১১. অ্যাগামেমননের কৃতিত্ব ॥ বহু গ্রীকবীর আহত

একাদশ পর্ব
অ্যাগামেমননের কৃতিত্ব ॥ বহু গ্রীকবীর আহত

আলোর দূত টিথোনাসের সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে এসে প্রভাতসূর্য স্বর্গে ও মর্ত্যলোকে একই সঙ্গে তাঁর কিরণমালা বিচ্ছুরিত করলেন। এদিকে জিয়াস কলহবিবাদের দেবীকে যুদ্ধের নিদর্শন হাতে গ্রীক জাহাজে প্রেরণ করলেন। বিবাদের দেবী গিয়ে গ্রীকরণতরীগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ওডিসিয়াসের জাহাজের মাস্তুলের উপর দাঁড়ালেন। কারণ সেখান থেকে কোন কথা বললে সমস্ত জাহাজের লোক শুনতে পাবে তার কথা। এই জাহাজগুলোর এক প্রান্তে অ্যাকেলিসের জাহাজ দুটি অবস্থিত ছিল। এই দুটি বীর তাদের শক্তি সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন বলেই জাহাজ দুটিকে দুই প্রান্তে স্থাপন করেছিলেন। যুদ্ধ-বিবাদের দেবী ওডিসির জাহাজের মাস্তুলের উপর থেকে চিৎকার করে অধিকতর উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন গ্রীকসৈন্যদের। তারা যেন দেশে না গিয়ে সেখানেই অবস্থান করে, প্রাণপণ শক্তিকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে, একথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি।

আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমনন তখন চিৎকার করে সৈন্যদের প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। নিজেও বর্ম পরিধান করে প্রস্তুত হলেন। প্রথমে তিনি রৌপ্যনির্মিত পদাচ্ছাদন দিয়ে জানু পর্যন্ত আবৃত করে সাইপ্রাসের রাজা সিজাইরাস প্রদত্ত ধাতব বক্ষাবরণী ধারণ করলেন। এই বক্ষাবরণীর দুদিকে তিনটি করে ধাতু নির্মিত রামধনু রঙের সর্প ঘাড় পর্যন্ত উঠে গেছে। এরপর স্বর্ণখচিত এক তরবারি ও স্বর্ণশৃঙ্খলে আবদ্ধ এক দীর্ঘ ছুরিকা কটিবন্ধনীতে বেঁধে নিলেন অ্যাগামেমনন। তারপর ঢালটি তুলে নিলেন। সেই ঢালের সামনে ছিল একটি রাক্ষসের মুখ আর তার দুদিকে ছিল উত্তেজনা আর শঙ্কার দুটি প্রতীকি মূর্তি। মাথায় পরলেন চারটি পালক আর সামনে ও পিছনে দুই দিকে চুড়াবিশিষ্ট এক শিরস্ত্রাণ। হাতে নিলেন দ্বিগুণীকৃত ব্রোঞ্জের ফলকবিশিষ্ট দুটি বর্শা। অ্যাগামেমননের সুতীক্ষ্ণ অস্ত্ররাজি হতে অকস্মাৎ কক্ষচ্যুত কোন উল্কার মত এক অত্যুজ্জ্বল আলোকপুঞ্জ বিচ্ছুরিত হলো। তা দেখে অ্যাগামেমননের সম্মানার্থে ক্ষণপ্রভামণ্ডিত এক বাগ্নি প্রদর্শন করলেন হেরা ও এথেন।

গ্রীক সৈন্যগণ তাদের আপন আপন অশ্বগুলো সারথিদের হাতে দিয়ে দিল। কারণ তারা রথ প্রস্তুত করবে যুদ্ধের জন্য। দলপতিগণ অস্ত্রসজ্জিত হয়ে উঠলেন সকলে। বর্মপরিহিত অ্যাগামেমনন তাঁর বর্শাটি উর্ধ্বে উত্তোলিত করতেই প্রভাতের লাল সূর্যরশ্মিতে তা চকচক করতে লাগল।

ওদিকে জিয়াসের তৎপরতায় ট্রয়সৈন্যগণও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। প্রভাতের উজ্জ্বল শিশিরবিন্দুগুলো রক্তে লাল হয়ে উঠল। উভয় পক্ষের অনেকে মৃত্যুপুরীতে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল।

অপরদিকে রণপ্রান্তরের ঢালু জায়গাটিতে হেক্টরের নেতৃত্বে কয়েকজন ট্রয়বীরও সংঘবদ্ধ হয়ে উঠলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পলিডেমাস ও এনিয়াস–যাদের ট্রয়বাসীরা দেবতার মত শ্রদ্ধা করত। এছাড়া ছিলেন অ্যান্টিনরের তিন পুত্র-পলিবাস, অ্যাজিনর ও সুদর্শন যুবক অ্যাকামাস। কোন এক উজ্জল নক্ষত্রের আলো যেমন একবার পার্শ্ববর্তী মেঘখণ্ডের অন্তরালে আচ্ছন্ন হয়ে পরমুহূর্তে প্রকাশমান হয়ে পড়ে তেমনি হেক্টরের আয়ত উজ্জ্বল ঢালটি একবার সম্মুখ সারিতে দেখা দিয়েই পরমুহূর্তে পার্শ্ববর্তী কোন স্থানে অদৃশ্য হয়ে পড়ছিল।

কোন বিস্তৃত গম বা যবের ক্ষেত্রে যখন শস্যকর্তনকারীরা শস্য কাটে তখন তাদের সামনে যেমন শস্যের স্তূপ স্তূপীকৃত হয়ে ওঠে, সেই বিশাল রণপ্রান্তরে উভয় পক্ষের মৃতদেহগুলো স্থূপীকৃত হয়ে উঠতে লাগল তেমনি। কোন পক্ষেই জয় পরাজয়ের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। উভয় পক্ষই ক্ষুধিত নেকড়ের মত মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধের এই বিভীষিকা দেখে যুদ্ধবিবাদের দেবী উফুল্ল হয়ে উঠলেন, কারণ সমস্ত দেবদেবীর মধ্যে একমাত্র তিনিই যুদ্ধেক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অন্যান্য দেবদেবীরা অলিম্পাসের শিখরদেশে আপন আপন আবাসে শান্তভাবে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা সকলেই ট্রয়বাসীদের উপর পক্ষপাতিত্ব করার জন্য দোষারোপ করছিলেন জিয়াসের উপর। কিন্তু কারো কথা শুনলেন না তিনি। সবকিছুর থেকে নিজেকে পৃথক করে এক বিপুল ঔদাসিন্য ও গৌরবময় প্রভুত্বের চূড়ায় মণ্ডিত হয়ে বসে রইলেন তিনি। ট্রয়নগরী ও গ্রীকরণতরী, অস্ত্রশস্ত্রের ধাতব উজ্জ্বলতা ও ঐশ্বর্য, বিজিত ও বিজেতা, হত্যাকারী ও হতাহত–সবকিছুকে একই অবজ্ঞার গরলে সিক্ত করে দেখতে লাগলেন তিনি।

সকাল হবার পর থেকে সারা প্রথম প্রহরবাপী যুদ্ধের গতি ছিল শ্লথ। উভয়পক্ষেই কিছু করে লোক হতাহত হচ্ছিল, কিন্তু কোন পক্ষই কোন আক্রমণাত্মক অভিযানে উৎসাহ দেখায় নি। কিন্তু বেলা দ্বিপ্রহর আসতেই অর্থাৎ অরণ্যপ্রদেশে কাঠ কাটতে কাটতে কাঠুরিয়ারা যখন তাদের মধাহ্নভোজন শুরু করে ঠিক সেই সময়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যব্যুহ ভেদ করে এক আক্রমণাত্মক অভিযানে এগিয়ে গেলেন অ্যাগামেমনন। নেতৃস্থানীয় এক ট্রয়বীর বিয়েনয়কে ও তার সারথি অয়েনিয়াসকে হত্যা করলেন। যথারূঢ় বিয়েনয় অ্যাগামেমনদের দিকে এগিয়ে আসতেই অ্যাগামেমনন-নিক্ষিপ্ত বর্শার ফলকটি তাঁর শিরস্ত্রাণের একাংশ ভেদ করে বিদ্ধ করল তার ললাটদেশ। তাঁদের বর্মগুলো খুলে নিলেন অ্যাগামেমনন এবং তার ফলে সেই অনাবৃত মৃতদেহগুলো পড়ে রইল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায়।

এরপর অ্যাগামেমনন প্রিয়ামপুত্রদ্বয় ইসাস ও অ্যান্টিফাসকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে গেলেন অপ্রহিত বেগে। ইয়াস ছিলেন রাজা প্রিয়ামের অবৈধ সন্তান আর অ্যান্টিফাস রথে বসেছিলেন আর ইসাস সারথিরূপে রথ চালনা করছিলেন। একবার আইডা পর্বতসংলগ্ন বনপথে অ্যাকেলিসের হাতে এঁরা দুজনেই বন্দী হন। প্রচুর উপঢৌকনের বিনিময়ে মুক্ত পান তারা। ইসাসের বক্ষে একটি বর্শার দ্বারা এবং অ্যান্টিফাসের মাথায় তরবারির দ্বারা জোর আঘাত করে দুজনকেই হত্যা করলেন অ্যাগামেমনন। সিংহ যেমন কোন হরিণমাতার সম্মুখেই তার মৃগশিশুকে থাবার দ্বারা নিষ্পেষিত করে হত্যা করে এবং তা দেখে প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় হরিণামাতা, তেমনি ট্রয়বাসীদের সামনেই ইসাস ও অ্যান্টিফাসকে হত্যা করলেন অ্যাগামেমনন এবং তাঁরা কেউ এগিয়ে আসতে পারলেন না তাদের সাহায্যের জন্য। বরং পালিয়ে যেতে লাগলেন প্রাণভয়ে।

এরপর অ্যান্টিমেকাসের দুই পত্র পিসাভাস ও হিপ্পোলোকাসকে বধ করলেন অ্যাগামেমনন। এই অ্যান্টিমেকাসই আলেকজান্দ্রাসের কাছ থেকে প্রচুর ঘুষ নিয়ে হেলেনকে মেনেলাসের হাতে প্রত্যর্পণের ব্যাপারে প্রথম আপত্তি জানায়। পিসাভারস ও হিপ্পোলোকাস যখন রথে করে যাচ্ছিল তখন তাদের থেকে অশ্বের বল্লাটা হাতছাড়া হয়ে যায়। অশ্বগুলো তখন বিব্রত হয়ে পড়ে আর তারা রথটাকে থামাবার চেষ্টা করতে থাকে। সিংহের মত তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন আত্রেউসপুত্র। তারা তখন কাতরস্বরে আবেদন জানিয়ে বললেন, আমাদের জীবন্ত বন্দী করুন, আমার পিতা অ্যান্টিমেকাসের হাতে অনেক সোনা ও ব্রোঞ্জ ধাতু আছে, তিনি যদি শোনেন আমরা জীবিত অবস্থায় গ্রীক জাহাজে বন্দী আছি তাহলে তিনি আপনাকে প্রচুর উপঢৌকন দানে খুশি করবেন।

তারা কাতরস্বরে অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না অ্যাগামেমনন। তিনি তাদের বললেন, যে অ্যান্টিমেকাস, ট্রয়শিবিরে মেনেলাস ও ওডিসিয়াস দূত হিসেবে গেলে তাদের মৃত্যু কামনা করে, তুমি যদি সেই অ্যান্টিমেকাসের পুত্র হও তাহলে তোমাকে ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। তোমার পিতার পাপের জন্য তোমাকে মরতেই হবে।

এই কথা বলতে বলতে পিসাভাসের বক্ষে অ্যাগামেমনন বর্শার দ্বারা আঘাত করতেই সে রথ থেকে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। হিপ্পোলোকাসও পালাচ্ছিল। কিন্তু তরবারির দ্বারা তারও হাত আর গলা কেটে ফেললেন অ্যাগামেমনন। তারপর তার সেই কাটা মুণ্ড আর হাত দুটো ট্রয়সৈন্যদের দিকে বলের মত ছুঁড়ে দিলেন।

দুই দলের পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যরা পরস্পরকে ভীষণভাবে আক্রমণ করল। উভয়পক্ষের অসংখ্য অশ্বক্ষুর দ্বারা উৎক্ষিপ্ত ধূলিরাশি মেঘের মত সমগ্র রণক্ষেত্রকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ট্রয়সৈন্যদের হত্যা করে গ্রীকসৈন্যদের উৎসাহিত করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন অ্যাগামেমনন। প্রজ্জ্বলিত দাবানলের ঘূর্ণিবায়ুতাড়িত ব্যাপক লেলিহান অগ্নিশিখার সামনে একে একে অরণ্যের সব মহীরুহগুলো যেমন দগ্ধ হয়ে যায় তেমনি ক্রোধোত্তপ্ত অ্যাগামেমননের সামনে পলায়নরত ট্রয়সৈন্যদের মাথাগুলো একের পর এক ভূপাতিত হচ্ছিল। আর সেই সব রথী ও সারথিদের মৃতদেহগুলো ধরাশায়ী অবস্থায় তাদের স্ত্রীদের পরিবর্তে শকুনিদের প্রীত করছিল।

উত্তেজনা ও উন্মাদনাপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রের রক্ত ও ধূলিরাশি হতে হেক্টরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জিয়াস। কিন্তু অ্যাগামেমনন গ্রীকসৈন্যদের ক্রমাগত আহ্বান জানাতে লাগলেন এগিয়ে যাবার জন্য। তিনি কোনমতেই ক্ষান্ত হলেন না। অবশেষে তারা রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে দার্দানসপুত্র ইনাসের স্মৃতিস্তম্ভের নিকটে গিয়ে সেই ডুমুরগাছের তলা দিয়ে নগরদ্বারের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু তারা যখন স্কিয়ান গেটের কাছে ওকগাছের তলায় উপস্থিত হলেন তখন তারা অন্যান্য গ্রীকসৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অ্যাগামেমননকে এইভাবে অপ্রতিহত বেগে ছুটে যেতে দেখে ট্রয়সৈন্যগণ সিংহদ্বারা আক্রান্ত গরুর পালের মত পালাতে লাগল। অ্যাগামেমননের বর্শার আঘাতে অনেক রথী ও সারথি রথ হতে পড়ে যেতে লাগল।

কিন্তু অ্যাগামেমনন যখন অপ্রতিহত বেগে ট্রয়ের নগরপ্রাচীরের নিকটবর্তী হলেন, স্বর্গলোক হতে অসংখ্য প্রস্রবণবিধৌত আইডা পর্বতের শিখরদেশে বিচলিত হয়ে নেমে এলেন বজ্ৰপাণি দেবরাজ জিয়াস। তিনি আইরিসকে ডেকে বললেন, হে দ্রুতগামী আইরিস, এখনি তুমি হেক্টরের কাছে গিয়ে বল, যতক্ষণ অ্যাগামেমনন এইভাবে ট্রয়সৈন্যদের আঘাত করতে করতে তাঁর সৈন্যদের নিয়ে এগিয়ে আসবেন ততক্ষণ সে যেন যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে, যতক্ষণ না অ্যাগামেমনন বর্শা বা তীরদ্বারা কোনভাবে আহত হয়ে রথে করে চলে যাবে তার জাহাজে, ততক্ষণ আমি শক্তি সঞ্চার করব তার মধ্যে এবং সে তার বলে রাত্রি নেমে না আসা পর্যন্ত এগিয়ে যাবে ওদের জাহাজে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে আদেশমত কাজ করল আইরিস। আইডা পর্বতের শিখরদেশ হতে সে নেমে এল ইলিয়াম নগরীতে। এসে দেখল তার রথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হেক্টর। আইরিস বলল, হে প্রিয়ামপুত্র হেক্টর, জিয়াসের কাছ থেকে আমি বাণী নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। যতক্ষণ অ্যাগামেমনন তার সৈন্য নিয়ে এইভাবে এগিয়ে যাবে ট্রয়সৈন্যদের হত্যা করতে করতে, ততক্ষণ তুমি বিরত থাকবে যুদ্ধ থেকে, অন্যদের হাতে ছেড়ে দাও যুদ্ধের ভার। কিন্তু যখন কোন বর্শা বা তীর দ্বারা আহত হয়ে রথে করে তার জাহাজে চলে যাবে অ্যাগামেমনন, তখন তোমার মধ্যে শক্তি সঞ্চার করবেন জিয়াস, যার ফলে তুমি রাত্রি নেমে না আসা পর্যন্ত এগিয়ে যাবে ওদের জাহাজ পর্যন্ত।

এই কথা বলে আইরিস চলে যেতেই হেক্টর অনুপ্রাণিত করে বেড়াতে লাগলেন তাঁর সৈন্যদের। ট্রয়সৈন্যগণও সাহস পেয়ে সম্মুখীন হলো গ্রীকসৈন্যদের। এদিকে গ্রীকসৈন্যগণও তখন সংখ্যায় ভারী হয়ে উঠেছে। উভয় পক্ষেই তখন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আস্ফালন করতে লাগল। একা অ্যাগামেমনন তখনও এগিয়ে যেতে লাগলেন।

হে অলিম্পাসবাসিনী মিউজ, এবার বল আমায়, ট্রয়সৈন্যদের অথবা তাদের মিত্রশক্তিবর্গের মধ্যে কে প্রথম সম্মুখীন হলো গ্রীকবীর অ্যাগামেমননের? তিনি হলেন অ্যান্টিনরপুত্র ইফিডেমাস তিনি একাধারে সাহসী বীর এবং বিশালবপু। গোচারণক্ষেত্র সমন্বিত উর্বর ও শস্যশালিনী গ্রেস দেশে লালিত পালিত হন তিনি। তাঁর মাতা সুন্দরী থিয়েনের পিতা সিসেস তাঁকে শৈশবে লালন পালন করেন। ইফিডেমাস ক্রমে যৌবনে পদার্পণ করলে সিসেস তার বিয়ে দেন। তারপর তিনি বারোটি রণতরী নিয়ে গ্রীকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অভিযান শুরু করেন। কিন্তু পার্কেটি নামক বন্দরে জাহাজগুলো রেখে দিয়ে তিনি স্থলপথে এসে উপস্থিত হন ইলিয়াম নগরীতে। আজ সেই ইফিডেমাস সম্মুখীন হয়েছেন অপ্রতিরোধ অপরাজেয় অ্যাগামেমননের। ইফিডেমাসই প্রথমে বর্শার দ্বারা আঘাত করলেন অ্যাগামেমননকে, কিন্তু বর্শা অ্যাগামেমননের রৌপ্যনির্মিত কটিবন্ধনীতে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল, আঘাত করতে পারল না তাঁকে। অন্যদিকে অ্যাগামেমনন তার কোষমুক্ত তরবারির দ্বারা ইফিডেমাসের ঘাড়ে আঘাত করে নিহত করলেন তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে। তার বর্ম ও অস্ত্রগুলো রথে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।

অ্যান্টিনরের জ্যেষ্ঠ পুত্র কূন তার ভাই-এর মৃত্যু স্বচক্ষে দেখে বেদনায় কাতর হয়ে উঠলেন। অ্যাগামেমননের অলক্ষ্য অগোচরেই তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর বাহুর মাঝখানে বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন। একবার শুধু কেঁপে উঠল অ্যাগামেমননের দেহটা। কিন্তু তিনি যুদ্ধ ত্যাগ করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাতের বর্শাটি তুলে নিক্ষেপ করলেন পলায়মান কূনের প্রতি। কূন তখন তার ভাই-এর মৃতদেহটি একা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্র হতে আর তারস্বরে চিৎকার করছিলেন সাহায্যের জন্য। কূন ঢাল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলেও অ্যাগামেমননের বর্শার আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটল তার। অ্যাগামেমনন তখন ছুটে গিয়ে ইফিডেমাসের মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে কূনের গলাটা কেটে ফেললেন।

অ্যাগামেমননের ক্ষত থেকে যতক্ষণ উত্তপ্ত রক্ত বেরিয়ে আসছিল অবিরাম ততক্ষণ তিনি বর্শা, তরবারি ও পাথর নিয়ে শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন অবলীলাক্রমে। কিন্তু যে মুহূর্তে রক্তঝরা বন্ধ হয়ে গেল তার ক্ষত থেকে, শুকিয়ে গেল তাঁর ক্ষতস্থানটি, সেই মুহূর্তে তার যন্ত্রণা হয়ে উঠল তীব্র। প্রসবের সময় কোন নারীকে যে তীব্র যন্ত্রণা প্রসবের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ইলিথিয়া দান করেন, সেই দুঃসহ যন্ত্রণায় তীব্রতায় কাতর হয়ে উঠলেন আত্রেউসপুত্র। তিনি তৎক্ষণাথ রথের উপর চেপে বসে সারথিকে তাদের জাহাজের দিকে রথ চালনা করতে বললেন, কারণ তিনি অতিশয় ব্যথা অনুভব করছিলেন। তারপর তিনি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বললেন, হে আমার বন্ধু ও গ্রীক রাজন্যবর্গ, এবার তোমরা নিজেরাই নিজেদের রণতরীগুলোকে রক্ষা করো। কারণ আমি সারাদিন যুদ্ধ করে যাই, দেবরাজ জিয়াসের তা অভিপ্রেত নয়।

অ্যাগামেমননের রথের অশ্বগুলো যখন তাদের আহত রাজাকে যুদ্ধক্ষেত্রে হতে জাহাজের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের অতি বেগের জন্য বুকগুলো সাদা হয়ে উঠছিল মুখের ফেনায়, ধূলিতে ধূসর হয়ে উঠেছিল তাদের উদরদেশ।

অ্যাগামেমননকে এইভাবে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পশ্চাদপসরণ করতে দেখে হেক্টর ট্রয়সৈন্যদের সম্বোধন করে বললেন, ট্রয়, লাইসিয়া ও দার্দানিয়ার বীর যোদ্ধাগণ, তোমরা প্রকৃত বন্ধুরূপে যুদ্ধে সমস্ত প্রাণমন নিয়োজিত করো। গ্রীকদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর তাদের সৈন্যদের ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়েছে। জিয়াস আমাকে এক বিরাট জয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা রথে চেপে আক্রমণ করো শত্রুদের। তাহলে অবশ্যই আরও বৃহত্তর গৌরবের অধিকারী হতে পারবে।

এই কথা বলে ট্রয়সৈন্যদের উত্তেজিত করতে লাগল হেক্টর। শিকারীরা যেমন তাদের শিকারী কুকুরগুলোকে কোন সিংহ বা বন্য শূকরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তেমনি রণদেবতা অ্যারেসের প্রিয় হেক্টরও গ্রীকদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলেন। প্রচণ্ড ঝড় যেমন সমুদ্রের বুকে নেমে এসে তার গভীরস্থ নীল জলরাশিকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে তেমনি হেক্টরও যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে ট্রয়সৈন্যদের বিক্ষুব্ধ করে তুললেন।

তাহলে বল দেবী, জিয়াসপ্রদত্ত জয়ের প্রতিশ্রুতিতে অগ্রসর হয়ে তার প্রথম অভিযানে কাদের বধ করেন হেক্টর। প্রথমে তিনি অ্যাফিয়াস, অতোলয়, ওপিতা, সেভোলোপ, ওযেতিয়াস, অ্যাজিলাস, ওসাইমাস, ওরাস ও হিপ্পোনয়–এই সব গ্রীক বীর ও দলপতিদের হত্যা করলেন। তারপর তিনি সাধারণ গ্রীক সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পশ্চিমা বায়ু যেমন দক্ষিণের শুভ্রনিবিড় মেঘমালাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় প্রচণ্ড বেগে অথবা সমুদ্রের জলরাশিকে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করে তেমনি হেক্টরের অব্যর্থ আঘাতে বহু গ্রিকসৈন্যের মস্তক ছিন্ন হয়ে ভূতলে পড়ে গেল। তাদের সেই ছিন্নমস্তক হতে উৎসারিত রক্তস্রোত উৎক্ষিপ্ত হতে লাগল চারিদিকে।

এইভাবে সবকিছু হয়তো ধ্বংস হয়ে যেত গ্রীকদের, গ্রীকরা হয়ত পালিয়ে যেত সবকিছু হারিয়ে যদি না ওডিসিয়াস এসে উত্তেজিত করতেন ডায়োমেডিসকে। ওডিসিয়াস বললেন, হে টাইডেউসপুত্র, কি হয়েছে আমাদের বলত, যার জন্য আমরা আমাদের শক্তির কথা ভুলে গেছি? হেক্টর যদি আমাদের রণতরীগুলোকে দখল করে তাহলে লজ্জার সীমা থাকবে না আমাদের।

ডায়োমেডিস উত্তর করলেন, তা হোক, চলে এস, আমি তার সম্মুখীন হব। তবে অবশ্য তাতে আমাদের কোন লাভ হবে না, কারণ জয়ের ব্যাপারে আমাদের থেকে ট্রয়বাসীদের প্রতি জিয়াস বেশি পক্ষপাতী।

এই কথা বলতে বলতেই রথারূঢ় থিমব্রেয়াসের বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করে রথ হতে ফেলে দিলেন ডায়োমেডিস আর ওডিসিয়াস থিমব্রেয়ারের সারথি ও সহকর্মী মলিয়নকে হত্যা করলেন। এই দুটি মৃতদেহ ফেলে রেখে একের পর এক করে শত্রুসৈন্য হত্যা করে বিভীষিকার সৃষ্টি করে যেতে লাগলেন এই দুই বীর। শিকারী কুকুরের দ্বারা তাড়িত দুটি বন্য শূকর যেমন হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে সেই কুকুরদের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, ওডিসিয়াস ও ডায়োমেডিসও তেমনি ট্রয়সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন করতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রীকসৈন্যরাও হেক্টরের কবল থেকে পালাবার অবকাশ পেল।

এরপর এই বীর পার্কোটের রাজা মেরপের দুই পুত্রকে রথে চাপিয়ে নিয়ে চললেন তাদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে। তাদের পিতা যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেছিলেন তাদের। কিন্তু তারা সে নিষেধবাক্য শোনে নি এবং স্বেচ্ছায় ট্রয়পক্ষে যোগদান করে। আজ টাইডেউসপুত্রের হাতে সহসা জীবনাবসান ঘটল তাদের। তাদের বর্ম দুটি নিয়ে নিল ডায়োমেডিস আর ওডিসিয়াস। তখন হিল্লোডেমাস ও হাইপেয়োকাসকে হত্যা করলেন তাঁরা।

আইডা পর্বতের শিখরদেশ হতে যুদ্ধে গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করতে লাগলেন জিয়াস। তিনি দেখলেন, আপাতত এ যুদ্ধে কোন পক্ষই জয়লাভ করতে পারবে না। উভয়পক্ষই শুধু হত্যা করে চলবে পরস্পরকে। ডায়োমেডিস পীওনপুত্র অ্যাগাসট্রোফাসকে হত্যা করলেন। অ্যাগাসট্রোফাসের সারথি আগেই যুদ্ধ নিহত হওয়ায় তার রথ সারথিহীন অবস্থায় অচল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়। তাই তিনি পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারলেন না ডায়োমেডিস-এর বর্শার আক্রমণ হতে। ডায়োমেডিস ও ওডিসিয়াসের এই তাণ্ডবলীলা স্বচক্ষে দেখে আর থাকতে পারলেন না হেক্টর। তিনি এক তীব্র হুঙ্কারে চারিদিক কাঁপিয়ে একদল ট্রয়সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন। তাঁর সেই রণোন্মত্ত গতিবেগের প্রচণ্ডতা দেখে ভীত হয়ে উঠলেন ডায়োমেডিস।

তিনি ওডিসিয়াসকে বললেন, ট্রয়বীর হেক্টর আমাদের লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। এবার আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। তবু আমরা তার অভিযানের সম্মুখীন হবো অটল ও নির্ভীকভাবে।

তাঁর হস্তপ্ত বর্শাটি আন্দোলিত করতে করতে হেক্টরকে লক্ষ্য করে তা সজোরে নিক্ষেপ করলেন ডায়োমেডিস। হেক্টরের মাথা লক্ষ্য করে তিনি বর্শাটি ছুঁড়লেও হেক্টরের মাথাকে তা স্পর্শ করতে পারল না। তার শিরস্ত্রাণের উপরিস্থিত ধাতব চূড়াকে আঘাত করে তা প্রতিহত হয়ে ফিরে এল। তবে তার আঘাতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গেলেন হেক্টর। হাত দুটো দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরলেন। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন তিনি। ডায়োমেডিস দেখলেন তার বর্শাটি হেক্টরের কাছ থেকে প্রতিহত হয়ে এসে মাটিতে গেঁথে গেছে। ইতোমধ্যে হেক্টর আবার রথে চেপে দ্রুতবেগে ফিরে গেলেন ট্রয়সৈন্যদের মাঝে। কিন্তু তাকে লক্ষ্য করে আবার বর্শাটি ধরে ডায়োমেডিস বললেন, হে হীন কুকুর, মৃত্যু তোমার নিকটে এলেও তুমি তা এড়িয়ে গেছ। আমার মনে হয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগেই প্রতিবার ফীবাস অ্যাপোলোর প্রার্থনা করো। সেই অ্যাপোলোই তোমাকে রক্ষা করেছেন। তথাপি যদি কোনদিন আমার সাহায্যে কোন দেবতা নেমে আসেন তাহলে আমি তোমার জীবন নাশ করবই। বর্তমানে আমি যাদের হত্যা করতে পারব, যারা আমার নাগালের মধ্যে আছে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করব।

এই কথা বলতে বলতে পীওনপুত্রের দেহগাত্র হতে বর্ম ও অস্ত্ররাজি খুলে নিতে লাগলেন। ডায়োমেডিস যখন অ্যাসাসট্রোফাসের দেহ হতে বক্ষাবরণী ও শিরস্ত্রাণটি খুলে নিচ্ছিলেন তখন দার্দানসপুত্র ইলাসের সম্মানার্থে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভের পাশ থেকে একটি তীর নিক্ষেপ করলেন হেলেনের দ্বিতীয় স্বামী আলেকজান্দ্রাস। সেই তীরের ফলকটি ডায়োমেডিস-এর একটি পায়ের পাতাকে বিদ্ধ করে মাটিতে গেঁথে গেল। তখন গর্বের হাসি হাসতে হাসতে স্মৃতিস্তম্ভের অন্তরাল হতে বেরিয়ে এসে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বললেন আলেকজান্দ্রাস, আমার তীর বৃথা যায়টি একেবারে। তবে এই তীর যদি তোমার উদরদেশকে বিদ্ধ করে তোমার প্রাণবিয়োগ ঘটাতে পারত তাহলে যে ট্রয়বাসীরা তোমাকে সিংহের দ্বারা সন্ত্রস্ত ছাগশিশুর মত ভয় করে, তারা বিপদের ভয় হতে নিষ্কৃতি লাভ করত।

শরাঘাতে কোনরূপে বিচলিত না হয়েই ডায়োমেডিস বললেন, কে কূটবাক্যবিশারদ ও পরস্ত্রীহরণকারী তীরন্দাজ, একমাত্র তীরই তোমার অবলম্বন ও ভরসাস্থল, তীর ছাড়া তোমার কোন অস্তিত্ব নেই। যদি তুমি আমার সঙ্গে কখনো দ্বৈতযুদ্ধে অবতীর্ণ হও তাহলে তোমার এই তীর ধনুক তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না কিছুতেই। আমার পদতলকে আঘাত করতে পারার জন্য যে গর্ব তুমি বোধ করছ তা বৃথা। আমার মনে হচ্ছে যেন কোন দূরন্ত বালক অথবা বালিকা আমাকে আঘাত করেছে। এ ধরনের অকিঞ্চিৎকর আঘাত একমাত্র একজন অপদার্থ কাপুরুষের কাছ থেকেই আশা করা যায়। আমি যখন কোন লোককে আঘাত করি তখন আমার অস্ত্র তার চর্মমাংস ভেদ করে তার মৃত্যু ঘটাবেই। শোকে তার পত্নী তার গণ্ডদ্বয় বিদীর্ণ করবে, তার পুত্রকন্যারা হবে অনাথ। তার দেহনিঃসৃত রক্তধারায় লাল হয়ে উঠবে পৃথিবীর মাটি আর তার পচনশীল দেহটিকে ঘিরে আনন্দ করবে না কোন প্রমোদললনার দল, সে দেহকে ঘিরে নেমে আসবে যত শকুনি আর গৃধিণীর দল।

ডায়োমেডিস-এর কথা শেষ না হতেই ওডিসিয়াস কোথা হতে এসে তাঁর পদতল হতে তীরটি জোর করে টেনে বার করে দিলেন। তখন তীব্র হয়ে উঠল ডায়োমেডিস এর যন্ত্রণা। তিনি তৎক্ষণাৎ রথে চড়ে জাহাজের দিকে রথচালনা করতে লাগলেন। ব্যথায় সত্যিই কাতর হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

ওডিসিয়াস দেখলেন, তিনি তখন একা, তার কাছে একজন গ্রীকসৈন্যও নেই। তারা সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। তিনি তখন আপন মনে বলতে লাগলেন, পরিণামে আমার কি হবে? যদি আমি এখান থেকে পিছন ফিরে পালিয়ে যাই তাহলে এদের কি হবে? আর যদি আমি ওদের হাতে বন্দী হই তাহলে তার ফল আরও খারাপ হবে। কারণ এখন ক্রোনাসপুত্র জিয়াসের চক্রান্তে গ্রীকগণ ভীত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এভাবে কেন আমি নিজের কথা ভাবছি? আমি একথা ভালভাবেই জানি যে, একমাত্র কাপুরুষেরাই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যায় ভয়ে আর যারা বীর তারা আহত হলেও অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায়।

দ্বিধাবিভক্ত ওডিসিয়াস যখন এই কথা ভাবছিলেন তখন ট্রয়সৈন্যরা অবাধে এগিয়ে এসে তাঁকে প্রায় ঘিরে ধরল। শিকারী কুকুর আর বলিষ্ঠ যুবকের দল যেমন কোন এক বন্য শূকরকে ঘিরে আক্রমণ করে আর সেই শূকরটি তখন দাঁত বার করে তাদের ভয় দেখালেও তারা যেতে চায় না, তেমনি ট্রয়সৈন্যরাও ওডিসিয়াসের প্রচণ্ড ক্রোধাবেগে কোনরূপ ভীত না হয়ে একসঙ্গে আক্রমণ করল তাকে। কিন্তু একাকী হয়েও তাদের সেই সমবেত আক্রমণে কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হলেন না ওডিসিয়াস। তিনিও তখন একের পর এক ক্রমাগত আক্রমণে দীপাইরাস, কূণ, এন্নোমাস, চেরিসডেমাস ও হিপ্পালাসপুত্র তরোপসকে হত্যা করে ফেললেন। তখন তারোপস-এর ভাই সোকাস ওডিসিয়াসের কাছে এসে বললেন, হে যশস্বী ওডিসিয়াস, সমরকুশীল অক্লান্ত বীর, আজ তুমি হিপ্পাসাসের দুই পুত্রকেই হত্যা করার গৌরব অর্জন করবে অথবা তুমি নিজে নিহত হবে।

এই কথা বলে তার বর্শা দিয়ে ওডিসিয়াসের ঢালটিকে আঘাত করল সোকাস। সে বর্শা ওডিসিয়াসের ঢাল ভেদ করে তার দেহের কিছুটা মাংস ছিঁড়ে নিল। ওডিসিয়াস বুঝতে পারলেন, তিনি আহত হলেও তাঁর মৃত্যুর সময় এখনো আসে নি। তিনি সোকাসকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়তে গিয়ে বললেন, হে হতভাগ্য, একদিন তুই এড়িয়ে গিয়েছিলি আমাকে। আজ আমার আঘাতে তোর মৃত্যু হবেই। তোকে মৃত্যুপুরীতে পাঠাবার গৌরব আজ অর্জন করবই।

যুদ্ধ করার জন্য সোকাস ঘুরে দাঁড়াতেই ওডিসিয়াসের বর্শাটি তার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে বুকের উপর বেরিয়ে এল। তখন তিনি বিদ্রূপ করে বললেন, হায় হতভাগ্য সোকাস, তুই পালাবার আগেই মৃত্যু তোকে এসে ধরে ফেলল। আজ তোর মৃত্যুকালে বাবা বা মা তোর কাছে থাকবে না। শুধু মাংসলোলুপ শকুনির দল নেমে এসে শবাচ্ছাদনের পরিবর্তে তাদের কৃষ্ণকুটিল পক্ষ বিস্তার করে আচ্ছন্ন করে থাকবে তোর মৃতদেহকে। মনে রাখিস, আমি আজ মৃত্যুকালে পতিত হলেও গ্রীকরা আমার যথাযথভাবে অন্ত্রেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করবে।

এই কথা বলতে বলতে সোকাসের বুক থেকে বর্শাটি বার করতেই প্রচুর পরিমাণে রক্ত ঝরতে লাগল সে দেহ থেকে। সে রক্ত দেখে ওডিসিয়াসও ভীত হয়ে পড়লেন কিছু পরিমাণে। ট্রয়বাসীরা সোকাসের সেই অবস্থার জন্য চিৎকার করে সমবেতভাবে এগিয়ে এসে আক্রমণ করল ওডিসিয়াসকে। চারিদিক হতে পরিবৃত হতে তিনবার সাহায্যের জন্য এমনভাবে চিৎকার করলেন ওডিসিয়াস যে তা শুনতে পেলেন মেনেলাস। তা শুনে মেনেলাস অ্যাজাক্সকে বললেন, হে তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স, ওডিসিয়াসের কাতর আর্তনাদ আমার কানে বাজছে। চলো আমরা তাকে রক্ষা করি। তার প্রচুর সাহস ও শক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি তিনি কোন সাহায্য না পান তাহলে তার ক্ষতি হবে এবং তাকে হারালে গ্রীকগণেরও সমূহ ক্ষতি হবে।

তখন মেনেলাস অ্যাজাক্সকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গেলেন ওডিসিয়াসকে বাঁচাবার জন্য। কোন ব্যাধের শরে আহত মৃগ রক্তাক্ত অবস্থায় বন পথে ছুটতে ছুটতে নিবিড় অবসাদে কোন জায়গায় ঢলে পড়লে যেমন পার্বত্য শৃগালের দল তাকে ঘিরে ধরে কিন্তু কোন সিংহের আকস্মিক আগমনে তারা পালিয়ে যায় শিকার ছেড়ে, ঠিক তেমনি ক্লান্ত ওডিসিয়াসকে ঘিরে থাকা ট্রয়সৈন্যরাও পালিয়ে যেতে লাগল অ্যাজাক্স ও মেনেলাসকে দেখে। অ্যাজাক্স তার বিশাল ঢালটি নিয়ে এগিয়ে যেতেই ট্রয়সৈন্যরা এদিক সেদিক ছুটে পালাতে লাগল । মেনেলাস ওডিসিয়াসের হাত ধরে তাঁকে বিপন্মুক্ত করে রথে চাপিয়ে দিলেন। এদিকে অ্যাজাক্স প্রচণ্ড বেগে ট্রয়সৈন্যদের আক্রমণ করে একের পর এক হত্যা করে যেতে লাগলেন শত্রুসৈন্যদের। একে একে তিনি প্যারাস, লাইসান্দ্রাস, পাইরাসাগ ও পাইলারতেসকে আহত করলেন। পার্বত্য প্রদেশ হতে বেরিয়ে এসে কোন বেগবান নদী যেমন সমতলভূমির দিকে ধাবিত হয় এবং তার বৃষ্টিজলপুষ্ট স্রোতধারায় অনেক ওক ও পাইনগাছকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং বহুল পরিমাণ কম সমুদ্রে নিক্ষেপ করে তেমনি দুর্বারবেগে পশ্চাদ্ধাবন করতে লাগলেন অ্যাজাক্স যুদ্ধক্ষেত্রে।

রণক্ষেত্রের বাঁদিকে স্কামান্দার নদীর তীরে নেস্টর ও বীর আইডোমেনেউসকে ঘিরে শত্রুসৈন্যরা ঘন হয়ে উঠেছিল যেখানে হেক্টর সেখানে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় অ্যাজাক্স কি করেছেন তা জানতেই পারেন নি। হেক্টর সেইখানে বেগে রথচালনা করে বহু শত্রুসৈন্য হত্যা করলেন তাঁর বর্শার দ্বারা। তথাপি গ্রীকরা অবিচলিতভাবে যুদ্ধ করে যেতে লাগল। অবশেষে আলেকজান্দ্রাসের একটি ত্রিমুখী তীর গ্রীকদলপতি মাকাওনের ডান কাঁধে লাগতেই বিচলিত হয়ে পড়ল গ্রীকরা। যুদ্ধের গতি গ্রীকদের পক্ষে অনুকূল না থাকায় ট্রয়সৈন্যরা অবশ্যই মাকাওনকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দী করে নিয়ে যাবে ভেবে আইডোমেনেউস নেস্টরকে বললেন, হে নেলেউসপুত্র নেস্টর, আপনি এই মুহূর্তে মাকাওনকে রথে চাপিয়ে দ্রুত গ্রীকজাহাজে নিয়ে যান; সাধারণ লোক ভিড় করে কিছু করতে পারবে না। সেখানে যে শল্যচিকিৎসক আছেন তিনি ঐ তীরটি কেটে কেটে বার করে দিতে পারবেন মাকাওনের দেহ থেকে।

আইডোমেনেউসের কথামত নেস্টর মাকাওনকে রথে চাপিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে সোজা গ্রীক জাহাজের দিকে চলে গেলেন। মাকাওন ছিলেন প্রখ্যাত গ্রীক চিকিৎসক অ্যাসক্লেপিয়াসের পুত্র।

ট্রয়সৈন্যরা তখন কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। তা দেখে ট্রয়বীর সেব্রিন হেক্টরকে বললেন, শোন হেক্টর, আমরা রণক্ষেত্রের একেবারে বাম প্রান্তে যুদ্ধ করছি। কিন্তু অন্য প্রান্তে দেখ ট্রয়সৈন্যরা ও তাদের রথের অশ্বগুলো বিভ্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। আমি একটি প্রকাণ্ড ঢাল দেখে বুঝতে পারছি তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স ট্রয়সৈন্যদের বিপন্ন করে তুলেছে। যেখানে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর ট্রয়সৈন্যরা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করছে সেইদিকে আমাদের রথের গতি ঘুরিয়ে চল আমরাও যাই।

এই কথা বলে তার রথের অশ্বগুলোকে চাবুক মারতেই রথ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে লাগল রণক্ষেত্রের ভিড়ের মধ্য দিয়ে পথ করে। অনেকে যারা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল, রথের চাকা তাদের উপর দিয়ে চলে গেল তাদের দেহকে ক্ষতবিক্ষত করে। রথের চাকা ও তার নাভিদণ্ডে রক্ত লেগে গেল প্রচুর। হেক্টরকে এইভাবে অবাধে পথ করে এগিয়ে যেতে দেখে ভীত হয়ে উঠল গ্রীকগণ। হেক্টর তার তরবারি ও বর্শার দ্বারা গ্রীকসৈন্যদের ক্রমাগত আঘাত করে যেতে থাকলেও তিনি তেলামনপুত্র অ্যাজাক্সকে এড়িয়ে যেতে লাগলেন। কারণ তিনি জানতের তার থেকে বড় তিনি কোন বীরের সঙ্গে যুদ্ধ করলে জিয়াস রেগে যাবেন।

এমন সময় অ্যাজাক্সের মনে ভীতি সঞ্চার করলেন স্বর্গাধিপতি জিয়াস। অ্যাজাক্স তখন তাঁর ঢালটিকে সামনে রেখে ট্রয়সৈন্যদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে না পেরে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। জ্বলন্ত মশাল ও শিকারী কুকুর সহযোগে প্রহরারত একদল কৃষকের তাড়নায় কোন সিংহ যেমন কোন মেষপাল হতে শিকার সগ্রহ করতে না পেরে রাত্রির পর সকাল হতেই নিষ্ফল আক্রোশ বুকে নিয়ে পালিয়ে যায় তেমনি অ্যাজাক্স তার অভিপ্রায় সিদ্ধ না হওয়াতে পিছু হাঁটতে শুরু করলেন। অথবা কোন গর্দভকে যেমন লাঠি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে করতে শস্যক্ষেত্র হতে তাড়িয়ে দেয় কৃষকেরা তেমনি ট্রয়সৈন্যরাও অ্যাজাক্সের ঢালের উপর ক্রমাগত আঘাত হেনে হেনে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল যুদ্ধক্ষেত্র হতে। এক একবার একা এগিয়ে আসতে থাকেন অ্যাজাক্স, কিন্তু পরক্ষণেই তাড়া খেয়ে পিছু হটতে থাকেন। তাঁকে লক্ষ করে ক্রমাগত বর্শা বর্ষণ করতে লাগল ট্রয়সৈন্যরা। কিন্তু সেই বর্শাগুলোর কিছু তাঁর প্রকাণ্ড ঢালে প্রতিহত হলো আর কিছু মাটিতে পড়ে গেল। তার গায়ে কোনটি লাগল না। তবে তার জাহাজের দিকে অগ্রসরমান অ্যাজাক্স গ্রীকবীরদের সেদিকে আসতে দিলেন না।

ইউমনপুত্র বীর ইউরিপাইলাস অ্যাজাক্সের এই দূরবস্থা দেখে এগিয়ে এসে তার বর্শা নিক্ষেপ করে ট্রয়সৈন্যদের প্রতি। সে বর্শা লাগল ফসিসাসপুত্র অ্যাপিসাওনের উরুতে। অ্যাপিসাওনের উদরদেশে বিদ্ধ হওয়ায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে পতিত হলেন মৃত্যুমুখে। ইউরিপাইলাস তাঁর দেহগাত্র হতে বর্মটি খুলে নিচ্ছিলেন যখন তখন আলেকজান্দ্রাসের একটি তীর এসে লাগল তার দক্ষিণ জানুতে। তীরটি তাঁর জানুতে বিদ্ধ অবস্থাতেই ভেঙে গেল। তখন ইউরিপাইলাস প্রাণ বাঁচাবার জন্য দ্রুত শিবিরের দিকে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, হে আমার বন্ধুগণ ও রাজন্যবর্গ, অ্যাজাক্স বড় বিপদে পড়েছেন, সে বিপদ হতে তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন কি না তা জানি না। সুতরাং যেমন করে হোক তাকে রক্ষা করো।

এইভাবে আহত অবস্থাতেই চিৎকার করতে লাগলেন ইউরিপাইলাস। আর সেই চিৎকার শুনে অনেকেই এগিয়ে এসে তাদের চারদিক থেকে ঢেকে ফেলল। সেই অবসরে অ্যাজাক্সও সেখানে এসে আশ্রয় নিলেন।

এইভাবে উভয় পক্ষই জ্বলন্ত আগুনের মত দুর্বারবেগে এগিয়ে যেতে লাগল পরস্পরের দিকে। নেলেউসের ক্লান্ত ও ঘর্মাক্ত রথাগুলো তখন নেস্টর ও মাকাওনকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের সীমানার বাইরে। অ্যাকেলিস তা লক্ষ্য করলেন। তিনি তার জাহাজের উপর থেকে যুদ্ধের এই সব কঠোর গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করছিলেন। তিনি তখন তাঁর সহকর্মী প্যাট্রোক্লাসকে ডাকলেন এবং প্যাট্রোক্লাসও তা শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে বললেন, কেন আমায় ডাকছ, কি আমায় করতে বল অ্যাকেলিস?

অ্যাকেলিস তখন উত্তর করলেন, হে মিনোতিয়াসপুত্র, আমি চাই এবার গ্রীকরা নতজানু হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করুক। তাদের এখন অবস্থা সত্যই শোচনীয়। এখন নেস্টরের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো, কাকে তিনি আহত অবস্থায় রথে করে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধক্ষেত্র হতে। আমার মনে হয় অ্যাসক্লোপিয়াসের পুত্র মাকাওন। তবে ঘোড়াগুলো খুব দ্রুতবেগে চলে যায় আমি তার মুখখানা ভালভাবে দেখতে পেলাম না।

অ্যাকেলিসের কথামত জাহাজ ও শিবির পার হয়ে নেস্টরের কাছে ছুটে গেলেন প্যাট্রোক্লাস।

এদিকে নেস্টরের রথ তাঁর শিবিরে উপনীত হতেই তারা অবতরণ করলেন সে রথ থেকে। নেস্টরের সহকর্মী ও সারথি রথ থেকে অশ্বগুলোকে বিযুক্ত করলেন। নেস্টর ও মাকাওন দুজনে তখন দেহের ঘাম মুছে ভিতরে গিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। সুন্দরী হেকামেদ তাদের জন্য প্রস্তুত করে আনল পানীয়। অ্যাকেলিস যখন তেনেদস জয় করেন তখন হেকামেদ বন্দিনী হন আর গ্রীকরা তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ ও মন্ত্রণাদাতা নেস্টরকে তাকে দান করেন। হেকামেদ প্রথমে তাদের সামনে টেবিলটি পরিষ্কার করে কিছু সুপেয় মদ আর মদের পিপে রাখল। নেস্টরের পানপাত্রটি ধাতুনির্মিত ও স্বর্ণখচিত। সেই পাত্রটির চারিদিকে চারটি হাতল আর তাতে দুটি করে সোনার কপোত ছিল আর তাদের নিচে ছিল দুটি করে স্তম্ভ। সেই পাত্রটি একা নেস্টর ছাড়া আর কেউ একা ব্যবহার করতে পারবেন না। হেকামেদ তাঁদের পানপাত্র উত্তম প্রামদেশীয় মদের সঙ্গে কিছু ছাগদুগ্ধ ও গুঁড়ো মিশিয়ে দিল। তারা সেই পানীয় পান করে কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে আলোচনা শুরু করলেন। আর ঠিক সেই সময়ে প্যাট্রোক্লাস এসে উপস্থিত হলেন। তাঁদের সামনে।

প্যাট্রোক্লাসকে দেখে তাঁর আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ নেস্টর। প্যাট্রোক্লাসকে হাত ধরে শিবিরাভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে তাকে পাশে বসতে বললেন। কিন্তু প্যাট্রোক্লাস দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি বললেন, মহাশয়, আমি বেশিক্ষণ দাঁড়াব না, ভিতরে যাব না, যিনি আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তিনি যে-সে লোক নন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করে পাঠিয়েছেন যাকে আপনি রথে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি কে। আমি দেখছি তিনি মাকাওন। আমি এখন ফিরে গিয়ে অ্যাকেলিসকে এই কথা জানাতে পারি। আপনি জানেন, তিনি অনেক সময় অকারণে মানুষকে কেমন করে দোষ দেন।

নেস্টর উত্তর করলেন, গ্রীকদের কতজন আহত হলো একথা কেন জানতে চেয়েছেন অ্যাকেলিস? যে ব্যাপক ভীতি বিরাজ করছে আমাদের গ্রীকসৈন্যদের মাঝে তা তিনি গ্রাহ্যই করেন না। বীর ডায়োমেডিস, ওডিসিয়াস, অ্যাগামেমনন সকলেই আহত। ইউরিপাইলাসের জানুতে তীর লেগেছে আর এই শরাহত মাকাওনকে আমি এইমাত্র নিয়ে আসছি কোনরকমে বাঁচিয়ে। এই সব সত্ত্বেও নিজে এতবড় একজন বীর হয়েও অ্যাকেলিস কিছু গ্রাহ্য করলেন না এবং তাঁর স্বজাতির প্রতি কোন দয়ামায়াও নেই। কবে আমাদের সব জাহাজগুলো জ্বলতে থাকবে, কবে আমাদের মৃতদেহগুলো স্থূপাকৃত হয়ে উঠবে একের পর এক করে, তিনি কি সেইদিনের জন্য প্রতীক্ষা করছেন? আমার নিজের কথা বলতে গেলে বলতে হয় আমার কোন শক্তি নেই। অতীতের মত দেহে আমার শক্তি থাকলেও বা কথা ছিল। একবার বহুদিন আগে এনিসবাসীদের সঙ্গে আমাদের পশু নিয়ে যুদ্ধ হয়। আমি তখন এনিসবাসী বীর হাইপীরোকাসের পুত্র ইতিমেনেউসকে হত্যা করি। আমি যখন তাদের পশুগুলো দখন করে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম এনিসবাসীরা তখন আমাকে বাধা দেয় এবং তাদের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করছিল ইতিমেনেউস। ঠিক সেই সময় আমার একটি তীর তার গায়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ে যায় আর তা দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তার দেশবাসীরা। আমরা যখন তাদের পঞ্চাশটি পশুর পাল দখল করে নিয়ে যাই। এছাড়া ছিল বহুসংখ্যক মেষ, শূকরছানা, গরু ও ঘোড়া। বাচ্চা সমেত দেড়শোটি ঘোটকীও আমরা দখল করি। এরপর সেই দখলীকৃত পশুগুলোকে আমরা নেলেউসের রাজধানী পাইলসে নিয়ে যাই। আমার প্রথম যুদ্ধে আমার এই ধরনের কৃতিত্বদর্শনে আনন্দিত হন আমার পিতা রাজা নেলেউস। সকাল হতেই চারিদিকে ঘোষক পাঠানো হলো। তারা ঘোষণা করল অ্যানিসের কোন লোকের আজ যদি কোন পশু পাবার কথা থাকে তাহলে তারা যেন এসে তা নিয়ে যায়। বিশিষ্ট পাইলসবাসীরা সমবেত হয়ে আমাদের অধিকৃত পশুগুলো ভাগ করে নিতে লাগল। আমরা পাইলসবাসীরা ছিলাম সংখ্যায় অল্প। এপিয়ার লোকেরা তাই আমাদের বড় জ্বালাতন ও পীড়ন করত। তারা পাইলসের অনেক পশু নিয়ে গিয়েছিল। আমার পিতার বারোটি পুত্রের মধ্যে আমি ছিলাম জীবিত। বাকি সকলেই অ্যাপিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়। আমার পিতার অধিকারে তিনশো পশুর এক পাল ছিল। আমার পিতা অশ্বক্রীড়ায় সুদক্ষ ছিল। তিনি এনিসের বহু লোকের অশ্বকে শিক্ষা দিয়ে ক্রীড়াপারদর্শী করে তোলেন। কিন্তু তার প্রতিদানে অ্যানিসবাসীরা কোন পশু আমার পিতাকে উপহার না দেওয়ায় আমার পিতা রেগে যান। একবার অ্যানিসের রাজা আগিয়াস আমাদের পাইলসের সব রথ ও অশ্ব কেড়ে নিয়ে সারথিদের শূন্য হাতে তাড়িয়ে দেন। তাতে আমার পিতা রেগে গিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং অ্যানিসের দখল করা পশুগুলো পাইলসের মধ্যে ভাগ করে নেন।

এইভাবে আমরা সব পশু ভাগ বণ্টন করে নেবার পর দেবতাদের পূজা দিলাম। কিন্তু মাত্র তিন দিন পরেই অ্যাপিয়ার অধিবাসীরা বহুসংখ্যক সৈন্য ও রথ নিয়ে আমাদের আক্রমণ করল। তাদের সঙ্গে দুই কিশোরবয়স্ক যুবরাজও ছিল। পাইলসের সীমান্তবর্তী এক পার্বত্য অঞ্চলে আলিফিয়াস নদীর ধারে ফ্রাইগ্যা নামে একটা শহর ছিল। সেই শহরটা ধ্বংস করাই লক্ষ্য ছিল ওদের। কিন্তু এক বিরাট প্রান্তর অতিক্রম করে সেই শহরের পথ যেতেই সহসা অলিম্পাস পর্বতের শিখর থেকে নেমে এসে আমাদের সংঘবদ্ধ হবার আদেশ করলেন এথেন। কারণ পাইলসের বহু লোক তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। আমার পিতা নেলেউস আমাকে যুদ্ধ করতে দিতে চাইছিলেন না; তিনি আমার ঘোড়াগুলোকে লুকিয়ে ফেললেন। কারণ তিনি বললেন আমি নাকি যুদ্ধের কিছুই জানি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এথেনের পরিকল্পনামত আমি পদাতিক হয়েও আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলাম এবং তাদের প্রধান যোদ্ধার সমকক্ষ হিসেবে যুদ্ধ করলাম।

পথে মাইনোলাস নামে আর একটা নদী ছিল সেই নদী অ্যারেনের কাছে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। সেই নদীর ধারে আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীর লোকেরা নেমে পড়ে আমাদের পদাতিক বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর দুপুরের দিকে আমরা সদলবলে আলফিয়াস নদীর ধরে গিয়ে তার পবিত্র জলের সঙ্গে পূজার অর্ঘ্য দিলাম দেবরাজ জিয়াসের উদ্দেশ্যে। একটা বলদ জিয়াস, একটা বলদ পসেডন ও একটা বকনা এথেনের নামে উৎসর্গ করলাম। উৎসর্গ করার পর সেই গোমাংস দিয়ে নৈশ ভোজন করলাম এবং নদীর ধারে আপন বর্ম পরিধান করেই বিশ্রাম করতে লাগলাম।

অ্যাপিয়ার সৈন্যরা অবরোধ করে ফেলল আমাদের শহরটাকে। তারা দৃঢ় সংকল্প হয়ে উঠল, আমাদের শহরটা জয় করবেই। কিন্তু এর জন্য তাদের অনেক যুদ্ধ করতে হবে। প্রাতঃকালীন সূর্যের রশ্মি পৃথিবীর উপর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যুদ্ধ শুরু করলাম। জিয়াস ও এথেনের কাছে প্রার্থনা করে আমাদের যুদ্ধ শুরু হলেই শত্রুপক্ষের বীর যোদ্ধা মুলিয়াসকে আমি প্রথম হত্যা করলাম। মুলিয়াস ছিলেন অগিয়াসের জামাতা; তিনি তাঁর কন্যা অ্যাগামেদকে বিবাহ করেন। অ্যাগামেদের চুলগুলো ছিল সোনালী রঙের এবং তিনি বিভিন্ন গাছ-গাছড়া ও ওষধির গুণাগুণ জানতেন। মুলিয়াস যখন আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন তখন আমি তাঁকে বর্শার দ্বারা আঘাত করতেই ধুলোর উপর চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন তিনি। আমি তখন তাঁর রথের উপর চড়ে বসে পড়লাম। অ্যাপিয়ার সৈন্যরা যখন দেখল তাদের অধিনায়ক ধরাশায়ী হয়ে পড়েছেন তখন হতাশ হয়ে চারিদিকে পালাতে লাগল তারা। আমি তখন তাদের উপর ঘূর্ণিঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পঞ্চাশটা রথ দখল করে নিলাম। প্রত্যেকটি রথে দুটি করে লোক ছিল; তারা আমার বর্শায় নিহত হয়ে রথ থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে ধূলিচুম্বন করতে লাগল। আমি দুই মলিওন ভ্রাতাদেরও হত্যা করতাম যদি না তাদের প্রকৃত পিতা ঝড় ও ভূমিকম্পেরর দেবতা পসেডন তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে হতে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘন কুয়াশার অন্তরালে লুকিয়ে রাখতেন। এইভাবে জিয়াস পাইলসকে জয়ের এক উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি দিলেন আর আমরা সেই প্রতিশ্রুতি দ্বারা উৎসাহিত হয়ে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলাম। অবশেষে আমরা গম উৎপাদনের সমৃদ্ধ বিউসিয়াস ও আলেসিয়াস পাহাড়ের ধারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন দেবী এথেনের সহায়তায় আমরা তাদের প্রায় সকলকে হত্যা করলাম। এইভাবে শত্রুদের বিতাড়িত করে সেই বিউসিয়াদের পার্বত্য অঞ্চল থেকে গ্রীকরা জিয়াস ও নরশ্রেষ্ঠ নেস্টরের জয়গান করতে করতে পাইলসে ফিরে এল।

এইভাবে একদিন আমি আমার জাতির জন্য সংগ্রাম করি। সে সব কথা অবশ্য স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু অ্যাকেলিস তাঁর জাতির স্বার্থে তাঁর বীরত্বের বিকাশ না ঘটিয়ে আবদ্ধ ও অব্যবহৃত রেখে দিয়েছেন নিজের মধ্যে। কিন্তু আজ গ্রীকসৈন্যরা যদি নির্জিত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই অ্যাকেলিসকে একদিন অনুশোচনা করতে হবে। হে আমার প্রিয় বন্ধু, তোমাকে যেদিন মিনোরিয়াস পিথিয়া হতে অ্যাগামেমননের সাহায্যার্থে প্রেরণ করেন তাঁর কাছে সেদিন তোমাকে কি জাতির জন্য প্রাণপণ সগ্রাম করার উপদেশ দেন নি তিনি? আমি আর ওডিসিয়াস তখন বাড়ির ভিতর থেকে তিনি তোমাকে যা বলেছিলেন তা সব শুনতে পাই। আমরা তখন সৈন্য সংগ্রহ করতে করতে পেলেউসভবনে ঘটনাক্রমে উপস্থিত হই এবং মিনোরিয়াসের কাছে তোমাকে ও অ্যাকেলিসকে দেখি। পেলেউস তখন ছিলেন প্রাসাদের বহিরাঙ্গনে। তিনি যজ্ঞানলে গোমাংস দগ্ধ করে জিয়াসের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছিলেন এবং একটি পানপাত্র হতে সেই যজ্ঞানলে মদ্য নিক্ষেপ করছিলেন।

তোমরা দুজনে যখন পূজার মাংস কাটতে ব্যস্ত ছিলে তখন আমরা প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হই, আমাদের দেখতে পেয়ে অ্যাকেলিস তখন লাফ দিয়ে উঠে আমাদের হাত ধরে প্রাসাদ অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে ভালভাবে টেবিলে বসিয়ে যথাযোগ্য আপ্যায়নে আপ্যায়িত করেন অতিথিদের। প্রচুর পান ও ভোজনে তৃপ্ত হবার পর আমরা আমাদের সব কথা ব্যক্ত করে আমাদের এই যুদ্ধে যোগদান করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলে তুমি এবং সেই দুজন প্রবীণ বীর অনেক উপদেশ দিলেন তোমায়। বৃদ্ধ পেলেউস তখন অ্যাকেলিসকে অন্যান্য গ্রীকবীরদের মধ্যে থেকে একসঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আদেশ করলেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, বংশগৌরব ও দৈহিক শক্তির দিক হতে অ্যাকেলিস তোমার থেকে বড়, কিন্তু বয়সে তুমিই বড় দুজনের মধ্যে। তাকে তুমি সৎপরামর্শের দ্বারা সুপথে চালিত করবে এবং সে নিজের স্বার্থের তোমার পরামর্শ মেনে চলবে।

এইভাবে তোমার পিতা উপদেশ দেন তোমায়: কিন্তু তুমি হয়ত তা সব ভুলে গেছ। তবু এই সব কথা অ্যাকেলিসকে একবার বলে দেখ সে তোমার কথা শোনে কিনা। কে জানে দেবতার কৃপায় তুমি হয়ত তাকে বোঝাতে পারবে, তোমার মত বন্ধুর পরামর্শ শোনা তার পক্ষে খুবই উচিত। অ্যাকেলিস যদি কোন দৈববাণীর ভয়ে বিরত থাকে অথবা তার মাতা জিয়াসের নাম ধরে নিষেধ করেন তাহলে সে যেন তোমার নেতৃত্বে মামিডনদের পাঠিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে যদি গ্রীকদের পরিত্রাণ করতে পার এবং তাদের নিবিড় হতাশার অন্ধকারের মাঝে আলো আনতে পার তার জন্য চেষ্টা করো। যদি সে একান্তই না আসে তাহলে সে যেন অন্তত তোমাকে বর্ম পরিধান করিয়ে তোমাকে যুদ্ধে পাঠায়। তাহলে ট্রয়সৈন্যগণ তোমাকে অ্যাকেলিস বলে ভুল করে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। গ্রীকরা তাহলে কিছুটা হাঁপ ছাড়ার সময় পাবে। এখন তারা শত্রুদের দ্বারা বড় বিব্রত হয়ে পড়েছে এবং তারা হাঁপ ফেলতে পারছে না। তোমার উদ্যম ও শক্তি এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। তুমি এখন সহজেই ক্লান্ত ও অবসন্ন শত্রুসৈনদের গ্রীকশিবির হতে বিতাড়িত করে তাদের নগরপ্রাচীরের মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য করবে।

এই কথা বলে প্যাট্রোক্লাসের অন্তরকে উত্তপ্ত ও অনুপ্রাণিত করলেন নেস্টর। প্যাট্রোক্লাস তখন অ্যাকেলিসের শিবিরাভিমুখে বেগে ধাবিত হলো। ওডিসিয়াসের যে জাহাজে ন্যায় বিচার অনুষ্ঠিত হত সেই জাহাজের কাছে যেতেই ইউমনপুত্র ইউরিপাইলাস তাঁকে দেখতে পেয়ে আহত অবস্থায় তাঁর কাছে এলেন। তাঁর জানু তীরবিদ্ধ হওয়ায় তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের সীমার বাইরে। তাঁর মস্তক ও স্কন্ধদেশ হতে ঘর্ম নির্গত হচ্ছিল অবিরাম, কালো রক্ত ঝরছিল তাঁর ক্ষতস্থান হতে। তবু তার মন বিচলিত হয় নি কিছুমাত্র। তাকে দেখে মিনোতিয়াস পুত্রের অনুকম্পা হলো এবং তিনি দুঃখের সঙ্গে বললেন, হে হতভাগ্য গ্রীকরাজন্যবর্গ ও মন্ত্রণাদাতাগণ, তোমরা কি তাহলে তোমাদের মাতৃভূমি হতে বহু দূরে মৃত্যুবরণ করে ট্রয়ের কুকুরদের তৃপ্ত করবে তোমার দেহমাংসের দ্বারা? হে মহান ইউরিপাইলাস, বল গ্রীকগণ কি দুর্ধর্ষ হেক্টরকে দমন করতে সমর্থ হয়ে অথবা তার বর্শাতেই তাদের ঘটাবে চূড়ান্ত পরাজয় আর পতন।

আহত ইউরিপাইলস উত্তর করল, হে মহান প্যাট্রোক্লাস, গ্রীকদের আর কোন আশা নেই। তারা তাদের জাহাজেই সর্বনাশের সম্মুখীন হবে। আমাদের মধ্যে যারা ছিলেন বড় বড় বীর তাঁরা সকলেই ট্রয়সৈন্যদের আঘাতে ধরাশায়ী বা আহত হয়ে পড়েছেন। ট্রয়সৈন্যরা ক্রমশই শক্তিবৃদ্ধি করছে। কিন্তু এখন আমাকে জাহাজে নিয়ে গিয়ে আমার জানু হতে তীরটা উঠিয়ে দাও। তারপর তপ্ত জল দিয়ে আমার ক্ষতস্থান ধৌত করে তাতে ওষধির প্রলেপ লাগিয়ে দাও। এই সব ওষধির প্রয়োগবিদ্যা তুমি অ্যাকেলিসের কাছ থেকে শিখেছ আর অ্যাকেলিস শিখেছে চিকিত্সা বিশারদ শিরণের কাছ থেকে। আমরা দুজন চিকিৎসক পোদাতিরিয়াস ও মাকাওনের মধ্যে একজন নিজেই আহত হয়ে চিকিৎসাধীনে আছেন আর একজন বর্তমানে যুদ্ধে ব্যাপৃত আছেন।

মিনোতিয়াসের বীর পুত্র উত্তর করলেন, হে মহান ইউরিপাইলাস, এখন কি করে এ কাজ করি? এখন আমি নেস্টরের কাছ থেকে অ্যাকেলিসের কাছে এক সংবাদ বহন করে নিয়ে চলেছি। তবুও তোমার এই দুঃখ ও যন্ত্রণায় উদাসীন থাকতে পারি না আমি।

এই কথা বলে তিনি তার গলা ধরে তাঁর শিবির মধ্যে নিয়ে গেলেন। তাঁর ভৃত্য একটি গোচর্ম পেতে দিলে তার উপর শুইয়ে দেওয়া হলো ইউরিপাইলাসকে। প্যাট্রোক্লাস তখন তীরটি কেটে ইউরিপাইলাসের জানু থেকে বার করে ক্ষতস্থানের কালো রক্ত গরম জল দিয়ে ধুয়ে দিলেন। তারপর ওষুধটি বেটে ক্ষতস্থানের উপর প্রলেপ চাপিয়ে দিলেন। সর্বযন্ত্রণাহরণকারী সেই ওষধির প্রভাবে তাঁর ক্ষতস্থান সহজেই শুকিয়ে গেল এবং রক্ত-ঝরা বন্ধ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *