২০. যুদ্ধে দেবতাদের আগমন ॥ অ্যাকেলিসের বীরত্ব প্রদর্শন

বিংশতি পর্ব
যুদ্ধে দেবতাদের আগমন ॥ অ্যাকেলিসের বীরত্ব প্রদর্শন

যুদ্ধের ক্ষুধায় উন্মত্ত পেলেউসপুত্রকে কেন্দ্র করে গ্রীকরা যখন তাদের জাহাজের পাশে অস্ত্রধারণ করে প্রস্তুত হয়ে উঠেছেন, ট্রয়বাসীরাও তখন রণসাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছিল ট্রয়ের রণপ্রান্তরে।

এদিকে বহু গ্রস্ত উপত্যকা সমন্বিত অলিম্পাস পর্বতের শিখরদেশে থেমিসকে দেবতাদের এক সভা আহ্বান করতে বললেন জিয়াস। সে সভায় একমাত্র ওসিয়ানাস নদী ছাড়া অন্য সব নদী, প্রান্তর ও প্রস্রবণের দেবতারা যোগদান করেছিলেন। তাঁরা সকলে সে সভায় উপস্থিত হয়ে হিফাস্টাসনির্মিত আসনে উপবেশন করলেন।

থেমিসের অনুরোধে ভুকম্পনদেবতা পসেডনও সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে এসে সভায় যোগদান করলেন। সে সভায় মাঝখানে বসে তিনি জিয়াসকে প্রশ্ন করলেন, হে বিদ্যুতাধিপতি, কেন তুমি এই দেবসভা আহ্বান করেছ? তুমি কি ট্রয় ও গ্রীকদের প্রজ্জ্বলনোনুখ আসন্ন যুদ্ধের কথা আলোচনা করবে?

জিয়াস উত্তর করলেন, তুমি আমার উদ্দেশ্যের কথা ঠিকই বলেছ। আমি এর জন্যই তোমাদের এখানে ডেকেছি। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চললেও আমি তাদের কথা ভাবি। আমি যখন অলিম্পাসের পর্বত শিখরে বসে শান্তিপূর্ণভাবে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিরীক্ষণ করব, তোমরা সকলে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে উভয় পক্ষকেই সাহায্য করবে। আপন আপন অভিরুচি অনুসারে তোমরা যেকোন পক্ষে যোগদান করতে পার। অ্যাকেলিস যদি অবাধে ট্রয়বাসীদের বিরুদ্ধে নামে তাহলে ট্রয়বাসীরা তারা প্রতিরোধ: করতে পারবে না, কারণ তারা তাকে দেখলেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। এখন তার সহকর্মীর শোকে সে এমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে বিধির বিধানকেও অতিক্রম করে ট্রয়নগরী ধ্বংস করবে সে।

জিয়াসের একথা শুনে দেবতারা ট্রয়যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য চলে গেলেন সেখান থেকে। হেরা, প্যালাস এথেন, পসেডন, হার্মিস, হিফাস্টাস, অ্যাপোলো, আর্তেমিস ও অ্যাফ্রোদিতে, সকল দেবদেবীই চলে গেলেন যুদ্ধে।

যতক্ষণ দেবতারা যুদ্ধ হতে বিরত ছিলেন ততক্ষণ গ্রীকরাই যুদ্ধে জয়ী হচ্ছিল, কারণ দীর্ঘদিন বিরত থাকার পর অ্যাকেলিস যোগদান করেন যুদ্ধে। সাক্ষাৎ রণদেবতাদের মত দ্রুতগামী পেলেউসপুত্রকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ট্রয়বাসীর অঙ্গ অসাড় ও অবশ হয়ে আসছিল ভয়ে। গর্জনশীল সমুদ্রের ধারে পরিখার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে এথেন গ্রীকদের উৎসাহ দান করলেন। অ্যারেসও বজ্রগর্জনে চিৎকার করে উৎসাহ দিতে লাগলেন ট্রয়বাসীদের।

এইভাবে দেবতারা উভয় পক্ষের লোকদের উত্তেজিত করতে লাগলেন। স্বর্গ হতে জিয়াস এবং সমুদ্রগর্ভ হতে পসেডন বজ্রগর্জনে চিৎকার করতে লাগলেন। পডেসন সমগ্র পৃথিবীকে প্রকম্পিত করে সমস্ত পাহাড়গুলোকে মাথা নাড়াতে বললেন। অসংখ্য প্রস্রবণবিধৌত আইডা পর্বতের শিখরদেশের সঙ্গে সঙ্গে ট্রয়নগরী ও গ্রীকরণতরীগুলোও প্রবলভাবে কম্পিত হয়ে উঠল। পাতালপুরীর রাজা হেডস ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠে ভয়ে খুব জোরে চিৎকার করে উঠলেন। ভাবলেন হয়ত বা ভূকম্পনদেবতা পসেডন তার পাতালপুরীর উপরিস্থিতি ছাদ অর্থাৎ মর্ত্যভূমির তলদেশস্থ মৃত্তিকা ফাটিয়ে দিয়ে পাতালপুরীর সুরম্য সৌধাবলীকে দেবতা ও নরকুলের দৃশ্যগোচর করে তুলবেন। পাতালপুরীর প্রাসাদসৌধ এমনই অন্ধকার ও ভয়াবহ তার কথা ভাবতে গেলে দেবতাদেরও হৃদকম্প উপস্থিত হয়। এইভাবে দেবতারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে স্বর্গ, মর্ত ও পাতালপুরীবে ব্যাপ্ত করে এক প্রচণ্ড আলোড়ন শুরু হয়। অ্যাপোলো তাঁর ধনুর্বাণ নিয়ে দাঁড়ালেন পসেডনের বিরুদ্ধে আর এথেন দাঁড়ালেন রণদেবতা অ্যারেসের বিরুদ্ধে। তীরন্দাজদেবী আর্তেমিস তাঁর ধনুর্বাণ নিয়ে দাঁড়ালেন দেবরাজ্ঞী হেরার বিরুদ্ধে। হার্মিস করতে লাগলেন লীটোর বিরোধিতা। আর নদীদেবতাকে নবলোকে বলত স্কামান্দার আর দেবলোকে বলত জ্যানথাস। তিনি দাঁড়ালেন খঞ্জদেবতা হিফাস্টাসের বিরুদ্ধে।

এইভাবে দেবতারা দাঁড়ালেন একে অন্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু অ্যাকেলিস শুধু প্রিয়ামপুত্র হেক্টরের অনুসন্ধান করতে লাগলেন, কারণ একমাত্র হেক্টরের রক্ত দ্বারাই তিনি তৃপ্ত করতে চেয়েছিলেন যুদ্ধে অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে। ইতিমধ্যে অ্যাপোলো অন্যতম প্রিয়ামপুত্র লাইকলের কণ্ঠস্বরে পেলেউসপুত্রের বিরুদ্ধে ঈনিসকে উত্তেজিত করতে লাগলেন। তিনি বললেন, ট্রয়জাতির মন্ত্রণাদাতা হে ঈনিস, তুমি পানোন্মত্ত অবস্থায় যে দম্ভোক্তি করে বলতে অ্যাকেলিসের সঙ্গে তুমি একা যুদ্ধ করবে সে দম্ভোক্তি তোমার কোথায় গেল।

ঈনিস উত্তর করল, আমার যখন মন নেই তখন কেন তুমি পেলেউসপুত্র অ্যাকেলিসের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছ আমায়? এখন তার সম্মুখীন হলেও এই প্রথমবার নয়, আর একবার তার দ্বারা আক্রান্ত হই আমি। একবার সে যখন আইডা পর্বতের উপর আমাদের পশুর পাল হতে লার্তেসাস ও পেদাসাস নামে দুটি নগরী বিধ্বস্ত করে তখন সে আমাকেও বর্শার দ্বারা আক্রমণ করলে আমি ছুটে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করি আর জিয়াস আমাকে সেই পলায়নের শক্তিটুকু দয়া করে দান করেন। তা না হলে সেইদিনই আমার মৃত্যু ঘটত অ্যাকেলিসের হাতে। সেদিন অ্যাকেলিসের ও এথেন ট্রয়বাসীদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে গিয়েছিলেন। কোন মানুষ কখনো অ্যাকেলিসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে না। কারণ একজন দেবতা সব সময় রক্ষা করে চলেন অ্যাকেলিসকে এর তার প্রতিপক্ষের প্রতি নিক্ষিপ্ত অ্যাকেলিসের অস্ত্র ব্যর্থ হয় না কখনো। অ্যাকেলিস আমাকে শীঘ্র পরাজিত করতে পারবে না, দেবতারা এ প্রতিশ্রুতি দিলেও আমি যুদ্ধ করব না।

অ্যাপোলো তখন বললেন, না না, তুমি অমর দেবতাদের নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা করো ঈনিস, কারণ লোকে বলে তুমি নাকি দেবী অ্যাফ্রোদিতের সন্তান আর অ্যাকেলিস হলো তোমার মাতার থেকেই নিকৃষ্ট শ্রেণীর দেবী থেটিসের সন্তান। অ্যাফ্রোদিতে দেবরাজ জিয়াসের কন্যা আর থেটিস সমুদ্রগর্ভস্থ জলদেবতা বৃদ্ধ ওসিয়ানাসের কন্যা। সুতরাং তোমার বর্শা এনে যুদ্ধ করে তার সঙ্গে। তোমার উপর ভীতিপ্রদ বিদ্রূপবাক্য বর্ষণ করতে তাকে কোন সুযোগ দিও না।

এইভাবে ঈনিসের অন্তরে সাহস সঞ্চার করলেন অ্যাপোলো এবং অ্যাঙ্কিসেসপুত্র ঈনিসও লম্বা লম্বা পা ফেলে ট্রয়পক্ষের প্রথম সারিতে যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে যেতে লাগলেন অস্ত্র হাতে। অ্যাকেলিসের সন্ধানে এইভাবে অস্ত্রহাতে এগিয়ে গেলে ঈনিসকে দেখতে পেলেন হেরা এবং অন্যান্য দেবতাদের ডেকে বললেন, দেখ পসেডন ও এথেন, ফীবাস অ্যাপোলো ঈনিসকে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করে অ্যাকেলিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠিয়েছে। আমরা কি এখনি তার গতি রোধ করব অথবা আমাদের মধ্য থেকে কোন দেবতা অ্যাকেলিসের সহায়তায় তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে যাতে সে বুঝতে পারে সবচেয়ে শক্তিমান কোন দেবতা তার সাহায্যার্থে প্রস্তুত সব সময় আর ট্রয়বাসীদের যে সব দেবতা সাহায্য করছে তাদের সব সাহায্য হবে ব্যর্থ। সে যেন বুঝতে পারে আজ তারই জন্য আমরা দেবদেবীরা অলিম্পাস পর্বতশিখর হতে নেমে এসেছি মর্ত্যভূমির এক রণপ্রান্তর মাঝে আর সে ট্রয়বাসীদের হাত কোন আঘাত লাভ করবে না। এর পরে অবশ্য জন্মকালে তার ভাগ্যে যে বিধির বিধান লিখিত হয় তাকে ভোগ করতেই হবে। তবে এখন তাকে আশ্বস্ত করতেই হবে, কারণ তা না করলে কোন দেবতাকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে পারে অ্যাকেলিস। যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে দেবতারা সত্যিই বড় ভয়াবহ হয়ে ওঠেন।

হেরার এক কথার উত্তরে পসেডন বললেন, তোমার ক্রোধ সংবরণ করো হেরা। ঘটনাস্রোত যখন আমাদের অনুকূলে তখন অন্যান্য দেবতাদের আমাদের জন্য যুদ্ধে উত্তেজিত করার কোন কারণ দেখি না। চল, আমরা বরং কোন এক পর্বতশিখরে গিয়ে বসে থাকি; উভয়পক্ষের মানব সৈন্যরা নিজেরা যুদ্ধ করে জয়পরাজয় নির্ণীত করুক। তবে অ্যারেস বা অ্যাপোলো যদি অ্যাকেলিসককে বাধা দেয় যুদ্ধে তাহলে আমরা এমন জোরে চিৎকার করব যাতে তারা পরাহত অবস্থা যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যান অলিম্পাসে।

এই কথা বলে কৃষ্ণকেশবিশিষ্ট দেবতা পসেডন হেরাকে পথ দেখিয়ে প্রস্তরনির্মিত এক বিশাল চত্বরে নিয়ে গেলেন। একবার যখন কোন এক জলদৈত্য পসেডনকে সমুদ্রকূল হতে তাড়া করে তখন এথেন নির্মিত এই চত্বরটিতে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন পসেডন। সেইখানে গিয়ে পসেডন পক্ষালম্বনকারী দেবতারা বসলেন সকলে। কিন্তু অ্যাপোলো ও অ্যারেসের পক্ষালম্বনকারী দেবতারা বসলেন ক্যালিকোলোন নামে এক স্থানে।

জিয়াস তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে নির্দেশ দান করলেও দেবতারা নিজেরা যুদ্ধ না করে পৃথক পৃথকভাবে বসে রইলেন। এদিকে তখন ঈনিস ও অ্যাকেলিস যুদ্ধে সম্মুখীন হলেন পরস্পরের, তখন এক বিপুল রণহুঙ্কার ও অস্ত্রঝঙ্কারে ভয়ঙ্করভাবে নিনাদিত হয়ে উঠল রণভূমি।

আক্রমণাত্মক অবস্থায় ঈনিসই এগিয়ে এল প্রথমে। তার উদ্ধত দর্পিত গতির তালে তালে তার মাথার শিরস্ত্রাণটি দুলতে লাগল এক অনমনীয় ঔদ্ধত্যে। তার ঢালটি বুকের উপর ধরে বর্শাটি সঞ্চালন করতে লাগল জোরে। অ্যাকেলিসও আক্রান্ত সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়লেন সে যুদ্ধে। ঈনিসের কাছে এসে একিলিস বললেন, ঈনিস, কেন তুমি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছ? প্রিয়ামের পরিবর্তে তুমিই কি ট্রয়রাজ্য শাসন করতে চাও? প্রিয়াম হচ্ছেন রাজা হিসেবে বিচক্ষণ, তাঁর অনেক পুত্র আছে, তুমি আমাকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করলেও তিনি তোমাকে তার রাজ্য দান করবেন না। অথবা আমাকে হত্যা করার জন্য ট্রয়বাসীরা কি তোমাকে পুষ্পেদ্যানসমন্বিত কোন শস্যসমৃদ্ধ উর্বর ভূমি দান করবে? কিন্তু তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না। কিভাবে একবার আইডা পর্বত হতে তোমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াই সেকথা কি বিস্মৃত হয়েছ? তুমি তখন পিছন ফিরে ভয়ে তাকাতেও সাহস পাও নি। তুমি লার্নের্সস। নগরীতে আশ্রয় নিলে আমি সে নগরী বিধ্বস্ত করে বহু রমণীকে বন্দি করে নিয়ে আসি। সেবার তোমায় জিয়াস রক্ষা করলেও মনে ভেবো না এবারও তিনি তোমার রক্ষা করবেন। সুতরাং এখনও ফিরে যাও। আমার সম্মুখে আর এস না, পরে অনুশোচনা করতে হবে। ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে নির্বোধরাও অনেককিছু শিক্ষা লাভ করতে পারে।

ঈনিস তখন উত্তর করলেন, হে পেলেউসপুত্র, ভেবো না আমি শিশুর মত তোমার কথায় ভয় পাব। বৃথা বাক্যব্যয় করে তোমার মত আমিও বড়াই করতে পারি। আমরা কেউ কারো পিতামাতাকে চোখে না দেখলেও লোকমুখে আমরা আমাদের বংশপরিচয়ের কথা শুনেছি। কিন্তু যেমন রাজা পেলেউস ও জলদেবী থেটিসের পুত্র, আমিও তেমনি অ্যাঙ্কিসেস ও দেবী অ্যাফ্রোদিতের পুত্র। তাহলে আমার বংশপরিচয় এবার শুনলে তো? সুতরাং বাজে কথা বলে বিরত করতে পারবে না আমায় যুদ্ধ হতে।

প্রাচীনকালে দাদানাস নামে জিয়াসের এক পুত্র ছিলেন। তিনি দার্দানিয়া নামে এক নগরের প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ ইলিয়াম নগরী তখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি আর তার ফলে ইলিয়ামবাসীরা তখন বাস করত আইডা পর্বতে। এরিকথোনিয়াস নামে এক পুত্র ছিল দার্দানাসের। এরিকথোনিয়াস ছিলেন মানব জাতির মধ্যে সর্বপেক্ষা ধনী। তাঁর তিন হাজার ঘোটকী ছিল এবং তারা সমুদ্রপ্রান্তরবর্তী এক বিশাল তৃণভূমিতে চড়ে বেড়াত। এরিকথোনিয়াসের পুত্র ট্রস ছিলেন ট্রয়বাসীদের রাজা। রাজা ট্রসের ছিল তিন পুত্র। তাঁরা হলেন ইলাস, অনারাকাস ও গ্যানীমীড। এঁদের মধ্যে গ্যানীমীড ছিলেন সর্বাপেক্ষা সুপুরুষ। তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দেবতারা তাঁকে নিয়ে যান স্বর্গে। ইলাসের পুত্র লাওমীডসের ছিল পাঁচ পুত্র। তাঁরা হলেন টিথোনাস, প্রিয়াম, ল্যাম্পাস, ক্লাইটিয়াস ও হিকেটাওন। কিন্তু আনারাকাস এর ছিল মাত্র এক পুত্র। তার নাম ক্যাপিস। সেই ক্যাপিসের পুত্র অ্যাঙ্কিসেস ছিলেন আমার পিতা আর হেক্টর হলেন রাজা প্রিয়ামের পুত্র।

এই হলো আমার বংশ পরিচয়। কিন্তু সাহস বা বীরত্ব হলো সর্বশক্তিমান দেবরাজ জিয়াসের হাতে তিনি যাকে যা দেন। এখন শিশুর মত যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বাজে কথা বলে কোন লাভ নেই। কথার ক্ষেত্র হচ্ছে অনন্ত প্রসারিত, কথার কখনো কোন শেষ নেই। তুমি যত কথা বলবে তত কথা তোমাকেও শুনতে হবে। এখন মেয়েদের মত পরস্পরের প্রতি শক্ত কথার ঢিল ছুঁড়ে বা গালাগালি না করে শক্তি পরীক্ষা করো। তোমার কোন কথাই আমাকে যুদ্ধ হতে নিবৃত্ত করতে পারবে না।

এই কথা বলতে বলতে অ্যাকেলিসকে লক্ষ্য করে তার বর্শা ছুঁড়ল ঈনিস। কিন্তু অ্যাকেলিসের ঢালে ছিল পাঁচটি স্তর। দুটি ব্রোঞ্জের, দুটি টিনের ও একটি সোনার। ঈনিসের বর্শাফলটি অ্যাকেলিসের ঢালের মাত্র তিনটি স্তর ভেদ করে সোনার স্তরটিতে প্রতিহত হয়ে আর ভিতরে যেতে পারল না। অ্যাকেলিস তখন তাঁর বর্শা নিক্ষেপ করতে সে বর্শা ঈনিসের ঢালটিকে ভেদ করে তার পিঠের পাশ দিয়ে চলে যায়। ঈনিস কোনক্রমে রক্ষা পায়। ভীতিবিহ্বল অবস্থায় সে ক্ষণকালের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। অ্যাকেলিস তখন মুক্ত তরবারি হাতে এগিয়ে আসেন। ঈনিসও একটি বিরাট পাথর নিয়ে অ্যাকেলিসের উপর নিক্ষেপ করতে উদ্যত হন।

হয়ত ঈনিসের দ্বারা নিক্ষিপ্ত সেই প্রস্তরে আহত হতেন অ্যাকেলিস অথবা অ্যাকেলিসের তরবারিতে নিহত হত ঈনিস। কিন্তু ঠিক সেই সময় পসেডন দেবতাদের বললেন, যে ঈনিস অ্যাকেলিসের হাতে মৃত্যুবরণ করতে চলেছে তার জন্য আমি দুঃখিত কারণ সে এ ব্যাপারে নির্দোষ। সে অ্যালোলোর মন্ত্রণা শুনে ভুল করেছে কারণ অ্যাপোলো তাঁকে বাঁচাবে না। সে একদিন দেবতাদের উদ্দেশ্যে অনেক অর্ঘ্য দান করেছে এবং অনেক পশু বলি দিয়েছে। সুতরাং তাকে মৃত্যুর কবল থেকে ছিনিয়ে আন। তার এভাবে বিনা দোষে মৃত্যু ঘটলে জিয়াস অসন্তুষ্ট হবেন আমাদের প্রতি। জিয়াসের ঔরসে মানবীর গর্ভে যত সন্তান উৎপন্ন হয়েছে তাদের মধ্যে দার্দাসকে সবচেয়ে ভালবাসতেন জিয়াস। সুতরাং তিনি চান না দার্দানাসের বংশে কোন উত্তরাধিকারী থাকবে না এবং সে বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একেবারে। এখন যেহেতু জিয়াস প্রিয়ামকে ঘৃণা করেন, ঈনিসই হবে ট্রয়বাসীদের রাজা।

হেরা তখন বললেন, শোন পসেডন, তুমি শুধু নিজের দিকটাই দেখছ। ঈনিসকে কিভাবে অ্যাকেলিসের হাত থেকে রক্ষা করবে শুধু তার কথাই ভাবছ। তবে সত্য কথা বলছি, আমি ও প্যালাস এথেন একবার শপথ করেছিলাম আমরা কখনই ট্রয়বাসীদের সাহায্য করব না, গ্রীকদের দ্বারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকাণ্ডে তাদের নগরী ভস্মীভূত হলেও আমরা তাদের রক্ষা করব না সে ধ্বংসের কবল থেকে।

একথা শুনে পসেডন নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে ঈনিস ও অ্যাকেলিসের নিকটে উপস্থিত হলেন। এক কৃত্রিম অন্ধকারে অ্যাকেলিসের চক্ষুদ্বয় আচ্ছন্ন করে দিয়ে ঈনিসের বর্শাটি অ্যাকেলিসের পায়ের তলায় ফেলে দিলেন। তারপর ঈনিসকে তুলে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের এক প্রান্তে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে তাকে বললেন, কোন দেবতা তোমাকে অ্যাকেলিসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করেছে। এটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই না। শক্তি ও বীরত্বে সে শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, তোমার থেকে সে দেবতাদেরও বেশি অনুগ্রহভাজন। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে মৃত্যুপুরীতে গমন করবে তুমি। অ্যাকেলিসের মৃত্যুর পর আর কোন গ্রীকবীর প্রতিরোধ করতে পারবে না তোমায়।

এই কথা বলে পসেডন চলে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকেলিসের চোখের সামনে থেকে সব অন্ধকার অপসৃত হলো। তখন তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি আপন মনে বললেন, হায়, কি আশ্চর্য! আমার বর্শা এখানে পড়ে রয়েছে, কিন্তু যে ঈনিসকে আমি হত্যা করতে চেয়েছিলাম তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার মনে হয় কোন দেবতা তাকে রক্ষা করেছে। যাই হোক, সে কোনক্রমে আমার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পালিয়েছে যখন তখন আর সে যুদ্ধ করতে আসবে না আমার সঙ্গে। আমি এবার অন্য কোন ট্রয়বীরকে আক্রমণ করার জন্য আদেশ দেব গ্রীকসেনাদের।

সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে গ্রীকদের উত্তেজিত করে অ্যাকেলিস বললেন, ট্রয়বাসীদের কাছে থেকে দূরে থেকো না। তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করো। আমি যত বড়ই বীর হই না কেন আমি তাদের অসংখ্য সৈন্যকে একা কখনো বিতাড়িত করতে পারি না, আমি কেন, একাজ এথেন বা অ্যারেসও পারবে না। তবে আমি অবশ্য হাত পায়ের কোন শৈথিল্যই মুহূর্তের জন্যও প্রদর্শন করব না এবং ট্রয়সেনাদের ছত্রভঙ্গ করবই। আমার বর্শার সম্মুখে কোন ট্রয়বাসী আসতে সাহস করবে কখনো।

অ্যাকেলিস যখন গ্রীকদের উপদেশ দান করছিলেন এইভাবে, হেক্টর তখন, ট্রয়সেনাদের উত্তেজিত করতে লাগলেন। তিনি বললেন, ভীত হয়ো না হে ট্রয়বাসিগণ, আমি যুদ্ধ করব অ্যাকেলিসের সঙ্গে। তার শক্তি লৌহসদৃশ্য এবং তার হস্তদ্বয় অগ্নিসদৃশ হলেও আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ করব।

ট্রয়সেনারা তখন বর্শা উত্তোলন করে এগিয়ে গেল গ্রীকদের কাছে। এমন সময় অ্যাপোলো হেক্টরের কাছে এসে বললেন, হেক্টর, কোনক্রমেই তুমি একক যুদ্ধে অ্যাকেলিসের সম্মুখীন হবে না। তাহলে হয় সে তোমাকে বর্শার দ্বারা বিদ্ধ করবে অথবা তরবারির আঘাতে শিরচ্ছেদ করবে তোমার।

হেক্টর একথা শুনে ট্রয়সেনাদের পশ্চাদভাগে চলে গেলেন। কারণ তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয় কোন দেবতা তার মঙ্গলের জন্যই নিষেধ করেছেন। এদিকে হেক্টরকে না পেয়ে অ্যাকেলিস ট্রয়সেনাদের আক্রমণ করলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল এক অপরাজেয় বীরত্বের অক্ষয় আবরণে আবৃত হয়ে আছে তার সর্বাঙ্গ। অ্যাকেলিস প্রথমে ওত্রিমাতিয়াসপুত্র ইফিতিয়নকে হত্যা করলেন। ওত্রিনাতিয়ান ছিল তৃষারাবৃত মোনাস পর্বত ও হার্মাস নদী সংলগ্ন হাইলাস রাজ্যের অধিপতি। ইফিতিয়ন তখন এগিয়ে আসছিল অ্যাকেলিসের দিকে তখন অ্যাকেলিস তরবারি দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন তার দেহটিকে।

গ্রীকপক্ষের রথচক্রে নিষ্পেষিত হলো ইফিতিয়ানের দেহ। তারপর অ্যাকেলিস হত্যা করলেন অ্যান্টিনরপুত্র ডেমোলিয়নকে। হিল্লোডেমাস তখন এই সব দেখে রথ থেকে অবতরণ করে পালাবার চেষ্টা করছিল তখন তার মস্তকে শিরস্ত্রাণেরই উপরেই আঘাত করলেন অ্যাকেলিস। পসেডনের উদ্দেশ্যে কোন বলদকে বলি দেবার জন্য টেনে দিয়ে গেলে বলদটি যেমন চিৎকার করে ভয়ে তেমনি মরিয়া হয়ে আর্তনাদ করছিল হিল্লোডেমাস। এরপর সর্বকনিষ্ঠ প্রিয়ামপুত্র পলিডেমাস যখন তাঁর পাশ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল তখন তার কটিবন্ধনীর নিচে পেটের তলায় বর্শা দিয়ে আঘাত করতেই তার সব নাড়িভুঁড়িগুলো বেরিয়ে এল।

হেক্টর যখন দেখলে তার ভ্রাতা পলিডেমাস তার পেট থেকে বেরিয়ে আসা নাড়িভুড়িগুলো হাত দিয়ে কোনরকমে ধরে মাটিতে বসে পড়ছে তখন তার চোখের সামনে যেন অন্ধকার নেমে এল সহসা। তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তখন তার হাত থেকে হেক্টর তাঁর বর্শাটি নিক্ষেপ করতেই সে বর্শা জ্বলন্ত এক অগ্নির মত ছুটে গেল অ্যাকেলিসের পানে। হেক্টর দেখতে পেলেন অ্যাকেলিস বললেন এই লোকটাই আমার প্রিয়তম সহকর্মীকে হত্যা করে আমার অন্তরাত্মাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দান করেছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রে খুব বেশিক্ষণ আমরা দুজন জীবিত থাকব না; দুজনের একজনকে নিহত হতেই হবে।

হেক্টরের মুখপানে কঠোরভাবে তাকিয়ে বললেন অ্যাকেলিস, যাতে তুমি শীঘ্র তোমার শেষ পরিণতি লাভ করতে পার তার জন্য আমার কাছে এগিয়ে এস।

হেক্টরও তাঁকে ভয় না করে উত্তর করলেন, আমাকে তুমি শিশু ভেবো না যে আমি তোমার কথায় ভয় পাব। যদিও তুমি আমার থেকে বেশি শক্তিমান তথাপি জয়পরাজয় দেবতাদের হাতে এবং আমার তীক্ষ্ণ বর্শার দ্বারা তোমাকে হত্যা করতে পারব না এমন কথা কি জোর করে বলতে পার?

এই কথা বলে বর্শা নিক্ষেপ করলেন হেক্টর। কিন্তু এথেন সকলের অলক্ষে মৃদু নিশ্বাস ফেলে সে বর্শার গতিপথ ঘুরিয়ে সেটিকে হেক্টরের পদতলে ফেলে দিলেন। অ্যাকিলিস তখন হেক্টরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এক হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার উপর। কিন্তু অ্যাপোলো এসে এক কৃত্রিম অন্ধকার সৃষ্টি করে লুকিয়ে ফেললেন হেক্টরকে। বর্শা হাতে তিনবার চেষ্টা করলেন অ্যাকেলিস হেক্টরকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু তিনবার ব্যর্থ হলেন তিনি। চতুর্থবারও তিনি হেক্টরকে খুঁজে না পেয়ে বললেন, শিকারী কুকুর, এবারও তুমি অ্যাপোলোর দয়ায় পরিত্রাণ পেলে আমার হাত থেকে। কিন্তু দেবতাদের মাঝে আমারও যদি কোন বন্ধু থাকে তাহলে এরপর যখনি তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে তখনি তোমার জীবনাবসান ঘটাব আমি। বর্তমানে আমি অন্যান্য ট্রয়বীরকে আক্রমণ করব।

এই কথা বলার পর সঙ্গে সঙ্গে ত্ৰিওয়াসকে হত্যা করলেন অ্যাকেলিস। তার ঘাড়ের মাঝখানে বর্শাটি বিদ্ধ করলেন তিনি। তারপর বর্শার দ্বারা ফিলেটরপুত্র দেমাকাসের জানুতে আঘাত করে পরে তরবারির দ্বারা বধ করলেন তাকে। এরপর অ্যাকেলিস বিয়াসপুত্র লাগোনাস ও দার্দানাসকে বধ করলেন। লাগোনাসকে বর্শার দ্বারা এবং দার্দানাসকে তরবারির দ্বারা আঘাত করে দুজনকেই হত্যা করলেন। এই হত্যাকাণ্ড দর্শনে ভীত হয়ে অ্যালস্টারপুত্র ট্রস অ্যাকেলিসের জানু ধরে জীবনভিক্ষা করল। কিন্তু অ্যাকেলিসের মনে তখন কোন দয়ামায়া ছিল না। তিনি ট্রসের কোন অনুনয় বিনয়ে কান না দিয়ে তার উদরদেশে তরবারি দিয়ে আঘাত করে যকৃতটা বার করে ফেললেন।

অতঃপর অ্যাকেলিস মুনিয়াসের কানে বর্শার দ্বারা এবং এজিনরপুত্র একেক্লাসের মস্তকে তরবারির দ্বারা আঘাত করে দুজনকেই হত্যা করলেন। এরপর দিউকালিয়ানের মাথাটি কেটে তার শিরস্ত্রাণটি খুঁড়ে ফেলে দিলেন অ্যাকেলিস। ফ্রেস হতে আগত গিয়ানের পুত্র রিগমাসের উদরদেশে আঘাত করতেই যে পড়ে গেল এবং তার সারথি এরেথোয়াস যখন রথ ঘুরিয়ে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল তখন তার পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে রথ থেকে ফেলে দিলেন তাকে। তার ঘোড়াগুলো তখন ভয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। দীর্ঘ অনাবৃষ্টির পর কোন পার্বত্য বনভূমির মাঝে দাবানল জ্বলে উঠলে শুষ্কতপ্ত বাতাস যেমন সে দাবানলের লেলিহান জিহ্বাগুলো বিভিন্ন দিকে প্রসারিত করে দেয়, অ্যাকেলিসের ক্রোধের আগুন তেমনি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল রণক্ষেত্রের বিভিন্ন দিকে। এর দেবোপম ঔদ্ধত্যে বর্শা সঞ্চালন করতে করতে একের পর এক করে ছুটে যেতে লাগলেন ট্রয়সেনাদের পশ্চাতে। অবশেষে অসংখ্য হত্যাজনিত রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠল রণভূমির উপর ধীর পদক্ষেপে নেমে আসা আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকার। শস্যপেষণকারী বলিষ্ঠ বলদের পদভরে যেমন শস্যকণা চূর্ণিত হয়, তেমনি অ্যাকেলিসের রথচক্রে নিষ্পেষিত হতে লাগল অসংখ্য শত্রুর মৃতদেহ। তার হাত দুটি শরক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলেও আরও বৃহত্তর এক জয়ের গৌরবলাভ মানসে এগিয়ে যেতে লাগলেন অ্যাকেলিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *