০১. প্রথম পর্ব

প্রথম পর্ব

যে বীরপুরুষের কথা ও কাহিনী আমাকে পরিজ্ঞাত করানোর জন্য কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী মিউজের নিকট প্রার্থনা জানাচ্ছি, তিনি হচ্ছেন এমন এক প্রত্যুৎপন্নমতি পুরুষ যিনি পবিত্র ট্রয়নগরী বিধ্বস্ত করার পর বহুদেশ পরিভ্রমণ করেন। বহু নগর ও জনপদ অতিক্রম করে তিনি অর্জন করেন কত অমূল্য অভিজ্ঞতার সম্পদ। নিজের জীবন রক্ষা করে সহকর্মীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কত বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয় তাঁকে, কত দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর সহকর্মীদের জীবনরক্ষা করতে পারেন নি তিনি। তারা অবশ্য নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে, কারণ তারা একবার সূর্যদেবতা হাইপীরিয়েনের নিকট উৎসর্গীকৃত বলির বলদগুলো ভক্ষণ করে ফেলে এক চরম নির্বুদ্ধিতার বশবর্তী হয়ে। ফলে অভিশাপ দেন সূর্যদেবতা, তারা যেন আর কোনদিন ফিরতে না পারে তাদের স্বদেশে। এই কাহিনীটি পরিব্যক্ত করার জন্য আমি প্রার্থনা জানাচ্ছি কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে। হে দেবী, এ কাহিনীর যেখান থেকে খুশি শুরু করো।

এক দীর্ঘ সংগ্রাম আর বিদপসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রার এক সকরুণ কাহিনীকে পিছনে ফেলে ট্রয়যুদ্ধে জীবিত গ্রীকসেনারা অবশেষে উপনীত হয় তাদের স্বদেশে। একমাত্র ওডিসিয়াসই ফিরে যেতে পারেন নি তার ঘরে। মিলিত হতে পারেন নি তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত ঘরণীর সঙ্গে। ক্যালিপসো নামী প্রবল পরাক্রমশালিনী এক জলদেবী বাধা দেন ওডিসিয়াসকে। ওডিসিকে বিবাহ করার মানসে তাঁকে বন্দী করে রেখে দেন তাঁর শূন্য গুহার এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারে। এমন কি অন্যান্য দেবতারা বৎসরের যে সময়টিতে ওডিসির স্বরাজ্য ইথাকায় প্রত্যাবর্তনের প্রকৃষ্ট ক্ষণ বলে নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন সে সময়েও বিপন্মুক্ত হতে পারলেন না তিনি। মিলিত হতে পারলেন না তিনি তাঁর আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে। এজন্য একমাত্র পডেসন ছাড়া অন্য সব দেবতাই মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন। এই পসেডন এক নির্মম অভিশাপের মত বীর ওডিসিয়াসের অনুসরণ করেছিলেন তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগের দিন পর্যন্ত।

পসেডন তখন স্বর্গলোকে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন পৃথিবীর এক সুদূর প্রান্তে অবস্থিত ইথিওপিয়ায়। পৃথিবীর মানবজাতির অর্ধেক বাস করে চিরসূর্যাস্ত অর্থাৎ চিরঅন্ধকারময় দেশে আর বাকি অর্ধাংশ বাস করে আলোর দেশে। পসেডন সেখানে গিয়েছিলেন তাঁর প্রতি উৎসর্গীকৃত কিছু বলদ ও মেষ লাভের জন্য এবং সেখানে তিনি ভোজসভায় আনন্দে মত্ত হয়ে ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। ইতিমধ্যে অধিকাংশ দেবতা দেবরাজ জিয়াসের অলিম্পাসস্থিত প্রাসাদে মিলিত হয়েছিলেন দেব ও মানবপিতা জিয়াস কর্তৃক অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায়। জিয়াস তখন ভাবছিলেন সেই বীর এজিসথাসের কথা যাকে অ্যাগামেমননপুত্র ওরেস্টেস হত্যা করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। সেই অ্যাজসথাসের কথা মনে ভেবেই জিয়াস বললেন, এটা খুবই দুঃখের কথা যে মানুষ সব সময় তাদের যতসব দুঃখকষ্টের জন্য দেবতাদের দায়ী করে আর তাঁদের উপর দোষারোপ করে অন্যায়ভাবে। আসলে কিন্তু তাদের নিজেদের পাপই তাদের দুঃখকষ্টের জন্য দায়ী। সে দুঃখকষ্টের তীব্রতা নিয়তিনির্ধারিত দুঃখকষ্টের জ্বালা থেকে অনেক বেশি।

অ্যাজিসথাসের কথাটা এখন একবার ভেবে দেখ, অ্যাগামেমননের স্ত্রীর শালীনতা নষ্ট করে এবং তার স্বামীকে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করে নিয়তির বিধান লঙ্ঘন করে। কিন্তু সে এর পরিণাম কি হবে তা জানত। কারণ আমরা তীক্ষ্ণ চক্ষুবিশিষ্ট দৈত্যদানবনিধনকারিণী হার্মিসকে তার কাছে পাঠিয়ে তাকে সাবধান করে দিই সে যেন অ্যাগামেমননকে হত্যা না করে এবং তার স্ত্রীকে ভালবাসতে না যায়। হার্মিস তখন তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, অ্যাগামেননপুত্র ওয়েস্টেস বড় হয়ে তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবেই। ওয়েস্টেস বড় হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং বাড়ি ফিরেই সে তার পিতৃহন্তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। এখন এজিসথাসকে তার কৃত পাপকর্মের উপযুক্ত প্রতিফল ভোগ করতে হলো।

উজ্জ্বল চক্ষুতারকাবিশিষ্ট দেবী এথেন এবার জিয়াসের কথা শেষ হতেই বললেন, সে আমাদের পিতা ক্রোনাসের পুত্র এবং রাজার রাজা, অ্যাজিসথাস পাপের যোগ্য শাস্তিই পেয়েছে। যারাই তার মত এই ধরনের পাপকর্ম করবে তারাই যেন একই ধরনের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হয়। এখন যে হতভাগ্য ওডিসিয়াস তার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর সমুদ্রমধ্যবর্তী এক নির্জন দ্বীপে দুঃসহ জীবন যাপন করছে তার জন্য আমার প্রাণ কাঁদছে। সতত বৃক্ষছায়াসমাচ্ছন্ন সে দ্বীপে এক মায়াবিনী দেবী বাস করে। সে হলো ইস্টদেবতা অ্যাটলাসের কন্যা। এই মায়াবী দেবতা অ্যাটলাস সমুদ্রের গভীরতম অতল প্রদেশে অবস্থান করে। তার স্কন্ধে পৃথিবীর মাঝখানে রয়েছে গেছে এক বিশাল ব্যবধানের সুনীল শূন্যতা। এই মায়াবী দেবতার কন্যাই হতভাগ্য ওডিসিয়াসর অজস্র অশ্রুসজল কাতর আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও তাকে তার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে দিচ্ছে না। সেই মায়াবিনী দেবীর নানারকমের মিথ্যা স্তোকবাক্যের দ্বারা ওডিসিয়াসের মন থেকে ইথাকার স্মৃতি সম্পূর্ণরূপ মুছে দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ওডিসিয়াস এখন তার স্বদেশের দিকচক্রবাল হতে উথিত ধূমরাশি একবার চোখে দেখার জন্য জীবনের যথাসর্বস্ব দান করতে পারে। কিন্তু তা দেখতে না পেরে সে এখন মৃত্যু কামনা করছে ব্যাকুলভাবে। এতকিছু সত্ত্বেও আমরা স্বর্গের দেবতারা নীরব অবিচলিত। বল আমায়, ট্রয়ের রণপ্রান্তরের প্রান্তভাগে গ্রীক রণতরী মাঝে একদিন ওডিসিয়াস যে পূর্জা অর্ঘ্য দান করে তোমার উদ্দেশ্যে তাতে কি তুমি তুপ্ত হও নি? বল পিতা, কেন তার প্রতি এমন বিরূপ তৃমি?

মেঘসঞ্চারকারী দেবতা জিয়াস তখন উত্তর করলেন, তুমি পাগলের মত প্রলাপোক্তি করছ বৎস। ওডিসিয়াসের প্রশংসনীয় কার্যাবলি কেমন করে আমি বিস্মৃত হতে পারি? জীবিত মানবকূলের মধ্যে সে শুধু বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ নয়, দেবতাদের প্রতি পূজা ও উত্সর্গের ব্যাপারেও সে উদার। যে পলিডেমাসকে অন্ধ করে দিয়েছে ওডিসিয়াস সেই পলিডেমাসের জন্যই ভূবেষ্টনকারী দেবতা পসেডন এত রুষ্ট হয়েছেন ওডিসিয়াসের প্রতি। পলিডেমাস শুধু তার জাতির নেতা নয়, ফোরয়কন্যা জলপরী থুজার পুত্র। ফোরয় হল লবণাক্ত সমুদ্রতরঙ্গের প্রহরী। সমুদ্রতলবর্তী এক গভীর গুহার মধ্যে জলপরী থুজার সঙ্গে এক রাত্রি বাস করে তাকে পুত্রসন্তান দান করে পসেডন। তাই পলিডেমাস অন্ধ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওডিসিয়াসকে নির্বাসনদণ্ড দান করেন ভূকম্পনদেবতা পসেডন। অবশ্য তিনি হত্যা করেন নি তাকে।

এখন কাজের কথায় এস, এখন সকলে মিলিত হয়ে এমন একটা উপায় খুঁজে বার করো যাতে নিরাপদে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারে ওডিসি। আমি জানি পসেডন একদিন অবশ্যই নত হবেন। সম্মিলিত দেবতাদের সর্বসম্মত ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুতেই তিনি একা অবিচলিত থাকতে পারবেন না।

এথেন উত্তর করলেন, হে পরম পিতা, রাজার রাজা, বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ওডিসিয়াস ইথাকায় ফিরে যাক এটা যদি স্বর্গের দেবতাদের কাম্য হয় তাহলে এখনই আমাদের দূত হার্মিসকে ওগিজিয়া দ্বীপে পাঠানো উচিত। সে গিয়ে সুন্দরী ক্যালিপসোকে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা বলবে। সে গিয়ে তাকে বলবে তার দীর্ঘদুঃখভোগকারী অতিথি এবার গৃহাভিমুখে রওনা হবে। ইতিমধ্যে আমি নিজে ইথাকায় গিয়ে ওডিসিয়াসের পুত্রের মনে সাহস সঞ্চার করব নতুন করে। সে যেন সাহসে বুক বেঁধে দীর্ঘ কেশবিশিষ্ট সহকর্মীদের এক সভা আহ্বান করে এবং তার মার সেই সব পাষণ্ড পামর প্রাণিপ্রার্থীদের তার মনের কথা জানিয়ে দেয় যারা তার বহু মেষ ও পশুকে অকারণে হত্যা করে। এরপর আমি তাকে পাঠাব স্পার্টা আর বালুকাময় প্রদেশ পাইসে যেখানে সে তার পিতার প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাবে। সেখানে সত্যিই সে তার পিতার কথা শুনতে পাবে এবং তাদের কৃতিত্ব আরও বেড়ে যাবে।

এথেনের কথা শেষ হতেই তিনি তাঁর পায়ের তলায় খাঁটি সোনায় নির্মিত পাদুকাগুলো বেঁধে নিলেন। সীমাহীন জল অথবা স্থলপথে এই পাদুকাই তাঁকে দেয় বাতাসের মত দ্রুত গতি। ব্রোঞ্জনির্মিত তীক্ষ্ণ ফলকবিশিষ্ট একটি বিরাট বর্শা হস্তে ধারণ করলেন। সর্বশক্তিমান দেবরাজের কন্যা এই বর্শার দ্বারা রোষবশবর্তী হলে বড় বড় যোদ্ধাদের ঔদ্ধত্য খর্ব করে দেন। এইভাবে অলিম্পাস পর্বতশিখর হতে মর্ত্যে অবতরণ করলেন তিনি। ইথাকায় উপনীত হয়ে তিনি ওডিসিয়াসের প্রাসাদ ভবনের সম্মুখস্থ অঙ্গনের এক স্থানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন মেন্তেস নামে জনৈক তাফিয়ান সর্দার।

এথেন সেখানে গিয়ে দেখলেন, ওডিসিয়াসপত্নী পেনিলোপের দুর্বিনীত প্রাণিপ্রার্থীরা তাদেরই দ্বারা নিহত পশুর চামড়ার উপর বসে তাস খেলছিল আর সেই সব পাণিপ্রার্থীদের সারথি ও ভৃত্যেরা ব্যস্ত ছিল তাদের নিয়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পানপাত্রে মদের সঙ্গে জল মেশাচ্ছিল, আবার কেউ বা ভোজের টেবিলে মাংস সাজাচ্ছিল।

একমাত্র ওডিসিয়াসপুত্র টেলিমেকাস ছাড়া আর কেউ দেখতে পেল না এথেনকে। টেলিমেকাস তখন সেইসব পাণিপ্রার্থীদের মাঝে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে মর্মাহত চিত্তে বসে ছিল। সে তখন শুধু ভাবছিল কখন তার মহান পিতা দূর সমূদ্র থেকে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হয়ে এইসব দুর্ধর্ষ পাষণ্ডদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তার রাজকীয় সম্মান পুনরুদ্ধার করবেন এবং পূর্বেকার মত সুখে শান্তিতে রাজ্যশাসন করবেন। এইরকম অবস্থার মধ্য থেকে এইসব কথা ভাবাই স্বাভাবিক। এই সব কথা যখন একমনে ভাবছিল টেলিমেকাস তখন সে হঠাৎ প্রাসাদদ্বারে এথেনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সেইদিকে। ভাবল কোন অতিথি যদি দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ তবে সেটা হবে লজ্জার কথা। সোজা অতিথিবেশিনী এথেনের কাছে চলে গেল। তার হাত থেকে বর্শাটি নিয়ে পাশে রেখে দিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাল তাকে।

তাফিয়ান সর্দারবেশিনী এথেনকে সম্বোধন করে টেলিমেকাস বলল, হে ভদ্রে, আসুন, আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করুন। প্রথমে উপযুক্ত পানাহারের দ্বারা তৃপ্ত হবার পর এখানে আপনার আসার কারণ বিবৃত করুন।

এই কথা বলে দেবী প্যালাস এথেনকে পথ দেখিয়ে প্রাসাদ অভ্যন্তরে নিয়ে গেল টেলিমেকাস। প্রাসাদের মধ্যে একটি বিরাট সুপ্রশস্ত কক্ষে এথেনকে নিয়ে গিয়ে টেলিমেকাস তাঁর বর্শাটি তার পিতা যেখানে বর্শা রাখতেন সে জায়গায় রেখে তাঁকে একটি উচ্চ আসনে বসতে দিলেন। পায়ের কাছে দিলেন একটি পাদানি। পাণিপ্রার্থী সেই পামর রাজন্যবর্গের কথাবার্তায় পাছে তার নতুন অতিথি বিরক্ত বোধ করেন এজন্য তাদের কাছ থেকে একটু সরে বসল টেলিমেকাস। তাছাড়া এই নতুন অতিথির কাছে তার পিতার কিছু কুশল জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল সে।

অতঃপর একজন পরিচারিকা একটি বড় স্বর্ণপাত্র করে জল এনে অতিথিকে মুখ হাত ধোবার জন্য দিল। তারপর একটি টেবিল পরিষ্কার করে রুটি ও মাংস সাজিয়ে দিল। তারপর একটি স্বর্ণপাত্রে দিল উত্তম মদ।

এথেনের অদূরে সেই কক্ষের আর এক প্রান্তে পাণিপ্রার্থী রাজন্যবর্গের ভোজনের ব্যবস্থা হয়েছিল। একটি বিরাট ভোজটেবিলের চারদিকে চেয়ারগুলোতে একে একে বসল সেই সব রাজন্যবর্গ। তাদের নিজস্ব সারথি ও ভৃত্যেরা পরিচারিকাদের সহায়তায় প্রচুর পরিমাণ রুটি, মাংস ও নানারকমের উত্তম খাদ্যদ্রব্য থরে থরে সাজিয়ে রাখল টেবিলে। উত্তম মদ পরিবেশন করল স্বর্ণনির্মিত পানপাত্রে। ভোজনপর্বে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য কিছু নৃত্যগীতের ব্যবস্থা হলো। গীতবাদ্য ব্যতীত কোন ভোজসভা সম্পূর্ণতা লাভ করে না। একজন ভৃত্য একটি সুন্দর বীণা এনে চারণকবি ও গায়ক ফেমিয়াসকে দিল। ফেমিয়াস তাতে একটি গান বাজাতে শুরু করতেই টেলিমেকাস এথেনের কানের কাছে মুখটা নিয়ে চুপি চুপি এমনভাবে কথা বলতে লাগল যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়।

টেলিমেকাস এথেনকে বলল, আমি আশা করি, যদি সরলভাবে অকপটে আমি আমার কিছু মনের কথা ব্যক্ত করি তাহলে আপনি কোন অস্বস্তি বোধ করবেন না। আপনি ঐ যে সব রাজন্যবর্গ দেখছেন তারা শুধু নৃত্য আর গীত ছাড়া কিছুই জানে না। ওরা সকলে এমনই একজন লোকের উপর নির্ভর করে এক নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছে। যার দেহের অস্থিমাংস হয়ত কোন দূরদেশস্থ সমাধিগহ্বরে পচনশীল অবস্থায় গলে যাচ্ছে দিনে দিনে অথবা কোন লবণাক্ত সমুদ্রতরঙ্গের দ্বারা তাড়িত হয়ে তা ভেসে যাচ্ছে সীমাহীন অজানার পথে। ইথাকার মাটিতে যদি একবার পদার্পণ করেন এবং এরা কোনরকমে একবার চকিতে তাঁর মুখ দর্শন করে তাহলে পালাবার পথ পাবে না। তবে মনে হয় তার জীবন এক ভয়াবহ পরিণতি লাভ করেছে। কেউ তাঁর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ দান করলে যে আনন্দ আমি পাব তার সঙ্গে কোন আনন্দের তুলনা হয় না। মনে হয় সেদিন আর আসবে না।

যাই হোক, আপনি এবার বলুন আপনি কে এবং কোথা হতে আসছেন। আপনার কোন নগরে জন্মস্থান? আপনার প্রজাবৃন্দ কোন জাতীয় লোক? আপনি নিশ্চয়ই পদব্রজে আসেন নি। তাহলে আপনি কোন অর্ণবপোতে করে এসেছেন? আপনার নাবিকরাই বা কে এবং কি করেই বা তারা আপনাকে এই ইথাকার পথ চিনে নিয়ে এল? আর একটা কথা জানতে চাই, আপনি এর আগে কখনো ইথাকায় এসেছিলেন? আমার পিতা বড় অতিথি বৎসল ছিলেন। তিনি যেমন বহু দেশ পরিভ্রমণ করতেন তেমনি স্বগৃহেও বহু বিদেশীকে আপ্যায়িত করতেন।

উজ্জ্বল চক্ষুতারকাবিশিষ্ট দেবী এথেন উত্তর করলেন, আমি তোমাকে সব বলব। আমার পিতা ছিলেন বিজ্ঞ রাজা অ্যাঙ্কিয়ালাস। আমার নাম হচ্ছে মেন্তেস। আমি হচ্ছি সমুদ্রমধ্যবর্তী কোন দ্বীপের উপজাতি তাফিয়ানদের সর্দার বা দলপতি। ইথাকায় আমার আগমন বৃত্তান্ত যদি শুনতে চাও তাহলে শোন, আমি আমার নিজস্ব অর্ণবপোতে ও নাবিকের সাহায্যেই এখানে এসেছি। এক জাহাজ তামার বিনিময়ে একাজাহাজ ভাল লোহা আমদানি করার মানসে আমরা রওনা হয়েছি বাজারের পথে। আমার জাহাজ এই নগরে নোঙর করে নি, সে জাহাজ আছে নিওন গাছের ছায়ায় ঘেরা রীখ্রনের গ্রাম্য উপকূলে। আর আমাদের বংশের কথা যদি জানতে চাও তাহলে বৃদ্ধ লার্তেসের কাছে যেতে পার। শুনেছি তিনি নাকি তার নগরমধ্যে আসেন না, তিনি থাকেন এক দূর গ্রাম্য খামারবাড়িতে। এক বৃদ্ধা পরিচারিকা তার সেবাযত্ন করে। পাহাড়সংলগ্ন এক বিরাট আঙুর ক্ষেতে পায়চারি করে বেড়ানো ছাড়া তাঁর অন্য কোন কাজ নেই।

এখানে আসার কারণ হলো আমার এই। তবে আমি শুনেছিলাম তোমার পিতা নাকি বাড়ি ফিরেছেন এবং এখানেই আছেন। যদিও তাঁর প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক বাধা সৃষ্টি করছেন দেবতারা, তথাপি আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে ওডিসিয়াস এখনো মৃত্যুমুখে পতিত হন নি। তিনি পৃথিবীর কোন না কোন দেশে জীবিত আছেন এখনো । আমার মনে হয় দূর সমুদ্র মধ্যবর্তী দ্বীপে কোন বন্য অসভ্য উপজাতীয় শত্রুদের হাতে বন্দী অবস্থায় কাল যাপন করছেন তিনি। তারা জোর করে আটকে রেখে দিয়েছে তাঁকে। আমি অবশ্য কোন জ্যোতিষী বা ভবিষ্যদ্বক্তা নই, তবু একটা ভবিষ্যদ্বাণী করব তোমার কাছে এবং সে ভবিষ্যদ্বাণী আমি জানি এক অভ্রান্ত দৈববাণী যা একদিন সত্য হবেই। তোমার পিতা তার এই প্রিয় স্বদেশ হতে আর দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকবেন না। কোন লৌহশৃঙ্খলই বেঁধে রাখতে পারবে না তাকে। তুমি বিশ্বাস কর। ওডিসিয়াস নিজেকে মুক্ত করবেন; কোন না কোন একটা উপায় খুঁজে তিনি অবশ্যই পাবেন।

তবে একটা কথা আমায় বল, তুমি কি সত্য সত্যই ওডিসিয়াসের পুত্র তোমার মাথা আর চোখগুলো সত্যিই তাঁর মত। আমার মত তাকে যে বহুবার দেখেছে একমাত্র সেই বুঝতে পারবে তোমার দেহের সঙ্গে তাঁর দেহের সাদৃশ্য কত নিবিড়। আমি তাকে শেষবার দেখেছি ট্রয়যুদ্ধে রওনা হওয়ার আগে। তারপর হতে তার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি।

টেলিমেকাস উত্তর করল, বন্ধু, আমি এবার সব কথা অকপটে ব্যক্ত করব। আমার মাতা জোর দিয়ে বলেন আমি ওডিসিয়াসের পুত্র। আমি নিজে কিছু বলতে পারি না। যে যত বিজ্ঞই হোক, খুব কম সন্তানই তার নিজের প্রকৃত পিতা কে তা জানতে পারে। হায়, আমি যদি অন্য কোন ভাগ্যবান ব্যক্তির সন্তান হতাম! কিন্তু আপনারা জানেন লোকে যাকে আমার পিতা বলে অভিহিত করে থাকে, তিনি সবচেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি।

উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট দেবী তখন বললেন, যে প্রাসাদে তুমি আর তোমার মা পেনিলোপ বাস করেন সে প্রাসাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং গৌরবহীন। কিন্তু একটা কথা তোমাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। এই ভোজসভার অর্থ কী? এই সব লোক কারা? এ ব্যাপারে তোমার ভূমিকা কি? এটা কি কোন বিবাহের ভোজ? কিন্তু সে যাই হোক, ভোজসভাটি ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না। এই ভোজসভার সদস্যদের অসদাচরণে যে কোন জ্বলোকই বিরক্তিবোধ করবেন।

টেলিমেকাস তখন গম্ভীরভাবে উত্তর করলেন, হে আমার প্রিয় বন্ধু, এ ব্যাপারে অবশ্যই আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন। এমন একদিন ছিল যেদিন আমাদের প্রাসাদ সমৃদ্ধি ও সম্মানে ছিল গৌরবময়। যার কথা আপনি বললেন সেই ওডিসিয়াস যেদিন ছিলেন আমাদের মধ্যে। কিন্তু নিষ্ঠুর দেবতাদের মনে ছিল অন্য বাসনা। তাঁরা যে কষ্ট আমার পিতাকে দান করেছেন সে কষ্ট এর আগে অন্য কোন মানুষ কখনো কোথাও ভোগ করে নি। দেবতাদের চক্রান্তেই আজ নিরুদ্দেশ ও নির্বাসিত তিনি। ট্রয়যুদ্ধের সময় তিনি যখন যুদ্ধ করছিলেন তখন যদি তার শক্তহস্তে পতন ঘটত তাহলে আমার দুঃখের কোন কারণ থাকত না। তাহলে সমস্ত গ্রীকজাতি তাঁর সম্মানার্থে নির্মাণ করত এক অক্ষয় স্মৃতিস্তম্ভ আর তাঁর পুত্রের জন্য রেখে যেতেন এক গৌরবময় নাম যে নামের গৌরব তাঁর উত্তরাধিকারিগণ বংশপরম্পরায় লাভ করে যেত যুগ যুগ ধরে। কিন্তু তার কোন গৌরবময় মৃত্যু হয় নি। মনে হয় শয়তানসুলভ প্রবল প্রভঞ্জন কোথাও উড়িয়ে নিয়ে গেছে তাকে। তিনি আর ইহলোকে নেই এবং শুধু অপরিসীম এক দুঃখ আর অশ্রু ছাড়া আমার জন্য কিছুই রেখে যান নি তিনি।

কিন্তু একমাত্র তাঁর জন্যই যে যত কিছু উদ্বেগ না নয়, দেবতারা আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে আরও অনেক দুঃখের বোঝ। দুলিনিয়াম, সেখ, জাকাইনমাস ও পার্বত্য ইথাকা প্রভৃতি দ্বীপের সর্দারেরা এসে আমার মার প্রতি প্রেম নিবেদন করছে এবং আমার সম্পদ ধ্বংস করছে। যদিও আমার মার পুনর্বিবাহের কোন ইচ্ছা নেই তথাপি তিনি সম্পূর্ণরূপে তাদের প্রত্যাখ্যান করছেন না, আবার তাদের কাউকে গ্রহণও করছেন না। ইতিমধ্যে তারা আমারই অন্ন ধ্বংস করে আমাকেই তাড়াবার চেষ্টা করছে। তারা যদি আমার হত্যা করে বসে তাহলেও সেটা এমন কিছু আশ্চর্যের হবে না।

ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের সঙ্গে প্যালাস এথেন বললেন, সত্যিই লজ্জার কথা। এসময় তোমার পিতার উচিত বাড়ি ফিরে এসে ঐ অসভ্য লোকগুলোর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করা। আমি আমাদের বাসভবনে আগে একবার তাঁকে যেভাবে দেখেছিলাম সেইভাবে অর্থাৎ তাঁর ঢাল, শিরস্ত্রাণ ও বর্শাদ্বয়হস্তে তিনি যদি শুধু একবার তার এই প্রাসাদদ্বারে আবির্ভূত হন তাহলে তাতেই ফল হবে। তিনি তখন মর্মেরাসপুত্র ইনাসের সঙ্গে দেখা করে এফায়ার থেকে এসেছিলেন আমাদের রাজবাড়িতে। তিনি সেখানে সমুদ্রপথে গিয়েছিলেন তাঁর তীরের ফলকে মেশানোর জন্য একপ্রকার মারাত্মক বিষের সন্ধানে। ধর্মভীরু ইনাস সে বিষ তাকে দিতে অস্বীকার করায় তিনি আসেন আমার পিতার সকাশে। আমার পিতা তাকে ভালবাসতেন বলে তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষিত বিষ তাঁকে প্রদান করেন। হা, ওডিসিয়াস যদি একবার সেই বেশে এসে উপস্থিত হতেন এইসব পাণিপ্রার্থীদের সামনে তাহলে কত শীঘ্রই না মৃত্যুর সঙ্গে ওদের হত বিবাহ। কিন্তু এসব ব্যাপার চূড়ান্তভাবে নির্ভর করছে দেবতাদের উপর। তারা সিদ্ধান্ত করবেন তিনি তাঁর প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করে এই সমস্যার সমাধান করবেন কি না।

ইতিমধ্যে আমি তোমাকে অনুরোধ করছি এই পাষণ্ড পাণিপ্রার্থীদের কবল থেকে তোমাদের এই প্রাসাদকে মুক্ত করা যায় কি না, তার একটা উপায় খুঁজে দেখ। আমি যা বলি মন দিয়ে শোন। আগামীকাল সকালে এক ঘোষণার দ্বারা গ্রীক রাজন্যবর্গকে এক সভায় সমবেত করো। দেবতাদের নিকট প্রার্থনা করে তারা যেন এ সভার কার্যবিবরণীর সাক্ষী থাকেন। পাণিপ্রার্থীদের সকলকে তাদের আপন আপন দেশে ফিরে যেতে বল। তামার মাতাকে বল তিনি যদি দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে চান তাহলে তিনি তাঁর পিতৃগৃহে চলে যান। তাঁর পিতা বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনি নিশ্চয় তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করবেন এবং তার কন্যাকে উপযুক্ত যৌতুক দান করবেন।

এবার তুমি কি করবে তা আমার কাছে শোন এবং আমি আশা করি আমার এ পরামর্শ তুমি মেনে চলবে। তুমি একটি সবচেয়ে ভাল জাহাজ বেছে নাও, তাতে কুড়িটি দাঁড় সংযোজিত করো। তারপর সমুদ্রে সেই জাহাজ ভাসিয়ে তোমার পিতা কোথায় গেছেন তার সন্ধান করো। কেউ না কেউ তার সন্ধান বলে দিতে সাহায্য করতে পারেন তোমায়। তাছাড়া স্বর্গলোক থেকে যে সব গুজব প্রচারিত হয় এবং যে সব গুজব প্রায়ই সত্যে পরিণত হয় সেই সব গুজবের কোনোটির সঙ্গে তোমার পিতার সম্পর্ক আছে কিনা তা দেখতে পার। প্রথমে তুমি পাইলসে গিয়ে বিজ্ঞ বিচক্ষণ নেস্টরকে জিজ্ঞাসা করো। তারপর স্পার্টায় গিয়ে লোহিতাভ কেশবিশিষ্ট মেনেলাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করো। গ্রীকদের মধ্যে তিনিই ট্রয়যুদ্ধ হতে সবশেষে প্রত্যাবর্তন করেন। যদি তুমি তাদের কাছ থেকে শোন তোমার পিতা জীবিত আছেন এবং তিনি স্বদেশের পথে রওনা হয়েছেন তাহলে তুমি অন্তত আর একটা বছর ঐ সব পাণিপ্রার্থীদের জন্য আরও কিছু ব্যয়ভার বহন করতে পার। আর যদি শোন তোমার পিতা মৃত তাহলে তৎক্ষণাৎ স্বদেশে ফিরে আসবে। উপযুক্ত অন্ত্যেষ্টিক্রয়ার সঙ্গে তার জন্য এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবে। তারপর কোন এক পাণিপ্রার্থীর সঙ্গে তোমার মার বিবাহ দান করবে। এই সবকাজ হয়ে গেলে তোমাকে ঠিক করতে হবে কিভাবে তুমি সম্মুখযুদ্ধ অথবা কোন চাতুর্যের দ্বারা এই দুবৃত্তদের ধ্বংস করতে পার। তুমি আর শিশু নেই; শিশুসুলভ যতসব দুর্বল চিন্তা ঝেড়ে ফেল মন থেকে; তুমি কি যুবরাজ ওরেস্টেসের নাম শোন নি? ওরেস্টেস নিজে তাঁর পিতৃহন্তা বিশ্বাসঘাতক এজিসথাসকে হত্যা করে। তুমি বেশ দীর্ঘকায় এবং সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছ। তুমিও নিশ্চয় ওরেস্টেসের মত বীর হবে। তুমি যদি তার মত কাজ করতে পার তাহলে ভবিষ্যতের মানুষ অবশ্যই তোমার গুণগান করবে।

কিন্তু আমার নাবিকরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আমার জাহাজে ফিরে যাচ্ছি। আমি এ ব্যাপারটা তোমার হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। আমি যা বলে যাচ্ছি সেকথাটা ভেবে দেখো ভাল করে।

বিজ্ঞ টেলিমেকাস বলল, মহাশয়, আপনি যা কিছু আমায় বলেছেন, তা আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়েই বলেছেন। পিতা তার সন্তানকে যে উপদেশ দান করেন তার মঙ্গলসাধনের জন্য ঠিক সেই উপদেশ আমায় দান করেছেন। আমি জীবনে কোনদিন ভুলব না আপনার কথা। তথাপি আমি আপনাকে আর কিছুক্ষণ বিলম্ব করে স্নান করে সুস্থ হতে অনুরোধ করছি। তারপর সুস্থ দেহে ও মনে আপনি জাহাজে ফিরে যেতে পারেন। যে উপহার মানুষ তার একাধারে অতিথি ও বন্ধুকে দান করে আমি আপনাকেও তেমনি এক সুন্দর উপহার দান করতে চাই। সে উপহার আপনি রেখে দেবেন আমাদের এই বন্ধুত্বের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ।

দেবী এথেন উত্তর করলেন, না,আমি এখনি ফিরে যেতে চাই। আমাকে আর আটক করে রেখো না। যে উপহারের কথা আমার বললে সে উপহার আমি আমার দেশে প্রত্যাবর্তনকালে নিয়ে যেতে চাই তোমার কাছ থেকে। যত ভাল উপহার দিতে চাও দেবে বিনিময়ে যে উপহার তুমি পাবে তাতে তুমি ঠকবে না।

একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রাসাদ অলিন্দসংলগ্ন ক্ষুদ্র ছিদ্রপথে উড়ে যাওয়া পাখির মত অদৃশ্য হয়ে গেলেন দেবী এথেন। কিন্তু টেলিমেকাসের মধ্যে এক অভূতপূর্ব তেজস্বিতা ও সাহসের সঞ্চার করে গেলেন তিনি। আগের থেকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সে তার পিতার প্রতি। তার এই মানসিক রূপান্তরের কথা ভাবতে গিয়ে ভয় পেয়ে গেল টেলিমেকাস, কারণ সে বেশ বুঝতে পারল এতক্ষণ একজন দেবতা এসে কথা বলছিলেন তার সঙ্গে।

যুবরাজ টেলিমেকাস এবার ফিরে গেল সেই ভোজসভায়। সে সেখানে গিয়ে দেখল সেই পাণিপ্রার্থীরা তখন মনোযোগ সহকারে একটি গান শুনছে। সেই কৃতী চারণকবি যেন ট্রয়যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনকারী গ্রীকদের কথা গানের সুরঝঙ্কার সহযোগে ব্যক্ত করছিলেন। দেবী প্যালাস এথেনের মধ্যস্থতায় যে দুঃখ বিপর্যয় তারা সহ্য করেছে তার কথাও বললেন তিনি। সেই সব কথা বুদ্ধিমতী আইকারিয়াসকন্যা তাঁর স্বীয় প্রকোষ্ঠ হতে শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সভাকক্ষে। তবে তিনি একাকী ছিলেন না, তার দুই ধারে দুই বিশ্বস্ত সহচরীকে নিয়ে তাঁর পাণিপ্রার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর অবগুণ্ঠন অপসারিত করে, চারণকবিকে সম্বোধন করে অশ্রুসজল নেত্রে বললেন, হে কৃতী যশস্বী চারণকবি, দেবতা ও মানবের নানাবিধ কৃতিত্বকে ভিত্তি করে যে সব আখ্যানকাব্য ও গীতিকবিতা লিখে থাকেন কবিরা, আপনারা তা গানের আকারে শুনিয়ে প্রীত করেন আমাদের। কিন্তু এ কাহিনী ছাড়া অন্য কোন আখ্যান আমাদের শোনান। আপনি শুধু একজন শ্রোতাকেই সে গান শোনান এবং অন্যান্য দর্শকরা নিশ্চিন্তে মদ পান করুন। কিন্তু এই গান আর গাইবেন না। এ গান বড়ই করুণ এবং এ গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমগ্র অন্তর বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। কারণ এই ট্রয়যুদ্ধ যে বিপর্যয় নিয়ে আসে গ্রীকদের জীবনে তাতে আমার থেকে বেশি গুরুতর আঘাত আর কেউ পায় নি। কারণ আমাকে এখন এমন একজন স্বামীর জন্য শোক প্রকাশ করতে হচ্ছে যিনি ছিলেন পুরুষশ্রেষ্ঠ এবং যার নাম হেলাস থেকে আর্গস পর্যন্ত অনুরণিত হয়ে ফেরে লোকের মুখে মুখে।

কিন্তু টেলিমেকাস তার মাতাকে বাধা দিয়ে বলল, কেন মা তুমি আমাদের অনুগত চারণকবিকে তার ইচ্ছামত গান গাওয়ার পথে বাধা দিচ্ছ? জগতে যে সব ঘটনা ঘটে তার জন্য কবিরা অবশ্যই দায়ী নয়। তার জন্য একমাত্র দায়ী হচ্ছেন দেবরাজ জিয়াস। তিনিই তাঁর ইচ্ছামত পৃথিবীর মানুষকে সুখদুঃখ দান করেন। যাকে যা পাওয়ার যোগ্য বলে মনে ভাবেন তাকে তাই দেন। গ্রীকদের দুর্ভাগ্য ও বিড়ম্বনার সকরুণ সঙ্গীত ফেমিয়াস যদি আমাদের শোনান তাহলে তাকে আমরা দোষ দিতে পারি না তার জন্য, কারণ শ্রোতারা সাধারণত বর্তমানের ঘটনাভিত্তিক গানই শুনতে চায়। তোমার উচিত মনকে শক্ত করে সাহসের সঙ্গে এ গান শোনা। মনে রেখো, ওডিসিয়াসই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি ট্রয়যুদ্ধ শেষে স্বগৃহে ফিরে আসতে পারেন নি। আরও অনেকেকেই প্রাণ হারাতে হয়েছে এ যুদ্ধে। সুতরাং তুমি তোমার স্বীয় প্রকোষ্ঠে ফিরে গিয়ে বয়নকার্যে মন দাওগে এবং ভৃত্যদেরও আপন আপন কার্যে মনোনিবেশ করার জন্য আদেশ দাও। এভাবে কথা বলা তোমার সাজে না, যা কিছু বলার আমি বলব, কারণ বর্তমানে আমি এ বাড়ির মালিক।

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন পেনিলোপ। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর শয়নকক্ষে চলে গেলেন। তবে যে বিচক্ষণতার পরিচয় তাঁর পুত্র দান করেছে তাতে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সহচরীদের সঙ্গে শয়নকক্ষে গিয়ে তাঁর প্রিয়তম স্বামী ওডিসিয়াসের জন নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন পেনিলোপ। এথেনের নির্দেশে নিদ্রা তার চোখে নেমে না আসা পর্যন্ত তিনি অশ্রুপাত করে যেতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে পেনিলোপকে চোখে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ান্ধকার সভাকক্ষে এব উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়ল তাঁর পাণিপ্রার্থীরা। তাদের প্রত্যেকেই আশা করতে লাগল সে অবশ্যই তার অঙ্কশায়িনী করতে পারবে পেনিলোপকে। কিন্তু সেই কামপ্রম উল্লাসকে মাঝপথে থামিয়ে দিলে টেলিমেকাস। সে বলল, ভদ্রমহোদয়গণ, আপনার যারা আমার মাতাকে বিবাহ করতে চান তাদের কাছে এই দুর্বিনীত ব্যবহার প্রত্যাশ করা যায় না। এখন নীরবে ভোজসভার কাজ সম্পন্ন করি। দেবোপম কণ্ঠধন্য এই চারণকবির সঙ্গীত আমাদের এখন উপভোগ করা উচিত। তবে আগামীকাল সকালে আমি এক সভা আহ্বান করে আপনাদের সকলকে জানিয়ে দিতে চাই আপনাদের এ প্রাসাদ ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। হ্যাঁ, আপনাদের এবার থেকে অন্যত্র পানাহার ব ভোজসভার কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আপনারা আপন আপন বাড়ি গিয়ে আপন আহার্যের সংস্থান করুন। কিন্তু যদি আপনারা নিশ্চিন্ত মনে শুধু একজনের অন্ন ও ধনসম্পত্তি ধ্বংস করে যান তাহলে যত খুশি তা করে যান। তবে আমি অমর দেবতাদের নিকট প্রার্থনা করি তারা যে আমাকে অচিরে এমন এক সুদিন দান করেন যেদিন আমার এই প্রাসাদেই ধ্বংস করতে পারি সকলকে।

তারা সকলে বিস্মিত হয়ে গেল এই কথা শুনে। তারা কখনোই ভাবতেই পারে নি একথা বলার ঔদ্ধত্য টেলিমেকাসের কোনদিন হতে পারে। তারা তখন এক অবদমিত আক্রোশে আপন আপন ওষ্ঠ দংশন করতে লাগল। অবশেষে তাদের মধ্যে থেকে অ্যান্টিনোয়াস বলল, আমার মনে হচ্ছে তোমাকে এইরকম উদ্ধতভাবে কথা বলার শিক্ষা দিয়ে দেবতারা তোমাকে সাহায্য করছেন টেলিমেকাস। তোমার পিতার পুত্ররূপে তুমি অবশ্যই এ রাজ্যের উত্তরাধিকারী। কিন্তু ঈশ্বর করুন, তুমি যেন এ রাজ্যের রাজা কোনদিন না হতে পার।

কিন্তু এ কথায় হতবুদ্ধি হলো না টেলিমেকাস। সে উত্তর করল, একথা শুনে আপনারা হয়ত হতাশ হয়ে উঠতে পারেন, আমি সানন্দে দেবরাজ জিয়াসের কাছ থেকে এ রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করব। আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন রাজা হওয়ার মত এতবড় বিড়ম্বনা আর কোন মানুষকে সহ্য করতে হয় না। কিন্তু আমার মনে হয় রাজা হওয়াটা এমন কিছু খারাপ কাজ নয়। তাতে ঐশ্বর্য ও প্রভুত্ব দুটোই বাড়ে যেহেতু মহান ওডিসিয়াস আজ আর জীবিত নেই; তাঁর রাজ্যের উত্তরাধিকারী কেউ না কেউ হবেই। তবে আপাতত আমি আমার বাড়ির মালিক এবং যুদ্ধে আমার পিতার হাতে বন্দীদের প্রভু হতে চাই।

এবার পলিয়াসপুত্র ইউরিমেকাস উত্তর করল, শোন টেলিমেকাস, ইথাকার রাজ্যভার কে গ্রহণ করবে সেটা ঠিক করবেন স্বর্গের দেবতারা। তবে যেকোন প্রকারে তোমার বাড়ির মালিকরূপে তুমি তোমার গৃহসম্পদ অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করো। ইথাকায় তোমাদের প্রজাকূল বর্তমান থাকতে কোন লোক যেন তোমার ন্যায়সঙ্গত অধিকার লাভের পথে কোন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।

তবে হে আমার প্রিয় টেলিমেকাস, যে অতিথি কিছুক্ষণ পূর্বে তোমাদের বাড়িতে এসেছিলেন তার সম্বন্ধে কিছু বল। কোথা হতে তিনি এসেছিলেন? কোন দেশ থেকে তিনি এসেছিলেন? তাঁর জন্মভূমি কোথায়? তিনি কি তোমার পিতার প্রত্যাবর্তন সংবাদ দিতে এসেছিলেন অথবা তিনি তাঁর নিজস্ব কোন প্রয়োজনে এসেছিলেন। তিনি সহসা লাফ দিয়ে এত দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলেন যে আমার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তার সঙ্গে কোন পরিচয় করতে পারলাম না। তবে তাঁর চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল তিনি ভদ্রসন্তান।

বুদ্ধিমান যুবরাজ টেলিমেকাস উত্তর করলো, শুনুন ইউরিমেকাস, একথা নিশ্চিত যে আমার পিতা আর কখনো ফিরে আসবেন না। কেউ একথা বললেও সে গুজবে আমি বিশ্বাস করব না। যেসব সুদক্ষ জ্যোতিষীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আমার মা তাদের ডাকেন আমি তাদের কথার কোন গুরুত্ব দান করি না। আপনি যে অতিথির কথা বললেন তিনি আমার পিতার এক বন্ধুর বন্ধু। তাঁর নাম মেন্তেস; তিনি হলেন অ্যান্টিকিয়ালাসের পুত্র এবং তাফিয়ানদের দলপতি। এইভাবে সেই অতিথির পরিচয় দান করলেন টেলিমেকাস। নিজে ভালভাবেই জানত সে অতিথি আসলে একজন দেবী।

সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই সব পাণিপ্রার্থীরা নৃত্যগীত উপভোগ করল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত তারা মেতে রইল আনন্দে। তারপর আপন আপন শয়নকক্ষে চলে গেল তারা। টেলিমেকাস গেল প্রাসাদ অঙ্গন মধ্যবর্তী এমন এক সুউচ্চ কক্ষে যেখান থেকে প্রাসাদের চারদিকে নিরীক্ষণ করা যায়। ইউরিক্লীয়া নাম্নী এক বিশ্বস্ত পরিচারিকা তাকে মশাল হাতে আলো দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ওপস-এর কন্যা এই ইউরিক্লীয়া যখন বালিকা ছিল তখন টেলিমেকাসের পিতামহ লার্তেস তাকে এই প্রাসাদে আনয়ন করেন। বিশুদ্ধচরিত্র ইউরিক্লীয়াকে বড় শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন লার্তেস। সেই ইউরিক্লীয়া আজ লার্তেসপৌত্র টেলিমেকাসের মশালবাহিকারূপে কাজ করছে, টেলিমেকাসকে নিজের হাতে মানুষ করায় ইউরিক্লীয়া তাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসত।

আপন শয়নকক্ষে প্রবেশ করে দরজা অর্গলবন্ধ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাতে লাগল টেলিমেকাস। দেবী এথেন প্রস্তাবিত সমুদ্রযাত্রা কিভাবে শুরু করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করতে লাগল এক মনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *