১৩. রণতরীর সন্নিকটে যুদ্ধ

ত্রয়োদশ পর্ব
রণতরীর সন্নিকটে যুদ্ধ

এইভাবে ক্রমাগত অনকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে হেক্টর ও ট্রয়সৈন্যদের গ্রীকরণতরীগুলোর অতি সন্নিকটে নিয়ে এলেন জিয়াস। প্রচুর শ্রমসহকারে যুদ্ধ করতে লাগল তারা। কিন্তু তাদের উপর এর বেশি আর সুনজর দিতে পারলেন না জিয়াস। তাঁর দৃষ্টি এবার অন্যত্র পড়ল। তিনি এবার গ্রেস, মাইসিয়া ও অ্যাবিয়ার সেনাদলগুলোর উপর নজর দিলেন। হিপ্পেমনগি নামে এক জাতিও যোগদান করেছিল ট্রয়যুদ্ধে। তারা শুধু দুধ খেয়ে বেঁচে থাকত। কিন্তু অ্যাবিয়ার অধিবাসীরা ছিল ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত। আর ট্রয়বাসীদের দিকে তাকালেন না জিয়াস। কারণ তিনি বেশ জানতেন কোন দেবতাই গ্রীক বা ট্রয়জাতিকে সাহায্য করতে যাবে না।

কিন্তু আর স্থির থাকতে পারলেন না ঝড় ও ভূমিকম্পের দেবতা পসেডন। তিনি এতক্ষণ ডাইডা পর্বতের একটি অরণ্যসমাচ্ছাদিত শিখরদেশ সামোগ্রোস থেকে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলেন। সেখান থেকে শুধু আইডা নয়, সমগ্র প্রিয়ামনগরী ও গ্রীকরণতরীগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। ট্রয়সৈন্যদের হাতে নিগৃহীত গ্রীকসৈন্যদের দয়াবশত তিনি সমুদ্রতলদেশ হতে উঠে অরণ্যছায়াসমাচ্ছন্ন এই সাম্যোথেসে আসন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন দেবরাজ জিয়াসের নীতি ও আচরণে।

সামোগ্রেসের সেই পর্বতশিখরে উঠে দাঁড়ালেন পসেডন। উঠে পদচারণা করতে লাগলেন। তাঁর অলৌকিক পদভারে সমগ্র পর্বত ও অরণ্যদেশ কম্পিত হতে লাগল। মাত্র তিনটি পদক্ষেপেই তিনি চলে গেলেন তাঁর সমুদ্রকূলবর্তী অক্ষয় প্রাসাদ এগার অভ্যন্তরে। সেখানে গিয়ে তিনি স্বর্ণকেশরমণ্ডিত ও পক্ষবিশিষ্ট দৈব অশ্বশুলোকে রথে সংযোজিত করে উঠে বসলেন রথের উপর। আপনা হতে বিদীর্ণ হয়ে সভয়ে পথে করে দিল সমুদ্র। তাদের দেবতাদের সশ্রদ্ধ অভ্যর্থনা জানাবার জন্য চারদিক হতে ছুটে আসতে লাগল উল্লসিত সমুদ্রতরঙ্গের দল। এইভাবে পসেডনের লঘুপক্ষ রথারা তাঁকে সমুদ্রের উপর দিয়ে গ্রীকরণতরীর অভিমুখে নিয়ে যেতে লাগল।

তেনেদস ও পার্বত্য উপত্যকায় ভরা ইমব্রাস দ্বীপের মধ্যবর্তী সমুদ্র অঞ্চলে ছিল এক বিরাট গহ্বর। তার মধ্যে তাঁর অশ্বগুলোকে পায়ে সোনার শিকল জড়িয়ে বেঁধে রাখলেন পসেডন। সে বাঁধন তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আর কেউ খুলতে পারবে না। এরপর তিনি পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলেন গ্রীকরণতরীগুলোকে লক্ষ্য করে।

প্রিয়ামপুত্র হেক্টরের নেতৃত্বে ট্রয়সৈন্যরা তখন বায়ুতাড়িত বিক্ষুব্ধ মেঘরাশি অথবা জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মত যুদ্ধ করছিল ভয়ঙ্করভাবে। তারা ভেবেছিল সেই মুহূর্তে গ্রীকরণতরীগুলো সব দখল করে তাদের বড় বড় বীরদের সকলকে হত্যা করবে। ইতিমধ্যে ভূবেষ্টনকারী দেবতা পসেডন ক্যালকাসের ছদ্মবেশে এসে উৎসাহিত করতে লাগল গ্রীকদের।

দুই অ্যাজাক্স বীর আগে হতেই ক্রমাগত যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। প্রথমে তাঁদের সম্বোধন করে পসেডন বললেন, হে অ্যাজাক্সবীরগণ, তোমরা যদি এইভাবে এক অপরাজেয় পৌরুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাও তাহলে তোমরা মাত্র দুজনেই গ্রীকদের রক্ষা করতে পারবে। ট্রয়সৈন্যরা প্রাচীর অতিক্রম করতে পারলেও আমি তাদের ভয় করি না, কারণ আমি জানি তারা কোথাও জয়লাভ করতে পারবে না এবং তাদের যেকোন সময়ে আমাদের সৈন্যরা বিতাড়িত করে দিতে পারবে। আমরা একমাত্র ভয় হেক্টরকে নিয়ে। যে হেক্টর নিজেকে জিয়াসপুত্রের মত দৈবানুগ্রগে অনুগৃহীত ভাবেন এবং যিনি এক জ্বলন্ত অগ্নিস্তম্ভের মত সৈন্য পরিচালনা করছেন, আমার ভয় শুধু তাকে। তাহলে তোমরা সহজেই তোমাদের জাহাজ হতে শত্রুদের বিতাড়িত করতে পারবে। তারা স্বয়ং জিয়াসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও তোমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারবে।

এই কথা বলতে বলতে ভূমিকম্পের দেবতা পসেডন তাঁর হস্তধৃত স্বর্ণদণ্ডের দ্বারা মৃদু আঘাত করলেন দুই অ্যাজাক্স বীরের দেহগাত্রে। তিনি ঐন্দ্রজালিক উপায়ে তাদের হাত-পাগুলোকে অতিশয় লঘু ও কর্মঠ করে তুললেন। তারপর লঘুপক্ষ কোন এক বাজপাখির মত উড়ে গেলেন আকাশ পথে। দুই অ্যাজাক্স বীরের মধ্যে অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স পসেডনকে চিনতে পেরে তেলামনপুত্র অ্যাজাক্সকে বললেন, শোন অ্যাজাক্স, ইনি নিশ্চয় অলিম্পাসবাসী কোন দেবতা যিনি জ্যোতিষী ক্যালকাসের ছদ্মবেশে আমাদের অনুপ্রাণিত করতে এসেছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই ভবিষ্যদ্বক্তা ক্যালকাস নন। আমি তার পা আর জানু দেখে বুঝতে পারলাম তিনি মানুষ নন দেবতা। দেবতাদের বুঝতে বিলম্ব হয় না। বিশেষ করে তাঁর কথায় আমার বুকের মধ্যে যুদ্ধের বাসনা আগের থেকে অনেক বেশি করে জেগেছে এবং আমার হাত পা আরও অনেক বেশি কর্মঠ হয়ে উঠেছে আগের থেকে।

তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স উত্তর করলেন, আমারও মনে হচ্ছে হাত পায়ের শক্তি আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি একাই ট্রয়বীর হেক্টরকে দ্বৈতযুদ্ধে আহ্বান করতে পারব।

এইভাবে কথা বলতে বলতে যুদ্ধের আকাক্ষা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল তাদের। ওদিকে পসেডনও অন্যান্য গ্রীকদের উত্তেজিত করতে লাগলেন তাদের মাঝে গিয়ে। হতোদ্যম গ্রীকসেনাগণ তখন হতাশায় মুহ্যমান হয়ে তাদের জাহাজে বসে ভাবছিল। ট্রয়সেনাগণকে তাদের সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর অতিক্রম করতে দেখে চোখে জল এসেছিল তাদের। তারা বেশ বুঝতে পারল তাদের সর্বনাশের ক্ষণ উপস্থিত। এমন সময় তাদের এই নিবিড় হতাশার অন্ধকারে এসে উপস্থিত হলেন ভূবেষ্টনকারী দেবতা পসেডন।

প্রথমে তিনি টিউসার, লীডাস, বীর পেলিসিলিয়াস, থোয়াস, দীপাইরাস, মেরিওন, বীর অ্যান্টিলোকাস প্রমুখ বীর যোদ্ধার কাছে গিয়ে তাদের বললেন, হে বীর গ্রীকযুবকগণ, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত, আমি তোমাদের শক্তির উপর নির্ভর করেই একান্তভাবে আশা করেছিলাম তোমরাই আমাদের জাহাজগুলোকে রক্ষা করবে শত্রুপক্ষের আক্রমণ হতে। কিন্তু তোমরা যদি যথাশক্তিতে এখনও যুদ্ধ না করো তাহলে আজকের মধ্যেই ট্রয়সৈন্যদের কাছে পরাজিত হব আমরা। সত্যি কথা বলতে কি আমি এক স্বপ্ন দেখেছি–ট্রয়সৈন্যরা গ্রীকজাহাজে উপস্থিত। যারা ছিল এতদিন আমাদের ভয়ে ভীত এবং সতত পশ্চাদপসরণপরায়ণ, যারা ছিল একমাত্র পলায়নেই পারদশী, যারা ছিল শৃগাল ও নেকড়ের শিকারের বস্তু সেই ট্রয়সৈন্যরা আজ গ্রীকরণতরীতে উপস্থিত। এতদিন যে ট্রয়বাসীরা আমাদের আক্রমণকে এক মুহূর্তের জন্য প্রতিহত করতে পারত না আজ তারা তাদের নগর সীমানা ত্যাগ করে আমাদের জাহাজের উপর উঠে এসে যুদ্ধ করছে। আর এর জন্য একমাত্র দায়ী হচ্ছে আমাদের নেতাদের কাপুরুষতা আর আমাদের নিজেদের অপর ঔদাসিন্য। আমরা যেন আমাদের জাহাজগুলোকে রক্ষা করতে চাই না, চাই শুধু পশুর মত শক্তহস্তে নিহত হতে। আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমননই আমাদের এই বিপর্যয়ের কারণ, কারণ তিনিই পেলেউসপুত্রকে অপমান করেন। কিন্তু তা হলেও আমরা কেন বিরত হব যুদ্ধ হতে? সব ক্ষতি আমরাই পূরণ করে দেব। কোথায় আমাদের দোষত্রুটি তা আমরা ভেবে দেখব, কারণ বীরেরা কখনই আত্মসমীক্ষায় পরাজুখ হন না। তোমরা যারা আমাদের সেনাদলের মধ্যে বীরচূড়ামণি হিসেবে পরিগণিত, সহসা যুদ্ধ ত্যাগ করে অন্যায় করেছ। কোন দুর্বল ব্যক্তি যদি যুদ্ধক্ষেত্র হতে সরে যান আমি তাকে দোষ দিই না, কিন্তু তোমরা বীর বলেই আজ আমি ক্রুদ্ধ তোমাদের প্রতি। ঘৃণাবোধ করি, তোমাদের প্রতি। হে আমার বন্ধুগণ, তোমাদের এই দুর্বলতার ফলে ব্যাপার আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। তোমরা প্রত্যেকেই আপন সম্মানের জন্য যত্নবান হও। এখন যুদ্ধের চরম ক্ষণ উপস্থিত, কারণ বীর হেক্টর প্রাচীরদ্বার ও তার অর্গল ভেঙ্গে আমাদের জাহাজে এসে যুদ্ধ করছে।

এই সব কথা বলে গ্রীকদের ক্রমাগতই উত্তেজিত করে যেতে লাগলেন পসেডন। গ্রীকদের মধ্য হতে আগে এগিয়ে এলেন দুই অ্যাজাক্স বীর। হেক্টর ও ট্রয়বাসীদের অগ্রপ্রসারী এই আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য। অ্যাজাক্সের পশ্চাতে গ্রীকসেনাগণও তখন সুসংবদ্ধ ও ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে ঢাল ও বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের অন্তর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যুদ্ধের জন্য।

হেক্টরের নেতৃত্বে সুসংবদ্ধ হয়ে দুর্বার বেগে হিমানী সম্প্রপাতের মত এগিয়ে যেত লাগল ট্রয়সৈন্যগণ। শীতের হাওয়ার প্রহারে অথবা প্রবল বর্ষণে ছিন্নমূল কোন বিরাট প্রস্তরখণ্ড যেমন পর্বতশিখর হতে বেগে নিম্নদিকে পতিত হয় আর তার পতনজনিত ঘোর শব্দে সমগ্র পর্বতদেশ নিনাদিত হয় এবং সেই পতনশীল প্রস্তর যেমন কোন দিকে গতি পরিবর্তন না করে কেবল নিম্নভিমুখে ধাবিত হয়, তেমনি এক অবিচলিত অপরিবর্তিত একাগ্রতার সঙ্গে দুর্বার বেগে গ্রীকশিবির ও জাহাজের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল হেক্টর। সে তার হত্যার অভিযান সমুদ্রকূল পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাবেই।

কিন্তু সহসা প্রতি আক্রমণে তৎপর হয়ে উঠল গ্রীকরা। তারা তরবারি ও বর্শা নিয়ে একযোগে বিভিন্ন দিক থেকে ঘিরে ফেলল হেক্টরকে। হেক্টরও তখন কিছুটা পিছু হটে এসে ট্রয়সৈন্যদের সম্বোধন করে বললেন, হে ট্রয়, লাইসিয়া ও দার্দানিয়বাসিগণ, তোমরা অটল সঙ্কল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। গ্রীকরা আমাদের প্রতিহত করার জন্য আমাদের মাঝখানে এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করেছিল, কিন্তু আমাকে তারা ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। পারবেও না। হেরাপতি বজ্ৰাধিপতি জিয়াস যদি সত্য সত্যই আমার এই অভিযানে প্রেরণা সঞ্চার করে থাকেন তাহলে আমার হাতে তাদের পতন ঘটবেই।

এই সব উৎসাহব্যঞ্জক কথার দ্বারা উদ্যম সঞ্চার করলেন হেক্টর ট্রয়সৈন্যদের মনে। প্রিয়ামপুত্র দীফোবাস প্রথমে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে লক্ষ্য করে গ্রীকবীর মেরিওন তাঁর বর্শা নিক্ষেপ করলেন। তবে দীফোবাস তাকে আগে হতেই দেখতে পেয়ে সরে দাঁড়ায় আর মেরিওনের বর্শাফলকটি দীফোবাসের ঢালের উপর লেগে ভেঙ্গে যায়। শহত্যায় ব্যর্থ হওয়ায় আর তার বর্শাফলকটি ভেঙে যাওয়ায় মেরিওন ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর সহকর্মীদের ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি আর একটি বর্শা আনার জন্য তাঁর জাহাজস্থ শিবিরে চলে গেলেন।

কিন্তু যুদ্ধ যথারীতি সমানে চলতে লাগল। রণনিনাদে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়ে উঠল আকাশ ও মৃত্তিকা। টিউসার প্রথমে মেস্টরপুত্র ইমব্রিয়াসকে হত্যা করল। মেস্টরের অনেক ভাল ভাল অশ্ব ছিল। মেস্টন ছিল একজন বীর যোদ্ধা। ট্রয়যুদ্ধের আগে অর্থাৎ গ্রীকরা এদেশে আসার আগে সে থাকত পেডামনে। প্রিয়ামের এক অবৈধ কন্যা মেদেসিকাস্তেকে বিবাহ করে সে। গ্রীকদের অভিযান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চলে যায় ইলিয়াম নগরীতে রাজা প্রিয়ামের প্রাসাদে আর রাজা প্রিয়ামও তার আপন সন্তানের মত সম্মান দানের ব্যবস্থা করেন। সেই মেস্টরপুত্র ইমব্রিয়াসের ঢালের নিচে বর্শার দ্বারা এমনভাবে আঘাত করলেন তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স যে, কাঠুরিয়ার আঘাতে সবুজ শাখা প্রশাখাসহ পর্বত হতে নিম্নভূমিতে ভূপাতিত বৃক্ষের মত মাটিতে পড়ে গেল ইমব্রিয়াস। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ হতে বর্মটি খুলে নেবার জন্য গেল টিউসার। কিন্তু তাকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করল হেক্টর। টিউসার তা দেখতে পেয়ে সরে যেতে সে বর্শা গিয়ে লাগল অ্যাম্ফিমেকাসের বুকে। অ্যাম্ফিমেকাস তখন সবেমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে আসছিল। এমন সময় তার বুকে বর্শা লাগতেই সে পড়ে গেল আর হেক্টর তার মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটি খুলে নেবার জন্য এগিয়ে গেল তার কাছে। কিন্তু শিরস্ত্রাণ খোলার আগেই অ্যাজাক্স তাকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করলেন একটি বর্শা। সে বর্শা হেক্টরের দেহগাত্রে না লাগলেও তাঁর ঢালের কঠিন উপরিভাগে আঘাত করল। তার চাপ হেক্টরকে সরিয়ে নিল অন্য দিকে। ইত্যবসরে স্টিচিয়াস ও মেনেসথিয়াস দুজনে মিলে অ্যাম্ফিমেকাসের মৃতদেহটি সরিয়ে নিয়ে গেল। ওদিকে দুই অ্যাজাক্স বীর ঝাঁপিয়ে পড়ল ইমব্রিয়াসের উপর। ইমব্রিয়াসের দেহ হতে বর্মটি খুলে নেবার পর অরলিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স তরবারির দ্বারা তার মুণ্ডটি কেটে ফেলে খেলার বলের মত হেক্টরের পায়ে ছুঁড়ে দিলেন।

তাঁর পৌত্র অ্যাফিমেকাসের মৃত্যুতে নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন পসেডন। তাই তিনি গ্রীকদের নতুন করে উত্তেজিত করার জন্য পুনরায় উপস্থিত হলেন গ্রীক শিবিরে। এবার তিনি ধারণ করলেন অ্যান্ডিমনপুত্র থোয়াসের ছদ্মবেশ। অ্যান্ডিমন ছিলেন পার্বত্যপ্রদেশ ঘুরন আর ক্যালিডনের অধিপতি এবং সেখানকার অধিবাসীরা তাকে দেবতার মত ভক্তি করত। পসেডন গ্রীকশিবিরে যেতেই তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হলো আইডোমেনেউসের। আইডোমেনেউস তখন তাঁর এক আহত বন্ধুর সাথে কথা বলছিলেন। বন্ধুটির জানুতে আঘাত লাগায় সে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে এবং অন্যান্য সৈনিকরা তাকে চিকিৎসার জন্য শিবিরে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আইডোমেনেউসকে দেখে পসেডন বললেন, হে ক্রীট দেশের অধিপতি আইডোমেনেউস, একদিন যে কথা বলে গ্রীকরা ভয় দেখাত ট্রয়সৈন্যদের সে কথা সে দম্ভ আজ কোথায়?

আইডোমেনেউস তখন বললেন, থোয়াস, এর জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। ভয়ে বা দুর্বলতায় কেউ পিছিয়ে নেই আমাদের মধ্যে। কিন্তু আমার মনে হয় সর্বশক্তিমান জিয়াস চান আমার সুদূর বিদেশেই সব ধ্বংস হয়ে যাই মাথায় এক অপরিসীম অগৌরবের লজ্জা আর গ্লানি নিয়ে। থোয়াস, তুমি সবসময়েই দৃঢ়সংকল্প, তুমি যদি কাউকে কর্তব্যচ্যুত দেখ, তাহলে তার মধ্যে সাহস সঞ্চার করবে। যাতে তারা সকলেই প্রাণপণে চেষ্টা করে তার জন্য প্রত্যেককে নীতি উপদেশ দান করবে।

ভূকম্পন দেবতা পসেডন এর উত্তরে বললেন, আইডোমেনেউস, যে আজ যুদ্ধে পরাজুখ হবে সে যেন কোনদিন ট্রয় থেকে স্বদেশে ফিরতে না পারে। এখন তোমার বর্ম পরিধান করে চল। আমরা যত শীঘ্র সম্ভব দুজনে যুদ্ধে যাই। সঙ্গে লোক থাকলে কাপুরুষরাও সাহস পায়। আমরাও দুজনে বীরদের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করব।

থোয়াসবেশী পসেডন চলে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে আর আইডোমেনেউস তার শিবিরে গেল বর্ম আনতে। বর্ম পরিধান করে দুহাতে দুটি বর্শা নিয়ে আইডোমেনেউস যখন তার শিবির থেকে বেরিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা হলো তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল ক্রোনাসপুত্র জিয়াসবিচ্ছুরিত বিদ্যুতের আলোর মত তার বর্মটা জ্বলছে। তার সারথি ও সহচর মেরিওন, আমার প্রিয় সহচর, কেন তুমি যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে এসেছ? তুমি কি আহত অথবা তুমি আমাকেই নিয়ে যেতে এসেছ? কিন্তু আমাকে তো নিয়ে যাবার প্রয়োজন নেই, কারণ আমি নিজেই যাচ্ছি এবং আমি যুদ্ধ না করে শিবিরে থাকতে পারি না।

মেরিওন বলল, হে আইডোমেনেউস, আমি একটা বর্শা আনতে চলেছি আমার শিবির থেকে। আমি দীফোবাসকে লক্ষ্য করে আমার যে বর্শটা ছুঁড়েছিলাম সেটা তার ঢালে লেগে ভেঙ্গে গেছে।

ক্রীট জাতির অধিনায়ক আইডোমেনেউস বলল, এটা নয়, আমার শিবিরের মধ্যে গেলে বিশটা বর্শা পাবে। আমি ট্রয়সৈন্যদের হত্যা করে সে সব বর্শা অধিকার করি। আমার শিবিরে বর্শা, শিরস্ত্রাণ, ঢাল প্রভৃতি সব অস্ত্রই মজুত আছে। আমি কখনো হাতের কাছে শক্র রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি না।

মেরিওন বলল, নিহত ট্রয়সৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া আমারও অনেক বর্শা আছে আমার শিবিরে, কিন্তু এখন আমার হাতের কাছে কিছু নেই। আমি সব সময় সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে এসেছি। যখনি কোথাও যুদ্ধ প্রবল হয়ে ওঠে তখনি তারা আমাকে নিয়ে যায় প্রথম সারিতে যুদ্ধকরার জন্য। গ্রীকদের মধ্যে এখনো অনেক জানে না আমি কেমন যুদ্ধ করি, কিন্তু আপনি ভালভাবেই জানেন।

আইডোমেনেউস উত্তর করল, আমি তোমার সাহস ও বীরত্বের কথা সব জানি। আমাকে বলার কিছু নেই। যদি জাহাজ থেকে ভাল ভাল যোদ্ধাদের বাছাই করে কখনো কোন অভিযানে পাঠানো হয় তাহলেই বোঝা যাবে কে বীর কে কাপুরুষ। কাপুরুষ ক্ষণে ক্ষণে তার ভাব বদলাবে। ভয়ে মলিন হয়ে যাবে, কিন্তু সে বীর সে কখনই ভয় পাবে না। সে সব সময়ই বরং যুদ্ধে যেতে চাইবে। সুতরাং কোন অভিযান বা আক্রমণকালে তোমার সাহস ও বীরত্বকে কেউ লঘু করে দেখতে পারে না। যদি তুমি কখনো নিকট যুদ্ধে আহত হও তাহলে সে আঘাত কখনই তোমার পশ্চাদভাগে না, লাগবে বুকে পেটে বা দেহের সম্মুখভাগে। তুমি সব সময় সম্মুখ সারিতে থেকে এগিয়ে চল। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে ছেলেমানুষের মত কথা বলে লাভ নেই। তোমার শিবিরে গিয়ে ব্রোঞ্জনির্মিত একটি বর্শা নিয়ে এস। তারপর আইডোমেনেউসকে অনুসরণ করতে লাগল। যুদ্ধে একটা বড় রকমের কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তখন উন্মুখ হয়ে উঠেছেন আইডোমেনেউস। রণদেবতা অ্যারেস যুদ্ধে গেলে তার সন্তানরা যেমন শত্রুপক্ষের মনে সন্ত্রাস সঞ্চার করে চলে তেমনি আইডোমেনেউসের সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষের মনে ভীতি উৎপাদন করে যেতে লাগল মেরিওন। মেরিওন প্রথমে বলল, হে হেকালিয়মপুত্র কোথায় আমরা যুদ্ধ শুরু করব? যুদ্ধক্ষেত্রের বাম না দক্ষিণ দিকে অথবা মধ্যভাগে কোথায় আপনি গ্রীকসৈন্যদের দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন?

আইডোমেনেউস উত্তর করল, রণক্ষেত্রের মধ্যভাগে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত লোক আছে। সেখানে আছে দুই অ্যাজাক্স বীর এবং বিখ্যাত তীরন্দাজ টিউসার। টিউসার দ্বন্দ্বযুদ্ধেও পারদর্শী। এরা হেক্টরের যুদ্ধ পিপাসাকে নিবৃত্ত করবে। হেক্টর যতই যুদ্ধ করুক তাদের অদম্য সামরিক প্রচণ্ডতাকে দমন করতে পারবে না, অথবা গ্রীকজাহাজে আগুন লাগাতেও পারবে না। একমাত্র জিয়াস যদি নিজে এক জ্বলন্ত মশাল গ্রীকজাহাজে ফেলে দেন তবেই আগুন লাগতে পারে। কোন মর্তমানবের কাছে কোনদিন মাথা নত করবে না তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স। যে অ্যাকেলিস সর্বাপেক্ষা দ্রুতগতি সেই অ্যাকেলিসের কাছেও দ্বৈতযুদ্ধে হার মানেন না অ্যাজাক্স। এখন চল দেখি যুদ্ধের গতি কোন দিকে যায়। এরপর আইডোমেনেউস যেদিকে যেতে চাইলে সেইদিকে তাকে নিয়ে গেল মেরিওন।

উজ্জ্বল বর্মপরিহিত অবস্থায় সারথিসহ আইডোমেনেউসকে অগ্রসর হতে দেবে ট্রয়সৈন্যরা দলবদ্ধ হয়ে গ্রীকজাহাজের দিকে এগিয়ে গেল। রথ থেকে নেমে উভয় পক্ষের সৈন্যরাই হাতে হাতে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল। পথের ঘনপু__ ধূলিরাশিকে প্রবল বাতাস যেমন উড়িয়ে নিয়ে যায় দিক হতে দিগন্তের পথে, তেমনি সৈন্যদের পদভারে উত্থিত ধূলিজালে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠল চারদিক। যুদ্ধরত সৈনিকদের ঢাল ও শিরস্ত্রাণগুলো সূর্যের রোদে চকচক করছিল। এই ধরনের যুদ্ধে যে ভীত না হয়ে তাতে যোগদান করে আনন্দ পায় তার সাহসন অবশ্যই লৌহকঠিন।

এইভাবে ক্রোনাসের দুই পুত্র মর্ত্যের কয়েকজন বীরপুরুষের পতনচিন্তা করছিলেন। দেবরাজ জিয়াস ট্রয়বাসী ও হেক্টরকে ততটুকু জয়ের গৌরব দান করতে চেয়েছিলেন অ্যাকেলিসের সম্মান রক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। ইলিয়াম নগরীর সম্মুখে গ্রীকদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে চান নি। তিনি শুধু চেয়েছিলেন থেটিস ও তার পুত্রকে গৌরবান্বিত করতে। অন্যদিকে পসেডন গ্রীকদের উত্তেজিত করে চললেন। তিনি ক্রমাগত ট্রয়সৈন্যদের হাতে গ্রীকদের পরাজিত হয়ে দেখে জিয়াসের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে সমুদ্রোপকূল থেকে উঠে আসেন। জিয়াস ও পসেডন একই জাতীয় দেবতা এবং একই দেবলোকের বাসিন্দা, কিন্তু জিয়াস ছিলেন বয়সে বড় এবং তাঁর অভিজ্ঞতাও ছিল বেশি। তাই পসেডন জিয়াসের বিরোধিতা করে গ্রীকদের সরাসরি সাহায্য করার সাহস পাচ্ছিলেন না। তিনি তাই মানুষের ছদ্মবেশে গ্রীকসৈন্যদের মাঝে গিয়ে উৎসাহিত করে যাচ্ছিলেন। একইভাবে দুই দেবতাই যুদ্ধের বন্ধনটিকে ক্রমশই জটিল হতে জটিলতর করে তুলেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউই সে যুদ্ধের বন্ধনকে ছিন্ন করতে পারছিলেন না। জটিলভাবে আবদ্ধ যুদ্ধের রশিটিকে দুইদলে ধরে টানটানি করছিল আর তার ফলে বহু লোকের পতন ঘটছিল একের পর এক।

ট্রয়সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রীকদের প্রতি উৎসাহব্যঞ্জক এমন এক রণহুঙ্কার দান করলেন আইড্রোমেনেউস যা শুনে ভীত হয়ে উঠল ট্রয়সৈন্যগণ। তাঁর বয়স বাড়ার জন্য মাথার কালো চুল সাদা হতে শুরু করেছিল। কিন্তু তার উদ্যম কমে নি কিছুমাত্র। প্রথমেই আইডোমেনেউস ক্যামিয়াস হতে সম্প্রতি আগত ওথরিওনাসকে হত্যা করলেন। ওথরিওনিয়াস ট্রয়ে এসেই রাজা প্রিয়ামের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী কন্যা ক্যাসান্ড্রার পানিগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। ক্যাসান্ড্রার প্রতি তার প্রণয়সঞ্জাত হওয়ার জন্য তিনি অবশ্য কোন উপঢৌকন দেন নি তার পিতাকে। তবে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ট্রয়নগরীর সীমানা হতে গ্রীকদের বিতাড়িত করবেন তার বল বীরত্বের দ্বারা। এই প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে বৃদ্ধ রাজা প্রিয়ামও তার কন্যাকে তাঁর হাতে দান করার প্রতিশ্রুতি দান করেছিলেন। রাজা প্রিয়ামের সেই প্রতিশ্রুতির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন ওথরিওনিয়াস। তাকে লক্ষ্য করে আইডোমেনেউস একটি বর্শা নিক্ষেপ করতেই সে বর্শাটি তার পেটে গিয়ে লাগল এবং মাটিতে পড়ে গেলেন ওথরিওনিয়াস। আইডোমেনেউস তখন তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, তাঁর কন্যাকে পাবার আশায় রাজা প্রিয়ামকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা যেভাবে পালন করেছ তুমি তা সত্যই প্রশংসনীয়। সমস্ত ট্রয়বীরদের মধ্যে তোমাকে শ্রদ্ধা করি আমি। আমরাও তোমাকে অনুরূপ এক প্রতিশ্রুতি দান করব। যদি তুমি আমাদের দলে যোগদান করে আমাদের সঙ্গে ইলিয়াম নগরী ধ্বংস করো তাহলে আমরাও তোমাকে আত্রেউসপুত্রের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী কন্যাকে তোমায় দান করব এবং তোমার সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়ার জন্য আর্গস থেকে আনানো হবে তাকে। চলে এস আমার কাছে। আমরা জাহাজে গিয়ে বিবাহের চুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তবে প্রেমনিবেদনের উপঢৌকন নিয়ে আমরা কোনরূপ চাপ দেব না তোমার উপর।

এই বলে ওথরিওনিয়াসের পা ধরে টানতে লাগল আইডোমেনেউস। কিন্তু অ্যাসিয়াস তখন ওথরিওনিয়াসের দেহটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য এল আইডোমেনেউসের রথের কাছে। অ্যাসিয়াস ভেবেছিল সে অতর্কিত আঘাতে রথ থেকে ভূপাতিত করবে আইডোমেনেউসকে। কিন্তু তার আগেই আইডোমেনেউস তাকে তার বর্শার দ্বারা এমনভাবে আঘাত করলেন যে সে বর্শার ফলক তার চিবুকের নিজে গলদেশ বিদ্ধ করল। এক বিশাল ওক, পপলার অথবা পাইনগাছের মত সশব্দে পড়ে গেল অ্যাসিয়াস। অ্যাসিয়াসের রথটি ছিল কিছু দূরে, কিন্তু সারথি এই হত্যাকাণ্ডে ভীতিবিহ্বল অবস্থায় রত হতে দেখেও তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে পারল না রথ নিয়ে। এদিকে নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকাসের নিক্ষিপ্ত একটি বর্শা অ্যাসিয়াসের সারথির উদরদেশ বিদ্ধ করল সহসা।

অ্যাসিয়াসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য এবার এগিয়ে এলেন দীফোবাস। আইডোমেনেউসকে লক্ষ্য করে তিনি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু তা আগ হতেই দেখতে পেয়ে সতর্ক হয়ে সরে গেল আইডোমেনেউস। তাছাড়া তাঁর বড় অদ্ভুত ধরনের ঢালটি তার সব অবয়বটিকে আচ্ছন্ন করে দিল। আইডোমেনেউসের মাথার উপর দিয়ে বর্শাটি চলে গেলেও ব্যর্থ হলো না দীফোবাসের সে বর্শা, কারণ সে বর্শা আঘাত করল হিপ্পামাসপুত্র হিপসেনরকে। হিপসেনরের পেটের নিচের যকৃৎটি বিদ্ধ হলো সে বর্শার ফলকে। দীফোবাস তখন দর্পভরে বিদ্রূপ করে বললেন, তাহলে অ্যাসিয়াসের জীবন সত্য সত্যই বিফল হয়ে যায় নি। তার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নিয়েছি। সে এখন মৃত্যুপুরীর দ্বার অতিক্রম করলেও আমি সহচর হিসেবে একজন পাঠালাম এবং এতে সে খুশি হবে।

এমনি করে বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করতে লাগল দীফোবাস আর তাতে ক্ষুণ্ণ ও ব্যথিত হলো গ্রীকগণ। নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হলো অ্যান্টিলোকাস। কিন্তু ক্রোধ তার বন্ধুর প্রতি কর্তববোধ ভুলিয়ে দিতে পারল না। সে তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে ঢাল দিয়ে রক্ষা করল হিপসেনরের দেহটিকে। তখন তার সহযোদ্ধা মেসিনিয়াস, অ্যাকেয়াস, ও অ্যালাস্টার তার মৃতদেহটি জাহাজে নিয়ে চলে গেল। আইডোমেনেউসের ক্রোধ কখনো থামে নি। হয় কোন ট্রয়সৈন্যকে মৃত্যুপুরীতে পাঠাবেন অথবা নিজে মৃত্যুবরণ করার জন্য মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করে যেতে লাগলেন তিনি। অ্যাসাইতেসের পুত্র ও অ্যাঙ্কিসেসের জামাতা অ্যালকেথেেয়র পতন ঘটল। অ্যালকেথর ছিল সারা ট্রয়নগরীর মধ্যে সুদর্শন ব্যক্তি এবং সে অ্যাঙ্কিসেসের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী কন্যা হেপ্পোডেমিয়াকে বিবাহ করে। শুধু সৌন্দর্য নয়, বুদ্ধি ও উপলব্ধিতেও হিল্লোডেমিয়া ছিল অন্যান্য বোনদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তাই সে তার পিতামাতার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সেই সুন্দরী হিল্লোডেমিয়ার স্বামী অ্যাকেথয়কে পসেডনের সহায়তায় হত্যা করল আইডোমেনেউস। দৈব প্রভাবে অ্যালকেথয় হঠাৎ চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্থাণুর মত অটল হয়ে। আইডোমেনেউস তখন বর্শাটি দিয়ে আমূল বিদ্ধ করে অ্যালকেথয়ের বুকটাকে। তার চোখে নেমে এল মৃত্যুর অপার অন্ধকার। ঘোররবে পড়ে গেল অ্যালকেথর।

আইডোমেনেউস তখন বিদ্রূপ করে জোর গলায় বলতে লাগলেন দীফোবাসকে, তুমি তো এতক্ষণ বিদ্রূপ ও রসিকতায় মত্ত হয়ে ছিলে । এবার আমরা আমাদের কৃতিত্বের কথাটা জোর গলায় বলতে পারব। তোমার একটি হত্যার প্রতিশোধে আমরা তোমাদেরও তিনজনকেও হত্যা করেছি। না না যেও না, আমার সঙ্গে একবার যুদ্ধ করে দেখ আমি জিয়াসের কত বড় বংশধর। দেবরাজ ক্রীটরাজ মাইনরের প্রথমে জন্ম দন। মাইনস জন্মদেন দিউক্যালিয়নের। দিউক্যালিয়ন আবার আমার জন্ম দান করে আমার উপর ছেড়ে দেন ক্রীট দেশ শাসনের ভার। আমি জাহাজে করে সেই ক্রীট দেশ থেকে এসেছি তোমাদের ধ্বংস করার জন্য।

আইডোমেনেউসের কথা শুনে দ্বিধাবিভক্ত চিত্তে ভাবতে লাগলেন দীফোবাস। তিনি কি একাই আইডোমেনেউসের সদম্ভ আহ্বান গ্রহণ করবেন অথবা অন্য কোন ট্রয়সৈন্যদের তাঁর সাহায্যের জন্য নিয়ে আসবেন তা বুঝে উঠতে পারলেন না। অবশেষে তিনি ঈনিসকে নিয়ে আসাই যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করলেন। ঈনিস রাগতভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, কারণ সে ট্রয়যুদ্ধে যথেষ্ট কৃতিত্ব প্রদর্শন করা সত্ত্বেও রাজা প্রিয়াম তাকে যোগ্য সম্মানে ভূষিত না করায় সে অনেকদিন হতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল প্রিয়ামের উপর। দীফোবাস ঈনিসের কাছে গিয়ে বললেন, ঈনিস, যদি তোমার সঙ্গে আমার কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার ভগ্নিপতির দেহটিকে রক্ষা করার জন্য সাহায্য করো আমাকে। যে অ্যালকেথয় তোমাকে শৈশব হতে লালন পালন করেছেন সেই অ্যালকেথয় আজ আইডোমেনেউসের দ্বারা নিহত। তুমি তার দেহটিকে মুক্ত করগে।

এই সব কথার দ্বারা ঈনিসকে বিচলিত করে তুললেন দীফোবাস এবং ঈনিস বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আইডোমেনেউসের সন্ধানে গেল। কিন্তু আইডোমেনেউস একজন শিশু নয় যে এত সহজে তাকে পরাজিত করা যাবে। পর্বতগাত্রে প্রতিহত হয়ে কোন বন্য শূকর যেমন ভয়াল হিংস্রতায় শিকারীদের প্রতীক্ষা করে তেমনি ঈনিসের জন্য এক ধ্বংসাত্মক আগ্রহের তীব্রতায় অপেক্ষা করতে লাগলেন আইডোমেনেউস। তিনি তখন চিৎকার করে তাঁর সহযোদ্ধাদের ডাকতে লাগলেন। এসকারাফাস প্রমুখ বীরকে সম্বোধন করে বললেন, হে আমার বন্ধুগণ, এদিকে এস। আমাকে ঈনিসের কবলে একা ঠেলে দিও না। মৃত্যুদণ্ডের সাক্ষাৎ বিধাতারূপে সে আমার দিকে ভয়ঙ্করভাবে ছুটে আসছে। তাছাড়া সে এখন বয়সে যুবক। তার মত যৌবনশক্তি আর এই মনের জোর আজ যদি আমার থাকত তাহলে আজ আমি অবশ্যই বিজয়গৌরব লাভ করতাম। ওদিকে ঈনিসও দীফোবাস, প্যারিস ও অ্যাজিনরকে সম্বোধন করে ডাক দিল। ঈনিস যখন দেখল তার পশ্চাতে অনেক ট্রয়সৈন্য অনুসরণ করছে তাকে তখন ভূরিভোজনে তৃপ্ত মেষপালের মত খুশি হয়ে উঠল সে।

এইভাবে দুজন সৈন্যদলসহ এক প্রচণ্ড যুদ্ধে মেতে উঠল দুইদিকে। উভয় দলের সৈন্যরাই পরস্পরকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। তাদের অঙ্গসঞ্চালন হেতু বর্মগুলোর ঝনাৎকার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চারদিকে। ইতিমধ্যে আইডোমেনেউস ও ঈনিস দুই বীর বর্শা ও তরবারি নিয়ে মেতে উঠেছে এক ভয়ঙ্কর দ্বৈতযুদ্ধে। আইডোমেনেউসকে লক্ষ্য করে ঈনিসই প্রথমে বর্শা নিক্ষেপ করল। কিন্তু আইডোমেনেউস সতর্কতার সঙ্গে সরে যেতে সে বর্শা লক্ষভ্রষ্ট হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। এমন সময় আইডোমেনেউস এক বর্শার দ্বারা এনোমাসের উদরদেশ এমনভাবে বিদ্ধ করল যে তার থেকে সব নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে। অ্যানোমাস যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে দুহাতের দুই তালু মাটির উপর রেখে চিৎকার করতে লাগল। আইডোমেনেউস তাঁর বর্শাটি অ্যানোমাসের পেট থেকে বার করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তার বর্শাটি তুলে নিতে বা তার দেহ হতে বর্শাটি খুলে নিতে পারলেন না তিনি, কারণ তখন শত্রুপক্ষের লোকেরা ক্রমাগত তীর বর্ষণ করছিল তার উপর। তাছাড়া বহুক্ষণ যুদ্ধ করার ফলে স্তিমিত হয়ে এসেছিল তার শক্তির বেগ। সে আর দ্রুত পদসঞ্চালন করতে পারছিল না। সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে বীর পায়ে সরে যেতে লাগল। এমন সময় দীফোবাস তাকে লক্ষ্য করে এক বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু এবারও সে বর্শা আঘাত করতে পারল না আইডোমেনেউসকে। তার পরিবর্তে সে বর্শা অ্যারেসপুত্র অ্যাসকাফালাসের স্কন্ধদেশ বিদ্ধ করল এবং সে সটান ভূমিতলে পড়ে গেল।

ভীষণাকৃতি অ্যারেস তখনও জানতে পারেন নি যে তাঁর পুত্রের পতন ঘটেছে। কারণ তিনি দেবরাজ জিয়াসের আদেশে অলিম্পাসের শিখরদেশে স্বর্ণমেঘের অন্তরালে বসেছিলেন অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে। ইতোমধ্যে উভয় পক্ষের সৈন্যরা মৃতদেহটিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। দীফোবাস মৃতদেহটির মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটি খুলে নিতেই মেরিওন এক বর্শার দ্বারা তাঁর বাহু স্কন্ধের সন্ধিস্থলে আঘাত করল আর সঙ্গে সঙ্গে দীফোবাসের হাত থেকে শিরস্ত্রাণটি পড়ে গেল। মেরিওন তখন দীফোবাসের উপর শকুনির মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর কাঁধের উপর গেঁথে যাওয়া বর্শাটি সজোরে তুলে নিয়ে স্বপক্ষীয় সৈন্যদলের মধ্যে ফিরে গেল। এদিকে দীফোবাসের ভাই পোলাউসে এসে দীফোবাসের কটিদেশে হাত দিয়ে ধরে অদূরে প্রতীক্ষমান রথের উপর তাঁকে চাপিয়ে শহরের পথে রওনা হলো। দীফোবাসের ক্ষতস্থান থেকে তখন প্রচুর রক্ত ঝরছিল এবং তিনি যন্ত্রণায় কাতরভাবে চিৎকার করছিলেন।

যুদ্ধ আগেই মতই চলতে লাগল। অবিরাম রণনিনাদ আকাশকে চুম্বন করতে লাগল। ঈনিস তার বর্শাদ্বারা ক্যালিতরপুত্র অ্যাকারিয়াসকে তার গলদেশে এমনভাবে আঘাত করল যার ফলে তার মুণ্ডটি ছিন্ন হয়ে গেল তার দেহ থেকে এবং মাথার শিরস্ত্রাণ ও হাতের ঢালও পড়ে গেল। জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রুর মৃত্যুর ছায়া নেমে এল চারিপাশে। এবার অ্যান্টিলোকাস ছুটে গিয়ে থুনকে আঘাত করল। থুন তার দিকেই আসছিল। থুনের সমগ্র পৃষ্ঠদেশটি এমনভাবে তরবারির দ্বারা চিরে দিল অ্যান্টিলোকাস যে সেখানকার সব শিরাগুলো কেটে যাওয়ায় প্রচুর রক্ত ঝরতে লাগল। থুন উপর দিকে হাত বাড়িয়ে তার সহকর্মীদের কাতরভাবে ডাকতে ডাকতে পড়ে গেল। অ্যান্টিফোকাস তার কাছে গিয়ে তার বর্মটি খুলতে লাগল। ট্রয়সৈন্যরা তখন চারদিক হতে এসে তাকে আঘাত করতে লাগল। কিন্তু সকলের সব আঘাত তার ঢালে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল। তার দেহের কোন অংশে আঘাত করতে পারল না। তাছাড়া পসেডন নেস্টরপুত্রকে রক্ষা করে যাচ্ছিলেন সব সময়। চারিদিক হতে নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টির মাঝে সে ছিল অটল হয়ে দাঁড়িয়ে। কোন সময়ের জন্য সে তার বর্শাটি চারিদিকে ঘুরিয়ে শত্রুপক্ষের কোন না কোন সৈন্যকে আঘাত করার জন্য সদ্যব্যস্ত ছিল।

অ্যান্টিলোকাসকে এইভাবে শক্ৰহননে উদ্যত দেখে অ্যাফিরাসপুত্র অ্যাডামাস বেগে ধাবিত হলো তার দিকে। অ্যান্টিলোকাসের ঢালের উপর সজোরে বর্শা দিয়ে আঘাত করল অ্যাডামাস। কিন্তু সে আঘাত ঐন্দ্রজালিকভাবে ব্যর্থ করে দিলেন পসেডন। অ্যাডামাসের হাতে অ্যান্টিলোকাসের জীবন বিনষ্ট হবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না ভূকম্পনদেবতা পসেডন। অ্যাডামাসের বর্শার অর্ধভাগ অ্যান্টিলোকাসের ঢালে গাঁথা রয়ে গেল আর অর্ধভাগ ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল। স্বপক্ষীয় সেনাদলের মধ্যে আশ্রয় নেবার জন্য পালিয়ে যাচ্ছিল অ্যাডামাস। কিন্তু মেরিওন তাকে দেখতে পেয়ে তার বর্শাটি অ্যাডামাসের পাকস্থলীর কাছে এমনভাবে গেঁথে দিল যে সেই বর্শার দণ্ডটি ধরে তীব্র যন্ত্রণায় নিজের দেহটাকে মোচড় দিতে লাগল অ্যাডামাস। কোন পার্বত্য বন্য বৃষকে শক্ত রশিতে করে বেঁধে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে সে যেমন ছটফট করতে থাকে তেমনি ছটফট করতে লাগল অ্যাডামাস। কিন্তু বেশিক্ষণ এ কষ্ট এ যন্ত্রণা সহ্য করতে হলো না তাকে। শীঘ্রই মেরিওন এসে তার পেট থেকে বর্শাটা তুলে ফেলতেই মৃত্যুর অন্ধকার নেমে এল অ্যাডামাসের চোখে।

হেনেলাস তার বিরাট থ্রেসীয় তরবারির দ্বারা নিকট হতে দীপাইরাসের মস্তকে আঘাত করে মস্তকচ্যুত করে ফেলল তার শিরস্ত্ৰণটাকে। শিরস্ত্রাণটা মাটিতে পড়ে যেতেই গ্রীকসেনাদের একজন তাড়াতাড়ি এসে তা কুড়িয়ে নিল ইতোমধ্যে দীপাইরাস ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।

দীপাইরাসের মৃত্যুতে মর্মাহত হলেন মেনেলাস। তিনি তখন ভয়ঙ্করভাবে বর্শা সঞ্চালন করতে করতে ছুটে এসে আক্রমণ করলেন হেলেনাসকে। হেলেনাস তখন তার তীরধনুক দিয়ে আক্রমণ করলে মেলেনাসকে। একজন বর্শা আর একজন তীরধনুক দিয়ে আক্রমণ করলে পরস্পরকে। প্রিয়ামপুত্র হেলেনাস মেনেলাসের ধাতব বাচ্ছাদনের উপর একটি তীর নিক্ষেপ করল, কিন্তু শস্যস্তূপের উপর নিক্ষিপ্ত পেষণকারী ভারী দণ্ডের মত সে তাতে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল। মেনেলাস তখন তাঁর বর্শার দ্বারা হেলেনাসের ধনুর্বাণবহনকারী একটি হাতকে আহত করলেন। বর্শাটি তার হাতে তখনো লেগে ছিল। সেইভাবেই পালিয়ে যাচ্ছিল হেনেলাস। অবশেষে অ্যাজিনর এসে সে বর্শাটি হাত থেকে তুলে তার সারথির দ্বারা আনীত একটুকরো পশমের কাপড় দিয়ে হাতের ক্ষতস্থানটিকে বেঁধে দিল।

সহসা পিসান্ডার এসে আক্ৰমল করল মেনেলাসকে। মেনেলাসের হাতেই মৃত্যু ছিল বলে সেই মৃত্যুর ডাকেই যেন ছুটে এল সে। তারা দুজনে পরস্পরের কাছাকাছি এসে মেনেলাস প্রথমে বর্শা নিক্ষেপ করলেন পিসান্ডারের উপর, কিন্তু পিসাডার সরে যেতেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো মেনেলাসের বর্শা। পিসান্ডার তখন বর্শা নিক্ষেপ করল মেনেলাসের উপর। কিন্তু সে বর্শা মেনেলাসের কঠিন ঢালের উপর প্রতিহত হওয়ায় তার ফলকটি ভেঙ্গে গেল। তথাপি জয়ের আশা ত্যাগ করল না পিসান্ডার। ওদিকে তরবারি কোষমুক্ত করে তাকে নতুন করে আক্রমণ করলেন মেনেলাস। পিসান্ডার তার কটিদেশে ঝোলানো অলিভ কাঠের হাতলওয়ালা একটি কুঠার দ্বারা মেনেলাসের শিরস্ত্রাণের চূড়াটিকে আঘাত করল। কিন্তু মেনেলাস তখন তাঁর তরবারি দিয়ে পিসান্ডারের নাকের উপর কপালে এমন জোরে আঘাত করলেন যে তার চোখ দুটি উপড়ে পড়ে গেল মাটিতে। মেনেলাস তখন তার বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বর্মটি খুলে নিয়ে দর্পভরে বললেন, যতই অহঙ্কারী বা যুদ্ধপিপাসু হও না, এইভাবে তোমাদের গ্রীকরণতরীগুলোকে ত্যাগ করে ফিরে যেতে হবে বিফল হয়ে। যে লজ্জা আর অপমানের বোঝা একদিন আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছ তোমরা তা সব পাবে আমার হাতে। নরখাদক কাপুরুষ মেয়ে-নেকড়ের মত জিয়াসের কাছ থেকে শাস্তি পাবার ভয়ের কথা ভুলে গেছ। মনে রেখো, যারা অতিথি হয়ে অন্যায়ভাবে গৃহস্বামীর ক্ষতি করে দেবরাজ জিয়াস নিজে প্রতিশোধ নেন তাদের উপর। সেই প্রতিশোধের খাতিরেই তিনি একদিন তোমাদের ট্রয়নগরী বিধ্বস্ত করবেন। তোমরা অতিথিরূপে গিয়ে আমার বিবাহিতা স্ত্রীকে বহু ধনরত্নসহ হরণ করে এনেছ। আবার আজ তোমরা অগ্নিসংযোগ করতে চাও আমাদের জাহাজে। এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন তোমরা প্রতিহত হবে সম্পূর্ণরূপে। হে পরম পিতা জিয়াস, জ্ঞানের দিক থেকে তুমি সমস্ত দেবতা ও মানুষ হতে বড়, তুমি সর্বজ্ঞ, তোমা হতেই জাগতিক সকল ঘটনা ও বস্তুনিচয়ের জন্ম। তুমি তো সবকিছুই জান। তাহলে সব জেনে শুনে কেন তুমি ট্রয়বাসীদের অনুগ্রহ করে যাচ্ছ? মানুষ মানুষ হয়েও এই ট্রয়বাসীরা এমন গর্বিত ও উদ্যমী যে তারা যুদ্ধ হতে কোন অবস্থাতেই বিরত হয় না। নিদ্রা, মধুর সঙ্গীত, লীলায়িত নৃত্যছন্দ–এই সব কিছুরই শেষ আছে। এই সব উপভোগ করে সব মানুষই একদিন না একদিক তৃপ্ত হয় কিন্তু এত যুদ্ধ করেও চরম তৃপ্তি কোনদিনই লাভ করে না ট্রয়বাসীরা।

এই কথা বলে তার দেহ থেকে রক্তরঞ্জিত বর্মটি খুলে নিয়ে তার সহচরের হাতে দান করলেন মেনেলাস। তারপর আবার তিনি সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে গেলেন।

এবার রাজা পাইলামেনেসের পুত্র হার্পেনিয়ন আক্রমণ করল মেনেলাসকে। ট্রয়যুদ্ধে যোগদান করার জন্য সে তার পিতার সঙ্গে তাদের রাজ্য ছেড়ে আসে, কিন্তু ঘরে ফিরে যেতে পারে নি। তার বর্শার আঘাতে মেনেলাসের ঢালের মধ্যভাগ কিঞ্চিৎ বিদ্ধ হলেও তাতে কোন ক্ষতিই হলো না মেনেলাসের। তখন হার্পেনিয়ন নিজেকে মেনেলাসের রোষ হতে বাঁচার জন্য নিজেদের দলের সৈন্যদের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। আহত হবার ভয়ে সে চারিদিকে ব্যাকুলভাবে তাকাতে লাগল। এমন সময় মেরিওনের দ্বারা নিক্ষিপ্ত একটি তীর হার্পেনিয়নের মূত্রথলিতে বিদ্ধ করতেই সে তার সহকর্মীর কোলে ঢলে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল তার প্রাণবায়ু। সে ছিল প্যাফ্লাগনিয়ার রাজপুত্র। হার্পেনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্যাফ্লাগনিয়ার লোকেরা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তাকে রথে চাপিয়ে ট্রয়নগরীর দিকে নিয়ে গেল।

হার্পেনিয়নের মৃত্যুতে দুঃখিত হলেন প্রিয়ামপুত্র প্যারিস। তিনি একদিন প্যাফ্লাগনিয়ায় বেড়াতে গিয়ে হার্পেনিনের রাজবাড়িতেই আতিথ্য গ্রহণ করেন। তিনি তখন গ্রীকপক্ষের সৈন্যদের লক্ষ্য করে একটি তীর নিক্ষেপ করলেন। ধনী জ্যোতিষী পলিডাসের ইউঁকিনর নামে এক পুত্র ছিল। তার বাড়ি ছিল কোরিনাথে। ইউনিরের এক কঠিন ব্যাধি ছিল। তাতে তাকে ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করতে হত প্রায়ই। তার পিতা পলিডাস ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন হয় তার ঘরে বসে সেই রোগযন্ত্রণাতেই মৃত্যু হবে অথবা যুদ্ধে গেলে ট্রয়বাসীদের হাতে মৃত্যু হবে। রোগযন্ত্রণার হাত হতে চিরতরে মুক্তি পাবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রের পথেই দেরি করে রওনা হলো ইউঁকিনর। কিন্তু অতিরিক্ত বিলম্ব হওয়ার জন্য গ্রীকরা তাকে জরিমানা করবে এই ভয়ে ট্রয়পক্ষে যোগদানের জন্য গেল। কিন্তু তার কথা বুঝতে না পেরে প্যারিস তার সেই তীর ইউঁকিনরের উপরেই নিক্ষেপ করল আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের চোয়ালটা ভেঙ্গে গেল। মুহূর্তে প্রাণবিয়োগ ঘটল ইউঁকিনরের।

জ্বলন্ত আগুনের অনির্বাণ শিখার মত কমার পরিবর্তে ক্রমশই বেড়ে যেতে লাগল যুদ্ধের আগুন। রণক্ষেত্রের বাম প্রান্তে গ্রীকরা যে এতজন ট্রয়সৈন্যকে হত্যা করেছে সেকথা তখনো শুনতে পান নি হেক্টর। পসেডন এমনভাবে গ্রীকদের উত্তেচিত করে যাচ্ছিল যে এর অনেক আগেই জয়লাভ করা উচিত ছিল। যে প্রাচীরদ্বার–পথ ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করেছিল হেক্টর এখন তিনি সেইখানেই আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। এইখানেই প্রাচীরটা ছিল সবচেয়ে নিচু এবং এই স্থানের নিকটেই অ্যাজাক্স ও প্রোতিসিলসের জাহাজ দুটো সমুদ্রোপকূল ঘেঁষে নোঙর করা হয়। এইখানেই বহুবার দুই পক্ষে পদাতিক ও অশ্বারোহীদের মাঝে তুমুল যুদ্ধ হয়। বেতুয়া, আইয়োনিয়া, নেক্রিয়া, পথিয়া ও অ্যাপিয়ার সম্মিলিত ও সমবেত সেনাবাহিনীও প্রতিরোধ করতে পারে নি হেক্টরের ভয়ঙ্কর গতির। হেক্টর যখন জ্বলন্ত এক পাবকশিখার মত গ্রীক রণতীরর অভিমুখে বেগে ধাবিত হচ্ছিলেন তখন তাঁকে সেই সম্মিলিত সেনাবাহিনীর শক্তি বিতাড়িত করতে পারেন নি তাঁকে তাঁর লক্ষ্যপথ হতে। মেনেসথিয়াসের নেতৃত্বে এথেন্সের নির্বাচিত সেনানীদের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। মেনেসথিয়াসের সঙ্গে ছিল ফেদাস, স্টিচাস ও বীর বিয়াস।

ফাইলিয়াসের পুত্র মেজিস, অ্যাফিয়ন ও ড্রেসিয়াস ছিল অ্যাপিয়ার সেনানায়ক। আর পিথিয়ার সেনাপতি ছিল মেডন ও কঠোরহৃদয় পোদারসেস। এদের মধ্যে মেডন ছিল আরনিয়াসের অবৈধ সন্তান এবং অ্যাজাক্সের ভ্রাতা। কিন্তু সে তার স্বদেশ হতে বহু দূরে ফাইলেসেস-এর বসবাস করত, কারণ সে একবার তার বিমাতার এক আত্মীয়কে হত্যা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগ করেন। পোদারসেস ছিল ইফিক্লাসের পুত্র। এখন মেডন ও পোদারসেন দুজনেই বিশেষ বীরত্বসহকারে রক্ষা করতে লাগল গ্রীকরণতরীগুলোকে।

অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্স এক মুহূর্তের জন্যও তেলামনপুত্র অ্যাজাক্সকে ছেড়ে কোথাও যায় নি। একই জোয়ালের দ্বারা সংযোজিত দুটি বলদ যেমন একখানি জমির সবটুকু কর্ষিত না হওয়া পর্যন্ত তারা পরস্পরকে ছেড়ে যায় না, তেমনি একই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পাশাপাশি একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল দুই অ্যাজাক্স। অনেক বীর সহকর্মী ঘর্মাক্ত কলেবর তেলামনপুত্র অ্যাজাক্সকে বিশ্রাম দান করার জন্য তাঁর ঢালটি হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে গেল। কিন্তু লোক্রিয়ার সৈন্যরা অয়লিয়াসপুত্র অ্যাজাক্সকে ছাড়তে চাইছিল না। কারণ তারা শুধু হাতে যেমন ভাল যুদ্ধ করতে পারত না, তেমনি তাদের কাছে ভাল অস্ত্র বা ঢাল ও শিরস্ত্রাণ কিছুই ছিল না। তাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল তীরধনুক। বর্ম পরিহিত অন্যান্য সেনাদলরা যখন সব সব ট্রয়বীর ও হেক্টরের প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধের অধিকাংশ বোঝাভার বহন করে যাচ্ছিল লোক্রিয়ার সেনাদল তখন আড়াল থেকে পিছন থেকে ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল ট্রয়সেনাদের প্রতি। ক্রমাগত তীর বর্ষণের ফলে বিব্রত বোথ করছিল ট্রয়সৈন্যরা।

এমন সময় পলিমেডাল যদি এগিয়ে না আসত তাহলে ট্রয়সৈন্যরা খুবই দূরবস্থার মুখে পড়ত এবং তাদের হয়ত গ্রীক রণতরী জয়ের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে গ্রীকশিবির ত্যাগ করে চলে আসতে হত। পলিমেডাস হেক্টরকে সম্বোধন করে বলল, দেখ হেক্টর, তোমাকে পরামর্শ দেবার কিছুই নেই। কিন্তু মনে ভেবো না, দেবতারা তোমার সমরবিদ্যায় পরদশী করে তুলেছেন বলে সৎ পরামর্শের ব্যপারে অন্যান্য মন্ত্রণাদাতাদের ছাড়িয়ে যাবে। সর্ববিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেছ তুমি একথা কখনই ভাবতে পার না। দেবতারা কাউকে ভাল যোদ্ধা, কাউকে ভাল সঙ্গীত অথবা নৃত্যশিল্পী, কাউকে প্রসিদ্ধ বীণাবাদক করে তুলেছেন, আবার কাউকে দান করেছেন গভীর বোধশক্তি ও বিজ্ঞতা, যার দ্বারা বহু লোক উপকার পেতে পারে। অর্থাৎ সেই ব্যক্তি সব বিষয়ে অন্যদের থেকে অবশ্যই বেশি জানে।

সুতরাং শোন, আমি যা ভাল বুঝি বলছি। আজকের এ যুদ্ধে শত্রুরা চারিদিকে পরিবৃত করে তুলেছে তোমায়। আজ ট্রয়সৈন্যরাও গ্রীকপ্রাচীরের মধ্যেই আবদ্ধ। তারা এখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, যদি তাদের মধ্যে কিছু সৈন্য অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত। এখনও ট্রয়সৈন্যরা সংখ্যাতে অনেক কম হয়ে পড়েছে এখানে। আপাতত পশ্চাদপসরণ করে তোমার সেনাপতিদের ডাক। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করো এখন, ঈশ্বর একদিন আমাদের জয়মাল্য দান করবেন এই আশায় গ্রীকরণতরী আক্রমণ করব না। পিছু হটব। আবার বড় ভয় হচ্ছে গতকালকার পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে গ্রীকরা, কারণ আমি দেখলাম গ্রীকসেনারা শৃংখলাবদ্ধভাবে এক সূরে কাজ করছে এবং তারা কখনই ক্লান্ত বা অবসন্ন হয় না অথবা বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে না তাদের কেউ।

পলিমেডাসের কথায় খুশি হলেন হেক্টর। রথ থেকে নিচে লাফ দিয়ে নেমে এসে তিনি বললেন, সমস্ত সেনাপতিদের একত্রিত করো তুমি। আমি একবার অদূরস্থ ঐ যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি, কিন্তু পরক্ষণেই আমি এখানে ফিরে এসে তাদের করণীয় সম্বন্ধে নির্দেশ দেব।

হেক্টর তখন তুষারাবৃত এক বিশাল পর্যতের মত ছুটে যেতে লাগলেন রণধ্বনি দিতে দিতে। তিনি ট্রয় ও তাদের মিত্রশক্তির মধ্যে প্রবেশ করলেন। হেক্টরের রণহুঙ্কার শুনে ট্রয়সৈন্যরা সকলে সমবেত হলো প্যানথরপুত্র পলিডেমাসের চারিদিকে। হেক্টর কিন্তু তখন সম্মুখ সারিতে গিয়ে দীফোবাস, হেলেনাস, মেনেলাস, অ্যাডামাস ও অ্যাসিয়াসকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে মর্মাহত হলেন গভীর দুঃখে। এদের মধ্যে দুজন প্রাণবলি দিয়েছে গ্রীক জাহাজের সামনে আর বাকি সকলে আগত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে ট্রয়নগরীর মাঝে। রণক্ষেত্রের বাম প্রান্তে সহসা তিনি আলেকজান্দ্রাসকে দেখতে পেলেন। আলেকজান্দ্রাস তখন একদল ট্রয়সৈন্যকে উৎসাহ দান করছিল। তার কাছে গিয়ে হেক্টর ভসনার সুরে বললেন, সুদর্শন অথচ কুটিলহৃদয়, নারীলোলুপ কামোন্মত্ত, মিথ্যাবাদী প্যারিস, বল কোথায় গেল দীফোসান ও রাজা হেলেনাস? অ্যাসিয়াসপুত্র অ্যাডামাস ও হার্তাকাসপুত্র অ্যাসিয়াই বা কোথায়? ওথরিওনিয়াসই বা কোথায়? ইলিয়ামের সর্বনাশ উপস্থিত, তার অবশ্যই পতন ঘটবে।

আলেকজান্দ্রাস উত্তর করল, যেখানে আমার কোন দোষ নেই, সেখানে কেন তুমি দোষের সন্ধান করছ হেক্টর? আমি অন্য কোন সময়ে অবশ্য যুদ্ধ হতে বিরত থাকতে পারি, কিন্তু এখন না। আমি সম্পূর্ণরূপে কাপুরুষ নই। যে মুহূর্ত হতে তুমি ট্রয়সৈন্যদের গ্রীকজাহাজে গিয়ে যুদ্ধ করতে আদেশ দিয়েছে সেই মুহূর্ত হতেই আমিও সমানে যুদ্ধ যুদ্ধ করে চলেছি ট্রয়সৈন্যদের সঙ্গে। তুমি যাদের কথা বলছ তাদের কেউ কেউ মৃত। তবে দীফোবাস ও হেলেনাস আহত অবস্থায় ট্রয়নগরীতে অবস্থান করছেন। তাদের হাতে আঘাত লেগেছে। জিয়াসের কৃপায় তারা প্রাণে বেঁচে গেছেন। সুতরাং এখন তুমি যেভাবে আমাদের পরিচালনা করবে সেইভাবেই যুদ্ধ করব আমরা। সেখানে যাবে সদিচ্ছাসহকারে অনুসরণ করব তোমায়। যতক্ষণ শক্তি থাকবে দেহে ততক্ষণ পশ্চাদপদ হব না। তবে ইচ্ছা থাকলেই মানুষ সবকিছু করতে পারে না। কারণ মানুষের শক্তি সীমাবদ্ধ।

প্যারিসের একথায় সন্তুষ্ট হলেন হেক্টর। তখন দুজনে রণক্ষেত্রের যেখানে তুমুল যুদ্ধ চলছিল সেখানে গেলেন। সেব্রিওন, বীর পলিডেমাস, ফেনেয়ুস, ওরথিয়াস, পলিফেটিস, স্যামিস, অ্যাসকালিয়াস ও মরিস, এরা সবাই ট্রয়সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য এসেছে দূর দেশ থেকে। জিয়াস তাদের প্রত্যেকেকেই উৎসাহিত করতে লাগলেন যুদ্ধে। উজ্জ্বল বর্ম পরিধান করে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মত্ত প্রভঞ্জনের মতো ট্রয়নেতাদের অনুসরণ করে যেতে লাগলেন। হেক্টর তাদের সকলকে নেতৃত্ব দান করলেন। তিনি এক বিরাট ঢালের দ্বারা দেহটিকে যথাসম্ভখব আচ্ছন্ন করে বর্ম পরিহিত মস্তক উন্নত করে এগিয়ে চললেন সকলের আগে। তিনি দেখতে লাগলেন তার অধীনস্থ কোন ট্রয়সৈন্য যুদ্ধে পশ্চাপদ হয় কিনা। কিন্তু হেক্টরের এই আক্রমণাত্মক অভিযানে ও অগ্রপ্রসারী সামরিক তৎপরতায় কিছুমাত্র ভীত হলো না গ্রীকসেনারা। তাদের মধ্যে থেকে অ্যাজাক্স প্রথম বললেন, এস এস, নিকটে এস, কেন তুমি বৃথা গ্রীকদের ভয় দেখাবার কথা ভাবছ? আমরা গ্রীক যোদ্ধা হিসেবে সুনিপূণ। কিন্তু আজ জিয়াসের অভিশাপে অভিশপ্ত আমরা। তোমরা আজ আমাদের জাহাজ ধ্বংস করতে চাও, কিন্তু আমাদের হাতে এমন সব সৈন্যদল আছে যারা অবশ্যই তোমাদের বেকায়দায় ফেলবে এবং অচিরে তোমাদের সুন্দরী ট্রয়নগরী হবে আমাদেরই দ্বারা বিধ্বস্ত। এমন দিন শীঘ্রই আসবে যখন দেবরাজ জিয়াস ও অন্যান্য দেবতাদের কাছে তোমাদের কাতরভাবে প্রার্থনা করতে হবে যাতে তোমাদের রথাশ্বগুলো দাঁড়কাকের মত দ্রুতগতিতে তোমাদের নগরীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তোমাদের। তোমরা তখন চাইবে শুধু পলায়ন আর পশ্চাদবৃত্তি।

অ্যাজাক্স যখন একথা হেক্টরকে বলছিলেন তখন তার মাথার উপর ডান দিকে একটি পাখি উড়ে গেল। এটি সুলক্ষণ বলে ধরে নিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল গ্রীকরা। কিন্তু হেক্টর উত্তর করলেন, শোন অহঙ্কারী অ্যাজাক্স, আমি দেবরাজ জিয়াসকে পিতার মত ও দেবরাজ্ঞী হেরাকে মাতার মত শ্রদ্ধা করে থাকি, আমি যদি দেবী এথেন আর দেবশ্রেষ্ঠ অ্যাপোলোক উপযুক্ত সম্মান দিয়ে থাকি তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আজ গ্রীকদের ধ্বংস আসন্ন। আজ এখন এই মুহূর্তে আমার বর্শার আঘাতে তোমার মৃত্যু না হলেও অন্যান্য গ্রীকদের সঙ্গে তোমাকে আজ মরতেই হবে। তোমার সুন্দর দেহ আমার বর্শার দ্বারা একসময় বিদীর্ণ হবেই এবং সে দেহ শিকারী কুকুরের খাদ্যে পরিণত হবে।

এই কথা বলে অন্যান্য ট্রয়সৈন্যদের আগে আগে এগিয়ে গেল হেক্টর। ট্রয়সৈন্যদের উৎসাহব্যঞ্জক ধ্বনির সঙ্গে বিদীর্ণ হলো আকাশ বাতাস। গ্রীক সেনারাও অনুরূপ ধ্বনি দিতে লাগল। ট্রয়দলপতিদের হত্যায় ক্ষিপ্ত ট্রয়সৈন্যদের সম্মুখীন হবার জন্য অটলভাবে প্রস্তুত হয়ে রইল তারা। উভয় পক্ষের সম্মিলিত বাহিনীর চিৎকার আকাশমণ্ডল ভেদ করে দেবরাজ জিয়াসের কর্ণগোচর হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *