২২. হেক্টরের মৃত্যু

দ্বাবিংশ পর্ব
হেক্টরের মৃত্যু

ভীরু পলাতক মৃগশিশুর মত ট্রয়বাসীরা নগরমধ্যে প্রবেশ করে ক্লান্ত দেহগ্রাত্র হতে ঘর্মবিন্দুগুলো অপনোদন করল। প্রাণভরে জলপান করে তৃষ্ণা নিবারণ করল। তারপর দুর্গপ্রাকার মধ্যস্থিত নিরাপদ আশ্রয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করতে লাগল তৃপ্তি সহকারে। এদিকে নগর প্রাচীরের বাইরে স্কন্ধে ঢাল নিয়ে সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গ্রীকসেনারা। কিন্তু কঠোর নিয়তির নিষ্ঠুর বিধানে হেক্টর যেখানে ছিলেন সেখানেই রয়ে গেলেন। ইলিয়াম নগরীর মধ্যে প্রবেশ না করে বাইরে স্কীয়াম তোরণদ্বারেরর সামনে আগের মতই দাঁড়িয়ে রইলেন।

ওদিকে এজিনররূপী অ্যাপোলোর তখনো পশ্চাদ্ধাবন করে বেড়াচ্ছিলেন অ্যাকেলিস। পথে প্রান্তরে নদীতীরে ক্রমাগত অ্যাকেলিসকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ানোর পর অবশেষে অ্যাপোলো বললেন, হে পেলেউসপুত্র, কেন একজন মানুষ হয়ে একজন দেবতাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ? তুমি কি কখনো বুঝতে পার নি যে তুমি একজন দেবতার পিছনে ছুটে চলেছ? অথচ ট্রয়বাসীরা সকলে নগরমধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং তাদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছ। কিন্তু যেহেতু আমি একজন অমর দেবতা, তুমি আমাকে কখনই হত্যা করতে পারবে না।

অ্যাকেলিস তখন ক্রুদ্ধ হয়ে উত্তর করলেন, সমস্ত দেবতার মধ্যে তুমি সবচেয়ে হিংসাপরায়ণ। তুমি আমাকে প্রতারিত করে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছ। তা না হলে ইতিমধ্যে আরো অনেক ট্রয়বাসী নগরমধ্যে প্রবেশ করার আগেই প্রাণ হারাত। তবে আমার যতদূর শক্তি আমিও প্রতিশোধ নেব এর। ট্রয়বাসীদের রক্ষা করে আমাকে যে জয়ের গৌরব থেকে বঞ্চিত করেছ আমি তা অর্জন করবই।

রথচালনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী রথাশ্বের মত তার স্নায়ুকে চরমভাবে নিয়োজিত করে নগরপথে ছুটে যেতে লাগলেন অ্যাকেলিস। এইভাবে অ্যাকেলিসকে যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে প্রথম দেখলেন রাজা প্রিয়াম। শীতকালে ফসল ওঠার সময় যে নক্ষত্রের কিরণ সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং যার কিরণ অশুভ লক্ষণের এক জ্বলন্ত প্রতীক, সেই ওরিয়ন নক্ষত্রের মত তেজোদ্দীপ্ত বর্ম পরিধান করে এক অগ্রসারী বিক্রমের আগ্নেয় প্রচণ্ডতার সঙ্গে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রধাবিত হতে লাগলেন অ্যাকেলিস। তাঁকে সেভাবে অগ্রসর হতে দেখে রাজা প্রিয়াম মস্তকে করাঘাত করতে করতে চিৎকার করে তাঁর প্রিয় পুত্র হেক্টরকে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু অ্যাকেলিসের সঙ্গে যুদ্ধ করার এক অসমসাহসিক ঔদ্ধত্যে জমাট বেঁধে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন হেক্টর। হেক্টরের কাছে গিয়ে বৃদ্ধ প্রিয়াম বলতে লাগলেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না, তাদের প্রিয় ওই ভয়ঙ্কর লোকটি তোমার থেকে বেশি শক্তিমান এবং ওর সঙ্গে তুমি একা যুদ্ধ করতে যেও না। ও আমার অনেক বীর পুত্রকে হত্যা করেছে অথবা সমুদ্রপারের কোন সুদূরতম দ্বীপে বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমানে আমি আমার রাণী লাওমীর গর্ভজাত লাইকাওন ও পলিডোরাস নামে দুজন পুত্রকে খুঁজে পাচ্ছি না। ও যেদিন ভূতলশায়ী হবে এবং ওর দেহটা যেদিন কুকুর শকুনিরা ছিঁড়ে খাবে সেইদিন আমার বুক থেকে এই ভারী দুঃখের বোঝাটা অপসারিত হবে। আমার এই দুজন পুত্র যদি আজও বেঁচে থাকে তাহলে প্রচুর সোনার উপঢৌকন দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনব, আর যদি মৃত্যুপুরীতে গমন করে থাকে তাহলে তাদের পিতামাতাদের দুঃখ অনেক বেড়ে যাবে। তবে তুমি যদি অ্যাকেলিসের হাতে নিহত না হও তাহলে অন্যান্য পুত্রদের মৃত্যুশোক দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে আমার মনে। সুতরাং চলে এস, হে আমার প্রিয় ট্রয়রমণী ও শিশুদের পরিত্রাতা। তুমি না এলে তোমার জীবন হারাবে এবং পেলেউসপুত্রকে এক বিরাট জয়ের গৌরব অর্জনে সহায়তা করবে তার দ্বারা। যার মধ্যে শেষ জীবনের কিছু অবশিষ্টাংশ আজও বিরাজ করছে তোমার সেই বৃদ্ধ পিতার উপর দয়া করো। ক্রোনাসপুত্র জিয়াসের ইচ্ছানুসারে তোমার পিতা বার্ধক্য জর্জরিত অবস্থাতেই লাভ করবে ভয়ঙ্কর এক শোচনীয় মৃত্যু। সে মৃত্যুর আগে আমার চোখের সামনে আমার পুত্রেরা হবে নিহত, আমরা কন্যারা শক্তহস্তে নিগৃহীত হবে বন্দিনীরূপে, আমার স্বর্ণবাসর হবে কলুষিত, আমার পুত্রবধুরা অপহৃত হবে নিষ্ঠুর গ্রীকদের দ্বারা, কঠিন ভূমিপরে নিষ্পেষিত হবে তাদের শিশুদের দেহ। পরিশেষে কোন শত্রুসৈন্যের বর্শা অথবা তরবারির আঘাতে আমার প্রাণপাখি দেহপিঞ্জর হতে বিতাড়িত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমারই নগরদ্বারে আমারই খাদ্যে পুষ্ট শিকারী কুকুরেরা ছিঁড়ে খাবে আমার মৃতদেহটিকে। কোন যুবক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করলে তার দেহটি যদি এভাবে নিগৃহীত হয় তাহলে এমন কিছু অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে না তার মধ্যে। কিন্তু যদি কোন বৃদ্ধ এমনি শোচনীয়ভাবে নিহত ও নিগৃহীত হয়, যদি তার পক্ককেশ ও শ্মশ্রুমণ্ডিত মস্তক ও দেহের গোপনাঙ্গটিকে প্রকাশে ছিঁড়ে খায় পশুতে তাহলে তার থেকে সকরুণ দৃশ্য আর কিছুই হতে পারে না।

কথা বলতে বলতে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন প্রিয়াম। তবু তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না হেক্টর। তারা মাতাও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, যদি আমি তোমায় কোনদিন আবার বক্ষ হতে স্তনদুগ্ধ দান করে তোমার তৃপ্তকরে থাকি তাহলে তার কথা স্মরণ করো আমার উপর। তুমি নগরপ্রাচীরের মধ্যে চলে এসে ওই ভয়ঙ্কর আক্রমণকারীর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো। ও যদি তোমায় হত্যা করে তাহলে তোমার বহু যৌতুকাবহ স্ত্রী ও আমি তোমার মৃতদেহটিকে নিয়ে শোক করতে পারব না, কারণ সে দেহটিকে গ্রীকজাহাজে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাদের কুকুরেরা ছিঁড়ে খাবে।

এইভাবে বৃদ্ধ রাজা-রাণী অনেক অশ্রুপাত করে অনকে অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না হেক্টর। বিষকুম্ভ কোন ভয়ঙ্কর সর্প যেমন এক অন্ধ হিংস্রতায় উন্মত্ত হয়ে কোন মানবের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে তার পার্বত্য গুহার আঁধারে, হেক্টরও তেমনি এক অপরিসীম প্রতিহিংসায় মত্ত ও স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন অ্যাকেলিসের প্রতীক্ষায়।

আপন মনের বলতে লাগলেন হেক্টর, হায়, আজ যদি আমি নগরমধ্যে প্রবেশ করি তাহলে পলিডেমাস আমাকে বিদ্রূপ করবে। কারণ সেই ভয়াবহ রাত্রিতেই দীর্ঘ যুদ্ধবিরতির পর অ্যাকেলিস যখন আমাদের বিরুদ্ধে পুনরাবতীর্ণ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে, পলিডেমাসই তখন ট্রয়সেনাদের নগর মধ্যে প্রবেশ করতে দেওয়ার আদেশদানের জন্য পরামর্শ দেয় আমাকে। কিন্তু তার সে পরামর্শ তখন আমি শুনি নি। শুনলে ভালই হত। আমার নির্বুদ্ধিতার ফলেই এত ট্রয়বাসী প্রাণ হারানোর ফলে কোন ট্রয়বাসীর মুখের সামনে গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারছি না। ভাবছি যে হয়ত আমার মুখের সামনে বলবে, হেক্টর তার আত্মবিশ্বাসের আতিশয্যবশত আমাদের প্রিয়জনদের ধ্বংস ডেকে এনেছে।

সুতরাং আমি যদি অ্যাকেলিসের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করি অথবা তার হাতে নিহত হই তাহলে আমার সে মৃত্যু হবে গৌরবময়। আর আমি যদি আমার ঢাল, শিরস্ত্রাণ ও বর্শা নামিয়ে রেখে অ্যাকেলিসের কাছে নিরস্ত্র অবস্থায় যাই তাহলেই বা ক্ষতি কি? যদি আমি তার কাছে গিয়ে হেলেন ও তার সঙ্গে আনীত সমস্ত ধনসম্পদ প্রত্যার্পণের প্রতিশ্রুতি দিই তাকে, তাহলে বা ক্ষতি কি? এবং তার সঙ্গে যদি ট্রয়নগরীর সমস্ত ধনসম্পদের অর্ধাংশ দান করি? কিন্তু একথা কেন ভাবছি আমি? নিরস্ত্র অবস্থায় তার কাছে গেলে অসহায় নারীর মত সে আমাকে হত্যা করবে, কোন দয়া-মায়া দেখাবে না। তার থেকে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে জানা ভাল কে জয়ী হবে আমাদের মধ্যে।

এইভাবে দাঁড়িয়ে যখন আপন মনে চিন্তা করছিলেন হেক্টর, অ্যাকেলিস তখন সাক্ষাৎ রণদেবতা অ্যারেসের ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন তাঁর কাছে। অ্যাকেলিস এবার একটি বর্শা নিক্ষেপ করতেই উদীয়মান সূর্যরশ্মি বা জ্বলন্ত অগ্নিসদৃশ তেজে মণ্ডিত হয়ে সে বর্শা তীরবেগে এগিয়ে যেতে লাগল হেক্টরের দিকে। তা দেখে ভীত হয়ে পালিয়ে গেলেন হেক্টর আর পর্বতবাসী এক বাজপাখির মত শিকার সংকল্পে দৃঢ় হয়ে তাঁর পশ্চাতে ধাবমান হলেন অ্যাকেলিস।

এইভাবে ধাবিত হতে হতে তাঁরা স্কামান্দার নদীর ধীরে যেখানে দুটি প্রস্রবণ এসে মিলিত হয়েছে নদীবক্ষে সেখানে উপনীত হলেন। একটি প্রস্রবণের জল উষ্ণ এবং তার থেকে নিয়ত বাষ্প নির্গত হয়ে ধুম্রসদৃশ কুহেলিজালে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল স্থানটিকে। অন্য প্রস্রবণটির জল আবার তুষারের মত শীতল। এই সব প্রস্রবণে তাদের বস্ত্র ধৌত করতে আসত ট্রয়রমণীরা যুদ্ধের আগে। সেখানেও থামলে না তারা। কোন মৃতদেহের সম্মানার্থে অনুষ্ঠিত ক্রীড়ায় অংশগ্রহণকারী জীগিন্ধ দুই প্রতিযোগীর মত ছুটতে লাগলেন দুইজনেই।

তাঁদের দেখে জিয়াস দেবতাদের বললেন, যে হেক্টর আমাকে বহুবার আইডা পর্বতে ও ট্রয়নগরীতে আমার উদ্দেশ্যে পশুবলি দিয়েছে তার প্রতি স্বভাবতই করুণা অনুভব করছি আমি। এখন অ্যাকেলিস তাকে ট্রয়প্রাচীরের বাইরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তোমরা এখন স্থির করে তাকে অ্যাকেলিসের কবল থেকে রক্ষা করবে কিনা।

এথেন তখন বললেন, হে বিদ্যুৎ, মেঘ ও বাত্যাধিপতি পরম পিতা জিয়াস, কী বলতে চাও তুমি? যার মৃত্যু বহু আগেই বিধিনির্দিষ্ট হয়ে আছে তাকে কেন বাঁচাতে চাও তুমি?

জিয়াস উত্তর করলেন, আমি গুরুত্বহীনভাবেই একথা বলেছি। যা ভাল বোঝ করো। আমি কোন বাধা দেব না।

অলিম্পাস হতে তীরবেগে যখন নেমে গেলেন এথেন, অ্যাকেলিস তখন মৃগশিশুর পশ্চাতে ধাবমান শিকারি কুকুরের মত ছুটে চলেছিলেন হেক্টরের পশ্চাতে। এমন সময় স্বর্গলোকে দেবরাজ জিয়াস জয়-পরাজয়ের দাঁড়িপাল্লায় মানদণ্ডটি সমানভাবে ধরে দেখলেন হেক্টরের ভাগ্য মৃত্যুপুরীর দিকে অর্থাৎ নিচের দিকে ঝুঁকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফীবাস অ্যাপোলো হেক্টরকে ত্যাগ করে চলে গেলেন আর এথেন অ্যাকেলিসের কাছে এসে বললেন, হেক্টরের রণ-পিপাসা চিরতরে নিবৃত্ত করে এক বিরাট জয়ের বস্তুকে অবশ্যই নিয়ে যাবে গ্রীকরণতরীতে। হেক্টরের আর পরিত্রাণ নেই। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে একটু হাঁপ ছাড়, ইত্যবসরে আমি হেক্টরের কাছে গিয়ে তাকে থামতে বলি।

এথেনের কথামত সেখানে তাঁর বর্শার উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অ্যাকেলিস। এথেন তখন হেক্টরের কাছে গিয়ে দীফোবাসের রূপ ধারণ করে তার কণ্ঠে বললেন, হে আমার প্রিয়তম ভ্রাতা, এতক্ষণ তুমি অ্যাকেলিসের দ্বারা তাড়িত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলে, এবার দাঁড়াও, তাকে আসতে দাও।

হেক্টর উত্তর করলেন, প্রিয়াম ও হেকুবাপুত্র হে দীফোবাস, সব ভাইদের থেকে তুমিই আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়। তোমার প্রতি আমার সে ভ্রাতৃপ্রেম আরও বেড়ে যাবে আজ থেকে, অন্য সকলে যখন নগরমধ্যে গিয়ে বিশ্রাম করছে, তখন একমাত্র তুমিই ছুটে এসেছ আমার কাছে।

এথেন বললেন, আমার পিতামাতা আমাকে সেখানে থাকতেই বলেছিলেন কিন্তু তোমাকে দেখে বেদনার্ত হৃদয়ে ছুটে আসি আমি। সুতরাং এখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব আমরা দুজনে।

এইভাবে তাঁর চাতুর্যের দ্বারা হেক্টরকে উত্তেজিত করতে লাগলেন এথেন। অ্যাকেলিস তাঁর কাছে এলে তাঁকে হেক্টর বললেন, এর আগে তিন তিনবার আমি তোমার সম্মুখীন না হয়ে পালিয়ে গিয়ে ট্রয়নগরীকে প্রদক্ষিণ করেছি, কিন্তু আর পালাব না। এখন হয় তোমাকে হত্যা করব অথবা তোমার দ্বারা আমি নিহত হব। তবে এস আমরা এক প্রতিজ্ঞাবদ্ধনে আবদ্ধ হই। জিয়াসের কৃপায় যদি আমি তোমাকে হত্যা করতে সমর্থ হই তাহলে তোমার বর্ম খুলে নিয়ে কোনরূপ অসম্মান না করে তোমার মৃতদেহ অর্পণ করব আমি গ্রীকদের হাতে।

কিন্তু তাঁর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর করলেন অ্যাকেলিস, নির্বোধ তুমি, মানুষ ও সিংহ, নেকড়ে ও মেষ দ্বারা পরস্পরকে ঘৃণার চোখে দেখে তাদের মধ্যে কোন চুক্তি হতে পারে না। আমাদের দুজনের মধ্যে তেমনি কোন চুক্তি বা বোঝাঁপড়া হতে পারে না। সুতরাং শক্তি সংহত করে এগিয়ে এসে বীরত্বের পরিচয় দাও। আমার বর্শার মাধ্যমে এথেনই তোমাকে পরাজিত করবেন। তুমি আমার সহকর্মীকে হত্যা করে যে দুঃখ আমার প্রাণে দিয়েছ তার জন্য তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।

একথা বলতে বলতে বর্শাটি একবার সঞ্চালন করে নিক্ষেপ করলেন অ্যাকেলিস হেক্টরের প্রতি। কিন্তু হেক্টর তা দেখতে পেয়ে সরে যেতে সে বর্শা তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হেক্টর তখন অ্যাকেলিসকে বললেন, তোমার লক্ষ্য ব্যর্থ হলো অ্যাকেলিস, তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি আমার শক্তি হরণের উদ্দেশ্যে বলছিলে আমার মৃত্যুর দিন আগত। কিন্তু তুমি তার কিছুই জান না। এবার আমি তোমার সামনে দাঁড়াচ্ছি, আবার বর্শা নিক্ষেপ করো, তারপর তোমার শক্তি থাকে তো আমার বর্শার আঘাত সহ্য করো। তোমার মৃত্যু ঘটতেই এ যুদ্ধের আমার জয় হবে অতীব এক সহজসাধ্য ব্যাপার।

একথা বলতে বলতেই বর্শাটি একবার সঞ্চালন করে অ্যাকেলিসের প্রতি নিক্ষেপ করলেন হেক্টর। হেক্টর নিক্ষিপ্ত সে বর্শা একেবারে ব্যর্থ হলো না, কারণ তা অ্যাকেলিসের ঢালের মধ্যভাগে লাগল। কিন্তু তা প্রতিহত হয়ে ফিরে এল, ঢালটিকে বিদ্ধ করতে পারল না। হেক্টরের নিকট দ্বিতীয় বর্শা না থাকায় ভীত হয়ে উঠলেন তিনি। চিৎকার করে দীফোবাসকে ডেকে তার কাছ থেকে একটি বর্শা চাইলেন। কিন্তু দীফোবাসের কোন চিহ্নই নেই কোথাও। তখন তিনি আসল তথ্য জানতে পেরে আপন মনে বললেন, হায়, দেবতারা ধ্বংসের পথে মন্ত্রমুগ্ধ করে নিয়ে চলেছেন। আমি ভেবেছিলাম দীফোবাস এসেছে আমার কাছে। কিন্তু তার বেশেই এথেনই প্রতারিত করেছে আমাকে। আগে আমাকে জিয়াস ও অ্যাপোলো রক্ষা করলেও আজ এটাই হয়ত তাদের ইচ্ছা। যাই হোক, আজ আমার মৃত্যু আসন্ন হলেও বিনা যুদ্ধে কোন অগৌরবের গ্লানি নিয়ে মরব না। মৃত্যুর আগে আমি এমন এক কৃতিত্ব প্রদর্শন করব যার কথা অনন্তকাল ধরে কথিত হবে মানুষের মুখে মুখে।

একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কোন মেষ বা খরগোসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ঈগল পাখির মত মুক্ত তরবারি হস্তে অ্যাকেলিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন হেক্টর। তাঁর বুকের সামনে আশ্চর্য সেই ঢালটি ধরে অ্যাকেলিসও তীরবেগে এগিয়ে গেলেন তার দিকে। চারটি ধাতব স্তর দিয়ে নির্মিত শিরস্ত্রাণটি তাঁর মাথায় কাঁপছিল। তাঁর গতিবেগের তালে তালে আর যে সব সোনালী চুল দিয়ে মণ্ডিত ছিল শিরস্ত্রাণটি সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল তার চারিপাশে। স্তব্ধ অন্ধকার রাত্রিতে কিরণদানরত সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল সন্ধ্যাতারকার মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল অ্যাকেলিসের হস্তদ্বারা সঞ্চালিত বর্শাটি। হেক্টরের মৃত্যুচিন্তা তখন একান্তভাবে আচ্ছন্ন করে ছিল তাঁর মনকে। হেক্টরের সর্বাঙ্গ বর্মদ্বারা আবৃত থাকায় অ্যাকেলিস খুঁজে দেখতে লাগলেন তার দেহের কোথাও কোন অনাবৃত অংশ আছে কি না। অবশেষে হেক্টরের ঘাড়ের কাছটি অনাবৃত দেখে কৌশলে সেইখানে তাঁর বর্শাফলকটি বসিয়ে দিলেন। কিন্তু সে আঘাতে হেক্টর মাটিতে পড়ে গেলেও তার কণ্ঠনালীটি ছিন্ন হয়নি তখনো। তাই তিনি কথা বলতে পারছিলেন। অ্যাকেলিস তখন তাঁকে বিদ্রূপ করে বলতে লাগলেন, হেক্টর, আমি তখন প্যাট্রোক্লাসের সঙ্গে না থাকায় তুমি ভেবেছিলেন তাকে হত্যা করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাবে। কিন্তু নির্বোধ, আমি তার শক্তিমান সহকর্মী, এতদিন জাহাজে ছিলাম। আর এসে ধরাশায়ী করলাম তোমাকে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে প্যাট্রোক্লাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করবে গ্রীকরা। কিন্তু তোমার দেহটাকে ছিঁড়ে খাবে পথকুকুর আর শকুনিতে।

হেক্টরের জীবনদীপ তখন নির্বাপিত হয়ে আসছিল। তবু তিনি বললেন, আমি নতজানু হয়ে তোমার পিতা-মাতার নামে প্রার্থনা করছি, গ্রীকজাহাজে আমার দেহটিকে নিয়ে গিয়ে কুকুরদের দ্বারা খাইয়ো না, বহু ধনরত্নের বিনিময়ে আমার দেহটিকে আমার রাজভবনে পাঠিয়ে দিও যাতে ট্রয়বাসীরা যথাযথভাবে আমার মৃত্যুর পর আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।

আগুন ঝরে পড়ছিল যেন অ্যাকেলিসের চোখ থেকে। তিনি বললেন, কুকুর কোথাকার, নতজানু হওয়া বা আমার পিতা-মাতার কথা আর বলবি না। তুই আমার যা ক্ষতি করছিস, তার জন্য আমি যদি তোর দেহের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে পারতাম তাহলে শান্ত হত আমার মন। তোর পিতা দার্দাসপুত্র প্রিয়াম যদি তোর প্রস্তাবিত ধনরত্নের কুড়ি গুণ দেয় অথবা তোর গোটা দেহটা ওজন করে সমপরিমাণ সোনা আমায় দান করেন তাহলেও আমি ছাড়ব না, তোর দেহটাকে কুকুর ও শকুনি দিয়েই। খাওয়াবই।

হেক্টরের কথা শেষ হতেই তাঁর দেহ ছেড়ে তার আত্মা চলে গেল মৃত্যুপুরীতে। হেক্টর তার দুর্ভাগ্যবশত তাঁর জীবনযৌবন আর ভোগ করতে পারলেন না, এই খেদ বুকে নিয়ে অকালে বিদায় নিল তাঁর আত্মা। তাঁর মৃহদেহটিকে উদ্দেশ্য করে অ্যাকেলিস তখন বললেন, আমার ভাগ্যে জিয়াস ও অন্যান্য দেবতার ইচ্ছায় তা ঘটে ঘটুক, তুমি এখন মরো।

এই কথা বলেই হেক্টরের দেহ থেকে বর্শাটি বার করে সেটি পাশে নামিয়ে রেখে বর্মটি খুলে নিলেন। ইতিমধ্যে অন্যান্য গ্রীকসেনারা হেক্টরের পতন দেখে তাঁর অমিত শক্তি ও সৌন্দর্যসম্পন্ন আশ্চর্য দেহটি চাক্ষুষ করার জন্য ছুটে এল। এরা পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, জীবিত হেক্টর ছিল কত ভয়াবহ, অথচ এখন দেখ কত নির্জীব। এই কথা বলে প্রত্যেকেই তাদের বর্শা দিয়ে নতুন করে আঘাত করতে লাগল হেক্টরের মৃতদেহটাকে।

এবার অ্যাকেলিস গ্রীকসেনাদের বললেন, বন্ধুগণ, যেহেতু আমরা আমাদের সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক শত্রুকে হত্যা করেছি, এখন স্থির করো ট্রয়নগরী আক্রমণ করে ট্রয়বাসীদের মনোভাব জানবে কি না। আমাদের জানতে হবে তারা আমাদের নগর ত্যাগ করে পালিয়ে যাবে না হেক্টরের পতন ঘটলেও তারা আমাদের প্রতিরোধ করবে নগর রক্ষার জন্য। কিন্তু প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে এসব কথা আমার চিন্তা করা অন্যায়। সাধারণত মানুষ মৃত ব্যক্তিদের প্রতি কর্মাকর্মের কথা সব ভুলে যায়। আমি কিন্তু প্যাট্রোক্লাসের কথা মৃত্যুপুরীতে গিয়েও ভুলতে পারব না। হেক্টরকে ট্রয়বাসীরা দেবতার মত পূজা করে, তাকে হত্যা করে আমরা এক বিরলতম বিজয়গৌরব অর্জন করেছি। সুতরাং বিজয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে চল আমরা আপাতত জাহাজে ফিরে যাই।

এই বলে হেক্টরের মৃতদেহটিকে তার রথের পিছনে বেঁধে ফেললেন অ্যাকেলিস। হেক্টরের পা দুটি রথের উপর দিকে বেঁধে মাথাটিকে মাটিতে ফেলে রাখলেন। রথ চলতে শুরু করলে ধূলিমলিন ও কালো হয়ে উঠল হেক্টরের অপূর্বসুন্দর মুখমণ্ডল। তাঁর মাথার চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

হেক্টরের মৃতদেহের প্রতি এই শোচনীয় অপমানের দৃশ্য দেখে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন তাঁর মাতা। তার বৃদ্ধ পিতা এবং সকরুণ আর্তনাদে ফেটে পড়ে নগরবাসীদের বলতে লাগলেন, বন্ধুগণ, তোমরা আমাকে দয়া করে একবার গ্রীকজাহাজে যেতে দাও। আমি সেই নিষ্ঠুর লোকটিকে একবার অনুরোধ করব। তার পিতাও আমার মতই বৃদ্ধ। দেখি আমার মত একজন বৃদ্ধের অনুভূতিকে সে শ্রদ্ধা করে কি না। হায়, সে যদি আমাদের কোলে শৈশবে প্রাণত্যাগ করত, তাহলে অন্তত তার মৃতদেহ নিয়ে আমরা শোক প্রকাশ করতে পারতাম।

এইভাবে যখন শোকে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন প্রিয়াম তখন ট্রয়বাসীরাও অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল তাঁর সঙ্গে। রাণী হেকুবা আর্তনাদ করে বলতে লাগলেন, হায় পুত্র, আর আমার পুত্রগর্বে গর্বিত হবার মত কিছুই রইল না। সারা ট্রয়নগরীর মধ্যে তুমি ছিলে এক বিরাট শক্তির স্তম্ভ, এই ভেবে অহির্নিশ গর্ব ও গৌরব বোধ করতাম আমি। ট্রয়ের নরনারী দেবতাজ্ঞানে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করত তোমায়। যতদিন জীবিত ছিলে, তুমি ছিলে তাদের গর্বের বস্তু। কিন্তু আজ মৃত্যু তোমার অকালে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাদের কাছ থেকে।

হেক্টরের স্ত্রী অ্যান্ড্রোমেক তখনো পর্যন্ত হেক্টরের মৃত্যু সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না, কারণ তাঁকে হেক্টর যে নগরদ্বারের বাইরে ছিলেন একথা কেউ বলে নি। তিনি তখন অন্তঃপুরের একটি ঘরে বসে পুষ্পখচিত এক সূচিশিল্পের কাজ করছিলেন। সেই কাজের ফাঁকেই একসময় তিনি তাঁর দাসীদের হেক্টরের স্নানের জন্য জল গরম করতে বললেন। কিন্তু হেক্টর যে ইহজগতে নেই, অ্যাকেলিসের অস্ত্রের মাধ্যমে দেবী এথেন তাঁকে বধ করেছেন তার কিছুই জানতেন না তিনি। এমন সময় নগরপ্রাচীরের সন্নিকটস্থ স্থান হতে এক করুণ ক্রন্দনধ্বনি শুনে তিনি তাঁর সহচরীদের বললেন, আমার মনে হচ্ছে আমি আমার স্বামীর মাননীয় মাতার ক্রন্দন শুনতে পাচ্ছি। আমার অন্তরাত্মা বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে মুখে, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে আসছে, আমি চলতে পারছি না। কোন-না-কোন প্রিয়ামপুত্র নিশ্চয় কোন বিপদের কবলে পড়েছেন অথবা অ্যাকেলিস হয়ত রণপ্রান্তরের মধ্যে হেক্টরের একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। হেক্টরের বড় দোষ সে দলবদ্ধভাবে থাকে না কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে; সে একাকী সম্মুখ সারিতে এগিয়ে গিয়ে সম্মুখীন হয় শত্ৰুবীরদের।

এই কথা বলে সহচরীদের সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেগে বেরিয়ে গেলেন অ্যান্ড্রোমেক। দুর্গপ্রাকারের উপর গিয়ে দেখলেন, অ্যাকেলিসের রথাশ্বগুলো হেক্টরের মৃতদেহটিকে নির্মমভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গ্রীকরণতরীগুলোর অভিমুখে। এ দৃশ্য দেখামাত্র চোখে অন্ধকার নেমে এল অ্যান্ড্রোমেকের। মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর বিবাহের দিন দেবী আফ্রোদিতে সে অবগুণ্ঠনটি পতিব্রত্যের লক্ষণস্বরূপ তাঁর মাথায় চাপিয়ে দেন সে অবগুণ্ঠনটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন অ্যান্ড্রোমেক। অ্যান্ড্রোমেককে আত্মহত্যায় উদ্যত দেখে তাঁর স্বামীর অন্যান্য স্ত্রী ও বোনেরা ঘিরে ফেলল তাঁকে। অবশেষে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আপন মনে বিলাপ করতে লাগলেন অ্যান্ডোমেক। বললেন, হায় হেক্টর, একই ভাগ্য দুজনের ভোগ করার জন্য জন্মলাভ করেছিলাম আমরা। কিন্তু তুমি চলে গেলে অকালে। অরণ্যসমাচ্ছাদিত প্লেকাস পর্বতের পাদদেশে থবস নগরী এলিয়নের প্রাসাদে এই জন্যই জন্ম হয়েছিল আমার? আজ আমাকে একা বিধবা অবস্থায় ফেলে রেখে তুমি যাচ্ছ মৃত্যুপুরীতে। তোমার একমাত্র শিশুপুত্র অ্যাসটিয়ানাক্সকে অনাথ করে গেলে। তুমি না থাকতে তাদের রাজ্য দখল করে নেবে বিদেশীরা, তোমার পুত্রের আর কোন সমাদর থাকবে না কোথাও। দুঃখের অন্ধকারে ভরে উঠবে তার হতভাগ্য জীবন। আজ তোমার কত মূল্যবান পোশাক তোমার ঘরে থাকা সত্ত্বেও তুমি নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছ গ্রীকজাহাজে। তোমার সে নগ্ন অসহায় দেহটিকে তাদের কুকুরেরা ছিঁড়ে খাবে। তোমার দেহটিকে না পেয়ে তোমার সম্মানার্থে তোমার পোশাকগুলোকেই আমি ট্রয়রমণীদের চোখের সামনে পুড়িয়ে ফেলব।

এইভাবে শোকে বিলাপ করতে করতে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন অ্যান্ড্রোমেক। অন্যান্য ট্রয়রমণীরাও সে বিলাপে যোগদান করল তার সঙ্গে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *