে নিয়ে যেতাম। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। এখন তুমি একজন উদারহৃদয় সামন্ত ইউরিমেকাসের বাড়িতে গিয়ে উঠতে পার। আমাদের সারা দেশের মধ্যে তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে ভাল লোক এবং তিনিও আমার মার অন্যতম পাণিপ্রার্থী।

টেলিমেকাসের কথা শেষ হতেই দেখা গেল ডান দিকে একটি শিকারী পাখি একটি কপোতকে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে থিওক্লাইমেনাস টেলিমেকাসকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, টেলিমেকাস, আমি নিজের চোখে দেখেছি এ পাখি হলো দেবতাদের পাঠিয়ে দেওয়া এক সুলক্ষণ। তোমার জয় অবশ্যম্ভাবী।

টেলমেকাস বলল, বন্ধু তোমার কথা যেন সত্যে পরিণত হয়। যদি তা হয় তাহলে দেখবে আমাদের এই বন্ধুত্বের দ্বারা কতদূর সৌভাগ্য লাভ করতে তুমি পার।

এরপর টেলিমেকাস তার একজন বিশ্বস্ত অনুচর পীয়েরীয়াসকে বলল, তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন। তুমি এই অতিথিদের ভার গ্রহণ করে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি এর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। পীয়েরীয়াস বলল, যতদিন খুশি উনি আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। সেখানে ওঁর আতিথেয়তার কোন ত্রুটি হবে না। এই বলে পীয়েরীয়াস জাহাজে গিয়ে চাপল। জাহাজটিকে বন্দরে নিয়ে গিয়ে নোঙর করার জন্য ছেড়ে দিল। আর টেলিমেকাস পাদুকা পরে বর্শা হাতে ইউমেয়াসের কুটিরের দিকে অগ্রসর হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *