২৩. প্যাট্রোক্লাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

ত্রয়োবিংশ পর্ব
প্যাট্রোক্লাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

এইভাবে ট্রয়ের নরনারীরা বিলাপ করছিল এক নিবিড়তম শোকে আকূল হয়ে। গ্রীকসেনারা তখন হেলসপন্ট উপসাগরের সন্নিকটে গিয়ে উপনীত হলো তাদের আপন আপন জাহাজে। অ্যাকেলিস কিন্তু তার মামিডনসেনাদের জাহাজে যেতে দিলেন। তিনি তাদের বললেন, প্যাট্রোক্লাসের দেহটা নিয়ে যথাযখভাবে শোকজ্ঞাপনক্রিয়া সুসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুক্ত করবে না তোমাদের রথাগুলোকে।

অ্যাকেলিসের নেতৃত্বে মার্মিডনসেনারা যখন তিনবার প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে রথে করে প্রদক্ষিণ করল। তখন উজ্জ্বল বর্মগুলো ও সমুদ্রতীরের বালুকারাশি সিক্ত হয়ে উঠল তাদের অবিরল অশ্রুধারায়। প্যাট্রোক্লাসের বক্ষপরে আপন রক্তরঞ্জিত হাতটি রেখে অ্যাকেলিস বললেন, আমি আমার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলিনি বন্ধু। আমি তোমার চিতার কাছে আমার কথামত হেক্টরের মৃতদেহটিকে কুকুর দিয়ে খাওয়াব। তারপর তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য বারোজন ট্রয়যুবককে তোমার চিতার সামনে হত্যা করব।

হেক্টরের ধূলিমলিন বিকৃত দেহটি প্যাট্রোক্লাসের চিতার পাশে আনা হলো। গ্রীকরা এবার বহু বলদ, মেষ, ছাগ ও শূকর কেটে প্রাক-অন্ত্যেষ্টি এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করতে লাগল। তারপর গ্রীকরাজন্যবর্গ রাজা অ্যাগামেমননের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন অ্যাকেলিসকে। কিন্তু শোকে কাতর অ্যাকেলিস যেতে চাইছিলেন না। অবশেষে কোনরকমে অ্যাগামমননের শিবিরে নিয়ে গিয়ে তাঁর রক্তাক্ত হস্ত প্রক্ষালনের জন্য জল গরম করতে দেওয়া হলো। কিন্তু অ্যাকেলিস বললেন, প্যাট্রোক্লাসকে চিতানলে ভস্মীভূত না করা পর্যন্ত আমার জল স্পর্শ করা উচিত হবে না। শবদাহ শেষে তার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও আমার মস্তকমুণ্ড কার্য শেষ করে তবে ক্ষান্ত হব আমি। হে রাজন অ্যাগামেমনন, রাত্রি প্রভাত হবার সঙ্গে সঙ্গে কাষ্ঠ ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভার

সংগ্রহ করে প্যাট্রোক্লাসের শবদাহকার্য সুসম্পন্ন করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা।

ভোজসভার কাজ শেষ হয়ে গেলে গ্রীকরা সকলে আপন আপন জাহাজে চলে গেল নৈশ বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শোকাকুল অ্যাকেলিস সমুদ্রতীরস্থ বেলাভূমিতেই রয়ে গেলেন একাকী।

ট্রয়নগরের উপান্তে হেক্টরকে দীর্ঘদিন ধরে বিতাড়িত করে নিয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভীষণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ার জন্য অচিরেই নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়েন অ্যাকেলিস। গর্জনশীল সমুদ্রতরঙ্গগুলো একের পর এক করে তার পায়ের কাছে এসে পড়ে আর সরে যায়। তাতে কিন্তু কোন ব্যাঘ্যাত ঘটে না তার নিদ্রার গভীরতায়। এমন সময় প্যাট্রোক্লাসের প্রেতাত্মা এসে হাজির হলো ঘুমন্ত অ্যাকেলিসের মনের মাঝে। এসে বলল, আমার কথা না ভেবে আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না করে তুমি ঘুমোচ্ছ অ্যাকেলিস? আমাকে আমার প্রাপ্য চিতাগ্নি দিয়ে দিলেই আমি আর মৃত্যুপুরী থেকে কোনদিন উঠে আসব না। তবে আমার দুর্ভাগ্যের ফলে শুধু আমারই মৃত্যু হলো না, ট্রয়নগরীর মধ্যে তোমার সুনিশ্চিত মৃত্যু আসন্ন হয়ে উঠেছে। তোমার কাছে আমার আর একটা প্রার্থনা আছে অ্যাকেলিস। শৈশবে খেলাচ্ছলে আমি একবার অ্যাম্ফিডেমাসপুত্রকে ঘটনাক্রমে হত্যা করে ফেলায় আমার পিতা মীনোতিয়াস আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই থেকে আমি তোমাদের বাড়িতেই একসঙ্গে তোমার সঙ্গে লালিত পালিত হই। তাই আমার একান্ত অনুরোধ, দ্বৈত হাতল সমন্বিত একই স্বর্ণপূজাগারে তোমার অস্থির সঙ্গে যেমন আমার দেহাস্থি সংরক্ষিত থাকে।

ঘুমের মধ্যেই অ্যাকেলিস উত্তর করলেন-কেন তুমি আমাকে দোষারোপ করছ। বন্ধু? তুমি যা যা বলেছ আমি সব করব। এখন এস আমরা আলিঙ্গন করি পরস্পরকে।

এই বলে প্যাট্রোক্লাসকে আলিঙ্গন করার জন্য হাত বাড়াতেই ঘুম ভেঙে গেল তার। কিন্তু কোথায় দেখতে পেলেন না তিনি। দেখলেন শুধু একচাপ ধোঁয়ার মত একটা বস্তু মিলিয়ে গেল শূন্যে। অ্যাকেলিস তখন লাফিয়ে উঠে খেদোক্তি করে বললেন, মৃত্যুপুরীতে মৃত মানুষদের অনেক প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায় একথা তাহলে সত্য। প্যাট্রোক্লাসের মত অবিকল দেখতে এক প্রেত সারারাত্রি ধরে আমার কাছে এসে অনুযোগ আর অশ্রুপাত করেছে।

পরদিন রাত্রি প্রভাত হতেই আইডোমেনেউসের সারথি মেরিওনস-এর উপর প্যাট্রোক্লাসের শবদাহের জন্য কাষ্ঠ আহরণের ভার দিলেন রাজা অ্যাগামেমনন। বহু কুঠার, দড়ি ও গর্দব নিয়ে মেরিওনাস-এর অধীনে বহু লোক কাষ্ঠ সগ্রহ করতে গেল। তারা আইডা পর্বতসংলগ্ন বিশাল অরণ্যপ্রদেশে বহু ওকগাছ কেটে গর্দবের পিঠে চাপিয়ে দিল। অবশেষে সমুদ্রতীরস্থ একটি জায়গায় এক উচ্চ ঢিবি নির্মাণ করে অ্যাকেলিস সেখানে চিতা সাজাচ্ছিলেন সেখানে প্রচুর কাষ্ঠ সংগ্রহ করে ফিরে এল তারা। তারা কাঠগুলো গর্দবের পিঠ হতে নামিয়ে রাখলে অ্যাকেলিস মার্মিডনসেনাদের রথে অশ্ব সংযোজিত করে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিতার কাছে আনতে বললেন। তাঁর কথামত অশ্বারোহী সেনারা রথে চেপে রথ চালনা করতে লাগল আর সেই সব রথের পিছনে অসংখ্য মার্মিডনসেনা প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি তাদের মাথা হতে কাটা চুল দিয়ে ঢেকে বহন করে নিয়ে যেতে লাগল।

অবশেষে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে বহ্নিমান চিতার পাশে সংস্থাপিত করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকেলিস স্পারকীয়াস নদীর উদ্দেশ্যে তাঁর মস্তকে সংরক্ষিত কেশগুচ্ছ কর্তন করে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের উপর চাপিয়ে দিয়ে বললেন, হে স্পরকীয়াস, বৃথাই আমার পিতা তোমার কাছে শপথ করে বলেছিলেন যদি আমি ট্রয়যুদ্ধ হতে নিরাপদে গৃহে প্রত্যাবর্তন করি তাহলে পঞ্চাশটি গৃহপালিত ছাগের সঙ্গে আমি আমার এই কেশগুচ্ছ উৎসর্গ করব তোমাকে। সুগন্ধি ধূপবাসিত কুঞ্জবনস্থ যে উৎসদেশ হতে তুমি উৎসারিত হয়েছ সেখানেই এই পূজা ও উৎসর্গের কার্য অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু যেহেতু তার সে মনোবাসনা পূর্ণ হলো না, সেইহেতু আমার এই কেশগুচ্ছ দান করছি আমি মৃত্যুপথযাত্রী প্যাট্রোক্লাসকে।

এইভাবে কেশ উৎসর্গ করার পর অ্যাকেলিস অ্যাগামেমননকে বললেন, হে আত্রেউসপুত্র, এবার সূর্য অস্তাচল গমনোখ। এবার গ্রীকসেনাদের শোক পরিহার করে চিতা ত্যাগ করে নৈশভোজন সমাপন করতে বল। শুধু আমরা অর্থাৎ মৃতের কয়েকজন প্রিয় ব্যক্তি থেকে গিয়ে দাহকার্যের দেখাশোনা করব।

অ্যাগামেমননের নির্দেশে গ্রীকসেনারা চলে গেলে অ্যাকেলিস আরো কয়েকজনের সহায়তায় একশো ফুট দৈর্ঘ্য ও একশো ফুট প্রস্থ এক বিরাট সুসজ্জিত চিতার উপর প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি চাপিয়ে কয়েকটি স্কুলদেহী মেষ কেটে তাদের চর্বি ভাল করে মাখিয়ে দিলেন মৃতদেহের গায়ে। তারপর সেই কাটা মেষগুলো চারটি ঘোড়া, দুটি প্যাট্রোক্লাসপালিত কুকুর চিতার উপর ফেলে দিলেন অ্যাকেলিস। তারপর তিনি বারোজন বন্দি ট্রয়যুবককে তরবারির দ্বারা হত্যা করে তাদের মৃতদেহগুলো চাপিয়ে দিলেন জ্বলন্ত চিতার উপর। সর্বশেষে তিনি চিৎকার করে বললেন, বিদায় প্যাট্রোক্লাস, আমার প্রতিশ্রুতি পালন করেছি। বারোজন ট্রয়যুবক তোমার চিতানলে তোমার সঙ্গে সঙ্গে দগ্ধ ও ভস্মীভূত হবে। কিন্তু কোন চিতাগ্নি হেক্টরের মৃতদেহকে গ্রহণ করবে না, সে দেহের মাংস ভক্ষণ করবে কতকগুলো ক্ষুধিত কুকুর।

অ্যাকেলিস একথা বললেও কোন কুকুর এল না মৃত হেক্টরের মাংস ভক্ষণ করার জন্য। কারণ দেবী অ্যাফ্রোদিতে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অ্যাকেলিস যখন সে দেহটিকে রথের পিছনে বেঁধে টেনে নিয়ে আসছিলেন তখন যাতে তার গায়ের মাংস ছিঁড়ে না যায় তার জন্য হেক্টরের মৃতদেহের উপর পবিত্র তেল মাখিয়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া হেক্টরের মৃতদেহটি যাতে সূর্যের তাপে শুকিয়ে না যায় তার জন্য স্বর্গমর্তব্যাপী এক বিশাল ঘনকৃষ্ণ মেঘচ্ছায়ার দ্বারা হেক্টরের মৃতদেহ যেখানে ছিল সেই স্থানটিকে আচ্ছন্ন করে দিলেন ফীবাস অ্যাপোলো।

কিন্তু প্যাট্রোক্লাসের চিতাটি সযত্নে সজ্জিত করে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হলেও সে চিতা জ্বলল না। তখন বোরিয়াস ও জেফাইরাস নামে দুটি বায়ুপ্রবাহের কাছে মদের অঞ্জলি দান করে আরো অনেক অর্ঘ্য দান করার শপথ করে প্রার্থনা করলেন অ্যাকেলিস, চিতার আগুনটি যেন তারা জ্বালিয়ে দেন। তাঁর এই প্রার্থনা শুনে আইরিসের দয়া হলো এবং তিনি জেফাইরাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলেন তার সঙ্গে। তখন বোরিয়াসও সেখানে ছিলেন এক ভোজসভায় অংশগ্রহণ করার জন্য। আইরিস গিয়ে বললেন, আমি এখন ওসিয়ানাসের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে ইথিওপিয়া যাব। কিন্তু অ্যাকেলিস অনেক পশুবলির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রার্থনা করছে তোমাদের কাছে, তোমরা যেন প্যাট্রোক্লাসের চিতার আগুনটা জ্বালিয়ে দাও।

আইরিসের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ বোরিয়াস ও জেফাইরাস এক বিরাট চিৎকার করে ছুটে যেতে লাগলেন সমুদ্রপথে। আকাশের মেঘরাশিকে বিদীর্ণ করে সমুদ্রের বুকে অসংখ্য তরঙ্গমালা উৎক্ষিপ্ত করে অবশেষে প্যাট্রোক্লাসের চিতার কাছে গিয়ে প্রবলভাবে প্রজ্জ্বলিত করে তুললেন সে চিতার আগুনকে। সারারাত্রি ধরে জ্বলতে লাগল সে চিতার আগুন। সেই প্রজ্জ্বলিত চিতাগ্নিতে ঘুরে ঘুরে বার বার অ্যাকেলিস এক পাত্র করে মদ দিয়ে প্যাট্রোক্লাসের মৃত আত্মাকে আহ্বান করে মাটিতে ফেলে দিতে লাগলেন সেই মদ।

রাত্রি শেষে ক্লান্ত ও অবসন্ন দেহে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন অ্যাকেলিস। মৃতদেহ ভস্মীভূত করে বায়ুপ্রবাহ দুটি চলে গেল। সকাল হতে রাজা অ্যাগামেমনন তাঁর লোকজনসহ এসে জাগিয়ে তুললেন অ্যাকেলিসকে। অ্যাকেলিস তখন উঠে বললেন, হে আত্রেউসপুত্র, তোমরা প্রথমে লাল মদ ঢেলে চিতার আগুনটিকে ভাল করে নির্বাপিত করো। তারপর চিতার মাঝখান থেকে প্যাট্রোক্লাসের অস্থিগুলো সংগ্রহ করো। একটি স্বর্ণপাত্রে সেগুলো সযত্নে রেখে দেব। আমার মৃত্যু দিন পর্যন্ত সেগুলো সংরক্ষিত থাকবে। আমার মৃত্যু হলে যে সব গ্রীকবীর অবশিষ্ট থাকবেন তারা যেন আমাদের দুজনের দেহাস্থি একটি পাত্রে রেখে এক স্থানে সমাহিত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।

অ্যাকেলিসের কথামত গ্রীকসেনারা প্যাট্রোক্লাসের চিতা থেকে তার দেহাস্থি সংগ্রহ করে একটি স্বর্ণপাত্রে রেখে লিনেনের একখণ্ড বস্ত্র দিয়ে তার মুখটি ঢেকে দিল। তারপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উপযুক্ত একটি স্থান নির্বাচিত করে সেটি উঁচু করে বাঁধিয়ে রাখল। অ্যাকেলিস জাহাজ থেকে তাঁর প্রাপ্ত পারিতোষিকগুলোকে নিয়ে এলেন। যুদ্ধে পুনরাবতীর্ণ হবার জন্য রাজা অ্যাগামেমনন তাঁকে যা যা উপহার দিয়েছিলেন তা সবই নিয়ে এলেন তিনি।

রথ প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার হিসেবে দেবার জন্য ঠিক করে রাখলেন এক কলাকুশলীনী নারী আর ত্রিপদবিশিষ্ট একটি গামলা। দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর জন্য ঠিক করলেন একটি ঘোটকী। তৃতীয় স্থানাধিকারীর জন্য রাখলেন একটি নতুন গামলা। চতুর্থের জন্য দুটি স্বর্ণমুদ্রা আর পঞ্চম পুরস্কার হিসেবে ঠিক করে রেখে দিলেন দুটি হাতলবিশিষ্ট একটি নতুন পাত্র। পুরস্কার গুলো সাজিয়ে রাখার পর অ্যাকেলিস গ্রীকদের সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, হে আত্রেউসপুত্র ও অন্যান্য গ্রীকসেনানীবৃন্দ, আসন্ন রথ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের জন্য আমি এই সব পুরস্কারগুলো ঠিক করে রাখলাম। অন্য সময় হলে পসেডন প্রদত্ত আশ্চর্য দ্রুতগামী অশ্বের সাহায্যে আমি এ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জয় করে নিয়ে যেতাম। কিন্তু বর্তমানে আমি এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব না, আমার যে অশ্বগুলোকে তাদের সারথি নির্মল জলে স্নান করাত ও কেশরে তেল মাখাত সেই অশ্বগুলো তাদের সারথির জন্য কাঁদছে।

অ্যাকেলিসের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমেন্টাসপুত্র ইউমেনাস উঠে দাঁড়ালেন প্রথমে। পরাহত ঈনিসকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালাবার সময় টাইডেউসপুত্র ডায়োমিডিস যে অশ্বগুলো নিয়ে আসেন সেই অশ্বগুলো রথে সংযোজিত করে প্রস্তুত হলেন রথ প্রতিযোগিতার জন্য। তারপর মেনেলাস তাঁর নিজের অশ্ব ছাড়া অ্যাগামেমননের ঘোটকী এথি ও তাঁর নিজস্ব অশ্ব পোদারগাসের সঙ্গে সংযুক্ত করলেন একিপোলাস এই এথি নাম্নী ঘোটকীকে অ্যাগামেমননের হাতে দান করে ট্রয়যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে থাকার অনুমতি পান। এরপর চতুর্থ প্রতিযোগী হিসেবে এগিয়ে এলেন অ্যান্টিলোকাস। তিনি রথে অশ্ব সংযোজিত করলে তাঁর পিতা নেস্টর কাছে এসে উপদেশ দিলেন, অ্যান্টিলোকাস, তুমি বয়সে তরুণ হলেও পসেডন ও জিয়াসের অনুগ্রহে হয়ে উঠেছ একজন সুদক্ষ অশ্বারোহী। কিন্তু অশ্বচালনায় তুমি সুনিপুণ হলেও তোমার অশ্বগুলো মন্দগতি। সুতরাং তুমি যদি কোন কৌশল অবলম্বন না করো তাহলে পুরস্কারলাভের সব সুযোগ বেরিয়ে যাবে তোমার হাত থেকে। ঐ দেখ, দূরে একটি মরা ওক অথবা পাইনগাছ রয়েছে। গাছটির দুধারে রয়েছে দুটি বড় সাদা পাথর। মনে হয় ওটি অতীতে এক সমাধিস্তম্ভ অথবা পথের দূরত্বসূচক মাইলস্তম্ভ ছিল। এই গাছটিকেই রথ প্রতিযোগিতার লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছেন অ্যাকেলিস। ওখান থেকেই রথগুলো ফিরে আসবে। তুমি তোমার রথে করে দ্রুতবেগে ওখানে গিয়ে দক্ষিণ দিকের অশ্বটির রশিটিকে যথাসম্ভব আলগা করে নিয়ে বাম অশ্বটির রশিটিকে শক্ত করে ধরবে। তুমি তখন রথের বাম দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুমি যদি সর্বপ্রথম এ ভগ্ন স্তম্ভটিকে ঘুরে আসতে পার তাহলে আর কেউ তোমার নাগাল পাবে না। আর তুমি যখন আদ্ৰেস্তান ও লাওমীডনের অশ্ব দুটি পেয়েছ তখন তা পারবেই বা না কেন।

নেস্টরের উপদেশ দান শেষ হয়ে গেলে পঞ্চম প্রতিযোগী হিসেবে মেরিওনস প্রস্তুত হলো। প্রতিযোগিতা শুরু হবার পর অ্যাকেলিস প্রতিযোগীদের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখলেন পাঁচজনের মধ্যে অ্যান্টিলোক প্রথম দাঁড়াবে, তারপর ইউমেনাস এবং সবশেষে ডায়োমেডিস। এইভাবে সারিবদ্ধভাবে সকলে দাঁড়ালে ফোনিক্সকে পরিদর্শক নিযুক্ত করলেন অ্যাকেলিস।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগীরা ঘোড়াকে চাবুক মেরে বল্পা ধারণ করে চিৎকার করে উৎসাহিত করতে লাগল আপন আপন রথাশ্বগুলোকে। ঘূর্ণিবায়ুর আকারে ধূলিরাশির মেঘ উড়িয়ে গ্রীক রণতরীগুলোর সন্নিকটস্থ স্থান হতে তীরবেগে প্রান্তরাভিমুখে ধাবিত হলো অশ্বগুলো। বিজয়াভিলাষী সারথিগণ যখন আপন আপন রথে স্পন্দিত বক্ষে দাঁড়িয়েছিল তখন মনে হচ্ছিল তাদের রথগুলো নে বাতাসে উড়ে চলেছে মৃত্তিকা ছেড়ে।

শেষের দিকে ইউমেনাসের রথটি এগিয়ে গেল সবার আগে। তার পিছনে ছিল ডায়োমেডিস-এর রথ। অ্যাপোলোর চক্রান্তে ডায়োমেডিস-এর হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলেও এথেন তাঁর অশ্বগুলোর মধ্যে এমন এক শক্তির সঞ্চার করলেন যাতে শেষ পর্যন্ত সবার রথকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল ডায়োমেডিস-এর রথ। তার পিছনে এগিয়ে গেল মেনেলাসের রথ।

তা দেখে নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকাস তার অশ্বগুলোকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, সে আমার প্রিয় অশ্বগণ, আমি তোমাদের টাইডেউসপুত্রের রথকে ছাড়িয়ে যেতে বলছি, কারণ তিনি দেবী এথেনের অনুগ্রহভাজন। কিন্তু তোমরা আত্রেউসপুত মেনেলাসকে ছাড়িয়ে যাও, তা না হলে স্ত্রী অশ্ব এথি তোমাদের বিদ্রূপ করবে। তোমাদের অবহেলার জন্য যদি পুরস্কার লাভে আমি অসমর্থ হই তাহলে নেস্টর তোমাদের দুজনকেই তরবারির দ্বারা হত্যা করবে। সুতরাং যথাসম্ভব বর্ধিত করো তোমাদের গতিবেগ।

অ্যান্টিলোকাসের ভর্ৎসনা শুনে তার অশ্বগুলো কিছুটা এগিয়ে গেল। অ্যান্টিলোকাস সহসা দেখল তার সামনে পথটি সংকীর্ণ এবং শীতকালীন বৃষ্টিহেতু গর্ত হয়ে গেছে সে পথ। মিনেলাস যখন দেখলেন অ্যান্টিলোকাস তাকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে তখন বললেন, অ্যান্টিলোকাস এখানে পথ সঙ্কীর্ণ, কেন তুমি আমাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করছ? তুমি মরিয়া হয়ে হঠকারীর মত রথ চালনা করছ। একটু পরেই পথটি যেখানে প্রশস্ত হবে সেখানে আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। আমার রথে ধাক্কা লাগলে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হবে।

তথাপি অ্যান্টিলোকাস তার অশ্বদুটিকে চাবুক মেরে তার রথের গতি বাড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ দুটি রথ পাশাপাশি চলার পর অ্যান্টিলোকাসের রথটি এগিয়ে গেল। মেনেলাসের ঘোটকী পিছিয়ে পড়লে মেনেলাস ভর্ৎসনার সুরে অ্যান্টিলোকাসকে বললেন, তোমার মত এতবড় প্রতারক আর মানবকূলের মধ্যে দ্বিতীয় নেই। যারা তোমায় বুদ্ধিমান বলে তারা ভুল বলে। ঠিক আছে, দেখি কি করে তুমি পুরস্কার লাভ করে নিয়ে যাও।

তারপর মেনেলাস তার অশ্বদের সম্বোধন করে বললেন, তোমরা তোমাদের গতি কোনমতে শ্লথ করো না। তোমাদের প্রতিযোগী অশ্বগুলো তোমাদের মত বয়সে তরুণ নয়।

তাদের প্রভুর উৎসাহব্যঞ্জক বাক্য শুনে অশ্বগুলো তাদের গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। ইতিমধ্যে গ্রীক দর্শকরাও সকলে দাঁড়িয়ে দেখছিল কিভাবে প্রতিযোগী রথাশ্বগুলো ধূলিরাশির এক বিরাট মেঘ তুলে তীরবেগে ছুটে চলেছিল লক্ষ্যের পথে। আইডোমেনেউস অন্যান্য গ্রীকদের বলল, তোমরা দেখ প্রতিযোগী রথগুলোর মধ্যে একটিতে কোন সারথি নেই, মনে হয় সেই রথের সারথি পড়ে গেছে। তার রথটি ভেঙ্গে গেছে আর সে সারথি হলো টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস।

অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স রূঢ়ভাবে বলল, এত তাড়াতাড়ি একথা বলা তোমার উচিত হয়নি আইডোমেনেউস। তোমার বয়স এমন কিছু কম নয়। প্রতিযোগিতার কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই একথা বলা বিধিবিরুদ্ধ কাজ। এখন ইউমেনাসের রথ আছে সবচেয়ে এগিয়ে।

ক্রীটাধিপতি আইডোমেনেউস বলল, অ্যাজাক্স তুমি বড় রূঢ়ভাষী, তোমার কোন বিচারবুদ্ধি নেই, আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমনন ঠিক করবে কোন রথের অশ্বগুলো প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স ক্রুদ্ধভাবে আরও রূঢ় উত্তর দান করতে যাচ্ছিল কিন্তু তাদের দুজনকে লক্ষ্য করে অ্যাকেলিস বললেন, অ্যাজাক্স ও আইডোমেনেউস, তোমাদের পারস্পরিক বাদ-প্রতিবাদ ও নিন্দাবাদ থামাও। লোকে দেখলে তোমাদের নিন্দা করবে। প্রতিযোগী রথগুলো এখনি লক্ষ্য ছুঁয়ে এদিকে এসে পড়বে। তখন স্বচক্ষে দেখতে পাবে কার অশ্ব প্রথম স্থান অধিকার করল।

অ্যাকেলিসের কথা শেষ হতে না হতেই ডায়োমেডিস-এর রথ সর্বাগ্রে এসে উপনীত হলো। মনে হলো ঝড়ের বেগে এল তাঁর রথটি। রথ থেকে অবতরণ করে অশ্বগুলো বিযুক্ত করলেন ডায়োমেডিস। তারপর প্রথম স্থানাধিকারী হিসেবে যেসব পুরস্কার ও রমণী লাভ করলেন তা তার লোকজনদের দিয়ে তাঁর শিবিরে পাঠিয়ে দিলেন। ডায়োমেডিস-এর পরে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করল নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকাস। তার অশ্বের দ্রুতগামিতার পরিবর্তে এক সুচতুর কৌশল অবলম্বন করে মেনেলাসকে পরাস্ত করে তার রথকে ছাড়িয়ে যায়। মেনেলাসের পর আসে মেরিনাস, আর সব শেষে এল অ্যাডমেন্টাসপুত্র। অ্যাকেলিস তাকে বললেন, যার সবচেয়ে আগে আসার কথা সে এল সবার শেষে। তাকে দ্বিতীয় পুরস্কার দেওয়া হবে। আর টাইডেউসপুত্র পাবেন প্রথম পুরস্কার।

অন্যান্য গ্রীকরা অ্যাকেলিসের প্রস্তাব উল্লাসভারে সমর্থন করলে অ্যান্টিলোকাস প্রতিবাদ করল উঠে দাঁড়িয়ে। বলল, অ্যাকেলিস, ইউমেনাসের রথ ভেঙ্গে যায় এবং সে পিছনে পড়ে যায়। কিন্তু আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা সত্ত্বেও আমাকে যদি আমার পুরস্কার হতে বঞ্চিত করো তাহলে অতীব দুঃখিত হব আমি। তুমি যদি তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে চাও তাহলে তোমার শিবির হতে কিছু সোনা ও মূল্যবান ধাতু তাকে উপহার দাও।

অ্যাকেলিস তখন সন্তুষ্টচিত্তে বললেন, অ্যান্টিলোকাস, যদি ইউমেনাসকে কোন উপহার দিই তাহলে টিনদ্বারা আচ্ছাদিত আমার ব্রোঞ্জের বক্ষাবরণী তাকে দান করব। এটি আমি এস্টারোপীয়দের কাছ থেকে পেয়েছিলাম এবং তার কাছে এটি অর্থের থেকেও মূল্যবান।

এই বলে অ্যাকেলিস তাঁর অন্যতম সহকর্মী অটোডীমনকে সেই বক্ষাবরণীটি তাঁর শিবির থেকে এনে ইউমেনাসকে দান করতে বললেন। কিন্তু মেনেলাস তখন রেগে গিয়ে বললেন, অ্যান্টিলোকাস, তোমার মত এমন নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের মানুষের পক্ষে এ কাজ করা উচিত হয় নি। তোমার অশ্বগুলো আমার থেকে নিকৃষ্ট হলেও তুমি প্রতারণার দ্বারা আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছ। সুতরাং হে গ্রীক রাজন্যবর্গ, আপনারা যথার্থ বিচার করুন, কারো প্রতি অহেতুক অনুগ্রহ প্রদর্শন করবেন না যাতে অন্য কেউ বলতে না পারে মেনেলাস মিথ্যা কথা বলেছে। সুতরাং সে অ্যান্টিলোকাস, তুমি আমাদের প্রথানুসারে এখানে এসে চাবুক হাতে তোমার অশ্বটিকে ছুঁয়ে ভূকম্পনদেবতা পসেডনের নামে শপথ করে বল তুমি কোনভাবে আমার বিরোধিতা করেছ কি না।

অ্যান্টিলোকাস তখন উত্তর করলেন, আমাকে ক্ষমা করুন রাজা মেনেলাস, আমি আপনার থেকে বয়সে তরুণ এবং আপনি জানেন তরুণদের সহজেই মতিভ্রম হয়। তারা বিচারবুদ্ধিহীন এবং হঠকারী। দেবতাদের নামে মিথ্যা শপথ না করে আমি যে ঘোটকীকে পুরস্কার হিসেবে লাভ করেছি তা স্বেচ্ছায় আমি আপনাকে ছেড়ে দেব।

নেস্টরপুত্র মেনেলাসকে ঘোটকীটি দেবার সঙ্গে সঙ্গে মেনেলাসের সমস্ত ক্রোধ প্রশমিত হলো। শিশিরস্নাত পরিণত শস্যক্ষেত্রের মত আনন্দিত হলেন মেনেলাস। মেনেলাস বললেন, অ্যান্টিলোকাস, তোমার উপর আমি ক্রুদ্ধ হলেও তোমার কথা আমি মেনে নেব। আমি আমার ঘোটকীকে তোমাকেই দিয়ে দেব। লোকে দেখুক আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ নই।

চতুর্থস্থান অধিকারী মেরিনাস দুটি স্বর্ণমুত্রা নিয়ে গেল এবং পঞ্চম পুরস্কার নেবার কেউ না থাকায় সে পুরস্কার অ্যাকেলিস নেস্টরকে দান করে বললেন, সে আমার প্রিয় বন্ধু, প্যাট্রোক্লোসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ এই উপহার গ্রহণ করুন। আপনি এখন বৃদ্ধ। কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। সুতরাং এটি গ্রহণ করুন।

এই দান গ্রহণ করে নেস্টর বললেন, তুমি যা বললে তা সব সত্য। এপিয়ার লোকেরা যখন সুপ্রাসিয়ামে তাদের রাজা আমরাইনসিয়াসকে সমাহিত করার সময় আমাকে উপহার দেয় তার পুত্ররা, তখন আমি যুবক ছিলাম। তখন পাইনিয়া ও ইটোলিয়ার অধিবাসীদের কোন লোক আমাকে কোন প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করতে পারে নি।

তখন পেলেউসপুত্র সবকিছু শুনে বক্সিং প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কার হিসেবে একটি গর্দভ আর একটি দ্বিমুখী পানপাত্র আনলেন। তারপর তিনি সকলকে বললেন, হে আত্রেউসপুত্র এ অন্যান্য গ্রীকবীরেরা, আমার ইচ্ছা দুজন প্রতিযোগী বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুন। সে প্রতিযোগিতার জয়ী হবে সে এই গর্দভ পাবে আর সে পরাস্ত হবে সে এই দ্বিমুখী পানপাত্রটি পাবে।

অ্যাকেলিসের কথা শুনে একজন বলিষ্ঠদেহী প্রতিযোগী এসে উপস্থিত হলো সকলের সামনে। সে হলো প্যানেসিয়াবাসী এপিয়াস। সে বলল, আমি জয়লাভ করবই এবং এই গর্দভ পুরস্কার হিসেবে পাবই। আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে অবতীর্ণ হবে আমি তার দেহ ক্ষতবিক্ষত করবই। সুতরাং তার মৃতদেহটি বয়ে নিয়ে যাবার জন্য তার বন্ধুরা যেন উপস্থিত থাকে এখানে।

এপিয়াসের কথা শুনে মেসিসতিয়ানসপুত্র ইউরিয়ানাস উঠে এসে দাঁড়াল। এই ইউরিয়ানাস একবার রাজা ঈডিপাসের মৃত্যুতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করার জন্য থবস নগরীতে গিয়ে সেখানে অন্যান্য প্রতিযোগীদের পরাস্ত করে প্রথম পুরস্কার লাভ করে। ডায়োমেডিস সমর্থন করলেন ইউরিয়ানাসকে। বক্সিং প্রতিযোগিতা শুরু হতেই এপিয়াস এমন এক ঘুষি মারল ইউরিয়ানাসের চোয়ালে যার ফলে জল থেকে নদীতীরে মাছ লাফিয়ে পড়ার মত লাফিয়ে উঠল ইউরিয়ানাস। তারপর বসে পড়ল। রক্ত ঝরে পড়তে লাগল তার মুখ থেকে, মুখটা ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। ফলে দ্বিমুখী পানপাত্রটি লাভ করল এপিয়াস।

এরপর শুরু হলো তৃতীয় অন্ত্যেষ্টিকিয়া প্রতিযোগিতা-মল্লযুদ্ধ। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী বীর লাভ করবে ত্রিপদবিশিষ্ট একটি কাষ্ঠাধার আর কলাকুশলিনী গুণবতী এক রমণী। অ্যাকেলিস প্রতিযোগীদের আহ্বান করে বললেন, যারা যোগদান করবে চলে এস।

একথায় দুজন মল্লবীর উঠে এলেন। তাঁরা হলেন তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স ও ওডিসিয়াস। তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘর্ম নিঃসৃত হতে লাগল তাদের দেহ থেকে। কিন্তু কেউ কাউকে আঘাত করতে পারলেন না। কেউ কাউকে পরাস্ত করতে পারলেন না। অবশেষে অ্যাজাক্স ওডিসিয়াসকে বললেন, হে মহান লার্তেসপুত্র, হয় তুমি আমাকে উত্তোলিত করো অথবা তোমাকে উত্তোলন করার আমাকে সুযোগ দাও।

এই বলে অ্যাজাক্স ওডিসিয়াসকে তুলে নিতেই ওডিসিয়াস তাঁকে কৌশলে এমনভাব তার জানুতে আঘাত করলেন যাতে মাটিতে পড়ে গেলেন অ্যাজাক্স আর তার বুকের উপর পড়লেন ওডিসিয়াস। এবার ওডিসিয়াস অ্যাজাক্সকে তুলে ফেললেন, কিন্তু বেশি উপরে ওঠাতে পারলেন না; অ্যাজাক্সকে নিয়ে পড়ে গেলেন। আবার তৃতীয়বারের জন্য তারা তৈরি হতেই অ্যাকেলিস বাধা দিয়ে বললেন, আর আপনাদের লড়াই করতে হবে না। আপনারা দুজনেই জয়ী হয়েছেন, দুজনেই সমান পুরস্কারে পুরস্কৃত হবেন।

এরপর দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য অ্যাকেলিস নিয়ে এলেন খাঁটি রৌপ্যনির্মিত এক পানপাত্র। সিডনের কোন শিল্পীর দ্বারা নির্মিত এই সুন্দর পানপাত্রটি ফিনিসীয়রা সমুদ্রপারের কোন দ্বীপ থেকে এসে থোয়াসকে দান করে। প্রিয়ামপুত্র লাইকাওনের মুক্তির জন্য জেসনপুত্র ইউনিয়াস প্যাট্রোক্লাসকে উপঢৌকন দেয়। দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে একটি স্বর্ণমুদ্রার অর্ধাংশ নিয়ে আসেন অ্যাকেলিস। অ্যাকেলিস বললেন, যারা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে তারা চলে এস।

অ্যাকেলিসের কথা শুনে অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স, ওডিসিয়াস ও নেস্টরপুত্র দ্রুতগামী যুবক অ্যান্টিলোকাস উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অ্যাকেলিস তাদের লক্ষ্যদণ্ডটি দেখিয়ে দিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। প্রথমে এগিয়ে গেলেন অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স, তার পিছনে ছিলেন ওডিসিয়াস। এমন সময় ওডিসিয়াস দেবী এথেনের কাছে আরও দ্রুতগতির জন্য প্রার্থনা করলে এথেন তাঁর পাগুলোকে অনেক লঘু করে দিলেন আর তার বিতৃষ্ণাবশত অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্সের পা দুটি গোময়লিপ্ত হওয়ায় পিছনে পড়ে গেল সে। ফলে ওডিসিয়াস প্রথম পুরস্কার আর অ্যাজাক্স দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করলেন। অ্যান্টিলোকাস তৃতীয় পুরস্কার লাভ করে বলল, দেবতারা বয়োপ্রবীণদের যথার্থ সম্মানে ভূষিত করেছেন। অ্যাজাক্স আমার থেকে বয়সে প্রবীণ এবং ওডিসিয়াস তার থেকেও প্রবীণ হলেও তিনি এখনো সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান এবং দ্রুতগামিতায় একমাত্র অ্যাকেলিস ছাড়া আর কেউ তাঁর সমকক্ষ নন।

এ কথায় সন্তুষ্ট হয়ে অ্যাকেলিস অ্যান্টিলোকাসকে আর একটি অর্ধ-স্বর্ণমুদ্রা দান করলেন এবং অ্যান্টিলোকাস তা সানন্দে গ্রহণ করল। দৌড় প্রতিযোগিতা এইভাবে শেষ হবার পর অ্যাকেলিস সার্পেডনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া প্যাট্রোক্লাসের বর্শা, শিরস্ত্রাণ ও ঢালগুলো নিয়ে এসে বললেন, দুজন বীর বর্ম পরিধান করে অস্ত্র নিয়ে চলে আসুন। যে জন পর জনের বর্ম ভেদ করে তার দেহে আঘাত করে রক্ত বার করতে পারতেন তিনি এই রৌপ্যখচিত থ্রেসীয় তরবারিটি লাভ করবেন। এই বর্মটি তাঁরা দুজনেই পাবেন এবং বিজয়ীবীরকে শিবিরে ভোজসভায় আপ্যায়িত করব।

অ্যাকেলিসের কথা শেষ হতে হতে তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স ও টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস বর্ম পরিধান করে এগিয়ে এলেন। বীরত্বে দুজনই সমকক্ষ হওয়ায় তিন তিনবার চেষ্টা করেও কেউ কাউকে আঘাত হানতে পারল না। কেউ কারো রক্ত আকর্ষণ করতে পারল না। কিন্তু ডায়োমেডিস যেভাবে অ্যাজাক্সের ঘাড়টি লক্ষ্য করে বর্শা চালনা করছিল তাতে শঙ্কিত গ্রীকরা যুদ্ধ থামাতে বলল এবং অ্যাকেলিস ডায়োমেডিসকেই প্রথম পুরস্কার দান করলেন।

এরপর শুরু হলো ভারী বস্তু উত্তোলন প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার জন্য অ্যাকেলিস একটি ভারী লোহা নিয়ে এসে বললেন, যে এই বস্তুটিকে যত দূরে ফেলতে পারবে সেই এটিকে লাভ করবে। এর মধ্যে যা লোহা আছে তাতে তার পাঁচ বছর চলে যাবে। অ্যাকেলিসের কথা শুনে চারজন অংশগ্রহণ করলে সে প্রতিযোগিতায়। তারা হলেন, পলিপোটেস, লিওটিয়াস, তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স ও এপিয়াস। কিন্তু সব শেষে যোগদান করে পলিপোটেস লৌহটিকে সবচেয়ে বেশি দূরে ছুঁড়ে ফেলে প্রথম পুরস্কার অর্জন করলেন।

তারপর শুরু হলো শরক্ষেপণ প্রতিযোগিতা। অ্যাকেলিস একটি জাহাজের মাস্তুলের উপর একটি পায়রাকে পায়ে সুতো দিয়ে বেঁধে রেখে বললেন, যে ব্যক্তি ঐ পায়রাটিকে তীর দ্বারা বিদ্ধ করতে পারবে সে দুইদিক ধারাল দশটি এবং একদিন ধারাল দশটি কুঠার পাবে। আর যে ব্যক্তি শুধু সুতোটাকে কাটতে পারবে তীর দিয়ে কিন্তু পাখিটিকে আঘাত করবে না সে শুধু একদিক ধারাল কুঠার লাভ করবে। এই প্রতিযোগিতায় টিউসার ও মেরিনাস যোগদান করলেন।

রাজা টিওসার ধনুর্বিদ্যায় সর্বাপেক্ষা পারদর্শী হলেও তিনি প্রথমে তীরন্দাজ দেবতা অ্যাপোলোর প্রার্থনা করে ও তাকে অর্ঘ্যদানের প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার জন্য কেবলমাত্র সুতোটাকে তীর দিয়ে কেটে ফেলতে পারলেন। কিন্তু পায়রাটি উড়ে গেল অক্ষত অবস্থায়। অতঃপর মেরিওনস অ্যাপোলোর আশীর্বাদ লাভ করে ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডীয়মান পায়রাটিকে তীরবিদ্ধ করে জাহাজের উপর ফেলে দিলেন।

এরপর অ্যাকেলিস বর্শাক্ষেপণ প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কারস্বরূপ একটি বর্শা ও একটি নতুন গামলা নিয়ে এলেন। এ প্রতিযোগিতায় যোগদান করলেন রাজা অ্যাগামেমনন আর মেরিওনস। কিন্তু অ্যাকেলিস বললেন, হে আত্রেউসপুত্র, আমরা জানি আপনি বর্শাক্ষেপণে অদ্বিতীয়, সুতরাং আপনি এই গামলাটি গ্রহণ করুন এবং আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি এই বর্শাটি মেরিওনসকে দান করব।

রাজা অ্যাগামেমনন তাতে সম্মত হওয়ায় তাঁর বর্শাটি মেরিওনসকে দান করলেন অ্যাকেলিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *