১৩. ওডিসিয়াসের ইথাকায় পদার্পণ

ত্রয়োদশ পর্ব
ওডিসিয়াসের ইথাকায় পদার্পণ

ওডিসিয়াসের কথিত কাহিনীর প্রভাবে এক সকরুণ আবেশে স্তব্ধ হয়ে উঠল অ্যালসিনোয়াসের প্রাসাদমধ্যস্থিত সেই সুপ্রশস্ত মায়াচ্ছন্ন কক্ষটি। কাহিনী শেষে রাজা অ্যালসিনোয়াম বললেন, হে ওডিসিয়াস, আপনি প্রচুর দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে আপনাকে আর কোন দুঃখ ভোগ করতে হবে না এবং আপনি নিরাপদে গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন। আর উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী, আপনারা আমার কথা শুনুন। যেসব উপহার আমাদের সম্মানিত অতিথি লাভ করেছেন তা একটি বড় কাঠের বাক্সে ভরে দেওয়া হয়েছে। তবে আরো কিছু আর্থিক দানের জন্য জনগণের কাছ থেকে কর হিসেবে আদায় করতে হবে।

অ্যালসিনোয়াসের প্রস্তাব সকলেই সমর্থন করল। তারপর সকলেই শুতে চলে গেল। সকাল হতেই রাজা অ্যালসিনোয়াস নিজে গিয়ে ওডিসিয়াসের জন্য নির্দিষ্ট জাহাজটি পরিদর্শন করতে এলেন। জাহাজটির প্রতিটি অংশ পরীক্ষা করলেন তিনি নিজের হাতে। তারপর প্রাসাদে ফিরে এসে জিয়াসের উদ্দেশ্যে বলদগুলো দান করে এক ভোজসভার আয়োজন করলেন। চারণকবি ডেমোডোকাস এসে আবার গান শোনাল সুমধুর কণ্ঠে। কিন্তু ভূমিকৰ্ষণরত কোন কৃষকের মত ওডিসিয়াস একদৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্তের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

সূর্য অস্তাচলগামী হয়ে উঠতেই ওডিসিয়াস রাজা অ্যালসিনোয়াসকে বললেন, হে শ্রদ্ধেয় রাজন, এবার দেবতাদের উদ্দেশ্যে মদের অঞ্জলি দান করে আমাকে বিদায় দিন। আপনি আমার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন, আমাকে প্রভূত উপহারে ভূষিত করেছেন। আপনি আপনার স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে সারা জীবনে সুখভোগ করে যান। আপনি যেন সর্বতোভাবে সুখী হন এবং আপনার প্রজারা সর্ব বিপদ থেকে মুক্ত থাকে।

ওডিসিয়াসের এই বিদায় ভাষণে সকলেই খুশি হলো। রাজা অ্যালসিনোয়াসের আদেশে তার সহচর পন্টোনোয়াস দেবতার উদ্দেশ্যে মদের অঞ্জলি দান করলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। এবার রাণী এ্যারিতের কাছে বিদায় নিলেন ওডিসিয়াস। বললেন, হে শ্রদ্ধেয়া রাণীমা, আমৃত্যু আপনি যেন সুখ সম্পদ ভোগ করে যান। এখন আমি বিদায় নিচ্ছি। আপনার স্বামী সন্তান ও পরিবারস্থ সকলে যেন দেবতাদের আশীর্বাদে ধন্য হন।

রাজার আদেশে একজন লোক ওডিসিয়াসের সংগে তাঁর জাহাজ পর্যন্ত গেল। রাণী এ্যারিতে একদল রমণীকে পাঠালেন ওডিসিয়াসের মালপত্র ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে তার জাহাজে দিয়ে আসার জন্য। তাদের মধ্যে একজন পোশাক, একজন বাক্স, আর একজন খাদ্য নিয়ে গেল।

ওডিসিয়াস জাহাজে উঠতেই রাজার লোকেরা তাঁর জন্য এক উত্তম শয্যা প্রস্তুত করে দিল জাহাজের একটি ঘরে। নাবিকরা তাদের আপন আপন জায়গায় বসে প্রস্তুত হয়ে অবশেষে জাহাজ ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে এমন দ্রুতগতিতে ছুটে চলতে লাগল জাহাজটি যে দ্রুতগামী এক বাজপাখিও তাকে ধরতে পারল না। এদিকে যে যেন সর্ববিস্মরণী মৃত্যুর পর বিস্তৃতির এক প্রলেপ মাখিয়ে দিল ওডিসিয়াসের দুচোখে আর গম্ভীর মুখের মধুর আস্বাদনে তলিয়ে গেল তার সমস্ত চেতনা। এতদিন ধরে যত কষ্ট ভোগ করেছেন তা সব ভুলে গেলেন।

ভোরের আকাশে শুকতারা উঠতেই ইথাকার উপকূলে উপনীত হলো ওডিসিয়াসের জাহাজ। এই উপকূলের প্রবেশপথে দুদিকে দুটি পাহাড় আছে। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রতরঙ্গের অবাঞ্ছিত উচ্ছ্বাসের প্রকোপ থেকে দ্বীপটিকে রক্ষা করে যে এটি দুটি পাহাড়। একটি পাহাড়ের মাথায় আছে ঢালা ঢালা পাতাওয়ালা এক অলিভগাছ। তার সততশীতল ছায়ায় নায়াদ নামী জলপরীরা বিশ্রামলাভ করে। এই পাহাড় দুটির অন্তরালে আপনার হতেই এক নিরাপদ পোতায় গড়ে উঠেছে। একটি পাহাড়ের এক প্রকাণ্ড গুহায় কতকগুলো পাথরের গামলা ও পাথরের চরকা আছে তাতে জলপরীরা ইন্দ্রনীল রঙের সুতো কাটে। সেই গুহার ধারে এমন এক দ্বিমুখী ঝর্ণা আছে যার যার জল কখনো পড়ে না বা প্রবাহিত হয় না নিচের দিকে, শুধু স্থির হয়ে থাকে এক জায়গায়। ঝর্ণার একটি মুখে মানুষরা স্নান করে এবং এবং তার জল ব্যবহার করে। আর একটি মুখের জল কেবল দেবতারাই ব্যবহার করে।

ফেসীয়রা দেখে শুনে জাহাজটিকে উপকূলভাবে নিয়ে গিয়ে থামিয়ে দিল। ওডিসিয়াস তখনো গভীর নিদ্রায় ছিলেন আচ্ছন্ন। তাঁকে সেই নিদ্রাভিভূত অবস্থাতেই ফেসীয় নাবিকরা তুলে জাহাজ থেকে ধরে উপকূলভাগ বেলাভূমিতে নামিয়ে দিয়ে গেল। তার মালপত্রের বাক্সটি পথ থেকে দূরে সেই অলিভগাছের তলায় নামিয়ে রেখে দিল। তারপর তারা চলে গেল।

এমন সময় স্বর্গলোক থেকে ভূকম্পনদেবতা পসেডন জিয়াসকে বললেন, হে পরম পিতা জিয়াস, আমি দেবতা হলেও আমারই বংশোদ্ভূত মানবসন্তান ফেসীয়রা আমার আদেশ অমান্য করে আমাকে অপমান করেছে। আমি ওডিসিয়াসের গৃহে প্রত্যাবর্তনের একান্ত বিরোধী না হলেও আমার ইচ্ছা ছিল প্রত্যাবর্তনের পথে ওডিসিয়াস আরও কষ্ট পাক। কিন্তু ফেসীয় নাবিকরা তাকে নিরাপদে এনে দিয়েছে তার দেশের উপকূলে। সঙ্গে এনেছে প্রচুর মূল্যবান উপহার।

জিয়াস উত্তর করলেন, হে ভূকম্পনদেবতা, তোমার মত একজন প্রবীণ দেবতাকে অশ্রদ্ধা করা অন্যায় হবে দেবতাদের পক্ষে। সুতরাং কোন দেবতাই তোমাকে অশ্রদ্ধা করে না। তবে যদি মনে করো কোন মানুষ তোমাকে কোনভাবে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে তাহলে তুমি খুশিমত প্রতিশোধ নিতে পার তার উপর।

পসেডন বললেন, এ প্রতিশোধ আমি এতদিন নিতে পারতাম। কিন্তু তোমার ক্রোধাকর্ষণের ভয়ে আমি তা পারি নি। এখন আমার ইচ্ছা হলো এই যে প্রত্যাবর্তনরত ফেসীয় জাহাজটিকে আমি দূর সমুদ্রে ভেঙ্গে দেব আর তাদের রাজধানীকে চারদিকে এক সুউচ্চ বিশাল পর্বতমালা দিয়ে ঘিরে দেব।

জিয়াসের সমর্থন লাভে উৎসাহিত হয়ে ফেসীয়দের আবাসভূমি স্কেরী দ্বীপে চলে গেলেন পসেডন। সেখানে বন্দরের কাছে দাঁড়িয়ে যে মুহূর্তে ইথাকা হতে প্রত্যাবর্তনরত ফেসীয় জাহাজটি দেখতে পেলেন সেই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে হাত দিয়ে এক চাপড়ে গোটা জাহাজটিকে প্রস্তুরীভূত করে সমুদ্রের অতল গর্ভে ডুবিয়ে দিলেন। যেসব ফেসীয় দর্শক কূলে দাঁড়িয়ে জাহাজটির প্রত্যাবর্তন গভীর আগ্রহ সহকারে লক্ষ্য করছিল তারা আশ্চর্য হয়ে গেল সকলে। অবশেষে রাজা অ্যালসিনোয়াস এর কারণটি ব্যাখ্যা করে শোনালেন তাদের। তিনি বললেন, হায়, এতদিন আমার পিতার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হলো। তিনি বললেন, পসেডন আমাদের এই অতিথিপ্রীতি পছন্দ করেন না। তিনি বলতেন, আমরা যাকে-তাকে নিরাপদে পৌঁছে দিই বলে পসেডন একদিন আমাদের একটি সুন্দর জাহাজকে ডুবিয়ে দেবেন আর আমাদের রাজধানীর চারদিকে এক বিরাট পর্বতমালা খাড়া করে আমাদের এই নগরীকে ঢেকে দেবেন। এখন আমার কথা শোন, পসেডন যাতে পর্বত-প্রাচীর তুলে আমাদর নগরীকে ঢেকে না দেন তার জন্য বারোটি শৃঙ্গযুক্ত বলদ বলিদান করে সন্তুষ্ট করতে হবে তাঁকে।

ফেসীয় সর্দারেরা ও রাজন্যবর্গ যখন পসেডনের বেদীর চারদিকে সমবেত হয়ে বলির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তখন ইথাকার উপকূলে ঘুম ভাঙল ওডিসিয়াসের। দীর্ঘকাল অনুপস্থিতির ফলে নিজের দেশকে নিজেই চিনতে পারলেন না। তিনি। পেনিলোপের পাণিপ্রার্থীরা উপযুক্ত শাস্তি পাওয়ার আগে ওডিসিয়াসকে যাতে তাঁর স্ত্রী ও বন্ধুরা চিনতে না পারে তার জন্য জিয়াসকন্যা প্যালাস এথেন অপরিচিতের এক মায়াময় কুয়াশাজাল বিস্তার করে দিয়েছিল তার উপর। ফলে ইথাকার দীর্ঘ পার্বত্যপথ, শান্ত নিস্তরঙ্গ উপসাগরের জল, চিরহরিৎ দ্রুমদল–সব অপরিচিত ঠেকতে লাগল রাজা ওডিসিয়াসের চোখে। তিনি হতাশ হয়ে আপন মনে বলতে লাগলেন, হায়, আমি এবার এ কোন দেশে এসে উঠলাম। এ দেশের লোকেরা বন্য বর্বর না ধর্মভীরু? আমি আমার এইসব মালপত্র কোথায় রাখব বা কোথায় নিয়ে যাব? ফেসীয়দের কাছে থেকে গেলেই ভাল হত। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আমাকে আমার স্বদেশে নিয়ে না গিয়ে এই অজানা জায়গায় ফেলে দিয়ে গেছে। এখন দেখি আমার ধনরত্ন সব ঠিক আছে কিনা। ফেসীয় নাবিকরা তা থেকে কিছু চুরি করে নেয়নি তো?

ওডিসিয়াস ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন তাঁর প্রাপ্ত ধনরত্ন ও উপহারের বস্তু সব ঠিক আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বাড়ির জন্য চিত্ত অতিমাত্রায় ব্যাকুল হওয়ায় সেই বেলাভূমির উপরেই পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে লাগলেন।

এবার এক সুন্দর রাখাল বালকের বেশে ওডিসিয়াসের সামনে আবির্ভূত হলেন দেবী এথেন। তাঁর হাতে ছিল একটি বর্শা। তাঁর শ্বেতকমলসদৃশ পদযুলের শোভা উঁকি মারছিল স্বর্ণ পাদুকার ফাঁকে ফাঁকে। তাকে দেখে ওডিসিয়াস খুশি হয়ে বললেন, এটি কোন দ্বীপ? আশা করি এখানে আমার কোন শত্রু নেই এবং আমার জীবন বা ধনরত্নের কোন ক্ষতি হবে না এখানে।

দেবী উত্তর করলেন, তুমি দেখছি একেবারে বোকা অথবা বহুদূর হতে আসছ। আমাদের এ দেশের নাম এতই গৌরবময় এবং এমনই শস্যসমৃদ্ধ যে এর নাম দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে কখনো বৃষ্টির অভাব হয় না এবং বিশাল তৃণভূমি থাকায় প্রচুর পশু পালিত হয়। এদেশের নাম ইথাকা যার নাম সুদূর ট্রয়ের অধিবাসীদের কাছেও সুপরিচিত।

ওডিসিয়াসের অন্তর আনন্দে লাফিয়ে উঠল দেবী এথেনের কথায়। কিন্তু তিনি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে সে আনন্দ প্রকাশ করলেন না। তিনি শুধু বললেন আমি এইসব মালপত্র নিয়ে ক্রিট থেকে আইডোমেনেউসপুত্র ওসিলোকাসকে হত্যা করে আসছি। সে আমার ট্রয়যুদ্ধে প্রাপ্ত ধনরত্ন কেড়ে নিয়ে তার পিতার দাসত্ব করতে বলেছিল আমায় কিন্তু আমি তা না করে একটি ফিনিসীয় জাহাজে করে পালিয়ে আসি। তারা আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে সিডনের পথে চলে গেছে।

ওডিসিয়াসের এই মিথ্যা মনগড়া কাহিনী শুনে তার পিঠে হাত রেখে হাসলেন দেবী এথেন। তারপর ছদ্মবেশ ত্যাগ করে আপন স্বরূপ উদঘাটন করে বললেন, আর নয় বন্ধু, তুমি একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও বাগ্মী হলেও নিজের দেশে এসে মিথ্যা কাহিনী রচনার এ অভ্যাস ত্যাগ করো। যে প্যালাস এথেন তোমার পাশে পাশে থেকে তোমাকে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, তোমাকে উপহার দান করতে বাধ্য করেছে ফেসীয়দের তাকে তুমি চিনতে পারলে না? এখন ধৈর্য ধরে শোন। প্রাসাদের মধ্যে গিয়ে তোমাকে যেসব কষ্ট ভোগ করতে হবে সে সম্বন্ধে সতর্ক করে দিচ্ছি। এখানকার কোন নরনারীকে তোমার প্রত্যাবর্তনের কথা জানাবে না। তাতে যত অপমান সহ্য করতে হয় নীরবে তা করবে।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলেন ওডিসিয়াস, দেবী ছদ্মবেশ ধারনে আপনি এমনই পটীয়সী যে কোন অতি বিচক্ষণ মানুষের পক্ষেও আপনাকে চেনা সম্ভব নয়। আপনি আমার প্রতি ট্রয়যুদ্ধকালে সদয় থাকলেও আমার জাহাজডুবির সময় আপনি আমার জাহাজে দয়া করে পদার্পণ করেন নি। তার ফলে আমাকে অশেষ কষ্ট ভোগ করে অকূল সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে হয়। পরে অবশ্য আপনি আমাকে ফেসীয়দের রাজধানীতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। যাই হোক, এখন আমাকে বলুন, আমি কি আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বদেশে ফিরে এসেছি?

এথেন বললেন, তুমি এত বুদ্ধিমান, সুসভ্য ও আত্মস্থ হয়েও একদিক দিয়ে বোকা? অন্য কোন লোক হলে স্বদেশে ফিরে আপনার বাড়িতে ছুটে যেত আর তুমি তোমার স্ত্রী-পুত্রের কোন কুশল সংবাদের কথাও জিজ্ঞাসা করছ না। জেনে রেখো, এই তোমার স্বদেশ। আমি জানতাম তুমি একা দেশে ফিরবে। কিন্তু আমার খুল্লতাত যে পসেডনের পুত্রকে অন্ধ করে দাও তাঁর প্রতি-বাসনার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করতে পারি নি। তুমি যে তোমার স্বদেশের ইথাকায় এসেছ তার প্রমাণস্বরূপ ঐ দেখ ফোরসি বন্দর, ঐ দেখ অলিভগাছ। ঐ দেখ পর্বতগুহাসংলগ্ন এক ছায়াছন্ন স্থান যেখানে নায়াদ নামে জলপরীরা কেলি করে। আর দেখ, তোমার পশ্চাতে ঢালু অরণ্যাচ্ছাদিত ভূমিটি নেরিতন পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে।

একথা বলতে বলতে ওডিসিয়াসের চোখের উপর হতে সেই মায়াময় কুয়াশার আবরণটি অপসারিত করে দিলেন এথেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেশকে চিনতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে সেখানে বসেছিলেন সেখানকার ভূমি চুম্বন করলেন ওডিসিয়াস, আপন মনে বললেন, হায়! আমি আমার দেশে ফিরে আসব একথা ভাবতে পারি নি। হে জিয়াস, যদি আমি আমার পুত্রকে দেখতে পাই তাহলে তোমাকে উপযুক্ত অর্ঘ্যদানে প্রীত করব।

এথেন বললেন, মনকে শক্ত করো, সব সংশয় ঝেড়ে ফেল। আমার প্রথম কাজ হবে তোমার এই মূল্যবান ধনরত্নগুলো এখানে এক গুহায় এক জায়গায় নিরাপদে লুকিয়ে রাখা, তারপর কি করা যায় তোমার জন্য পরে ঠিক করব।

এই বলে একটি অন্ধকার গুহার ভিতরে প্রবেশ করলেন দেবী এথেন আর পিছু পিছু গিয়ে তার ধনরত্নপূর্ণ বাক্সটি রেখে এলেন ওডিসিয়াস। পরে গুহাটির মুখে এক বড় পাথর দিয়ে মুখটি বন্ধ করে দিলেন। তারপর সেই অলিভগাছের তলায় দুজনে বসে ভাবতে লাগলেন, কিভাবে সেই উদ্ধত পাণিপ্রার্থীদের পতন ঘটানো যায়। দেবী এথেন বললেন, হে লার্তেসপুত্র, তুমি বুদ্ধিমান। এখন স্থির করো কি করবে। একদল দুবৃত্ত পূর্ণ তিন বৎসর ধরে তোমার প্রাসাদে অবস্থান করে তোমার স্ত্রীর প্রতি প্রেম নিবেদন করছে। তোমার স্ত্রী তাদের প্রত্যেকেকে ব্যক্তিগতভাবে গোপনে চিঠি দিয়ে আশা দিলেও আসলে সে তোমার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করছে।

ওডিসিয়াস হতাশ হয়ে বললেন, হায়! আমার মনে হচ্ছে রাজা অ্যাগামেমননের মত আমিও আমার প্রাসাদে পদাপর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে এক শোচনীয় পরিণতি লাভ করব। কিন্তু হে দেবী, তুমি যদি আমাকে ট্রয়নগরী ধ্বংসকালে যেভাবে সাহায্য করেছিলে সেইভাবে সাহায্য করো তাহলে আমি একা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেইসব দুবৃত্তদের তাড়িয়ে দিতে পারি আমার প্রাসাদ থেকে। তুমি শুধু আমার পাশে পাশে থাকবে।

এথেন উত্তর করল, আমি থাকব। আমাকে যখন যা করতে হবে তা আমি ভুলব না। উপস্থিত আমি তোমার চেহারাটিকে বিকৃত করে এক ঘৃণ্য ভবঘুরেতে পরিণত করব, ফলে তোমার স্ত্রী বা তার পাণিপ্রার্থীরা কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না। তুমি প্রথম যার দেখা পাবে সে হলো এক বৃদ্ধ শূকরপালক যে তোমার স্ত্রী-পুত্রের প্রতি খুবই বিশ্বস্ত। তার সঙ্গে এরেথুসা ঝর্ণার ধারে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করে অনেক কথা জানতে পারবে। ইতিমধ্যে আমি স্পার্টাতে গিয়ে তোমার পুত্র টেলিমেকাসকে ডেকে আনব। সে তোমার অনুসন্ধান করতে ল্যাসিডীমন ও স্পার্টায় গেছে।

ওডিসিয়াস বললেন, হে দেবী, তুমি সর্বজ্ঞা হয়েও কেন তাকে আমার কথা বল নি? তুমি কি চাও আমার মত সেও সমুদ্রে বিপদে পড়ুক?

এথেন বললেন, ভয় নেই, আমিই তার যাত্রার ব্যবস্থা করেছিলাম। সে এখন রাজা মেনেলাসের প্রাসাদে সুখে শান্তিতেই আছে। তোমার স্ত্রীর সেই পাণিপ্রার্থীরা তার হত্যার চক্রান্ত করলেও সফল হবে না তাদের সে চক্রান্ত।

এই বলে এথেন তাঁর দণ্ডটি দিয়ে ওডিসিয়াসকে স্পর্শ করতেই তাঁর গায়ের মসৃণ চামড়া কর্কশ হয়ে উঠল। মাথার লম্বা লম্বা সব চুল উঠে গেল। বার্ধক্যজনিত কুঞ্চন দেখা দিলে সর্বাঙ্গে এবং চোখের জ্যোতি ম্লান হয়ে গেল। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও মলিন হয়ে গেল। পরে এথেন ওডিসিয়াসকে একটি লাঠি আর ছেঁড়া কম্বল দিলেন এবং তাঁর ছদ্মবেশ ধারণের কাজ সম্পূর্ণ হলে এথেন টেলিমেকাসকে আনতে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *