০৯. সাইক্লোপ জাতি

নবম পর্ব
সাইক্লোপ জাতি

রাজা অ্যালসিনোয়াসের অনুরোধক্রমে তার কাহিনী শুরু করলেন ওডিসিয়াস। তিনি বললেন, হে শ্রদ্ধেয় রাজা অ্যালসিনোয়াস, দেবোপম কণ্ঠবিশিষ্ট আমার এই চারণকবির সঙ্গীত শ্রবণ করা সত্যিই আনন্দের কথা। যখন কোন ভোজসভার টেবিলগুলো প্রচুর ভোজ্যদ্রব্যে পরিপূর্ণ থাকে এবং রুটি মাংস ও মদের সঙ্গে উত্তম সঙ্গীত পরিবেশিত হয় তখন সে সভায় উপস্থিত থাকার মত আনন্দদায়ক আর কিছুই হতে পারে না।

আপনি অবশ্য আমার দুঃখের সব কথা জানতে চেয়েছেন, কিন্তু তাতে আমার দুঃখ বেড়েই যাবে। কিন্তু সে কথার কোথায় শুরু এবং কোথায় তার শেষ দেবতারা যে দুঃখ আমায় দান করেন তা এমনই দীর্ঘ এবং অনাদান্ত যে তার কোন শুরু বা শেষ নেই। আমি আমার পরিচয় প্রথমে দান করব যাতে আমি পরে নিয়তির নিষ্ঠুর বিধান হতে মুক্ত হলে আপনারা আমাকে বন্ধুভাবে স্মরণ রাখবেন।

আমি হচ্ছি লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াস। সমগ্র পৃথিবীর লোক আমার সমরকৌশলের প্রশংসা করে এবং আমার যশ সুদূর স্বর্গলোকেও অবিদিত নেই। ইথাকার উদার নির্মল আকাশের তলদেশে আমার বাড়ি। আমাদের নগরটি নিয়ত বাত্যাতাড়িত অরণ্যাচ্ছাদিত লেরিতন পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আমাদের ইথাকার চারদিকে আছে ইলিসিয়াস, সেম, জ্যামাইনথাস প্রভৃতি কয়েকটি দ্বীপ। তবে ইথাকা দ্বীপ অবস্থিত এক প্রান্তে এবং পশ্চিম দিকে একটু হেলে থাকায় সূর্যকিরণ তির্যকভাবে তার উপর পড়ে। কিন্তু অন্যান্য দ্বীপের উপর সূর্যকিরণ পড়ে লম্বভাবে। ইথাকার ভূপ্রকৃতি কঠিন বলে সেখানকার মানুষরাও পরিশ্রমী হয়। আমার মনে হয় জন্মভূমির মত চোখ জুড়োন জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। দেবী ক্যালিপসো আমাকে স্বামীত্বে বরণ করার জন্যই তাঁর গুহাতে আমাকে বন্দী করে রেখে দেবার বহু চেষ্টা করেন। এবং এই উদ্দেশ্যেই ইয়াকার যাদুকরীও তাঁর প্রাসাদে আমাকে রেখে দেবার জন্য বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু একমুহূর্তের জন্য তারা আমার হৃদয় জয় করতে পারেন নি। কোন মানুষ বিদেশে যত ধন ঐশ্বর্যের মধ্যেই থাক না কেন, তার জন্মভূমি আর পিতামাতার মত মধুর বা মনোরম আর কিছুই হতে পারে না। যাই হোক, এখন আমি বলব ট্রয় প্রত্যাবর্তনকালে আমার বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রার কথা।

যে অনুকূল বাতাসে জাহাজ ভাসিয়ে একদিন আমরা গিয়েছিলাম, সেই বাতাসে তাড়িত হয়েই সিকোস দ্বীপের রাজধানী ইসমেরাস নগরীতে উপনীত হই। সে নগর আক্রমণ করে তার অধিবাসীদের হতাহত করি। তারপর সে নগরের সম্পদ ও রমণীদের নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নিই। তখন আমি আমার সহকর্মীদের বললাম এবার আমাদের চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমার সৈন্যরা যেতে চাইল না। সে দেশে প্রচুর মদ এবং মাংসের ব্যবস্থা থাকায় তারা সমুদ্রের ধারে রোজ ভেড়া আর গরু কেটে প্রায়ই পানাহারে মত্ত থাকত। ইতিমধ্যে সিকোনস-এর অধিবাসীরা তাদের প্রতিবেশী রাজ্যের লোকদের কাছে সাহায্যের আবেদন করে বেড়াতে লাগল। সেই সব প্রতিবেশী রাজ্যের লোকেরা ছিল সমরকুশলী এবং আমাদের থেকে সংখ্যায় বেশি।

একদিন সকাল হতেই সিকোনস-এর অধিবাসীরা তাদের প্রতিবেশীদের সহায়তায় বসন্ত সমাগমে মলয়পবনপ্রস্ফুটিত অসংখ্য পুষ্পগুচ্ছের মত বহুল সংখ্যায় আক্রমণ করল আমাদের। দেখে মনে হচ্ছিল জিয়াস যেন আমাদের সবচেয়ে তীব্র দুঃখ দিতে চান এবং আমাদের দুর্দিন শুরু হয়েছে সবেমাত্র। উভয়পক্ষের জাহাজগুলো হতে যুদ্ধ শুরু হলো। উভয় পক্ষের সৈন্যরাই বর্শা বিনিময় করতে লাগল। সকাল থেকে সূর্য যতক্ষণ আকাশে দোর্দণ্ড প্রতাপে কিরণ দান করছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সিকোনস সৈন্যদের দমন করে রাখলাম। কিন্তু সূর্য অস্তাচলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সিকোনস সৈন্যরা জয়লাভ করতে লাগল। আমাদের প্রতিটি জাহাজ থেকে ছয়জন করে বীর যোদ্ধা নিহত হলো। আমরা ক্রমশ পিছু হটতে লাগলাম। অতি কষ্টে আমরা কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এলাম।

আমরা এইভাবে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইসমেরাস থেকে চলে এলাম। যে সব সহকর্মী নিহত হয়েছিল যুদ্ধে তাদের জন্য আমরা যৎপরোনাস্তি শোকাবহ হয়ে পড়েছিলাম। আমি কিন্তু নিহত সহকর্মীদের যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত না করে জাহাজ ছাড়তে দিলাম না। বজ্ৰাধিপতি উত্তর দিক থেকে আবার ভয়ঙ্কর ঝড় পাঠিয়ে দিলেন আমাদের জন্য। এক বিশাল মেঘের চন্দ্রাতপ দিয়ে সমগ্র আকাশ ও পৃথিবী ঢেকে দিলেন জিয়াস। ঝড়ের প্রকোপে অকূলে ভেসে যেতে লাগল আমাদের জাহাজগুলো এবং পালগুলো সব ছিঁড়ে গেল। আমরা তখন প্রায়শূন্য সেইসব জাহাজগুলোকে কূলের দিকে কোনক্রমে চালনা করে নিয়ে যেতে লাগলাম। আশঙ্কা আর উদ্বেগের কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল আমাদের অন্তর। তবু দুই দিন দুই রাত্রি আমরা সকলে এইভাবে কূলের সন্ধানে এগিয়ে যেতে লাগলাম। তৃতীয় দিনে সব মেঘ কেটে গেল। উজ্জ্বল সোনারোদে আবার সাদা পাল খাঁটিয়ে নতুন উদ্যমে জাহাজ চালাতে লাগলাম আমরা। এইভাবে আমরা হয়ত নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারতাম, যদি না স্ফীতকায় সমুদ্রতরঙ্গের সঙ্গে উত্তর দিক হতে আগত এক ঝড় মিলেমিশে আমাদের আবার পথভ্রষ্ট করে দিত। তখন আমরা মেলিয়ার কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। কিন্তু ঝড় ও ঢেউ-এর আঘাতে আমাদের ঠেলে নিয়ে গেল সাইথেরার দিকে।

মৎস্যসঙ্কুল সেই অকূল সমুদ্রে নয়দিন ধরে আমরা বাত্যাতাড়িত অবস্থায় ভেসে যেতে লাগলাম। দশ দিনের দিন আমরা উপস্থিত হলাম পদ্মভোজীদের দেশে। পদ্মভভাজীরা ছিল এমনই এক জাতি যারা শুধু শাকসজি খেয়ে জীবন ধারণ করত। আমরা তাদের দ্বীপের উপকূলে জাহাজ ভিড়িয়ে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করতে লাগলাম। আমরা আমাদের পানাহার সম্পন্ন করার পর তিনজন নাবিককে সেই দ্বীপের অধিবাসীদের সম্পর্কে জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠালাম। তাদের মধ্যে একজন দূত হিসেবে বা তথ্য সংগ্রহ করবে আর দুজন বিবরণ লিখবে।

অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সে দ্বীপের মাঝখানে চলে গেল এবং সেই অধিবাসীদের সঙ্গে দেখা করল। তারা আমাদের দূতদের মোটেই শত্রু ভাবল না; তারা শুধু তাদের কতকগুলো পদ্ম খেতে দিল। তারা তিনজন প্রত্যেক পদ্মের মধু খাবার সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে গেল। যে কাজের জন্য তাদের পাঠিয়েছিলাম সেকাজ তারা করতে পারল না। তারা সব কর্তব্যের কথা ভুলে, ঘরবাড়ির কথা ভুলে সেইখানেই রয়ে গেল। তাদের জাহাজে ফিরিয়ে আনার জন্য বলপ্রয়োগ করতে হয়েছিল। তারা আসার সময় পথে কাঁদছিল। আমি তাদের জাহাজের উপর টেনে এনে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলাম। আমি তখন তাড়াতাড়ি জাহাজ ছেড়ে দিলাম, যাতে আমাদের অন্যান্য সহকর্মীরা সেই পদ্মের মধু খাবার কোন সুযোগ না পায়। নাবিকেরা আপন আপন জায়গায় বসে দাঁড় টানতে লাগল।

এইভাবে আমরা দুঃখিত চিত্তে পদ্মভোজীদের দেশ ত্যাগ করে আবার পাড়ি দিলাম সমুদ্রে। কিছুদিন পর আবার একটি নতুন দ্বীপে এসে উঠলাম। সে দ্বীপে যারা বাস করত তাদের নাম সাইক্লোপ জাতি। তারা ছিল দুর্ধর্ষ ও অসভ্য। তারা কৃষিকার্যের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারত না। তারা শুধু ভাগ্যের উপর নির্ভর করে থাকত। সাইক্লোপরা বীজ বপন করত না, কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় গম, যব, আঙ্গুরগাছ আপনা হতেই বৃষ্টির জলে বেড়ে উঠত। সাইক্লোপদের আইনসভা ছিল না। তাদের কোন সুপ্রচলিত প্রথাও ছিল না। তারা প্রত্যেকেই স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে এক একটি গুহাতে বাস করত। প্রত্যেকটি লোক তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের শাসনে রাখত।

সেই সাইক্লোপদের দ্বীপের উপকূল থেকে অদূরে আর একটি দ্বীপ ছিল। সারা দ্বীপটি ছিল গভীর বনে সমাচ্ছন্ন। অরণ্যপরিপূর্ণ সমগ্র দ্বীপটিতে ঘুরে বেড়াত অসংখ্য বন্য ছাগ। সে দ্বীপের অরণ্য এমনই গভীর এবং জটিল যে তার মধ্যে কোন মানুষ পথ করে প্রবেশ করতে পারত না। সেখানে কোন শিকারীও যেতে পারত না কোনদিন। দুর্ভেদ্য অরণ্য আর খাড়াই পাহাড়ঘেরা সেই দ্বীপে কোন কৃষিযোগ্য ভূমি ছিল না। কোন জনমানব সেখানে যেতে না পারায় ছাগলরাই সর্বক্ষণ চরে বেড়াত সে দ্বীপের সর্বত্র। আমাদের মত সাইক্লোপদের কোন জাহাজ বা জলযান ছিল না। তারা জাহাজ নির্মাণ করতেও পারত না। ফলে তারা সমুদ্রপথে দেশবিদেশে যাতায়াত করতে পারত না। পৃথিবীর অন্য কোন জাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত না। জাহাজ নির্মাণ বা নৌশিল্পের কোন ব্যবস্থা থাকলে সাইক্লোপরা এক সুসভ্য ও সুদক্ষ জাতিতে পরিণত হতে পারত। কারণ তাদের দেশে কৃষিজ সম্পদের কোন অভাব ছিল না। উর্বর সেই দেশে যে কোন ঋতুতে যেকোন ফসল ফলাতে পারত তারা একটু চেষ্টা করলেই। তাদের বিস্তীর্ণ উপকূলভাগে সমুদ্রজলবিধৌত প্রচুর আঙ্গুরক্ষেত ছিল। এছাড়া ছিল বিশাল কৃষিযোগ্য প্রান্তর। ওখানকার মাটি বিশেষভাবে উর্বর এবং যেকোন ফসল উৎপাদনের পক্ষে উপযুক্ত। দ্বীপের বন্দরটিও ছিল বড় নিরাপদ। ওখান জাহাজগুলোকে নোঙর করতে হয় না। রশি দিয়ে বাঁধার দরকার পড়ে না কোন নৌকো বা জাহাজকে। নাবিকরা জাহাজ বা নৌকোকে বেলাভূমিতে ভিড়িয়ে দিয়ে অনুকূল বাতাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এবং তাদের যাত্রাপথে অনুকূল বাতাসের স্পর্শ পাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা জাহাজ ছেড়ে দেয়। সেই বন্দরের নিকটে এক পপলার গাছের কুঞ্জমধ্যবর্তী এক গুহা থেকে নির্মল জলের এক প্রস্রবণ উৎসারিত হয়ে চলেছে।

এই দ্বীপে আমরা এসে পড়ি কোন এক রাত্রিতে। নিশ্চয় কোন দেবতা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান সেখানে, কারণ আমরা কুয়াশায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আকাশ ছিল মেঘলা আর চারিদিক ঘন কুয়াশায় ছিল ঢাকা। ঘন কুয়াশার জন্য চাঁদের আলোটাকে ঝাপসা দেখাচ্ছিল। ফলে আমাদের মত কেউ সে দ্বীপের কোন কিছুই দেখতে পায় নি, আমাদের জাহাজটি আপনা হতে সে দ্বীপের বেলাভূমির চরে আটকে যায় আর আমরা তখন জাহাজ থেকে নেমে পড়ে সেই বেলাভূমিতেই শুয়ে পড়ি। রাত্রির জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকি নীরবে।

সকালের লাল আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উঠে পড়ে দেখতে পেলাম সেই দ্বীপটিকে আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেরিয়ে পড়লাম তা দেখার জন্য। আমাদের লোকজন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল। সেই দ্বীপের মধ্যে ঢুকে পড়েই তার বনের ভিতরে প্রচুর বন্য ছাগল দেখে বর্শা ও তীর ধনুক দিয়ে শিকার শুরু করে দিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বহু ছাগল শিকার করলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল মোট বারোটি জাহাজ। প্রত্যেকটি জাহাজের ভাগে পড়ল নয়টি করে ছাগল। সারাদিন ধরে আমরা সেই শিকারের ছাগমাংস মদ্য সহকারে ভক্ষণ করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে সাইক্লোপদের দ্বারা এখানে সেখানে জ্বালানো আগুনের ধোয়া চোখে পড়ল আমাদের। আর কানে আসতে লাগল অসংখ্য ছাগ ও মেষের চিৎকার। রাত্রির অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলে আমরা বেলাভূমিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার লোকজনদের এক জায়গায় সমবেত করে বললাম, বন্ধুগণ, আপাতত আমি চাই তোমরা এখানে থাক, আমি শুধু আমার জাহাজ আর নাবিক নিয়ে অদূরবর্তী ঐ দ্বীপটির মধ্যে গিয়ে দেখে আসি ওখানে, যারা বাস করে তারা কি ধরনের মানুষ। আমি দেখতে চাই ওরা কি অসভ্য বা বর্বর কোন উপজাতি না অতিথিবৎসল বা ধর্মভীরু।

আমি আমার জাহাজ আর লোকজন নিয়ে তখনি রওয়ানা হলাম। আমরা যেখানে প্রথম উঠেছিলাম সেখান থেকে দ্বীপটি বেশি দূরে ছিল না। আমরা প্রথমেই সমুদ্রের ধারে লরেল লতা দিয়ে ঢাকা একটি গুহা দেখতে পেলাম। সেই গুহার ভিতরে সারারাত ধরে ভরা ছিল প্রচুর ছাগল আর মেষ। সে গুহার সামনে লম্বা লম্বা পাইন আর ওকগাছে ঘেরা একটি উঠোন ছিল। সে গুহায় বাস করত এব অদ্ভুত দর্শন দৈত্য। একা একা সে থাকত সেই গুহায় আর মেষপালন করত। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না তার। আমাদের মত মানুষদের চেহারার সঙ্গে তার কোন মিল ছিল না। তাকে দেখে মনে হত সে যেন অরণ্যকুন্তল এক নিঃসঙ্গ পাহাড় মাথা উঁচু করে একা একা দাঁড়িয়ে আছে।

সেই গুহার কাছে আমি আমার লোকজনদের মধ্যে বাছাই করে বারোজনকে নিয়ে বাকি লোকদের সেইখানে কাছে প্রহরারত অবস্থায় রেখে দিলাম। আমরা ইসাথেরাসে থাকাকালে ফীবাস অ্যাপোলোর পুরোহিত মেরণ আমাকে যে মদ দিয়েছিল তা প্রচুর পরিমাণে চামড়ার থলেতে ভরে নিলাম। দেবপুরোহিত মেরণকে তার স্ত্রী পুত্রসহ এক ভয়ঙ্কর বিপদ হতে উদ্ধার করেছিলাম। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মেরণ আমাকে স্বর্ণমুদ্রা ও প্রচুর মদ উপহার দেন। মেরণের স্ত্রীপুত্ররা যখন মদ খেত তখন তিনি এক কাপ লাল মিষ্টি মদ কুড়ি কাপ জলের সঙ্গে মিশিয়ে তাই খেতে দিতেন আর তাতে মন্ত্রের মত কাজ হত। একটি বড় বোতলে করে মদ আর কিছু খাদ্য নিলাম সঙ্গে। আমি কাপুরুষ বা ভীরু প্রকৃতির ছিলাম না। তথাপি আমার মনে এই আশঙ্কা ছিল যে শক্তিমান ও হিংস্র একশ্রেণীর লোকের সম্মুখীন হতে হবে আমাকে। সেই সব বন্য বর্বরমানুষদের মধ্যে ঈশ্বরভয় বা মানবিক ন্যায় নীতির কোন পরিচয় ছিল না। সমুদ্রের ধারে সেই প্রথম গুহাটিতে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেখি সেই দৈত্যটি নেই, মেষ চরাতে গেছে। আমরা তাই বিনা বাধায় গুহাটির ভিতরে গিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলাম। দেখলাম সেই গুহার ভিতরে অনেক মেষশাবক ও ছাগশিশু বাধা রয়েছে। অনেকগুলো বালতিতে ছাগল ও ভেড়ার দুধ ছিল। অনেক মাখন ও ঘি ছিল ভিন্ন পাত্রে।

আমার সঙ্গের লোকজন চাইছিল, সেইসব মাখন দুধ আর ভেড়া ও ছাগলগুলোকে নিয়ে আমাদের জাহাজে পালিয়ে যেতে। ওরা চাইছিল জাহাজ ছেড়ে দিতে, কিন্তু একথায় আমার মন সায় দিল না। আমি চাইছিলাম এই গুহার মালিকের সঙ্গে দেখা করতে। আমি চাইছিলাম আমি তার সঙ্গে দেখা করে তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ এক সম্পর্ক গড়ে তুলব এবং তখন সে আপনা হতেই আমাদের অনেক উপহার দিবে। কিন্তু পরে লোকটির চেহারা দেখে আমার লোকজন সত্যিই ভয় পেয়ে গেল।

আমরা আগুন জ্বালিয়ে একটি পশু বলি দিলাম দেবতাদের উদ্দেশ্যে। কিছু মাখন নিয়ে আমরা আহারকার্য সম্পন্ন করলাম। তারপর সেই দৈত্যের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে সেই দৈত্যটি কাঁধে একবোঝা জ্বালানি কাঠ আর মেষের পাল নিয়ে হাজির হলো। সে সশব্দে কাঠের বোঝাটি নামিয়ে যেসব ভেড়া ও ছাগল চরাতে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো সব গুহার ভিতরে ঠেলে দিল। তারপর একটি বিশাল পাথর দিয়ে গুহার মুখটা বন্ধ করে দিল। সেই পাথরটি এত বড় এবং ভারী যে কোন মানুষ সেটিকে মাটি থেকে তুলতে পারে না, অথবা চারচাকা মালবাহী গাড়িও বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। যে পাথরটি দিয়ে সেই দৈত্যটি গুহার মুখটি অনায়াসে বন্ধ করে দিল সেই পাথরের আয়তন ও ওজন থেকেই বোঝা যাবে সেই দৈত্যটি কী ভীষণ। তারপর শাবকগুলোকে ছাগী ও ভেড়ীদের কাছে দিয়ে তাদের দোহন করার জন্য প্রস্তুত হলো। দোহনকার্য সম্পন্ন করে সে দুধ থেকে মাখন তুলে একটি পাত্রে রাখল আর বাকি দুধ বালতিতে রেখে দিল নৈশভোজনের জন্য। তারপর আগুন জ্বালিয়ে আমাদের কাছে এসে প্রশ্ন করল, হে বিদেশিগণ, তোমরা কারা? এই সমুদ্র পার হয়ে কোথা থেকে এসেছ? তোমরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এই সমুদ্রযাত্রা করেছ অথবা তোমার জলদস্যু হিসেবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এখানে এসে পড়েছ?

আমি বললাম, আমরা জাতিতে গ্রীক, ট্রয় হতে ফেরার পথে প্রতিকূল বাতাসের দ্বারা তাড়িত হয়ে এখানে এসে পড়েছি।

এখানে আসার আমাদের কোন পরিকল্পনা ছিল না। আমরা ট্রয় থেকে সোজা আমাদের দেশে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেবরাজ জিয়াসের বিধানে আমরা পথ হারিয়ে এখানে এসে পড়েছি। আমরা হচ্ছি আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমননের অধীনস্থ সেনাদল। বীর অ্যাগামেমনন ট্রয় জাতিকে পরাস্ত করে ও ট্রয়নগরী ধ্বংস করে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। আমরা তার থেকে কম ভাগ্যবান বলেই এখানে আপনার কাছে এসে পড়েছি। আমরা আশা করি আপনি আমাদের বন্ধু হিসেবে কিছু দান করে আপনার উদারতার পরিচয় দেবেন। আশা করি আপনি আতিথেয়তার নিয়ম জানেন। আমি যথাবিহিত বিনয়ের সঙ্গে আপনাকে দেবতাদের প্রতি আপনার কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আজ আমরা একান্তভাবে আপনার অনুগ্রহপ্রার্থী। দেবরাজ জিয়াস অতিথিদের দেবতা। তিনি অতিথিদের অধিকার রক্ষা করেন এবং তাদের নিরাপত্তার বিধান করেন।

আমার একথা শুনে সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল, হে বিদেশী, তুমি নির্বোধ। মনে হয় তুমি বহু দূর হতে এসেছ এবং আমাদের চেন না। তাই দেবতাদের ভয় খেয়ে তাদের শ্রদ্ধা করতে বলছ। আমরা সাইক্লোপ জাতির লোক, জিয়াস বা অন্যান্য দেবতাদের ভয় করি না। কারণ আমরা দেবতাদের থেকে অনেক বেশি শক্তিমান। জিয়াসের ভয়ে আমি তোমাকে এবং তোমার লোকজনদের ছেড়ে দেব তা মনে ভেবো না। তবে যে জাহাজে করে তোমরা এখানে এসেছ সে জাহাজটি কোথায় রেখেছ বল? সেটা কোন দূর উপকূলভাগে আছে না কাছাকাছি কোথাও আছে? আমি তা দেখতে চাই।

সে এইভাবে আমাকে বিপদাপন্ন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বহু জায়গায় ঘুরে, বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করায় তার মতলব বুঝতে পারলাম আমি এবং তার সঙ্গে ছলনা করতে লাগলাম।

আমি উত্তর করলাম, আমার যে জাহাজের কথা বললে তা ভূকম্পন দেবতা পসেডন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন। আমরা সমুদ্রের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে পড়েছি। সে জাহাজের কোন চিহ্নও অবশিষ্ট নেই।

সেই নিষ্ঠুর দৈত্যটা আমার কথার আর কোন উত্তর দিল না। সে তখন আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আমাদের কয়েকজন লোককে কুকুরছানার মত ধরে তাদের মাথাগুলো সেই পাথরটার উপর ঠুকে ভেঙ্গে দিল। তারপর তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো টেনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে পার্বত্য সিংহের মত তাদের নাড়ীভুড়ি ও অস্থিমজ্জাসহ সব চিবিয়ে খেয়ে নিল। অথচ আমরা আকাশের দিকে হাত তুলে জিয়াসের উদ্দেশ্যে কাতর আবেদন জানানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না। এক নিবিড় হতাশা আর অসহায়তাবোধে অসাড় হয়ে আসছিল আমাদের সমগ্র দেহ-মন।

এইভাবে সাইক্লোপ নামে সেই দৈত্যটা পেট ভরে নরমাংস ভক্ষণ করে নির্জলা দুধে হাত ধুয়ে তার ছাগল ও মেষের পালের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এবার আমার মাঝে ঘুমন্ত পৌরুষ জেগে উঠল। ভাবলাম, এবার আমি আমার তরবারি বার করে দৈত্যটার কাছে গিয়ে তার পেটে লিভারের কাছে সেটা আমূল বসিয়ে দেব। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম তাকে আমি হত্যা করতে পারলেও সে পাথরটা দিয়ে সে গুহার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছে তা আমরা কোনমতেই ঠেলে সরিয়ে বের হতে পারব না। সুতরাং আমাদের সেখানে তার হাতে মরা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। তাই হতাশ হয়ে আমরা দিনের আলোর জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলাম নীরবে।

পূর্বদিগন্তে গোলাপী আলো ফুটে উঠতেই সাইক্লোপ নামে সেই দৈত্যটা আলো জ্বেলে ছাগ ও মেষ দোহন করতে লাগল। তারপর আমাদের মধ্যে থেকে আরও কয়েকজনকে ধরে তাদের হাড় মাংস চিবিয়ে খেল। তারপর তার মেষ ও ছাগলের পাল নিয়ে সেই পাথরটা অবলীলক্রমে সরিয়ে তাদের চরাতে চলে গেল পশুচারণ ক্ষেত্রের পথে। যাবার সময় সেই পাথরটাকে আবার গুহার মুখে রেখে গেল তেমনি করে। আমি তখন একমনে সেই দৈত্যাটাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে লাগলাম। তবে একমাত্র দেবী এথেন যদি দয়া করেন তাহলেই এই হত্যাকার্য সম্পন্ন করতে পারব আমি। সহসা আমি এক পরিকল্পনা খাড়া করে ফেললাম। এই গুহার ভিতরে অলিভ কাঠের তৈরি এক বিরাট সবুজ রঙের লাঠি ছিল। সেই লাঠিটা আমরা ধরে তার একটা মুখ সুঁচের মত সরু ও তীক্ষ্ণ করে তুললাম। তারপর সেটা আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করলাম যথাসম্ভব। তারপর আমার অবশিষ্ট চারজন সঙ্গীকে বললাম সাইক্লোপ যখন ঘুমোবে তখন আমি এই সূঁচলো বর্শার মত লাঠি দিয়ে তার চোখ দুটো খুঁচে দেব এবং তারা যেন আমাকে সাহায্য করে একাজে।

সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল সাইক্লোপ তার মেষ ও ছাগলের পাল নিয়ে। পশুগুলোকে যথাস্থানে রেখে সে ছাগী ও ভেড়ীদের দোহন করল। তারপর আমাদের সঙ্গীদের দুজনকে ধরে তাদের খেল আমি একপাত্র মদ নিয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম, নরমাংস ভক্ষণ করারপর এই মদটুকু খেয়ে নাও, দেখ কী উত্তম মদ আমাদের জাহাজে সযত্নে রক্ষিত ছিল। এই মদ তোমাকে দেবার জন্যই এনেছিলাম। কারণ আমার আশা ছিল তুমি আমাদের বাড়ি ফিরতে সাহায্য করবে। কিন্তু তোমার ব্যবহার এমনই বর্বরোচিত যে তা সহ্য করা যায় না। হে নিষ্ঠুর দানব, এরপর কেমন করে তুমি আশা করতে পার যে আর কোনদিন কোন অতিথি তোমার কাছে আসবে?

আমার হাত থেকে মদের পাত্রটা নিয়ে একচুমুকে তা পান করে ফেলল সাইক্লোপ। সেই মদ আস্বাদন করে এক আনন্দ লাভ করল যে সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছ থেকে আর একমাত্র মদ চাইল।

সাইক্লোপ বলল, দয়া করে আমাকে আরো একপাত্র দাও। তারপর তোমার নাম বল। তাহলে আমি তোমাকে এক মূল্যবান উপহার দেব। আমাদের দেশের উর্বর মাটি আর সময়মত বৃষ্টিপাতের ফলে প্রচুর আঙ্গুর উৎপন্ন হয়। সেই আঙ্গুর থেকে প্রচুর মদ তৈরি হয়। কিন্তু তোমার মদ লাল এবং তা দেবতাদের মদের মত খুবই ভাল।

আমি তাকে একপাত্র নয়, পর পর তিনপাত্র দিলাম। সেও সেই পাত্রের তলানিটুকু পর্যন্ত খেয়ে নিল। তার মদ্যপান শেষ হলে আমি তাকে সম্বোধন করে বললাম শোন সাইক্লোপ, তুমি আমার নাম জানতে চেয়েছিলে। আমি তা বলছি এবং তার পরিবর্তে তুমি যে উপহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা আমায় দেবে। আমার নাম হচ্ছে ‘কেউ না’, এই নামেই আমার পিতা-মাতা ও বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে ডাকে।

এক নিষ্ঠুর ন্দ্রিপের সঙ্গে সাইক্লোপ বলল, তোমার দলের সকলের মধ্যে ‘কেউ না’-কে আমি সব শেষে খাব। আমি সবাইকে খাব তার আগে। এইটাই হবে তোমার উপহার।

একথা তার বলা শেষ না হতেই চিৎ হয়ে মেঝের উপর পড়ে গেল। তার ঘাড়টা মচকে গেল। মনে হলো সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। নেশার ঘোরে বমি করতে লাগল সে। সঙ্গে সঙ্গে যে মদ আর নরমাংস খেয়েছিল তা গলা দিয়ে উঠে এল। আমি তখন সেই অলিভ কাঠের বল্লমটি আগুনে পোড়াতে দিলাম। তারপর আমার অবশিষ্ট লোকদের উৎসাহ দিয়ে বললাম তারা যেন কাপুরুষের মত কাজ করে আমাকে বিপদে না ফেলে। যখন পুড়ে পুড়ে সেই সবুজ অলিভ কাঠটা লাল হয়ে উঠল তখন আমি সেটাকে টেনে বার করে আমার লোকরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে নিয়ে গেলাম। ঈশ্বর আমার মনের মধ্যে এক দুরন্ত সাহস সঞ্চার করলেন। সেই কাঠটাকে ধরে তার উঁচলো দিকটা যথাশক্তিতে আমরা সকলে মিলে চেপে ধরলাম সাইক্লোপের চোখে আর তার উপর চাপ দিতে লাগলাম জোরে। তখন তার চোখের চারদিকে রক্ত ঝরে তা সেই কাঠের আগুনে পুড়তে লাগল আর তার থেকে ধোঁয়া বের হতে লাগল। তার চোখের তারা ফেটে গেল। কর্মকার কোন তপ্ত লোহা হঠাৎ জলে ডোবালে যেমন এক হিস হিস শব্দ হয় ঠিক তেমনি এক শব্দ বের হতে লাগল সাইক্লোপের চোখ থেকে। সে তখন এমন বিকট চিৎকার করতে লাগল যার শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাথরের দেওয়ালগুলোতে। আমরা ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলাম গুহার একপাশে। সাইক্লোপ তার চোখের মধ্যে গেঁথে যাওয়া সেই অলিভ কাঠের বল্লমটি তুলে ফেলতেই তার মণিহীন চোখের গর্ত থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। সে সেই বল্লমটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার জাতি ভাইদের ডাকতে লাগল। সাইক্লোপ জাতীয় তার প্রতিবেশীরা তার গুহার আশেপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের গুহায় থাকত। তারা তৎক্ষণাৎ সেই রাত্রিতেই ছুটে এল। তারা গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল তোমার কি হয়েছে পলিফেমাস? এইভাবে চিৎকার করে কেন তুমি আমাদের এই শান্ত রাত্রির সুখন্দ্রিা নষ্ট করলে? কোন দস্যু কি তোমার মেষ চুরি করে নিয়ে গেছে অথবা কোন লোক বিশ্বাসঘাতকতা করে তোমাকে হত্যা করতে চলেছে?

পলিফেমাস তার গুহার ভেতর থেকে বলল, বন্ধুগণ, আমার যে মৃত্যু ঘটতে চলেছে তা কোন লোকের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নয়। এটা কেউ না’র কাজ।

সাইক্লোপরা তখন উত্তর করল, যদি কেউ না তোমার এ নির্জন গুহাতে তোমায় আক্রমণ করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তুমি অসুস্থ। মর্ত্যমানবের যেকোন অসুস্থতা দেবরাজ জিয়াসেরই সৃষ্টি। এখন তুমি তোমার পিতা পসেডেনের কাছে প্রার্থনা জানাতে পার তোমার রোগ মুক্তির জন্য।

এই বলে ওরা চলে গেল। আমি তখন ভাবতে লাগলাম কিভাবে আমার এক মিথ্যা নাম আমাদের আপাতত এ যাত্রা রক্ষা করল। পলিফেমাস তখন উঠে ধীরে ধীরে গুহার মুখের কাছে গিয়ে সেই বড় পাথরটা সরিয়ে সেইখানে নিজে বসে হাত বাড়িয়ে আমাদের ধরার চেষ্টা করতে লাগল। আমি তখন আমাদের তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উপায়ের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। অবশেষে একটা পরিকল্পনা খাড়া করলাম। ভোর হলেই পুরুষ ভেড়াগুলোকে বার করে দিয়ে ভেড়ীগুলোকে দোহন করে পলিফেমাস। আমি ঠিক করলাম, আমি ও আমার সহকর্মীরা বড় বড় লোমওয়ালা ভেড়াগুলোর পেটের তলা ধরে ভেড়াগুলোর সঙ্গে বেরিয়ে যাব আমরা। আমাদের দুপাশে থাকবে দুটো করে ভেড়া। পলিফেমাসের চোখদুটো সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে দেখতে পায় না। বড় বড় ভেড়াগুলো যখন বেরিয়ে যাবে গুহা থেকে তখন আমরাও তাদের পেটের তলা দিয়ে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে যাব। সুতরাং প্রষ্যের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

ভোর হতেই ভেড়াগুলো চরতে যাবার জন্য চিৎকার করতে লাগল আর ভেড়ীগুলোকে তখনো দোহন করা হয় নি বলে তাদের বাঁটগুলো দুধে ভর্তি হওয়ায় অস্বস্তিতে তারাও চিৎকার করছিল। পলিফেমাস তখন ভেড়াগুলোর পিঠে হাত বুলিয়ে কি অনুভব করতে লাগল। আমি আমার সহকর্মীদের এক একটি ভেড়ার লোমশ পেটের তলায় ভাল করে বেঁধে নিয়েছিলাম। আমি নিজে ছিলাম সবচেয়ে একটি বড় ভেড়ার পেটের তলায়। ভেড়াগুলো সব বেরিয়ে যাবার পর আমার ভেড়াটি যখন বার হয়ে যাচ্ছিল তখন পলিফেমাস তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, হে আমার প্রিয় মেষ, কেন তুমি আজ সব শেষে বার হচ্ছ? তুমি ত কখনো কোনদিন আমার দল থেকে পিছিয়ে পড় নি। এমনকি নদী পার হবার সময়ও তুমি সবার আগে দর্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে। সমাগত সন্ধ্যার ছায়া পৃথিবীতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গৃহাভিমুখে পদক্ষেপ করতে তুমি সর্বপ্রথম। কিন্তু আজ তুমি তোমার প্রভুর অন্ধত্বের জন্য দুঃখিত বলেই কি পিছিয়ে পড়েছ? তুমি হয়ত জান একটা দুষ্ট লোক তার অভিশপ্ত বন্ধুদের সাহায্যে আমাকে মদ খাইয়ে আমার বুদ্ধিনাশ করে আমার চোখ দুটিকে নষ্ট করে দিয়েছে চিরতরে। তার নাম ‘কেউ না’ এবং আমি জোর করে বলতে পারি সে এখনো বার হতে পারে নি এ গুহা থেকে। হায়, তুমি যদি বুঝতে পারতে আমার প্রচণ্ড ক্রোধের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোথায় সে আত্মগোপন করে আছে সেকথা যদি তুমি আমায় স্বকণ্ঠে বলতে পারতে! যদি আমি তার মাথাটা ভেঙ্গে দিয়ে তার বিচূর্ণিত করোটিকঙ্কাল দিয়ে এই গুহার তলদেশটি ভরে দিতে পারতাম তবেই আমি কষ্ট ভুলে যেতে পারতাম।

এই কথা বলে সে শেষ ভেড়াটিকে ছেড়ে দিল গুহার মুখ থেকে। গুহার বাইরে এসে আমি প্রথমে নিজেকে মুক্ত করলাম। তারপর আমার সহকর্মীদের একে একে মুক্ত করলাম তাদের বন্ধন খুলে দিয়ে। আমরা তখন সেই লম্বা পাওয়ালা বড় বড় ভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে আমাদের জাহাজের দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম। জাহাজে আমার যেসব সহকর্মীদের রেখে গিয়েছিলাম তারা আমাদের দেখতে পেয়ে প্রথমে অতীব আনন্দিত হলো। কিন্তু পরক্ষণে যখন শুনল তাদের কয়েকজন সহকর্মী নিহত হয়েছে পলিফেমাসের হাতে তখন মর্মাহত হলো তারা। কিন্তু আমি সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলাম তারা যেন কান্না থামিয়ে তাড়াতাড়ি ভেড়াগুলোকে জাহাজে তুলে জাহাজ ছেড়ে দেয়। আমার নাবিকরা যথাশ্রীঘ্র দাঁড় বেয়ে জাহাজটিকে গভীর জলের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।

আমরা যখন বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলাম তখন পলিফেমাসকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে আমি আমার মনের কথা ব্যক্ত করলাম। বললাম, পলিফেমাস, তুমি যার বন্ধুদের সব একে একে ভক্ষণ করতে চেয়েছিলে তোমার গুহার মধ্যে সে কিন্তু যতটা দুর্বল তুমি ভেবেছ ততটা দুর্বল নয়। হে বর্বর অসভ্য, তোমার অপরাধের শেষ নেই, তুমি তোমার অতিথিদের ভক্ষণ করেছ এবং দেবরাজ জিয়াস তোমার যথোপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন।

আমার এই বিজ্ৰপবাক্যে পলিফেমাস এমন প্রচণ্ডভাবে রেগে গেল যে সে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার উপর পাহাড় থেকে একটা পাথরখণ্ড তুলে আমাদের জাহাজটার দিকে সমুদ্রে ছুঁড়ে দিল। পাথরটা আমাদের জাহাজের সামনে জলে এত জোরে পড়ল যে তার ঢেউ উঠে আমাদের জাহাজটাকে আবার বেলাভূমির দিকে নিয়ে এল। আবার আমরা পলিফেমাসের কবলে পড়ে যাব ভেবে আমি নিজেও দাঁড় টানতে লাগলাম যথাশক্তিতে এবং নাবিকদেরও নির্দেশ দিলাম। আমাদের জাহাজটা আগেকার থেকে দ্বিগুণ দূরত্বের ব্যবধানে চলে যেতেই আমি পলিফেমাসকে ডেকে আবার কিছু বলতে উদ্যত হলাম।

কিন্তু এবার আমাদের জাহাজের সহকর্মীরা সকলে আমাকে বাধা দিয়ে বলল, আপনি ঐ দৈত্যটাকে রাগিয়ে দিয়ে হঠকারিতার কাজ করেছেন। যে পাথরটা সে ছুঁড়েছিল তা আমাদের জাহাজটাকে কূলের দিকে এতটা নিয়ে গিয়েছিল। আবার যদি সে আমাদের কোন কথা শুনতে পায় তাহলে আর একটা পাথরের আঘাতে একই সঙ্গে আমাদের মাথা আর জাহাজের মাস্তুলটাকে চূর্ণ করে দেবে। কত জোরে ও পাথর ছুঁড়তে পারে তা আপনি নিজে দেখেছেন।

কিন্তু সেকথায় আমি কান দিলাম না। ক্রোধের আবেগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আমার অন্তর। আমি বলতে লাগলাম, জেনে রেখো পলিফেমাস, যদি তোকে কেউ কোন দিন জিজ্ঞাসা করে কিভাবে তুমি অন্ধ হলে তাহলে তাকে বলবে ট্রয় নগর ধ্বংসকারী ইথাকানিবাসী লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াসই আমাকে অন্ধ করেছে।

গর্জন করে উঠে পলিফেমাস বলল, তাহলে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যে পরিণত হলো। ইউরেমাসপুত্র টেলিমান নামে এক জ্যোতিষী আমাদের মধ্যে বাস করত। সে ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রে অভিজ্ঞ। সে একবার আমার ভাগ্য পরীক্ষা করে বলেছিল ওডিসিয়াস নামে এক ব্যক্তি ভবিষ্যতে চোখ দুটিকে নষ্ট করে অন্ধ করে দেবে আমার। আমি তাই সবসময় কোন এক শক্তিধর বিরাটকায় মানুষের প্রতীক্ষায় থাকতাম। কিন্তু কখনো ভাবতে পারি নি একটা ছোট্ট মানুষ এসে আমাকে মদ খাইয়ে আমার চোখ দুটোকে নষ্ট করে দেবে। কিন্তু এখন শোন ওডিসিয়াস, এখানে এস, আমি তোমাকে একটি উপহার দেব এবং ভূকম্পন দেবতার কাছে অনুরোধ করে তোমাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ব্যবস্থা করব। আমি হচ্ছি তাঁর পুত্র এবং তিনি তা স্বীকার করতে কোন লজ্জা অনুভব করেন না। তিনি ইচ্ছা করলে আমার সব যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে পারেন।

আমি তার প্রত্যুত্তরে বললাম, আমার শুধু মনে হচ্ছে আমি যদি তোমার জীবন নাশ করতে পারতাম, কারণ আমি জানি ভূকম্পন দেবতা নিজে এলেও তোমাকে আরোগ্য করতে পারবেন না।

আমার একথা শুনে পলিফেমাস আকাশের দিকে হাত তুলে বলতে লাগল, হে ভূকম্পনতেদবতা পসেডন, যদি তুমি আমাকে তোমার পুত্র বলে স্বীকার করো, তাহলে এমন ব্যবস্থা করো যাতে লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াস তার বাড়ি ইথাকায় কখনো প্রত্যাবর্তন করতে না পারে আর যদি গৃহে প্রত্যাবর্তন তার ভাগ্যে থাকে তাহলে সে যেন অনেক বিলম্বে শোচনীয় দূরবস্থার মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে আর তার সব সহকর্মীরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সে যেন কোন বিদেশী জাহাজে করে বাড়ি ফেরে আর বাড়ি ফিরে যেন অশান্তির সম্মুখীন হয়।

পলিফেমাসের এই প্রার্থনা পসেডন শুনলেন। পলিফেমাস প্রার্থনা শেষ করে আর একটি আগের থেকেও বড় পাথর তুলে আমাদের জাহাজের দিকে ছুঁড়ল, কয়েক ইঞ্চির জন্য বেঁচে গেলাম আমরা। তাতে যে বিরাট ঢেউ-এর সৃষ্টি হলো সে ঢেউ আমাদের আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। আমরা তার ফলে আরো শীঘ্র মূল উপকূলে ফিরে গিয়ে আমাদের অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হলাম। এইখান থেকেই আমি কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে সাইক্লোপদের দ্বীপ দেখতে গিয়েছিলাম। আমার অন্যান্য সহকর্মীরা আমাদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় মুহূর্ত গণনা করছিল। আমরা জাহাজ থেকে উপকূলে অবতরণ করে পলিফেমাসের ভেড়াগুলোকে নামালাম। তারপর সেগুলো নিজেদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নিলাম। আমাকে ওরা কিছু বেশি দিল। আমি তখন একটি ভেড়ার উরু কেটে আগুনে দগ্ধ করে কৃষ্ণকুটিল বজ্রগর্ভ মেঘের দেবতা জিয়াসের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম। কিন্তু জিয়াস সে উৎসর্গ গ্রহণ না করে আমার জাহাজ ও সঙ্গীদের কিভাবে ধ্বংস করা যায় তার পরিকল্পনা করতে লাগলেন।

এইভাবে সারাদিন ধরে আমরা মাংস ও মদ্যসহকারে তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করতে লাগলাম। সন্ধ্য হলে আমরা বেলাভূমিতে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে আমরা জাহাজ ভাসিয়ে দিলাম সমুদ্রে। এক ভয়ঙ্কর বিপদ এবং নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার লাভ করে যে আনন্দ অনুভব করছিলাম, আমাদের নিহত সহকর্মীদের জন্য লোকের কালিমা ম্লান করে দিচ্ছিল সে আনন্দের সমস্ত উজ্জ্বলতাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *