০৩. নেস্টর সকাশে টেলিমেকাস

তৃতীয় পর্ব
নেস্টর সকাশে টেলিমেকাস

ক্রমে প্রভাতকাল হলো সমুপস্থিত। পূর্ব দিগন্তের জলরাশি ভেদ করে সূর্য উঠল আকাশে। দ্যুলোক ও ভূলোক পরিপ্লাবিত হয়ে উঠল তার আয়ত উজ্জ্বল রশিমালায়। অবশেষে রাজা নেলেউসের রাজধানী পাইলস নগরীতে উপস্থিত হলো সমুদ্রযাত্রীরা।

তারা প্রথমে দেখল, সমুদ্রের বেলাভূমিতে পাইলসবাসীরা কৃষ্ণবর্ণের বলদ উৎসর্গ করছে ভূকম্পন দেবতা পসেডনের উদ্দেশ্যে। পাঁচশো জন লোক নয়টি দলে বিভক্ত হয়ে নয়টি করে বলদ উৎসর্গ করছিল। বালির পশুগুলোর উরুদেশ বিচ্ছিন্ন করে দেবতাদের উদ্দেশ্যে অগ্নিদগ্ধ করছিল তারা যখন, তখনই টেলিমেকাসের জাহাজটি উপনীত হলো সেই উপকূলে। নাবিকরা জাহাজ থামিয়ে নোঙর করল। তারা নেমে গেলে সব শেষে নামল টেলিমেকাস। মেন্টরের ছদ্মবেশে দেবী এথেনও নামলেন তাদের সঙ্গে।

দেবী এথেন তখন টেলিমেকাসকে সম্বোধন করে বললেন, তোমার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা ভুলে যেয়ো না টেলিমেকাস। এই বেলাভূমিতে বর্তমানে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। তোমার পিতা কেমন করে তাঁর শেষ পরিণতি লাভ করেছেন এবং কোথায় তাঁর দেহাস্থি আছে সেকথা যদি জানতে না পার তাহলে বৃথাই তোমার সমুদ্রযাত্রা। তুমি এখন সোজা অশ্ব প্রশিক্ষণ বিশারদ নেস্টরের কাছে চলে যাও। তাঁর কাছ থেকে সব গোপন কথা বার করে নিতে হবে। কিন্তু তোমাকে নিজে যেতে হবে। তুমি নিজে না গেলে তাঁর মত বিজ্ঞ ব্যক্তি কোন কথাই বলবেন না কাউকে।

টেলিমেকাস কিন্তু কুণ্ঠাবোধ করছিল। সে বলল, মেন্টর, কেমন করে আমি এতবড় একজন লোকের কাছে যাব? কিভাবে তাঁকে অভিবাদন জানাব? আমি বয়সে তরুণ যুবা, ভালভাবে কথা বলতে জানি না। তাঁর মত বয়োপ্রবীণ লোকের সঙ্গে কথাকাটাকাটি করতেও পারব না।

এথেন উত্তর করলেন, শোন টেলিমেকাস, যেখানে তোমার নিজস্ব বুদ্ধি কাজ করবে না, সেখানে স্বর্গলোকের দেবতারা তোমার বুদ্ধি যোগাবেন। ভুলে যেয়ো না, তারা তোমার জন্মের পর থেকেই লক্ষ্য রাখছেন তোমার উপর। তাঁদের এ কাজ কখনই বৃথা যাবে না।

এই বলে মেন্টরের ছদ্মবেশে টেলিমেকাসাকে দ্রুতগতিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন দেবী প্যালাস এথেন। অবশেষে তারা পাইলসের রাজপ্রাসারে সন্নিকটস্থ হলেন। সেখানে এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করছিল পাইলসবাসীরা। পুত্রগণ ও অনুচরবর্গের দ্বারা পরিবৃত হয়ে তাদের মধ্যে বসে ছিলেন মেন্টর। বিদেশীদের দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সসম্মানে সরে দাঁড়াল পাইলসবাসীরা। নেস্টরের জ্যেষ্ঠ পুত্র পীজেসট্রেটাস এগিয়ে এসে তাদের হাত ধরে অভ্যর্থনা জানালেন তাদের। তারপর কিছু মাংস ও একপাত্র মদ দিয়ে মেন্টরবেশিনী এথেনকে বললেন, আজ আমরা এখানে যে যজ্ঞ ও ভোজসভার অনুষ্ঠান করছি তা সর্প দেবতা পডেসনের সম্মানার্থে। আমাদের দেশীয় প্রথা অনুসারে মদ্য অর্ঘ্য দান করে প্রার্থনা করো দেবতার কাছে। তারপর এই পানপাত্রটি তোমার সঙ্গীকে দান করো। উনি আমার মত বয়সে নবীন বলে এ পাত্র আমি তোমারই হাতে দিলাম।

এ কথায় সন্তুষ্ট হলো দেবী এথেন। তরুণ নেস্টরপুত্র তাঁর হাতে প্রথমে অর্ঘ্যপাত্র দান করে উচিত কাজই করেছে। তিনি তখন পসেডনের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, হে ভূবেষ্টনকারী দেবতা পসেডন, আমাদের আবেদনে সাড়া দাও। আমাদের প্রতি বিরূপ হয়ো না। আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করো। প্রথমত, নেস্টর এবং তাঁর পুত্রদের মঙ্গলসাধন করো। তারপর পাইলসবাসীদের মঙ্গল করো, এই উৎসর্গের ফলে তাদের জীবন ও যাত্রাপথ যেন নিরাপদ হয়। তারপর যে মহান ব্রত নিয়ে আমি ও টেলিমেকাস এসেছি একটি কালো জাহাজে করে সে ব্ৰত যেন সার্থক হয় এবং আমরা যেন নিরাপদে গৃহে ফিরে যেতে পারি।

এইভাবে প্রার্থনা করল দেবী এথেন। তারপর দুটি হাতলসংযুক্ত পান পাত্রটি টেলিমেকাসের হাতে অর্পণ করলেন। টেলিমেকাসও এইভাবে প্রার্থনা করল। তখন তারা সকলে মিলে ভোজন করতে লাগলেন। তারা সকলে প্রচুর ভোজন ও পানে তৃপ্ত হলে বৃদ্ধ নাইট নেস্টর বললেন, এখন যেহেতু আমাদের অতিথিরা পানাহারে তৃপ্ত হয়েছেন এবার তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা অভদ্রজনোচিত কাজ হবে না।

অতিথিদের লক্ষ্য করে নেস্টর বললেন, আপনারা কারা এবং কোন দেশ থেকেই বা এসেছেন? আপনারা কি কোন বাণিজ্যগত ব্যাপারে এই বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন অথবা আপনারা কোন ভ্রাম্যমাণ দুস্যদল যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে পরের ক্ষতি করে বেড়ায়?

দেবী এথেন এক সুযোগ খুঁজছিলেন যাতে টেলিমেকাস তার পিতার দীর্ঘ অনুপস্থিতি সম্পর্কে নেস্টরকে প্রশ্ন করতে পারে। এথেনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সাহস সঞ্চয় করে উত্তর করল টেলিমেকাস, হে নেলেউসপুত্র নেস্টর, আপনি সমগ্র গ্রীকজাতির সম্মানের পাত্র। আপনাকে আমি অভিবাদন জানাচ্ছি। তারপর আমাদের পরিচয় দান করছি। আমরা আসছি লিডন পর্বতের সানুদেশে অবস্থিত ইথাকা রাজ্য থেকে। আমি এসেছি ব্যক্তিগত ব্যাপারে। সেকথা আমি বললেই আপনি বুঝতে পারবেন। যে বীর ওডিসিয়াস ট্রয়যুদ্ধে আপনাদের পক্ষে যুদ্ধ করেন আমি তাঁরই পুত্র এবং তাঁরই সন্ধানে বহু দেশ পরিভ্রমণ করছি আমি। তার সংবাদ সংগ্রহের আশায় এসেছি আমরা। ট্রয়যুদ্ধে যোগদানকারী অন্যান্য সব বীরদের কথা আমরা জানি। কিন্তু দেবরাজ জিয়াস একমাত্র ওডিসিয়াসের মৃত্যুর ব্যাপারটিকে এমন এক অপার রহস্যের দ্বারা আবৃত করে রেখেছেন যাতে কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে না তিনি কোথায় কিভাবে প্রাণত্যাগ করেছেন। শত্রুভাবাপন্ন কোন উপজাতি দ্বারা তিনি কি নিহত হয়েছেন অথবা প্রত্যাবর্তনকালে কোন দূর সমুদ্রে সলিল সমাধি লাভ করেছেন? আমি আপনার নিকট এসে এই আশা ব্যক্ত করছি যে, আপনি আমার পিতার শোচনীয় পরিণতি সম্পর্কে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করবেন। কারণ হয় আপনি স্বচক্ষে এই পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছেন অথবা কোন ভ্রমণকারীর নিকট সে সম্পর্কে কোন সংবাদ স্বকর্ণে শ্রবণ করেছেন। তাঁর মত এত দুঃখ কোন মানুষ পৃথিবীতে ভোগ করে নি কোনদিন। আপনি দয়া বা আমার প্রতি সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে সত্য ঘটনা বিবৃত করতে কোনরূপ কুণ্ঠা বোধ করবেন না। আপনি যা দেখেছেন তা যথাযথভাবে ব্যক্ত করবেন। আমরা সদাশয় পিতা ওডিসিয়াস ট্রয়যুদ্ধে যদি কোন উপকার আপনাদের করে থাকেন অথবা কোন ভাল কথা বলে থাকেন তাহলে সেকথা স্মরণ করে আমার অনুরোধ রক্ষা করুন। আপনি যা জানেন তা বিবৃত করুন।

জিরেনের নাইট নেস্টর উত্তর করলেন, হায় আমার বন্ধু, ট্রয়ের নামে কত কথাই না মনে পড়িয়ে দেয়। আমরা গ্রীকরা কত দুঃখই না ভোগ করি। সেই বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রা, কত আক্রমণের পর আক্রমণ, প্রিয়ামনগরীর দুর্গপ্রাকারের বাইরে যুদ্ধের পর যুদ্ধ। সে যুদ্ধে আমাদের প্রায় সব শ্রেষ্ঠ বীরদেরই পতন ঘটে একের পর এক। অ্যাজাক্স, অ্যাকেলিস, প্যাট্রোক্লাস, আমার বীর পুত্র অ্যান্টিলোকাস যে ছিল একই সঙ্গে দ্রুতগতি ও বীর যোদ্ধা–তারা আজ কেউ নেই। ট্রয়যুদ্ধে গ্রীকরা যে বীরত্ব প্রদর্শন করে তার পূর্ণ বিবরণ দান করা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। দীর্ঘ বিশ বছরেও সে বিবরণ শেষ হবে না, শুনতে গেলে তুমি তোমার ধৈর্য হারাবে।

দীর্ঘ নয় বছর ধরে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ট্রয়বাসীদের দুর্গ হতে নামিয়ে আনার চেষ্টা করি। এমন কি যতবার আমরা চূড়ান্ত জয়ের গৌরব লাভ করতে গিয়েছি, ততবারই তার থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছেন জিয়াস। কিন্তু ওডিসিয়াসের মত স্থিতধী প্রাজ্ঞ ও বুদ্ধিসম্পন্ন বীরের কোন তুলনা নেই। বলছি তোমার পিতার কথা, তুমি যদি অবশ্য সত্যসত্যই তাঁর সন্তান হও। আমি কিন্তু তোমার পানে তাকিয়ে বিস্ময়ান্বিত না হয়ে পারছি না। তোমার কথাগুলো তাঁরই মতো। পিতা ও পুত্রের কথার মধ্যে যে এতদূর সাদৃশ্য থাকে তা আমার জানা ছিল না। এই কয়েক বছর কোন সাধারণ সভায় বা রাজন্যবর্গের মন্ত্রণাসভায় একটি দিনের জন্যও কোন বিষয়ে মতভেদ হয় নি আমার ওডিসিয়াসের সঙ্গে। সফলভাবে গ্রীকনেতাদের পরিচালনার ব্যাপারে যেকোন নীতিগত বিষয়ে আমরা একমত হয়ে কাজ করতাম। আমাদের সুমতি ও বিচারবুদ্ধি ছিল দুজনেরই সমান।

কিন্তু সকল গ্রীক সেনানীই সততা ও সুমতিতে সমান ছিল না আর তার ফল প্রিয়ামনগরী ধ্বংস করার পর আমরা জলপথে যখন জাহাজ ভাসিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করছিলাম তখন আমাদের উপর এক বিরাট বিপর্যয় এনে দিলেন জিয়াস। দেবতাদের কোপে পতিত হয়ে আমাদের রণতরীগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সর্বশক্তিমান জিয়ানকন্যার রোষের ফলে আমাদের মধ্যে অনেককেই অনেক শোকদুঃখ নতুন করে সহ্য করতে হলো। দুই আত্রেউসপুত্রের মধ্যে বিবাদের মধ্যে দিয়ে প্রথম শুরু হলো এই বিপর্যয়। আবেগে উত্তেজিত হয়ে হয়ে একদিন সূর্যাস্তকালে সমস্ত গ্রীকসৈন্যকে একস্থানে সমবেত হওয়ার জন্য আদেশ দিলেন তাঁরা। তখন তাঁরা অতিরিক্ত মদ্যপানে মত্ত অবস্থায় ছিল। তারা সমবেত হলে তাদের সামনে আপন বক্তব্য ব্যক্ত করলেন আত্রেউসপুত্রদ্বয়। মেনেলাস সেনাবাহিনীকে বললেন তাদের প্রথম কাজ হবে দূর সমুদ্র অতিক্রম করে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা। একথা কিন্তু মনঃপূত হলো না রাজা অ্যাগামেমননের। তিনি চাইছিলেন গ্রীকসৈন্যরা সেখানে অবস্থান করে রুষ্ট দেবী এথেনকে পূজা ও অর্ঘ্যদানের দ্বারা তুষ্ট করবে। কিন্তু আপন নির্বুদ্ধিবশত অ্যাগামেমনন বুঝতে পারেন নি সে চেষ্টা নিরর্থক। বুঝতে পারেন নি, দেবতারা কখনো আপন আপন উদ্দেশ্য হতে কোন অবস্থাতেই বিচ্যুত হন না। দুই ভাই সেখানে দাঁড়িয়ে কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। তখন সৈন্যরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গোলমাল করতে করতে সভা ভঙ্গ করে চলে গেল। সারা রাত্রি ধরে বিশ্রাম করতে পারলাম না আমরা। সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে লাগল সর্বক্ষণ। এইভাবে জিয়াস এক মারাত্মক আঘাত হানতে চেয়েছিলেন আমাদের উপর। পরদিন সকালে দেখা গেল সমগ্র গ্রীকসেনাদলের অর্ধাংশ শান্ত সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে রওনা হয়েছে স্বদেশের পথে। তারা আমাদের অনেক জিনিস আর মেখলাশোভিত নিতম্ববর্তিনী বহু বন্দিনীকে নিয়ে গেছে তাদের জাহাজে। সেনাদলের আর এক অংশ রাজা অ্যাগামেমননের সঙ্গে সেখানেই অবস্থান করতে থাকে।

আমিও ছিলাম সেই প্রত্যাবর্তনরত গ্রীকদের মাঝে। আমাদের জাহাজ ভালভাবেই এগিয়ে যেতে লাগল। সমুদ্রে কোন ঢেউ ছিল না। কোথাও কোন অশান্ত জলস্ফীতি ছিল না। আমরা তেনেদসে পৌঁছে দেবতাদের জন্য পূজা ও অর্ঘ্য দান করলাম। কিন্তু দেবরাজ অত সহজে আমাদের বাড়ি ফিরতে দিলেন না। তাঁর নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি আমাদের সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ রাজা ওডিসিয়াসের নেতৃত্বে জাহাজের গতি ফিরিয়ে দিল উল্টো মুখে। নতুন করে অ্যাগামেমননের প্রতি তাঁর বশ্যতা জ্ঞানের উদ্দেশ্যেই এই পথ অবলম্বন করলেন ওডিসিয়াস। আমি কিন্তু দেবতাদের উদ্দেশ্যের কথা বুঝতে পেরে আমার দলবল নিয়ে প্রত্যাবর্তনের পথই অনুসরণ করতে লাগলাম। বীর যোদ্ধা ডায়োমেডিসও তার দলভুক্ত সৈন্যদের নিয়ে আমার পথ অনুসরণ করতে লাগলেন। পরে লোহিতাভ কেশবিশিষ্ট মেনেলাসও আমাদের পশ্চাদ অনুসরণ করলেন। তিনি লেসবসে এসে আমাদের সঙ্গ নিলেন। কোনদিকে যাব এই ভেবে আমরা ইতস্তত করছিলাম এই লেসবসে এসে। আমরা সমুদ্রের মাঝ বরাবর যাব না কিওস দ্বীপের পাশ দিয়ে যাব তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ বিষয়ে এক সঙ্কেতচিহ্ন দানের জন্য আমরা প্রার্থনা জানাচ্ছিলাম দেবতাদের নিকট। অবশেষে দেবতারাই আমাদের এক পরিষ্কার নির্দেশ দান করে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে সোজা গিয়ে ইউবীয়াতে ওঠা উচিত। তাহলে আমরা অন্তত বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারব। এক সুন্দর অনুকূল বাতাস বইতে লাগল আমাদের পথে। দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল আমাদের জাহাজ। অবশেষে রাত্রিতে আমরা পৌঁছলাম জিরাস্তাস নামক এক দ্বীপে। বহু জলরাশি অতিক্রম করে সেখানে উপনীত হয়ে আমরা পসেডনের বেদীতে অনেককিছু উৎসর্গ করলাম।

চতুর্থ দিনে ডায়োমেডিস উপনীত হলেন তাঁর দেশ আর্গসে। আমি তখনো এগিয়ে যেতে লাগলাম পাইলস অভিমুখে। পথে দেবতাদের কৃপায় আমাদের অনুকূল বাতাসের অভাব হয় নি কখনো। ফলে আমাদের পিছনে যারা রয়ে গিয়েছিল তাদের কোন খবর আমি পাই নি। কারা শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরেছিল নিরাপদে আর কারাইবা মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছিল তা আমি জানতে পারি নি। তবে বাড়ি ফিরে এখানে বসে যেসব সংবাদ পরে পেয়েছি তাতে জেনেছি অ্যাকিলিসের মহান পুত্রের নেতৃত্বে মার্মিডনরা নিরাপদ ফিরে এসেছে তাদের দেশে। পীরার পুত্র ফিরোকটেটও নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে। আইডোমেনেউস তার সমস্ত লোকজন নিয়ে ফিরে এসেছেন ক্রীটে। আর রাজা অ্যাগামেমননের দেশ তোমাদের দেশ থেকে অনেক দূরে হলেও হয়তো শুনে থাকবে তিনি বাড়ি ফেরার পর কিভাবে নিহত হয়েছিলেন এজিসথাসের দ্বারা আর কিভাবে ওরেস্টেস এজিসথাসকে হত্যা করে তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তুমিও বেশ সবল ও সুগঠিতভাবে গড়ে উঠেছ। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমিও বীর ওরেস্টেসের মতই সাহসী।

তরুণ অথচ বিজ্ঞ টেলিমেকাস উত্তর করল, হে রাজন নেস্টর, গ্রীকগণ আপনাকে অন্তরের সঙ্গে সম্মান করে। সত্যসত্যই উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে ওরেস্টেস। তাদের যশ যুগ যুগ ধরে অক্ষুণ্ণ থাকবে সারা গ্রীস দেশ জুড়ে। হায়, দেবতারা যদি আমায় ওরেস্টেসের মত শক্তি দান করতেন তাহলে আমি আমার মাতার সেই দুর্বিনীত উদ্ধত পাণিপ্রার্থীদের সমুচিত শিক্ষা দিতে পারতাম। তাদের যত সব শয়তানি ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিতে পারতাম। কিন্তু ভাগ্যে আমার এই ধরনের কোন সুখ নেই, আমার পিতার ভাগ্যেও কোন সুখ নেই। এসব বিড়ম্বনা আমাকে সহ্য করতেই হবে।

নেস্টর তখন উত্তর করলেন, শোন বন্ধু, তুমি যখন কথাটা তুললে তখন আমার সব মনে পড়ে গেল। আমি শুনেছি একদল যুবক তোমার মাতাকে বিবাহ করতে চাইছে এবং বাঞ্ছিত অতিথিরূপে নানারূপ বিশৃংখলার সৃষ্টি করছে তোমাদের বাড়িতে। বল আমাকে, একথা কি মিথ্যা না ইথাকার সব লোকই বিরূপ হয়ে গেছে তোমার প্রতি। কে জানে ওডিসিয়াস একদিন সত্যি সত্যিই একাকী অথবা সদলবলে বাড়ি ফিরে এসে ঐসব পাণিপ্রার্থীদের ধ্বংস করবেন কি না? আমি ভাবছি দেবী এথেন তোমার পিতাকে যে অনুগ্রহ দান করেছেন যদি তিনি তোমার প্রতিও তেমনি কৃপাপরবশ হতেন। যে কৃপা ও স্নেহের চোখে দেবী এথেন তোমার পিতাকে দেখতেন, সেচোখে অন্য কোন দেবী কখনো কোন মানুষকে দেখেছেন বলে আমার জানা নেই। তোমার প্রতিও যদি অনুরূপ কৃপা প্রদর্শন করতেন তাহলে এতদিন নিশ্চয় কোন বীর ঐ সব পাণিপ্রার্থীদের মাথা থেকে বিবাহের পরিকল্পনা চিরতরে বার করে দিত।

টেলিমেকাস বলল, মহাশয়, আপনি যা বললেন তা সত্যে পরিণত হবে বলে কোন আশাই আমি করতে পারি না। আপনি কল্পনার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যে চিত্র অঙ্কন করলেন সে সুখের প্রত্যাশা করার মত সাহস আমার নেই। দেবতাদের এ বিষয়ে ইচ্ছা থাকলেও আমি তা আশা করতে পারি না।

মেন্টরের বেশে দেবী এথেন বললেন, একথা কেন বললে টেলিমেকাস? একজন যত দীর্ঘদিন বিদেশে থাকুক না কেন, কোন দেবতা ইচ্ছা করলে তাকে যেকোন সময়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে পারেন। আমাকে যদি বাড়ি ফেরার পর অসহনীয় দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয় তাহলে তা করেও আমি সেই দিনটি দেখার জন্য বেঁচে থাকব। অবশ্য একদিন না একদিন সকলকে মরতে হবে।

টেলিমেকাস উত্তর করল, নেস্টর, এইসব দুঃখজনক কথা আর আলোচনা করবেন না। আমি আমার পিতার প্রত্যাবর্তনের আর কোন আশা করতে পারি না। অমর দেবতাদের মধ্যস্থতায় অবশ্যই তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। আমি কিন্তু নেস্টরকে আর একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই। মানব চরিত্র সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান নাকি অতুলনীয়। আমি শুনেছি উনি নাকি তিনপুরুষ ধরে রাজত্ব করেছেন এবং ওঁর দিকে যখন তাকিয়ে থাকি তখন মনে হয় উনি অমরত্বের এক জীবন্ত প্রতীক।

এবার নেস্টরের দিকে ঘুরে টেলিমেকাস বলল, আপনি দয়া করে একটা বিষয় বিস্তারিত করে বলবেন কি? আচ্ছা, কিভাবে অ্যাগামেমনন মৃত্যুবরণ করলেন? তখন কোথায় ছিলেন মেনেলাস? এজিসথাসের থেকে অনেক বড় বীর সেই অ্যাগামেমননকে হত্যা করার জন্য কিভাবে ফাঁদ পেতেছিল এজিসথাস? আর্গস থেকে তখন মেনেলাস অনেক দূরে ছিল বলেই কি সেই কাপুরুষটা তাকে আঘাত করার সাহস পেয়েছিল?

নেস্টর উত্তর করলেন বস, আমি তোমাকে সানন্দে সমগ্র কাহিনী ব্যক্ত করব। সে কাহিনী শুনে তুমি সহজেই অনুমান করতে পারবে, ট্রয় থেকে ফিরে এসে অ্যাগামেমননের ভ্রাতা মেনেলাস যদি এজিসথাসকে তার বাড়িতে জীবিত অবস্থায় দেখতে পেতেন তাহলে কি ঘটত। তাহলে তার সমাধির উপর কোন স্মৃতিস্তম্ভ শোভা পেত না। তার মৃতদেহটা প্রাচীরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত আর শকুনি আর কুকুরে তা ভক্ষণ করত। সারা গ্রীক দেশের মধ্যে কোন নারী তার জন্য একবিন্দু অশ্রুও বর্ষণ করত না। এজিসথাসের অপরাধ সাধারণ অপরাধ নয়। আমরা যখন ট্রয় অবরোধ করে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম সে তখন আর্গসে অলসভাবে বসে থেকে তার ছলনাময় কথাবার্তার দ্বারা অ্যাগামেমননের স্ত্রীর মন জয় করে তাঁর রূপসৌন্দর্য উপভোগ করছিল। প্রথমে এজিসথাসের অন্যায় ও অসম্মানজনক পরিকল্পনায় কোন সায় দেন নি রাণী ক্লাইমেস্ত্রা। তাছাড়া যুদ্ধে যাবার সময় তখন অ্যাগামেমনন একজন চারণকবির উপর প্রাসাদের ভার দিয়ে রাণীর উপর লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দিয়ে যান। তিনি তার কার্যসিদ্ধির দিন আগত হলে এজিসথাস কৌশলে সেই চারণকবিকে এক নির্জন দ্বীপে নিয়ে গিয়ে তাকে শিকারি পাখির খাদ্যরূপে একা ফেলে এল সেখানে। তারপর রাণী ক্লাইতেমেস্ত্রাকে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। ক্রমে ক্রমে কাছে ধরা দিলেন রাণী, প্রতারক হয়ে উঠল প্রেমিক। এই হীন কাজের সাফল্যলাভের পর দেবতাদের অর্ঘ্যদানে তুষ্ট করতে লাগল আর মন্দিরগাত্রগুলোকে সোনার পাত দিয়ে মুড়ে দিল।

মেনেলাস আর আমি তখন ট্রয় থেকে সমুদ্রপথে প্রত্যাবর্তন করছি। মেনেলাস আর আমি দুজনে ছিলাম পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কিন্তু যখন আমরা সুনিয়াস অন্তরীপ উপনীত হলাম তখন ফীবাস অ্যাপোলো মেনেলাসের জাহাজের একজন নাবিকের উপর শর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করলেন। নাবিকটির হাতে তখন হাল ধরা ছিল। ওমেন্টরপুত্র ফ্রেন্টিস ছিল ঝঞ্ঝাহত সমুদ্রে জাহাজ চালানোর ব্যাপারে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাবিক। গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য মেনেলাস অতিমাত্রায় উৎসুক হলেও তিনি সুনিয়াস দ্বীপে নেমে যথাযযাগ্য মর্যাদার সঙ্গে সুদক্ষ নাবিক ফ্রেন্টিসকে সমাহিত না করে পুনরায় যাত্রা শুরু করতে পারলেন না। কিন্তু মেনেলাসের বড় বড় জাহাজগুলো ধূসর সমুদ্র অতিক্রম করে খাড়াই পাহাড়ঘেরা মেলিয়া দ্বীপের কাছে পৌঁছাতেই তাদের নতুন করে এক বিপদে ফেলার জন্য এক প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি করলেন জিয়াস। অসংখ্য পর্বতপ্রমাণ ঢেউ উতুঙ্গ বিশালতায় খাড়া হয়ে উঠতে লাগল জাহাজগুলোর চারদিকে। মেনেলাস তখন তাঁর জাহাজগুলোকে দুইভাবে বিভক্ত করে ক্রীট ও সাইডেনিয়ার দিকে চালিত করতে আদেশ দিলেন। ঝড় ও সমুদ্রতরঙ্গের দ্বারা ক্রমাগত তাড়িত হতে হতে মেনেলাসের পাঁচটি জাহাজ মিশরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। অন্য জাহাজের দলটি ফীস্তান দ্বীপের কাছে গিয়ে এক গুপ্ত পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এইভাবে যখন দূর বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন মেনেলাস, দুবৃত্ত এজিসথাস তখন অ্যাগামেমননকে হত্যা করে মাইসেনের অধিপতিরূপে রাজ্যশাসন করছিল। সাত বছর ধরে সে রাণীকে হাত করে রাজ্যসুখ উপভোগ করে যায়। অষ্টম বৎসর নিষ্ঠুর নিয়তি ওরেস্টেসের মূর্তিতে প্রাদুর্ভূত হয় ওর জীবনে। নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ধীর ওরেস্টেস এথেন্সে ফিরেই তার পিতৃহন্তা ওজিসথাসকে যেদিন হত্যা করে সেইদিনই প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন মেনেলাস।

আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি বন্ধু, বাড়ি থেকে দীর্ঘদিন দূরে থেকো না। তাহলে সেইসব দুবৃত্তরা তোমার সব সম্পদ নষ্ট করে দেবে আর ব্যর্থ করে দেবে তোমার এই অনুসন্ধান কার্য। অবশ্য মেনেলাসের সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য অনুরোধ করছি তোমায়। সম্প্রতি এমন এক দূরবর্তী অঞ্চল হতে ফিরে এসেছেন তিনি যেখান থেকে ফেরার কোন আশা থাকে না। যদি ঝাবিক্ষুব্ধ এমন এক বিশাল সমুদ্র অতিক্রম করেছেন যার জলরাশির উপর দিয়ে একটি বছরের মধ্যে কোন পাখি উড়ে চলার সাহস পায় না। সুতরাং তুমি তোমার জাহাজ আর নাবিক নিয়ে মেনেলাসের কাছে চলে যাও, আর যদি সেখানে স্থলপথে যেতে চাও তাহলে আমি আমার রথ আর অশ্ব তোমায় দেব। আমার সন্তানরা তোমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে সেই সুন্দর নগরী ল্যাসিডীমনে যেখানে লোহিত কেশবিশিষ্ট বীর মেনেলাস বাস করেন। যদি কোন সত্য তার মুখ থেকে জানতে চাও তাহলে তুমি স্বয়ং সাক্ষাৎ করবে তার সঙ্গে, তা না হলে তাঁর মত বুদ্ধিমান লোক কোনকিছুই প্রকাশ করবেন না।

নেস্টরের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্য অস্তাচলে গেল। নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। দেবী এথেন তখন মেন্টরের বেশে বললেন, মহাশয়, এ কাহিনী ব্যক্ত করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এখন বলির পশুগুলোর জিহ্বা কেটে মদের পাত্রে পবিত্র জল মিশিয়ে দিন যাতে আমরা পসেডন ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দান করতে পারি। এখন পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত গেছে, নিদ্রা যাবার কাল উপস্থিত। কিন্তু নিদ্রা যাবার আগেই আমাদের পূজা অর্চনার কাজ সমাপন করতে হবে। পূজা বা যজ্ঞের কাজে বিলম্ব করতে নেই।

বৃথা গেল না এথেনের কথা। বয়োপ্রবীণ পুরোহিতরা শান্তিজল ছিটিয়ে দিলেন অতিথিদের গাত্রে। তারপর তাদের মদ পরিবেশন করল তরুণ ভৃত্যরা। এরপর যজ্ঞানলে বলির পশুদের জিহ্বা উৎসর্গ করা হলে মদ পান করল অতিথিরা। পরিশেষে টেলিমেকাস ও মেন্টরবেশিনী এথেন তাদের লোকজন নিয়ে জাহাজে শুতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু নেস্টর তাতে বাধা দিয়ে বললেন, ভগবান করুন, তোমরা যেন আমার প্রাসাদ ছেড়ে জাহাজে শুতে যেও না। আমার প্রাসাদে কি অতিথিদের আরামে শয়ন করার মত বিছানা বা কম্বল কিছুই নেই? আমি কি এমনই নিঃস্ব দরিদ্র হয়ে গেছি? আমি যতদিন জীবিত থাকব এবং আমার পর আমার পুত্ররা যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন আমার একান্ত সুহৃদ ওডিসিয়াসের পুত্র কখনো জাহাজের পাটাতনে শুতে যাবে না।

মেন্টরের বেশে এথেন বললেন, ঠিকই বলেছেন পিতা। টেলিমেকাস অবশ্যই আপনার আমন্ত্রণ রক্ষা করবে। টেলিমেকাস আপনার সঙ্গে আপনার প্রাসাদে গমন করুক আর আমি আমাদের সেই কৃষ্ণবর্ণের জাহাজে গমন করি। সেখানে আমাদের যেসব লোকজন আছে তাদের করণীয় সম্বন্ধে কিছু নির্দেশ দিতে হবে। তারা যাতে অধৈর্য না হয় তার জন্য তাদের আশ্বস্ত করতে হবে। কারণ আমাদের মধ্যে একমাত্র আমিই বয়োপ্ৰবীণ আর সকলেই টেলিমেকাসের মত বয়সে তরুণ যুবা। টেলিমেকাসের প্রতি তাদের অকৃত্রিম প্রীতির খাতিরে তার সঙ্গে নাবিকরূপে এসেছে তারা। আমি রাত্রির মত আমাদের সেই জাহাজে বিশ্রাম করব। সকালবেলা ককোনিয়া নামে এক জাতির লোকেদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে, সেখানে আমার কিছু দরকারী কাজ আছে। যেহেতু আমার বন্ধু টেলিমেকাস আপনার অতিথি হয়েছে, আপনি অনুগ্রহপূর্বক আগামী কাল সকালে ওকে দ্রুতগামী এক রথে করে আপনার একজন পুত্রকে সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন আমার কাছে।

কথা শেষ করেই একটি ঈগল পাখির রূপ ধারণ করে উড়ে গেলেন এথেন। এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল উপস্থিত সকলে। বিস্ময়াভিভূত বৃদ্ধ রাজা নেস্টর তা দেখে টেলিমেকাসের হাত ধরে চিৎকার করে আবেগের সঙ্গে বললেন, বয়সে তরুণ হলে নিজেকে তুচ্ছ ভেবো না বন্ধু। তুমি এমন সব দেবতাদের কৃপা লাভ করেছ যারা তোমায় রক্ষা করবেন। যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন তোমার কাছে তিনি জিয়াসকন্যা এথেন ছাড়া আর কেউ নন। তিনিই সমস্ত গ্রীকবীরদের মধ্যে তোমার পিতাকে সবচেয়ে স্নেহ ও কৃপার চোখে দেখতেন। হে দেবরাজ্ঞী, তোমার এই অধম ভৃত্যকে অনুগ্রহ করো, আমাকে ও আমার পুত্রদের যশস্বী করে তোল। আমার অনুগত ও আমার প্রতি বিশ্বস্ত স্ত্রীকে যশস্বিনী করে তোল। এর জন্য স্বর্ণ মোড়কের দ্বারা আবৃত শৃঙ্গযুক্ত এক বছরের একটি বকনাকে উৎসর্গ করব তোমার কাছে।

এ প্রার্থনা যথাসময়ে কর্ণগোচর হলো দেবী প্যালাস এথেনের। এবার নেস্টর তাঁর পুত্র ও জামাতাদের সঙ্গে টেলিমেকাসকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন তার প্রাসাদে। প্রাসাদে উপনীত হয়ে নিজের হাতে একপাত্র উত্তম মদ নিয়ে তাঁর অতিথিকে পান করতে দিলেন। গাড়িবারান্দার উপরে একটি ঘরে কাষ্ঠনির্মিত একটি পালঙ্কের উপর শুতে দিলেন টেলিমেকাসকে। তার কাছে রইল নেস্টরের একমাত্র অবিবাহিত পুত্র। পীজেসট্রেটাস। প্রাসাদের পশ্চাদভাগে একটি ঘরে রাজা নেস্টর নিজে শুতে গেলেন, সেখানে তাঁর রাণী নিজের হাতে শয্যা প্রস্তুত করে রেখেছিলেন তাঁর জন্য।

স্নিগ্ধ প্রত্যূষে যখন তার গোলাপী আলোয় গড়া হাত দিয়ে আকাশের সব অন্ধকার অপসারিত করে দিল তখন বিছানা থেকে উঠে নেস্টর তার ঘরের বাইরে একটি মসৃণ মর্মরপ্রস্তরের উপর উপবেশন করলেন। এই মর্মরপ্রস্তর নির্মিত মসৃণ আসনটিতে একদিন উপবেশন করতেন বৃদ্ধ রাজা নেলেউস। কিন্তু আজ তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মৃত্যুপুরীতে নির্বাসিত। জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধিতে রাজা নেলেউস ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আজ সমগ্র গ্রীক জাতির অতন্দ্র প্রহরীরূপে রাজা নেস্টরও রাজদণ্ড হাতে ঠিক সেই আসনটিতেই উপবেশন করেন। নেস্টর উপবেশন করতেই একিথ্রিন, স্ট্রেটিয়াস, পার্সিয়াস, আরেতাস ও গ্লেসিমেদিস নামে তাঁর এই পাঁচজন পুত্র এসে তাঁর পাশে দাঁড়াল। সব শেষে এল পীজেসটোস। তাদের পাশে একটি আসনে টেলিমেকাসকে বসতে দেওয়া হলো। এবার নেস্টর তাঁর আসল মনোভাব ব্যক্ত করতে লাগলেন। তিনি বললেন, হে আমার পুত্রগণ, যথাযথভাবে দেবী এথেনের পূজা অর্চনার ব্যাপারে আমাকে তোমরা সাহায্য করো। কারণ একমাত্র তিনিই গতকাল তোমাদের ভোজসভায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। তোমাদের মধ্যে একজন এই মুহূর্তে পশুচারণক্ষেত্রে গিয়ে একটি বকনাকে নিয়ে এস। আর একজন টেলিমেকাসের জাহাজে গিয়ে দুজন বাদে সব নাবিকদের নিয়ে এস। আর একজন কর্মকার ডেকে আন যে সেই বকনার শৃঙ্গ দুটি স্বর্ণমোড়ক দ্বারা আবৃত করে দেবে। বাকি তোমরা এখান থেকে প্রাসাদে এক ভোজসভার আয়োজন করবে। ভৃত্যদের দ্বারা কাষ্ঠ, পবিত্র জল প্রভৃতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করবে।

নেস্টরের আদেশমত সকলে চলে গেল আপন আপন কাজে। যথাসময়ে টেলিমেকাসের অন্যান্য নাবিকেরা চলে এল। কর্মকার এসে সেই বকনার শিং দুটি সোনার পাত দিয়ে মুড়ে দিল। তারপর সেই পশুকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে তার রক্ত একটি পাত্র ধারণ করে সেই রক্ত ও যবের দানা চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। তারপর প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞানলে বলির মাংস আহুতি দিয়ে লাগলেন নেস্টর।

ইতিমধ্যে নেস্টরের কনিষ্ঠা কন্যা সুন্দরী পলিমাস্তে টেলিমেকাসের স্নানের ব্যবস্থা করে দিল। সে নিজের হাতে টেলিমেকাসের গায়ে অলিভ তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিল। তারপর তাকে স্নানশেষে পরিধান করার জন্য এক সুন্দর পোশাক ও দেহবন্ধনী দিল। তাতে তার দেহসৌন্দর্য আরও বেড়ে গেল।

ভোজসভার অনুষ্ঠান শেষ হলো এবং অতিথিরা প্রচুর পান ও ভোজনে তৃপ্ত হলে নেস্টর তাঁর পুত্রদের বললেন, এবার তোমরা একটি রথ আর দীর্ঘ কেশরবিশিষ্ট দুটি দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে এসে টেলিমেকাসের যাত্রার ব্যবস্থা করো।

নেস্টরের কথামত রথে অশ্ব সংযোজিত করে সেই রথে প্রচুর মদ, রুটি, ফল প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য ভরে দিল। তারপর টেলিমেকাস তার উপর উঠে বসতেই নেস্টরপুত্র পীজেসট্রেটাস তার পাশে বন্ধু হাতে রথ চালনা করতে লাগল।

সারাদিন রথ চলত লাগল । সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফেরা নামক এক নগরে উপস্থিত হলো। সেখানে ওনিলোকাসপুত্র ডাওকলস-এর বাড়িতে রাত্রির মত আতিথ্য গ্রহণ করল। সেখানেও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে উপযুক্ত পান ও ভোজনে তাদের তৃপ্ত করল ডাওকলস।

পরদিন সূর্য ওঠার আগেই রথে রওনা দিল ওরা। আবার বিস্তীর্ণ গমের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে ছুটে যেতে লাগল রথ। ক্রমে ওরা উপনীত হলো ওদের যাত্রাপথের শেষ স্তরে। এইভাবে কেটে গেল সারাদিন। দিনের শেষ সূর্য অস্ত গেল। পথের উপর প্রসারিত হতে লাগল প্রাকসন্ধ্যার ছায়াধূসর এক তরল অন্ধকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *