০৪. মেনেলাস ও হেলেন

চতুর্থ পর্ব
মেনেলাস ও হেলেন

বহু পার্বত্য পথ উক্রমণ করে অবশেষে তারা এসে উপনীত হলো চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা ল্যাসিডীমন নগরীতে। তারা সরাসরি রথ চালনা করে চলে গেল মেনেলাসের প্রাসাদে। প্রাসাদে গিয়ে তারা দেখল মেনেলাসের পুত্র ও কন্যার বিবাহ উপলক্ষে এক বিরাট ভোজসভার অনুষ্ঠান চলেছে সেখানে। মামিডনের বর্তমান রাজা। অ্যাকিলিসপুত্রের সঙ্গে তাঁর কন্যা হার্মিওনের বিবাহ দান করে তাঁর কন্যাকে মার্মিডনে পাঠাচ্ছিলেন মেনেলাস। ট্রয়যুদ্ধকালে এ বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দান করেছিলেন অ্যাকিলিসকে। সেই সঙ্গে তিনি স্পার্টা হতে অ্যালেকটরকন্যাকে এনেছিলেন তাঁর পুত্রবধুরূপে। তাঁর একমাত্র বীরপুত্র মেগাপেনথেসের জন্ম হয় তাঁর এক দাসীর গর্ভে। হেলেনের গর্ভে তাঁর সুন্দরী কন্যা হার্মিওনের জন্ম হয়। মেনেলাস যখন জানতে পারেন হেলেন আর কোন সন্তান ধারণ করতে পারবে না, তখনই তিনি তাঁর দাসীর গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেন।

মেনেলাসের যত আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতি কুটুম্ব প্রতিবেশী সকলে সম্মিলিত হয়েছিল সেই বিরাট ভোজসভায়। ভোজনপর্ব শেষে তখন চলছিল নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। উৎসবের অনাবিল আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন রাজা মেনেলাসও। তিনি একটি বীণা হাতে একটি সুর বাজাচ্ছিলেন আর সেই সুরের তালে প্রস্তুত হচ্ছিল দুজন নৃত্যশিল্পী।

মেনেলাসের প্রাসাদপ্রাঙ্গণে রথ থামিয়ে উৎসবমুখর সেই প্রাসাদের পানে তাকিয়ে রথের উপরেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইল মেলিমেকাস ও পীজেসট্রেটাস। এমন অবস্থায় রথ হতে অবতরণ করে রাজার নিকট যাওয়া তাদের উচিত হবে কি না তা বুঝে উঠতে পারছিল না। এমন সময় মেনেলাসের পক্ষ থেকে অতিথিদের যিনি তত্ত্বাবধান করছিলেন সেই লর্ড এতিওনিয়াস তাদের দেখতে পেয়ে রাজাকে সংবাদ দিলেন। এতিওনিয়াস বললেন, দুজন অতিথি এসেছেন প্রাসাদ প্রাঙ্গণে, দেখে মনে হলো তাঁরা রাজপুরুষ। আমি কি তাদের রথ হতে অবতরণ করতে বলব না তাঁদের অন্যত্র চলে যেতে বলব?

মেনেলাস বললেন, এতিওনিয়াস, তুমি এমন নির্বোধ এর আগে ছিলে না, তবে কেন এমন নির্বোধের মত কথা বলছ? একবার ভেবে দেখ দেখি ট্রয় থেকে প্রত্যাবর্তনকালে কত গৃহে আমরা কত আতিথ্যগ্রহণ করেছি। ঈশ্বর করুন আর যেন তা না হয়। ওদের রথ হতে অশ্বগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ওঁদের প্রাসাদে নিয়ে এস যাতে ওঁরাও আমাদের সঙ্গে এই ভোজসভায় যোগদান করতে পারেন।

ভৃত্যদের এতিওনিয়াস নির্দেশ দেওয়ায় তারা ছুটে গিয়ে টেলিমেকাসের রথ হতে অশ্ব দুটিকে খুলে আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে খেতে দিল। তারপর তাদের দুজনকে পথ দেখিয়ে প্রাসাদ অভ্যন্তরে নিয়ে গেল।

টেলিমেকাসের মনে হলো অমিত ঐশ্বর্যে সতত উজ্জ্বল সেই প্রাসাদের রত্নরাজি মণ্ডিত সমগ্র অন্তঃপুরটি পর্যাপ্ত সূর্যালোকে আলোকিত। চারদিকে মণিমুক্ত ও রত্নবিমণ্ডিত ঐশ্বর্যসম্ভারের প্রাচুর্য দেখে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়ল টেলিমেকাস।

তারা প্রথমে কয়েকজন পরিচারিকার সহায়তায় স্নান করল। তাদের গায়ে তৈলমর্দন করে দিল তারা। তারপর স্নানশেষে উত্তম পোশাক পরিধান করে মেনেলাসের পাশে একটি আসনে উপবেশন করল। তাদের উত্তম খাদ্য, স্বর্ণপাত্রে মদ পরিবেশন করা হলো।

মেনেলাস এবার অতিথিদের লক্ষ করে বললেন, আগে আপনারা পান ও ভোজনে তৃপ্ত হোন। পরে আমি আপনাদের পরিচয় জানব। তবে আপনাদের মুখমণ্ডল দেখে বেশ বোঝা যায় আপনারা রাজপুত্র। দেবরাজ জিয়াসের দ্বারা অনুগৃহীত রাজদণ্ডধারী কোন ব্যক্তি আপনাদের জন্মদান করেছেন। কোন সাধারণ বা হীন মানুষ কখনো এই ধরনের সন্তান জন্ম দান করতে পারে না।

পানাহার শেষ হলে টেলিমেকাস চুপিচুপি তার বন্ধুর কানে কানে বলল, দেখ পীজেসট্রেটাস তাম্র, রৌপ্য ও গজদণ্ড নির্মিত বস্তুর প্রাচুর্যে সমস্ত প্রাসাদ অন্তঃপুরটি দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। এমন ধাতব সম্ভারের প্রাচুর্য সচরাচর দেখাই যায় না। এসব দেখে আমি একথা মনে না করে পারছি না যে, একমাত্র দেবরাজ জিয়াসের স্বর্গলোকের প্রাসাদই এ প্রাসাদের সঙ্গে তুলনীয়।

তাদের কথা মেনেলাসের কানে যেতে মেনেলাস বললেন, কোন মানুষের সঙ্গে কখনো দেবরাজ জিয়াসের তুলনা করা যেতে পারে না বৎস। কারণ দেবরাজ জিয়াসের প্রাসাদের সকল বস্তুই অক্ষয়। তবে ধনসম্পদে খুব কম মানুষই আমার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারবে। ভেবে দেখ, যুদ্ধ শেষে প্রত্যাবর্তনকালে আমি সাত বছর ধরে বহু কষ্ট সহ্য করে বহু দেশে ঘুরে এইসব সম্পদ অর্জন করে এনেছি। আমি গিয়েছি সাইপ্রাস, ফোনিসিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, সাইডেনিয়া ও এরেম্বম্বিতে। সবশেষে গিয়েছি লাইবিয়াতে যেখানে শৃঙ্গযুক্ত মেষশাবক জন্মগ্রহণ করে আর বছরে তিনবার করে ভেড়ীদের বাচ্চা হয়। সেখানে যেকোন মানুষের সঙ্গে সবসময় ভেড়ার মাংস আর ভেড়ির দুধ থাকে।

কিন্তু আমি যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে এইভাবে সম্পদ আহরণ করছিলাম তখন আমাদের এক শত্রু আমার ভ্রাতাকে হত্যা করে। তার অবিশ্বস্ত স্ত্রীর সহায়তায় তার রক্ষীকে ঘায়েল করে আমার ভ্রাতাকে হত্যা করে সেই দুবৃত্ত। আজ আমি এত সম্পদের অধিকারী হয়েও আনন্দ পাচ্ছি না মনে। তোমাদের পিতা যেই হোন, তোমরা হয়ত তোমাদের পিতার কাছে শুনেছ কত দুঃখ আমি জীবনে সহ্য করেছি এবং আমার অনুপিস্থততে কত মূল্যবান বস্তু নষ্ট হয়েছে। আমার যেসব বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী আর্গস হতে বহু দূরে ট্রয়ের রণপ্রান্তরে প্রাণবলি দিয়েছে তারা যদি আজ জীবিত থাকত তাহলে আমি আমার এইসব ধনসম্পদের এক তৃতীয়াংশ পেয়েও সুখী হতাম। এই প্রশস্ত কক্ষে নির্জনে বসে থাকতে থাকতে তাদের কথা যখন মনে হয় তখন দুঃখে চোখে চল আসে আমার। অবারিত সেই অশ্রুধারা কোনক্রমেই প্রতিহত হতে চায় না।

কিন্তু যেসব প্রিয়জনদের আমি হারিয়েছি তাদের সকলের জন্য সমান দুঃখ আমি অনুভব করি না। তাদের মধ্যে একজনের জন্য আমার সবচেয়ে বেশি দুঃখ হয়। তার কথা যখন মনে করি তখন আহার নিদ্রা ঘৃণ্য মনে হয় আমার কাছে। কারণ ট্রয়যুদ্ধে যে। ব্যক্তি সবচেয়ে শ্রমসহকারে যুদ্ধ করেন এবং সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করেন তিনি হলেন ওডিসিয়াস এবং তারই জন্য আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। অথচ তার এত কষ্টভোগের কোন সুফল তিনি লাভ করতে পারলেন না। দুঃখে কেটে গেল তাঁর সারাজীবন আর আমি তাঁর মত এক বন্ধুকে হারিয়েছি একথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যেহেতু তাঁর দেশবাসী তাঁকে মৃত ভেবে শোকপ্রকাশ করছে, তথাপি তিনি সত্যসত্যই জীবিত না মৃত তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। দীর্ঘদিন ধরে একথা ভাবতে গিয়ে শুধু বিস্মিত হই। বৃদ্ধ লার্তেস, সুচতুর পেনিলোপ, যাকে তিনি নবজাত শিশু দেখে গৃহত্যাগ করেন সেই টেলিমেকাস–তারা সব তাঁকে মৃত বলে ধারণা করছে।

তার পিতার জন্য মেনেলাসকে শোক করতে দেখে টেলিমেকাসের দুঃখ আরও বেড়ে গেল। তার গণ্ডদ্বয় প্রবাহিত করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল তার চোখ থেকে। তার নীলাভ পোশাকের অঞ্চলভাগ দিয়ে সেই অশ্রু মুছে ফেলতে লাগল টেলিমেকাস। তা দেখে গভীর অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন মেনেলাস। টেলিমেকাস নিজে থেকে তার পিতার পরিচয় দান করবেন না তিনি প্রশ্ন করে জেনে নেবেন তা ভেবে পেলেন না।

মেনেলাস যখন বিহ্বল অবস্থায় এইসব ভাবছিলেন তখন তাঁর পরিচারিকাবৃন্দসহ হেলেন এসে উপস্থিত হলো সেখানে। পরিচারিকাদের অন্যতমা আদ্রিস্তে তার জন্য একটা চেয়ার টেনে দিল, আর নিজে তার জন্য এক পশমের কম্বল এনে দিল। ফাইলো তার কাছে এক রৌপ্য নির্মিত ঝুড়ি এনে ধরল। এই ঝুড়িটি মিশরের অন্তর্গত থীবস নিবাসী রাজা পলিবাসের স্ত্রী আলসিন্দে উপহার দেন হেলেনকে। পলিবাস মেনেলাসকে আরও দুটি রৌপ্যপাত্র ও একটি স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন। এছাড়া তার স্ত্রী হেলেনকে অনেক উপহার দেয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি ঝুড়ি। হেলেন তার চেয়ারে বসতেই ফাইলে কিছু সরু সুতো ও সেই সোনার চরকা সমেত সেই ঝুড়িটি এনে হেলেনের পাশে ধরল। এদিকে হেলেন বসে যা যা ঘটেছে স্বামীর কাছ থেকে তা জানতে চাইল। সে বলল, হে আমার স্বামী, আমাদের প্রাসাদে যারা এসেছেন তাদের পরিচয় জানতে পারি কি? আমি কি কিছু না জানার ভান করব না তোমাকে মনের কথা সব বলব? কোন নরনারীর মধ্যে তার পিতার সঙ্গে এমন সাদৃশ্য এর আগে কখনো দেখিনি আমি। আমি এতদূর বিস্মিত হয়ে পড়েছি যে এই যুবকের উপর হতে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না। নিশ্চয় ইনি ওডিসিয়াসপুত্র টেলিমেকাস। আমার মত একজন নির্লজ্জ হতভাগ্য নারীর জন্য তোমরা যখন ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করো তখন ওডিসিয়াস একে নবাগত শিশুরূপে বাড়িতে রেখে যান।

মেনেলাস উত্তর করলেন, হে আমার প্রিয়তমা পত্নী, তোমার মত আমিও এ সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছি। ওডিসিয়াসের হাত পা চুল ঠিক এইরকম ছিল। ওডিসিয়াসের চোখগুলোও এইভাবে ঘুরত। তাছাড়া আমি যখন একটু আগে ওডিসিয়াসকে স্মরণ করে বলছিলাম যে আমার জন্য কত দুঃখ ভোগ করেছেন তিনি, তখন ওর গণ্ডদ্বয় প্রবাহিত করে অশ্রু ঝরে পড়ে এবং ওর পোশাকের প্রান্তভাগ দিয়ে সে অশ্রু মুছে ফেলে।

এবার নেস্টরপুত্র পীজেসট্রেটাস বলল, মহাশয়, আমার এই বন্ধু যে ওডিসিয়াসের পুত্র সে অনুমান আপনার যথার্থ। কিন্তু উনি খুবই ভদ্র বলে প্রথমে নিজের পরিচয় দান করছেন না আর তাছাড়া আপনার এইসব আলোচনা আমাদের খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে দেবকণ্ঠ নিঃসৃত অমৃতবাণী শুনছি। টেলিমেকাস আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাওয়ায় জিরেনিয়ার রাজা নেস্টর আমাকে ওঁর সঙ্গে পাঠালেন। আপনি যাতে ওঁকে সৎ পরামর্শ দান অথবা কোন উপায়ের কথা বলে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন সেই জন্যই উনি এসেছেন আপনার কাছে। যদি তার পিতা থাকেন বা তাকে সাহায্য করার জন্য কোন হিতাকাঙ্খী ব্যক্তি না থাকে তাহলে যেকোন সন্তানকেই নানারকম বিপদে পড়তে হয়। রাজা ওডিসিয়াস এখন নিরুদ্দেশ এবং তার সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রাসাদে তাঁর কোন বন্ধু নেই।

মেনেলাস তখন আবেগের সঙ্গে বলে উঠলেন কে তা বলল। আমি রয়েছি। তিনি ছিলেন আমার এমনই একজন বন্ধু যিনি আমার প্রতি ভালবাসার জন্য বহু বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। যদি তিনি আমার সঙ্গে নিরাপদে গৃহে ফিরে আসতেন তাহলে আমি বহুকিছু পারিতোষিক দিয়ে তাকে পরিতৃপ্ত করতাম, কারণ আমি সমগ্র গ্রীক জাতির মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে ভালবাসি। আমি তাকে আমার রাজ্যের একটি নগর ও আর্গস তার বসবাসের জন্য দান করতে পারতাম। আমি তার জন্য একটি বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করে তাঁকে তাঁর পুত্র ও প্রজাপুঞ্জসহ এখানে নিয়ে আসতাম স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। আমরা তাহলে একই দেশে পাশাপাশি বাস করে প্রায়ই মিলিত হতাম। তাহলে আমাদের দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব ও ভালবাসা মৃত্যুর দিন দিন পর্যন্ত অবাধে চলতে থাকত। কিন্তু নিশ্চয় কোন ঈর্ষান্বিত দেবতা অন্যকিছু ভাবলেন এবং তাঁরই নিষ্ঠুর বিধানে একমাত্র সেই হতভাগ্য বন্ধুটি বাড়ি ফিরতে পারলেন না।

মেনেলাসের কথায় সকলেরই চোখে জল এল। আর্গসের হেলেন কেঁদে ফেললেন। টেলিমেকাস ও মেনেলাসও কাঁদতে লাগলেন। নেস্টরপুত্রও তার ভাই অ্যান্টিলোকাসের মৃত্যুসংবাদ শুনে অশ্রুসংবরণ না করে থাকতে পারল না। এবিষয়ে মেনেলাসের কাছ থেকে জানতে চাইলে সে বলল, মহাশয়, আমাদের বাড়িতে যখনই আপনার নাম ওঠে কোন আলোচনা প্রসঙ্গে তখনই আমার পিতা নেস্টর আপনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি বলে অভিহিত করেন। এখন আমার অনুরোধ, আপনি অশ্রু সংবরণ করে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। আমিও একজনের জন্য আহার-নিদ্রা, আনন্দ-বেদনা কোন কিছুতেই শান্তি পাই না। সে হচ্ছে আমার ভাই অ্যান্টিলোকাস, তাকে হয়তো আপনি দেখেছেন। কিন্তু আমি তাকে চোখে দেখি নি। কিন্তু লোকে বলে সে ছিল বড় সুদর্শন। দ্রুতগতি আর বীর যোদ্ধা।

মেনেলাস উত্তর করলেন, হে আমার বন্ধুগণ, তোমরা এতক্ষণ যা বললে আর করলে তাতে বৃদ্ধসুলভ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছ। তোমাদের বয়স এর দ্বিগুণ হওয়া উচিত ছিল। উপযুক্ত পিতার উপযুক্ত সন্তানের কাছে যে সদ্ব্যবহার প্রত্যাশা করি তোমরা সেই ব্যবহারেই প্রীত করেছ আমাকে। সদ্বংশের পরিচয় কখনো গোপন থাকে না। তোমার পিতা নেস্টর সত্যিই ভাগ্যবান। তিনি সদ্বংশজাত এবং জীবনের প্রথম দিন হতে বরাবর সৌভাগ্য লাভ করে আসছেন। বর্তমানে তিনি সমরকুশলী এবং বুদ্ধিমান পুত্রদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে সুখে শান্তিতে বার্ধক্য জীবনযাপন করছেন। যাই হোক, এখন অশ্রু বিসর্জন ত্যাগ করে নৈশভোজন সম্পন্ন করে নাও। প্রাতঃকালে আমি ও টেলিমেকাস দুজনে দুজনকে অনেক কাহিনী শোনাব।

অ্যামফ্যালিয়ন নামে মেনেলাসের জনৈক সহচর অতিথিদের হাতে জল দিল। ইতিমধ্যে হেলেন তাদের পানপাত্রে একরকম ওষুধ মিশিয়ে দিলেন যা মদের সঙ্গে পান করলে মানুষ সব দুঃখ ও দুঃসহ স্মৃতির বেদনা ভুলে যায়। যেকোন ব্যক্তি সে ওষুধ পান করলে সারাদিনের মধ্যে যে তার পিতামাতা, ভ্রাতা বা সন্তান কারো কোন মৃত্যুশোক একবারও অনুভব করবে না। একবিন্দু অশ্রুও বিসর্জন করবে না। হেলেনকে এই আশ্চর্য ওষুধ দান করে মিশরনিবাসী ফুনের পত্নী পলিডেমনা। মিশরের উর্বর মাটিতে বহু অদ্ভুত গাছ-গাছড়া ও ওষধি জন্মে। তাদের মধ্যে অনেক ওষধি প্রাণদায়িনী ক্ষমতায় সমৃদ্ধ, আবার কিছু বিষাক্ত ও ক্ষতিকর। ফুন ছিল খ্যাতিমান বৈদ্য পীওনের পুত্র।

হেলেন যেসব পাত্রে সেই ওষুধটি ফেলে দিয়েছিল সেগুলো মদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলে হেলেন বলল, হে আমার স্বামী মেনেলাস এবং আমাদের তরুণ অতিথিদ্বয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য, সুখ ও দুঃখের দিন আসবেই। এটাই হলো সর্বশক্তিমান জিয়াসের বিধান। তাই যদি হয় কেন তবে আমরা নৈশভোজন সম্পন্ন করে পরস্পরের কাহিনী শুনে তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করব না? এই ধরনের একটি কাহিনী আমি নিজেও বলব। অবশ্য অপরাজেয় বীর ওডিসিয়াসের সকল কৃতিত্বের কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তথাপি তাঁর একটি আশ্চর্য বীরত্বের কথা আমি বলব। ট্রয়যুদ্ধকালে একবার গ্রীকরা যখন যুদ্ধে বিপন্ন ও বিব্রত হয়ে পড়ে তখন সাহসের সঙ্গে একাকী এগিয়ে যান বীর ওডিসিয়াস। তিনি সহসা নিজের দেহকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে তোলেন। তারপর গায়ে একটি কম্বল চাপিয়ে ভিক্ষুকের বেশে ট্রয়নগরীতে প্রবেশ করে ভাল করে পথঘাট চিনে নেন। তাঁকে দেখে কোন ট্রয়বাসীই চিনতে পারেন নি। একমাত্র আমি তাঁর ছদ্মবেশ ভেদ করে তার আসল পরিচয় জানতে পারি। কিন্তু তাঁকে এ বিষয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি এড়িয়ে যান আমাকে। অবশ্য আমি যখন প্রতিশ্রুতি দিই তাঁকে যে তার নাম বা কোন কথা ট্রয়বাসীদের বলব না তখন তিনি আমাকে গ্রীকদের পরিকল্পনার কথা খুলে বললেন। তখন আমি তাঁর স্নানের ব্যবস্থা করে দিয়ে কিছু পোশাক দিই। তখন তাঁর বিরাট তরবারির দ্বারা বহু ট্রয়সৈন্যকে বধ করে গ্রীকশিবিরে ফিরে গিয়ে এক সুসংবাদ দান করেন। তখন অনেক ট্রয়রমণী তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে ক্রন্দন করতে থাকলে আমি আনন্দ করতে থাকি। কারণ তখন ঘরে ফেরার বাসনা প্রবল হয়ে উঠেছিল আমার মনে। আমার তখন হৃদয়ের পরিবর্তন হয়েছিল। যে প্রেমের কথায় আমাকে ভুলিয়ে আমাকে মোহান্ধ করে দেবী অ্যাফ্রোদিতে আমার স্বামীর ঘর ও সন্তানকে ত্যাগ করে ট্রয়নগরীতে যেতে বাধ্য করেন তার জন্য সত্যই অনুতাপ ভোগ করতে থাকি আমি।

মেনেলাস উত্তর করলেন, হে আমার প্রিয়তমা, তোমার বিবৃত কাহিনী সত্য। আমি পৃথিবীর বহুদেশে পরিভ্রমণ করেছি, আমি বহু লোকের সঙ্গে মিশেছি, অনেক মহান ব্যক্তির পরামর্শ লাভ করেছি, কিন্তু ওডিসিয়াসের মত এমন সাহসী ও অদম্য তেজস্বিতাসম্পন্ন মানুষ কখনো দেখিনি। সেই কাঠের ঘোড়া সম্পর্কে তিনি যা করেছিলেন তাও বুদ্ধি, সাহস ও দৃঢ় সংকল্পের অভ্রান্ত পরিচয় দান করে। আমার মনে আছে, কিছু নির্বাচিত গ্রীকসৈন্যসহ আমি সেই বিশাল কাঠের ঘোড়ার মধ্যে বসেছিলাম। কখন আমরা ট্রয়বাসীদের উপর চূড়ান্ত ধ্বংস সংঘটিত করতে পারব তার অপেক্ষায় ছিলাম। এমন সময় তুমি এলে সেই ঘটনাস্থলে। আমার অনুমান ট্রয়জাতিকে বিজয়গৌরব দানে ইচ্ছুক কোন দেবতার নির্দেশেই তুমি সেখানে গিয়েছিলে তখন। ট্রয়রাজকুমার দীফোবাসও তোমার সঙ্গে ছিল। শূন্যগর্ভ সেই বিশাল কাষ্ঠ নির্মিত ঘোড়াটিকে তিনবার বেষ্টন করে তুমি তার বহিরঙ্গটিকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কি দেখে নিলে। তারপর গ্রীকনেতাদের প্রত্যেকের নাম ধরে তাদের স্ত্রীর কণ্ঠ নকল করে ডাকতে লাগলে। আমি আর ডায়োমেডিস ভিতরে মাঝখানে বসেছিলাম, আমার পাশে ছিলেন ওডিসিয়াস। তোমার ডাক শুনে আমরা দুজন বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ঝাঁপ দিতে ও তোমার ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ওডিসিয়াস আমাদের হঠকারিতার পথে বাধা দিলেন। অন্যান্য বীরেরা কেউ কোন সাড়া দেয় নি। একমাত্র অ্যান্টিফাস তোমার কথার কি উত্তর দিতে যাচ্ছিল। ওডিসিয়াস সজোরে তার মুখের উপর হাতটা চেপে ধরে তাকে নিবৃত্ত করলেন। এথেনের নির্দেশে তুমি সেখান থেকে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি তার মুখটি জোরে চেপে রেখেছিলেন হাত দিয়ে। এইভাবে তিনি তখন আমাদের গোটা দলটিকে বাঁচিয়ে দেন।

এমন সময় টেলিমেকাস বলল, হে রাজন, এটা ভাবতে আরো খারাপ লাগে যে, এমন গুণসম্পন্ন ব্যক্তি নিজেকে বিপদ হতে রক্ষা করতে পারেন নি। এমন লৌহকঠিন হৃদয় তাকে বাঁচাতে পারল না। কিন্তু এখন আমি শুতে যাবার জন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি। এখন বিছানায় গিয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে চাই।

একথা শুনে হেলেন তার পরিচারিকাদের গাড়িবারান্দার উপর দুটো খাটে দুটি বিছানা প্রস্তুত করে তাতে লেপ কম্বল প্রভৃতি উপযুক্ত শীতবস্ত্র দিতে বললেন। শয্যা প্রস্তুত হলে অতিথিদের শয়নকক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন মেনেলাস প্রাসাদের পশ্চাদ্বর্তী একটি কক্ষে শয়ন করতে গেলেন। দীর্ঘায়িত পোশাকপরিহিতা হেলেনও তাঁর পাশে গিয়ে শুলেন।

প্রত্যূষের লাল আলো পূর্ব দিগন্তে ফুটে উঠতেই পরিধানে পোশাক আর পায়ে চটি পরে একটি তরবারি স্কন্ধে ঝুলিয়ে নিয়ে শয়নকক্ষ হতে বেরিয়ে পড়লেন বীর যোদ্ধা মেনেলাস। তিনি সোজা টেলিমেকাসের কাছে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের পাশে একটি আসনে উপবেশন করলেন।

প্রশ্ন করলেন রাজা মেনেলাস, এবার তোমার এখানে আসার আসল উদ্দেশ্যটা কি তা বলত টেলিমেকাস। তুমি কি রাষ্ট্রগত কোন ব্যাপারে এসেছ, না তোমার কোন ব্যক্তিগত কাজে এসেছ?

টেলিমেকাস উত্তর করল, হে রাজন মেনেলাস, আমি জানতে এসেছি আপনি আমার পিতার কোনো সংবাদ দিতে পারেন কি না। আমারই বাড়ি থেকে আমি বিতাড়িত, আমার যাবতীয় ধনসম্পত্তি নিঃশেষিত হতে বসেছে। একদল দুবৃত্ত আমার বাড়িতে থেকে দিনের পর দিনে আমার গবাদি পশুগুলোকে নিধন করে চলেছে এবং সমস্ত শালীনতায় জলাঞ্জলি দিয়ে আমার মার পাণিপ্রার্থীরূপে এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে পরস্পরের মধ্যে। আপনি হয়ত আমার পিতার শোচনীয় পরিণতি সম্পর্কে কোন সত্য উদঘাটন করতে পারবেন এই আশায় আমি এসেছি আপনার কাছে। হয়ত আপনি নিজেও চোখে দেখে থাকতে পারেন অথবা কোন পরিব্রাজকের মুখ থেকে এ বিষয়ে শুনে থাকতে পারেন। আমার পিতার মত হতভাগ্য ব্যক্তি আর কখনো জন্মগ্রহণ করে নি পৃথিবীতে। আমার প্রতি দুর্বলতা বা দয়াবশত কোন সত্য গোপন করবেন না। আপনি যা ঘটেছে সে সম্বন্ধে প্রকৃত সত্য যথাযথভাবে বলবেন। আমি আবার অনুরোধ করছি, আমার পিতা ওডিসিয়াস যদি ট্রয়যুদ্ধে তাঁর বাহ্যিক বা কায়িক কার্যের দ্বারা কোন উপকার আপনাদের করে থাকেন তাহলে আপনি যা কিছু জানেন, তা অকুণ্ঠভাবে ব্যক্ত করুন।

এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধে উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন মেনেলাস। চিৎকার করে বললেন, কী লজ্জার কথা। তাহলে সেই হীন কাপুরুষগুলো বীরের দাম্পত্য শয্যাকে কলুষিত করতে চলেছে! ভীরু হরিণ যেমন চায় শক্তিধর সিংহের গুহায় গিয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে। সিংহ অধ্যুষিত সুউচ্চ ও তৃণাচ্ছন্ন কোন গ্রস্ত উপত্যকাকে পরিণত করতে চায় তার চারণক্ষেত্রে। কিন্তু ভয় নেই, সিংহ তার গুহায় ফিরে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর এক বিপদ ঘনিয়ে আসছে ঐসব কাপুরুষদের জীবনে। ক্রুদ্ধ ওডিসিয়াসের সম্মুখীন হতেই হবে ওদের সকলকে। একবার আমি লেসরস দ্বীপে ফিলোমেনিদেসের সঙ্গে এক মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখি ওডিসিয়াসকে। সেই মল্লবীরকে অচিরে ধরাশায়ী করে উপস্থিত সকলকে প্রীত করেন তিনি। দেবরাজ জিয়াস, এথেন ও অ্যাপোলোর নামে শপথ করে বলছি, ঐসব পাণিপ্রার্থীদের সঙ্গে শীঘ্রই সাক্ষাৎ হবে ওডিসিয়াসের। এক শোচনীয় মৃত্যুকে বন্ধু হিসেবে বরণ করতে হবে ওদের সকলকেই।

এবার তোমার আবেদনের কথায় আসা যাক। তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা বা দায়িত্বহীন কথা বলে তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। সত্যবাদী একজন বৃদ্ধ নাবিকের মুখ থেকে আমি যা যা শুনেছি তা যথাযথভাবে বিবৃত করব।

ঘটনাটা ঘটেছিল মিশরে। আমি তখন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য। কিন্তু উপযুক্ত অর্ঘ্যদানে দেবতাদের ঠিকমত প্রীত করতে পারি নি। দেবতারা বিলম্বিত করেছিলেন আমার যাত্রাপথকে। কারণ কোন মানুষের দৈব নিয়মভঙ্গ ক্ষমা করেন না দেবতারা। মিশরে নীল নদীর মোহনা থেকে কিছু দূরে ফ্যারস নামে এক দ্বীপ আছে। ওখান থেকে এক দ্রুতগামী জাহাজের পক্ষে মাত্র একদিনের পথ। সেই দ্বীপের এক পার্বত্য গুহার ভিতরে স্বচ্ছ জলের এক কূপ আছে। সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকরা সেই দ্বীপের পাশে জাহাজ থামিয়ে সেই কূপ থেকে পানীয় জল নিয়ে যায়। সেই দ্বীপের পাশে দেবতাদের বিধানে সহসা আমাদের জাহাজ থেমে যায়। অনুকূল বাতাসের অভাবে কুড়িদিন ধরে সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকে সে জাহাজ। আমার সব রসদ ও লোকজনের সব প্রাণশক্তি নিঃশেষে ফুরিয়ে যেত যদি না এক দেবতা আমার উপর দয়া করে এগিয়ে আসতেন আমার সাহায্যে। তিনি ছিলেন প্রবীণ জলদেবতা প্রোতেউসের কন্যা আইদোথী। আমার লোকজনেরা তখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে দ্বীপের উপকূলে ছিপে করে মাছ ধরে ক্ষুন্নিবৃত্তি করার চেষ্টা করল।

একদিন আমার লোকেরা যখন এইভাবে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত ছিল তখন আমি এক নির্জনে বেড়াচ্ছিলাম। সহসা দেবী আইদোথীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আমার আর আমি তখন তাঁর কাছে আমার উদ্ধারের জন্য কাতর আবেদন জানাই। দেবী আইদোথী সোজা আমার কাছে এসে বললেন, তুমি কি নির্বোধ, তোমার মাথায় কোন বুদ্ধি নেই। অথবা তুমি দুঃখকষ্ট ভালবাস। তোমার লোকজন দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়া সত্ত্বেও তুমি কি কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছ না দ্বীপ হতে বেরিয়ে যাবার?

আমি তখন বললাম, আমি জানি না আপনি কোন দেবী। তবে বলতে পারি এ দ্বীপে অবস্থান করার কোন বাসনাই নেই আমার। আমার মনে হয় স্বর্গলোকের কোন দেবতাকে কোন কারণে রুষ্ট করেছি আমি। আপনারা দেবতা, সর্বজ্ঞ। আমাকে বলুন কোন দেবতা আমাকে এভাবে আবদ্ধ করে রেখেছেন এবং কেমন করেই বা আমি মুক্তি পাব মৎস্যসঙ্কুল এই সমুদ্ৰাঞ্চল থেকে।

দয়াময়ী সেই দেবী মমতার সঙ্গে উত্তর করলেন, তোমার জ্ঞাতব্য সব তথ্যই আমি দান করব। এই দ্বীপটি হলো বয়োপ্রবীণ জলদেবতা প্রোতেউসের অধিকারে। লোকে বলে তিনি নাকি আমার পিতা। প্রোতেউস হচ্ছে প্রভঞ্জন ও প্রকম্পন দেবতা পসেডনের বশীভূত এবং সমগ্র সমুদ্র ও তার তলদেশ তাঁর নখদর্পণে। যদি তুমি কোনভাবে একটি ফাঁদ পেতে তাকে ধরতে পার তাহলে তিনি তোমার অবশিষ্ট যাত্রাপথ ও তার দূরত্ব সম্পর্কে সবকিছু নির্ভুল তথ্য বলে দেবেন তোমায়। শুধু তাই নয়, যেহেতু তুমি একজন রাজা এবং কষ্টসাধ্য বিদেশভ্রমণে ব্যাপৃত, তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিকালে তোমার প্রাসাদে ভালমন্দ যা যা ঘটেছে তা সব বলে দিতে পারবেন তিনি।

আমি তখন বললাম, একমাত্র আপনিই বলে দিতে পারবেন তাকে ধরার পথ। আমাকে দেখতে পেয়ে, আমার উদ্দেশ্যের কথা আগেই বুঝতে পেরে তিনি অন্যত্র সরে পড়তে পারেন। মায়াবেশী সেই রহস্যময় দেবতাকে ধরা সহজ কাজ নয়। এবারও সেই দেবী দয়া করে আমাকে পথ বলে দিলেন। তিনি বললেন, এখন বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। এমনি সময় সেই বৃদ্ধ দেবমানব সমুদ্রতল হতে উঠে আসেন। তিনি যখন আসেন তখন পশ্চিম দিগন্ত হতে একটি বিশাল রহস্যময় মার্জারের থাবা এসে এমনভাবে অন্ধকার করে দেয় সমুদ্রপৃষ্ঠকে যে কারো দৃশ্যগোচর হয় না তাঁর আগমন। সমুদ্র হতে এসে এই দ্বীপের কোন একটি পার্বত্য গুহাভ্যন্তরে নিদ্রা যাবার জন্য বেছে নেন তিনি তার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য সীল মাছ দল বেঁধে তাঁর চারদিকে ভিড় করে আর তাদের দেহগাত্র হতে মৎস্যগন্ধ নিঃসৃত হতে থাকে। তোমার নাবিকদের মধ্যে ভাল দেখে তিনজনকে বেছে নাও। সকাল হলে আমি তোমাদের এক জায়গায় নিয়ে যাব। তারপর কি করতে হবে বলে দেব। সকালে উঠে প্রোতেউস প্রথম তাঁর চারপাশে শুয়ে থাকা সীল মাছগুলোকে গণনা করবেন, তারপর আবার তিনি সেই গুহার মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়বেন।

সেই সময় তোমার একটা কাজ করতে হবে। তিনি শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার শক্তি ও সাহসকে সংহত করে ধরে ফেলতে হবে তাঁকে। তিনি নিজেকে মুক্ত করার জন্য যত কঠোর চেষ্টাই করুন না কেন, কোনমতেই ছাড়বে না তাঁকে। ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন রকমের রূপ পরিগ্রহ করবেন তিনি। তিনি শুধু বিভিন্ন রকমের জীবজন্তুর আকারই ধারণ করবেন না, জল এবং জ্বলন্ত আগুনের রূপ ধরেও তোমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু যে কোন অবস্থাতেই তাকে শক্ত করে ধরে থাকতে হবে তোমাকে। তারপর যখন তিনি তাঁর স্বাভাবিক রূপ ধারণ করে তোমাকে প্রশ্ন করবেন, একমাত্র তখনি তুমি তাকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, কোন দেবতা তোমাকে এখানে আবদ্ধ করে রেখে দিয়েছেন এবং কিভাবেই বা তুমি মুক্তি পাবে এই দ্বীপ থেকে।

এই কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন দেবী আইদোথী। চিন্তান্বিত মনে সেখানে থেকে জাহাজে ফিরে গেলাম আমি। তারপর নৈশভোজন শেষ করে সমুদ্রের সেই তলদেশের বেলাভূমির উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পূর্ব দিকে লাল আলো ফুটে উঠতেই তিনজন বিশ্বস্ত নাবিককে সঙ্গে করে রওনা হয়ে পড়লাম আমি। আগের দিন সন্ধ্যায় আইদোথী সমুদ্রের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন কোথাও, আবার তিনি সমুদ্র হতেই আবির্ভূত হলেন। সমুদ্রকূল সংলগ্ন একস্থানের বেলাভূমিতে হাতে চারটি সীল মাছের চামড়া নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। আমরা সেখানে উপস্থিত হতেই তিনি আমাদের সেখানে শুইয়ে দিয়ে আমাদের গায়ের উপর সীল মাছের সেই চামড়াগুলো চাপিয়ে দিলেন। সীল মাছের সেই উৎকট দুর্গন্ধে প্রাণ আমাদের ওষ্ঠাগত হয়ে আসতে লাগল। আমার কেবলি মনে হতে লাগল, সমুদ্রতলবর্তী মৎস্যগন্ধবিশিষ্ট কোন জীব যেন কারো শয্যাসঙ্গী না হয়। দেবী তা বুঝতে পেরে তিনি আমাদের রক্ষা করলেন তার থেকে। আমাদের নাসারন্দ্রে একটি ওষুধ প্রয়োগ করতেই তার মধুর গন্ধে সেই উৎকট মৎস্যগন্ধ অপসৃত হলো মুহূর্তে।

সারা সকাল আমরা সেই বেলাভূমিতেই সীল মাছের চামড়া গায়ে দিয়ে শুয়ে রইলাম। পরে দেখলাম সমুদ্র হতে দলে দলে সীল মাছ এসে সেই বেলাভূমিতে আমাদের কাছাকাছি শুয়ে পড়ছে। বেলা দ্বিপ্রহর হতেই প্রোতেউস সমুদ্র হতে উঠে এসে সীল মাছগুলোকে গণনা করতে লাগলেন। আমাদেরও সীল মাছ ভেবে প্রথমে গণণা করলেন। তারপর তিনি নিজে শুতে যেতেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার পিঠের উপর। কিন্তু মায়াবী যাদুবিদ্যার বলে সেই বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ রূপ পরিবর্তন করে প্রথমে সিংহ ও পরে সর্প হয়ে গেলেন। পরে বন্য শূকর, প্রবহমান জলস্রোত ও জ্বলন্ত আগুনের রূপও ধারণ করলেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই তাকে ছেড়ে দিলাম না আমরা।

সমস্ত কৌশল যখন ব্যর্থ হয়ে গেল একে একে তখন প্রোতেউস আমাদের সহজভাবে প্রশ্ন করলেন, বল মেনেলাস, কোন দেবতা তোমার সঙ্গে চক্রান্ত করে আমাকে এভাবে বন্দী করতে সমর্থ করল তোমায়? কি জন্যই বা তুমি এ কাজ করলে?

আমি তখন বললাম, সে বয়োপ্ৰবীণ দেবতা, এটা শুধু মুক্তিলাভের এক চেষ্টামাত্র। আপনি ভালভাবেই জানেন কিভাবে আমি বন্দী হয়ে আছি এই দ্বীপে এবং দিনে দিনে কেমন হীনবল হয়ে পড়ছি। আপনি আপনার দৈব সর্বজ্ঞতার প্রভাবে বলুন, কোন দেবতা আমার যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টি করছেন এমন করে এবং কিভাবেই বা আমি মুক্তি পাব এখান থেকে।

বৃদ্ধ পোতেউস তখন বললেন, যখন তুমি গৃহে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করে তখন তুমি জিয়াস বা অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে কোন কিছু উৎসর্গ করো নি বা উপযুক্ত পূজা অর্ঘ্য দান করো নি। তা না করে বড় রকমের ভুল করেছ তুমি। যদি তুমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করে আত্মীয় পরিজনদের দেখতে চাও তাহলে আবার তোমাকে নীল নদী পার হয়ে আনুষ্ঠানিক পূজা-অর্চনার কাজ ঠিকমত সম্পন্ন করতে হবে। একমাত্র তাহলেই আকাশবাসী দেবতারা প্রীত হয়ে তোমার সমুদ্রযাত্রা আবার সম্ভব করে তুলবেন।

তিনি যখন আমায় বললেন আমার মিশর দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নীল নদীকে অতিক্রম করতে হবে, তখন আমি সত্যি হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। তথাপি সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আপনি যা বললেন আমি তাই করব। কিন্তু আমার আর একটি কথার জবাব দিতে হবে আমাকে। ট্রয় থেকে যাত্রা করে পথে আমি ও নেস্টর আমাদের যেসব বন্ধুদের ফেলে চলে আসি তারা কি সবাই বাড়ি ফিরতে পেরেছে অথবা সমুদ্রে কোন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে অথবা মৃত্যুবরণ করেছে?

প্রোতেউস বললেন, কেন তুমি এসব প্রশ্ন আমায় জিজ্ঞাসা করছ আত্রেউসপুত্র? আমার অন্তরে নিহিত সেই সকল কথা জানার কি প্রয়োজন তোমার? আমার সেই কাহিনী শুনলে তোমার চোখের জল যে আরো দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হবে সে বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছি তোমায়। অনেকে বেঁচে গেলেও অনেক হয়েছে নিহত। শুধু দুজন সেনাপতি বাড়ি যাবার পথে প্রাণ হারায়। ট্রয়যুদ্ধের কথা অবশ্য আমি কিছু বলতে চাই না। কারণ তুমি নিজে যে যুদ্ধে যোগদান করেছিলে। তৃতীয় একজন গ্রীক সেনাপতি এখনো জীবিত থাকলেও তিনি এই বিরাট সমুদ্রের মাঝে এক দ্বীপে বন্দী অবস্থায় কালযাপন করছেন। প্রথমে বলি আমাদের আয়াসের কথা। পসেডনের ইচ্ছায় তার জাহাজডুবি হয় আর সে স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে চলে যায়। তারপর পাইরা দ্বীপের কাছে গিয়ে কোনরকমে রক্ষা পায় সে। এথেনের শত্রুতা সত্ত্বেও সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে যেত যদি সে বড়াই করে না বলত যে দেবতাদের কোন সাহায্য না নিয়েই সম্পূর্ণ নিচের চেষ্টায় রক্ষা পেয়েছে সমুদ্রের ক্ষুধিত গ্রাস থেকে। আর এই দম্ভোক্তি পসেডনের কানে যেতেই তিনি রেগে গিয়ে পাইরা দ্বীপের যে পাহাড়টির উপর বসে বড়াই করছিল আয়াস পাগলের মত, সেই গোটা পাহাড়টিকে ধরে দুফাঁক করে দেন পসেডন। সেই পাহাড়ের অর্ধাংশ ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু যেদিকটায় আয়াস বসেছিল সেদিকটা ভেঙ্গে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। আর আয়াসও সমুদ্রের জলে পড়ে লবণাক্ত জল খেতে খেতে মরে গেল। তোমার ভ্রাতা কোনরকমে যে-যাত্রা রক্ষা পেল। কিন্তু সে মানিয়া অন্তরীপের কাছে এক বিরাট ঝড়ের কবলে পড়ে। সেখান থেকে ঢেউয়ের দ্বারা তাড়িত হয়ে অনেক দূরে চলে যায়। পরে ঝড় থেমে গেলে তিনি রক্ষা পান। অন্তরে প্রচুর আনন্দ নিয়ে তার পৈত্রিক দেশে ফিরে এলেন অ্যাগামেমনন। বহুদিন পরে স্বদেশের মাটি দেখে তপ্ত অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল তার গাল বেয়ে। কিন্তু এজিসথাস নিযুক্ত এক গুপ্তচর একটি উঁচু গম্বুজ হতে অ্যাগামেমননের আগমন প্রত্যক্ষ করে এবং এজিসথাসকে যথাসময়ে খবর দেয়। এ কাজে সে দুটি স্বর্ণমুদ্রা পায়। এক বছর থেকে সেই লোকটা লক্ষ্য করে আসছিল। রাজা অ্যাগামেমনন যদি হঠাৎ এসে পড়ে তিনিই প্রথমে এজিসথাসকে আক্রমণ করেন এই ভয়ে সে তোক রেখেছিল রাজার আগমন সংবাদ তাকে দেবার জন্য। অ্যাগামেমননকে দেশের মাটিতে পা দিতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই গুপ্তচরটা প্রাসাদের ভিতরে ছুটে গিয়ে খবর দিল এবং এজিসথাস তখন মাথা খাঁটিয়ে এক ফন্দী আটল। সে এক সুচতুর ফাঁদ পাতল রাজার জন্য। সে কুড়িজন ভাল সৈনিককে নগর থেকে নিয়ে এসে প্রাসাদের এক অংশে লুকিয়ে রাখল। আর এক অংশে রাজার সম্মানার্থে এক ভোজসভার আয়োজন করল। তারপর একটি রথ নিয়ে রাজাকে আনতে গেল সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে। তার মনের সেই কুটিল কুৎসিত চক্রান্তের কথা কিছুই জানতে পারলেন না রাজা অ্যাগামেমনন। তাই তিনি এজিসথাসের সঙ্গে বন্দর থেকে আপন প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর ভোজসভা চলাকালীন রাজাকে হত্যা করল এজিসথাস, ঠিক যেমন গোশালায় বলদকে অতর্কিতে হত্যা করা হয়। রাজার অনুচরদের আগেই হত্যা করা হয়েছিল।

এই হলো তার কাহিনী। তার সে কাহিনী শুনে অন্তর ভেঙ্গে পড়েছিল আমার। সমুদ্রের বেলাভূমির উপর বসে আমি কাঁদতে লাগলাম। জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলাম আমি। আমি তখন একান্তভাবে কামনা করছিলাম শুধু মৃত্যু আর অন্ধকার। জীবনে আমার কোন প্রয়োজন ছিল না। সূর্যের মুখ আর দেখার ইচ্ছা ছিল না আমার। বালির উপর শুয়ে ছটফট করতে করতে অনেকক্ষণ কাদার পরে প্রোতেউস বললেন, মেনেলাস, তুমি অনেক অশ্রুপাত করেছ। বৃথা অশ্রুপাত করলে কোন ফল হবে না। যথা শীঘ্র পার স্বদেশে ফিরে যাও। তুমি সেখানে দেখবে হয় এজিসথাস বেঁচে আছে অথবা ওরেস্টেস তাকে হত্যা করে তোমাকে রাজারূপে ঘোষণা করেছে এবং এজিসথাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ত তুমি দেখতে পাবে।

তার কথা শুনে আমি আবার সম্বিত ফিরে পেলাম। দুঃখের মাঝেও কিছুটা শান্তি পেলাম।

আমি তাকে আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, আপনি দুজন গ্রীকবীরের কথা বললেন। কিন্তু তৃতীয়জন যিনি সমুদ্র মধ্যবর্তী কোন দ্বীপে বন্দী হয়ে আছেন তার কথা কিছু বলুন।

প্রোতেউস বললেন, তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন ওডিসিয়াস, যার বাড়ি হলো ইথাকায়। আমি একবার তাকে যে দ্বীপে জলপরী ক্যালিপসো থাকে সেই দ্বীপে দেখেছিলাম। তাঁর চোখ থেকে ঝরে পড়ছিল বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা। ক্যালিপসো সেখানে তাকে বন্দী করে রেখে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কোন নাবিক বা জাহাজ নেই যাতে করে তিনি বিশাল সমুদ্রপথ অতিক্রম করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন। এবার মেনেলাস তোমার নিজের ভাগ্যের কথা শোন। তুমি কিন্তু তোমার স্বদেশের বিশাল অশ্বচারণভূমিসমৃদ্ধ আর্গসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারবে না। দেবতাদের নির্দেশে তোমাকে যেতে হবে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এলিসীয় সমভূমিতে অবস্থিত র‍্যাদামানথাসের দেশে যেখানে বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না কখনো, যেখানে জীবিকার্জন খুবই সহজ, যেখানে সমুদ্র হতে আগত পশ্চিমাবায়ু, মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হয় প্রতিনিয়ত। এইভাবে জিয়াসকন্যা হেলেনের স্বামীকে তার শেষ পরিণতির দিকে দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন স্বর্গের দেবতারা।

বন্ধু প্রোতেউস তাঁর কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করলেন নিমেষের মধ্যে। আমি আমার সেই বীর সঙ্গীদের নিয়ে আমাদের জাহাজে ফিরে গেলাম। আমরা সকলেই গভীরভাবে চিন্তামগ্ন অবস্থায় হাঁটছিলাম। জাহাজে উঠে আমরা নৈশ ভোজন সেরে নিলাম। রহস্যময়ী রাত্রির অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল আমাদের চারিপাশে। আমরা সেই সমুদ্রতরঙ্গলাঞ্ছিত বেলাভূমির উপর শুয়ে পড়লাম।

প্রভাতের প্রথম গোলাপী আলো ফুটতে না ফুটতেই উঠে পড়লাম আমরা। জাহাজে পাল খাঁটিয়ে যাত্রার উপযোগী করে সাজিয়ে তুললাম জাহাজটিকে। আমার নাবিকরা প্রস্তুত হয়ে উঠল। তারপর জাহাজ ছেড়ে দিল। সমুদ্র হতে নীল নদের মোহনায় গিয়ে জাহাজ উপনীত হতেই কূলে নেমে পড়লাম আমি। দেবতাদের যথাযথ অর্ঘ্যদানে প্রীত করে রাজা অ্যাগামেমননের জন্য এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলাম আমি। তারপর আবার যাত্রা শুরু করলাম। দেবতাদের কৃপায় এবার পেলাম অনুকূল বাতাস যাতে করে আমি অনায়াসে উপনীত হলাম আমার বহু আকাঙিক্ষত প্রিয়তম জন্মভূমিতে।

এবার শোন বন্ধু, আমি তোমাকে আমার প্রাসাদে বারো দিন অবস্থান করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তারপর তোমাকে আমি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পাঠিয়ে দেব। তোমাকে আমি তিনটি অশ্ব ও একটি রথ উপহার হিসেবে দান করব। আর একটি সুন্দর পানপাত্র দান করব যা দিয়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে মদের অঞ্জলি দান করতে পারবে।

তার স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে টেলিমেকাস উত্তর করল, সে মাননীয় লর্ড, আপনার প্রাসাদে আমার এই অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আমাকে অনুরোধ করবেন না। অবশ্য একথা সত্য, আপনার কথিত কাহিনী ও মধুর আলোচনা শুনে আমি এতদূর প্রীত হয়েছি যে, আমি একটি বৎসর আমার স্বদেশের কথা না ভেবে অবস্থান করতে পারি এই প্রাসাদে কিন্তু আমার যেসব সহচরকে আমি পাইলসে রেখে এসেছি তারা অসহিষ্ণু হয়ে পড়বে। আমাকে আর বিলম্ব করতে বলবেন না। আর আমাকে এমন উপহার দান করবেন যা আমি সহজে বহন করতে পারি। আমাকে যে অশ্ব দান করবেন বলেছেন তা আমি আপনার আস্তাবলেই রেখে যাব। কারণ আপনাদের এদেশে যে বিরাট অশ্বচারণক্ষেত্র আছে আমাদের ইথাকায় তা নেই। ওখানে আছে মেষচারণ ক্ষেত্র। ওখানে পর্বতদেশসমাকীর্ণ যেসব নিম্নভিমুখী তৃণাচ্ছন্ন ভূমি সমুদ্রে গিয়ে মিশে গেছে সেসব ভূমি অশ্বচালনার পক্ষে অনুকূল নয়।

একথা শুনে মৃদু হাস্য করলেন মেনেলাস। তিনি তাঁর হাত দিয়ে টেলিমেকাসের পিঠ চাপড়ে বললেন, তোমার কথা শুনে সত্যিই প্রীত হয়েছি। তোমার কথা শুনে যে কেউ বলে দিতে পারে তোমার দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে উচ্চ বংশজাত রক্তের ধারা। ঠিক আছে, তোমার কথামত আমি দেব আমাদের প্রাসাদের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু। সেটি হলো দেবশিল্পী হিফাস্টাসনির্মিত সোনার হাতলবিশিষ্ট রৌপ্যনির্মিত একটি পানপাত্র। এটি আমার বন্ধু সিডনের রাজা প্রত্যাবর্তনকালে তাঁর প্রাসাদের আতিথ্য গ্রহণ করলে তিনি আমায় উপহার দেন।

তাঁদের আলোচনার মধ্যেই নিমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে সমবেত হতে লাগল মেনেলাসের প্রাসাদে। তারপর শুরু হলো ভোজসভা।

এদিকে ইথাকায় ওডিসিয়াসের প্রাসাদের সম্মুখস্থ ক্রীড়াভূমিতে অস্ত্রীড়ায় মত্ত হয়ে উঠেছে পেনিলোপের পাণিপ্রার্থীরা। তাদের দুই নেতা অ্যান্টিনোয়াস ও যুবরাজ ইউরিমেকাস এক প্রান্তে বসে তা দেখছিল। এমন সময় ফ্রোনিয়াসপুত্র নোমন এসে অ্যান্টিনোয়াসকে একটি প্রশ্ন করল। সে বলল, আচ্ছা টেলিমেকাস, পাইলস থেকে কখন ফিরবে সে সম্বন্ধে তোমাদের কোন ধারণা আছে না সে বিষয়ে কিছু জান না। তোমরা? সে আমার জাহাজটা নিয়ে গেছে। সে জাহাজটার এখন আমার দরকার। আমি সে জাহাজে করে এলিস দ্বীপে গিয়ে বারোটা ঘোটকী পুষতে চাই।

নোমনের কথায় এক গোপন আশঙ্কা দেখা দিল পাণিপ্রার্থীদের মনে। কারণ তারা কোনদিন ভাবতেই পারেনি টেলিমেকাস সত্যি সত্যিই পাইলস যাবে। তারা ভেবেছিল টেলিমেকাস পার্শ্ববর্তী কোন কৃষিক্ষেত্রে বা পশু চারণক্ষেত্রে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে। কিন্তু নোমনের কথায় তাদের চৈতন্যোদয় হলো। এবার অ্যান্টিনোয়াস প্রশ্ন করল নোমনকে, তোমার কাছ থেকে সত্য কথা জানতে চাই। সে কখন এখান থেকে যায় এবং কারাই বা তার সঙ্গে যায়? সে কি শহর থেকে নাবিক সংগ্রহ করে অথবা তার ভৃত্যদের নাবিক হিসেবে নিয়ে যায়? আর একটি কথা তোমায় স্পষ্ট করে বলতে হবে। সে কি তোমার জাহাজ জোর করে কেড়ে নিয়ে যায় অথবা তুমি স্বেচ্ছায় তা তাকে দাও?

নোমন বলল, আমি তাকে স্বেচ্ছায় তা দিয়েছি। তার মত সম্মানিত ব্যক্তি যদি কোন জিনিস কারো কাছে চায় তাহলে কি তা না দিয়ে পারা যায়? তাছাড়া সে তখন অতিশয় মনোকষ্টে ভুগছিল, আমি তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। আর যেসব যুবককে সে শহর থেকে নিয়ে যায় তারা নাবিক হিসেবে আমাদের পরেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে। সেই জাহাজের প্রধান চালক হিসেবে মেন্টরকে দেখেছি আমি। অবশ্য জানি না তিনি মেন্টরবেশী কোন দেবতা কি না। কারণ গতকাল সকালে আমি মেন্টরকে এই শহরেই দেখেছি স্বচক্ষে। অথচ সেদিন আমি যে তাকে আবার সেই জাহাজে করে পাইলসের পথে রওনা হতে দেখেছি সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

নোমনের এ কথায় অ্যান্টিবোয়াস ও ইউরিমেকাস দুজনে রাগে ফুলতে লাগল। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে নোমন চলে গেল তার পিতার কাছে। তখন তারা অস্ত্রীড়া থামিয়ে অন্যান্য পাণিপ্রার্থীদের তাদের কাছে ডাকল। সকলে সমবেত হলে অ্যান্টিনোয়াস তার বক্তৃতা শুরু করল। এক প্রবল ক্রোধে ভরে উঠেছিল তার অন্তর। তার চোখদুটো জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মত জ্বলছিল। সে বলল, জাহান্নামে যাক সব। কী দুঃসাহসের সঙ্গেই না টেলিমেকাস এই বিদেশযাত্রার ব্যবস্থা করেছে। অবশ্য জোর গলায় বলতে পারি এ যাত্রা ব্যর্থ হবে তার। আমাদের সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও সে কুড়িজন সুদক্ষ নাবিক আর একটা জাহাজ সংগ্রহ করে রওনা হয়েছে। এই ছোকরা ক্রমাগত আমাদের বাধা দিয়ে আসছে, আমাদের মনে অশান্তি সৃষ্টি করছে, ঈশ্বর করুন, বেশি বাড় হবার আগেই ওর পাখাগুলো আমরা যেন কেটে ফেলতে পারি। যাই হোক, আমাকে একটা জাহাজ আর কুড়িজন নাবিক যোগাড় করে দাও। তাই নিয়ে ইথাকা আর সামস দ্বীপের মাঝখানের প্রণালীতে অপেক্ষা করব তার জন্য। সে সেখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার এই পিতৃসন্ধানবিলাসী সমুদ্রযাত্রার চির অবসান ঘটাব। অবিলম্বে অ্যান্টিনোয়াসের এই প্রস্তাবিত পরিকল্পনাকে অভিনন্দন জানাল অন্য সকলে। সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে সভা ভঙ্গ হলো। সকলে প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলে গেল।

অল্পকালেই মধ্যেই পেনিলোপ তাঁর পাণিপ্রার্থীদের দ্বারা পরিকল্পিত এই চক্রান্তের কথা জানতে পারলেন। মেডন নামে প্রাসাদের এক প্রহরী তাঁকে এ সংবাদ দান করল। পাণিপ্রার্থীরা প্রাসাদ প্রাঙ্গণে যখন এক জায়গায় সমবেত হয়ে এই চক্রান্তের কথা আলোচনা করছিল মেডন আড়ি পেতে তা শুনতে পেয়ে প্রাসাদের অন্তঃপুরে গিয়ে এই সংবাদ দান করার জন্য পেনিলোপের ঘরে গেল। পেনিলোপ মেডনকে বললেন, আচ্ছা, প্রহরী, ওরা তোমাকে কি আদেশ দান করেছে? ওরা নাকি রাজা ওডিসিয়াসের পরিচারিকাদের সব কাজ ফেলে ওদের ভোজসভার আয়োজন করতে বলেছে? তাদের এই প্রেমনিবেদন এবং অবাঞ্ছিত উপস্থিতির ব্যাপারটাকে কী ঘৃণার চোখেই না দেখি। আমি তাদের কোনদিন আর এখানে ভোজসভার অনুষ্ঠান করতে দেব না। আর তোমরা ভৃত্য ও প্রহরীর দল যারা দিনের পর দিন এই প্রাসাদে আসছ আর আমার পুত্রের অন্ন। ধ্বংস করছ তারা হয়ত তাদের পিতার কাছ থেকে রাজা ওডিসিয়াসের গুণের কথা কিছু শোনো নি। তখন তারা শিশু ছিল। কাউকে একটা শক্ত কথাও কোনদিন বলেন নি ওডিসিয়াস। কারো প্রতি কোন অন্যায় করেন নি, অথচ তোমরা কত সহজে তার দয়ার কথা সব ভুলে গেছ।

মেডন কিন্তু কোনক্রমেই অবিশ্বস্ত ছিল না। সে বলল, হে আমার শ্রদ্ধেয়া রাণীমা, আশা করি এইখানেই আপনার দুঃখের যেন অবসান হয়। কিন্তু আপনার পাণিপ্রার্থীরা আরো ভীষণতর এক ষড়যন্ত্র করছে আপনার বিরুদ্ধে। ঈশ্বর করুন ওদের সে ষড়যন্ত্র যেন সার্থক না হয়। বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে টেলিমেকাসকে হত্যা করার জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠেছে ওরা। আর একথাও আমি জানাচ্ছি আপনাকে যে সেই যুবরাজ টেলিমেকাস এখন তাঁর পিতার সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য পাইলস ও ল্যাসিডীয়াম গেছেন।

মেডনের এই কথা শুনে পেনিলোপের জানু দুটো কাঁপতে লাগল। ভয়ে হীনবল ও কাতর হয়ে উঠল তাঁর অন্তঃকরণ। কিছুক্ষণের জন্য তিনি কোন কথাই বলতে পারলেন না। চোখে জল এল। কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে উঠল অশ্রুজলে। অবশেষে তিনি উত্তর করলেন, কিন্তু বল প্রহরী কেন আমার পুত্র বিদেশে গেছে? সামান্য অপটু জাহাজ নিয়ে সে কি করে অনন্ত সমুদ্রে পাড়ি দিল? সে কি জোর করে ইচ্ছে করে নিজের নামকে মুছে দিতে চায়?

বুদ্ধিমান মেডন উত্তর করল, আমি জানি না কোন দেবতার নির্দেশে অথবা নিজের ইচ্ছায় পাইলস যাত্রা করেছেন টেলিমেকাস। তবে এ যাত্রার উদ্দেশ্য হলো তার পিতার প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা। যদি তিনি আর প্রত্যাবর্তন না করেন তাহলে কিভাবে সেই শেষ পরিণতি লাভ করেছেন তা জেনে আসবেন তিনি।

এই কথা বলে প্রাসাদের অন্যত্র চলে গেলেন মেডন। এদিকে অপরিসীম অন্তঃবেদনার চাপে অভিভূত হয়ে উঠলেন পেনিলোপ। তাঁর ঘরে অনেক চেয়ার থাকা সত্ত্বেও ঘরের মেঝের উপর উপবেশন করে তিনি তীক্ষ্ণকণ্ঠে ক্রন্দন করতে লাগলেন। তা শুনে তার যত দাসী পরিচারিকারা এসে ভিড় করে দাঁড়াল তার চারপাশে।

কাঁদতে কাঁদতে তাদের বললেন পেনিলোপ, হে আমার সহচরীবৃন্দ, শোন, আমার মত আর কোন নারীকে কি দেবরাজ জিয়াস এত কষ্ট দান করেছেন? কয়েক বছর আগেও আমার স্বামী ছিলেন। তিনি ছিলেন সিংহহৃদয় এক বীরপুরুষ। সুদূর হেলাস থেকে শুরু করে আর্গস পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডে তাঁর কোন তুলনা নেই। সেই স্বামীকে আমি হারিয়েছি। তার উপর আমার একমাত্র সন্তান একটা কথাও না বলে বাড়ি থেকে চলে গেল। তার বিদেশযাত্রার কথাটাও কেউ আমাকে জানায় নি, এমন কি তোমরা জানা সত্ত্বেও আমাকে তা বল নি। এ ব্যাপারে তোমরা নিষ্ঠুরের মত ব্যবহার করেছ। সে একটা কালো জাহাজে করে বিদেশে যাত্রা করেছে, প্রতিদিন প্রাতঃকালে তোমরা আমাকে ঘুম থেকে জাগাও, অথচ এই সংবাদটা আমাকে দিতে পার নি? আমি যদি আগে জানতে পারতাম এ কথা তাহলে আমি জীবিত থাকতে সে কখনই যেতে পারত না এ প্রাসাদ ত্যাগ করে।

যাই হোক, তোমাদের মধ্যে একজন কেউ আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য ডোনিয়াসকে ডেকে দাও। আমি যখন প্রথম বধূরূপে স্বামীর ঘর করতে আসি এখানে, তখন আমার পিতা তাঁর বিশ্বস্ত ভৃত্যকে আমার সঙ্গে দেন। সে এখন এই প্রাসাদসংলগ্ন আমার উদ্যানবাটিকার দেখাশোনা করে। তাকে আমি এখন সোজা বৃদ্ধ লার্তেসের কাছে পাঠাব। তাকে সব কথা বলে তাঁর কাছে বসে সে তার রামর্শ চাইবে। হয়ত ভাবনা চিন্তা করে লার্তেস কোন উপায় আবিষ্কার করতে পারেন এবং তাঁর সেই নির্জন আবাসভূমি হতে এখানে এসে পাণিপ্রার্থীদের বোঝাতে পারেন। ওরা এখন তাঁর বংশের কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় না।

বৃদ্ধা ধাত্রী ইউরিক্লীয়া উত্তর করল, হে আমার প্রিয় রাণীমা, আমাকে আপনি ছুরিকাঘাতের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করুন অথবা শান্তিতে বেঁচে থাকতে দিন, আমি কিন্তু চুপ থাকতে পারছি না। সমস্ত ব্যাপারটা আমি জানতাম, আমিই তাকে রুটি ও মদ সরবরাহ করি। কিন্তু তখন তিনি দেবতাদের নামে আমাকে শপথ করিয় নেন আমি যেন অন্তত বারো দিন তাঁর সমুদ্রযাত্রার কথা আপনাকে না বলি। অবিরল অশ্রুবিসর্জনের দ্বারা আপনার গণ্ডদ্বয় মলিন হয়ে উঠুক এটা তিনি চান নি।

যাই হোক, এখন মুখ হাত ধুয়ে শুদ্ধ পোশাক পরে উপরতলার পূজার ঘরে পরিচারিকাদের সঙ্গে নিয়ে চলে যান। সেখানে গিয়ে জিয়াসকন্যা এথেনের কাছে প্রার্থনা করুন ভক্তিভরে। এখনো সময় আছে, ইচ্ছা করলে তিনি তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারেন। দুঃখের ভারে যিনি আগে হতেই ভারাক্রান্ত সেই বৃদ্ধ লার্তেসের উপর আর নতুন করে চাপ দেবেন না। দেবতারা লার্তেসের বংশের কাউকে বাঁচিয়ে রাখবেন না একথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে এ রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে একজন অবশ্যই থাকবেন।

এইভাবে পেনিলোপ দুঃখের অনেকখানি প্রশমিত করল ইউরিক্লীয়া। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালেন পেনিলোপ। মুখ হাত ধুয়ে শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করে উপরতলার পূজার ঘরে চলে গেলেন। পূজার যাবতীয় উপচার ঝুড়িতে করে নিয়ে গেল পরিচারিকারা। সে ঘরে গিয়ে দেবী এথেনের নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন পেনিলোপ। তিনি কাতরকণ্ঠে বলতে লাগলেন, হে জিয়াসকন্যা দেবী এথেন, বিজ্ঞ ওডিসিয়াস যদি কোনদিন তাঁর এই প্রাসাদে ভক্তিভরে তোমার উদ্দেশ্যে কোন পশুবলি দিয়ে থাকেন তোমার সম্মানাথে তাহলে সেকথা স্মরণ করে আমার পুত্রকে এইসব দুবৃত্তদের নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাও।

প্রার্থনা শেষে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন পেনিলোপ। দেবী এথেন শুনতে পেলেন তাঁর প্রার্থনা। এদিকে প্রাসাদ অন্তবর্তী সেই প্রায়ান্ধকার প্রশস্ত কক্ষে পাণিপ্রার্থীরা তাঁরই কথা আলোচনা করছিল নিজেদের মধ্যে। তাদের মধ্যে অল্পবয়সী এক রূঢ়ভাষী যুবক বলল, আমার মনে হয় রাণী এবার আমাদের কাউকে বিবাহ করবে। তার পুত্রের মৃত্যুর ব্যবস্থা সব যে পাকা হয়ে গেছে সেকথার কিছুই সে জানে না।

এইভাবে তারা দর্পভরে কত দম্ভোক্তি করতে লাগল। কিন্তু প্রকৃত ঘটনার কথা কেউ তারা জানত না। জানত না বাস্তব অবস্থার গতি কোন দিকে মোড় ফিরছে। অবশ্য তাদের মধ্যে অ্যান্টিনোয়াস উঠে দাঁড়িয়ে তাদের চুপ করিয়ে দিলে বলল, নির্বোধের দল, চুপ করো, এভাবে বড়াই করো না। কেউ অন্তঃপুরে গিয়ে একথা ফাঁস করে দিতে পারে। নীরবে চলে যাও এখান থেকে। যে পরিকল্পনা আমরা সর্বসম্মতভাবে করেছি তা কার্যে রূপ ধারণ করার চেষ্টা করবে।

আর কালবিলম্ব না করে অ্যান্টিনোয়াস কুড়িজন নাবিক সংগ্রহ করল। তারা উপকূলে গিয়ে একটি কালো জাহাজ সমুদ্রযাত্রার উপযোগী করে সাজিয়ে সব ঠিক করে আবার কূলে ফিরে এল। তারপর রাত্রির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।– বুদ্ধিমতী পেনিলোপ কিন্তু পূজার ঘরেই রয়ে গেছেন। তিনি কোন কিছু না খেয়ে উপবাস করতে লাগলেন। সেই সব দুবৃত্ত দর্পিত পাণিপ্রার্থীদের হাত থেকে কিভাবে তাঁর পুত্র রক্ষা পাবে সেকথা বার বার ভাবতে লাগলেন। ক্রমাগরমান শিকারীদের দ্বারা তাড়ির সিংহের মত তার মন ক্রমাগত তাড়িত হতে লাগল শঙ্কা আর সংশয়ের দ্বারা। ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তিনি। ক্রমে ঢলে পড়লেন গভীর ঘুমের মধ্যে। সে ঘুমের প্রভাবে অবসন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁর সুস্থ হলো।

এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে আবার তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন উজ্জ্বল চক্ষুতারকাবিশিষ্ট দেবী এথেন। রাজা আইকারিয়াসের ইপথিমে নামে আর একটি কন্যা ছিল। ফেরার রাজা ইউমেলাসের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। মর্মাহত ও ক্রন্দনরত রাণী পেনিলোপকে দুঃখকষ্টের হাত হতে মুক্তি দেবার জন্য ওডিসিয়াসের প্রাসাদে ইপথিমের এক অলৌকিক মূর্তিকে পাঠালেন দেবী এথেন। সে মূর্তি পেনিলোপের ঘরে গিয়ে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল অনুচ্চ স্বরে, দুঃখে কাতর হয়ে তুমি কি নিদ্রিত হয়ে পড়েছ পেনিলোপ? আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, দেবতারা আর তোমাকে দুঃখ দেবেন না। কারণ এটা বিধিনির্দিষ্ট যে তোমার পুত্র নিরাপদে গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে। কারো সঙ্গে তার কোন প্রত্যক্ষ বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় নি।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নবিষ্টের মত উত্তর করলেন পেনিলোপ, এখানে তুমি কি করে এলে বোন? তুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে থাক বলে তোমার সঙ্গে আমার দেখাই হয় না। তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাক বলেই বলছ, যে সব দুঃখ ও উদ্বেগে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে আমার অন্তর তা যেন সব আমি ভুলে যাই। হায়, আমার যদি বিবাহ না হত, আজ যদি আমি সিংহহৃদয় বীর স্বামীকে না হারাতাম! তার মত এত বড় বীর আমাদের সারা দেশের মধ্যে আর নেই। তারপর আমার প্রিয়তম যে পুত্রের জন্য তার পিতার থেকেও বেশি দুঃখ অনুভব করছি সেই পুত্র জাহাজে করে দূরে অজানা সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে। সে এখন বয়সে তরুণ, সব কিছুতে অনভিজ্ঞ। সে কোথায় গেছে, ঐসব দুবৃত্তদের সঙ্গে দেখা হলে কি ঘটতে পারে তার ভাগ্যে সেকথা ভাবতে গেলে বৃক কেঁপে ওঠে আমার। তার রক্তপিপাসু এমন অনেক শত্রু আছে যারা সে বাড়ি ফেরার আগে তাকে হত্যা করতে চায়।

সেই অস্পষ্ট অলৌকিক মূর্তি উত্তর করল, সাহসের সঙ্গে এইসব শঙ্কা জয় করো। তোমার পুত্রের সঙ্গে এমনই এক দেহরক্ষক আছে যা কোন মানুষ সাধ্যসাধনা করেও পায় না। স্বয়ং দেবী এথেন সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করে চলেছেন তোমার পুত্রকে। আর তিনিই তোমার প্রতি দয়াবশত তোমাকে এক সংবাদ দেবার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন এখানে।

তখন বুদ্ধিমতী পেনিলোপ বললেন, যদি তুমি সত্য সত্যই দেবতা কর্তৃক প্রেরিত হও এবং দেবতার কণ্ঠস্বর স্বকর্ণে শ্রবণ করে থাক তাহলে আমার পুত্রের হতভাগ্য পিতার কথাও বল। তিনি কি এখনো জীবিত আছেন? সূর্যের মুখ তিনি কি এখনও দেখছেন না চিরঅন্ধকার মৃত্যুপুরীতে গমন করেছেন?

সেই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি উত্তর করল, ওডিসিয়াস জীবিত না মৃত তা আমি বলতে পারব না। অসার শূন্যগর্ভ কথা বলে কোন লাভ নেই। এই কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। কিন্তু আইকারিয়াসকন্যা পেনিলোপ ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে প্রথম রাত্রিতে যে সুখস্বপ্ন তিনি দেখেছেন তার কথা যথাযথভাবে মনে করে যথেষ্ট সান্ত্বনা পেলেন মনে মনে।

ইতিমধ্যে পেনিলোপে পাণিপ্রার্থীরা টেলিমেকাসকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে রওনা হলো জাহাজে করে। ইথাকা ও সামস এই দুই উপকূলভাগের মধ্যবর্তী সমুদ্রের মাঝখানে অ্যাস্টারিস নামের এক পার্বত্য দ্বীপপুঞ্জ আছে। দ্বীপগুলো আকারে খুব ক্ষুদ্র হলেও তার উপকূলভাগের কোন জাহাজ দুই মাস অবস্থান করতে পারে। এই অ্যাস্টারিস দ্বীপেই পাণিপ্রার্থীরা লুকিয়ে রইল টেলিমেকাসের আশায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *