১৬. প্যাট্রোক্লাসের কৃতিত্ব ও মৃত্যু

ষোড়শ অধ্যায়
প্যাট্রোক্লাসের কৃতিত্ব ও মৃত্যু

প্রোতেসিলসের জাহাজের সামনে যুদ্ধ ক্রমশই ঘোরতর হয়ে উঠল। তা দেখে অপূর্ণ নয়নে অ্যাকেলিসের নিকট গিয়ে দাঁড়ালেন প্যাট্রোক্লাস। কোন সুউচ্চ খাড়াই পর্বতশিখর হতে স্ফটিকস্বচ্ছ জলধারা বেগে পতিত হয় যেমন তার সানুদেশে, বীর প্যাট্রোক্লাসের চোখ থেকেও তেমনি করে ঝরে পড়ছিল মুক্তার মত স্বচ্ছ অশ্রুধারা। প্যাট্রোক্লাসকে অশ্রু বিসর্জন করতে দেখে দুঃখিত হয়ে অ্যাকেলিস বললেন, মাতৃসমীপে আগত ক্ৰন্দরতর শিশুর মত কেম তুমি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাট্রোক্লাস? অবোধ শিশু যেমন তার মার কাছে গিয়ে মার আঁচল ধরে তাকে কোলে তুলে নেবার জন্য কাঁদতে কাঁদতে আবেদন জানাতে থাকে এবং তার মাও তাকে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও কোলে তুলে নেয়, তেমনি তুমিও অশ্রুপাত করে যাচ্ছ কোন না কোন আবেদন জানাবার জন্য। তুমি কি মামিডনদের বা আমাকে কোন কথা বলতে চাও? অথবা পিথিয়া থেকে কোন দুঃসংবাদ পেয়েছ? ওরা বলাবলি করছে অ্যাজাক্সপুত্র মেনোতিয়াস ও ঈয়াকাসপুত্র পেলেউস এখনো জীবিত আছেন। ওঁদের দুজনের মৃত্যুই আমাদের দুজনের পক্ষে বিশেষভাবে দুঃখজনক হবে। অথবা গ্রীকরা তাদের নিজেদের দোষের জন্য তাদের জাহাজে দলে দলে নিহত হচ্ছে বলে তাদের জন্য দুঃখ অনুভব করছ তুমি?

একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীর নাইট প্যাট্রোক্লাস উত্তর করলেন, অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রীকবীর হে পেলেউসপুত্র, অ্যাকেলিস ক্রুদ্ধ হয়ো না আমার কথায়, আমি সত্যি সত্যিই গ্রীকদের বিপর্যয়ে অশ্রু বিসর্জন করছি। তাদের যেসব বীর নেতৃবৃন্দ এতদিন যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছিলেন তাঁরা আজ সকলে বর্শা বা তরবারির দ্বারা আহত হয়ে শিবিরমধ্যে বিশ্রাম লাভ করছেন। টাইডেউসপুত্র বীর ডায়োমেডিস আহত হয়েছেন বর্শার আঘাতে, ওডিসিয়াস ও অ্যাগামেমনন আহত হয়েছেন তরবারির আঘাতে আর ইউরিপাইলাসের উরুদেশ বিদ্ধ হয়েছ এক তীরের দ্বারা। সুদক্ষ চিকিৎসকরা তাঁদের সেবা করে তাঁদের ক্ষতস্থানগুলো আরোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছেন। হে অ্যাকেলিস, তুমি কি এখনো তেমনি নির্মম রয়ে গেছ? যে অনমনীয় ক্রোধাবেগ তোমার সুনামকে ক্ষুণ্ণ করে তুলছে আমি যেন সে ধরনের কোন ক্রোধাবেগকে পোষণ না করি আমার অন্তরে। এই অত্যাসন্ন ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাত থেকে আজ যদি তুমি গ্রীকদের রক্ষা না করো তাহলে ভবিষ্যতে কে তোমাদের যশোগান করবে? তোমার মোটেই দয়া মায়া নেই। পেলেউস তোমার পিতা নন, থেটিসও তোমার মাতা নন। ধূসর সমুগ্রগর্ভ হতে উত্থিত কঠিন হিমশৈলের মতই তুমি নিষ্ঠুর, অনুশোচনাবিহীন। যদি তুমি কোন দৈববাণীর ভয়ে অথবা তোমার মাতা থেটিসের মুখে জিয়াস প্রেরিত কোন নির্দেশের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধ হতে বিরত থাক তাহলে আমাকে ও আমার সঙ্গে মার্মিডনদের পাঠাও যাতে আমরা গ্রীকদের উদ্ধার করতে পারি। তোমার বর্মটি আমাকে পরিধান করতে দাও। ট্রয়সেনারা তাহলে আমাকে তুমি ভেবে পালিয়ে যেতে পারে যুদ্ধক্ষেত্র হতে আর আমরা গেলে পরিশ্রান্ত গ্রীকসেনারাও হাঁপ ছাড়ার সময় পাবে। তাছাড়া আমাদের নতুন উদ্যম ও সজীব সচেতন প্রাণশক্তির সামনে অবসন্ন ট্রয়সেনারা দাঁড়াতে না পেরে তাদের নগরে পালিয়ে যেতে পারে।

তিনি কি বলেছেন, অ্যাকেলিসের কাছে কি চাইছিলেন তা উনি নিজেই জানতেন না। উনি জানতেন না, উনি তাঁর নিজের মৃত্যুকেই কামনা করছেন। ব্যথাহত চিত্তে উত্তর করলেন অ্যাকেলিস, কি বলছ প্যাট্রোক্লাস? আমি কোন দৈববাণীর কথা জানি না, আমার মাতা জিয়াস প্রদত্ত কোন নির্দেশের কথাও বলেন নি। আমার শুধু এই দুঃখ যে আমারই জাতির এক লোক আমার থেকে বেশি শক্তিমান বলে আমাকে বঞ্চিত করেছে আমার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে। এ অপমান আমার সহ্যের অতীত। আমাকে এই সামান্য তুচ্ছ ভবঘুরে ভেবে আমার বন্দিনীকে জোর করে কেড়ে নিয়ে গেছে অ্যাগামেমনন। তবু যা হয়ে গেছে গেছে। কোন দুঃখই মানুষের চিরকাল থাকে না। আমি বলছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না যুদ্ধের ধ্বনি আমার জাহাজে এসে পৌঁছবে ততক্ষণ প্রশমিত হবে না আমার ক্রোধ। এখনো সে ধ্বনি এখানে শ্রুত না হলেও তুমি আমার বর্মটি তোমার স্কন্ধদেশে স্থাপন করা, মার্মিডনদের নিয়ে যাও যুদ্ধক্ষেত্রে, কারণ কৃষ্ণকুটিল মেঘমালা সদৃশ্য ট্রয়সেনাদের যখন সমতৎপরতা আজ প্রচণ্ডভাবে ফেটে পড়েছে গ্রীক জাহাজের মাঝে। গ্রীকরা এখন বিতাড়িত হয়ে তাদের জাহাজে আশ্রয় নিয়েছে আর সমস্ত ট্রয়বাসী উল্লাসে মত্ত হয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করছে, কারণ তারা আমার উজ্জ্বল বর্ম দেখতে পায় নি গ্রীকসেনাদের মাঝে। তা যদি তারা দেখতে পেত তাহলে ভয়ে পালিয়ে যেত তারা। অ্যাগামেমনন আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলে এ ঘটনা অনেক আগেই ঘটত। যাই হোক, ট্রয়বাসীরা এখন বিপর্যস্ত করে তুলেছে গ্রীকদের। এখন ডায়োমেডস আর বর্শা সঞ্চালন করে বেড়াচ্ছে না, আত্রেউসপুত্রও এখন আর তাঁর ঘৃণিত মস্তক নিয়ে বেরিয়ে আসছেন না তার কক্ষ হতে। এখন আমি শুধু হেক্টরের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। তিনি নতুন নতুন আদেশ দান করছেন তার অধীনস্থ সৈন্যদের আর সেই সব সৈন্যরাও রণহুঙ্কার তুলে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে তুলেছে সমগ্র রণক্ষেত্রটিকে। তা হলেও তুমি যাও প্যাট্রোক্লাস, আমাদের জাহাজগুলোকে রক্ষা করো, তা না হলে শত্রুরা তাতে অগ্নিসংযোগ করে অসম্ভব করে তুলবে আমাদের প্রত্যাবর্তন যাত্রাকে। এখন আমি যা বলছি তা করো। তাহলে গ্রীকরা আমাকে সম্মান করবে আর সসম্মানে আমার বন্দিনীকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে আরো অনেক উপহারে ভূষিত করবে। এই জাহাজগুলো হতে ট্রয়সেনাদের বিতাড়িত করেই চলে আসবে তুমি আমার কাছে। হেরানাথ বজ্ৰাধিপতি জিয়াস তোমার হাতের কাছে বিজয়গৌরব এনে দিলেও আমার অনুপস্থিতিতে আর যুদ্ধ করবে না শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে। তাহলে আমার প্রাপ্য গৌরব এবং মর্যাদা হতে আমাকে বঞ্চিত করবে তুমি। যদি তুমি এক অদৃশ্য যুদ্ধ পিপাসায় উন্মত্ত হয়ে ক্রমাগত ট্রয়সেনাদের হত্যা করে দাও অথবা গ্রীকসেনাদের পরিচালিত করে নিয়ে যাও ইলিয়াম নগরীর মাঝে তাহলে স্বর্গবাসী কোন দেবতা আক্রমণ করতে পারেন তোমাকে। ফীবাস অ্যাপোলো ট্রয়বাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তুমি শুধু গ্রীক অর্ণবপোত হতে শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করেই চলে আসবে। তারপর যুদ্ধের ভার অন্য কোন গ্রীক বীর গ্রহণ করবে। যদি জিয়াস, এথেন আর অ্যাপোলোর কৃপায় সমস্ত গ্রীক ও ট্রয়বাসীর মৃত্যু হত তাহলে ঐ রহস্যময়ী ট্রয়নগরীর অবগুণ্ঠনটি অপসারিত করে শুধু আমরা দুজনে লাভ করতাম এক বিরল জয়ের গৌরব।

এইভাবে প্যাট্রোক্লাসকে বোঝালেন অ্যাকেলিস। এদিকে শত্রুসৈন্যনিক্ষিপ্ত অবিরাম শরবর্ষণের মাঝে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না অ্যাজাক্স। জিয়াসের অনুগ্রহধন্য ট্রয়সেনাদের দ্বারা ক্রমাগত অস্ত্রক্ষেপণের ফলে তাঁর শিরস্ত্রাণটি কাঁপছিল প্রতিনিয়ত। সেই সব অস্ত্র একা আর প্রতিহত করতে পারছিলেন না তিনি। বহুক্ষণ ধরে বাম স্কন্ধের উপর ঢালটি বহন করার ফলে ব্যথা অনুভব করছিলেন সে জায়গায়। অবিরাম ঘাম ঝরে পড়ছিল তাঁর দেহগাত্র হতে। তিনি এতদূর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার।

কাব্য ও শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হে মিউস, বল আমায় কেমন করে অগ্নিসংযোগ করা হয় গ্রীক অর্ণবপোতগুলোতে।

হেক্টর এগিয়ে এসে তাঁর সেই বিরাট তরবারির দ্বারা অ্যাজাক্সের বর্শার উপর এমনভাবে আঘাত হানলেন যে বর্শার কাষ্ঠদণ্ডটি ভেঙ্গে দুখণ্ড হয়ে গেল আর তার ফলে ফলকটি পড়ে গেল। অ্যাজাক্স বুঝতে পারলেন এতে নিশ্চয়ই দেবতাদের হাত আছে। এই ভেবে ভীত হয়ে উঠলেন অ্যাজাক্স যে, জিয়াস তাঁকে এইভাবে অসহায় করে তুলে ট্রয়সেনাদের জয়ের গৌরব দান করতে চান। তাই তিনি বিমর্ষ চিত্তে সরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রীকজাহাজে অগ্নিসংযোগ করলেন ট্রয়সেনারা। আর সে আগুন অচিরেই অসংখ্য লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। গ্রীকজাহাজের দাঁড়ে আগুন ভালভাবে ধরে গেলে তার উরু চাপড়ে অ্যাকেলিস প্যাট্রোক্লাসকে বললেন, যাও হে বীর নাইট, এখন দেখছি আমাদের অর্ণবপোতগুচ্ছে অগ্নিসংযোগ করছে শত্রুরা। তারা আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দিলে আমাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আর কোন পথই থাকবে না। তুমি এই মুহূর্তে আমার বর্ম পরিধান করে যাও আর আমিও আমার সৈন্যসামন্তদের ডাকি।

অ্যাকেলিসের বর্ম পরিধান করলেন প্যাট্রোক্লাস। প্রথমে পায়ে রৌপ্যনির্মিত পদাচ্ছাদন পরিধান করে মাথায় শিরস্ত্রাণ স্থাপন করে স্কন্ধে ব্রোঞ্জনির্মিত রৌপ্যখচিত তরবারি ঝুলিয়ে নিলেন। দুটি বর্শা হস্তে ধারণ করলেন। কিন্তু অ্যাকেলিসের বর্শাটি নিতে পারলেন না। কারণ সে বর্শাটি একমাত্র অ্যাকেলিস ছাড়া আর কেউ সঞ্চালন করতে পারবে না। এই আশ্চর্য বর্শাটি শিরণ গেলিয়ন পর্বতে পান এবং তা শত্রু নিধনের জন্য পেলেউসকে দান করেন। প্যাট্রোক্লাস অটোমীডনকে রথে অশ্ব সংযোজিত করতে আদেশ দিলেন। যুদ্ধের ব্যাপারে অটোমীডনের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে প্যাট্রোক্লাস। অটোমীডন সঙ্গে সঙ্গে জ্যানথাস ও বেলিয়াস নামে দুটি দ্রুতগামী অশ্ব সংযোজিত করে দিলেন তার রথে। পশ্চিম বায়ুর ঔরসজাত এই দুটি অশ্বকে পেদাদাস নামে এক ঘোটকী গর্ভে ধারণ করে এবং ওসিয়ানাস সমুদ্রের তীরে চরবার সময় প্রসব করে একদিন। পেদাসাস নামে সে অশ্বটি অ্যাকেলিস এতিয়ন নগরী ধ্বংস করে নিয়ে আসেন সেখান থেকে প্যাট্রোক্লাসের রথে সেটিকে সংযোজিত করা হলো। পেদাদাস মর্ত্যের এক মরণশীল জীব হলেও শক্তি ও দ্রুতগামিতায় সে ছিল স্বর্গলোকের অমর দেবতাদের সমকক্ষ।

ইত্যবসরে অ্যাকেলিস সমস্ত শিবিরগুলো ঘুরে ঘুরে মার্মিডনের বর্ম পরিধান করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার আদেশ দিলেন। রক্তপিপাসু একদল নেকড়ে যেমন কোন এক পার্বত্য উপত্যকায় সদ্য নিহত একটি মৃগের মাংস ভক্ষণ করতে করতে সহসা পিপাসার্ত হয়ে কোন ঝর্ণার স্বচ্ছ জলধারা পান করার জন্য রক্তাক্তমুখে ছুটে আসে, মার্মিডনরাও তেমনি ছুটে এসে সমবেত হলো অ্যাকেলিসের চারিপাশে। তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন অ্যাকেলিস।

অ্যাকেলিস তার দেশ থেকে এনেছিলেন পঞ্চাশটি যুদ্ধ জাহাজ এবং প্রত্যেকটি জাহাজে ছিল পঞ্চাশজন করে সুদক্ষ নাবিক। অ্যাকেলিস প্রতিটি জাহাজে পাঁচজন করে নাবিক নিযুক্ত করেন আর তিনি নিজে ছিলেন সমস্ত জাহাজ ও তাঁর মার্মিডন সেনাদলের সর্বাধিনায়ক। স্বর্গজাত নদী পার্কেইয়াসের সন্তান মোসেসিয়াস ছিলেন প্রথম দলের নায়ক। পেলেউসকন্য সুন্দরী পলিডেবরা স্পার্কেইয়াসের ঔরসজাত এই সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। মানবী হলেও তিনি দেবতার সঙ্গে সঙ্গম করে এই পুত্রের জন্ম দান করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকচক্ষে বাইরের জগতে মেনেসথিয়াস বোরাসপুত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন, কারণ তার মাতা পলিডেবরা বোরাসের বিবাহিত স্ত্রীরূপেই বাস করতেন তাঁর সঙ্গে। বোরাস তাকে লাভ করার জন্য প্রভূত ধনরত্বের উপঢৌকন দান করেন পলিডেবরার পিতাকে। কোন এক অনূড়া নারীর সন্তান ইউডোরাস ছিলেন দ্বিতীয় দলের অধিনায়ক। সে নারী হলো ফাইলাসকন্যা পলিমেনি। একবার আর্তেমিসের সম্মানার্থে অনুষ্ঠিত এক নৃত্যানুষ্ঠানে পলিমেসি যখন নৃত্য করছিল অপরূপ ছন্দে, তখন তার রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবদূত হার্মিস তাকে উপরিতলের একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে যান এবং তার সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। সেই সঙ্গমের ফলেই ইউডোরাসের জন্ম হয় পলিমেনির গর্ভে।

ইউডোরাস ছিল তেমন সাহসী বীর, তেমনি দ্রুতগামী। প্রসবযন্ত্রণার দেবী ইলিখিয়া সদ্যজাত শিশু ইউরোরাসকে সূর্যালোকে নিয়ে আসেন যখন, তখন অ্যাক্টরপুত্রও অ্যাকেসে সেই নবজাত শিশুর অনৃঢ়া মাতাকে বহু যৌতুক দিয়ে বিবাহ করেন। তবে ফাইলাস সেই শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করতে থাকেন। প্যাট্রোক্লাসের পরেই মার্মিডনদের মধ্যে যার ছিল বর্শা চালনার স্থান সেই মেনেলাসপুত্র পিসান্ডার ছিলেন তৃতীয় দলের অধিনায়ক। বীর নাইট ফোনিস্ক ছিলেন চতুর্থ দলের আর লার্তেউসপুত্র আলসিমীডন ছিলেন পঞ্চম দলের অধিনায়ক।

অ্যাকেলিস তাঁর সেনাদলকে বিভিন্নভাগে ভাগ করে দেবার পর তাদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, হে মার্মিডনগণ, ক্রুদ্ধ অবস্থায় আমার যুদ্ধবিরতিকালে তোমরা ট্রয়বাসীদের বিরুদ্ধে আমার কাছে যে সব অভিযোগ করেছ তা আজ স্মরণ করো। তোমরা আমাকে প্রায়ই বলতে, পেলেউসের নিষ্ঠুর পুত্র, আপনার মাতা নিশ্চয়ই দুগ্ধের পরিবর্তে বিষ পান করিয়ে মানুষ করেছেন আপনাকে। আপনি যদি এমন নির্মম ও অনমনীয়ভাবে যুদ্ধ হতে বিরত হয়ে বসে থাকেন তাহলে আমাদের এই জাহাজে আটক করে রেখে দেওয়ার দরকার কি, আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিন। কতবার তোমরা আমায় ভর্ৎসনা করেছ। আজ সময় এসেছে। এতদিন ধরে যে সব অস্ত্র অব্যবহৃত হয়ে পড়ে রয়েছে আজ সেগুলোর সদ্ব্যবহার করে আপন আপন কৃতিত্ব প্রদর্শন করবে। সুতরাং আশায় ও উৎসাহে বুক বেঁধে যুদ্ধ করো ট্রয়বাসীদের সঙ্গে।

তাদের রাজার মুখ থেকে এই ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনে ঘনসংঘবদ্ধভাবে পঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে উঠল যুদ্ধের জন্য। প্রস্তরগুলোকে নিচ্ছিদ্রভাবে পরস্পরের সঙ্গে গ্রথিত করে যেমন স্থপতিরা প্রাসাদ নির্মাণ করে তেমনি মাৰ্মিৰ্ডনসৈন্যরা এমন ঘন হয়ে দাঁড়াল যে একজনের শিরস্ত্রাণের সঙ্গে আর একজনের শিরস্ত্রাণের ঘর্ষণ হচ্ছিল।

এবার মার্মিডন সেনাদলের সামনে এসে বর্ম পরিধান করে দাঁড়ালেন দুই নেতা। প্যাট্রোক্লাস ও অটোমীডন। দুটিতে মিলে এক, একই মন বাস করছে যেন দুটি দেহে। অ্যাকেলিস তাঁর শিবিরমধ্যে গিয়ে একটি বড় সিন্দুকের ঢাকনা খুললেন। এই সিন্দুকটি রজতশুভ্ৰপদবিশিষ্টা থেটিস তাঁকে সমুদ্রযাত্রার জন্য দান করেন। শৈত্যনিবারণের উপযুক্ত বহু কম্বল ও চাদর প্রভৃতি বিভিন্ন শীতবস্ত্রে যে সিন্দুকটি ভরে দেন থেটিস। সেই সিন্দুকের মধ্যে চিকন কারুকার্যখচিত এক পানপাত্র ছিল যে পানপাত্র হতে একমাত্র অ্যাকেলিস ছাড়া আর কোন মানুষ মদ পান করতে পারত না। সে পাত্র করে একমাত্র জিয়াস ছাড়া অন্য কোন দেবতাকে মদের অঞ্জলি দান করতেন না অ্যাকেলিস। পাত্রটি বার করে গন্ধক ও জল দিয়ে ভালভাবে ধৌত করলেন, তারপর নিজের হাত ধুয়ে তাতে মদ ঢাললেন। অতঃপর উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে মুখ তুলে জিয়াসের উদ্দেশ্যে মদের অঞ্জলি দান করে প্রার্থনা করতে লাগলেন, হে দেবরাজ জিয়াস, পেলাসগির দেবতা শৈত্যদেবী দোদোনীর দমনকর্তা, তুমি আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে থেকেও আমাদের সবকিছু প্রত্যক্ষ করো। এর আগে আমি একবার প্রার্থনা করেছিলাম তোমার কাছে। কিন্তু সে প্রার্থনা তুমি শোন নি, তুমি শুধু বিপর্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছ গ্রীকদের মাথার উপর। আজ কিন্তু পূরণ করতে হবে আমার সে প্রার্থনা। আমি এই জাহাজেই রয়ে যাব, কিন্তু আমার একজন সহকর্মীর নেতৃত্বে মার্মিডনদের পাঠাব যুদ্ধে। হে সর্বপ্রত্যক্ষকারী জিয়াস, আমার সহকর্মী যেন জয়ী হয়। তার মনের মধ্যে সাহস সঞ্চার করবে। হেক্টর যেন জানতে পারে শুধু আমার উপস্থিতি ও সাহচর্যে নয়, আমার অনুপস্থিতিতেও আমার সহকর্মী একা যুদ্ধ করতে পারে তার সঙ্গে। সে সব সময়েই অদম্য। শত্রুদের বিতাড়িত করে, তাদের রণহুঙ্কারে স্তব্ধ করে সে যেন অক্ষত দেহে ফিরে আসতে পারে।

এমনি করে অনেকক্ষণ ধরে প্রার্থনা করলেন অ্যাকেলিস। সর্বশক্তিমান জিয়াস এ প্রার্থনা শুনলেন। তার আংশিক মঞ্জুর করলেন। কিন্তু প্রার্থনার সবটুকু মঞ্জুর করতে সম্মত হলেন না। তিনি শুধু এইটুকু মঞ্জুর করলেন যে প্যাট্রোক্লাস জাহাজ থেকে যুদ্ধ করে শত্রুদের বিতাড়িত করে দেবে, কিন্তু সে যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে না।

প্রার্থনা ও অঞ্জলি দানের পর নিজের শিবিরমধ্যে ফিরে গেলেন অ্যাকেলিস। তাঁর নিজস্ব কক্ষে প্রবেশ করে সেই পানপাত্রটি রেখে দিলেন সিন্দুকের মধ্যে। তারপর ঘর থেকে আবার বেরিয়ে এলেন অ্যাকেলিস। যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ নতুন করে শুরু হয়েছে গ্রীক ও ট্রয়সৈন্যদের মাঝে তা অবলোকন করতে লাগলেন তাঁর জাহাজের বহির্ভাগস্থ পাটাতনের উপর থেকে। ইতোমধ্যে প্যাট্রোক্লাসের নেতৃত্বে সশস্ত্র মার্মিডন সেনাদল বীরবিক্রমে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্রয়সেনাদের উপর। কোন এক বোলতার বড় চাকে শিশুরা অথবা কোন পথিক অকস্মাৎ একটি লোষ্ট্র নিক্ষেপ করলে যেমন বোলতাগুলো ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করে লোষ্ট্রনিক্ষেপকারীকে, তেমনি মার্মিডনেরাও দল বেঁধে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুদের উপর। প্যাট্রোক্লাস উচ্চৈঃস্বরে মার্মিডনের সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, হে মার্মিডন সেনাগণ, তোমরা সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধ করো, যাতে আমরা আমাদের সর্বাধিনায়ক সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীকবীর পেলেউসপুত্রের মাথায় জয়ের গৌরবমুকুট পরিয়ে দিতে পারি, যাতে অ্যাগামেমনন এই গ্রীকবীরকে তার প্রাপ্য সম্মান না দিয়ে যে ভুল করেছেন তা বুঝতে পারেন।

বহুক্ষণ পর মার্মিডনদের রণহঙ্কারে আবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল স্তব্ধ গ্রীকরণতরীগুলো। উজ্জ্বল বর্ম পরিহিত অবস্থায় প্যাট্রোক্লাস ও তাঁর সারথিকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখে বেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়ল ট্রয়সেনাগণ। তারা তখন ভাবল পেলেউসপুত্র এবার ক্রোধ পরিহার করে অ্যাগামেমননের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন এবং যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন তিনি। একথা ভেবে তারা অনেকেই পলায়ন ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে লাগল।

প্রোতেসিলদের যে জাহাজদুটিতে যুদ্ধ হচ্ছিল তার উপর থেকেই ঘনসংবদ্ধ ট্রয়সেনাদের মাঝে একটা বর্শা নিক্ষেপ করলেন প্যাট্রোক্লাস। সে বর্শার আঘাতে অ্যামাইডন হতে আগত পীওনিয়ার অশ্বারোহী সেনাদলের নেতা পাইরেকমেস হলেন আহত। বিশাল অ্যাসিয়াস নদীর দ্বারা বিধৌত এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল সমৃদ্ধিশালী অ্যামাইডাস রাজ্য সে রাজ্যের অধিপতি পাইরেকমেসের দক্ষিণ স্কন্ধ বিদ্ধ হলো প্যাট্রোক্লাসের নিক্ষিপ্ত বর্শার ফলকে। তাদের দলনেতা আহত হওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল পীওনিয়ার অশ্বারোহীদল। এইভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রয়সেনাদের মনে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি করলেন প্যাট্রোক্লাস। জাহাজ থেকে ক্রমে পালিয়ে গেল ট্রয়সেনারা। যে জাহাজটিতে আগুন লাগিয়েছিল তারা যে জাহাজটি ইতোমধ্যে অর্ধদগ্ধ হয়ে পড়েছিল। প্যাট্রোক্লাস সে আগুন নিবিয়ে ফেললেন। বজ্ৰাধিপতি জিয়াস সহসা বজ্র নিক্ষেপের জন্য কোন পর্বতশিখর হতে ঘন মেঘমালাকে অপসারিত করলেও চারিদিকে অন্যান্য শিখরদেশ ও অরণ্যভূমি যেমন সেই বজ্ৰাগ্নিবিচ্ছুরিত আলোর সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ভয়ে পালায় না, তেমনি প্যাট্রোক্লাসের তেজোদীপ্ত সমবোদ্যমের ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেও একেবারে পালিয়ে গেল না ট্রয়সেনারা, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত লাগল ইতস্তত।

বিক্ষিপ্তভাবে হলেও যুদ্ধ ঘোরতর হয়ে উঠল। উভয় পক্ষের দলপতিরা পরস্পরকে হত্যা করতে লাগল। মেনোতিয়াসপুত্রের বর্শার ফলকটি আরেইলাইকাসের একটি উরুদেশ বিদ্ধ করে তার সমস্ত অস্থি চূর্ণ করে ফেলল। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন অ্যারেইলাইকাস। মেনেলাস থোয়াসের বুকে আঘাত করতেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন থোয়াস। অ্যাফিক্লাস যখন ফাইলেউসপুত্রকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল তখন ফাইলেউসপুত্র আগেই তা দেখতে পেয়ে তার বর্শা দিয়ে অ্যাফিক্লাসের ঊরুদেশের ঊর্ধ্বভাগে আঘাত করলেন এমনভাবে যাতে গোটা পা-টি ভেঙ্গে গেল তার। অন্যতম নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকাস আতিমনিয়াবাসের গলদেশ বর্শার দ্বারা বিদ্ধ করে হত্যা করলেন তাকে। মেরিস তার ভাই-এর মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য অ্যান্টিলোকাসকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু অ্যান্টিলোকাসকে আঘাত করার আগেই থেসিমিদিস তার ঘাড়ে তাঁর বর্শাটি আমূল বসিয়ে দিয়ে তাকে বধ করেন। এইভাবে নেস্টরের দুই পুত্রের আঘাতে সার্পেডনের দুই সহকর্মী মৃত্যুপুরীতে গমন করলেন। অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স ক্লিওবুলাসকে জীবন্ত বন্দী করলেন, কিন্তু পরে তার ঘাড়ে তরবারি দ্বারা আঘাত করে হত্যা করলেন তাকে। ক্লিওবুলাসের তপ্ত তাজা রক্তে রঞ্জিত হলে উঠল অয়লিয়াসপুত্রের তরবারি।

এবার পেনেলিয়াস ও লাইকস যুদ্ধে মেতে উঠল দুজনে। প্রথমে বর্শা দ্বারা কেউ কাউকে আঘাত করতে না পারায় তরবারি বার করে আক্রমণ করল পরস্পরকে। লাইকস তার তরবারির দ্বারা পেনেলিয়াসের শিরস্ত্রাণের উপর আঘাত করতেই তরবারির হাতলটি ভেঙ্গে গেল। পেনেলিয়াস তখন লাইকসের কানের কাছে ঘাড়ের উপর আঘাত করল। সে আঘাতে ছিন্ন হয়ে গেল লাইকসের মুণ্ডটি। মেরিওনস অ্যাকামাসের পশ্চাতে ধাবিত হলে সে যখন তার রক্তের উপর চাপতে যাচ্ছিল তখন বর্শা দিয়ে তার ডান কাঁধে আঘাত করতেই যে পড়ে গেল। আইডোমেনেউস এরাইমাসের মুখের ভিতর বর্শাটি ঢুকিয়ে দিতেই সমস্ত দাঁত ও মুখমণ্ডলের অস্থিগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

এইভাবে গ্রীকবীরগণ একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করে যেতে লাগলেন। ক্ষুধার্ত নেকড়েরা যেমন দলচ্যুত বা পালচ্যুত কোন ছাগশিশু বা মেষশাবককে ধরে ধরে খায়। তেমনি হিংস্রভাবে গ্রীকরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্রয় সৈন্যদের উপর।

এদিকে তেলামনপুত্র বীর অ্যাজাক্স হেক্টরকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু বুদ্ধিমান হেক্টর তাঁর সেনাদলের পিছনে ঢালের আড়ালে এমনভাবে দাঁড়িয়েছিলেন যে সে বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। তিনি এক নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করে শত্রুদের বর্শা ও তীরবৃষ্টি লক্ষ্য করছিলেন। তিনি এবার বেশ বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধের গতির সঙ্গে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। তথাপি তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ না করে করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সহকর্মীদের রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন।

জিয়াস কোন প্রবল ঝড়ের সৃষ্টি করলে সে ঝড়ের দ্বারা তাড়িত হয়ে মেষগুলো যেমন পর্বতশিখর হতে শূন্য আকাশে ভেসে বেড়ায় দিক হতে দিগন্তের পথে, তেমনি গ্রীকতাড়িত ট্রয়সৈন্যরা ছুটে বেড়াতে লাগল প্রাণভয়ে।

হেক্টর অন্যান্য ট্রয়সৈন্যদের ফেলে রেখে একটা রথে করে চলে গেলেন। ট্রয়সৈন্যরা গ্রীকদের দ্বারা খনিত পরিখার এপারেই রয়ে গেল এবং তাদের রথ সে পরিখা পার হবার পথ খুঁজে না পেয়ে সেই পরিখার মধ্যে প্রায়ই পড়ে যাচ্ছিল। তীব্র সন্ত্রস্ত ট্রয়সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে দিকে পারছিল ছুটে পালাচ্ছিল। প্যাট্রোক্লাস ক্রমাগত তাদের তাড়না করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পলায়নরত সৈন্যদের পদভারে ধূলোয় মেঘ উড়ে বেড়াতে লাগল সারা যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে। তাদের অশ্বগুলো অতিকষ্টে তাদের নিয়ে পালাচ্ছিল গ্রীকদের জাহাজ ও শিবিরসংলগ্ন জায়গা থেকে।

প্যাট্রোক্লাস তার অধীনস্থ সেনাদলকে তথনো উত্তেজিত করে যাচ্ছিলেন। পলায়নরত ট্রয়সৈন্যদের রথগুলো পরিখা পার হতে গিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। অনেকে রথ হতে পড়ে যাচ্ছিল মাটির উপরে। যারা পড়ে যাচ্ছিল তারা প্যাট্রোক্লাসের রথচক্রে পিষ্ট হচ্ছিল। প্যাট্রোক্লাসের রথাশ্বগুলো দেবদত্ত ছিল বলে তারা অনায়াসে পরিখা অতিক্রম করে যাচ্ছিল প্রয়োজনকালে। প্যাট্রোক্লাসের একমাত্র লক্ষ্য ছিল হেক্টর। হেক্টরকে আঘাত করার মানসে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন দিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু হেক্টর তখন তার রথে করে বহু দূরে চলে গিয়েছিলেন। শরৎকালের কোন একদিন প্রথম বৃষ্টিপাত হলে যেমন পার্বত্য নদী সহসা জলস্ফীত হয়ে সমুদ্রাভিমুখে বেগে ধাবিত হয় তেমনি ট্রয়সৈন্যদের অশ্বগুলো তাদের মনিবকে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, প্যাট্রোক্লাস তার মাঝখানে গিয়ে পড়ায় তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল এবং একদল গ্রীকজাহাজের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য হলো। ট্রয়নগরীতে ফিরে যেতে তাদের দিলেন না প্যাট্রোক্লাস। তারা গ্রীকজাহাজের কাছে ফিরে এলে প্যাট্রোক্লাস নির্বিচারে তাদের হত্যা করে তার মৃত সহকর্মীদের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করতে লাগলেন।

প্রথমে তিনি তাঁর বর্শা দিয়ে পোণয়ের বুকে আঘাত করলেন। তারপর তিনি এনপস-এর পুত্র মেস্টরকে আক্রমণ করলেন। মেস্টর তখন রথের উপর ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে বসেছিলেন। যুদ্ধের অবস্থা দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন তিনি এবং রথাশ্বের লাগামটি পড়ে গিয়েছিল তার হাত থেকে। প্যাট্রোক্লাস তাঁর বর্শাটি তাঁর মুখের চোয়ালে গেঁথে দিতেই বঁড়শিগাঁথা মাছের মত রথ হতে উঠে পড়ে গেলেন মেস্টর। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটল তার। মেস্টরের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার অভিপ্রায়ে অ্যারাইলস প্যাট্রোক্লাসের দিকে এগিয়ে আসতেই প্যাট্রোক্লাস একটি বড় প্রস্তরখণ্ড ছুঁড়ে মারতেই সে মাটিড়ে পড়ে গেল। এইভাবে প্যাট্রোক্লাস একের পর এক করে অ্যারাইমাস, অ্যাফোডেমাস, অ্যাপিলটেস, নিপোলিমাস, অ্যাকিয়াস, অ্যাফিয়াস, ওপলিমেনাসকে হত্যা করলেন।

প্যাট্রোক্লাস যখন এইভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন হত্যার তাণ্ডব তখন তা সার্পেন দেখে লাইসিয়াবাসীদের ভর্ৎসনা করে বললেন, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। কোথায় পালাচ্ছ তোমরা তোমরা না পার আমি নিজে গিয়ে ঐ লোকটির সম্মুখীন হয়ে দেখব ও কত বড় বীর। সে আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে এবং আমাদের বহু বীরকে ধরাশায়ী করেছে।

এই বলে রথ হতে অবতরণ করলেন সার্পেড়ন। তা দেখে প্যাট্রোক্লাসও তাঁর রথ থেকে অবতরণ করে এগিয়ে এলেন। পর্বতোপরি দুটি ক্রুদ্ধ শকুনি যেমন আক্রমণ করে তেমনি পরস্পরকে আক্রমণ করলেন দুজনে।

ক্রোনাসপুত্র জিয়াস স্বর্গ থেকে এ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে তাঁর ধর্মপত্নী হেরাকে বললেন, হায়, যে, সার্পেৰ্ডনকে আমি এত ভালবাসি সেই সার্পেৰ্ডন আজ প্যাট্রোক্লাসের হাতে মৃত্যুকে বরণ করতে বসেছে। যুদ্ধক্ষেত্র হতে নিরাপদে তুলে এনে তাকে কি লাইসিয়ায় পাঠিয়ে দেব না মেনোতিয়াসপুত্রের হাতে তার মৃত্যু ঘটাব তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।

হেরা উত্তর করলেন, কি বলছ তুমি ক্রোনাসপুত্র? যে একজন মরণশীল মানুষের মৃত্যু বিধিনির্দিষ্ট হয়ে আছে আগে হতে, তাকে তুমি ছিনিয়ে নিয়ে আসতে চাও নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে তোমার যা খুশি করতে পার কিন্তু আমরা তোমাকে সমর্থন করব না। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, যদি তুমি সার্পেডনকে নিরাপদে বাড়ি পাঠিয়ে দাও তাহলে অন্যসব দেবতারাও তাদের আপন আপন মানবসন্তানকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে দূরে নিয়ে যাবে। এই ট্রয়যুদ্ধে অনেক দেবতার সন্তান যুদ্ধ করছে। তাহলে দেবতারা সকলেই ঈর্ষান্বিত হবে তোমার প্রতি। যদি তুমি একান্তই তাকে ভালবাস এবং দয়া করো তাহলে প্যাট্রোক্লাসের হাতে মৃত্যুবরণ করতে দাও। তারপর নিদ্রা ও মৃত্যুকে পাঠিয়ে দাও। সেখানে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হবে, তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হবে।

দেবরাজ জিয়াস তাতে সম্মত হলেন। তবে প্যাট্রোক্লাস যখন ট্রয়ের রণপ্রান্তরে সার্পেডনকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন তখন সাপেডনের সম্মানার্থে পৃথিবীর উপর রক্তবৃষ্টি করলেন জিয়াস।

সার্পেৰ্ডন ও প্যাট্রোক্লাস দুজনে পরস্পরের কাছে এলে প্যাট্রোক্লাস প্রথমে সার্পেডনের সারথি থেসিমেনাসকে তার উদরদেশে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করলেন। সার্পেডন তখন তার বর্শাটি নিক্ষেপ করলেন প্যাট্রোক্লাসকে লক্ষ করে। কিন্তু প্যাট্রোক্লাসকে তা আঘাত করতে পারল না। সে বর্শাটি লাগল প্যাট্রোক্লাসের রথের অন্যতম অশ্ব পেদারসাদের গায়ে। পেদারসাস চিৎকার করে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণবিয়োগ ঘটল তার। রথের সঙ্গে সংযযাজিত তিনটি অশ্বের মধ্যে একটি পড়ে যাওয়াতে দুটি অশ্ব রথের লাগামের সঙ্গে জড়িয়ে গেল ফলে তারা ছুটতে পারছিল না রথ নিয়ে। তখন সারথি অটোমীডন তার কটিদেশে সংবদ্ধ তরবারিটি বার করে তাই দিয়ে মৃত অশ্বের লাগামটি কেটে দিতেই অশ্ব দুটি রথ নিয়ে বেগে চলে গেল অন্য দিকে।

সার্পেডন এবার প্যাট্রোক্লাসকে লক্ষ্য করে আবার বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু এবারেও তা ব্যর্থ হলো। সে বর্শা প্যাট্রোলাসের বাঁ কাঁধের উপর দিয়ে চলে গেল। এবার প্যাট্রোক্লাস তার বর্শা নিক্ষেপ করলেন সাডেনকে লক্ষ্য করে। সে বর্শা কিন্তু ব্যর্থ হলো না। সে বর্শা সোজা গিয়ে লাগল সার্পেডনের বুকে ঠিক যার তলায় হৃৎপিণ্ড থাকে। কাঠুরিয়ারা জাহাজ নির্মাণের জন্য দীর্ঘক্ষণ কুঠার দ্বারা কোন বিরাট ওক বা পপলার গাছ কাটতে থাকলে সে গাছটি যেমন একসময় সশব্দে পড়ে যায়, তেমনি বীর সার্পেডনও কাতর আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গিয়ে রক্তাপুত মাটি মুঠোয় করে ধরার চেষ্টা করলেন। সহসা কোন সিংহ গরুর পালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি বলিষ্ঠকায় বলদকে তুলে নিয়ে গেলে বলদটি যেমন গর্জন করতে থাকে সিংহের কবলের মাঝে থেকেও, তেমনি প্যাট্রোক্লাসের হাতে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও গর্জন করতে লাগলেন সার্পেড়ন। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মী গ্লাকাসকে ডেকে বললেন, হে ভাই গ্লাকাস, বীরশ্রেষ্ঠ পুরুষ, বীর সৈনিকের মত যুদ্ধ করে যথাশক্তি প্রয়োগ করে। লাইসিয়াবাসীদের মাঝে গিয়ে বল, তারা যেন আমার সম্মানের খাতিরে যুদ্ধ করে আর তুমি নিজে আমার জন্য যুদ্ধ করবে যাতে ওরা আমার বর্মটি খুলে না দিতে পারে আমার দেহ থেকে। তোমার উপস্থিতিতে আমার বর্ম খুলে নিলে চিরদিন আমার নামউচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র লজ্জা অনুভব করবে তুমি। যাও, আমি যা বললাম তা করো, সকলকে সমবেত করো।

কথা বলতে বলতেই মৃত্যু ঘটল সার্পেডনের। প্যাট্রোক্লাস তখন তার বুকের উপর পা দিয়ে বর্শাটি তুলে ফেললেন আর তার সঙ্গে তাঁর হৃৎপিণ্ডটাও যেন বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে মার্ডিডনরা সার্পেডনের রথের অশ্বগুলো নিয়ে নিল।

সার্পেডনের কথা শুনে নিদারুণ মর্মযন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল গ্লুকাস, কারণ সে কোনভাবে সাহায্য করতে পারে নি সার্পেড়নকে। কারণ সে যখন এর আগে গ্রীকপ্রাচীর আক্রমণ করে তখন তা রক্ষা করতে গিয়ে টিউসার একটি তীর নিক্ষেপ করে তাকে লক্ষ্য করে আর সেই তীরে তার একটি বাহু আহত হয়। সেই থেকে আর একটি হাত দিয়ে বাহুর ক্ষতস্থানকে ধরে ছিল গ্লুকাস। সেই বাহুর ক্ষতস্থানে তখনো যন্ত্রণা হচ্ছিল তার। সাপেড়নকে সাহায্য করতে না পেরে সে কাতরভাবে অ্যাপোলোর উদ্দেশ্য প্রার্থনা জানিয়ে বলল, হে দেবরাজ অ্যাপোলা, তুমি লাইসিয়া বা ট্রয় যেখানেই থাক আমার এই কাতর প্রার্থনা অবশ্যই শুনতে পাবে, তা শুনে বুঝতে পারবে আজ আমি কত দুর্দশাগ্রস্ত। আমার বাহুতে এক ভয়ঙ্কর ক্ষত থাকায় তাতে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে, আমার হাতটি ভারী হয়ে রয়েছে, আমার রক্তের মধ্যে কোন জোর পাচ্ছি না। যার ফলে জিয়াসতনয় সার্পেডন নিহত হওয়া সত্ত্বেও আমি বর্শা ধারণ করে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারছি না। জিয়াস তাঁর নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে পারেন নি। সুতরাং হে দেবযুবরাজ, আমার যন্ত্রণার উপশম ঘটিয়ে আমার দেহে শক্তি দাও যাতে আমি লাইসিয়াবাসীদের অনুপ্রাণিত করে সার্পেডনের মৃতদেহটি রক্ষা করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি।

তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন অ্যাপোলো। তিনি তার যন্ত্রণার উপশম ঘটালেন এবং ক্ষতস্থান হতে কালো রক্ত বার করে দিয়ে শক্তি সঞ্চার করলেন তার দেহে। গ্লুকাস বুঝতে পারল দেবতা তার প্রার্থনার কথা শুনেছেন। দেহে শক্তি পেয়ে লাইসিয়াবাসীদের মাঝে চলে গেল সে।

তাদের দলপতিদের কাছে আবেদন জানাল তারা যেন সবাই একযোগে সাপেডনের মৃতদেহটিকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করে। এরপর গ্লকাস চলে গেল ট্রয়বীর পরিডেমাস, অ্যাজিনর, ঈনিস ও হেক্টরের সন্ধানে। হেক্টরের দেখা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকাস বলল, হে বীর হেক্টর, আপনার যে মিত্রশক্তিবর্গের লোকের ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরে বিদেশে এসে কষ্ট করছে, আপনি তাদের কথা ভুলে গেছেন। আপনি তাদের সাহায্যার্থে কিছুই করছেন না। লাইসিয়াবাসীদের ন্যায়পরায়ণ ও শক্তিমান নেতা সার্পেডনের পতন ঘটেছে। প্যাট্রোক্লাসের বর্শার আঘাতে অ্যারেস তার মৃত্যু ঘটিয়েছেন। এখন হে ট্রয়বীরগণ, আপনারা সেই মৃতদেহটিকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করুণ যাতে এই মৃতদেহের গাত্র হতে মার্মিডনরা বর্ম খুলে নিতে বা গ্রীকজাহাজে অনেক গ্রীকসেনাকে আমরা হত্যা করেছি বলে তার প্রতিশোধস্বরূপ এই মৃতদেহের উপর যেন কোন অসম্মান করতে না পারে।

গ্লুকাসের কথা শুনে ট্রয়বীররা সার্পেডনের কথা গভীর শোকে নিমগ্ন হলেন। বহুসংখ্যক লাইসিয়াবাসীদের নেতা সার্পেন বিদেশী হলেও ট্রয়বাসীরা তাঁকে তাদেরই একজন হিসেবে গণ্য করতেন। সার্পেনের মৃত্যুজনিত ক্রোধে উন্মত্ত প্রায় হেক্টরের নেতৃত্বে শত্রুসৈন্যদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য এগিয়ে গেলেন ট্রয়বীরেরা। ওদিকে অনমনীয় তেজস্বিতায় উদ্দীপিত প্যাট্রোক্লাসও উত্তেজিত করে যাচ্ছিলেন গ্রীকসেনাদের। প্যাট্রোক্লাস প্রথমে এই অ্যাজাক্স বীরকে সম্বোধন করে বললেন, হে অ্যাজাক্সবীরদ্বয়, নতুন করে আবার তোমাদের সেই অসমসাহসিকতা ও অতুলনীয় শক্তির পরিচয় দাও। যে সার্পেডন প্রথম গ্রীকপ্রাচীর লঙ্ঘন করে সেই সার্পেন আজ নিহত। চল আমরা তার দেহ থেকে বর্ম খুলে নিয়ে তার মৃতদেহটিকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করি। যদি তার কোন সহকর্মী আমাদের কাছে বাধা দিতে আসে তাহলে তাদের আমরা হত্যা করব।

গ্রীকবীরেরা আগে হতেই এবিষয়ে এক আগ্রহ অনুভব করছিলেন। সার্পেডনের মৃহদেহটির চারিপাশে উভয়পক্ষের সৈন্যরা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। একদিকে ট্রয় ও লাইসিয়াবাসীরা ও অন্যদিকে গ্রীক ও মার্মিডন সৈন্যরা। তাঁর পুত্রের মৃতদেহকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের গতিকে তীব্রতর করার জন্য রণক্ষেত্রের উপর মায়াঘন এক অন্ধকারজাল বিস্তার করলেন জিয়াস।

প্রথম দিকে ট্রয়পক্ষই কিছুটা এগিয়ে গেল। কারণ প্রথম ট্রয়পক্ষের সৈন্যরা মার্মিডননেতা অ্যাগাকলসপুত্র অ্যাসেইপিয়াসকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। অ্যাসেইপিয়াস প্রথমে বুদেয়াম নামে এক নগরে বাস করত। কিন্তু তার এক জ্ঞাতিভাইকে হত্যা করে সে তার দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে মার্মিডনে আশ্রয় নেয়। রাজা পেলেউসই তাকে অ্যাকেলিসের নেতৃত্বে ট্রয়যুদ্ধে পাঠান। অ্যাসেইপিয়াস যখন সার্পেডনের মৃতদেহটি নিয়ে যাবার জন্য সেটিকে ধরতে যায় তখন হেক্টর একটি বড় পাথর দিয়ে তার মাথার উপর সজোরে নিক্ষেপ করেন আর সঙ্গে সঙ্গে শিরস্ত্ৰণাসমতে তার মাথাটি চূর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যায়। তাঁর সহকর্মীর মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্যাট্রোক্লাস ছুটে গিয়ে স্থেনেলাসের ঘাড়ের উপর একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করেন আর তার ফলে ঘাড় আর মেরুদণ্ডের সন্ধিস্থানটি ভেঙ্গে যায়। তা দেখে হেক্টর ও অন্যান্য ট্রয়বীরেরা সরে গেলেন। অস্ত্রসঞ্চালন প্রতিযোগিতা অথবা যুদ্ধকালের কোন প্রতিযোগিতা অথবা যুদ্ধকালে কোন প্রতিযোগী বা সেনানী একটি বর্শা যথাশক্তি প্রয়োগ করে নিক্ষেপ করলে তা যতদূর যেতে পারে ঠিক ততটা জায়গা গ্রীকদের সামনে ছেড়ে দিয়ে পশ্চাপসরণ করলেন ট্রয়বীরেরা। লাইসিয়াবাসীদের নতুন অধিপতি গ্লকাস মামিনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনী ও হেলাস দ্বীপের অধিবাসী ব্যাথাইকলস-এর বক্ষস্থল বর্শার দ্বারা

ভেদ করে হত্যা করল তাকে। ব্যাথাইকলস-এর মৃত্যুতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল গ্রীকরা। অন্য দিকে আনন্দোফুল্ল ট্রয়বাসীরা এগিয়ে এল সার্পেডনের মৃতদেহটিকে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু গ্রীকরা তাদের শক্তি সম্বন্ধে নতুন করে সচেতন হয়ে আক্রমণ করল সংশ্লিষ্ট ট্রয়সেনাদলকে।

এরপর মেরিওরস লাগোনাস নামে এক ট্রয়যোদ্ধাকে হত্যা করলেন। অলিনরপুত্র লাগোনাস ছিলেন আইডা পর্বতস্থ জিয়াসের মন্দিরের পুরোহিত। লোকে তাঁকে দেবতার মত ভক্তি করত। কিন্তু মেরিওনস তার কান ও মুখের চোয়ালের কাছে আঘাত করতেই সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেল। ঈনিস তখন একটি বর্শা। নিয়ে মেরিওনসকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করলেন। কিন্তু মেরিওনস তা দেখতে পেয়ে সরে গেল এবং বর্শাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে গেল। তখন ঈনিস মেরিওনসকে সম্বোধন করে বললেন, মেরিনাস, তুমি একজন ভাল নৃত্যশিল্পী। কিন্তু আমার বর্শা যদি আঘাত করতে পারত তোমায় তাহলে আজ জীবনাবসান ঘটত তোমার।

মেরিনাস উত্তর করল, ঈনিস, তোমার যতই বীরত্ব থাক, তোমার সকল শত্রুর জীবনাবসান ঘটাবার ক্ষমতা তোমার নেই। তুমিও আমার মতই একজন মরণশীল মানুষ। আমার বর্শা যদি তোমায় আঘাত করতে পারত তাহলে যতবড় শক্তিমান হও না কেন, মৃত্যুদেবতার কাছে উৎসর্গ করতে হত তোমার জীবন।

একথা শুনে মেনোতিয়াসপুত্ৰ প্যাট্রোক্লাস তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মেরিনাস, একজন বীর হয়ে এরূপ বিদ্রূপবাক্য উচ্চারণ করা উচিত নয়। তুমি শুধু কথার দ্বারা ট্রয়সৈন্যদের বিতাড়িত করতে পারবে না এখান থেকে। তাদের বেশকিছু সৈন্যকে মৃত্যুপুরীতে পাঠাতে হবে তার জন্য। যুদ্ধে ঘাত-প্রতিঘাত আর বিতর্কে বাক্যবানই বিধেয়। সুতরাং মুখে কোন কথা বলল না।

প্যাট্রোক্লাসকে নীরবে অনুসরণ করতে লাগল মেরিওনস। আবার ঘোরতর হয়ে উঠল যুদ্ধ উভয়পক্ষে। একসঙ্গে বহু কাঠুরিয়া কোন পার্বত্য অরণ্যে কাঠ কাটতে গেছে যেমন কাঠ ও কুঠারের ঘর্ষণজনিত এক বিপুল শব্দ দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি উভপক্ষের অস্ত্র ও ঢালের ঘর্ষণের ফলে এক বিপুল শব্দের সমুদ্র ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল রণক্ষেত্রের নিস্তরঙ্গ বাতাসে। সার্পেডনের মৃতদেহটি নিয়ে যাবার জন্য তখনে সমানে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল উভয়পক্ষের সৈন্যরা। অসংখ্য বর্শা ও ঢাল দিয়ে মৃতদেহ এমনভাবে ঢাকা ছিল যে তা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না।

ওদিকে সুদূর স্বর্গলোকে বসে মুহূর্তের জন্য তাঁর সতর্ক দৃষ্টি সার্পেডনের মৃতদেহ থেকে অপসারিত করে নেননি জিয়াস। তিনি তখন একমনে চিন্তা করছিলেন প্যাট্রোক্লাসকে কিভাবে হত্যা করা যায়। তিনি কি এখনই প্যাট্রোক্লাসকে হত্যা করে তার দেহ হতে বর্শা খুলে নিতে সমর্থ করে তুলবেন হেক্টরকে, না যুদ্ধে ট্রয়বাসীদের আরও কিছু দুঃখ ভোগ করতে বাধ্য করবেন সে বিষয়ে চিন্তা করছিলেন তিনি। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্ত শ্ৰেষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করলেন যে, পেলেউসপুত্রের সহকর্মী এবং সারথি হেক্টর ও ট্রয়সেনাদের বিতাড়িত করে নগরমধ্যে নিয়ে যাবেন আর বহু ট্রয়সৈন্যকে হত্যা করবেন। প্রথমে তিনি হেক্টরকে রথে চেপে পলায়ন করতে বাধ্য করলেন। হেক্টর ও ট্রয়সৈন্যদের তাঁর অনুসরণ করতে আদেশ দিলেন, কারণ তিনি বুঝতে পারলেন জিয়াসের পক্ষপাতিত্বের মানদণ্ড তাদের উপর থেকে তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি ঝুঁকেছে। লাইসিয়াবাসীরাও তাদের রাজাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তারা ভীত হয়ে পালাতে লাগল। তখন গ্রীকসেনারা এসে সার্পেডনের মৃতদেহ হতে উজ্জ্বল বর্মটি খুলে নিতেই প্যাট্রোক্লাস সেটিকে গ্রীকজাহাজে নিয়ে যাবার আদেশ দিলেন। জিয়াস তখন অ্যাপোলোকে বললেন, যাও ফীবাস, সার্পেডনের মৃতদেহটি অস্ত্রের নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়ে পবিত্র মদ্য দ্বারা সেটিকে মার্জনা করো, তারপর উত্তম পোশাকে আবৃত করে নিদ্রা ও মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করো তাকে। তারা তাকে নিয়ে যাবে তার স্বদেশ লাইসিয়া যেখানে তার ভ্রাতা ও আত্মীয় পরিজনরা তাকে সমাহিত করে তার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করবে তার সম্মানার্থে।

তাঁর পিতার কথামত আইডা পর্বত হতে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে সাপেড়নের মৃতদেহটি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নদীর জলে স্নান করিয়ে দিলেন অ্যাপোলো। তারপর তৈল মর্দন করে উত্তম পোশাক পরিয়ে মৃত্যু ও নিদ্রার হাতে তাকে সমর্পণ করলেন। আর তারা সঙ্গে সঙ্গে লাইসিয়ায় নিয়ে গেল সার্পেডনের মৃতদেহটিকে।

এদিকে আপন অহঙ্কার ও নির্বুদ্ধিতার বশবর্তী হয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ধ্বনি দিতে দিতে ট্রয় ও লাইসিয়াবাসীদের পশ্চাতে ধাবিত হলেন প্যাট্রোক্লাস। যদি তিনি পেলেউসপুতের আদেশ অনুসারে শত্রুসৈন্যদের জাহাজের সীমানা থেকে বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হয়ে ফিরে যেতেন তাহলে মৃত্যুকে পরিহার করতে পারতেন স্বচ্ছন্দে। কিন্তু জিয়াসের অভিপ্রায়ের রহস্য বুঝবার সাধ্য কোন মানুষের নেই। কখনো তিনি বীরকেও যুদ্ধ হতে বিরত হয়ে পলায়নে বাধ্য করেন, তার হাতের মুঠো হতে জয়ের গৌরব চলে যায় অন্য লোকের হাতে। আবার কখনো বা তিনি তার মনে ভ্রান্ত আশা সঞ্চার করে ক্রমাগত তার মনকে টেনে নিয়ে যান যুদ্ধের দিকে। তেমনি এখন তিনি এক অদম্য উচ্চশা জাগিয়ে তুললেন প্যাট্রোক্লাসের মনে।

কিন্তু প্যাট্রোক্লাস যখন এইভাবে বিধিনির্দিষ্ট মৃত্যুর দ্বারদেশে ভাগ্যচক্রে আনীত হলেন তখন কে সর্বপ্রথম আর কেই বা সর্বশেষ নিহত হলো তাঁর দ্বারা প্রথমে আদ্ৰেস্তানস, অ্যান্টোনোয়াস, অ্যাকোস, মেদিসপুত্র মেরিকাস, অ্যাপিস্টার ও মেলানিপ্লাস নিহত হলো তার দ্বারা। তারপর তিনি হত্যা কররেন ইনানাস, মুনিয়াস, পাইলেটসকে। বাকি ট্রয়বাসীরা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাল।

প্যাট্রোক্লাস যখন প্রচণ্ডভাবে তাঁর বর্শা সঞ্চালন করছিলেন যাতে সেই দিনই গ্রীকরা ট্রয়নগরী অধিকার করতে পারত তাঁর নেতৃত্বে। কিন্তু সহসা অ্যাপোলো সেই নগরপ্রাচীরের উপর এসে দাঁড়ালেন তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার মানসে। তিনবার প্যাট্রোক্লাস নগর প্রাচীরের এধার থেকে আক্রমণ করলেন আর তিনবারই সে আক্রমণ প্রতিহত করলেন অ্যাপোলো নিজে। কিন্তু প্যাট্রোক্লাস যখন চতুর্থবার আক্রমণ করলেন তখন অ্যাপোলো তাকে বললেন, শোন প্যাট্রোক্লাস, তুমি সরে যাও, ট্রয়নগরীর বিধ্বস্ত করার গৌরব তোমার ভাগ্যে নেই। তোমার থেকে যদি অনেক বেশি শক্তিমান ও সুযোগ্য সেই অ্যাকেলিসের ভাগ্যে সে গৌরব নেই। অ্যাপোলোর কথা শুনে তাঁর রোষ পরিহার করার জন্য সরে গেলেন প্যাট্রোক্লাস।

হেক্টর এতক্ষণ ট্রয়নগরীর স্কীয়ান দ্বারপথে রথে চেপে অপেক্ষা করছিলেন। সৈন্যগণহ নগরমধ্যে প্রত্যাবৃত হবেন না পুনরায় যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বহির্গত হবেন তাই তিনি ভাবছিলেন স্থিরচিত্তে। এইভাবে সংশয়াচ্ছন্ন চিত্তে ভাবছিলেন হেক্টর, এমন সময় রাণী হেকুবার ভ্রাতা ডাইমাসপুত্র তরুণ বীর অ্যাসিয়াসের ছদ্মবশ ধারণ করে অ্যাপলো তাঁর নিকটে এসে বললেন, কেন তুমি যুদ্ধ ত্যাগ করেছ হেক্টর? এটা তোমার মত বীরের পক্ষে উচিত কাজ হয় নি। আমি যদি তোমার থেকে বড় যোদ্ধা হতাম তাহলে কিছুতেই এই ভুল করতাম না। তোমার এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য পরে অনুশোচনা করতে হবে তোমায়। সোজা এখন প্যাট্রোক্লাসের কাছে চলে যাও। অ্যাপোলোর কৃপায় তুমি তাকে হত্যা করে লাভ করবে জয়ের গৌরব।

এই কথা বলেই ভিড়ের মধ্যে কোথায় মিশে গেলেন অ্যাপোলো। গ্রীকদের পাশ দিয়ে অ্যাপোলো যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন তাকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল গ্রীকরা, কারণ তিনি স্পষ্টত হেক্টর ও ট্রয়বাসীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।

হেক্টর অন্য কোন গ্রীকসেনাকে আক্রমণ না করে সোজা প্যাট্রোক্লাসের কাছে রথ চালনা করে নিয়ে গেলেন। প্যাট্রোক্লাসও তাঁকে দেখে রথ হতে অবতরণ করে এক হাতে বর্শা আর এক হাতে একটি বড় পাথর নিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি প্রথমে পাথরটি লক্ষ্য স্থির করলেন হেক্টরকে লক্ষ্য করে আর তার আঘাতে হেক্টরের সারথি সেব্রিওনের মাথাটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। রথ হতে পড়ে গেল সেব্রিন। দেখে মনে হলো সেব্রিন যেন জলে ডুব দিচ্ছে। তা দেখে পি করে বললেন প্যাট্রোক্লাস, বাঃ কেমন চমৎকারভাবে ডুব দিচ্ছে! ও সমুদ্রে থাকলে সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে অনেক মুক্তো তুলতে পারত। ট্রয়সৈন্যদের মাঝে অনেক ডুবুরিও আছে দেখছি।

এই কথা বলতে বলতে সেব্রিওনের অসাড় দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্যাট্রোক্লাস। আত্মঘাতী সে সাহস আপন ধ্বংসকেই ডেকে আনে, মৃঢ় সিংহসুলভ সেই সাহসের বশবর্তী হয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে সেব্রেওনের মৃতদেহটিকে আক্রমণ করলেন প্যাট্রোক্লাস। এদিকে হেক্টর তখন নেমে এলেন তাঁর রথ হতে। তখন সেই মৃতদেহ নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলো দুজনের মধ্যে। পর্বতের কোন নির্জন উপত্যকা মাঝে কোন এক মৃত হরিণের অধিকারকে কেন্দ্র করে যেমন দুটি সিংহ মেতে উঠে এক আত্মঘাতী সংগ্রামে, তেমনি এক প্রাণপণ সংগ্রামে মেতে উঠলেন হেক্টর ও প্যাট্রোক্লাস। তাঁদের দেখাদেখি গ্রীক ও ট্রয়সৈন্যরাও মেতে উঠল এক প্রচণ্ড যুদ্ধে। অনেক সময় যেমন কোন গভীর অরণ্য প্রদেশের অধিকার নিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণা বায়ু প্রচণ্ড সগ্রামে মেতে উঠলে সেই অরণ্যমধ্যস্থ বড় বড় মহীরুহগুলোও যেমন প্রমত্ত হয়ে উঠে এক পারস্পরিক সংঘর্ষণে তেমনি তাদের দুই বীরকে যুদ্ধরত দেখে গ্রীক ও ট্যয়সৈনরাও যুদ্ধ করতে লাগল প্রবলভাবে। সেব্রিওনের মৃতদেহটিকে কেন্দ্র করে বর্শা ও তীর উভয়পক্ষে হতেই নিক্ষিপ্ত হলো। কত পাথর ঢালের উপর ফেলে পড়ল, অথচ সেই অবিরাম অস্ত্রবর্ষণ আর সঘন ধূলিরাশির ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে নির্বিকারভাবে শুয়ে রইল সেব্রিওন। কোন পক্ষেই হার মানবে না কারো কাছে।

সূর্য যতক্ষণ মধ্যগগনে দীপ্যমান ছিল ততক্ষণ উভয় পক্ষই সমান কৃতিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। কিন্তু যখন সূর্য অস্ত যাবার সময় হলো তখন অপ্রত্যাশিতভাবে গ্রীকরা অগ্রসর হতে লাগল জয়ের পথে। ট্রয়সৈন্যদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও গ্রীকরা সেব্রিওনের মৃতদেহটি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে তার কাঁধ থেকে বর্ম খুলে নিল। প্যাট্রোক্লাস তখন রণদেবতা সাক্ষাৎ অ্যারোসের মত বিক্রম ও গর্বসহকারে তিন তিনবার ট্রয়পক্ষকে আক্রমণ করে নয়জন শত্রুসৈন্যকে হত্যা করলেন। কিন্তু তিনি চতুর্থবার আক্রমণ করতেই তাঁর মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে এল। তার পতনের জন্য তখন স্বয়ং অ্যাপোলো গেলেন এগিয়ে। মায়াময় এক সঘন ছায়ান্ধকার অ্যাপোলোর দেহটি আচ্ছন্ন থাকায় তাকে দেখতে পাননি প্যাট্রোক্লাস। তাঁর হাতের তালু দিয়ে প্যাট্রোক্লাসের পিঠের উপর চপেটাঘাত করতেই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন প্যাট্রোক্লাস। একটি আঘাতেই প্যাট্রোক্লাসের মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটি ধূলি ও রক্তে গড়াগড়ি করতে লাগল। অ্যাকেলিসের দেবোপম মস্তকে যে শিরস্ত্রাণ শোভা পেত সেই শিরস্ত্রাণের এমন দুর্দশা এর আগে কখনো হয় নি। এবার সেই শিরস্ত্রাণটি শোভা পাবে বীর হেক্টরের মস্তকে। কিন্তু হেক্টরের মৃত্যুরও বিলম্ব ছিল না। শুধু মাথা হতে শিরস্ত্ৰণা নয়, হাতের বর্শাটিও গেল ভেঙ্গে, তার ঢালটি পড়ে গেল মাটিতে এবং তার দেহবন্ধনী শিথিল করে দিলেন অ্যাপোলো।

ফলে প্যাট্রোক্লাসের চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হয়ে পড়ল শক্তিহীন। তিনি বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। এমন সময় সুদক্ষ অশ্বারোহী প্যানেথোয়াসপুত্র অ্যাফোরবাস এসে দাঁড়াল প্যাট্রোক্লাসের পিছনে। পিছন থেকে তাঁর পিঠের উপর বর্শাটি বসিয়ে দিল। অ্যাফোরবাস এই প্রথমবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও ইতিপূর্বেই কুড়িজন শত্রুসৈন্য হত্যা করে। কিন্তু এ আঘাতে প্যাট্রোক্লাসের পতন না ঘটায় সে প্যাট্রোক্লাসের পিঠ হতে বর্শাটি বার করে নিয়ে পালিয়ে গেল নিজেদের দলভুক্ত লোকদের মাঝে। ওদিকে দেবতার প্রভাবে বিভ্রান্ত ও আঘাতে কাতর প্যাট্রোক্লাস পলায়নে তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু হেক্টর তাকে এভাবে আহত অবস্থায় পালাতে দেখে তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে তাঁর উদরদেশের নিম্নভাগে আঘাত করলেন। এবার মাটিতে পড়ে গেলেন প্যাটোক্লাস। আর এই পতনের ফলে দুঃখের পরিসীমা রইল না গ্রীকদের। প্যাট্রোক্লাসকে ধরাশায়ী দেখে হেক্টর বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, প্যাট্রোক্লাস, তুমি ভেবেছিলে তুমি আমাদের নগর বিধ্বস্ত করে আমাদের রমণীদের শালীনতা হানি করে তোমরা নিয়ে যাবে তাদের সকলকে। নির্বোধ তুমি বুঝতে পার নি হেক্টর ও তার দ্রুতগামী অশ্বরা অতন্দ্র প্রহরীর মত নিরত ছিল তাদের প্রতিরক্ষার কাজে। আমিই হচ্ছি শ্রেষ্ঠ ট্রয়বীর, আমি তাদের সেই সম্ভাব্য পরাধীনতার গ্লানি হতে মুক্ত করলাম তাকে। এবার তোমার দেহ হবে শকুনির ক্ষুধার খাদ্য। হতভাগ্য অ্যাকেলিস তার এত বীরত্ব সত্ত্বেও রক্ষা করতে পারল না তোমায়। অথচ সে হয়ত তোমায় এখানে আসার সময় উপদেশ দিয়েছিল ‘হেক্টরের রক্ত না দেখে জাহাজে ফিরে আসবে না। আমার মনে হয় তোমার আসার সময় সে এই কথা বলেছিল আর নির্বোধের মত সে কথার ছলনায় ভুলে গিয়েছিলে তুমি।

নির্গতপ্রায় প্রাণবায়ু নিয়ে কোনরকমে উত্তর করলেন প্যাট্রোক্লাস। বললেন, আজ জিয়াস তোমার হাতে জয়ের গৌরব এনে দিয়েছেন বলেই তার জোরে এত গর্ব করছ তুমি। দেবতারাই আসলে আমায় পরাজিত করে আমার দেহ থেকে বর্ম খুলে নিয়েছে। তা না হলে তোমার মত কুড়িটা লোকও আমার কিছু করতে পারত না। বরং আমার বর্শার আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হত তারা সব। নিয়তি আর লিটোর পুত্রই আমার সব শক্তি কেড়ে নেয়। তার সঙ্গে মানবসন্তান অ্যাফোরবাসও ছিল। তিনি হলে তৃতীয় ব্যক্তি যে আমার হত্যার কাজ সম্পূর্ণ করলে। তবে একটা কথা শুনে রাখ, তোমার জীবনও বেশিদিন আর ইহলোকে নেই। তোমার মৃত্যু ও শেষ পরিণতির দিন এগিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে। আর তা হবে অ্যাকেলিসের হাতে।

এই কথা বলতে বলতেই মৃত্যু হলো প্যাট্রোক্লাসের। তার দেহের পিঞ্জর ত্যাগ করে আত্মার পাখি বেরিয়ে ঘেল চিরতরে। প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যু হবার পরে হেক্টর তাঁকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, প্যাট্রোক্লাস, কেন তুমি আমার মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী করলে? কে জানে, এমনও হতে পারে, আমারই আঘাতে মৃত্যুবরণ করতে হবে অ্যাকেলিসকে।

এই কথা বলার পর প্যাট্রোক্লাসের দেহের উপর পা দিয়ে তাঁর উদদেশ হতে বর্শাটি বার করে নিয়ে সেই বর্শা নিয়ে অটোমীডনের সন্ধানে চলে গেলেন হেক্টর। তিনি অটোমীডনকেও হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অটোমীডন তার অনেক আগেই অ্যাকেলিসের দ্রুতগামী অশ্বগুলো সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে হতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *