০২. ইথাকায় তর্কযুদ্ধ

দ্বিতীয় পর্ব
ইথাকায় তর্কযুদ্ধ

প্রত্যূষের সোনালি আলোর প্লাবনে দূর দিগন্ত ভরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল টেলিমেকাস। পোশাক ও পাদুকা পরিধান করে একটি তীক্ষ্ণ তরবারি ও একটি বর্শা হতে বেরিয়ে পড়ল শয়নকক্ষ হতে। সে তার ঘোষকদের আদেশ দিল তারা যেন পিতার সহকর্মী ও প্রজাদের এক সভায় আহ্বান জানায়। ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছোট বড় সকলেই সমবেত হলো। সভাস্থল পূর্ণ হলে টেলিমেকাস নিজে সেখানে গেল। তার সাথে রক্ষী হিসেবে ছিল শুধু দুটি কুকুর। এথেন তার চেহারাটাকে এমন এক মনোহারিতা দান করলেন যাতে সভাস্থলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল সে। প্রবীণ ব্যক্তিরা তার যাবার পথ করে দিল এবং তার পিতার আসনে গিয়ে উপবেশন করল টেলিমেকাস।

অ্যাজিপটিয়াস নামে একজন বিজ্ঞ ও বয়োপ্ৰবীণ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে কথা বললেন। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ তাঁর বীর পুত্র সৈনিক হিসেবে ওডিসিয়াসের সঙ্গে ট্রয়যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরে নি। এই পুত্রের নাম অ্যান্টিফাস। সে জাহাজে করে অশ্বনগরী ইলিয়ামে যুদ্ধ করতে গিয়ে বন্য বর্বর সাইক্লোপ দেশীয় উপজাতির দ্বারা নিহত হয়। ওডিসিয়াসের লোকজনের কাছ থেকে দূরে গিয়ে সে যখন তার খাবার খাচ্ছিল তখন সহসা তাকে প্রাণবলি দিতে হয় সেই অসতর্ক মুহূর্তে। অ্যাজিপটিয়াসের ছিল তিন পুত্র। তাদের মধ্যে ইউরিমেকাস পেনিলোপের পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে একজন। বাকি দুই পুত্র তাদের পিতার খামারবাড়িতে চাষের কাজ করে। তিনটি পুত্র জীবিত থাকা সত্ত্বেও অ্যান্টিফাসের মনটা ছিল সবচেয়ে ভাল। তাই শোক-দুঃখের সীমা নেই অ্যাজিপটিয়াসের। সেই মৃত পুত্রের কথা স্মরণ করেই অশ্রুসজল কণ্ঠে বলতে শুরু করল অ্যাজিপটিয়াস, হে আমার স্বদেশবাসী, আমি তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। বীর ওডিসিয়াসের সমুদ্রপথে যুদ্ধযাত্রা করার পর থেকে আমরা এমন কোন সভায় কখনো মিলিত হই নি। কিন্তু কে এই সভা আহ্বান করেছে?–তিনি কোন নবীন যুবক না বয়োপ্ৰবীণ? এই সভা আহ্বানেরই বা প্রয়োজন কি? হয়ত তিনি আমাদের সেনাবাহিনীর প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনেছেন এবং সেই সংবাদ আমাদের দান করতে চান। অথবা তিনি হয়ত অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাধারণভাবে আলোচনা করতে চান। তবে যাই হোক, তিনি সৎ এবং মহান। আমরা আশীর্বাদ করছি দেবরাজ জিয়াস তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ করুন।

অ্যাজিপটিয়াসের এই সব শুভলক্ষণসূচক কথা শুনে আশ্বস্ত হলো ওডিসিয়াসপুত্র টেলিমেকাস। সে তখন নিজের মনের কথা ব্যক্ত করার জন্য নীরবে সভাস্থলের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। লীমেনয় নামে জনৈক প্রহরী তার হাতে বক্তৃতার দণ্ডটি তুলে দিল। টেলিমেকাস তখন অ্যাজিপটিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, যে মাননীয় পারিষদ, আপনি শীঘ্রই সত্য কথা জানতে পারবেন। যে ব্যক্তি এই সভা আহ্বান করেছে সে হচ্ছে আমি, যে আমি অদ্ভুত ধরনের এক দুঃখের বোঝাভার একাকী বহন করে চলেছি নীরবে অপ্রতিবাদে। সেনাবাহিনীর প্রত্যাগমন সম্পর্কে কোন সংবাদ আমি এখনো পাই নি। আপনারা যদি সে সংবাদ পেয়ে থাকেন তাহলে আমি তাতে অংশগ্রহণ করব। আজ তাই এই সভায় কোন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা আলোচনা করব না, আমি এখানে আলোচনা করব আমার এক ব্যক্তিগত দুঃখের কথা। প্রথম কথা হলো, এই রাজ্যের রাজা আমার মহান পিতাকে আমি হারিয়েছি। তিনি ছিলেন সমগ্র জাতির পিতা। কিন্তু এর থেকে আরও বড় এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি আমি, যে বিপর্যয় ডেকে আনবে আমাদের এই রাজবংশের ধ্বংস এবং আমার জীবিকা থেকে আমাকে করবে বঞ্চিত। একদল অবিবেচক পাণিপ্রার্থী জোরপূর্বক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে এবং সেই সব পাণিপ্রার্থীরা হলো এই সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সন্তান। তারা এমনই কাপুরুষ যে আমার মাতামত আইকারিয়াসের কাছে গিয়ে আমার মার পাণিপ্রার্থনা করতে পারছে না তারা। তাহলে সেখানে আইকারিয়াসই তার কন্যার পুনর্বিবাহের জন্য তাদেরই মধ্যে একজন পাণিপ্রার্থী নির্বাচিত করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা আমাদের এই প্রাসাদেই কাল যাপন করছে। তারা আমাদের মেষ ও বলদগুলোকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। উত্তম মদ পান করছে প্রতিদিন। কিন্তু আমাদের যে অর্থ ও সম্পদ ক্ষয় করছে তার কথা একবারও ভেবে দেখছে না। আসল কথা হলো এই যে, ওডিসিয়াসের মত এমন একজন বীরও নেই যিনি আমাদের এই প্রাসাদকে মহামারীর বীজাণুসদৃশ ঐসব পাণিপ্রার্থীদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারেন। আপনারা জানেন আমাদের সে ক্ষমতা নেই, যদি আমরা তাদের কবল থেকে এ প্রাসাদকে মুক্ত করার চেষ্টা করি তাহলে সে চেষ্টা হবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত এবং তাতে আমাদের দুর্বলতাই হবে প্রকাশিত। কিন্তু আমার হাতে যদি সৈন্যদল থাকত তাহলে অবশ্যই আমি এর প্রতিকার করতাম। তবে আমি আমার শেষ কথা বলে দিচ্ছি আপনাদের, তারা যা করছে এবং যেভাবে আমার সম্পদ নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে তা ভদ্রতাবিরুদ্ধ এবং সহ্যের অতীত।

হে ভদ্রমোহদয়গণ, আপনাদের নিজেদের সন্তানদের কথা ভেবে ও আমাদের জাতীয় মর্যাদার খাতিরে এ অবস্থা আপনাদের সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলো নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে আমাদের। একবার দেবতাদের কথা ভেবে দেখুন, তাঁরা অবশ্যই এ অন্যায়ের শাস্তি আপনাদের মাথার উপর চাপিয়ে দেবেন। অলিম্পাস-অধিপতি দেবরাজ জিয়াস ও সভানুষ্ঠানের দেবতা থেমিশের নামে বলছি, আপনারা শুনুন আমার কথা, আপনারা কি মনে ভাবেন একদিন আমার পিতা রাজারূপে তার অধীনস্থ সেনাদলের উপর অত্যাচার করেছিলেন এবং সেই অত্যাচারের শাস্তি আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন আপনারা? তা না হলে আপনারা আমাকে একা এ দুঃখ ভোগ করতে দিতেন না, তা না হলে আপনারা ঐ সব পাণিপ্রার্থীদের প্রশ্রয় দিতেন না। আজ যদি আপনারা আমাদের এই ক্ষতি করতেন এবং পশুহত্যা করতেন তাহলে আমার কোন দুঃখ থাকত না, তাহলে তার ক্ষতিপূরণের জন্য আমার ভাবতে হত না। তাহলে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করলেই সব ক্ষয়ক্ষতি পূরণ হয়ে যেত। এই সব পাণিপ্রার্থীদের প্রতি আপনাদের বর্তমান মনোভাবই আমার মনকে তিক্ততায় ভরে তুলেছে।

কথা বলতে বলতে বলতে এক প্রবল আবেগে বিচলিত হয়ে উঠল টেলিমেকাসের অন্তর। তার বক্তৃতা শেষ হতেই সে কেঁদে ফেলল। হস্তধৃত বক্তৃতার দণ্ডটি ছুঁড়ে ফেলে দিল। টেলিমেকাসের প্রতি এক দয়া ও মমতার ঢেউ খেলে গেল সভাস্থ জনগণের কাছে। কেউ কোন কথা বলতে পারল না। টেলিমেকাসের মুখের উপর কেউ কোন তীক্ষ্ণ প্রত্যুত্তর প্রদান করতে পারল না।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে অ্যান্টিওনাস প্রথমে কথা বলল। সে বলল, এ কোন ধরনের অহঙ্কার টেলিমেকাস, ঘৃণার একটি কৃৎসিত অভিপ্রকাশ! এতে আমরা সকলেই লজ্জিত। তুমি কি সব দোষ শুধু আমাদের উপর চাপিয়ে দেবে? তুমি ভুল করছ। আমি বলছি আমরা পাণিপ্রার্থীরা সকলে নির্দোষ। তোমার মাই হচ্ছে একমাত্র অপরাধী। এক অতুলনীয় চক্রান্তকারিণী। দীর্ঘ তিন বৎসর, প্রায় চার বৎসরের কাছাকাছি তিনি আমাদের এক তীক্ষ্ণ উদ্বেগের মধ্যে ঝুলিয়ে রেখেছেন, গোপনে প্রত্যেক পাণিপ্রার্থীকে এমন এক মিথা প্রতিশ্রুতি দান করেছেন যা তিনি কোনদিন রক্ষা করবেন না।

আর ছলনার প্রমাণের কথা শোন। তিনি একখানি বস্ত্রখণ্ডের উপর এক বয়নশিল্প রচনা করেছেন। তিনি আমাদের একদিন বললেন, “হে যুবকবৃন্দ, রাজা ওডিসিয়াসের মৃত্যুর পর আমাকে বিবাহ করার প্রস্তাব করার জন্য আমি আপনাদের নিকট কৃতজ্ঞ। এই বয়নশিল্পের কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে হবে। তা না হলে অর্থাৎ এই আরদ্ধ কার্য অসম্পন্ন রয়ে গেলে অনেক সুতো নষ্ট হয়ে যাবে। এই বয়নশিল্পসমৃদ্ধ বস্ত্রখণ্ডটি লর্ড লাৰ্তেসের শবাচ্ছাদনরূপে ব্যবহৃত হবে। কারণ তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলে এই ধরনের বস্ত্রের দ্বারা তার শব যদি আচ্ছাদিত না হয় তাহলে আমাদের দেশের নারী সমাজ হবে ধিকৃত। লোকে বলবে যিনি এত সম্পদ রেখে গেছেন তিনি এমন হীনভাবে সমাহিত হলেন।

এই কথা বলে তিনি আমাদের সাময়িকভাবে প্রতিনিবৃত্ত করেন এবং আমরা তাঁর সে অনুরোধ রক্ষা করি। কিন্তু সমস্ত দিন ধরে যে বয়নশিল্প তিনি রচনা করতেন রাত্রিতে তা নষ্ট করে দিতেন। এইভাবে তিনি তিন বৎসরকাল প্রতারিত করেন আমাদের। চতুর্থ বৎসর শুরু হতেই এক সহচরী এই কথাটি ফাঁস করে দেয় আমাদের কাছে এবং তিনি যখন সেই সুন্দর শিল্পকর্মের সুতোগুলো খুলে দিচ্ছিলেন তখন আমরা তাঁকে ধরে ফেলি। তখন তোমার মাতা সেই বয়নশিল্পকর্মটি সম্পন্ন করতে বাধ্য হন।

পাণিপ্রার্থীদের পক্ষ থেকে এই উত্তর আমি তোমায় প্রদান করতে চাই টেলিমেকাস, তোমার মাকে এবার পাঠিয়ে দাও তোমার মাতামহের কাছে। তোমার মাতামহ এবং তিনি নিজে যাকে পছন্দ করবেন তার সঙ্গেই তার বিবাহ হবে। দেবী এথেনের কৃপায় তিনি যে শিল্পপ্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তা লাভ করেছেন তার অহঙ্কারে মত্ত হয়ে তিনি যদি এইভাবে পাণিপ্রার্থীদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে যান তাহলে তার পরিণামের কথা একবার চিন্তা করা উচিত। এই প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তার কোন তুলনা নেই একথা আমি স্বীকার করছি। এমন কি আমাদের দেশের পুরা কাহিনীতেও এর কোন তুলনা পাওয়া যায় না। টাইরো, আলমেনি, মাইসেন প্রমুখ যেসব অনিন্দসুন্দরী রমণী ছিলেন তাঁদেরও এমন বুদ্ধিমত্তা ছিল না। কিন্তু এক্ষেত্রে তার বুদ্ধিমত্তার কোন পরিচয় দিতে পারেন নি পেনিলোপ। কারণ যতদিন তিনি এই মনোভাব পোষণ করবেন যে এই পাণিপ্রার্থীদের কাউকে নির্বাচন করলে তিনি ভুল করবেন ততদিন এঁরা সকলেই তোমাদের অন্ন ধ্বংস করে করে রাজকোষ শূন্য করে দেবে। তিনি হয়ত তাঁর চাতুর্যের জন্য এক অক্ষয় নামযশ লাভ করতে চান, কিন্তু তার জন্য তোমাকে করতে হবে প্রচুর কষ্টভোগ। সুতরাং আবার আমি বলছি, যতদিন পর্যন্ত না উনি আমাদের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করছেন, ততদিন আমরা এ প্রাসাদ ত্যাগ করে কোথাও যাব না।

যুবরাজ টেলিমেকাস উত্তর করলেন, শুনুন অ্যান্টিওনাস, আমার যে মাতা আমাকে প্রসব করে লালন পালন করেছেন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে। বিশেষ করে আমার পিতা যখন জীবিত নেই। একবার ভেবে দেখুন আমি যদি আমার মাতাকে তাঁর পিতার কাছে পাঠিয়ে দেই তাহলে ক্রুদ্ধ আইকারিয়াসকে আমি কিভাবে শান্ত করব? আইকারিয়াস আমার উপর ধ্বংসকার্য সাধন করার পর দেবতারা আমার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আমার মাতা তাঁকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করার জন্য যে অভিশাপ আমায় দেবেন তা কার্যে রূপায়িত করে তুলবেন দেবতারা। সবশেষে আমার প্রজারা ধিক্কার দেবে আমায়। আমি আপনাদের কথা কোনমতেই মেনে নিতে পারব না। যদি আপনাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধও থাকে তাহলে এ প্রাসাদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবেন আপনারা। অন্য কোথাও ভোজসভার অনুষ্ঠান করবেন। কিন্তু যদি কেবল একজনের সব ধনসম্পদ নষ্ট করে সব দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার কোন গভীর চক্রান্ত করে থাকেন তাহলে তাই করুন। আমি শুধু অমর দেবতাদের কাছে প্রার্থনা জানাব তাঁরা যেন আমায় এমন এক সুদিন দেন যেদিন আমি আমার এই প্রাসাদেই আপনাদের ধ্বংস করে নিজে অক্ষয় রয়ে যেতে পারব।

টেলিমেকাসের এই কথার প্রত্যুত্তরে দেবরাজ জিয়াস অলিম্পাসের পর্বতশিখর হতে দুটি ঈগলকে উড়িয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ ধরে ঈগল দুটি প্রসারিত পাখা দুটি জড়ো করে বাতাসে ভেসে যেতে লাগল। কিন্তু তারা সভাস্থলে মাথার উপরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাখাগুলো নেড়ে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে সভাস্থিত জনতার পানে এমন এক কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল যে দৃষ্টির মধ্যে ছিল এক আসন্ন মৃত্যুর আভাস। তারপর ঈগলটি একে অন্যের গাল ও ঘাড়গুলো ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাতে লাগল। এইভাবে তারা নগরের পূর্ব দিকে একটি বাড়ির ছাদে গিয়ে বসে পড়ল।

নগরের বহু লোক এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। কিন্তু এই লক্ষণের অর্থ কি তা তারা বুঝতে পারল না। অবশেষে মাস্টারপুত্র বৃদ্ধ লর্ড হ্যাঁলিসার্থে এগিয়ে এলেন এই লক্ষণ ব্যাখ্যা করার জন্য। সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভবিষ্যদ্বক্তা হ্যাঁলিসার্থেস পাখি সংক্রান্ত লক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারতেন। তিনি সভায় এসে জনগণকে সম্বোধন করে বললেন, হে ইথাকার অধিবাসিগণ, শোন আমার কথা। আমি বিশেষ করে পাণিপ্রার্থীদের লক্ষ্য করেই এই পাখিদুটির লক্ষণ ব্যাখ্যা করছি। তাদের উপর নেমে আসছে এক বিরাট বিপর্যয়। ওডিসিয়াস আর দীর্ঘদিন তার বন্ধু ও আত্মীয় পরিজন হতে দূরে থাকবেন না। এখন তিনি ইথাকা নগরী হতে খুব একটা বেশি দূরে নেই আর তাঁর আসার সঙ্গে সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাণিপ্রার্থীদের মৃত্যুবরণ করতে হবে আর সেটা হবে আমাদের মত অনেক ইথাকাবাসীর পক্ষে দুঃখের কথা। সেই বিপর্যয় যাতে না ঘটে আমরা কি তার ব্যবস্থা করতে পারি না? আর তাছাড়া পাণিপ্রার্থীরাই নিজে থেকে এ কাজে বিরত থেকে অন্যত্র চলে যেতে পারেন। আমি ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে সুদক্ষ এবং আমি আমার পরিপক্ক অভিজ্ঞতা হতেই এ কথা বলছি। একবার ওডিসিয়াসের কথাটা ভেবে দেখ। তিনি যখন ইলিয়ামের পথে গ্রীকদের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রা করেন আমি তখন যা যা বলেছিলাম তা কি সব সত্য হয় নি? আমি তাকে বলেছিলাম উনিশ বছরের আগে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন না এবং তাঁর সঙ্গের একজন সহকর্মীও জীবিত থাকবে না। বলেছিলাম, বহু দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হবে তাকে আর তিনি যখন ফিরবেন তখন তাকে কেউ চিনতে পারবে না। আমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয় কিনা দেখ।

পলিবাসপুত্র ইউরিমেকাস উঠে বৃদ্ধ হ্যাঁলিসার্থেসের ভবিষ্যদ্বাণীর উত্তরে বলল হে শুভ্রশ্মশ্রুবিশিষ্ট বৃদ্ধ, বাড়ি গিয়ে তোমার ছেলেমেয়েদের কাছে লক্ষণ ব্যাখ্যা করগে। এখন এই পাখিদের লক্ষণ ব্যাখ্যার কাজ আমার উপর ছেড়ে দাও। এ বিষয়ে আমি তোমার থেকে বেশি দক্ষ। সূর্যালোকিত মুক্ত আকাশে বাতাসে পাখিই উড়ে বেড়ায়। কিন্তু তাদের সবার উড়ে চলার অর্থ হয় না। ওডিসিয়াসের কথা যদি বল, বিদেশে তার মৃত্যু ঘটেছে এবং তার সঙ্গে তোমার মৃত্যু ঘটলেও ভাল হত। তাহলে তোমার মুখ থেকে উৎসারিত এই সব ভবিষ্যদ্বাণীর প্লাবন থেকে পরিত্রাণ পেতাম আমরা। তাহলে তুমি এভাবে টেলিমেকাসের ক্রোধের আগুনে ইন্ধন যোগাতে পারতে না। টেলিমেকাসের মেজাজ ভাল থাকলে তার কাছ থেকে বড় রকমের একটা উপহার পেতে পার। কিন্তু আমার কথা শুনে রাখ এবং আমি যা বলি তা করি। যদি তুমি তার থেকে বয়সে অনেক প্রবীণ হওয়া সত্ত্বেও তোমার বার্ধক্যসূলভ জ্ঞানবুদ্ধি ও বাগ্মিতার অপব্যবহার করে এই যুবককে উত্তেজিত করো, তাহলে প্রথমত তাতে তার ভাল হবে না আর দ্বিতীয়ত তোমাকেও তার জন্য অপ্রীতিকর পরিণাম ভোগ করতে হবে। তোমার উপর এ জন্য আমরা এমন জরিমানা ধার্য করব যা দিতে তোমার বুক ফেটে যাবে। শোন টেলিমেকাস, তোমার প্রতি এই হলো আমার পরামর্শ। আমি সকলের সামনে প্রকাশ্যে তা বলে দিচ্ছি। তুমি তোমার মাকে তাঁর পিতার বাড়ি পাঠিয়ে দাও। সেখানে তাঁরা তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করবেন এবং তাঁদের কন্যার উপযুক্ত যৌতুক বিবাহে দান করবেন। তা যতদিন না ঘটবে আমাদের এই সব যুবক পাণিপ্রার্থীদের দল তাদের দাবি প্রত্যাহার করে কিছুতেই চলে যাবে না। কারণ আমরা কাউকে ভয় করি না, টেলিমেকাসের আলঙ্কারিক কথাবার্তা সত্ত্বেও কিছুমাত্র তার ভয়ে ভীত নই আমরা।

আর শোন বৃদ্ধ, তোমার এই সব ভবিষ্যদ্বাণী আমরা মোটেই গ্রাহ্য করি না। এই বাণী কোনদিনই সত্যে পরিণত হবে না আর তার ফলে তোমার নাম আরও খারাপ হয়ে যাবে। পেনিলোপ যদি এইভাবে আমাদের বিবাহের প্রস্তাব ঝুলিয়ে রাখে তবে টেলিমেকাসকে অবশ্যই দুঃখ ভোগ করতে হবে আর ধনসম্পত্তির যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা আর কোনদিন পূরণ হবে না। তা যতদিন না হয় ততদিন আমরা এই প্রাসাদেই থাকব, অন্য কোথাও যাব না। যে অতুলনীয় পুরস্কার লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করছি আমরা পরস্পরের সঙ্গে, সে লাভের আশা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে আমাদের কমার পরিবর্তে।

টেলিমেকাস এবার উঠে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞজনের মত বলল, ইউরিমেকাস এবং যে সব মহান পাণিপ্রার্থী আমার মাতার উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন তাদের যা কিছু বলার আমি বলেছি। এ বিষয়ে আর কিছু আমি আলোচনা করব না। স্বর্গের দেবতাবৃন্দ এবং সভাস্থ জনগণ আমার কথা সব শুনেছেন। এখন আমি যা চাই তা হলো একটি দ্রুতগামী জাহাজ আর কুড়িজন নাবিক। তা নিয়ে আমি একবার সমুদ্রযাত্রা করব এবং অবিলম্বে ফিরে আসব। আমি যাব স্পার্টা আর পাইলসে। সেখানে আমার পিতার দীর্ঘকাল অনুপস্থিতির কারণ ও তার প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে অনুসন্ধান করব। এমনও হতে পারে কেউ তার সন্ধান দিতে পারে। আবার স্বর্গ হতে উত্থিত কোন গুজবের কথা শুনে ফেলতে পারি। স্বর্গের এই সব গুজব প্রায় সত্যে পরিণত হয়। যদি আমি শুনি তিনি জীবিত আছেন এবং ফিরে আসছেন তাহলে আমি এক বছর এই সব ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করব। আর যদি শুনি তিনি মৃত তাহলে আমি বাড়ি ফিরে এসে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করব। তারপর অন্য এক লোকের সঙ্গে আমার মাতার দ্বিতীয়বার বিবাহ দেব।

টেলিমেকাস তার কথা শেষ করে আসন গ্রহণ করতেই মেন্টর উঠে দাঁড়াল। মেন্টর ছিলেন ওডিয়াসের এক পুরাতন বন্ধু। ওডিসিয়াস যখন যুদ্ধের জন্য বিদেশযাত্রা করেন তখন মেন্টরের উপরেই তাঁর রাজপ্রাসাদের সব ভার অর্পণ করে যান। তিনি আদেশ দিয়ে যান মেন্টর যেন বৃদ্ধ লার্তেসের প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং বাড়ির সব ধনসম্পত্তি যা আছে সব অক্ষুণ্ণ রাখেন।

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর উদ্ধত স্বদেশবাসীদের তিরস্কার করে তাঁর শুভেচ্ছা প্রকাশ করলেন টেলিমেকাসের প্রতি। তিনি বললেন, হে নাগরিকবৃন্দ, তাহলে আমি এখন এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে যারা রাজদণ্ড ভোগ করবেন, দয়া, উদারতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি গুণাবলির প্রতি তাদের কারো কোন লক্ষ্য থাকবে না। বস্তুত তারা অত্যাচার ও যত সব অবৈধ কার্যাবলির মধ্যে দিয়েই দিনাতিপাত করে যাবেন। ওডিসিয়াসের কথাটা যদি কেউ ভেবে দেখে তার এই কথাই মনে হবে। ওডিসিয়াস ছিলেন এমনি এক শ্রদ্ধেয় রাজা যিনি স্নেহশীল পিতার মত জনগণকে সুশাসনে রেখেছিলেন। অথচ আজ একজনও তাঁর কথা ভাবে না। তাদের দুষ্টবুদ্ধিতার বশে এই সব উদ্ধত পাণিপ্রার্থীরা যে অন্যায় করে চলেছে তার জন্য আমি তাদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করতে চাই না। মনে রেখো ওডিসিয়াস চিরদিনের জন্য পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ভেবে তোমরা যদি তাঁর ধনসম্পত্তি অপচয় করে চল তাহলে কিন্তু তোমরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নেবে। না, শুধু পাণিপ্রার্থীরা নয়, অন্য যারা এক নিবিড় নীরবতায় নিজেদের আচ্ছন্ন করে রখে বসে আছে নিষ্ক্রিয়ভাবে আজ তারাই আমার ঘৃণা ও ক্রোধের সৃষ্টি করেছে সবচেয়ে বেশি। পাণিপ্রার্থীরা সংখ্যায় অনেক কম আর তোমরা সংখ্যায় অনেক বেশি, অথচ তাদের অন্যায় কর্মের নিন্দা করে অথবা তাদের সংযত করার উদ্দেশ্যে একটা কথাও বললে না।

ইউনরপুত্র লিওব্রিটাস চিৎকার করে বলল, থাম মেন্টর, বোকা পাগল কোথাকার। আমাদের নিবৃত্ত করার জন্য ওদের অনুরোধ করার মধ্যে কী এমন যুক্তি থাকতে পারে সামান্য খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তারা কখনই আমাদের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি করতে পারে না। ওডিসিয়াস নিজে এসেও তার প্রাসাদে আমাদের ভোজন করতে দেখে রেগে যদি আমাদের বিরোধিতা করে তাহলে তার স্ত্রী বেশি দিন আর মিলনের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। এই সামান্য কারণে সে রাগ করলে এক শোচনীয় পরিণতি লাভ করবে তার জীবন। সুতরাং তুমি যা বলেছ তা মিথ্যা। কিন্তু অনেক হয়েছে। এখন এ সভা ভেঙ্গে দাও। প্রতিটি পাণিপ্রার্থী আপন আপন দেশে চলে যাক। টেলিমেকাসের দুই পিতৃবন্ধু মেন্টর ও হ্যাঁলিসার্থে তার সমুদ্রযাত্রার ব্যবস্থা করে দেবে। তবে আমার মনে হয় ও কোনদিন ইথাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না এবং এখানে থেকেই সে যতদূর সম্ভব সংবাদ সংগ্রহ করবে।

জনতা সভাটি ভেঙ্গে দেওয়ার প্রস্তাবে সম্মত হলো। তারপর সভা ভঙ্গ হলে আপন আপন বাড়ির দিকে চলে গেল। ওদিকে পাণিপ্রার্থীরা ওডিসিয়াসের প্রাসাদের অন্তর্গত তাদের বাসস্থানের দিকে চলে গেল।

এই অবসরে টেলিমেকাস চলে গেল নির্জন সমুদ্রতীরে। সেখানে গিয়ে সমুদ্রজলে হাত ধুয়ে এক অঞ্জলি জল নিয়ে হাতে তুলে দেবী এথেনের উদ্দেশ্যে বলল, আমার আবেদন শোন দেবী, গতকাল তুমি আমার কাছে আবির্ভূত হয়ে আমায় আদেশ করেছিলে, আমি যেন দূর অজানা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমার হারানো বাবা ফিরে আসছেন কি না তার সন্ধান করি। কিন্তু তুমিই দেখ, আমার দেশবাসী এবং বিশেষকরে যেসব দুবৃত্ত আমার মাতাকে অবরুদ্ধ করেছে তারা প্রতিপদে বাধা দিচ্ছে আমায়।

এই প্রার্থনার কথা শুনে দেবী এথেন সশরীরে আবির্ভূত হলেন তার সামনে। এমনভাবে তিনি মেন্টরের বেশ ধরলেন যাতে তাকে দেখে বা তার কথা শুনে কিছু বোঝাই গেল না। টেলিমেকাসকে সম্বোধন করে তিনি বলতে লাগলেন, আর এটা প্রমাণিত হয়েছে টেলিমেকাস, তুমি একজন কাপুরুষ অথবা নির্বোধ নও; তোমার পৌরুষ ও তেজস্বিতা তোমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে বলে আমাদের যে ধারণা সে ধারণা ঠিক। কাজে ও কথায় কী মানুষই না তিনি ছিলেন! না, তোমার এই সমুদ্রযাত্রা ব্যর্থতায় পর্যবসিত অথবা উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে সে ভয় তুমি করো না। যদি তুমি ওডিসিয়াস ও পেনিলোপের প্রকৃত সন্তান না হতে তাহলে তোমার পরিকল্পনা হয়ত ব্যর্থ হতে পারত। পিতার সমকক্ষ কোন সন্তান হয় না, বরং তার পিতার থেকে সন্তানরা সাধারণত নিকৃষ্টই হয়। তবে অতি অল্প কিছুসংখ্যক তার পিতাকে ছাড়িয়ে যায়, আরও ভাল হয়। যেহেতু আমরা জানি তোমার মধ্যে ওডিসিয়াসের মত বুদ্ধির অভাব নেই এবং তুমি কোনদিন কাপুরুষ বা নির্বোধের মত কাজ করবে না, তুমি অবশ্যই মনে ভাববে তোমার সাফল্যের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সুতরাং এখন পাণিপ্রার্থীদের কথা ভুলে যাও, তাদের চক্রান্তের কথা ঝেড়ে ফেলে দাও তোমার মন থেকে। আসলে তারা সবাই নির্বোধ এবং তাদের আত্মসম্মানবোধ বলে কোন বস্তু নেই। দুর্ভাগ্যের যে কৃষ্ণকুটিল মেঘ ঘনীভূত হয়ে আসছে তাদের জীবনে এবং যে মেঘ চূড়ান্ত ধ্বংসের এক প্লাবন বইয়ে দেবে তাদের উপর দিয়ে, সে মেঘ সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারে নি তারা। ইতিমধ্যে যে সমুদ্রযাত্রার বাসনা তোমার অন্তরে জেগেছে তা শুরু করে ফেল। আমি কি তোমার পিতার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু নই? আমি তোমার জন্য একখানা ভাল জাহাজ দেখে দেবো এবং নিজে তোমার সঙ্গে যাব। এবার তুমি বাড়ি গিয়ে পাণিপ্রার্থীদের সামনে দেখা দাওগে। তারপর সমুদ্রযাত্রার জন্য যা যা দরকার তা সব যোগাড় করে নাওগে। সেইসব জিনিস জাহাজে গুছিয়ে তুলে নেবে। বিশেষ করে কিছু ভাল মদ, কিছু চামড়ার পোশাক আর যবজাতীয় খাদ্যদ্রব্য নেবে। এর মধ্যে আমি শহর থেকে জনকতক ভাল নাবিক বেছে আনব। সমুদ্রপরিবৃত ইথাকা বন্দরে প্রচুর ভাল ভাল জাহাজ আছে। আমি তার থেকে একটা বেছে আনব ও তোমার জন্য সমুদ্রে ভাসিয়ে দেব।

জিয়াসকন্যা দেবী এথেনের কথা শুনে সেই নির্জন সমুদ্রতীরে আর পদচারণা না করে চিন্তান্বিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে গেল টেলিমেকাস। প্রাসাদপ্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে টেলিমেকাস দেখল সেই দুবৃত্ত পাণিপ্রার্থীরা ছাগল ও মোটা চর্বিওয়ালা শূকর কেটে তাদের ছাল ছড়াচ্ছে। অ্যান্টিওনাস তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে তার একটা হাত ধরে বলতে লাগল, হে তরুণ বাগ্মীপ্রবর টেলিমেকাস, তুমি অনেক কঠোর কথা বলেছ এবং আমাদের ধ্বংস চিন্তা করেছ। এবার আমাদের সঙ্গে পানাহারে প্রবৃত্ত হও। আমি বলছি, আমাদের লোকজন তোমার জন্য একটা জাহাজ আর কিছু নির্বাচিত ভাল নাবিকের ব্যবস্থা করে দেবে, যাতে তুমি পবিত্র নগরী পাইলসে গিয়ে তোমার পিতার অনুসন্ধান করতে পারবে।

কিন্তু ওদের কথায় প্রতারিত হলো না টেলিমেকাস। সে তার হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, অ্যান্টিওনাস, তোমাদের মত উচ্ছংখল ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে নৈশভোজনে প্রবৃত্ত হওয়া কোন ভদ্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। খুব হয়েছে, তোমরা কি ভেবেছ আমার মার পাণিপ্রার্থনার নামে আমার ধনসম্পত্তি এতদিন ধরে নষ্ট করে এসেছ আর আমি এমনই এক নির্বোধ শিশু যে তা বুঝতে পারি নি? এখন আমি তোমাদের স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, যা যা ঘটেছে সে কথা অপরের কাছ থেকে সব শুনেছি। তা বোঝার মত বয়স আমার হয়েছে। এখন আমি আমার মধ্যে শক্তি খুঁজে পেয়েছি। আমি এখানেই থাকি অথবা পাইলসেই যাই তোমাদের জাহান্নামে না পাঠিয়ে ক্ষান্ত হব না। আর যে সমুদ্রযাত্রার কথা আমি বলছি তার থেকেও প্রতিনিবৃত্ত হব না, যদিও অবশ্যই আমি এজন্য কোন জাহাজ বা নাবিক না পেলে তোমদের খুবই ভাল হয়।

টেলিমেকাসের কথাকে কেন্দ্র করে অপমান ও উপহাসের এক ঝড় বয়ে গেল। জনৈক যুবক পাণিপ্রার্থী বলে উঠল, আমার বিশ্বাস টেলিমেকাস আমাদের গলা কাটতে চায়। সেই পাইলসৈ যাচ্ছে সাহায্য প্রার্থনার জন্য। আমাদের রক্তের জন্য এমনই পিপাসার্ত হয়ে উঠেছে যে সে হয়ত সাহায্যের জন্য স্পার্টাতেও যাবে। আবার সে হয়তবা উর্বর ভূমিসমৃদ্ধ এফায়ারেরও যেতে পারে। সে হয়ত এক মারাত্মক বিষ এনে আমাদের মদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে আমাদের সকলকেই হত্যা করবে।

অন্য এক যুবক বলল, কে জানে, টেলিমেকাস যদি সত্যি সত্যিই সমুদ্রযাত্রা করে তাহলে সেও হয়ত তার পিতার মত হারিয়ে যেতে পারে সমুদ্রে। তাহলে আমাদের অবশ্য কিছু কষ্ট সহ্য করতে হবে। কারণ তখন তার সম্পত্তিটা আমাদের মধ্যে ভাগ করে নিতে হবে আর এই প্রাসাদটা তার মা ও তার নতুন স্বামীকে দান করতে হবে।

তারা যখন নিজেদের মধ্যে এইসব কথা আলোচনা করতে লাগল, তখন টেলিমেকাস তার পিতার ধনভাণ্ডারে চলে গেল। একটি প্রশান্ত ও আয়তবিশাল কক্ষে স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জ প্রভৃতি বহু মূল্যবান ধাতু স্থূপাকৃতি করা ছিল। উত্তম পোশাক আর সুবাসিত তৈলে পরিপূর্ণ ছিল কয়েকটি সিন্দুক। বহু কষ্ট ভোগ করে বহুদিন পর বাড়ি ফিরে ওডিসিয়াস পান করবেন বলে বড় বড় পাত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ মদ ও অমিশ্রিত ফলের রস সাজানো ছিল। বড় বড় তালাযুক্ত দরজাবিশিষ্ট সুরক্ষিত ধনাগারের ভার ছিল বুদ্ধিমতী ইউরিক্লীয়ার হাতে।

ইউরিক্লীয়াকে ডেকে টেলিমেকাস বলল, শোন ধাত্রী, আমাকে কিছু ভাল মদ দেবে। সেই হতভাগ্য রাজা বহু দূর থেকে অকস্মাৎ একদিন এসে পান করবেন বলে যেসব উত্তম মদ তুমি কত আশায় সাজিয়ে রেখেছ, তার থেকে কিছু দাও। ছিপিআঁটা বারোটি বড় পাত্র আর কুড়ি মণ যবের আটা দাও। কাউকে এ বিষয়ে কোন কথা বলবে না। সমস্ত মাল একজায়গায় গুছিয়ে রাখবে। রাত্রিতে মা উপরতলায় চলে গেলে আমি তা নিয়ে যাব। আমি যাব স্পার্টা আর পাইলসে সেখানে আমার পিতার কোন সংবাদ পেতে পারি।

একথা শুনে এক প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়ল ইউরিক্লীয়া। বলল, হে বৎস, কে তোমার মাথায় এই পরিকল্পনা ঢোকাল? তুমি তোমার মায়ের একমাত্র সন্তান, চোখের মণি, তোমার পিতা দূর বিদেশে প্রাণত্যাগ করেছেন। এমত অবস্থায় কেন তুমি বিদেশে যাবে? যে মুহূর্তে তুমি তোমার পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, এই সব দুবৃর্তগুলো তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে এবং এই সব ধনসম্পত্তি ভাগ করে নেবে নিজেদের মধ্যে। তার থেকে এই বাড়িতে থেকেই তুমি তোমার সম্পত্তি রক্ষা করে চল। দূর অজানা সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে অপরিসীম দুঃখ কষ্ট ভোগ করার কোন প্রয়োজন নেই তোমার।

বিজ্ঞের মত উত্তর করল টেলিমেকাস, হে ধাত্রী, ভয় করো না। এ ব্যাপারে একজন কৃপাময়ী দেবীর হাত আছে। কিন্তু তুমি শপথ করো, আমি চলে যাবার পর অন্তত পনের দিন আমার মাকে কোন কথা বলবে না? আমি এখানে নেই একথা তিনি নিজে থেকে যখন জানতে পারবেন, তার আগে তাকে কোন কথা বলবে না। তাহলে অবিরত চোখের জলে ভাসিয়ে দেবেন তিনি তাঁর সুন্দর গণ্ডদ্বয়।

সমস্ত দেবদেবীর নামে শপথ করল ইউরিক্লীয়া। শপথ করে বলল, একথা সে গোপন রাখবে। কাউকে কোন কথা বলবে না। তারপর টেলিমেকাসের কথামত সে মদ আর আটা সব গুছিয়ে রাখল। টেলিমেকাস তখন নিশ্চিন্ত মনে হল ঘরে গিয়ে ওদের ভোজসভায় যোগদান করল।

ইতিমধ্যে দেবী এথেন অন্য একটি উপায়ের কথা চিন্তা করলেন। তিনি সহসা টেলিমেকাসের বেশ ধারণ করে ইথাকা নগরে গিয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে বন্দরের সেই জাহাজের কাছে সকলকে আসার জন্য নির্দেশ দিলেন। তারপর ইথাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ফ্রোনিয়াসের পুত্র লোমনের কাছ থেকে একটি জাহাজ চেয়ে নিলেন।

ক্রমে সূর্য গেল অস্তাচলে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে উঠল রাজপথে। লোমনের সেই জাহাজটি সমুদ্রযাত্রার উপযুক্ত কি না তা ভাল করে চালিয়ে দেখে নিয়ে এথেন নোঙ্গর করে রাখলেন বন্দরে। নাবিকরা সকলেই সেই জাহাজের কাছে সমবেত হলে তিনি তাদের উপযুক্ত নির্দেশাদি দান করলেন।

এরপর ওডিসিয়াসের রাজপ্রাসাদে সোজা চলে গেলেন দেবী এথেন। সেখানে গিয়ে পাণিপ্রার্থীদের তন্দ্রার ঘোরে এমনভাবে সহসা আচ্ছন্ন করে ফেললেন যে, তাঁদের হাত হতে মদের পাত্র পড়ে গেল। তারা উঠে কোনরকমে তাদের আপন আপন শয়নকক্ষের মাঝে চলে গেল। দেবী এথেন তখন মেন্টরের বেশ ধরে টেলিমেকাসকে ডেকে বললেন, চলে এসে টেলিমেকাস, তোমার সাহসী সুদক্ষ নাবিকেরা প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তারা তোমার আদেশের অপেক্ষা করছে। আর বিলম্ব করা চলে না।

এই বলে মেন্টরবেশিনী দেবী এথেন দ্রুতগতিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন আর তাকে অনুসরণ করে চলল টেলিমেকাস। গিয়ে দেখল নাবিকরা সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত। টেলিমেকাস তাদের বলল, বন্ধুগণ, আমাদের প্রয়োজনীয় রসদ দ্রব্যাদি সব প্রাসাদে প্রস্তুত করে রেখেছি। সেগুলো এনে জাহাজে তুলে নাও। এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করো তোমরা।

টেলিমেকাসের কথামত কাজ করল নাবিকরা। তখন তাদের জাহাজ ছাড়ার জন্য আদেশ দিল টেলিমেকাস। তখন সমুদ্রের রংটা ছিল মদের মত ধূসর। পশ্চিম দিগন্ত হতে সেই জাহাজ চলার উপযুক্ত অনুকূল বাতাস এনে দিলেন এথেন। টেলিমেকাসের কাছ থেকে আদেশ পেয়ে জাহাজ ছেড়ে দিল নাবিকরা। মাস্তুলের সঙ্গে সাদা পাল তুলে চামড়ার দড়ি দিয়ে টাঙ্গিয়ে দিল।

জাহাজটি পাল তুলে যাত্রা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের জলভাগ বিদীর্ণ হয়ে দুদিকে কালো ঢেউ স্ফীত হয়ে উঠল।

জাহাজ এইভাবে চলতে শুরু করলে মদের সঙ্গে পবিত্র জল মিশিয়ে টেলিমেকাস দেবী এথেন ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দান করল। সারা রাত্রি ধরে অন্ধকার সমুদ্রের অনন্ত জলরাশি কর্ষণ করে জাহাজটি এগিয়ে যেতে লাগল পাইলসের পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *