১৪. ইউমেয়াসের কুটির

চতুর্দশ পর্ব
ইউমেয়াসের কুটির

ইতিমধ্যে সেই ফোরসি বন্দরকে পিছনে ফেলে পার্বত্য বনপথ দিয়ে সেই বিশ্বস্ত শূকরপালকের সন্ধানে এগিয়ে যেতে লাগলেন ওডিসিয়াস। তার কুটিরের সামনে গিয়ে ওডিসিয়াস দেখলেন শূকরপালক তার কুটিরের অঙ্গনে বসে একট চামড়া কেটে তার পায়ের চটি তৈরি করছে। উঠোনের চারদিকে পাথর, কাঠ প্রভৃতি দিয়ে এক দুর্ভেদ্য বেড়া দেওয়া হয়েছে শূকরগুলোকে রক্ষা করার জন্য। পেনিলোপের পাণিপ্রার্থীরা তাদের ভোজসভার জন্য অনেক মোটা মোটা শূকর ধ্বংস করলেও এখনো তিনশত ষাটটি শূকর জীবিত আছে।

কুটিরের সামনে ওডিসিয়াস এগিয়ে যেতেই প্রহরারত কুকুরগুলো ছুটে গেল। ওডিসিয়াস বসে পড়ে হাতের লাঠিটি ফেলে দিলেও শূকরপালক বেরিয়ে এসে কুকুরদের তাড়িয়ে না দিলে তারা তাকে জীবন্ত কামড়ে খেত।

শূকরপালক বেরিয়ে এসে বলল, হে বৃদ্ধ অতিথি, খুব বেঁচে গেলে। দেখ আমার অবস্থা। যার শূকর আমি পালন করছি আমার সেই মনিব বিদেশে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তার শূকর যত সব পর লোকে খাচ্ছে। এখন এস, আমার সঙ্গে কিছু খাবে এস। কিছু মদ আর রুটি দেব। তাই খেয়ে বলবে কোথা থেকে আসছ তুমি আর তোমার দুঃখই বা কি।

শূকরপালক ইউরেমাস ওডিসিয়াসকে পথ দেখিয়ে কুটিরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর ছাগলের চামড়া দিয়ে এক আসন তৈরি করে বসতে দিল। খুশি হয়ে ওডিসিয়াস বললেন, আমার প্রতি এই যে সদয় ব্যবহার করলে, আদর অভ্যর্থনা জানালে তার জন্য জিয়াস ও অন্যান্য দেবতারা অবশ্যই তোমায় পুরস্কৃত করবেন।

ইউমেয়াস বলল, আমার বিবেক এই কথাই বলে যে, কোন অতিথি বা ভিক্ষুক যত খারাপ অবস্থাতেই আসুক না কেন, আমি যেন তাকে তাড়িয়ে না দিই। জিয়াসের নামে যেকোন অতিথি বা ভিক্ষুক আসে তাকে সমাদর জানাতে হয়, কিন্তু আমাদের মত যারা দাসানুদাস তারা কিই বা দিতে পারে। আমার প্রভু এখনও বাড়ি ফেরেন নি। তিনি থাকলে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে দীর্ঘকাল তাঁর কাজ করার জন্য আমার বৃত্তির ব্যবস্থা করতেন এবং প্রচলিত রীতি অনুসারে এক সুন্দরী রমণীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি আর বেঁচে নেই। আমার মনিব রাজা অ্যাগামেমননের হয়ে ইলিয়াম নগরীতে ট্রয়বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন।

ইউমেয়াস তার পোশাক থেকে কোমরবন্ধনীটি খুলে খোঁয়াড়ে গিয়ে দুটি শূকর শাবক এনে কেটে মাংস ছড়িয়ে সেই মাংস আগুনে পুড়িয়ে যবের দানা ছড়িয়ে ওডিসিয়াসকে খেতে দিল। তারপর অলিভ কাঠের এক পাত্রে করে মদ দিল। তারপর তাঁর সামনে বসে বলল, আমরা এছাড়া আর কি দিতে পারি বল। যত সব মোটা মোটা শূকরগুলো পাণিপ্রার্থীরা খাচ্ছে। তাদের কোন ধর্মভয় বা নীতিজ্ঞান নেই। কিন্তু দেবতারা এই অন্যায় কাজ কখনই ভালবাসেন না। জলদস্যুরাও অনেক ধনরত্ন লুণ্ঠন করে ঘরে ফেরার সময় বিবেকের দংশনজ্বালা অনুভব করে। কিন্তু আমার মনে হয় এই সব পাণীপ্রার্থীরা কোনভাবে শুনেছে আমার মনিব মারা গেছেন। তাই তারা তাঁর বিধবা স্ত্রীকে বিয়েও করছে না অথবা তার প্রাসাদ থেকে চলেও যাচ্ছে না। আমার মনিব ছিলেন খুব ধনী ব্যক্তি। গরু ভেড়া শূকর ছাগল গবাদি পশুর বারোটি পাল ছিল তাঁর।

ওডিসিয়াম নীরবে ইউমেয়াসের দেওয়া মাংস ও মদ পান করে সুস্থ হলেন। এইভাবে তার ক্ষুধাকে তৃপ্ত করে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বন্ধু, তোমার মনিব কে? কেই বা ট্রয়যুদ্ধে গিয়েছিলেন তার নাম আমায় বল।– ইউমেয়াস উত্তর করল, তোমার আগেও বহু অতিথি ও ভিক্ষুক এসে রাজা ওডিসিয়াসের সংবাদ দানের ভান করেছিল। কিন্তু তাদের কেউ তাঁর স্ত্রী পুত্রের বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারে নি। কোন ভিক্ষুক ইথাকায় এলেই সে সোজা চলে যায় রাজপ্রাসাদে, তারপর কৌশলে রাণীমাকে মিথ্যা মনগড়া কাহিনী বলে তাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে তার দুচোখ থেকে গণ্ডদ্বয় প্রবাহিত করে জল গড়িয়ে পড়ে রাণীমার চোখ থেকে। স্বামীর মৃত্যুতে পব্রিতা রমণীরা এইভাবেই কাতর হয়। তাদের মত তুমিও কিছু মনগড়া কাহিনী রাণীমার কাছে গিয়ে বলতে পার। তবে আমার যতদূর মনে হয় তিনি আর বেঁচে নেই আর তার ফলে তাঁর নিকট-আত্মীয় বন্ধুদের মত আমাকেও আঘাত ও কষ্ট ভোগ করতে হবে। যদিও আমি এখন আমার নিজের দেশে ফিরে যেতে চাই এবং আমার আত্মীয়-স্বজনের জন্য প্রায়ই দুঃখ জাগে মনে তথাপি আমার মনিব আমাকে এত ভালবাসতেন যে আমার আত্মীয়-স্বজনের দুঃখের থেকে আমার মনিবের জন্য দুঃখই প্রকট হয়ে উঠেছে আমার মনে। তিনি এখন এখানে না থাকলেও তাঁর নাম করে পারছি না।

তার উত্তরে ওডিসিয়াস বললেন, হে বৃদ্ধ, তুমি হয়ত আমার কথা বিশ্বাস করবে । আমি শপথ করে বলছি ওডিসিয়াস এই বছরেই ফিরে এসে দুবৃত্ত পাণিপ্রার্থীদের শাস্তি দেবেন। তবে তিনি ফিরে এলে তোমাকে এই সুসংবাদ দান করার পুরস্কার হিসেবে আমাকে একটি নতুন পোশাক ও দেহবন্ধনী দান করবেন।

ইউমেয়াস বলল, হায় বৃদ্ধ, সে পুরস্কার আর তোমায় নিতে হবে না। কারণ ওডিসিয়াস আর কোনদিন ফিরে আসবে না। এখন মদ পান শেষ করে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করো। আমার মনে কষ্ট দিও না, কারণ কেউ কখনো আমাদের রাজার ফিরে আসার কথা বললেই আমার অন্তরটা যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে। এখন আমার মনে আর এক দুঃখ আর উদ্বেগের উদ্ভব হয়েছে। সে উদ্বেগ হলো ওডিসিয়াসের পুত্র টেলিমেকাসের জন্য। এক সজীব সতেজ বৃক্ষচারার মত গড়ে উঠছিলেন টেলিমেকাস। বীরত্বে ও সৌন্দর্যে তিনি তাঁর পিতার মতই হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কেন যে তিনি তাঁর পিতার সন্ধানে পাইলস গেলেন বোকারমত তা জানি না। এখন পাণিপ্রার্থীরা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। এখন দেবতাদের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই আমাদের। তিনি তাদের হাতে মরতেও পারেন, আবার দেবতাদের কৃপায় বাঁচলেও বাঁচতে পারেন। যাই হোক, আচ্ছা বন্ধু, এখন বল, তুমি কে এবং কোথা থেকে আসছ? কিভাবেই বা তুমি এলে এখানে?

ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, আমি তোমাকে সব খুলে বলব। যদি তোমার ঘরে প্রচুর খাদ্য ও পানীয় থাকে আর আমি অবিরাম এইভাবে বসে তোমাকে আমার কাহিনী শুনিয়ে যাই তাহলে দীর্ঘ বারো মাসেও আমার সে দুঃখের কাহিনীর শেষ হবে না। ওডিসিয়াস বলতে লাগলেন, আমার বাড়ি হলো ক্রীট দেশে। আমার পিতার নাম হাইলাক্সপুত্র ক্যাস্টর। তাঁর আরো পুত্র ছিল। কিন্তু তারা ছিল আমার পিতার বিবাহিত স্ত্রীর পুত্র। কিন্তু আমি ছিলাম তাঁর এক রক্ষিতার গর্ভজাত সন্তান। তথাপি তাঁর অন্যান্য পুত্রদের মত আমার পিতা সমান মর্যাদার সঙ্গে আমাকে লালন পালন করতেন। কিন্তু আমার পিতার মৃত্যুর পর আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তির বেশিরভাগ আমার বৈমাত্ৰীয় ভাইরা ভাগ করে নেয় নিজেদের মধ্যে আর তার সামান্য এক অংশ দেয় আমাকে।

আমার সাহস ও বীরত্বের জোরে এক ধনী পরিবারে আমার বিবাহ হয়। আমি ছিলাম অকুতোভয়, অসমসাহসী আর গোপন আক্রমণকার্যে অদ্বিতীয়। কিন্তু এসব কাজ আমার ভাল লাগত না। আমি সবচেয়ে ভালবাসতাম সমুদ্রযাত্রা করতে এবং প্রত্যক্ষ সমরে বর্শা ও তীরধনুক হাতে প্রবল শত্রুর সম্মুখীন হতে। গ্রীকরা যখন ট্রয় অভিযান শুরু করে তখন আমিও একদল রণতরীর নেতারূপে সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে নয় বৎসর আমরা ট্রয়নগরী অবরোধ করে থাকি। দশম বৎসরে আমরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করি।

স্বদেশে ফিরে আমি মাত্র এক মাস স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সুখভোগ করি। কিন্তু তার পরেই কিছু লোক আর জাহাজ নিয়ে মিশরের পথে রওনা হই। ছয়দিন ধরে আমার নির্বাচিত নাবিকরা পানভোজে মত্ত হয়ে থাকে। আমি তাদের আনন্দোৎসবের জন্য প্রচুর পশুমাংসের ব্যবস্থা করলাম। সাত দিনের দিন আমরা জাহাজ ছেড়ে দিলাম। উত্তর হতে আগত অনুকূল বাতাস পেয়ে আমরা ক্রীট দেশের সীমানা ত্যাগ করে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলাম। চারদিন নিরাপদে কেটে গেল। চারদিন জাহাজ চলার পর পঞ্চম দিনে মিশরের প্রসিদ্ধ নীলনদের মুখে গিয়ে উপনীত হলাম। সেখানে আমাদের জাহাজ থামিয়ে কয়েকজনকে জাহাজের মধ্যে প্রহরায় নিযুক্ত রেখে আর কয়েকজনকে জায়গাটি সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠালাম। কিন্তু হঠাৎ তারা পাগলের মত হয়ে গিয়ে বহু মিশরবাসীকে হত্যা করে তাদের স্ত্রী ও শিশুদের ধরে নিয়ে এল।

এ খবর তাদের রাজধানীতে পৌঁছতেই বহু মিশরীয় পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য এসে আমাদের রণতরীগুলোকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। আমার বহু লোক হতাহত ও বন্দী হলো। হঠাৎ আমার কি মনে হলো আমি আমার শিরস্ত্রাণ, বর্শা ও অস্ত্র ফেলে দিয়ে মিশরের রাজা রথের সামনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে কাঁদতে লাগলাম। আমাকে দেখে রাজার দয়া হতে তিনি আমাকে নিয়ে গিয়ে প্রাসাদে আশ্রয় দিলেন। অতিথিদের দেবতা ও নিষ্ঠুরতার বিরোধী দেবরাজ জিয়াসের নামে আমাকে রক্ষা করলেন। আমি সাত বৎসর মিশরে রয়ে গেলাম। মিশরবাসীরা আমাকে ভালবাসত। তারা আমাকে অনেক কিছু দানও করেছিল। কিন্তু অষ্টম বৎসর জনৈক ফনিশীয় দুবৃত্তের ছলনাময় কথায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে দেশে গিয়ে এক বৎসর থাকি। তারপর সে আমাকে নিয়ে একটি জাহাজে করে লিবিয়ার পথে রওনা হয়। সে আমাকে বলে বাণিজ্য করতে যাচ্ছে, কিন্তু আসলে সে আমাকে বিক্রি করতে যাচ্ছিল টাকার বিনিময়ে। আমি তা বুঝতে পারলেও কোন উপায় না থাকায় আমি তার সঙ্গে না গিয়ে পারলাম না।

প্রথম দিকে অনুকূল বাতাস পেয়ে জাহাজ এগিয়ে চলল। কিন্তু হঠাৎ আকাশে মেঘ আর সমুদ্রে ঝড় উঠল। জিয়াস সহসা এক বস্ত্র নিক্ষেপ করে আমাদের জাহাজটিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিলেন। আমার সঙ্গীরা সব মারা গেল আর আমি একটি কাঠকে অবলম্বন করে নয়দিন সমুদ্রে ভেসে বেড়িয়ে অবশেষে গ্রেসপ্রোশিয়ার উপকূলে এসে উঠলাম সেখানে রাজা ফীডন আমায় আতিথ্য দান করেন তাঁর রাজবাড়িতে এবং আমায় উত্তম পোশাক পরিচ্ছদও দান করেন। আমি সেই রাজা ফীডনের কাছে ওডিসিয়াসের কথা শুনি। তিনি আমাকে বলেন রাজা ওডিসিয়াস তাঁর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে তাঁর প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করে এবং তিনি ওডিসিয়াসের কাছে তাম্র, স্বর্ণ প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু এসব প্রচুর পরিমাণে দেখেন যা তাঁর দশপুরুষের লোকেরাও শেষ করতে পারবে না। তিনি বলেন ওসিসিয়াস তাঁর কাছ থেকেই একটি জাহাজে করে দোদনা গেছেন। সেখানে সেই পবিত্র ওক গাছের মাধ্যমে জিয়াসের কাছ থেকে জানবেন তিনি সরাসরি ইথাকায় যাবেন অথবা ছদ্মবেশে যাবেন। রাজা ফীড়নই আমাকে একটি জাহাজে করে দুলিসিয়াম দ্বীপে পাঠিয়ে দেন রাজা একাস্তের কাছে। কিন্তু সে জাহাজের নাবিকরা আমার পোশাক পরিচ্ছদ সব কেড়ে নিয়ে জাহাজে বেঁধে রাখে। গতকাল সন্ধ্যার সময় তারা ইথাকার উপকূলে জাহাজ থামিয়ে যখন বেলাভূমিতে নেমে নৈশভোজন করছিল, তখন আমি কোনরকমে আমার বাঁধন খুলে জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে কোন পার্বত্য অরণ্যের গভীরে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। তারা আমাকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে পালিয়ে যেতে আমি তোমার কাছে চলে আসি। আশা করি তোমার এখানে আমার জীবন নিরাপদ।

শূকরপালক বলল, হে আমার হতভাগ্য বন্ধু, তোমার দীর্ঘ দুঃখভোগের কাহিনী আমার মর্মকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু আমার এই কাহিনীর মধ্যে যেখানে ওডিসিয়াসের কথা বললে সেখানে তা নিতান্তই অবিশ্বাস্য। তোমার মত একজন তোক কেন এমন করে মিথ্যার জাল বুনতে গেলে, তুমি কি ভাব আমি কিছু জানি না? তিনি যদি ট্রয়যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করতেন তাহলে সমগ্র গ্রীকজাতি তার জন্য এক বিরাট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করত এবং তাঁর মত পিতার জন্য তাঁর পুত্রও এক বিরাট গৌরব বোধ করত। কিন্তু মনে হয় কোন ঝড়ের শয়তান তাকে গ্রাস করেছে।

আমার কথা যদি বল, আমি এখানে শূকরপালক হিসেবে একেবারে নির্জন তপোবন জীবনযাপন করি। আমি রাণী পেনিলোপ আমায় ডেকে না পাঠালে কখনো শহরে যাই না। যখনই কোন বিদেশী অতিথি প্রাসাদে আসেন তখনি তাঁরা তাঁকে নানারকম প্রশ্ন করেন। আমি কিন্তু এসব পছন্দ করি না। এই যেমন সেদিন একজন ইটোলিয়ার লোক এসে বলল, সে ক্রীটে আইডোমেনেউসের সঙ্গে ওডিসিয়াসকে দেখেছে এবং আগামী গ্রীষ্ম অথবা শরৎ পড়তে বিবিধ প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু তাদের মত তুমিও কিন্তু কথা বলে আমার মন জয় করতে পারবে না। তবে আতিথেয়তার নিয়ম অনুযায়ী যেটুকু শ্রদ্ধা করার আমি অবশ্যই তা তোমাকে করব।

ওডিসিয়াস বললেন, তুমি বড় সন্ধিগ্ধমনা। কোন কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। ঠিক আছে, দেবতাদের সাক্ষী রেখে আমি এক চুক্তিতে আবদ্ধ হই। যদি আমার কথামত তোমার মনিব আসেন তাহলে আমাকে ভাল পোশক উপহার দিয়ে আমাকে দুলিসিয়ামে পঠিয়ে দেবে। কারণ সেখানেই আবার যাবার কথা ছিল। আর তোমার মনিব যদি না আসেন তাহলে আমাকে এক খাড়াই পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে ফেলে দেবে। এই ঘটনা থেকে তাহলে ভিক্ষুকরা এমন শিক্ষা পাবে যে তারা আর কখনো মিথ্যা কথা বলতে সাহস পাবে না।

শূকরপালক বলল, তোমাকে বাড়িতে আশ্রয় দেবার পর যদি তোমার জীবননাশ করি তাহলে কী সুনামই না আমার হবে। যাই হোক, এখন নৈশভোেজনের সময় হলো। আমার লোকেরা হয়ত এসে পড়বে তাহলে একসঙ্গে আমরা তৃপ্তির সঙ্গে খাব।

শূকরপালক তার লোকজনদের শূকরের পাল নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, সবচেয়ে ভাল একটা শূকর নিয়ে এস। আমার বাড়িতে একজন বিদেশী অতিথি এসেছে। আজ আমরা আনন্দ উপভোগ করব। এতদিন শুধু আমরা খেটে এসেছি আর যতসব ভূত আমাদের নিয়ে ফুর্তি করে এসেছে।

এই বলে সাদা দাঁতওয়ালা পাঁচ বৎসরের একটি মোটা শূকর কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবতার পূজা করল ইউমেয়াস। প্রথমে তার গা থেকে একগোছা চুল কেটে আগুনে তা ফেলে সমস্ত দেবতার কাছে ওডিসিয়াসের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রার্থনা করল। তারপর মাংস কেটে যথারীতি পুড়িয়ে প্রথমে দেবতাদের উৎসর্গ করল ও মদের অঞ্জলি দেবার পর ওডিসিয়াসকে দিল। মেসনিয়াস নামে ইউমেয়াসের একজন ভত্য তাদের রুটি দিল। আপাতত তার মনিব না থাকায় কারো কাছ থেকে কোন সাহায্য পায় না ইউমেয়াস। তবু সে নিজের খরচে একজন ভৃত্য রেখে তার মনিবের সব শূকর পালন করে চলেছে। এইভাবে ক্ষুধা তৃষ্ণা মিটিয়ে তৃপ্ত হয়ে শয়নের কথা চিন্তা করতে লাগল ইউমেয়াস।

সেদিন সন্ধ্যার দিকে আবহাওয়াটা খারাপ হয়ে উঠল। ঘন বাদল মেঘে আকাশের চাঁদ আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বৃষ্টি নামল এবং সারারাত ধরে সে বৃষ্টি চলতে লাগল। মদের ঘোরে গল্প বলতে লাগলেন ওডিসিয়াস। তিনি বললেন, মদের নেশায় লোকে কত নাচগান করে। কিন্তু আমি গল্প বলব। তিনি শুরু করলেন, আমার মনে হচ্ছে। ট্রয়যুদ্ধকালে যেমন ছিলাম তেমনি আবার এক বলিষ্ঠ যুবকে পরিণত হই। একবার ওডিসিয়াস, মেনেলাস আর আমি রাত্রিকালে ট্রয়নগরী আক্রমণ করি। আমাদের ঢালগুলোর উপর বরফ জমতে থাকে। সকলেই শিবিরে তাদের পোশাক পরেই ঘুমোতে থাকে। কিন্তু একা আমি পোশাক খুলে শুই। পরে রাত্রি তৃতীয় প্রহরে আকাশে তারারা মধ্য আকাশ হতে ঢলে পড়লে আমি ওডিসিয়াসকে উঠিয়ে বলি আমি শীতে খুন হয়ে যাচ্ছি। তখন তিনি থোয়াসকে উঠিয়ে রাজা অ্যাগামেমনসের কাছে দৌত্যকার্যে পাঠালে আমি তার পোশাক পরে প্রাণ বাঁচাই।

ইউমেয়াস তখন ওডিসিয়াসকে বলল, তুমি যে গল্প বললে তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আজকের এই রাত্রিতে কোন গরম পোশাক বা আচ্ছাদনের জন্য ভাবতে হবে না। তবে আগামীকাল অবশ্য তোমাকে তোমার নিজস্ব পোশাক পরেই যেতে হবে। কারণ আমাদের এখানে কারো বাড়তি পোশাক নেই। তবে ওডিসিয়াসের পুত্র যদি এসে পড়ে তাহলে তিনি তোমাকে একটি পোশাক দান করতে পারেন। এবং যেখানে তুমি যেতে চাও সেখানে তোমাকে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। ওডিসিয়াস বিছানায় শুয়ে পড়তে ইউমেয়াস তার উপর কম্বল চাপা দিয়ে দিল ভাল করে। ইউমেয়াস কিন্তু শুল না। সেই দুর্যোগঘন শীতের রাত্রিতে গায়ে কম্বল জড়িয়ে একটি তীক্ষ্ণ তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে আর হাতে একটি বর্শা নিয়ে কুটিরের বাইরের একটি বড় পাথরের তলায় যেখানে শূকরগুলো বিশ্রাম করছে সেখানে গিয়ে প্রহরা দিতে লাগল। কিভাবে তাঁর অনুপস্থিতিতে তারই এক কর্মচারী তাঁর সম্পত্তি রক্ষা করছে তা দেখে মনে মনে আনন্দিত হলেন ওডিসিয়াস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *