১৭. প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের চারপাশে যুদ্ধ

সপ্তদশ পর্ব
প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের চারপাশে যুদ্ধ

আত্রেউসপুত্র মেনেলাস স্বচক্ষে দেখলেন প্যাট্রোক্লাসের পতন ঘটেছে। তা দেখার সঙ্গে সঙ্গে বর্মপরিহিত অবস্থায় ছুটে গেলেন তিনি তাঁর মৃতদেহের দিকে। গাভীমাতা যেমন তাঁর প্রথম নবজাত গোবৎসের জন্য আকুলভাবে হাম্বার করতে থাকে তেমনি আকুল হয়ে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি রক্ষা করার জন্য ছুটে গেলেন সুকেশী বীর মেনেলাস। তিনি মৃতদেহের সামনে তার বড় ঢাল ও বর্শাটি এমনভাবে ধরে রইলেন যাতে মনে হলো, যে তার সামনে যাবে তাকে তিনি হত্যা করার জন্য দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু ট্রয়বীর প্যানথোয়াসপুত্রও মৃতদেহটি লক্ষ্য করেছিল। সে মেনেলাসকে দেখে তাঁর কাছে এগিয়ে এসে বলল, রক্তাল্পত এই মৃতদেহটিকে ছেড়ে চলে যাও আত্রেউসপুত্র মেনেলাস। ট্রয়বীরদের মধ্যে আমিই প্রথম বর্শাবিদ্ধ করি প্যাট্রোক্লাসের দেহটিকে। সে জয়ের পূর্ণ গৌরব আমাকেই লাভ করতে দাও। আর তা যদি না দাও তাহলে আমি তোমাকেও হত্যা করব।

ক্রুদ্ধ মেনেলাস উত্তর করলেন, পরম পিতা জিয়াসের নামে শপথ করে বলছি, বড়াই করা গর্ব করা সত্যিই খুব খারাপ কাজ। প্যানতোয়াসের পুত্রদের থেকে নেকড়েও বেশি উদ্ধত নয় আর সবচেয়ে হিংস্র জন্তু বন্য শূকরও বেশি বর্বর নয়। তথাপি মনে রেখো, আমাকে একজন সামান্য হীন গ্রীকসেনা ভেবে তুচ্ছজ্ঞান করার জন্য হাইপীরেনর তার যৌবনকাল শেষ না হতেই ইহলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সে তার স্ত্রী ও পিতামাতার আনন্দ বর্ধনের জন্য আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেনি। যদি তুমি আমাকে বাধা দাও, তাহলে তোমারও তেমনি অবস্থা করব। সুতরাং চলে যাও এখান থেকে। বাস্তব অবস্থা ও ঘটনা থেকে নির্বোধরা অনেক জ্ঞানের কথা শিখতে পারে।

এফোরবাস সেকথা শুনল না। সে বলল, আমার যে ভ্রাতার নববধুকে তার বাসর ঘরেই বিধবা করেছ, তার পিতামাতাকে শোকসাগরে নিমগ্ন করেছ, সে মৃত্যুর ঋণ তোমাকেই শোধ করতে হবে। আমি তোমার মাথাটা যদি সেই সব শোকতপ্ত ব্যক্তিদের কাছে নিয়ে যেতে পারি তাহলে কিছুটা সান্ত্বনা অন্তত তারা পারেন। এখন দেখছি। যুদ্ধের দ্বারাই ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে হবে।

এই বলে মেনেলাসকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করল এফোবাস। কিন্তু সে বর্শা মেনেলাসের ঢালটিকে ভেদ করতে না পেরে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। এরপর এফোবাস যখন পালিয়ে যাচ্ছিল তখন মেনেলাস পিছন থেকে তাঁর বর্শার দ্বারা তার ঘাড়টিকে বিদ্ধ করলেন। সে পড়ে যেতেই রৌপ্য ও স্বর্ণবন্ধনীতে বাঁধা তার সুন্দর চুলগুলো রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠল। জলের ধারে সজীব ও সতেজভাবে বেড়ে উঠা কোন কুসুমিত অলিভগাছ যেমন সহসা কোন মত্ত প্রভঞ্জনের আঘাতে নির্মূল হয় অকালে, তেমনি তরুণ যুবক এফোবাসের জীবনেরও অকালে অবসান ঘটল মেনেলাসের হাতে। প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটির পাশে ভয়ঙ্করভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন মেনেলাস। শক্তিমত্ত কোন সিংহ যেমন পাল থেকে গোবৎসকে তুলে নিয়ে তাকে একে একে ভক্ষণ করতে থাকলেও কোন রাখাল বা কুকুর যেতে পারে না তার কাছে তেমনি প্যাট্রোক্লাসেরও মৃতদেহের সামনে প্রহরারত মেনেলাসের কাছেও কেউ যেতে পারল না। এফোরবাসের মৃতদেহ হতে তার বর্মটি অনায়াসেই খুলে নিয়ে যেতে পারতেন মেনেলাস, যদি না ফীবাস অ্যাপোলো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন সহসা। তিনি সিকনস জাতির দলপতি মেন্তেসের ছদ্মবেশ ধারণ করে হেক্টরকে বললেন, হেক্টর, ঈয়াকাসের অশ্ব দুটির পিছনে ছুটো না। ও অশ্ব দেবমাতার গর্ভজাত, অ্যাকেলিস ছাড়া আর কোন মানবসন্তান চালিত বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে না। এখন দেখ, মেনেলাস কি ভাকে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে প্রহরা দিচ্ছে এবং এফোরবারকে বধ করেছে।

এই কথা বলে চলে গেলেন অ্যাপোলো। নিবিড় দুঃখের ঘনকৃষ্ণমেঘ আচ্ছন্ন হয়ে উঠল হেক্টরের অন্তর। তিনি দেখলেন ভূতলশায়ী এফোরবাসের অসাড় দেহ হতে তখনো রক্ত ঝরছে, তার দেহ হতে বর্ম খুলে নিচ্ছেন মেনেলাস। তা দেখে এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মত সেদিকে ছুটে গেলেন উজ্জ্বল বর্ম পরিহিত হেক্টর। তাঁর প্রবল রণহুঙ্কার শুনে মেনেলাস ভাবলেন, হায়, আমি এখন কি করব? যে প্যাট্রোক্লাস আমার জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে তার গাত্র হতে ট্রয়বাসীরা বর্ম খুলে নেবে এটা কখনই আমি হতে দিতে পারি না। তাহলে গ্রীকরা আমায় লজ্জা দেবে। কিন্তু যদি একা হেক্টর ও তার দ্বারা একত্রিত ট্রয়সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করি তাহলে সেটা কখনই শুভ হবে না আমার পক্ষে। এতে আর ইতস্তত করার কি আছে? কোন মানুষ কখনো দেবতাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেববল্লভ বা দেবানুগৃহীত কোন ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধ না করে চলে যাই তাহলে গ্রীকরা আমার দোষ দেবে না। কারণ দেবতারা ওর সহায়। কিন্তু আমি যদি অ্যাজাক্সকে পেতাম আমার পাশে তাহলে অ্যাকেলিসের খাতিরে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি রক্ষা করার জন্য আমি হেক্টর ও এমন কি দেবতাদের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারতাম।

এইভাবে দ্বিধাবিভক্ত চিত্তে ভাবছিলেন যখন মেনেলাস, তখন হেক্টর দলবদ্ধভাবে এগিয়ে এলেন প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের পানে। দলবদ্ধ মানুষ বা কুকুরদের দ্বারা তাড়িত কোন পশু যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাগতভাবে সরে যায় তেমনি প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ ছেড়ে সরে গেলেন মেনেলাস। কিছুদূরে গিয়ে বাঁদিকে তেলামনপুত্র অ্যাজাক্সকে দেখতে পেলেন। অ্যাপোলোর দ্বারা আতঙ্কগ্রস্ত গ্রীকসেনাদের তখন উত্তেজিত করছিলেন অ্যাজাক্স। তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে মেনেলাস বললেন, হে আমার বন্ধু এস, আমার সঙ্গে যোগ দাও যাতে আমরা প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি অ্যাকেলিসের কাছে নিয়ে যেতে পারি তার জন্য চেষ্টা করো। হেক্টর তার বর্ম খুলে নিচ্ছে।

এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে হেক্টরের দিকে ছুটে গেলেন অ্যাজাক্স। মেনেলাসও তাঁর সঙ্গে গেলেন। দেখলেন, হেক্টর প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ থেমে বর্ম খুলে নিয়েছে এবং তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার গলাটা কেটে ট্রয়ের কুকুরদের খাওয়াবার জন্য। অ্যাজ্যাক্স বীরবিক্রমে সেদিকে এগিয়ে যেতেই হেক্টর পালিয়ে গিয়ে রথে চাপলেন। অন্যান্য ট্রয়সেনাদের আদেশ দিয়ে গেলেন তারা যেন প্যাট্রোক্লাসের বর্মটি হেক্টরের বিজয়চিহ্ন স্বরূপ ট্রয়নগরীতে নিয়ে যায়। অ্যাজাক্স তখন তার বিশাল ঢালটি দিয়ে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি ঢেকে রাখলেন। কোন সিংহমাতা যেমন শিকারীদের নিষ্ঠুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তার সমস্ত শক্তির প্রচণ্ডতা দিয়ে তার শাবকগুলোকে প্রহরা দেয় তেমনি অ্যাজাক্সও প্রহরা দিতে লাগলেন সেই মৃতদেহটিকে। তার পাশে নীরব দাঁড়িয়ে রইলেন শোকমগ্ন মেনেলাস।

হিপ্পোলোকাসপুত্র গ্লকাস তখন ক্রুদ্ধ হয়ে হেক্টরকে বললেন, হেক্টর, তুমি বাইরে যে বীরত্বের বড়াই করো যুদ্ধক্ষেত্রে সে বীরত্বের পরিচয় দিতে পার না। তোমার মত যে লোক যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যায় সে কখনো কোন যশের দাবি করতে পারে না। এইবার দেখ কিভাবে তুমি তোমার ইলিয়াম নগরী ও তার অধিবাসীদের রক্ষা করবে। এবিষয়ে লাইসিয়াবাসীদের কাছ থেকে কোন সাহায্য আর পাবে না। তারা যে কষ্ট এতদিন এ যুদ্ধে ভোগ করে এসেছে তার জন্য কি প্রতিদান তারা পেয়েছে। সে সার্পেডন একাধারে ছিলেন তোমার সম্মানিত অতিথি ও যুদ্ধে সহকর্মী, সেই সার্পেনকে গ্রীকদের কবলে ফেলে যদি পালিয়ে যেতে পার তাহলে তার থেকে কম প্রসিদ্ধ বীরকে কখনই তুমি সাহায্য করবে না। যতদিন সার্পেৰ্ডন জীবিত ছিলেন তিনি তোমাদের নগররক্ষার জন্য প্রাণপণ শক্তিতে যুদ্ধ করেছেন আর তুমি তার মৃতদেহটিকে কুকুরদের ভক্ষণের জন্য ফেলে রেখে চলে যাও। লাইসিয়াবাসীরা একথা শুনলে চলে যাবে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। শত্রুদমন ও দেশের জন্য যুদ্ধ করার জন্য তেজস্বিতা যদি ট্রয়বাসীদের মধ্যে থাকে তাহলে তারা প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে ইলিয়াম নগরীতে নিয়ে যাবেই। এই মৃতদেহটি আমরা নিয়ে গেলেই গ্রীকরা সার্পেডনের বর্মটি আমাদের প্রত্যর্পণ করবে। কারণ প্যাট্রোক্লাস যার সারথি তিনি হচ্ছেন গ্রীকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। সব জেনেও তুমি অ্যাজাক্সের সামনে দাঁড়াতে পারছ না, যেহেতু সে তোমার থেকে আরো বড় বীর।

গ্লুকাসের একথা শুনে গর্জন করে উঠলেন হেক্টর। বললেন, আমি তোমাকে বুদ্ধিমান বলে জানতাম। কিন্তু অ্যাজাক্সের ভয়ে আমি ভীত একথা বলার জন্য আমি তোমায় ঘৃণা করি। আমি কখনই যুদ্ধকে ভয় করি না। তাছাড়া জিয়াসের আশীর্বাদ আছে আমাদের মাথায়। যাই হোক, এস বন্ধু আমার সঙ্গে একযোগে যুদ্ধ করো। দেখ আমি কাপুরুষের মত পালিয়ে যাই না, প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে ঘিরে প্রহরারত গ্রীকদের প্রতিহত করি।

এরপর ট্রয়সৈন্যদের যুদ্ধে আহ্বান জানিয়ে বললেন হেক্টর, তোমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করো। যে প্যাট্রোক্লাসকে আমি হত্যা করেছি তার বর্মটি পরিধান করে আমি অবিলম্বে আসছি।

প্যাট্রোক্লাস পরে এসেছিলেন অ্যাকেলিসের বর্মটি। সেই বর্মটি প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ থেকে খুলে নিয়ে পালাচ্ছিল ট্রয়সৈনরা। হেক্টর কিছুদূরে গিয়ে তাদের থামিয়ে বর্মটি নিয়ে পরিধান করে নিজের বর্মটি ট্রয়নগরীতে পাঠিয়ে দিলেন। এই অক্ষয় বর্মটি দেবতারা দান করেছিলেন পেলেউসকে এবং পেলেউস পরে এটি তাঁর পুত্রকে দান করেন।

জলদ ও পবনাধিপতি জিয়াস অ্যাকেলিসের বর্ম পরিহিত অবস্থায় হেক্টরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপন মনে মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে বললেন, হায় হতভাগ্য মানব, তুমি এমন এক বীরের বর্ম পরিধান করেছ আজ যার সামনে অনেক বীরের হৃদয়ও বিকম্পিত। তোমার যে শেষ পরিণতি অতি আসন্ন সে বিষয়ে কিছুই জান না তুমি। তুমি তার এমন এক সহকর্মীকে হত্যা করেছ, যে ছিল একাধারে সাহসী ও শক্তিমান। কিন্তু তার বর্মটি তার দেহগাত্র হতে খুলে নেওয়া সমীচীন হয়নি তোমার পক্ষে। বর্তমানে আমি অবশ্য এক বিরাট শক্তির ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান করে তুলে তোমায় কিন্তু তোমার এই হীন কাজের জন্য তুমি কখনই এই বর্মটি তোমার স্ত্রী অ্যান্ড্রোমেকের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না।

স্বর্গলোক হতে এক তৎপর্যপূর্ণ ভ্রুকুটি করলেন ক্রোনাসপুত্র। অ্যাকেলিসের বর্মটি খাপে খাপে বসে গেল হেক্টরের গায়ে। এমন সময় রণদেবতা অ্যারেস সূক্ষ্ম শরীরে তার দেহমধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে সাহস ও শক্তি সঞ্চার করলেন। হেক্টর তখন বীরদর্পে তাঁর মিত্রপক্ষীয় সেনাদলের নিকটে গেলেন। তাঁর সেই দেহগাত্রস্থিত বর্মের অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি নিজেই যেন পেলেউসপুত্র অ্যাকেলিস। তিনি যাদের কাছে গিয়ে উৎসাহিত করতে লাগলেন তাঁরা হলেন মেনথলেস, গ্নকাস, মীডন, থার্সিলোকাস, অ্যাসটাররোপিয়াস, দিসেনর, হিপ্পোয়োরাস, ফোরয়, ক্রেমিয়স ও এনোমাস। ভর্ৎসনার সুরে তাদের শিক্ষা দেবার জন্য বললেন হেক্টর, হে আমার মিত্রশক্তিবর্গ, আমার কথা শোন, তোমরা যারা দূর দেশ থেকে এখানে এসে সমবেত হয়েছ, তারা মনে রেখো, এখানে তোমাদের ভিড় করার জন্য ডাকি নি। তোমরা ভয়ঙ্কর গ্রীকদের হাত থেকে ট্রয়বাসীদের স্ত্রী-পুত্রদের রক্ষা করবে যথাশক্তি প্রয়োগ করে, এইজন্যই তোমাদের এখানে ডাকা হয়েছে। এইজন্যই আমার দেশস্থ জনগণ ভরণপোষণ জোগায় ও তোমাদের নানা রকম উপহার দেয়। সুতরাং যুদ্ধের রীতি অনুসারে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে হয় জয়লাভ করো অথবা মৃত্যুবরণ করো। তোমাদের মধ্যে যেকেউ অ্যাজাক্সকে সরে যেতে বাধ্য করে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি নিয়ে আসতে পারবে তাকে আমি আমার সম্পত্তির অর্ধেক দান করব।

হেক্টরের কথায় ট্রয়সেনারা একযোগে বর্শাগুলো সামনে উঁচিয়ে ধরে আক্রমণ করল গ্রীকদের। তাদের প্রত্যেকের মনে এই আশা জাগল যে তারা তেলামনপুত্র অ্যাজাক্সকে বাধ্য করবে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে ছেড়ে যেতে। তারা নির্বোধ বলেই তাদের এত সৈন্য হত হচ্ছে অ্যাজাক্সের হাতে।

অবশেষে অ্যাজাক্স মেনেলাসকে বললেন, হে আমার প্রিয় বন্ধু মেনেলাস, তুমি ও আমি দুজনে কিছুতেই এ যুদ্ধ হতে জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে যেতে পারব না। আমার মতে এখন প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের থেকে তোমার ও আমার নিরাপত্তার মূল্য অনেক বেশি। কারণ তার মৃতদেহ একটু পরে ট্রয়ের কুকুর ও শকুনিদের খাদ্যে পরিণত হবে। হেক্টর আমাদের চারিদিকে এমনভাবে যুদ্ধের জাল পেতে ঘিরে ফেলেছে সে আমাদের পরিত্রাণের কোন আশা নেই। এখন গ্রীকরাজন্যবর্গকে ভেবে দেখতে বল তারা কি বলে।

মেনেলাস তখন যথাসাধ্য জোর গলায় গ্রীকরাজন্যবর্গকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বন্ধুগণ, আমাদের এখানে যুদ্ধ এত জোর চলছে যে, আমি তোমাদের কাউকে চিনতে পারছি না পৃথকভাবে। তোমরা সকলেই স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে যুদ্ধ করো। প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি ট্রয়কুকুরদের খাদ্য হবে এটা কি লজ্জার কথা মনে হয় না তোমাদের?

মেনেলাসের কথা শুনে প্রথম এগিয়ে এল অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স। তার পর এল আইডোমেনেউস ও তার সারথি ও সহকর্মী মেরিওনস। ওদিকে ট্রয়সৈন্যরাও হেক্টরের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধভাবে এগিয়ে গেল। সমুদ্রগর্ভোঙ্খিত কোন উন্নত পাহাড় বা কোন নদীমোহনার দিকে প্রধাবিত গর্জনশীল সমুদ্রতরঙ্গের মত ছুটে চলল ট্রয়সৈন্যরা। এদিকে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে ব্রোঞ্জনির্মিত ঢাল দিয়ে ঢেকে তাকে রক্ষা করার জন্য গ্রীকরাও হয়ে উঠেছিল বদ্ধপরিকর। তার উপর এক ঘন মেঘাবরণ সৃষ্টি করে তা দিয়ে তাদের শিরস্ত্রাণগুলোর উজ্জ্বলতা ঢেকে দিলেন জিয়াস। তিনি একই সঙ্গে প্যাট্রোক্লাসের দেহটাকে কুকুরের খাদ্যে পরিণত করতে এবং গ্রীকসেনাদেরও সাহায্য করতে চাইছিলেন তাদের সহকর্মীর দেহটিকে রক্ষা করার জন্য।

ট্রয়সৈন্যরা শত্রুপক্ষীয়দের কাউকে হতাহত করতে না পারলেও মৃতদেহটিকে টেনে নিয়ে গেল। গ্রীকদের তাড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু পরমুহূর্তে তরুণ শিকারীদল তাড়িত বন্য শূকরের মত এক ভয়ঙ্কর হিস্রতার সঙ্গে অ্যাজাক্স একদল সৈন্য নিয়ে নতুন করে আক্রমণ করলেন ট্রয়সৈন্যদের। নেশাসপুত্র হিপ্পোতোয়াস এবং প্যাট্রোক্লাসের পায়ে একটি দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। অ্যাজাক্স ছুটে গিয়ে তার মাথায় সজোরে আঘাত করতেই হাতের দড়ি ছেড়ে পড়ে গেল হিপ্লোথোয়াস। ওইভাবে এক বিশাল সমৃদ্ধিশালিনী দেশ ল্যারিসা হতে বহু দূরে বিদেশের ভূমিতে নিহত হলো হিপ্পোথোয়াস। হেক্টর তখন অ্যাজাক্সকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু অ্যাজাক্স তা আগে হতে দেখতে পেয়ে সরে যাওয়ায় সে বর্শা লাগল ফোসিয়ার দলপতি ইপথিয়াসপুত্র স্কেদিয়াসের ঘাড়ে। তখন অ্যাজাক্সও একটি বর্শার দ্বারা ফোরসির উপরদেশ বিদ্ধ করে সব নাড়ীভূঁড়ি বার করে ফেললেন। গ্রীকরা তখন এক বিপুল বিজয়োল্লাসে ধ্বনি দিতে দিতে ফোরসি ও হিপ্পোথোয়াসের মৃতদেহটি টেনে নিয়ে গিয়ে বর্মটি খুলে নিল।

গ্রীকদের সামনে দাঁড়াতে না পেরে ট্রয়সৈন্যরা হয়ত তাদের নগরে ফিরে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হত যদি না অ্যাপোলো ইপিটানপুত্র ফেরিফাসের ছদ্মরূপ ধারণ করে ঈনিসকে যুদ্ধে নতুন উদ্যমে প্রবৃত্ত হতে বলতেন। তিনি বললেন, হে ঈনিস, যুদ্ধের অবস্থা আমাদের প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও তুমি কি আমাদের ইলিয়াম নগরী রক্ষা করতে পারবে না? আমি এমন অনেক জাতির কথা জানি, যারা জিয়াসের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শুধু সাহস ও স্বাবলম্বনের দ্বারা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু আজ যদি ভীত না হয়ে তুমি যুদ্ধ করো তাহলে জিয়াস আমাদের অবশ্যই দান করবেন জয়ের গৌরব।

ঈনিস অ্যাপোলোকে দেখে চিনতে পারলেন এবং হেক্টরকে ডেকে বললেন, হে বীর হেক্টর, আমরা যদি আমাদের কাপুরুষতাবশত গ্রীকদের হাতে পরাজিত হয়ে ইলিয়াম নগরীতে গিয়ে আশ্রয় নিই তাহলে সেটা হবে অতীব লজ্জার কথা। সুতরাং চল আমরা গ্রীকদের আক্রমণ করি যাতে তারা প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ বয়ে নিতে যেতে না পারে।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঈনিস এগিয়ে এসে সর্বাগ্রে আক্রমণ করল গ্রীকদের। সে প্রথমে লাইকোমেদিসের অনুচর লিওক্রিটাসকে বর্শার দ্বারা আঘাত করল। তা দেখে মর্মাহত হয়ে লাইকোমেদিস হিপ্পাসাসপুত্ৰ এপিলাওনকে আক্রমণ করল। পিওনিয়া হতে আগত এপিলাওনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটল লাইকোমেদিসের বর্শার আঘাতে। তা দেখে অ্যাস্টরোপীয়াস ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করল গ্রীকদের। কিন্তু বীর অ্যাজাক্সের কঠোর আদেশে গ্রীকরা তাদের ঢাল দিয়ে প্যাট্রোক্লাসের দেহটাকে ঢেকে এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যেখানে কোন ট্রয়বীর এগিয়ে যেতে পারছিল না। অ্যাজাক্সের কঠোর আদেশ ছিল, প্রহরারত কোন গ্রীকসেনা যেন সে দেহ ছেড়ে দিয়ে প্রাণ থাকতে কোথাও না পালায়। ফলে উভয়ক্ষেই প্রচুর লোক হতাহত হতে লাগল।

সেদিন আকাশে কোন মেঘ ছিল না। প্রসন্ন পর্যাপ্ত সূর্যালোকে পরিপূর্ণ ছিল পৃথিবী। সেই উজ্জ্বল সূর্যালোকে গ্রীকরা রণক্ষেত্রের দুই স্থানে দুটি প্রধান দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করছিল শত্রুদের সঙ্গে। এক স্থানে তাদের একটি দল বীর অ্যাজাক্সের আদেশে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে বেষ্টন করে যুদ্ধ করছিল। আর এক স্থানে তারা বীর নেস্টরের আদেশে প্রতিহত করছিল ট্রয়সৈন্যদের। গ্রীকবীর প্রেসিমেদিস ও অ্যান্টিলোকাস তখনো পর্যন্ত বীর প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যু সংবাদ শোনেন নি। তাঁদের ধারণা তখনো জীবিত আছেন প্যাট্রোক্লাস।

সেদিন প্যাট্রোক্লাসের দেহটিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধের অবতারণা করলেন লীলাময় দেবরাজ জিয়াস, তা সত্যিই তুলনাহীন। প্যাট্রোক্লাসের দেহের একটি অংশ ধরে ট্রয়বাসীরা ইলিয়ামে নিয়ে যাবার জন্য টানতে লাগল আর এক অংশ গ্রীকরা তাদের জাহাজে নিয়ে যাবার জন্য টানতে লাগল। সেই ঘোরতর যুদ্ধ দেথে রণদেবতা অ্যারেস ও দেবী এথেন তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারলেন না।

এদিকে অ্যাকেলিস তখনো জানতে পারেননি প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যু ঘটেছে, কারণ গ্রীক জাহাজ হতে অনেক দূরে ট্রয়নগরীর দুর্গ-প্রাচীরের কাছে যুদ্ধ হচ্ছিল বলে সে সংবাদ তিনি তখনো পান নি। তার ধারণা ছিল প্যাট্রোক্লাস ট্রয়সেনাদের ট্রয়ের দুর্গদ্বার পর্যন্ত তাড়না করে নিয়ে গিয়ে ফিরে আসবে তাঁর কাছে। তিনি জানতেন প্যাটোক্লাস অ্যাকেলিসের সঙ্গে ছাড়া বা তাকে বাদ দিয়ে কোনক্রমেই ট্রয়নগরী ধ্বংস করতে পারবে না। একথা জিয়াসের কাছে থেকে শুনে তাঁকে জানাল না তাঁর মাতা থেটিস। কিন্তু তার মাতা থেটিস তাঁর সহকর্মীর মধ্যে যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন তার মৃত্যুসংবাদটি তাঁকে জানান নি।

গ্রীকসৈন্যরা তখনো যুদ্ধ করতে করতে একে অন্যকে প্রায়ই বলছিল প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ যদি ট্রয়বাসীরা নিয়ে যায় তাহলে আমরা আর এ মুখ গ্রীকজাহাজে গিয়ে দেখাতে পারব না কখনো। তার থেকে আমাদের মৃত্যুও ভাল। ধরীত্ৰীমাতা যেন আমাদের গ্রাস করেন।

অন্যদিকে ট্রয়সৈন্যরা একে অন্যকে বলছিল, বন্ধুগণ, আমাদের যদি এতে সকলের মৃত্যু ঘটে তাহলেও যেন ভয়ে চলে যেও না। যুদ্ধ করে যাও সমানে। দুই পক্ষের অস্ত্রের ঘর্ষণজনিত বিপুল শব্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল সমগ্র আকাশ। ঈয়াকাশের অশ্বগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের একপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন করছিল নীরবে, কারণ তারা এবার প্রথম জানতে পারল তাদের সারথি প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যু ঘটেছে নরঘাতক হেক্টরের আঘাতে। অটোমীডন তাদের পিঠে চাবুক মেরে রথ চালনা করে রণক্ষেত্রের মধ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের অনেক মিষ্ট কথায় তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন। আবার অনেক ভর্ৎসনাও করলেন। কিন্তু অশ্বগুলো এক পাও নড়ল না। তারা সারথির জন্য নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে যেতে লাগল। তারা হেলেসপন্ট উপসাগরের বিশাল জলরাশির কাছে গেল না, অথবা রণক্ষেত্রে গ্রীক সেনাদের মাঝেও ফিরে গেল না; তারা তাদের সেই মৃত সারথিকে নিয়ে কোন সমাধিস্তম্ভের মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের উদ্ধত কেশরগুলো নত হয়ে জোয়ালের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল তাদের কাঁধের দুই পাশে।

ক্রোনাসপুত্র স্বর্গ থেকে তাদের পানে তাকিয়ে তাদের জন্য অনুকম্পা অনুভব করলেন। তিনি আপন মনে বিড় বিড় করে বললেন, আমি কেন যে রাজা পেলেউসকে দান করেছিলাম তোমাদের তা আমি নিজেই জানি না। রাজা পেলেউস একজন মরণশীল মানুষ, অথচ তোমরা দেবাশ্ব বলে অমর। তোমরা কি মৰ্তমানবের দুঃখে কাতর হচ্ছ? পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তার মধ্যে মানুষই করুণার পাত্র। তবে বলে দিচ্ছি, হেক্টর তোমাদের রথকে পরিচালনা করবে না। সে তার অস্ত্র নিয়ে অনেক বড়াই করে বেড়িয়েছে, অনেক কৃতিত্ব দেখিয়েছে। যাই হোক, আমি তোমাদের যুদ্ধক্ষেত্র হতে গ্রীকজাহাজের দিকে অটোডীমনকে বয়ে নিয়ে যাবার মত শক্তি দান করব, কারণ আমি ট্রয়বাসীদের আরও কিছু জয়ের গৌরব দিতে চাই এবং গ্রীকজাহাজে যাবার পথে তারা আরও কিছু গ্রীকসেনা হত্যা করবে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে আসবে রাত্রির অন্ধকার।

এই কথা বলে সেই দেবাশ্বদুটির দেহে শক্তি ও উদ্যম সঞ্চার করলেন জিয়াস আর সঙ্গে সঙ্গে তারা উঠে পড়ে মুহূর্তমধ্যে অটোডীমনকে যুদ্ধরত গ্রীক ও ট্রয়সৈন্যদের মাঝে নিয়ে গেল ছুটে। দুঃখে তার চিত্ত ভারাক্রান্ত হলেও শান্ত ভীরু রাজহংসীদের মাঝে শিকারী শকুনির মত এক হিংস্র বিক্রমে ফেটে পড়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন অটোডীমন। কিন্তু শত চেষ্টাতেও কোন শত্রুসৈন্য নিহত করতে পারলেন না, কারণ তিনি রথে একা থাকার জন্য একই সঙ্গে যুদ্ধ ও রথচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না তাঁর পক্ষে। তার সেই অসহায় অবস্থা দেখে লার্তেসপুত্র অ্যালসিমীডন তাঁর কাছে এসে বলল, অটোমীডন, কোন দেবতা তোমায় এমন নির্বুদ্ধিতা দিল যার জন্য তুমি তোমার সহকর্মীকে হারানো সত্ত্বেও আস্ফালনরত বীরপুঙ্গব হেক্টরের সম্মুখে একা যুদ্ধ করার দুঃসাহসকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছ? চেয়ে দেখ, ইতিমধ্যেই ঈয়াকাসের বংশধরেরা বর্মটি পরিধান করে কেমন গর্বে উদ্ধত হয়ে উঠেছে হেক্টর।

অটোমীডন উত্তর করলেন, অ্যালসিমীডন, প্যাট্রোক্লাসের পর তুমি ছাড়া এই অমর দেবাশ্বগুলোকে আর কেউ চালনা করতে পারবে না। সুতরাং এখন চাবুক আর বন্ধু হাতে নিয়ে ওদের চালনা করো, আমি রথ থেকে অবতরণ করে যুদ্ধে পরিপূর্ণভাবে যোগদান করি।

এই কথা বলে রথ থেকে নেমে যুদ্ধে চলে গেলেন অটোডীমন আর অ্যালসিমীডন রথে চেপে রথচালনা করতে লাগলেন। হেক্টর তা দেখে ঈনিসকে বললেন, দেখ ঈনিস, ঈয়াকাসপুত্রের দ্রুতগতি অশ্বগুলো চালনার ভার পড়েছে কোন এক দুর্বল হাতের উপর। সুতরাং তুমি যদি চাও আমরা ঐ রথ আর অশ্বগুলো দখল করতে পারি। আমরা একযোগে আক্রমণ করলে সে আক্রমণ ও প্রতিহত করতে পারবে না একা।

বীর অ্যাঙ্কিসেসপুত্রও তাই চাইছিলেন মনে মনে। ব্রোঞ্জ ও বলদচর্মনির্মিত উত্তম ঢাল দিয়ে স্কন্ধদেশকে সুরক্ষিত করে এগিয়ে গেলেন দুজনে। তাদের সঙ্গে ক্রোমিয়াস ও অ্যারেনাসও গেল জয়ের আশা বুকে নিয়ে। কিন্তু তারা মুঢ় ছিল বলেই সকাতর প্রার্থনালব্ধ জিয়াসপ্রদত্ত শক্তি ও সাহসে ধন্য অটোমীডনের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি তাদের। হেক্টরের সঙ্গে তাদের এগিয়ে আসতে দেখে অটোডীমন অ্যালসিমীডনকে বললেন, তুমি আমার অতি সন্নিকটে রথ চালনা করবে। প্রিয়ামপুত্রকে আমরা প্রতিহত করতে পারব কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তার আগেই হয়ত আমাদের হত্যা করে হয় গ্রীকসেনাদের মাঝে সন্ত্রাস ছড়িয়ে বেড়াবে অথবা সে নিজেই নিহত হবে।

অতঃপর তিনি এই অ্যাজাক্সবীর ও মেনেলাসকে সম্বোধন করে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তোমরা যে মৃতদেহটিকে রক্ষা করছ ওখানে দাঁড়িয়ে তা ওদের ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে আমাদের উদ্ধার করো। দুজন সর্বশ্রেষ্ঠ ট্রয়বীর হেক্টর ও ঈনিস যুদ্ধের এক অতীব বিপজ্জনক জোয়ারের মাঝে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। অবশ্য ও ব্যাপারের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ভর করছে দেবতাদের উপর। সুতরাং আমি আমার বর্শা নিক্ষেপ করে আমার কর্তব্য সম্পাদন করব। তারপর জিয়াস যা করার করবেন।

এই কথা বলে বর্শা নিক্ষেপ করলেন অটোডীমন সজোরে আর সেই বর্শা অ্যারেসের বর্ম ভেদ করে তার উদরদেশের নিম্নভাগকে বিদ্ধ করল। কোন বলিষ্ঠ যুবকের কুঠারের আঘাতে টলতে টলতে যেমন কোন বলদ পড়ে যায় তেমনি অ্যারেসও চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন তৎক্ষণাৎ। হেক্টর তখন অটোমীডকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা ছুঁড়লেন কিন্তু সে বর্শা তার দেহে না লেগে মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়েও হেক্টরের দেহবিচ্ছুরিত শক্তির বেগে প্রাণভরে বিকম্পিত হচ্ছিল সেই বর্শাফলকটি, কিন্তু অ্যারেস সেই শক্তি হরণ করে নিষ্কর্মা করে তুললেন সেটিকে। অটোমীডনের আবেদনে সাড়া দিয়ে অ্যাজাক্সবীর যদি ভিড় ঠেলে সেখান এসে না পড়তেন তাহলে হয়ত তারা তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করত পরস্পরের সঙ্গে। অ্যাজাক্সবীরদের দেখে হেক্টর, ঈনিস ও ক্রোমিয়াস সরে গেল। সেই স্থানেই পড়ে রইল অ্যারেসতাসের মৃতদেহটি। তখন অটোমীডন সেই মৃতদেহ থেকে বর্মটি খুলে নিয়ে গর্বের সঙ্গে বললেন, মীনোতিয়াসপুত্রের মৃত্যুতে যে শোকদুঃখ অনুভব করেছিলাম তার কিঞ্চিৎ উপশম ঘটল। কিন্তু সে ব্যক্তিকে আমি হত্যা করলাম কোন দিক থেকেই তুলনা হয় না তার সঙ্গে।

এই কথা শেষ করে শরক্তে রঞ্জিত হয়ে রথে চাপলেন অটোমীডন। তাঁকে দেখে মনে হলো যেন কোন পশুরাজ এইমাত্র এক বলদ শিকার করে তার তাজা রক্তে পরিপ্লাবিত হয়ে এসেছে।

এবার প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে কেন্দ্র করে দুই দলে যুদ্ধ প্রবল হয়ে উঠল আবার। কারণ জিয়াস তাঁর মন পরিবর্তন করে গ্রীকদের উৎসাহিত করার জন্য এথেনকে নিজে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেবরাজ জিয়াস তাৎপর্যপূর্ণ উজ্জ্বল কুঞ্চনের সঙ্গে সঙ্গে অত্যুজ্জ্বল পোশাক পরিহিত অবস্থায় এসে এতে প্রতিটি গ্রীকসৈনকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। তিনি ফোনিক্সের ছদ্মবেশ ধারণ করে মেনেলাসকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, মেনেলাস, যদি অ্যাকেলিসের সহকর্মীর মৃহদেহটিকে শৃগাল কুকুরে ছিঁড়ে খায় তাহলে সেটা তোমার পক্ষে হবে লজ্জার কথা।

মেনেলাস উত্তর করলেন, হে আমার প্রিয় বন্ধু ফোনিক্স, দেবী এথেন যেন শক্তি সঞ্চার করেন আমার মধ্যে যাতে আমি প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটিকে রক্ষা করতে পারি। কিন্তু জিয়াস প্রদত্ত জয়ের গৌরবে সমৃদ্ধ হয়ে হেক্টর এক জ্বলন্ত অনিবার্ণ অগ্নিস্তম্ভের মত অবিরাম আঘাত হেনে চলেছে আমাদের উপর।

সব দেবতাদের আগে তাঁর নাম করার খুশি হলেন এথেন। তিনি তখন মেনেলাসের দেহে এমনভাবে শক্তি সঞ্চার করলেন যাতে তিনি অদম্য রক্তলোলুপ মক্ষিকার মতো প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে বর্শা নিক্ষেপ করলেন। মেনেলাসের সে বর্শা গিয়ে হেক্টরের সহকর্মী পোদেষের কটিদেশে লাগতেই সে পড়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে মেনেলাস তার মৃহদেহটিকে টেনে গ্রীকসেনাদের মাঝে নিয়ে এলেন।

অ্যাপোলো তখন হেক্টরের কাছে গিয়ে তাঁকে উত্তেজিত করার জন্য বলতে লাগলেন, যোদ্ধা হিসেবে যে মেনেলাস নিকৃষ্ট সেই মেনেলাসের সামনে যখন তুমি নত হয়েছে তখন এরপর থেকে কোন গ্রীকসেনা আর ভয় করবে না তোমাকে। সে একা তোমার এ বীর সহকর্মীকে হত্যা করে মৃতদেহটিকে টেনে নিয়ে গেছে।

এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের এক ঘন মেঘ নেমে এল হেক্টরের মনে আর মুখে। অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে তিনি নতুন উদ্যমে আক্রমণ করলেন গ্রীকদের। ক্রোনাসপুত্র জিয়াস যথন দণ্ড ধারণ করে বস্ত্র ও বিদ্যুৎকে পাঠিয়ে দিলেন ট্রয়বাসীদের জয়ী করার জন্য।

প্ৰথমে ট্রয়বীরদের পলিডেমাসের দ্বারা নিক্ষিপ্ত একটি বর্শার আঘাতে মেনেলিয়াসের পতন ঘটতেই ব্যাপকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে গ্রীকসেনারা। এরপর হেক্টর নিকট হতে আলেকত্রিয়নপুত্র লীটাসকে হত্যা করলেন। হেক্টর যখন লীটাসের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন তখন তার বক্ষস্থল লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করে আইডোমেনেউস। কিন্তু সে বর্শার ফলকটি হেক্টরের কঠির ধাতব বক্ষাবরণীতে প্রতিহত হয়ে ভেঙ্গে যায়। হেক্টর তখন আইডোমেনেউসকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু বর্শাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মেরিওনস-এর সারথি কোরানাসকে আঘাত করল। কোরানাস তাড়াতাড়ি রথে করে আইড্রোমেনেউসকে জাহাজ থেকে না গিয়ে এলে গ্রীকরা আরও বিপন্ন হয়ে পড়ত। কিন্তু সেই কোরানাসের চোয়ালটিকে হেক্টরের বর্শাফলক এমনভাবে বিদ্ধ করল যাতে তার দাঁতগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ আর জিহ্বাটি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়ল। রথ থেকে পড়ে গেল কোরানাস। মেরিওনস তখন আইডোমেনেউসকে বলল, জাহাজে পালিয়ে যাও, যুদ্ধের গতি আমাদের পক্ষে মোটেই ভাল নয়।

আইডোমেনেউস আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জাহাজে পালিয়ে গেলেন। অ্যাজাক্স ও মেনেলাস এবার বুঝতে পারলেন কিভাবে ট্রয়বাসীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন দেবরাজ জিয়াস। অ্যাজাক্স বললেন, ট্রয়পক্ষ হতে কাপুরুষ যে কেউ অস্ত্র নিক্ষেপ করছেন আমাদের উপর সে অস্ত্র কার্যকরী হচ্ছে, অথচ আমাদের দ্বারা নিক্ষিপ্ত প্রতিটি অস্ত্রই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এখন হেক্টরকে কোনমতেই প্রতিহত করা যাবে না। সুতরাং এই মৃতদেহ রক্ষা করা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে। বিষাদগ্রস্ত চিত্তে আমাদের ফিরে যেতে হবেই। হেক্টর অবশ্যই আমাদের রণতরীগুলো ধ্বংস করবে। আমার মতে একজন গিয়ে খবর দিক। কারণ অ্যাকেলিস এখনো তার প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুসংবাদ পায় নি। তিনি কোন গ্রীকসেনাকেই দেখতে পাচ্ছিলেন না সামনে, কারণ জিয়াস আমাদের সব রথগুলোকেই অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। হে পরম পিতা জিয়াস, এই মেঘান্ধকার অপসরিত করে আকাশকে নির্মল করো। তুমি যদি একান্তই আমাদের ধ্বংস চাও তাহলে অন্তত স্পষ্ট দিবালোকে আমাদের ধ্বংস সংঘটিত করো।

অ্যাজাক্সের অশ্রুসিক্ত আবেদনে অনুকম্পা জাগল জিয়াসের মনে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই মেঘান্ধকার অপসৃত করলেন এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোকের উজ্জ্বল স্বচ্ছতায় আলোকিত হয়ে উঠল সমগ্র রণক্ষেত্র। অ্যাজাক্স তখন মেনেলাসকে বললেন, দেখ মেনেলাস, নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকাস এখনো জীবিত আছে কি না। যদি সে বেঁচে থাকে তাহলে এখনি তাকে অ্যাকেলিসের কাছে পাঠিয়ে দাও। সে গিয়ে অ্যাকেলিসকে বলতে তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সহকর্মীর পতন ঘটেছে।

মেনেলাস তৎক্ষণাৎ সে স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন। মাংসলোলুপ সিংহ যেমন হাতের কাছে পশুপাল পেয়েও জ্বলন্ত মশাল আর তীক্ষ্ণ তীরের ভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাল ছেড়ে, ঠিক তেমনি প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ ছেড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যেতে বাধ্য হলেন মেনেলাস। তথাপি যাতে শত্রুরা গ্রীকসেনাদের তাড়িয়ে দিয়ে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ নিয়ে চলে যায় এই ভয়ে তিনি যাবার সময় অ্যাজাক্স বীরদ্বয় ও মেরিওনস-এর উপর সব ভার দিয়ে বললেন, হে অ্যাজাক্স বীরদ্বয় ও মেরিওনস, জেনে রেখো প্যাট্রোক্লাস কত ভাল লোক ছিল, জীবিত কালে সে সকলের সঙ্গেই সৌজন্যমূলক ব্যবহার করে গেছে।

ঈগল যেমন বহু ঊর্ধ্বে উডডীয়মান অবস্থানে নিচে পৃথিবীতে কোথায় কোন শিকারের বস্তু আছে তা সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখতে থাকে উপর থেকে, মেনেলাসও তেমনি যেতে যেতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলেন চারিদিকে। অবশেষে তিনি দেখলেন রণক্ষেত্রের বাম প্রান্তে অ্যান্টিলোকাস গ্রীকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য উপদেশ দিয়ে উৎসাহিত করছে। তখন তিনি অ্যান্টিলোকাসের কাছে গিয়ে তাকে বললেন, কাছে এসে দুঃসংবাদ শ্রবণ করো। তুমি নিজের চোখে এসে দেখ দেবতারা কিভাবে বিপদের উপর বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন গ্রীকদের উপর আর ট্রয়বাসীদের গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন জয়ের মালা। প্যাট্রোক্লাস নিহত। অ্যাকেলিসকে গিয়ে বল, তিনি যেন নিজে এসে প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ জাহাজে নিয়ে যান। হেক্টর ইতিমধ্যে তার বর্ম ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন।

এই দুঃসংবাদ শুনে এক সকরুণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল অ্যান্টিলোকাস। তার চোখে শুধু জল ঝরতে লাগল, কোন কথা বার হলো না। অবশেষে সে মেনেলাসের আদেশমত তার বর্শাটি তার সহকর্মী ও সারথি লাওডেমাসের হাতে দিয়ে সে ছুটে অ্যাকেলিসকে খবর দিতে গেল।

অ্যান্টিলোকাস ছুটে চলে গেলে পাইলসবাসীরা তার অভাব বোধ করে অসহায় বোধ করছিল নিজেদের। মেসেলাস তখন তাদের কাছে গিয়ে তাদের অন্যতম নেতা থেসিমেদিসকে উৎসাহ দান করলেন। তারপর তার শক্রনিগৃহীত সহকর্মীদের কাছে আবার ফিরে গেলেন। তারপর তিনি অ্যাজাক্সবীরদের বললেন, আমি অ্যান্টিলোকাসকে পাঠিয়েছি। কিন্তু বর্ম না পেলে অ্যাকেলিস কি করে যুদ্ধ করবে? সুতরাং আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে মৃতদেহ উদ্ধার করা। তা না হলে আমাদের কোন আশা নেই।

তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স উত্তর করলেন, মেনেলাস ঠিক বলেছ তুমি। মেরিওনস যাও, এই মৃহদেহটি তুলে নিয়ে যাও। আমরা দুজন হেক্টর ও ট্রয়সেনার তোমার পশ্চাতে ধাবমান হলে তাদের প্রতিরোধ করব।

মেনেলাস ও মেরিওনস তখন অতিকষ্টে মৃহদেহটি তুলে ধরলেন। ট্রয়সেনারা চিৎকার করে আহত শূকরের পশ্চাতে ধাবমান শিকারী কুকুরের মত ছুটে আসতে লাগল। ট্রয়সেনারা দলবদ্ধভাবে ছুটে এলেও দুই অ্যাজাক্সবীর যখন তাদের সামনে রুখে দাঁড়াল তখন তারা তার সামনে দাঁড়াতে সাহস করল না। প্যাট্রোক্লাসের শববাহী গ্রীকবীরদের কেন্দ্র করে যুদ্ধে জ্বলন্ত আগুন ক্রমশই বেড়ে যেতে লাগল, ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নগরধ্বংসকারী ক্রমবর্ধমান অগ্নিকাণ্ডের মত অনেক মানুষ ও অশ্বকে গ্রাস করছিল সে আগুন। মেনেলাস ও মেরিনাস যখন প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যে দুটি ক্লান্ত ও অবসন্ন গর্দভ কোন এক বন্ধুর পার্বত্য পথে এক বিশাল ভারী কাঠকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। হেক্টর ও ঈনিসের নেতৃত্বে ধাবমান ট্রয়সেনাদের ঠেকিয়ে রাখছিলেন দুই অ্যাজাক্সবীর। এদিকে অনেক সময় একদল দাঁড়কাক যেমন বাজপাখিকে তাড়া করে তেমনি হেক্টর ও ঈনিসের বীরত্বের কথা ভুলে গিয়ে গ্রীকসেনারা তাদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তাড়া করছিল। এইভাবে গ্রীকদের পরিখার ধারে সবচেয়ে তীব্র হয়ে উঠল যুদ্ধের গতি এবং বহু গ্রীকসৈন্য হতাহত হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *