১৮. অ্যাকেলিসের অস্ত্রসভার

অষ্টাদশ পর্ব
অ্যাকেলিসের অস্ত্রসভার

এইভাবে যুদ্ধের বিশাল অগ্নিস্তম্ভ ক্রমশ তীব্র হতে তীব্রতর হতে হতে গ্রীকরণতরী গুলোর দিকে যখন এগিয়ে আসছিল তখন দ্রুতগামী অ্যান্টিলোকাস অ্যাকেলিসের কাছে দূতরূপে গিয়ে দেখল অ্যাকেলিস তখন একা একা বসে ভাবছেন। অ্যাকেলিস তখন ভাবছিলেন, হায়, গ্রীকসেনারা আবার তাদের জাহাজের পানে পালিয়ে আসছে কেন! তবে কি আমার মাতা যে দুঃখের কথা একদিন বলেছিলেন সেই দুঃখের বোঝাই দেবতারা চাপিয়ে দিচ্ছেন আমার উপরে। আমার মাতা বলেছিলেন আমার জীবিত থাকাকালেই মার্মিডনদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর নিহত হবে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে মীনোতিয়াসপুত্র তার আপন দুঃসাহসের দ্বারা আপনার পতন ডেকে এনেছে। অথচ আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম, সে যেন গ্রীকজাহাজে অগ্নিসংযোগকারী ট্রয়সেনাদের তাড়িয়ে দিয়ে চলে আসে এবং হেক্টরের সঙ্গে যুদ্ধ না করে।

অ্যাকেলিস যখন এই সব ভাবছিলেন অ্যান্টিলোকাস তখন তাঁর কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, হায়, পেলেউসপুত্র, আমি তোমার কাছে এনেছি এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। প্যাট্রোক্লাস নিহত, তার মৃতদেহকে কেন্দ্র করে তীব্র যুদ্ধ চলছে। হেক্টর তার বর্ম ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

বিরাট দুঃখের এক কালো মেঘ নেমে এল অ্যাকেলিসের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুহাত দিয়ে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন। তাদের বন্দিনী নারীরা বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুতে। অ্যান্টিলোকাসের তখন ভয় করতে লাগল অ্যাকেলিস হয়ত তার বুকে একটা ছুরি বসিয়ে দিতে পারেন তাঁর অসহনীয় শোকের আবেগের বশবর্তী হয়ে।

কিন্তু তা না করে জোরে চিৎকার করে তাঁর মাতাকে ডাকতে লাগলেন অ্যাকেলিস আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাতা থেটিস সমুদ্রগর্ভে যেখানে তিনি তার বৃদ্ধ পিতার সঙ্গে বাস করতেন সেখান থেকে চিৎকার করে নেলেউসকন্যা ও অন্যান্য জলদেবীদের ডাকতে লাগলেন। সে চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই সব জলদেবীরা দলে দলে এসে সমবেত হতে লাগল থেটিসের চারিদিকে। তারা হলেন এস, থানিয়া, সাইমেদিসি, নেসাইয়া, স্পীড, থো, সিতোনয়, হেলি, সাইমোথা, অ্যাকটিয়া, লিমলেরিয়া, মেনিতে, লীরা, অ্যাক্সিথো, আগাভে, দোতো, প্রোতা, ফেরুসা, ডাইনামেনি, ডেক্সামেনি, অ্যাফিনোমি, ক্যানিয়ামেইরা, ডোরিস, পালোপ এ ছাড়া ছিল প্রসিদ্ধ জলপরী গালুচিয়া, নর্মাৰ্ডেস, আপসিউডেস, গালিয়ানোসা, ক্লাইমেনি, আয়ানৈরা, আয়ালাসা, মেরা, ও রেইথুইয়া আমাথুইয়া। সেই সব সুকেশিনী জলদেবী ও জলপরীরা সমুদ্রগর্ভে থেটিসের কাছে সমবেত হয়ে বুক চাপড়াতে লাগল থেটিসের শোকে।

অবশেষে থেটিস তাদের বললেন, হে নেরেউস কন্যারা, আমাদের দুঃখের কাহিনী শোন। কী দুঃখের কথা, আমি একসময় সুন্দর, বলবান ও গৌরবময় মানবসন্তান প্রসব করি। বীরের মতই সে এক সতেজ চারাগাছের মত বেড়ে ওঠে। আমি তাকে লালন পালন করার মত তাকে জাহাজে করে ইলিয়াম নগরীতে পাঠাই ট্রয়বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু আর তাকে কোন দিন ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব না আমি পেলেউসভবনে। সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে থাকবে তার অন্তর। আমি গিয়ে কোন সাহায্য করতে পারব না। তথাপি আমি আমার পুত্রকে দেখতে যাব, গিয়ে তার দুঃখের কারণ অবগত হব। যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা সত্ত্বেও কেন সে এত কাতর হলো দুঃখে তা জানতে হবে আমার।

এই বলে তাঁর সেই সমুদ্রবর্তী অন্ধকার গুহাদেশ ত্যাগ করে রওনা হলেন থেটিস। অন্যান্য জলদেবীরা ক্রন্দরত অবস্থায় অনুসরণ করতে লাগল তাঁর। তাঁদের দেখে সমুদ্রতরঙ্গগুলো পথ করে দিল সসম্মানে। ট্রয়নগরীর নিকটে গিয়ে তারা সমুদ্র থেকে উঠে সারিবদ্ধ হয়ে মার্মিডনদের রণতরীগুলোর মাঝে অবস্থিত অ্যাকেলিসের জাহাজে গিয়ে সমুপস্থিত হলেন। থেটিস সোজা অ্যাকেলিসের ঘরে গিয়ে দেখলেন তখনও অ্যাকেলিস শায়িত অবস্থায় কাতর আর্তনাদ করছেন। থেটিস গিয়ে অ্যাকেলিসের মাথাটি আপন কোলে তুলে নিয়ে বললেন, হে আমার পুত্র, কি কারণে তুমি কাঁদছ? কি তোমার দুঃখ আমার কাছে গোপন না করে তা বলো। একদিন তুমি জিয়াসের উদ্দেশ্যে দুহাত তুলে প্রার্থনা করেছিলে গ্রীকরা যেন তাদের জাহাজেই বন্দী থাকে, তোমার সে প্রার্থনা তো পূরণ হয়েছে। আজ কেন তবে আক্ষেপ করছ তার জন্য।

অ্যাকেলিস আর্তনাদের সুরে উত্তর করলেন, হে মাতঃ, অলিম্পিয়াধিপতি জিয়াস আমার সে প্রার্থনা পূরণ করেছেন সত্য, কিন্তু যাকে আমি আমার আপন প্রাণের মত ভালবাসতাম, আমার সেই প্রিয়তম সহকর্মীর যদি মৃত্যু হয় তাহলে আমার শান্তি কোথায়? আমি তাকে চিরদিনের মত হারালাম আর হেক্টর তার আশ্চর্য সুন্দর বর্মটি খুলে নিয়ে গেছে তার দেহ থেকে। যে পেলেউস মর্তমানব হয়েও তোমার মত একজন দেবীর শয্যাসঙ্গীরূপে প্রীত করেছিল তোমায়, সেই পেলেউসকে এই বর্মটি দান করেছিলেন দেবতারা। তারপর তুমি সমুদ্রগর্ভে জলপরীদের মধ্যে বাস করতে থাক আর পেলেউস কয়েকজন মর্তমানবীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তুমি কিন্তু তোমার এই পুত্রের মৃত্যুতে অন্তহীন দুঃখে জর্জরিত হবে। যদি আমার বর্শার দ্বারা আমি হেক্টরকে বধ করতে না পারি তাহলে আমি আর বাঁচব না, অথবা মানুষের মধ্যেও আর ফিরে যাব না।

থেটিস তখন অপূর্ণ চোখে উত্তর করলেন, তাহলে তোমার মৃত্যুর দিনও নিকটে এসেছে। কারণ হেক্টরের মৃত্যুর পরই তোমাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।

তখন দুঃখিত চিত্তে অ্যাকেলিস বললে, যেহেতু আমার প্রিয় সহকর্মীর জীবন রক্ষা করতে পারি নি, যেহেতু তার বিপদকালে কোন সাহায্যই দান করতে পারি নি, আমি এখানে এখনই প্রাণ ত্যাগ করতে চাই। মন্ত্রণাকার্যের ক্ষেত্রে আমার থেকে ভাল লোক থাকলেও সামরিক পারদর্শিতার দিক থেকে গ্রীকদের মাঝে দ্বিতীয় কোন লোক নেই। তথাপি আমাকে এত তুচ্ছ অবাঞ্ছিত বোঝার মত এখানে থাকতে হচ্ছে। সুতরাং দেবতা ও মানুষের মাঝে সকল ক্রোধ ও বিবাদের অবসান ঘটাও। যে ক্রোধ মানুষের উত্তপ্ত আত্মার উৎসদেশ হতে কৃষ্ণকুটিল ধূমরাশির মত উথিত হয়, যা অতি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির অন্তরকেও কঠিন করে তোলে এবং সে ক্রোধ মধু অপেক্ষা মধুর মানুষের কাছে সেই ক্রোধকে ধ্বংস করো অচিরেই। সেই ক্রোধ আমার মধ্যে সঞ্চার করছে অ্যাগামেমনন। কিন্তু সমস্ত বিপদ সত্ত্বেও আমি আমার অতীতকে ভুলে গিয়ে আমার আত্মাকে বশীভূত করে যে হেক্টর আমার প্রিয়তম ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, আমি তার পশ্চাদ্ধাবন করব। তারপর আমি আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করব। তাতে যদি জিয়াস ও অন্যান্য দেবতারা প্রীত হন তো হবেন। তোমার ক্রোধহেতু জিয়াসের প্রিয়তম পুত্র হেরাকলসকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়। কিন্তু সে মৃত্যুবরণ করার আগে আমি এক অক্ষয় যশ অর্জন করব। বহু ট্রয় ও দার্দানীয় রমণীকে এক তীব্র শোকদুঃখের তাড়নায় চোখের জল মুছতে বাধ্য করব। তারা বুঝবে চিরদিন উদাসীন ও নিষ্ক্রিয় থাকবে না অ্যাকেলিস। সুতরাং স্নেহবশত আমাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করো না। আমাকে বিচলিত করতে পারবে না।

তখন রজতশুভবরণা থ্রেটিস উত্তর করলেন, হে আমার পুত্র, তুমি যা বলেছ তা ঠিক। তোমার সহকর্মীদের যুদ্ধের বিভীষিকা হতে রক্ষা করা তোমার কর্তব্য। কিন্তু তোমার বর্মটি হেক্টর পরিধান করে আছে। আমি অবশ্য জানি হেক্টরের অহঙ্কার আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না, তার শেষ পরিণতির দিন কাছে এসে গেছে। কিন্তু আমার ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি যুদ্ধে যাবে না। আগামীকাল প্রাতে আমি এখানেই হিফাস্টাস নির্মিত এক বর্ম এনে দেব তোমার জন্য।

এই কথা বলে থেটিস তাঁর পুত্রের কাছ থেকে সরে গিয়ে জলপরীদের বললেন, তোমরা সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে আমার বৃদ্ধ পিতাকে সবকিছু বলবে। ইতিমধ্যে আমি অলিম্পাসে গিয়ে আমার পুত্রের জন্য এক বর্ম নির্মাণ করে দেবার জন্য হিফাস্টাসকে অনুরোধ করব।

জলপরীরা সমুদ্রে ডুব দিলে থেটিস চলে গেলেন অলিম্পাস পর্বতে। গ্রীকরা তখন হেক্টরের ক্রমাগত আক্রমণের তাড়নায় জাহাজের দিকে ছুটে পালাচ্ছিল। তখন হেক্টর ও ট্রয়সেনাদের অস্ত্রের নাগালের বাইরে বয়ে আনতে পারেনি প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে। আবারও হেক্টরও সেই মৃতদেহের পা ধরে টানতে থাকেন আর তিনবারই দুই অ্যাজাক্সবীর হেক্টরকে তাড়িয়ে দেন। তবু এক অদম্য উদ্যম আর অপরাজেয় পৌরুষের সঙ্গে পুনরায় তাদের আক্রমণ করছিলেন হেক্টর। পশুদেহ ভক্ষণকারী কোন বুভুক্ষু সিংহকে যেমন মেষপালকেরা বিতাড়িত করতে পারে না তেমনি হেক্টরকেও সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করতে পারছিল না গ্রীকরা।

হেক্টর হয়ত অবশেষে সেই মৃতদেহটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে এক অক্ষয় গৌরব অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু ইতিমধ্যে দেবদূত আইরিস দেবী হেরার দ্বারা প্রেরিত হয়ে পেলেউসপুত্রের কাছে গিয়ে তাঁকে যুদ্ধে প্ররোচিত করতে লাগলেন, তিনি জিয়াস বা অন্যান্য দেবতাদের অগোচরেই হেরার অনুরোধে চলে আসেন অ্যাকেলিসের কাছে। আইরিস হেক্টরকে বললেন, ওঠ পেলেউসপুত্র, প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহকে কেন্দ্র করে জোর যুদ্ধ চলছে। ট্রয়সেনারা ইলিয়াম নগরীতে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। হেক্টর প্যাট্রোক্লাসের মাথা কেটে নিয়ে যেতে চাইছে। আর চুপ করে বসে থেকো না। তাহলে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি ট্রয়ের কুকুরদের খাদ্যে পরিণত হবে এবং সেটা হবে আমাদের পক্ষে লজ্জার কথা।

অ্যাকেলিস বললেন, কোন দেবতা তোমাকে পাঠিয়েছেন আইরিস?

আইরিস উত্তর করলেন, আমাকে পাঠিয়েছেন জিয়াসপত্নী হেরা। তুষারাবৃত অলিম্পাসবাসী জিয়াস ও অন্যান্য দেবতারা আমার এখানে আসার কথা জানেন না।

অ্যাকেলিস বললেন, কি করে আমি যুদ্ধে যাব, আমার বর্মটি ওরা নিয়ে গেছে। আমার মাতা ফিরে না আসা পর্যন্ত যুদ্ধে যেতে আমাকে নিষেধ করে গেছেন। তিনি হিফাস্টাসনির্মিত এক বর্ম এনে দেবেন আমাকে। একমাত্র তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স ছাড়া আর কারো বৰ্ম আমি পরিধান করতে পারি না। কিন্তু অ্যাজাক্স এখন সম্মুখ সারিতে তার বর্শা সঞ্চালন করে যুদ্ধ করছে।

আইরিস বললেন, আমরা জানি তোমার বর্ম ওরা নিয়ে গেছে। তথাপি তুমি পরিখার পাশে যাও। তোমাকে ট্রয়বাসীরা দেখলে ভয় পাবে এবং তখন তারা যুদ্ধ থেকে বিরত হতে পারে। তাহলে গ্রীকরা হাঁপ ছাড়বার কিছুটা অন্তত সময় পাবে।

আইরিস চলে গেলে অ্যাকেলিস উঠে প্রস্তুত হলেন যুদ্ধের জন্য। এথেন তখন তাঁর মাথাটিকে অগ্নিশিখাসুলভ এক জ্যোতির দ্বারা আচ্ছন্ন করে দিলেন। কোন দ্বীপ বা নগরীর উপর ভাসমান মেঘসদৃশ ধূমরাশির উপর সূর্যালোক পতিত হলে যেমন দেখায় তেমনি গ্রীক পরিখার পাশে দণ্ডায়মান অ্যাকেলিসের মস্তকটিকেও ধূমপরিবৃত প্রদীপ্ত অগ্নিশিখাবৎ প্রতীয়মান হচ্ছিল। অ্যাকেলিস কিন্তু গ্রীকদের সঙ্গে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন নি, কারণ তিনি মাতার নিষেধাজ্ঞার কথা বিস্মৃত হন নি।

সেখানে দাঁড়িয়ে একবার উচ্চৈস্বরে চিৎকার করলেন অ্যাকেলিস। এথেনও তাঁর কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সে চিৎকারকে ঢক্কানিনাদের মত ভয়ঙ্করভাবে তীব্র করে তুললেন। সে চিৎকার শুনে এক আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল ট্রয়বাসীরা। ট্রয়বীরদের রথারূঢ় সারথিরা পেলেউসপুত্রের দেদীপ্যমান জ্যোতি দেখে ভীতিবিহ্বল হয়ে উঠল। তিনবার চিৎকার করে উঠলেন অ্যাকেলিস আর তিনবারই ট্রয়সেনারা ও তাদের মিত্রবর্গের লোকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল সে চিৎকার শুনে। বারোজন ট্রয়বীর হতবুদ্ধি হয়ে তাদের রখ হতে মাটিতে পড়ে গিয়ে তাদের নিজেদের বর্শার আঘাতে নিজেরাই নিহত হলো। গ্রীকরা তখন মহা আনন্দে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে শত্রু অস্ত্রের নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটি শবাধারের উপর রাখল। প্রিয় সহকর্মীকে মৃত অবস্থায় দেখে শোকে আকুল হয়ে উঠলেন অ্যাকেলিস। উপযুক্ত রথ ও অশ্বে সজ্জিত করে যে প্যাট্রোক্লাসকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তিনি সেই প্যাট্রোক্লাস এভাবে প্রত্যাবর্তন করলে কেমন করে অভ্যর্থনা জানাবেন তিনি।

এমন সময় হেরা সূর্যের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে অকালে অস্তগমন করতে আদেশ করলেন। ওসিয়ানাস নদীগর্ভে অস্তাচলে চলে গেল সূর্য। শ্রমসিক্ত কঠোর সগ্রাম হতে বিরত লাভ করে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল গ্রীকরা।

এদিকে ট্রয়বাসীরাও যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে নৈশভোজনের পূর্বে এক মন্ত্রণাসভায় মিলিত হলো। তারা সবাই দাঁড়িয়ে রইল, ভয়ে বসতে পর্যন্ত সাহস পেল না। কারণ বহুদিন বিরত থাকার পর সহসা যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন অ্যাকেলিস। তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি ও ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রজ্ঞাদৃষ্টিসম্পন্ন বীর প্যানথোয়াসপুত্র পলিডেমাস প্রথমে কথা বললেন। তিনি ছিলেন হেক্টরের সহকর্মী এবং সমান মর্যাদাসম্পন্ন। যথোচিত নিষ্ঠা ও শুভেচ্ছা সহকারে তিনি বলতে শুরু করলেন, বন্ধুগণ, আমি তোমাদের অনুরোধ করছি প্রভাতকাল পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা না করে তোমরা নগরমধ্যে চলে যাও। পেলেউসপুত্র অ্যাকেলিস যতদিন অ্যাগামেমননের সঙ্গে কলহে লিপ্ত থাকার জন্য বিরত ছিল যুদ্ধ থেকে ততদিন গ্রীকদের যুদ্ধ করা সহজ ছিল আমাদের পক্ষে। আমরা তাদের রণতরীগুলো দখল করার আশায় তাদের শিবিরের কাছে শিবির স্থাপন করেছিলাম আমাদের। কিন্তু বর্তমানে আমি এই লোকটাকে ভীষণ ভয় করছি, কারণ ও কিছুতেই এই রণক্ষেত্রে যেখানে এতদিন সমপরিমাণ বীরত্ব সহকারে গ্রীক ও ট্রয়সেনারা যুদ্ধ করে আসছে সেখানে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ও আমাদের নগর আক্রমণ করে তা ধ্বংস করবে আমাদের নারীদের হরণ করার জন্য। যা ঘটবে তাই বললাম। সুতরাং আমার কথামত পশ্চাদপসরণ করো। রাত্রিকালের মত যুদ্ধ হতে বিরত থাকবে অ্যাকেলিস। কিন্তু সকাল হতেই পূর্ণ অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত হয়ে যখন সে অবতীর্ণ হবে যুদ্ধে তখন আমরা তার বীরত্বের পূর্ণ পরিচয় লাভ করব। বহু ট্রয়সৈন্য শৃগাল কুকুরের খাদ্যে হবে পরিণত। যারা তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে কোনরকমে তারা সত্যিই ভাগ্যবান। আমার কথামত যদি কাজ করো তাহলে সমস্ত নগরদ্বারগুলো রুদ্ধ করে সুরক্ষিত করে তোল আমাদের নগরীকে, উপরন্তু আমরা রাত্রিকালে মন্ত্রণাসভায় বিষয়টি পর্যালোচনা করার যথেষ্ট অবকাশ পাব। সকাল হলে আমরা সকলে সশস্ত্র অবস্থায় দুর্গপ্রকারের উপর থেকে যুদ্ধ করতে পারি এবং অ্যাকেলিস তার জাহাজ থেকে এসে আমাদের সেই অবস্থায় দেখে হতাশ হয়ে আক্ষেপ করবে। সে তখন আমাদের নগরী ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে তার মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করে আমাদের নগরপ্রাচীরের বাইরে তার রথটিকে ইতস্তত এদিক ওদিক কিছুক্ষণ চালনা করার পর প্রত্যাবর্তন করবে তার শিবিরে।

হেক্টর কিন্তু পলিডেমাসের পানে ভয়ঙ্করভাবে তাকিয়ে বললেন, পলিডেমাস, তুমি আমাদের নগরমধ্যে আবদ্ধ থাকার যে পরামর্শ দান করছ তা আমি মানতে পারছি না। নগরপ্রাচীরমধ্যে এতদিন অবস্থান করেও কি তোমার সাধ মেটেনি? প্রাচীনকালে প্রভৃত ধনসম্পদের জন্য ট্রয়নগরী ছিল সুপ্রসিদ্ধ কিন্তু ক্রোনাসপুত্র জিয়াসের অভিশাপে সে ধনসম্পদ ও মনিমাণিক্যের অনেক কিছু ফার্জিয়া ও মেয়োনিয়াতে বিক্রীত হয়ে গেছে। এখন যখন জিয়াস গ্রীকদের জাহাজ পর্যন্ত তাদের বিতাড়িত করে জয়ের গৌরব অর্জনের প্রতিশ্রুতিপূর্ণ সুযোগ দান করেছেন তখন বৃথা বাক্যব্যয় করে আমাদের সৈন্যদের বিভ্রান্ত করো না। তোমার কথা কেউ শুনবে না। তোমরা সকলে আমার কথামত কাজ করো। এখন সমবেতভাবে সকলে নৈশভোজন সমাপন করো, সারারাত্রি সজাগ থেকে পাহারা দাও। কেউ তার কর্তব্যে শৈথিল্য দেখালে তাকে বার করে দেবে শিবির থেকে। সকাল হলেই আমরা যুদ্ধ শুরু করব। সে যুদ্ধে অ্যাকেলিস অবতীর্ণ হলে ভালই। আমি তাকে ছাড়ব না, আমি নিজে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হব না হয় পরাজিত হব। রণদেবতা সকলের প্রতি সমান বিধান করেন, সেই বিধান অনুযায়ী হত্যাকারীও একদিন নিহত হয়।

হেক্টরের কথা শেষ হতেই নির্বোধ ট্রয়বাসীরা হর্ষধ্বনি করে সে কথাকে সমর্থন করল। প্যালাস এথেন তাদের বুদ্ধিভ্রষ্ট করে তুলেছিল ঠিক সেই সময়ে। তারা হেক্টরের ভ্রান্ত পরামর্শ শুনল, কিন্তু পলিডেমাসের বিজ্ঞজনোচিত কথায় কেউ কান দিল না।

ইতোমধ্যে সারারাত ধরে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ নিয়ে শোকে বিলাপ করতে লাগল গ্রীকরা। সে শোকবিলাপের ক্ষেত্রে সকলের পুরোভাগে রইলেন অ্যাকেলিস। শাবকহারা সিংহের মত ক্রোধান্মত্ত হয়ে মৃত প্যাট্রোক্লাসের বুকে একটি হাত রেখে মামিডনদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, হায়, বৃথাই আমি মীনোতিয়াসকে উৎসাহ দান করে বলেছিলাম, আমি তার বীর পুত্রকে আবার ফিরিয়ে আনব ইলিয়াম নগরী ধ্বংস করার পর। কিন্তু জিয়াস সবার সব কামনা পূরণ করেন না। তবে ট্রয়ের এই রণপ্রান্তরের মাটি আমাদের দুজনের রক্তেই রঞ্জিত হবে, কারণ আমিও বাড়ি ফিরতে পারব না বা বৃদ্ধ নাইট পেলেউসও আমাকে কোনদিন অভ্যর্থনা জানাতে পারবেন না। আমার মাতা থেটিসের কাছেও ফিরে যেতে পারব না কোনদিন। এখানকার মাটিতে চিরদিনের মত সমাধিস্থ রয়ে যাব আমি। কিন্তু যাই হোক, হে প্যাট্রোক্লাস, যে হেক্টর তোমাকে হত্যা করেছে তার মাথা ও বর্ম তোমার পাশে না আনা পর্যন্ত তোমাকে সমাধিস্থ করব না আমি। শুধু তাই নয়, তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে বারোজন ট্রয়বীরের শিরচ্ছেদ করব আমি এবং আমরা আমাদের বাহুবলে ট্রয়নগরী ধ্বংস করার পর যে সব ট্রয়রমণীকে বন্দী করে নিয়ে আসব তারা তোমার জন্য বিলাপ করবে।

অ্যাকেলিসের আদেশে একটি বড় পাত্র জল গরম করে পরে প্যাট্রোক্লাসের সব ক্ষতস্থান ধুয়ে দেওয়া হলো। তারপর একটি সাদা লিলেনের বস্ত্র দ্বারা আবৃত করে দেওয়া হলো সমগ্র মৃতদেহটিকে। জিয়াস তখন হেরাকে বললেন, তাহলে হেরা, এবার দেখছি তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো। কারণ যে গ্রীকরা তোমার আপন অঙ্গের মত প্রিয় তোমার কাছে তাদের জন্য অ্যাকেলিসের ক্রোধকে অবশেষে জাগ্রত করতে পেরেছে।

হেরা উত্তর করলেন, হে বিভীষণ ক্রোনাসপুত্র, কেন তুমি একথা বলছ? হলোই বা মানবসন্তান, সে ইচ্ছা করলে অপর একজনের জন্য কি কিছুই করতে পারে না? স্বর্গের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবী, তোমার সহধর্মিণী এবং একই বংশোদ্ভূতা আমি যদি কারো প্রতি ক্রুদ্ধ হই তাহলে তার ক্ষতিসাধন করতে পারি না?

এইভাবে হেরা ও জিয়াস যখন কথোপকথন করছিলেন, তখন থেটিস চলে গেলেন হিফাস্টাসের স্বর্গস্থিত বাসভবনে। খঞ্জ-দেবতা হিফাস্টাসের নিজের হাতে নির্মিত এই বাসভবনটি সর্বতোভাবেই সুন্দর। থেটিস গিয়ে দেখলেন হিফাস্টাস তখন কুড়িটি স্বয়ংস্ক্রিয় স্বর্গরথ নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন, যে রথগুলো আপনা হতে বিনা অশ্বে সেই বাসভবন হতে স্বৰ্গস্থ দেবসভায় গমনাগমন করতে পারবে।

থেটিস প্রথমে হিফাস্টাসপত্নী চ্যারিসের ঘরে গেলেন। চ্যারিস তাকে তার একটি হাত ধরে বললেন, কি অভিপ্রায়ে আপনি এখানে এসেছেন হে দেবী, আপনি তো বড় একটা আমাদের বাড়ি আসেন না? আপনি আসুন। আসন গ্রহণ করুন। আমি আপনার জলযোগের ব্যবস্থা করছি।

চ্যারিস থেটিসকে সঙ্গে করে ঘরের ভিতর গিয়ে রৌপ্যখচিত এক সুসজ্জিত আসনে বসালেন। সেই আসনের নিচে একটি পা-দানি ছিল। তারপর তিনি হিফাস্টাসকে ডাকলেন, এখানে আসুন হিফাস্টাস, থেটিস আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

তখন প্রখ্যাত খঞ্জ-দেবতা হিফাস্টাস বললেন, তিনি এমনই একজন দেবী যিনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্রী। কারণ আমি খঞ্জ বলে আমার জন্মের পর আমার মাতা যখন স্বর্গলোক হতে মর্তে আমায় ফেলে দেন তখন থেটিস আমার সেবা করে আমাকে সেই পতনজনিত যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্ত করেন। আমার নিষ্ঠুর মাতা ক্রোধবশত যখন আমাকে ফেলে দেন তখন সমুদ্রদেবতা ওসিয়াসকন্যা ইউরিনমি ও থেটিস যদি আমাদের তুলে না ধরতেন তাহলে হয়ত তখনই আমার জীবনাবসান ঘটত। তাঁরা আমাকে কোলে তুলে নেন সযত্নে। নয় বৎসরকাল আমি ছিলাম তাদের কাছে। ব্রোঞ্জনির্মিত কত সুন্দর জিনিস আমি তাঁদের জন্য তৈরি করি। তাঁদের ছিল স্বর্ণবলয়, পানপাত্র, শৃঙ্খল প্রভৃতি জিনিস। যে থেটিস একদিন আমার প্রাণরক্ষা করেছেন তিনি যদি আমার বাসভবনে আসেন তাহলে অবশ্যই আমাকে যথাযযাগ্য সম্মানের সঙ্গে তাকে আপ্যায়িত করতে হবে। এজন্য অবশ্যই এই যন্ত্রপাতি নির্মাণকার্য সরিয়ে রাখতে হবে।

এই কথা বলে হিফাস্টাস তার যন্ত্রপাতিগুলো একটি রৌপৗনির্মিত সিন্দুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে হাপর থেকে উঠে মুখহাত ধুয়ে নিলেন। তারপর পোশাক পরে মানবিক চেতনা সম্পন্ন সুবর্ণনির্মিত দাসীর কাঁধের উপর ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। হিফাস্টাস থেটিসের কাছে এসে একটি সৃদুশ্য আসনে উপবেশন করে থেটিসের একটি হাত টোন নিয়ে বললেন, কি হেতু আগমন আপনার হে দেবী, আপনি তো এখানে আসেন না? বলুন আপনি কি চান। আমার পক্ষে তা সম্ভব হলে আমি অবিলম্বে তা করব।

থেটিস তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন হিফাস্টাস, আমার মত অলিম্পাসের আর কোন দেবীকে ক্রোনাসপুত্র এত দুঃখকষ্ট দান করেছেন তা বলতে পার? সমস্ত জলদেবীর মধ্যে একমাত্র আমাকেই তিনি একজন মরণশীল মানুষের হাতে দান করেন। এখন আমার স্বামী সেই মর্তমানবসন্তান ঈয়াকাসপুত্র পেলেউস বার্ধক্য জর্জরিত অবস্থায় তাঁর গৃহে অবস্থান করেছেন। শুধু তাই নয়, দেবরাজ জিয়াসের ইচ্ছায় আমি এক পুত্র সন্তানও গর্ভে ধারণ করি। তাকে আমি সতেজ সজীব চারাগাছের মত লালন পালন করে মানুষ করে ইলিয়াম নগরীতে পাঠাই ট্রয়যুদ্ধে যোগদানের জন্য। কিন্তু আর তাকে আমি পেলেউস ভবনে নিয়ে যেতে পারব না। জীবনে সে কোনদিন সুখ পায় নি। রাজা অ্যাগামেমনন তার বন্দিনীকে কেড়ে নেওয়ায় সে চোখের জল ফেলতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। সে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ট্রয়সেনারা যখন গ্রীক জাহাজে চলে আসে অগ্নিসংযোগ করার উদ্দেশ্যে তখন গ্রীকরাজন্যবর্গের অনুরোধে নিজে যুদ্ধে না গিয়ে তার সহকর্মী প্যাট্রোক্লাসকে পাঠিয়ে দেয়। সেই প্যাট্রোক্লাস ট্রয়পক্ষে বহু ক্ষয়ক্ষতি করার পর নিহত হয় হেক্টরের হাতে। আমি তাই এখন নতজানু হয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, তুমি আমার প্রিয় পুত্রের জন্য একটি ঢাল ও বর্ম নির্মাণ করে দাও। আমার পুত্রের যে বর্মটি পরিধান করে প্যাট্রোক্লাস যুদ্ধে যায় সেটি ট্রয়বীরেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এবং সেই দুঃখে কাতর হয়ে ভূমিশয্যায় শায়িত হয়ে আছে আমার পুত্র।

হিফাস্টাস উত্তর করলেন, ধৈর্য ধারণ করুন, এবিষয়ে কোনরূপ চিন্তা করবেন না। আমি তার জন্য এমন এক বর্ম নির্মাণ করে দেব যা দেখে বিস্মিত হয়ে যাবে মর্ত্যের মানুষ। হায়, আমি যদি মৃত্যুর সন্ধানী দৃষ্টির হাত থেকে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারতাম আপনার পুত্রকে।

এই বলে তাঁর কর্মশালায় চলে গেলেন হিফাস্টাস। অগ্নিকুণ্ডে রৌপ্য ও স্বর্ণসহ কিছু শক্ত করে পেটানো তামা আর টিন ঢালেন। তারপর এক হাতে হাপর সঞ্চালন করতে লাগলেন। আর এক হাতে করে হাতুড় পিটাতে লাগলেন।

প্রথমে তিনি একটি সুদৃঢ় ও প্রকাণ্ড ঢাল নির্মাণ করলেন। তারপর তার উপর তার শিল্পগত দক্ষতার দ্বারা স্বর্গ ও মর্ত্য ও পাতালের বিভিন্ন দৃশ্য খচিত করে দিলেন। বহু গ্রহ নক্ষত্রের ছবিও খচিত হলো তার উপর। সেই ঢালের উপর হিফাস্টাস দুটি নগরের চিত্রও খোদিত করেন। একটি নগরে রয়েছে কয়েকজন তোক বিবাহ উৎসব উপলক্ষে মশাল হাতে বিয়ের কনেকে নিয়ে চলেছে নগরপথে। বিবাহের ঘটক তীব্ৰস্বরে ঘোষণা করে চলেছে বিবাহের সংবাদ আর যুবক-যুবতীরা বীণা বাজিয়ে নৃত্যগীত করছে। ইতিমধ্যে সেই নগরের আর এক স্থানে একটি বিবাহহেতু লোক সমবেত হয়েছে। সেখানে দুটি বিবদমান লোকের একজন আর একজনের কাছ থেকে তার আত্মীয় হত্যার ক্ষতিপূরণস্বরূপ কিছু অর্থের দাবি করছিল। তার প্রতিপক্ষ ব্যক্তিটি বলছিল, সে সে-অর্থ দিয়ে দিয়েছে। দুজন বিবদমান ব্যক্তিই আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি দেখাচ্ছিল। প্রস্তরাসনে আসীন বিচারকেরা তা মন দিয়ে শুনছিলেন। তারপর বিচারকেরা একে একে উঠে দাঁড়িয়ে আপনআপন রায় দান করলেন। যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ রায় দান করলেন তিনি দুটি স্বর্ণমুদ্রা লাভ করলেন পুরস্কার হিসেবে।

আর একটি নগরে দেখানো হয়েছে শত্রুদ্বারা আক্রান্ত সেই নগরের প্রান্তদেশে স্থাপিত শিবিরে শত্রুপক্ষীয় লোকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। তাদের মধ্যে একদল বলছে নগরটিকে ধ্বংস করা হোক, আর একদল বলছে নগরটিকে ধ্বংস না করে তাকে জয় করে অর্ধেক ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা হোক।

কিন্তু সেই শহরের লোকরা বিনা যুদ্ধে নিজেদের শহরকে বিলিয়ে দেবে না আক্রমণকারীদের হাতে। তাই তারা নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্গপ্রকারের উপর সুরক্ষিত অবস্থায় রেখে নিজেরা বর্ম পরিধান করে এগিয়ে চলল নগরপ্রান্তে। যুবকরা তাদের অনুসরণ করতে লাগল। তাদের মাথার উপর ছিল রণদেবতা অ্যারেস আর প্যালেস এথেনের ছবি। নগরদ্বারের বাইরে গিয়ে তারা একটি নদীর ধারে লুকিয়ে রইল শত্রুদের অপেক্ষায়। এমন সময় দুজন রাখাল একপাল গবাদি পশু নিয়ে বাঁশী বাজাতে বাজাতে মাঠে চরাতে এল। তারা কোন বিপদের কথা ভাবতেই পারে নি। কিন্তু আত্মগোপনকারী সৈনিকেরা সেই রাখাল দুজনকে হত্যা করে নির্বিচারে পশুগুলোকে বধ করল। এই সব হত্যাকার্যকালে যে সব চিৎকার ও গোলমাল হচ্ছিল তা শুনে অবরোধকারী সৈন্যরা সজাগ হয়ে উঠে আক্রমণ শুরু করে দিল। জীবন্ত মানুষের মত দুই দলে যুদ্ধ করতে লাগল।

সেই ঢালের উপর সুদৃশ্য বিশাল এক প্রান্তরের ছবিও খচিত ছিল। বহু লোক সেই প্রান্তরস্থ ভূমিটিকে কর্ষণ করেছিল। একটি লোক এসে সেই সব ভূমিকৰ্ষণকারীদের হাতে এক কাপ করে চা দিয়ে গেল। যদিও মাঠটি ছিল স্বর্ণখচিত, তথাপি তা দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিকারের কর্ষিত এক মাঠ।

পাকা ফসলে ভরা আর একটি সোনার ছবি খচিত করেছিলেন হিফাস্টাস। কয়েকজন্য শস্যকর্তনকারী শস্য কর্তন করছিল আর সেই সব কর্ষিত শস্য আঁটি করে বাঁধছিল অন্য কয়েকজন। কয়েকজন বালকভৃত্য ফসলের ঝোলাগুলো এক জায়গায় জড়ো করছিল। একটি ওকগাছের তলায় ভৃত্যেরা তাদের মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা করছিল। একটি বড় বলদ বলি দিয়ে তারা সেটিকে কাটছিল আর মেয়েরা যবের দানা ছড়াচ্ছিল তার উপর।

সেই ঢালের উপর ছিল আর একটি আঙ্গুর ক্ষেতের ছবি। রূপোর সুতোয় কালো আঙ্গুরের থোকাগুলো ঝুলছিল। সেই আঙ্গুর ক্ষেতে যাবার একটি পথ ছিল। সেই পথ দিয়ে মদ তৈরির জন্য আঙ্গুর আনতে যাচ্ছিল কিছু লোক। আনন্দোচ্ছল যুবক-যুবতীরা ঝুড়িতে করে ফল তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। একটি বালক বাঁশি বাজিয়ে গান করছিল আর যুবক-যুবতীরা তালে তালে নাচছিল ।

শৃঙ্গধারী একপাল গরু আর পার্বত্য উপত্যকার উপর অবস্থিত গোচারণক্ষেত্রও খচিত হয়। সোনার টিন দিয়ে তৈরি গরুগুলো নদীর ধারে নলখাগড়া গাছগুলোর মধ্যে চরছিল। একটা সিংহ সেই পালের ভিতর থেকে একটি বলদকে ধরে টানছিল আর তার গা থেকে রক্ত ঝরছিল। চারজন রাখাল সিংহটাকে তাড়া করছিল, কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছিল সিংহটার চারিপাশে। তবু সিংহটা যাচ্ছিল না।

আর একটা সবুজ জায়গা ছিল যার উপর তরুণ যুবক-যুবতীরা হাত ধরাধরি করে নাচছিল। মেয়েদের গলায় ছিল মালা আর ছেলেদের হাতে ছিল রূপোর খাপে তৈরি সোনার ছবি। ছেলেমেয়েরা বৃত্তাকারে নাচছিল আর চারিপাশে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। একজন চারণকবি বীণা বাজাচ্ছিল। সেই প্রকাণ্ড ঢালটির একধারে ওসিয়ানাস নদীটিও খচিত ছিল।

এই ঢালটি ছাড়া জ্বলন্ত আগুনের থেকে উজ্জ্বল এক ধাতব বক্ষাবরণীও নির্মাণ করেন হিফাস্টাস। এছাড়া একটি শিরস্ত্রাণও নির্মাণ করে যার মাথায় ঝুলছিল সোনার পালক।

অবশেষে এইভাবে ঢাল, বর্ম ও শিরস্ত্রাণটি নিয়ে গিয়ে অ্যাকেলিসের মাতাকে দান করলেন হিফাস্টাস। আর সঙ্গে সঙ্গে থেটিসও অলিম্পাস পর্বতের তুষারাবৃত্ত শিখরদেশে অবস্থিত হিফাস্টাসের বাসভবন হতে যাত্রা করে রাজপাখির মত উড়ে চললেন ট্রয়ের বন্দরে অবস্থিত গ্রীকরণতরীগুলোর অভিমুখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *