১২. সিল্লা ও চ্যারিবডিস

দ্বাদশ পর্ব
সিল্লা ও চ্যারিবডিস

ওসিয়ান নদীর প্রবহমান জলধারাকে অতিক্রম করে আমার জাহাজ এসে পড়ল মধ্য সমুদ্রে। এরপর আমরা উপনীত হলাম সূর্যালোকের দেশ এঈলা দ্বীপে। সেখানকার বেলাভূমিতে আমরা নেমে তার উপর শুয়ে রাত্রির মত বিশ্রাম করলাম।

পরদিন প্রভাতে পূর্ব দিগন্তে প্রথম আলোকরশ্মি ফুটে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি জাদুকরীর প্রাসাদ থেকে এলপিনরের মৃতদেহটিকে আনার জন্য লোক পাঠালাম। মৃতদেহটিকে আনা হলে সেটিকে আমরা দাহ করলাম উপকূলের এক স্থানে। তারপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলাম।

মৃত্যুপুর থেকে আমরা ফিরে এসেছি একথা শুনে জাদুকরী নিজে এল আমাদের দেখতে। সঙ্গে অনেক ভৃত্যের সাহায্যে প্রচুর খাদ্য ও পানীয় নিয়ে এল। জাদুকরী দেবী আমাকে দেখে বলল, তাহলে তোমরা মৃত্যুপরী থেকে জীবন্ত ফিরে এসেছ। অনেকের পরিবর্তে একজনের মৃত্যু বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তোমাদের আরো দুজনের মৃত্যু হবে। যাই হোক, এখন সেসব কথা ভুলে পানাহারে তৃপ্ত হও। রাত্রিতে এখানে বিশ্রাম করে পরদিন প্রাতে আবার রওনা হবে। আমি তোমাকে পথের বিবরণ দিয়ে দেব এবং জল বা স্থলপথের যেখানে তোমাদের জন্য বিপদের ফাঁদ পাতা থাকবে থেকে যাতে অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পার তার উপায় বলে দেব।

আমরা মেনে নিলাম সেকথা। সুতরাং সারাদিন ধরে মদ ও মাংসসহ পানাহারে মত্ত হয়ে রইলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলে আমার লোকজন জাহাজে বিশ্রাম করতে লাগল। কিন্তু জাদুকরী আমাকে নিয়ে গেল এক নির্জন স্থানে। সেখানে সে আমার পাশে শুয়ে আমাকে মৃত্যুপুরীর যাবতীয় অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করতে বলল।

আমার সব কথা শুনে জাদুকরী বলল, ঠিক আছে, যা হয়েছে ভালই হয়েছে। এবার শোন, ভবিষ্যতে যা ঘটবে তাই বলছি আমি এবং আশা করি দেবতাদের কৃপায় আমার সেসব কথা তোমার মনে থাকবে। এরপর সমুদ্রপথে তোমার দেখা হবে সাইরেণ জাতির সঙ্গে। তারা যেকোন বিদেশীকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে গানের দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে যে সে আর দেশের ফেরার কথা ভাবতেই পারে না। একবার কোন সাইরেণ জাতীয় লোকের কণ্ঠস্বর কোন বিদেশীর কানে গেলেই সে বিদেশী তার বাড়ির স্ত্রী পুত্রের কথা ভুলে যায়। সাধারণত সাইরেণরা শুকনো চামড়া দিয়ে ঢাকা মৃতদেহ কঙ্কাল-স্কুপের মাঝখানে বসে যখন গান গায় তখন সেই গানের সুর থেকে এমন এক মায়াজাল সৃষ্টি হয়, সে জাল কোন বিদেশী শ্রোতা ছিন্ন করতে পারে না। সেই সাইরেণদের দ্বীপের পাশ দিয়ে তোমার জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে এবং তোমার কোন নাবিক যাতে সে গান শুনতে না পায় তার জন্য তাদের কানগুলোকে মোম দিয়ে বন্ধ করে দেবে। আর তুমি যদি তাদের পাশ দিয়ে জাহাজ চালিয়ে যাবার সয় তাদের গান শুনতে চাও তাহলে নিজেকে জাহাজের মাস্তুলের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে। কিন্তু তাদের গান শোনার পর তোমার লোকদের যেন সে বাঁধন খুলে দিতে বলো না।

এই বিপদসঙ্কুল দ্বীপটি অতিক্রম করতে পারলে তোমরা একটি জায়গায় গিয়ে পড়বে যার ওপরে কি হবে তা আর আমি বলতে পারব না। সেখানে দুটি পথ পাবে সামনে। দুটি পথের বিবরণই আমি দেব তোমায়। একদিনের পথের পাবে এক ভাসমান পাহাড় যাতে বড় বড় ঢেউগুলো ক্রমাগত আছাড় খেয়ে পড়ে এবং সে পাহাড়টি এমনই বিপজ্জনক যে কোন পাখি পর্যন্ত সেখানে নিরাপদে উড়ে গিয়ে ফিরে আসতে পারে না। এমন কি যেসব ধর্মভীরু কপোত সেই পাহাড়ের উপর দিয়ে জিয়াসের কাছে অঞ্জলি দেবার জন্য যায়, উড়ে যাবার সময় তারাও পরিত্রাণ পায় না। কোন নাবিক সে দিকে জাহাজ নিয়ে গিয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র তরঙ্গমালার আঘাতে অথবা কোন লেলিহান অগ্নিশিখার দ্বারা তার মৃত্যু ঘটবেই আর তার মৃতদেহ অন্যান্য মৃতের সঙ্গে স্থূপীকৃত থাকবে সেই ভাসমান পাহাড়ের উপরে। যেখান থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র একটি জাহাজ নিরাপদে ফিরে আসে। সেটির নাম হলো আর্গো। হেরাকলসপত্নী দেবী হেরে জেসনের প্রতি তাঁর গুপ্ত প্রণয়বশত যদি সে জাহাজটিকে সাহায্য না করতেন তা কখনই এত সহজে পরিত্রাণ পেত না।

অন্য এক পথে আছে দুটি পাহাড়। তাদের মধে বড়টির মাথা এত উঁচু যে ঘনকৃষ্ণ মেঘমালায় সতত সমাচ্ছন্ন থাকে তার শিখরদেশ। কী শীত কী গ্রীষ্ম কখনই মেঘমুক্ত হয় না সে পাহাড়ের শিখরদেশ। পৃথিবীর কোন মানুষ কুড়িজন লোকের সাহায্য নিয়েও সে পাহাড়ে উঠতে পারে না, কারণ পাহাড়ের গা-টি অতি মসৃণ। সেই পাহাড়ের মসৃণ। গাত্রদেশে আছে পশ্চিমমুখী একটি বিশাল গহ্বর যার তলদেশ সুদূর নরক পর্যন্ত বিস্তৃত। হে ওডিসিয়াস সেই পাহাড়টিকে পাশ কাটিয়ে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে। সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দাজও কোন জাহাজ থেকে তীর ছুঁড়ে সেই গুহার তল খুঁজে পাবে না। সেই গুহাটি হলো ভয়ঙ্কর এক ওষ্ঠবিশিষ্ট সিল্লা নামে অদ্ভুত এক প্রাণীর আবাস। তার ডাকটা ক্ষীণ হলেও সেই প্রাণীটিকে যে দেখে সেই ভয় পায়। তার বারোটা পা ছয়টা ঘাড়, তিনপাটি দাঁত। দাঁতগুলো কৃষ্ণকুটিল এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুর সঙ্গে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। তার গুহার মধ্যে সিল্লার গোটা দেহটার অর্ধেক ডুবে আছে। কিন্তু তা হলেও তার ছয়টি মাথা দিয়ে সে সমুদ্রবাসী মাছ ও এমন কি বড় বড় জলজন্তুদেরও ধরে ধরে খায়। কোন নাবিক তার জাহাজ নিয়ে সিল্লার কাছে গিয়ে পড়লে তার জাহাজ থেকে কোন না কোন মানুষকে তার লম্বা ঘাড় আর ভয়ঙ্করভাবে ধারাল ঠোঁট দিয়ে ধরে খাবেই সিল্লা।

হে ওডিসিয়াস, তুমি দেখবে অন্য পাহাড়টি আরো নিচু এবং এই দুই পাহাড়ের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। দ্বিতীয় পাহাড়টির গায়ে একটি ডুমুরগাছের তলায় চ্যারিবডিস নামে এক অদ্ভুত প্রাণী থাকে। সে তিনবার সমুদ্রের তলা থেকে কালো জল অদ্ভুতভাবে গলাধঃকরণ করে তার তিনবার সেই জল সে মুখ থেকে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। সে যখন এই কাজ করে তখন সেখানে তুমি যদি গিয়ে পড় তাহলে ভূকম্পনদেবতা স্বয়ং পসেডনও তোমায় রক্ষা করতে পারবেন না। তুমি ওখানে খুব তাড়াতাড়ি জাহাজ চালিয়ে যাবে। তা না হলে তোমার একটি নাবিকও বাঁচবে না।

আমি তখন দেবীকে বললাম, আমি আরও জানতে চাই। আচ্ছা সিল্লা বা চ্যারিবডি যখন আমাদের নাবিকদের আক্রমণ করবে তখন কি তাদের হাত থেকে কোনক্রমে উদ্ধার করতে পারব না?

দেবী তখন চিৎকার করে আমাকে নির্বোধ বলে ভর্ৎসনা করলেন। তিনি বললেন আমি নাকি সবসময় যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনি। তিনি বললেন, তুমি দেবতাদের বিধানকেও মানতে চাও না। তবে জেনে রাখ, সিল্লাকে কেউ কখনো মারতে পারবে না। সে এমনই হিংস্র যে তার সঙ্গে কেউ যুদ্ধ করতে পারে না। যদি

তুমি অস্ত্র নিয়ে তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাও তাহলে সে তার ছটা ঘাড় দিয়ে তোমার ছয়জন নাবিককে ধরে খাবেই। তবে তার পাশ কাটিয়ে জাহাজ চালিয়ে তার মা ক্রেটেইসের কাছে যেতে পার। সে বরং সিল্লাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।

এরপর তুমি যাবে থ্রিনেসি দ্বীপে যেখানে সূর্যদেবতা নিজে পঞ্চাশটি করে মাথাওয়ালা এক আশ্চর্য রকমের মেষ চরায়। সেই ধরনের মেষের সাতটি পাল তিনি এক বিশাল তৃণভূমিতে চরান। এই আশ্চর্য প্রাণীগুলোর সাধারণভাবে জন্ম হয় নি এই পৃথিবীতে এবং তাদের কোনো মৃত্যু নেই। সূর্যদেবতা হাইপীরিয়নের দুই কন্যা জলদেবী ফেথুসা ও ল্যাম্পেটি তাদের চরায়। সেদিকে যাবার সময় যদি তাদের কোনভাবে স্পর্শ না করে এবং একমনে বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে চলে যাও তাহলে তোমার নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যদি তাদের আঘাত করো তাহলে আমি জোর গলায় বলতে পারি তোমার জাহাজ ও সব নাবিক ধ্বংস হবে। আর অতি কষ্টে তুমি শোচনীয় অবস্থায় বাড়ি পৌঁছাতে পার।

জাদুকরীর কথা শেষ হতেই সকাল হয়ে গেল। সে আমাকে ছেড়ে তার বাসভবনের দিকে চলে গেল আর আমি ফিরে এলাম আমার জাহাজে। জাদুকরী দেবী আমাদের জন্য অনুকূল বাতাস দিতেই আমার আদেশমত নাবিকেরা জাহাজ ছেড়ে দিল।

জাহাজ তীরবেগে ছুটতে লাগল। আমি তখন অশান্তচিত্তে জাদুকরী দেবীর কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। আমি আমার নাবিকদের বিশ্বাস করে সেকথা বলতে শুরু করলাম। আমি বললাম, বন্ধুগণ, জাদুকরীর কথাগুলো তোমাদের সকলেরই শোনা উচিত। তার সতর্কবাণীগুলো তোমাদের সকলেরই জানা উচিত। আমাদের প্রতি তার প্রথম সতর্কবাণী হলো সাইরেণদের রহস্যময় সঙ্গীত সম্পর্কে। আমরা যেন তাদের কুসমিত প্রান্তরে আর রহস্যময় সঙ্গীত এড়িয়ে যাই। আমি একা তাদের সে সঙ্গীত শুনতে পারি, কিন্তু আমাকে তোমরা জাহাজের মাস্তুলর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে। আমার বন্ধন খুলে দেবার জন্য তোমাদের অনুরোধ করলেও তোমরা আমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে দেবে।

আমি আমার লোকদের জাদুকরীর সতর্কবাণীগুলো বুঝিয়ে বললাম। ইতিমধ্যে আমাদের জাহাজ অনুকূল বাতাস পেয়ে সাইরেণদের দ্বীপে পৌঁছে গেল। কিন্তু সহসা বাতাস বন্ধ হয়ে গেল কোন জাদুমন্ত্রবলে। সমুদ্রের যতসব ঢেউগুলো স্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তে। আমি তখন কিছু মোম গলিয়ে আমার নাবিকদের কানগুলো বন্ধ করে দিলাম, তারপর আমার নাবিকেরা আমাকে জাহাজের মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে রেখে দাঁড় বাইতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা সাইরেণদের দ্বীপের উপকূলে চলে এলাম এবং সাইরেণরাও আমাদের জাহাজের কথা জানতে পেরে এক তরল মোহপ্রসারী সঙ্গীতের ধারায় ফেটে পড়ল। আমরা তাদের কাছে যেতেই সাইরেণরা আমাকে সম্বোধন করে বলল, হে গৌরবময় গ্রীকসন্তান ওডিসিয়াস, তোমার জাহাজ থামিয়ে আমাদের গান শোন। কোন নাবিক এদিকে এসে আমাদের গান না শুনে চলে যেতে পারে নি। আমরা এখানেই বসেই ট্রয়যুদ্ধের সবকথা জানতে পারি এবং জগতের কোথায় কি ঘটছে জানতে পারি।

তাদের সেই রহস্যময় গানের সুর আমার কানে এসে লাগতেই সে গান শোনার জন্য এক প্রবল বাসনা জাগল আমার মনে। আমি আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য কুটি সহকারে সঙ্কেত করলাম। কিন্তু পেরিমেদিন ও ইউরিলোকাম আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বন্ধন আরো শক্ত করে দিল। যাই হোক, আমরা সাইরেণদের সেই দ্বীপ ফেলে অনেকদূর এগিয়ে যেতে বিপদের সব ভয় কেটে গেল এবং আমার নাবিকরা তাদের কান থেকে মোমের ছিপিগুলো খুলে ফেলল। আমার বাঁধনও খুলে দিল।

কিছুদূর গিয়ে আমরা দূরে একটি ধোয়ার মেঘ দেখতে পেলাম এবং বিশাল বিক্ষুব্ধ এক তরঙ্গের গর্জন শুনতে পেলাম। সে গর্জন শুনে আমার নাবিকরা এতদূর ভীত হয়ে পড়ল যে তাদের হাত থেকে দাঁড় ও হাল খসে পড়ল। ফলে জাহাজটি থেমে গেল। আমি তখন তাদের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে বললাম, বন্ধুগণ আমরা এর থেকে আরো বিপদ অতিক্রম করে এসেছি, সাইক্লোপ আমাদের বন্দী করে রাখতে পারে নি তাদের দ্বীপে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ বিপদও আমরা কাটিয়ে উঠব। সুতরাং এ ধোয়ার মেঘ না দেখে ও ঐ তরঙ্গের গর্জন না শুনে দাঁড় বেয়ে জাহাজ নিয়ে এগিয়ে চল। তা না হলে জাহাজটি ঐ পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা মারবে আর আমরা সকলেই ডুবে যাব।

নাবিকরা আমার কথা শুনে জাহাজ চালাতে লাগল। আমি তাদের সিল্লার কথা বললাম না। তাহলে তারা ভয়ে জাহাজ চালানো ছেড়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম সিল্লার কাছ থেকে বিপদ আমাদের সহ্য করতে হবে। কিন্তু জাদুকরী আমাকে অস্ত্রধারণ করতে নিষেধ করে যে সতর্কবাণী করেছিল আমি ভুলে গিয়ে বড় বড় একটি বর্শা নিয়ে জাহাজের পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে সিল্লাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু পাহাড়টার কোন ধারে কোথাও দেখতে পেলাম না সিল্লাকে।

একদিকে সিল্লা আর একদিকে চ্যারিবডিস। আমরা অতি সন্তর্পণে জাহাজ চালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। সমুদ্রের গম্ভীর হতে চ্যারিবডিস যখন লবণাক্ত জল শোষণ করত তখন সমুদ্রের তলদেশের বালুরাশি পর্যন্ত দেখা যাবে। তার প্রসারিত মুখগহ্বরের ভিতর দিয়ে পেটের ভিতর পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হত। তার দ্রুতস্পন্দিত দেহ হতে বেরিয়ে আসা এক প্রকার গজনে পাশের পাহাড়টা কেঁপে উঠত।

আমরা যখন চ্যারিবডিসের সন্ধানে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম তখন সহসা সিল্লা তার ভয়ঙ্কর ঠোঁট বাড়িয়ে আমার জাহাজ থেকে ছয়জন সুদক্ষ নাবিককে শূন্যে তুলে নিল। আমি তাদের চিৎকারে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম তারা শূন্যে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমার নাম ধরে ডাকছে। ছিপ নিয়ে কোন লোক মাছ ধরার সময় বড়শীতে মাছ গাঁথার সঙ্গে সঙ্গে টান দিয়ে মাছটিকে সে যেমন তুলে নেয় তেমনি সিল্লা তার ছয়টি মুখ দিয়ে আমার ছয়জন লোককে তুলে নিল তার পাহাড়ের মাথায়। আমি অনন্ত সমুদ্রে বহুদিন ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু এমন সকরুণ দৃশ্য কখনো দেখি নি এর আগে।

এইভাবে আমরা সিল্লা ও চ্যারিবডিসের বিপদ কাটিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম সূর্যদেবতা হাইপীরিয়নের মেষচরণ ক্ষেত্রসমন্বিত সেই মায়াময় দ্বীপে। আমি গরু ও ভেড়ার ডাক শুনতে পেলাম তখন আমার থীবসে সেই জ্যোতিষী ও জাদুকরী দেবীর কথা মনে পড়ে গেল। তারা আমায় সতর্ক করে দিয়েছিল, সেই দ্বীপে আমরা যেন অবতরণ না করে সেটাকে ফেলে চলে যাই।

আমি তখন আমার লোকদের বললাম, বন্ধুগণ, এই দ্বীপ আমাদের পক্ষে ভয়ঙ্করভাবে বিপজ্জনক। সুতরাং এটিকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত জাহাজ চালনা করো।

একথা শুনে মর্মাহত হয়ে উঠল আমাদের লোকেরা। তার মধ্য হতে ইউরিলোকাস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ওডিসিয়াস, আপনি এমনই একজন মানুষ যার দেহ মন কখনো ক্লান্ত হয় না। আপনার সারা দেহটি লোহা দিয়ে তৈরি তাই আমরা দীর্ঘ শ্রমক্লান্তি পর সমুদ্রবেষ্টিত সুন্দর এই দ্বীপে অবতরণ করে রান্না করে তৃপ্তির সঙ্গে নৈশভোজন করতে চাইলে আমাদের বাধা দিচ্ছেন আপনি। তার পরিবর্তে আপনি চাইলেন নৈশ অন্ধকার আর কুয়াশার কবলে পড়ে আমরা মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়াই। রাত্রিতে যদি সহসা ঝড় ওঠে, যদি আমরা পশ্চিম বা দক্ষিণা বায়ুর আঘাতে আক্রান্ত হই তাহলে কি আমাদের জাহাজের কোন ক্ষতি হবে না? সুতরাং এ দ্বীপে নেমে এই গোধূলিবেলায় আমাদের রন্ধনকার্য সম্পন্ন করব। আমরা জাহাজ থেকে বেশিদূরে যাব না এবং সকাল হলেই আবার জাহাজ ছেড়ে দেব।

ইউরিলোকাসের কথাগুলো নাবিকেরা প্রত্যেকেই হাততালি দিয়ে সমর্থন করল। আমি তখন বুঝলাম আমাদের ভাগ্যে সত্যিই বিপদ আছে। আমি গম্ভীরভাবে তাদের বললাম, ইউরিলোকাস, আমি একা, তোমর সংখ্যায় অনেক, তোমরা যা চাইছ তা অবশ্যই হবে। তবে আমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দাও, যদি তোমরা এই দ্বীপে কোন গবাদি পশুর পাল দেখ তাহলে তাদের কোন ক্ষতি করবে না। জাদুকরী দেবী তোমাদের যে খাদ্য দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে।

আমার নাবিকরা তাতে সম্মত হলো এবং প্রতিশ্রুতি দিল আমাকে। আমরা জাহাজ থামিয়ে যেখানে নোঙর করলাম তার কাছেই সুপেয় জল ছিল। তারা রান্না করে নৈশভোজন করল তৃপ্তির সঙ্গে। তারপর সিল্লা তাদের যে সব সহকর্মীদের ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের কথা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।

রাত্রি তৃতীয় প্রহরে ঝড় উঠল। ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেল সমগ্র আকাশ আর পৃথিবী। আমরা জাহাজটিকে টেনে কোনরকমে একটি নিরাপদ স্থানে রাখলাম। আমি আমার লোকদের আবার সাবধান করে দিয়ে বললাম, ঐ সমতলে তৃণভূমিতে যেখানে জলপরীরা নৃত্য করতে থাকে সেখানে কোন মেষের পাল দেখলে যেন তাতে হাত দিও না। সেগুলো সব সূর্যদেবের যিনি পৃথিবীর মর্তমানুষের দ্বারা কৃত যেকোন গোপন কর্ম দেখতে পান।

আমার কথার কোন প্রতিবাদ করল না নাবিকরা। কিন্তু পুরো একটি মাস ধরে সমানে ঝড় বইতে লাগল। দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্ব–সব বায়ু প্রবাহগুলো একযোগে প্রবাহিত হতে লাগল প্রবলবেগে। যতদিন জাহাজে খাদ্য ছিল ততদিন আমার নাবিকরা সে দ্বীপের তৃণপ্রান্তরে চরতে থাকা সূর্যদেবতার কোন পশুকে হত্যা করে নি। কিন্তু সকল রসদ ফুরিয়ে গেল এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল আমার লোকেরা তখন আমি দ্বীপের ভিতরে এক নির্জন স্থানে গিয়ে এত ঘোর বিপদ হতে মুক্তির পথ বলে দেবার জন্য অলিম্পাসের দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রাথর্না করতে লাগলাম। কিন্তু কোন পথ বলে দিলেন না তারা। তারা শুধু আমাকে দিলেন এ গভীর সুখনিদ্রা।

ইতিমধ্যে এক অবাঞ্ছনীয় ও দূরন্ত পরিকল্পনা খাড়া করে বসল ইউরিলোকাস তার সঙ্গীদের নিয়ে। সে তার সঙ্গীদের বলল, আমাদের মত মরণশীল মানুষের কাছে যেকোন মৃত্যুই ঘৃণ্য, তথাপি অনশনে মৃত্যু সর্বাপেক্ষা দুঃখজনক। সুতরাং আমাদের কথা শোন। আমরা সূর্যদেবতার ভাল গরুগুলো ধরে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি দিই। আমরা ইথাকায় উপনীত হয়ে সূর্যদেবতা হাইপীরিয়নের উদ্দেশ্যে এক মন্দির নির্মাণ করব। কিন্তু তা সত্ত্বেও সূর্যদেবতা যদি অন্যান্য দেবতাদের সহায়তায় আমাদের শাস্তি দান করেন তাহলে আমি সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে এ মরদেহ ত্যাগ করব। এই দ্বীপে তিলে তিলে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরার থেকে সে মৃত্যু হবে অনেক সুখের।

ইউরিলোকের কথায় সকলেই সায় দিল। তারা সূর্যদেবতার গরুর পাল থেকে গরু ধরতে গেল। তারা প্রথমে নিকটস্থ ওকগাছ থেকে বড় বড় পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যবের দানার পরিবর্তে তাই দিয়ে প্রার্থনার কাজ সারল। তারপর গরুগুলো কেটে তাদের মাংস আগুনে দগ্ধ করতে লাগল। মদ না থাকায় জলের অঞ্জলি দিচ্ছিল তারা মাঝে মাঝে। মাংস পুড়িয়ে তারা খেতে শুরু করেছে এমন সময় আমার সহসা ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি চমকে উঠে জাহাজে এসে মাংস পোড়ার গল্প পেয়েই নিমেষে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমি তখন দেবরাজ জিয়াসের উদ্দেশ্যে বললাম, হে পরম পিতা জিয়াস আমাদের ধ্বংস করার জন্যই তোমরা আমার এক নিষ্ঠুর নিদ্রা অভিভূত করে রেখেছিলে। আর সেই অবসরে তারা এই ভয়ঙ্কর কার্য সাধন করে ফেলে। সূর্যদেবতার পশুকে হত্যা করেছে আমার লোকেরা এই সংবাদ জলপরী ল্যাম্পেটি জানিয়ে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে সূর্য জিয়াস ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, হে পরম পিতা জিয়াস ও অন্যান্য অমর দেবতাবৃন্দ, লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াসের যেসব অনুচর আমার গবাদি পশগুলোকে হত্যা করেছে তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তি বিধানের জন্য আমি অনুরোধ করছি তোমাদের। উদয় হতে অস্তকাল পর্যন্ত যতক্ষণ আমি আকাশে বিরাজ করি ততক্ষণ প্রতিদিন পশুগুলো আমার চক্ষুর তৃপ্তিসাধন করত। যদি তারা অন্য পশু দিয়ে ক্ষতিপূরণ না করে তাহলে এবার হতে আমি স্বর্গ ও মর্ত্যলোকে কোন কিরণ দান না করে মৃত্যুপুরীতে গিয়ে কিরণ দান করব।

দেবরাজ জিয়াস তখন বললেন, সে সূর্য, তুমি যথারীতি স্বর্গ ও মর্ত্যলোকেই বিরাজ করে কিরণ দান করবে। আমি দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি দান করব। আমি বজ্ৰদ্বারা তাদের জাহাজটিকে খণ্ড খণ্ড করে নিশ্চিহ্ন করে দেব।

দেবতাদের এই কথাগুলো আমি শুনেছিলাম ক্যালিপসোর কাছ থেকে। ক্যালিপসো একথা শুনেছিল দেবদূত হার্মিসের কাছ থেকে।

আমি আমার লোকদের ভর্ৎসনা করলাম। কিন্তু তখন সব শেষ; প্রতিকারের কোন উপায় ছিল না। কতকগুলো কুলক্ষণের মাধ্যমে দেবতারা শাস্তির আভাস দিতে লাগলেন। কাঁচা ও দগ্ধ মাংসের ভিতর থেকে গরুর হারব শোনা যাচ্ছিল। ছয়দিন ধরে আমার লোকেরা তাদের দ্বারা নিহত সেই পশুর মাংস ভোজন করে চলল। কিন্তু সাত দিনের দিন ঝড়ের প্রকোপ কমে গেলে আমরা জাহাজ ছেড়ে দিলাম।

দ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে কিছুদূর যাবার পর জিয়াস আকাশে গুরুগম্ভীর মেঘমালা বিস্তার করলেন। সেই মেঘচ্ছায়ার প্রভাবে আরও কালো হয়ে উঠল সমুদ্রের জল। সহসা পশ্চিম দিক হতে এক প্রবল ঝড় আমাদের জাহাজের পালের দড়িগুলো ছিঁড়ে দিল। মাস্তুলর কাঠটি ভেঙ্গে আমার নাবিকদের মাথার উপর পড়ায় সকলের মাথার খুলি চূর্ণ হয়ে গেল। তারপর জিয়াস এমন এক বস্ত্র নিক্ষেপ করলেন আমাদের জাহাজের উপর যাতে সমগ্র জাহাজটি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল। তরঙ্গশীর্ষে উড়ে বেড়ানো সামুদ্রিক পাখির মত আমার নাবিকদের মৃতদেহগুলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকের বিক্ষুব্ধ

তরঙ্গমালার উপর। আমি ভগ্ন জাহাজের দুটি কাঠকে শক্ত করে ধরে ভেসে যেতে লাগলাম ক্রমাগত ঝড়ের দ্বারা তাড়িত হয়ে। আসলে আমি জলের হাতে ক্রীড়ানক হয়ে উঠলাম।

যে ঝড়টি বইছিল সেটি থেমে গেলেও দক্ষিণ দিক হতে আবার একটি ঝড় এসে আমাকে উল্টো দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। আমি আবার আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিল্লার সেই ভয়াবহ পাহাড় আর চ্যারিবডিসের ঘূর্ণির দিকে ভেসে চললাম। চ্যারিবডিস ঘটনাস্থলে তখন জল শোষণ করছিল আর তার ফলে আমি সেই শোষিত জলের সঙ্গে এক বিশাল ডুমুরগাছের শাখায় লেগে শূন্য ঝুলতে লাগলাম। পরে যখন চ্যারিবডিস তার গলাধঃকরণ জল ছড়িয়ে ফেলতে লাগল চারদিকে তখন আমি আবার ঢেউ-এর উপর ভাসতে লাগলাম আগের মত। তবে দেবতাদের কুপায় সিল্লার পাহাড়ের কাছে গিয়ে পড়লেও সিল্লার সঙ্গে দেখা হয় নি। তা হলে সবকিছুর শেষ হয়ে যেত তখন।

নয় দিন নয় রাত্রি এইভাবে সমুদ্র তরঙ্গে তাড়ির হয়ে ইতস্তত ভেসে বেড়াবার পর ক্যালিপসোর আবাসভূমি ওগিজিয়া দ্বীপে এসে পড়ি। মনারীর কণ্ঠস্বরবিশিষ্টা সেই দেবী আমার প্রতি যথেষ্ট দয়া ও মমতা প্রদর্শন করেন। কিন্ত সে কথা সে কাহিনী গতকাল আপনাকে ও আপনার ধর্মপত্নীকে সব বলেছি। কথিত কাহিনীর পুনরুক্তির কোন প্রয়োজন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *