১১. মৃতদের কাহিনী

একাদশ পর্ব
মৃতদের কাহিনী

আমাদের প্রথম করণীয় হলো জাহাজটিকে পোতাশ্রয় থেকে টেনে এনে সমুদ্রের লবণাক্ত জলে ভাসিয়ে দেওয়া। তারপর জাদুকরীপ্রদত্ত ভেড়াগুলোকে জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে জাহাজ ছেড়ে দিলাম। আমাদের প্রত্যেকের চিত্তই ছিল ভারাক্রান্ত। প্রতিটি নাবিকের গণ্ডদ্বয় সিক্ত ছিল অশ্রুজলে। মানবীর মত কণ্ঠস্বর হলেও আসলে যিনি ছিলেন দেবী, সেই জাদুকরী দেবী আমাদের সমুদ্রযাত্রার প্রাক্কালেই এমন এক অনুকূল বাতাস দান করলেন যা অনায়াসে টেনে নিয়ে যেতে লাগল আমাদের নির্বিঘ্নে ।

ক্রমে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর যখন অন্ধকার নেমে এল ধীরে ধীরে তখন আমরা ওসিয়ান নদীতে গিয়ে উপনীত হলাম। সেই ওসিয়ান নদীর ওপারে ছিল এক অনন্ত কুয়াশার নগরী যেখানে সিমারিয়া নামে এক জাতি বাস করত। এক অন্তহীন রাত্রির অবিচ্ছিন্ন অন্ধকার সারা রাত্রিদিন বিরাজ করে সে দেশে। সূর্যের আলো কখনো সে দুর্ভেদ্য কুয়াশার আবরণ ভেদ করে স্পর্শ স্করতে পারে না সে দেশের মাটিকে।

সেই ওসিয়ান নদীর তীরে জাহাজ থামিয়ে জাহাজ থেকে অবতরণ করলাম আমরা। তারপর জাদুকরীর নির্দেশমত আমার সেই নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের অভিমুখে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমার দলের মধ্যে প্রথমে পেরমেদিস ও ইউরিলোকাস দেখতে পায় প্রেতাত্মাদের। আমি তখন জাদুকরীর নির্দেশমত আমার তরবারী বার করে একটি পরিখা খনন করে তার চারপশে দুধ ও দুধের সঙ্গে সুমিষ্ট মদ মিশিয়ে মৃতদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করলাম। তারপর জল ছিটিয়ে মৃতদের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে শপথ করলাম আমি ইথাকায় নিরাপদে ফিরে গিয়ে তাদের একটি অক্ষতযোনি বকনা ও প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে অর্ঘ্য দান করব। তারপর আমি জাহাজ থেকে বলির ভেড়াগুলোকে টেনে তাদের একে একে কাটলাম এবং তাদের রক্ত সব সেই পরিখার মধ্যে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বহু প্রেতাত্মা এসে রক্তের লোভে ভিড় করতে লাগল সেই পরিখার চারপাশে। অবিবাহিত যুবক যুবতী, যুদ্ধক্ষেত্রে অকালে মৃত কত সৈনিকের আত্মা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে আমার কাছে এল। কিন্তু আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আমার লোকদের নিয়ে বলি দেওয়া ভেড়াগুলোর মাংস অগ্নিদগ্ধ করতে লাগলাম। তারপর যখন তারা প্রার্থনা করতে লাগল আমি তখন মুক্ত তরবারি হাতে সেইখানে বসে রইলাম যাতে কোন প্রেতাত্মা পরিখামধ্যস্থিত সেই রক্ত স্পর্শ করতে না পরে। অন্তত তিয়েরিসিয়াসের সঙ্গে আমার কথা হওয়ার আগে কেউ যেন তাতে হাত দিতে না পারে।

সর্বপ্রথমে আমার সামনে এল এলপিনরের প্রেতাত্মা। তার মৃতদেহটি তখনো জাদুকরীর প্রাসাদ প্রাঙ্গণে পড়ে আছে। তাকে সমাধিস্থ না করেই আমরা চলে এসেছি। আমি তাকে দেখে বললাম, আমাদের আসার আগেই কি করে তুমি এখানে এসে পড়লে এলপিনর?

এলপিনর তখন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর করল, হে আমার প্রভু ওডিসিয়াস, আমি সেই জাদুকরীর প্রাসাদে নিদ্রা যাবার আগে কিছু মদ খেয়েছিলাম বলে কোন শয়তান আমার শোচনীয় মৃত্যু ঘটায়। যার ফলে আমি মই দিয়ে না নেমে ছাদ থেকে লাফ দিই। আমার ঘাড়টি ভেঙে যায় আর আমার আত্মা এই মৃত্যুপুরীতে চলে আসে। আমি জানি আপনারা এখান থেকে আপনাদের স্বদেশের পথে রওনা হবেন। আমার তাই একান্ত অনুরোধ আমাকে সেইস্থানে দাহ করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে তবে বাড়ি ফিরবেন। আমার সমাধির উপর আমি জীবিত অবস্থায় যে দাঁড় টানতাম জাহাজে সেই দাঁড় আর আমার বসার বেঞ্চটি স্থাপন করবেন।

আমি তখন উত্তর করলাম, হায় হতভাগ্য এলপিনর, আমি তোমার কোন কথাই ভুলব না। পরিখার একধারে আমি ছিলাম আর একধারে বসে কথা বলছিল এলপিনরের প্রেতাত্মা। তারপর এল আমার মাতা এ্যান্টিক্লীয়া। আমি যখন ট্রয়যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হই তখন তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁকে দেখে আমার চোখে জল এল। আমি বিচলিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু তিয়েরিসিয়াসের সঙ্গে কথা না হওয়া পর্যন্ত আমি কোন প্রেতাত্মাকেই সেই পরিখার মধ্যস্থিত রক্ত স্পর্শ করতে দেব না। অবশেষে একটি স্বর্ণদণ্ড হাতে থীবসদেশীয় সেই জ্যোতিষী এসে গেলেন। তিনি আমাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, হে বুদ্ধিমান ভাগ্যবিড়ম্বিত ওডিসিয়াস, পৃথিবীর উজ্জ্বল স্বর্গলোক ত্যাগ করে কিজন্য তুমি এই চির অন্ধকারে প্রেতপুরীতে এসেছ? এখন তুমি পরিখা থেকে সরে যাও তোমার তরবারি নিয়ে যাতে আমি তোমার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার আগে এই রক্ত পান করতে পারি।

আমি তখন আমার তরবারি কোষবদ্ধ করে সরে গেলাম পরিখা থেকে। অসংখ্য বলির পশু পুঞ্জীভূত সেই রক্ত পান করে তিয়েরিসিয়াসের বিজ্ঞ জ্যোতিষীর মত বলতে লাগলেন, হে ওডিসিয়াস, তুমি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন নিমিত্ত সর্বাপেক্ষা সহজ পথের সন্ধান করছ। কিন্তু স্বর্গের দেবতারা তোমার যাবার পথকে বিপদসঙ্কুল করে তুলতেন চান। বিশেষ করে যে পসেডনের পুত্রকে তুমি অন্ধ করে দিয়েছ তাঁর হাত থেকে তুমি কিছুতেই পরিত্রাণ পাবে না। তথাপি তুমি একদিন তোমার সঙ্গীদের নিয়ে স্বদেশে পৌঁছতে পারবে যদি এখান থেকে জাহাজ ছাড়ার পর থেকে তোমার বিশেষ সংযম পালন করে চলে। বিশেষ করে থ্রিনেসি দ্বীপে উপনীত হয়ে তোমরা যখন দেখবে সেখানকার সমুদ্রতীরবর্তী দ্বীপে সূর্যদেবতার নধর গবাদি পশুগুলো চরে বেড়াচ্ছে তখন যেন তাদের আঘাত করবে না কোনভাবে। যদি তা না করো তাহলে দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও তোমাদের ইথাকা পৌঁছানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আর যদি তোমরা তাদের আঘাত করো তাহলে তুমি তোমার সমস্ত সহকর্মীদের হারিয়ে অতি শোচনীয় অবস্থায় বাড়ি ফিরে দেখবে একদল দুবৃত্ত তোমার প্রাসাদে বসে তোমার অন্ন ধ্বংস করছে আর তোমার স্ত্রীর প্রতি প্রেম নিবেদন করছে। তুমি তাদের যেকোনভাবে বিতাড়িত করতে পারলেও আবার তোমাকে সমুদ্রযাত্রায় বের হতে হবে। যাই হোক, শক্ত দাঁড় নিয়ে যাত্রা শুরু করো। পথে এমন এক জাতি দেখতে পাবে যারা কখনো জাহাজ দেখেনি এবং যারা লবণের ব্যবহার জানে না। তারপর এক পথিকের দেখা পাবে যে তোমার কাঁধে ঝোলানো পাখার কথা বলবে এবং সেইসময় তুমি ভূকম্পন দেবতা পসেডনের উদ্দেশ্যে একটি মেষ, একটি বলদ আর একটি শূকরী বলি দেবে। তারপর বাড়ি গিয়ে অমর দেবতাদের উদ্দেশ্য অর্ঘ্য দান করবে।

আর যদি তোমার নিজের কথা জানতে চাও তাহলে জেনে রেখো, তোমার মৃত্যু সমুদ্রমাঝেই হবে স্বাভাবিকভাবে। যথাসময়ে বার্ধক্যকালে সহানুভূতিশীল একদল উন্নত বন্ধু-পরিজনের মাঝে মৃত্যু ঘটবে তোমার।

আমি তখন বললাম, আমার এই ভাগ্য যে দেবতাদের বিধানে নির্দিষ্ট হয়েছে সেবিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আর একটি কথা জানতে চাই আমি। আমি এই পরিখার পাশে আমার মাতার আত্মাকে দেখলাম। কিন্তু তিনি কোন কথা বলতে পারছেন না। আমাকে বলুন তাঁকে আমার পরিচয় দান করার কি কোন উপায় আছে?

তিয়েরিসিয়াস বললেন, এতো সহজ কথা। যেসব প্রেতাত্মা পরিখার পাশে রক্তের লোভে ভিড় করেছে তাদের রক্ত পান করতে দিলেই তারা মানুষের মত যুক্তপারম্পর্যসহ কথা বলবে। যাদের প্রত্যাখ্যান করা হবে তারা নীরবে চলে যাবে।

এই কথা বলে চলে গেলেন তিরেসিয়াস। আমি কিন্তু তখনো সেই পরিখার পাশে আমার মাতার আত্মার আশায় বসে রইলাম। অবশেষে আমার মাতার আত্মা এসে সেই পরিখা হতে কৃষ্ণবর্ণ রক্ত পান করে আমাকে বললেন, জীবিত অবস্থায় তুমি কেমন করে এখানে এলে? এখানে তো কোন জীবিত মানুষ আসতে পারে না। কারণ তোমাদের মত জীবিত মানুষ আর আমাদের মত মৃত মানুষদের মাঝখানে নিরন্তর বয়ে চলেছে এক শঙ্কার ভয়াল নদী আর এক অন্তহীন মহাসমুদ্র। তুমি কি ট্রয় থেকে আসছ? তুমি কি এখনো ইথাকায় গিয়ে তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারনি?

আমি উত্তর করলাম, এখানে না এসে আমার কোন উপায় ছিল না মা। যেদিন আমি ট্রয়যুদ্ধে যোগদানের জন্য রাজা অ্যাগামেমননের সঙ্গে রওনা হই বাড়ি থেকে সেদিন হতেই শুরু হয় আমার দুঃখ আর বিড়ম্বনা। যাই হোক, এবার তোমার কি করে মৃত ঘটল তা বল। কোন রোগভোগের ফলে না আর্তেমিসের শরে মৃত্যু ঘটেছে। তোমার। আমার পিতা ও পুত্র কেমন আছে বল। আমার রাজ্য কি অক্ষত আছে? আমার স্ত্রীর বর্তমান মানসিক অবস্থায় কি? সে কি আমার পুত্রের কাছেই আছে না অন্য কাউকে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে?

আমার মাতা তখন উত্তর করলেন, তোমার স্ত্রীর তোমার প্রাসাদে না থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সে ধৈর্য্যে বুক বেঁধে আজও প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্য। রাজ্যের ভার এখনো তোমার পুত্র টেলিমেকাসের হাতেই আছে। তবে তোমার পিতা তোমার দুঃখে নগর ত্যাগ করে দূর গ্রাম খামারবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অতিশয় সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে তোমার জন্য আত্মনিগ্রহ করে চলেছেন। আমার মৃত্যুর কারণ হলো বার্ধক্য আর তোমার জন্য দুশ্চিন্তা।

আমার মাতার আত্মা যখন কথা বলছিল তখন আবেগের সঙ্গে তাঁকে তিন তিনবার জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনবারই ছায়ার মত অদৃশ্য হয়ে গেল সে আত্মা। আমি তখন আমার মার আত্মাকে বললাম, দুঃখের মধ্যেও এক শীতল সান্ত্বনা পাবার আশায় যখনি আমি তোমাকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছি তখনি আমাকে কেন তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ মা? তবে কি তুমি পার্সিফোনে প্রেরিত এক অলীক ছায়ামাত্র, আমার মনের দুঃখ বাড়াবার জন্য এসেছ, তবে কি তুমি আমার মা নও?

আমার মাতার আত্মা উত্তর করল, মৃত্যুপুরীর এটাই নিয়ম। এটা জিয়াসকন্যা পার্সিফোনের কোন ছলনা নয়। কারো দেহ হতে প্রাণশক্তি নির্গত হলে তার অস্থিমজ্জা মাংস কিছুই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তার বিদেহী আত্মা তখন বাতাসে বেড়াতে থাকে। কিন্তু বিলম্ব না করে তুমি চলে যাও মর্ত্যভূমির মাঝে সেখানে গিয়ে তোমার পত্নীকে একদিন একথা বলবে।

আমার মার আত্মার সঙ্গে যখন আমার এইভাবে কথা হচ্ছিল তখন পার্সিফোনের নির্দেশে বহু সম্ভ্রান্তবংশীয় মৃত নারীর আত্মা রক্তের আশায় সেই পরিখার আশেপাশে ভিড় করতে লাগল। আমি আমার সেই বৃহৎ তরবারি সঞ্চালন করে বললাম, তারা যেন একসঙ্গে সকলে রক্ত পান না করে। ফলে সেইসব প্রেতাত্মারা একে একে আসতে লাগল। আমার সামনে এবং আমি তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম। পূর্বজন্মে এইসব নারীরা প্রত্যেকেই ছিল হয় কোন রাজার কন্যা অথবা স্ত্রী।

প্রথমে আমার সামনে যে এল সে হলো সামমোলেউসের কন্যা টাইরো। ঈয়ালাসপুত্র ক্রেথিয়াসকে যে বিবাহ করে। পরে সে এলিপেউস নদীর দেবতার প্রেমে পড়ে এবং সেই সুন্দর নদীতীরে বেড়াত সে। একদিন ভূকম্পনকারী ও ভূবেষ্টনকারী দেবতা পসেডন সেই নদীদেবতার ছদ্মবেশে তার সামনে এসে তার সঙ্গম প্রার্থনা করে। সঙ্গে সঙ্গে পর্বতপ্রমাণ এক কৃষ্ণকুটিল তরঙ্গ তাদের আচ্ছন্ন এবং অপরিদৃশ্য করে তোলে। সেই বিশাল তরঙ্গাচ্ছাদনের মাঝে পসেডন টাইরোকে আলিঙ্গন করে তার কটিদেশের নীবিবন্ধন খুলে দিলেন। তারপর তার চোখদুটিকে তন্দ্রাভিভূত করে দিয়ে আপন কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করলেন পসেডন। টাইরোকে অবশেষে জাগিয়ে তার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে পসেডন বললেন, আমাদের প্রেমমিলনে আনন্দ অনুভব করো। দেবতাদের আলিঙ্গন বা সঙ্গম কখনো বৃথা যাবার নয়। আজ হতে এক বছর পরে তুমি দুটি সন্তান প্রসব করবে। তুমি যেন তাদের যত্নসহকারে লালন পালন করো। আপাতত বাড়ি ফিরে যাও, কিন্তু কাউকে কোন কথা বলো না। কিন্তু আমি তোমাকে জানাচ্ছি তোমার অবগতির জন্য। আমি হচ্ছি ভুকম্পনদেবতা পসেডন। এই বলে পসেডন অদৃশ্য হয়ে যান সমুদ্রতরঙ্গের অন্তরালে। এক বৎসর পরে যথাসময়ে টাইরো পেলিয়াস ও নেলেউস নামে দুটি পুত্রসন্তান প্রসব করে। পেলিয়াস বাস করত পশুপালনসমৃদ্ধ দেশ আইলোসে আর নেলেউস বাস করত বালুকাময় দেশ পাইলসে। ক্রেথিয়াসের ঔরসেও তিনটি সন্তানের জন্ম জন্ম হয় টাইরোর গর্ভে। তারা হলেন ঈসন, ফেরেস ও অ্যামাইথাওন।

এরপর আমার সামনে এল এসোপাসকন্যা অ্যান্টিওপের আত্মা। সে একবার জিয়াসের অঙ্কশায়িনীরূপে তার সঙ্গে সঙ্গম করে। তার ফলে অ্যাম্ফিয়ন ও জেয়াস নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। এই দুই বীর সন্তানই পরবর্তীকালে এক বিশাল প্রাচীর দ্বারা গীবস নগরী সুরক্ষিত করে।

অ্যান্টিওপের পর এল অ্যাফিলিয়ানের স্ত্রী এ্যানকুমেনির আত্মা। সেও একবার জিয়াসের সঙ্গে এক সুরতশয্যায় শয়ন করে সিংহহৃদয় বীর সন্তান হেরাকলস-এর জন্ম দান করেন। ক্রীওনকন্যা মীগোবারকেও দেখলাম।

তারপর আমি দেখলাম ঈডিপাসমাতা সুন্দরী এপিকান্তেকে। এপিকান্তে না জেনে তার আপন পুত্রকে বিবাহ করে গভীর পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত হন। ইডিপাসও না জেনে তার পিতাকে হত্যা করে তার মাতাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। পরে দেবতাদের বিধানে প্রকৃত ঘটনা তাদের গোচরীভূত হয় এবং ঈডিপাসের মাথার উপর নেমে আসে এক কঠোর শাস্তির বোঝ। কারণ এপিকাস্তে একথা জানতে পাবার পর গলায় দড়ি দিয়ে উদ্বদ্ধনে আত্মহত্যা করে। ফলে ঈডিপাস এক সীরস রাজ্যের রাজারপে সারাজীবন মর্মজ্বালায় তিলে তিলে দগ্ধ হতে থাকে। এইভাবে একই সঙ্গে দৈবশাস্তি আর মাতৃ-অভিশাপের বোঝা একা বহন করে যেতে থাকে ঈডিপাস।

এরপর এল সবচেয়ে সুন্দরী ক্লোরিস। ক্লোরিস ছিল এ্যাস্ফিয়নের কন্যা ও নেলেউসের স্ত্রী। পাইলরাজ নেলেউস ক্লোরিকে বিবাহ করার ফলে নেস্টর ক্রোমিয়াস ও পেরিক্লাইমেনাস নামে তিনটি পুত্র ও পীরো নামে এক পরমাসুন্দরী কন্যার জন্ম হয়। পীরেকে বহু যুবক বিবাহ করতে চাইল। কিন্তু নেলেউস ঘোষণা করলেন যে ইফিকলস-এর এক বিরাট ভেড়াকে ফাইলেসে উত্তোলন করতে পরবে তারই সঙ্গে তার কন্যার বিবাহ দান করবেন।

তারপর আমি দেখলাম তিনপারিয়াসপত্নী মেদিকে। যাদের বিবাহের ফলে ক্যাস্টর ও পলিডিউসেস নামে দুই যমজ সন্তানের জন্ম হয়। জিয়াসের দয়ায় দুই সন্তানের একজন জীবিত ও একজন মৃত এই অবস্থায় ধরাপৃষ্ঠ ও মৃত্যুপুরীতে কাল যাপন করে চলেছে।

এরপর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আলোয়াসপত্নী ইফিমেদিয়ার উপর। ইফিমেদিয়া বলল, তার সঙ্গে ভূকম্পনকারী দেবতা পসেডন সঙ্গম করেন এবং তার ফলে ওটাস ও ইকিয়ানটেস নামে দুই সুন্দর পুত্রের জন্ম হয়। মাত্র নয় বছর বয়সে তারা এতদূর লম্বা চওড়া হয়ে ওঠে যে তারা তাদের সমরবিদ্যা ও সামরিক তৎপরতার দ্বারা স্বর্গের দেবতাদের ভীত করে তোলে। এই দুই বীর সন্তান চেয়েছিল অলিম্পাস পর্বতের উপর ওসা পর্বত ও তারপর ওসা পর্বতের উপর পেলিয়ন পর্বতকে চাপিয়ে মর্ত্য থেকে সুদূর স্বর্গলোক পর্যন্ত এক সিঁড়ি নির্মাণ করে স্বর্গগমনের পথকে সহজ করে তুলতে। কিন্তু লিটার গর্ভে হাত এক পুত্র তাদের সে বাসনা বিনষ্ট করে দেয় অঙ্কুরে।

তারপর আমি একে একে দেখলাম কেন্দ্রে প্রেক্রিস ও সুন্দর অ্যারিয়াদনের আত্মাকে। সুন্দরী অ্যারিয়াদনে ছিল জাদুকরী মাইনসের কন্যা যাকে একবার থিয়াস ক্রীট থেকে এথেন নগরীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু থিয়াসের সে মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি, কারণ ডাইওনিয়াস একথা আর্তেমিসকে জানাতেই আর্তেমিসের শরে নিহত হন অ্যারিয়াদনে।

ক্রমে এল মেরা, ক্লাইমেনি ও ঘৃণ্য এরিফাইলের প্রেতাত্মা। এরিফাইলে জীবিত অবস্থায় স্বামীর জীবনের বিনিময়ে বিলাসজীবন বেছে নেয়।

এইভাবে যেসব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির পত্নী ও কন্যাদের আত্মা ভিড় করে আসে আমার কাছে তাদের সকলের কথা ও কাহিনী বলার সামর্থ্য আমার নেই। সেসব কথা বলতে গেলে একটি গোটা রাত্রি পার হয়ে যাবে।

আমি আপনার প্রাসাদেই থাকি অথবা আমার নাবিকদের কাছে জাহাজে গিয়েই রাত্রি যাপন করি, এখন নিদ্রা যাবার সময় হয়েছে। আমার প্রত্যাবর্তনের যাত্রার সব ভার আপনার ও দেবতাদের উপর ছেড়ে দিলাম।

এইকথা বলে থামলেন ওডিসিয়াস। তাঁর মুখনিঃসৃত এই দীর্ঘ কাহিনী উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে এমন এক আবেগ সঞ্চার করেছিল সে সেই বিশাল ছায়াছন্ন কক্ষে কেউ বিন্দুমাত্র শব্দ করে নি। সকলেই স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ওডিসিয়াসকথিত সেই আশ্চর্য কাহিনী। অবশেষে রানী এ্যারিতে সে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, হে ফেসীয় দলপতিগণ, এবার তো তোমরা তোমাদের এই অতিথির আসল পরিচয় জানতে পারলে। উনি শুধু আমাদের অতিথি নন, উনি আমাদের সমগ্র জাতির অতিথি ও সম্মানের পাত্র। ওঁকে তাড়াহুড়া করে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত হবে না।

বয়োপ্ৰবীণ দলপতি অ্যাকেনিয়াস বললেন, বন্ধুগণ, আমাদের রাণীর নিকট হতে এই ধরনের পরামর্শই আশা করেছিলাম। অবশ্য এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন রাজা অ্যালসিনোয়াস।

রাজা অ্যালসিনোয়াস তখন ইতস্তত না করে বললেন, তাই হবে। তবে আমার অতিথির কাছে আমার অনুরোধ তিনি যেন তাঁর গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুলভাবে কিছু খর্ব করে আগামীকাল এখানে অবস্থান করেন যাতে আমি আমার উদারতা প্রদর্শনের পরিকল্পনাটিকে কার্যে পরিণত করতে পারি। তাঁর স্বদেশযাত্রার ব্যবস্থা করা আমাদের সমগ্র জাতির করণীয় কর্তব্য। যেহেতু আমি এ রাজ্যের রাজা, আমার দায়িত্ব এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি।

ওডিসিয়াস তখন বললেন, হে শ্রদ্ধেয় রাজন অ্যালসিনোয়াস, যদি আপনি আমাকে প্রচুর মূল্যবান দ্রব্যসম্ভার উপহার হিসেবে দান করেন, আপনি যদি আমার নিরাপদ স্বদেশযাত্রার ব্যবস্থা করেন তাহলে একদিন কেন আপনি আমাকে এখানে এক বছর অবস্থান করার জন্যও অনুরোধ করতে পারেন। প্রচুর ধনদৌলত সহ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলে সকলের কাছ থেকেই আমি পাব অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা আর সাদর সম্ভাষণ।

অ্যালসিনোয়াস বললেন, শুনুন ওডিসিয়াস, যেসব প্রতারক ও ভণ্ড মিথ্যাবাদীর দল মিথ্যার সুতো দিয়ে অলীক কাহিনীর জাল বুনে চলে এবং যাদের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রচুর, আমরা কখনো আপনাকে তাদের একজন হিসেবে ভাবতে পারি না। উল্টে বরং আপনার বিবৃত কাহিনী শুধু আমাদের আনন্দ দানই করে নি, আপনার বিচারবুদ্ধিরও পরিচয় দিয়েছেন। আপনি আপনার বিদপসঙ্কুল যেসব ভ্রমণবৃত্তান্ত ও সহকর্মীদর কাহিনী যে নৈপুণ্য ও বাকচাতুর্য সহকারে ব্যক্ত করেছেন তা একমাত্র সুদক্ষ চারণকবিদের দ্বারাই সম্ভব। আমি আপনাকে এই ধরনের আরও কাহিনী ব্যক্ত করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনি বলুন, আপনার সেইসব সহকর্মীর কথা যারা ইলিয়াম নগরী অভিযানকালে আপনার সঙ্গী হয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। রাত্রি দীর্ঘ এবং নিদ্রাকালে এখনো সমাগত হয় নি। আমার অনুরোধ, ঊষাকাল সমুপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত আপনি আপনার আশ্চর্য কৃতিত্বের কাহিনী এই প্রাসাদস্থ কক্ষের মধ্যে অবস্থান করেই বিবৃত করে যান।

রাজার এই অনুরোধবশত ওডিসিয়াস পুনরায় শুরু করলেন তাঁর কাহিনী। তিনি বললেন, হে শ্রদ্ধেয় রাজা অ্যালসিনোয়াস, যদিও আমাদের নিদ্রাকাল সমুপস্থিত তথাপি আপনার অনুরোধ আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমি আমার এক সহকর্মী যোদ্ধার সকরুণ কাহিনী বিবৃত করব যিনি ট্রয়যুদ্ধে জয়ী হবার পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে প্রাণ হারান। তিনি ভয়ঙ্কর ট্রয়যুদ্ধের সমস্ত বিপদ অতিক্রম করে অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে তাঁর অবিশ্বস্ত স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে অকালে প্রাণ হারাতে হয় তাঁকে।

অবশেষে পার্সিফোনে যখন আমার সেই রক্তগর্ভ পরিখার পাশ থেকে নারী প্রেতাত্মাদের সব বিতাড়িত করে দিল তখন আমার কাছে এল আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমননের আত্মা। তার চারপাশে ছিল সেই সব হতভাগ্যের আত্মা যারা তাঁরই সঙ্গে এজিসথাসের হাতে প্রাণ হারায়। অ্যাগামেমননের আত্মা আমার সেই পরিখা হতে কৃষ্ণরক্ত পান করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চিনতে পেরে দুঃখে আর্তনাদ করে উঠলেন। আমাকে আলিঙ্গন করার জন্য দুহাত বাড়িতে কেঁদে ফেললেন তিনি। কিন্তু হায়, তা হবার নয়, কারণ প্রাণবিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সব শক্তিই হারিয়ে ফেলে মৃতেরা। সে দৃশ্য দেখেও আমি বিচলিত হয়ে উঠলাম। অপূর্ণ হয়ে উঠল আমার চোখ। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি বললাম, সে মহান রাজা আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমনন, বল আমায় কিভাবে তুমি এই শোচনীয় পরিণতি লাভ করলে? প্রত্যাবর্তন পথে পসেডন কি কোন প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি করে তোমার অর্ণবপোত ধ্বংস করে দেন অথবা কোন শত্রুভাবাপন্ন উপজাতির সঙ্গে কোন বিষয় নিয়ে যুদ্ধ করার সময় মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হও তুমি।

অ্যাগামেমনন তখন উত্তর করলেন, হে লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াস, পসেডন কোন ঝড়ের সৃষ্টি করেন নি আমার পথে অথবা আমি কোন বন্য উপজাতির শত্রুতারও সম্মুখীন হই নি। আমার পাপিষ্ঠা স্ত্রীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এজিসথাসই আমার মৃত্যু ঘটায়। সে আমাকে তার প্রাসাদে আক্রমণ করে। ভোজসভায় প্রথমে আমার আপ্যায়িত করে। কিন্তু তারপর পশুর মত আমাকে হত্যা করে। কোন বিবাহোৎসব বা ভোজসভার জন্য তেমন শুভ্রদন্তবিশিষ্ট শূকরদের বধ করা হয় তেমনি আমার প্রহরীদেরও হত্যা করা হয়। ওডিসিয়াস, তুমি দ্বৈত বা সমবেত যুদ্ধে নিহত বহু সৈনিকের মৃত্যু দেখেছে, কিন্তু সেই ভোজসভার কক্ষটিকে রক্তে প্লাবিত করে ভোজের টেবিল ও পানপাত্রের পাশে ভূতলশায়ী হয়ে যে শোচনীয় মৃত্যু আমি বরণ করি তেমন মৃত্যু কোথাও কখনো দেখ নি তুমি। তবে প্রিয়ামকন্যা ক্যাসান্ড্রার মৃত্যু সবচেয়ে মর্মন্তুদ। আমার বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রী ক্লাইতেমেস্ত্রা আমার সামনেই হত্যা করে ক্যাসান্ড্রাকে। আমি তখন মুমূর্ষ অবস্থায় ভূতলে শায়িত থাকলেও তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সে তা মানে নি। যদিও তখন আমি ছিলাম মৃত্যুপথযাত্রী তথাপি সে আমার মুখে বা চোখে একবার হাত পর্যন্ত দেয় নি। পাশবিকতা ও অবিশ্বস্ততার দিক থেকে পৃথিবীর কোন নারীই তার পক্ষে তুলনীয় হতে পারে না। এমন কোন নারী আছে যে তার স্বামীকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করার কল্পনা করতে পারে? হায়, আমি ভেবেছিলাম এতদিন পর বাড়ি ফিরছি, আমার পরিবারবর্গের কাছ থেকে এক সাদর অভ্যর্থনা লাভ করব। কিন্তু তার এই জঘন্য পাপকর্ম ও সুগভীর শয়তানির দ্বারা ক্লাইতেমেস্ত্রা শুধু নিজেকে নয়, চিরকালের জন্য সমগ্র নারী জাতিকেই এক অনপনেয় কলঙ্কের কালিমায় চিহ্নিত করে দিয়েছে।

আমি তখন বললাম, হায়, সর্বশক্তিমান জিয়াস যেন সমগ্র আত্রেউস পরিবারের উপর এক নির্মম অভিশাপ বর্ষণ করে চলেছেন ক্রমাগত। প্রথম থেকেই দেখা যাচ্ছে এই পরিবারের নারীদের কুটিল চক্রান্তের জন্যই ধ্বংস নেমে আসছে এই পরিবারে। হেলেনের জন্য কত লোককে মৃত্যুবরণ করতে হলো। আবার ক্লোইতেমেস্ত্র তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে এক জঘন্য ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করল তার স্বামীর বিরুদ্ধে।

অ্যাগামেমনন উত্তর করলেন, আর এই ঘটনা থেকে তুমিও শিক্ষা পেতে পার। তোমার স্ত্রীর প্রতি কখনো খুব বেশি দুর্বলচিত্ত হবে না, তাকে বিশ্বাস করে তোমার মনের সব কথা বলবেও না। অবশ্য তার মানে এই নয় যে তোমার স্ত্রীও তোমায় হত্যা করবে। সেদিক দিয়ে আইকারিয়ানকন্যার অন্তঃকরণ পবিত্র এবং বিচারবুদ্ধি দৃঢ়। বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতায় পেনিলোপ সত্যিই অদ্বিতীয়া। আমরা যখন যুদ্ধযাত্ৰা করি তখন সে নিতান্ত তরুণী ছিল বয়সে। তার কোলে ছিল এক শিশুপুত্র। আমার মনে হয় এখন সেই শিশুই পরিণত হয়েছে পূর্ণবয়স্ক মানুষে। তোমার সে পুত্র সত্যিই ভাগ্যবান। তার প্রিয়তম পিতা একদিন বাড়ি ফিরবেই এবং সে তার পিতাকে চুম্বন করবে। আর আমার স্ত্রী আমার পুত্রকে একবার চোখে দেখতেই দিল না আমার বাড়ি ফেরার পর। এখন তোমার প্রতি আমার এক পরামর্শ আছে। আশাকরি তা মেনে চলবে। তুমি কখনো সরাসরি আর বন্দরে গিয়ে উঠবে না। গোপনে সেখানে গিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবে। কোন নারীকেই বিশ্বাস করা যায় না সম্পূর্ণরূপে। কিন্তু আমার পুত্রের খবর কিছু জান? সে এখন কোথায় বাস করছে? তবে এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে সে এখনো জীবিত আছে, কারণ তার মৃত্যু হলে সে এখানেই আসত।

আমি উত্তর করলাম, হে আত্রেউসপুত্র, কেন তুমি আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করছ? সে জীবিত কি মৃত সে-বিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। তোমাকে বাজে ভিত্তিহীন কথা বলে তো কোন লাভ নেই।

এইভাবে দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বললাম আমরা অনেকক্ষণ ধরে। আমাদের দুজনেরই চোখ থেকে অনেক জল ঝরে পড়ল মাটিতে। তারপর আমার কাছে এল পেলেউসপুত্র অ্যাকেলিস আর প্যাট্রোক্লাসের আত্মা। অ্যাকেলিসের আত্মা আমাকে চিনতে পেরে বলল, কী খবর বীর ওডিসিয়াস? এখানে আবার তোমার কোন বীরত্বের পরিচয় দিতে এসেছ? যেস্থান শুধু বিদেহী প্রেতাত্মাদের দ্বারা অধ্যুষিত সেই মৃত্যুপুরীতে কোন সাহসে এসেছ তুমি জীবিত অবস্থায়?

আমি বললাম, হে গ্ৰীকবীরচূড়ামণি পেলেউসপুত্র, আমি এখানে এসেছি তিয়েরিসিয়াসের সঙ্গে আমার বাড়ি ফেরার পথ সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আমি এখনো পার্বত্য ইথাকার পথের কোন সন্ধান পাই নি, একিয়ার কাছেও যেতে পারি নি। তুমি সত্যিই কত ভাগ্যবান আমার তুলনায়। জীবিতকালে তুমি আমাদের কাছ থেকে পেয়েছ দেবদুর্লভ সম্মান আর মৃত্যুর পরেও তুমি এই মৃত্যুপুরী মাঝে রাজকীয় সম্মানে অধিষ্ঠিত। মৃত্যু আজ পর্যন্ত কোন যন্ত্রণার হুল ফোঁটাতে পারে নি তোমার মধ্যে।

অ্যাকেলিস বললেন, মৃত্যুর প্রশংসা আর আমার কাছে করো না ওডিসিয়াস। আমাকে তুমি পৃথিবীপৃষ্ঠে নিয়ে চল। সেখানে আমি কোন দরিদ্র ভূমিহীন মানুষের বাড়িতে দাস হয়ে থাকব তবু এই মৃত্যুপুরীতে মৃত প্রেতাত্মাদের মাঝে রাজত্ব করতে চাই না। এখন আমার পুত্রের কোন খবর জান তো বল। আমার পিতা পেলেউসের কোন খবর জান কি? মার্মিডনরা কি আজও তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে অথবা বার্ধক্যের জন্য তাঁকে ঘৃণা করে? আমার যে শক্তিধর বাহুর দ্বারা আমি ট্রয়ের বিশাল রণপ্রান্তরে বহু শত্রুকে নিধন করি সে বাহুর দ্বারা এখন মর্ত্যলোকে গিয়ে আমার পিতাকে কোন শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারব না। অথচ আমি একবার আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হতে পারলে আমার অপরাজেয় বাহুবলের সামনে সন্ত্রাসে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ত তাঁর অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকারী শত্রুরা।

আমি অ্যাকিলিসকে বললাম, পেলেউসের কোন খবর আমি জানি না। তবে তোমার পুত্র নিওটলেমাসের খবর আমি তোমায় বলব। আমি তাকে স্কাইরাস থেকে এনে গ্রীকদলে যোগদান করাই। ট্রয়নগরীর সম্মুখস্থ প্রান্তরে আমরা যখন যুদ্ধের পরিকল্পনা করতাম সে আমাদের সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে আলোচনাসভায় যোগদান করত এবং যুদ্ধকালে সে সব সময় সম্মুখসারিতে যুদ্ধ করত বীরত্বের সঙ্গে। তার অপরাজেয় গৌরব কারো কাছে মাথা নত করে নি। তার তরবারির অব্যর্থ আঘাতে অনেক বীরেরই প্রাণবিয়োগ ঘটে। তাদের মধ্যে টেলিফাসপুত্র ইউরিপাইলাসের কথা আমার সবচেয়ে বেশি করে মনে আছে। আবার এপিয়াসনির্মিত সেই বিশাল কাঠের ঘোড়াটির মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম আমরা যখন তখন বহু গ্রীক দলপতির পা কাঁপছিল এবং তারা চোখের জল মুছছিল। কিন্তু একমাত্র তোমার পুত্র লিওটলেমাসের মুখ কখনো আমি ভয়ে মলিন হতে দেখি নি। উপরন্তু সে তার মুক্ত তরবারি ও বর্শা নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেই ঘোড়া থেকে ট্রয়বাসীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকে আমাকে। ট্রয়নগরী ধ্বংস করার পর লুণ্ঠিত ধনরত্নের মধ্যে তার প্রায় অংশ সে অক্ষত দেহে নিরাপদে তার জাহাজে নিয়ে ওঠে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য। রণদেবতা সাধারণত রণাঙ্গণে যোগদানকারী কোন মানুষকে অক্ষত রাখেন না। কিন্তু শত্রুপক্ষের কোন তীর বা তরবারির কোন আঘাতই কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি তোমার পুত্রকে।

আমার কথা শেষ হলে তার পুত্রের সুসংবাদে আনন্দিত হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন অ্যাকেলিস।

এইভাবে আমাকে তাদের প্রিয়জনদের সম্পর্কে নানারূপ প্রশ্ন করে অনেক প্রেতাত্মা চলে গেল একে একে। কিন্তু তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স আমার কাছে এসে কোন প্রশ্ন করল না। আমি তখন বললাম, অ্যাকেলিসের পক্ষ অবলম্বন করে আমি একবার গ্রীক জাহাজে তোমাকে পরাস্ত করি। তুমি কি মৃত্যুর পরেও সেই রাগ ভুলতে পার নি? তোমার মৃত্যুর জন্য দেবরাজ জিয়াস ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। যে জিয়াস বরাবর গ্রীকদের প্রতি অকারণে বিরূপ ছিলেন সেই জিয়াসের নির্দয়তার ফলে তোমার মত এক শক্তিমান পুরুষকে হারায় গ্রীকরা। এখন ক্রোধ ও অহঙ্কারকে জয় করো।

কিন্তু অ্যাজাক্স আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে নীরবে চলে গেল মৃতদের মাঝে।

তারপর আমি সেখানে দেখলাম জিয়াসপুত্র মাইনসকে। একটি স্বর্ণদণ্ড হাতে করে মৃতদের মাঝখানে বিচারকার্য সম্পন্ন করছিল সে। অসংখ্য মৃত আত্মা বিভিন্ন রকমের অভিযোগ এনেছিল তার কাছে আর সেইসব অভিযোগের ক্রমঅনুসারে তার বিচারের রায় দান করছিল মাইনস। তারপর আমি দেখলাম শিকারী দৈত্য ওচিয়নকে। সে জীবিতকালে বহু পশু বধ করে।

এরপর আমি দেখলাম ধরিত্রীপুত্র টিটিয়সকে। দেখলাম সে মাটিতে শুয়ে রয়েছে আর তার দুপাশে দুটি শকুনি তাদের দীর্ঘতীক্ষ্ণ ওষ্ঠ দুটি তার উদরমধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করে তার যকৃতটাকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। অথচ হাতগুলো এমনই অসাড় যে সে তাদের তাড়াতে পারছে না। একবার অন্যতমা জিয়াসপত্নী লিটোকে সে আক্রমণ করেছিল বলেই নরকে এই নিরারুণ শাস্তি ভোগ করতে হয় তাকে।

তারপর আমি দেখলাম কি এক ভয়াবহ বেদনা প্রতিমুহূর্তে সহ্য করতে হচ্ছে ট্যান্টালাসকে। দেখলাম বৃদ্ধ ট্যান্টালাস দাঁড়িয়ে আছে একগলা জলের মধ্যে। অথচ তীব্র পিপাসায় তার বুক ফেটে গেলেও একবিন্দু জল সে পান করতে পারছে না। কারণ যতবারই সে জল পান করার জন্য হাত বাড়াচ্ছে ততবারই সে জল শুকিয়ে যাচ্ছে নিঃশেষে, শুধু দেখছে কোথাও জল নেই, শুধু তার পদতলে উদাসী পৃথিবীর এক নির্মম কৃষ্ণমৃত্তিকা অন্তহীন শুষ্কতায় প্রসারিত হয়ে আছে তার চারদিকে। তার মাথার উপরে আপেল ডালিম, ডুমুর, অলিভ প্রভৃতি গাছে কত সুন্দর সুন্দর ফল ধরে রয়েছে। অথচ অসংখ্য ক্ষুধা তার পেটের ভিতরে আঁচড় কাটতে থাকলেও একটা ফলও সে হাত বাড়িয়ে পাচ্ছে না। কারণ যখনই সে কোন ফলের দিকে হাতটি বাড়িয়ে দিচ্ছে তখনই বাতাস এক নিষ্করুণ তীব্রতায় প্রবল হয়ে সেই ফলধৃত বৃক্ষ শাখাঁটিকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছায়াচ্ছন্ন মেঘমালার রাজ্যে।

তারপর আমি দেখলাম সিসিফাসের পীড়ন। সিসিফাসের কাজ ছিল একটা বিশাল ভারী পাথরকে মাটি থেকে তুলে একটি পাহাড়ের মাথার উপর নিয়ে যাওয়া। কিন্তু যতবারই সে তার হাত পায়ের সাহায্যে কোনরকমে সেই পাথরটিকে ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে তার শিখরদেশে উপনীত হচ্ছিল, ততবারই তার প্রাণান্তকর প্রয়াসকে ব্যর্থ করে আপন ভারের গুরুত্বে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল সেই নিষ্ঠুর পাথরটি। কিন্তু ঘর্মাক্ত কলেবর ক্লান্ত অবসন্ন দেহে আবার পা বাড়াতে হচ্ছিল তাকে সেই ব্যর্থ প্রচেষ্টা পথে। আবার সেই পাথরটিকে প্রাণপণ শক্তিকে বুকে ধরে পাহাড়ে উঠতে হচ্ছিল সিসিফাসকে।

তারপর আমি দেখলাম হেরাকলসকে। জিয়াসপুত্র হেরাকলস যদিও অমর দেবতাদের সঙ্গে তার স্ত্রী হেরেকে নিয়ে স্বর্গলোকে বাস করেছেন তথাপি তার প্রেতাত্মা মৃত্যুপুরীতে তীর ধনুক হাতে প্রহরা দিচ্ছে। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মৃতেরা সন্ত্রাসে পালিয়ে যাচ্ছে। হেরাকলস-এর মুখখানা রাত্রির মত কালো ও গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তার বুকের উপর ছিল নানারূপ শিকারী জীবজন্তুর ছবি আঁকা এক ধাতব বক্ষাবরণী। আমার মুখপানে একবার তাকিয়ে হেরাকলস বলল, তুমিও এই মৃত্যু আর ধ্বংসের জগতে? আমি জিয়াসপুত্র হলেও জীবনে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয় আমাকে। আমাকে একবার বিধির বিধানে আমার থেকে হীন একটি লোকের দাসত্ব করতে হয় আর সে আমাকে এখানে মৃত্যুপরীতে প্রহরী হিসেবে পাঠায়।

হেরাকলস এই বলে মৃত্যুপুরীর মধ্যে চলে গেল। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেলাম। অতীতে মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার দেখা হবে এই আশায় আমি বসে রইলাম সেই পরিখার পাশে। বিশেষ করে থিসিয়াস ও পেরিঘোয়াসকে আমার দেখতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু আমার আগে দলে দলে অসংখ্য মৃত আত্মা আমার কাছে এসে তীব্র চিৎকার ফেটে পড়ল। গর্গণের মাথার মত বিকটাকার কিছু একটা পার্সিফোনে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে এই ভয়ে আমি সেই মৃত্যুপুরী থেকে বাইরে এসে আমার জাহাজে গিয়ে উঠলাম। নাবিকরা আমার আদেশে জাহাজে উঠে জাহাজ ছেড়ে দিল। অনুকূল বাতাসের সাহায্য পেয়ে জাহাজটি শীঘ্রই ওসিয়ান নদীতে গিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *