১০. নৈশ অভিযান

দশম পর্ব
নৈশ অভিযান

অন্যান্য গ্রীক রাজন্যগণ যখন আপন আপন শয়নকক্ষে গভীরভাবে নিদ্রা যাচ্ছিলেন, একা অ্যাগামেমনন তখন অশান্ত ও অস্থিরচিত্তে অতন্দ্র রাত্রি যাপন করতে লাগলেন। বজ্র, বিদ্যুৎ ও তুষারপাতে মর্ত্যভূমিকে মাঝে মাঝে যেমন কম্পিত করে তোলেন হেরানাথ দেবরাজ জিয়াস তেমনি আপন মর্মমাঝে কাঁপতে লাগল আপনারই আত্মা। দুঃখে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন রাজা অ্যাগামেমনন। দূরে অন্ধকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি দেখলেন ইলিয়াম নগরীর সম্মুখে অসংখ্যা প্রহরাগ্নি জ্বলছে উজ্জ্বলভাবে, উল্লসিত ট্রয়বাসীগণ আনন্দে বাঁশী ও নানারকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। তারপর গ্রীকদের দিকে দৃকপাত করে দেখলেন চারদিকে অন্ধকার ও নিরানন্দময়। তখন তিনি হতাশায় মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন আর উপরে মুখ তুলে জিয়াসের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন এক অব্যক্ত বেদনায়। পরিশেষে তিনি নেলেউসপুত্র নেস্টরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সমীচীন বিবেচনা করলেন যদি তিনি আসন্ন ও এই নিশ্চিত ধ্বংসের হাত হতে গ্রীকদের বাঁচাবার কোন উপায়ের সন্ধান দিতে পারেন। তখন তিনি উঠে দেহবন্ধনী পরিধান করে চটি পরলেন পায়ে। তারপর স্কন্ধ হতে আপাদবিস্তৃত এক সিংহচর্ম ঝুলিয়ে নিয়ে বর্শা হাতে বেরিয়ে পড়লেন শিবির হতে।

মেনেলাসও ঘুমোতে পারেন নি। যে গ্রীকগণ তার জন্য ঘরবাড়ি ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে সমুদ্র পার হয়ে ট্রয়বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে তাদের কথা ভাবতে গিয়ে ভীত হয়ে পড়লেন মেনেলাস। সহসা রজতবিন্দুচিত্রিত এক সিংহচর্মদ্বারা তার বিস্তৃত পৃষ্ঠদেশ আবৃত করে, মাথায় ব্রোঞ্জনির্মিত একটি মুকুট পরে বর্শা হাতে বেরিয়ে পড়লেন শিবির হতে। যিনি গ্রীকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, যাকে তারা দেবতার মত ভক্তি করে তার সেই প্রিয় ভাইকে ঘুম হতে অসময়ে জাগাতে চলেছেন তিনি। বাইরে বেরিয়ে দেখলেন তার ভাই অ্যাগামেমননও তার জাহাজের দিকেই আসছেন। তাঁকে দেখে আনন্দিত হলেন মেনেলাস।

প্রথমে মেনেলাসই কথা বললেন, হে আমার প্রিয় ভাই, কেন তুমি এরূপ অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এসেছ? তুমি কি আমাদের কোন সহকর্মীকে ট্রয়শিবিরে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য পাঠাতে চাও? আমার কিন্তু ভয় হয় এই নিশীথ রাত্রিতে কেউ শত্রুদের মাঝে গিয়ে এ কাজ করতে সম্মত হবে না। এ কাজের জন্য চাই প্রচুর সাহস।

অ্যাগামেমনন উত্তর করলেন, মেনেলাস, গ্রীকদের ও তাদের রণতরীগুলোক রক্ষা করার জন্য আজ আমাদের কূটনৈতিক পরামর্শের প্রয়োজন। কারণ এখন জিয়াস তাঁর মত পরিবর্তন করে আমাদের থেকে হেক্টরের পূজা বেশি পছন্দ করছেন। হেক্টরের মত কোন মানুষ একদিনের মধ্যে এমন বিপুল পরিমাণ ধ্বংসকার্য সাধন করতে পারে– আমি তা কখনো চোখে দেখি নি অথবা তার কথা কোথাও শুনি নি। তবে হেক্টর শুধু গ্রীকদের ক্ষতি করে নি, সে তার আপন আত্মারও ক্ষতি করেছে, কারণ সে নিজে দেবতা বা দেবতার পুত্র নয়। সে অমর নয়, তাকে একদিন না একদিন মরতে হবেই। সুতরাং তুমি এখন যত দ্রুত সম্ভব চলে যাও অ্যাজাক্স আর আইডোমেনেউসের কাছে। আমি যাব নেস্টরের কাছে। গিয়ে বলব তিনি যেন অবিলম্বে আমাদের প্রহরীদের কর্তব্য সম্বন্ধে নির্দেশ দেন। তাঁর কথা সকলে শুনবে, কারণ তাঁর পুত্র ও ভ্রাতাই হচ্ছে প্রহরীদের অধিনায়ক। এ বিষয়ে আমরা সব ভার তাদের উপরেই দিয়েছি।

মেনেলাসের উত্তর করলেন, আমি কি করব তোমার কথা হতে তা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কি ওদের ওখানেই তোমার দেখা না পর্যন্ত অপেক্ষা করব না ওদের আদেশ দিয়েই এখানে চলে আসব?

অ্যাগামেমনন বললেন, থাম, বিভিন্ন শিবিরে যাবার এত বেশি পথ আছে যে সব পথ চিনে সব শিবিরে যেতেই পারবে না। তুমি বরং ওদের সকলকে তোমার কাছে এক জায়গায় ডাকবে। তোমার নিজের মান মর্যাদাটাকে সেখানে বড় করে দেখাবে না। ওদের প্রত্যেকের পিতার নাম ধরে ডাকবে এবং ওদের বংশপরিচয় দেবে, ওদের আপন পদবী বা উপাধিগত সম্মানও দান করবে। কি করব, আমাদের এখন প্রত্যেককেই শ্রমের অংশ গ্রহণ করতে হবে, কারণ দেবরাজ জিয়াস আমাদের জন্মকালে আমাদের উপর এই দুর্ভাগ্যের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন।

এই নির্দেশ দান করে তার ভাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে জনপ্রতিনিধি নেস্টরের কাছে চলে গেলেন অ্যাগামেমনন। নেস্টরের শিবিরের মধ্যে গিয়ে দেখলেন, তাঁর শয্যায় শায়িত আছেন নেস্টর আর সেই শয্যার পাশে তাঁর বর্ম, শিরস্ত্রাণ, দুটি বর্শা ও ঢালটি নামানো রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনাকালে এই ঢাল দিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন নেস্টর। বয়সে বৃদ্ধ হয়েও যুদ্ধ হতে কখনো বিরত থাকেন না তিনি। অ্যাগামেমননের পদশব্দে সহসা ঘুম থেকে জেগে উঠে নেস্টর নিদ্রাজড়িত চোখে বললেন, এই নিশীথ রাতে গ্রীকদের জাহাজে একা ঘুরে বেড়াচ্ছ কে তুমি! তুমি কি তোমার কোন হারানো পশু বা সহকর্মীর অনুসন্ধান করছ? নীরবে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার উদ্দেশ্য কী তা বল।

অ্যাগামেমনন উত্তর করলেন, হে নেলেউসপুত্র নেস্টর, গ্রীকদের গৌরবচূড়ামণি আমি আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমনন, যার উপর সারা জীবনব্যাপী দুঃখ আর শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন জিয়াস। যতদিন আমার দেহে প্রাণ থাকবে, যতদিন আমার চলৎশক্তি থাকবে ততদিন এ দুঃখ আর শ্রমের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব না আমি। দুশ্চিন্তায় নিদ্রা আসছে না আমার চোখে, তাই শয়নকক্ষ হতে বেরিয়ে পড়েছি পথে। যুদ্ধ আর গ্রীকদের আসন্ন বিপদের চিন্তায় অণুক্ষণ নিপীড়িত হচ্ছে আমার অন্তর। এ বিপদের কথা ভেবে ভীত হয়ে উঠেছি আমি, বিহ্বল ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। কোন নির্ভরযোগ্য পরামর্শও পাচ্ছি না। আমার বক্ষে হৃৎকম্পন এত দ্রুত হচ্ছে যে আমার দেহ হতে এখনি লাফ দিয়ে বেরিয়ে যাবে আমার হৃৎপিণ্ড। এই বিপদে আপনি যদি কিছু করতে পারেন এবং যেহেতু আপনার চোখেও ঘুম আসছে না, চলুম আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে দেখুন প্রহরীরা তাদের কর্তব্যকর্মে অবহেলা করে তন্দ্রাচ্ছন্ন বা নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়েছে কি না। কারণ আমাদের শত্রুরা অতি নিকটে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করছে এবং এই রাত্রিতেই তারা যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে।

নেস্টর বললেন, হে আত্রেউসপুত্র মহান নৃপবর অ্যাগামেমনন, হেক্টর যতদূর ভাবছে ততদূর সৌভাগ্যের অধিকারী জিয়াস তাকে করেন নি। অ্যাকেলিস তার ক্রোধ সংবরণ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেই বিপদে পড়বে হেক্টর, প্রচুর দুঃখভোগ আছে তার ভাগ্যে। তবে আপাতত চল আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে অন্যান্য রাজন্যদের ডেকে ওঠাব। আমরা ডায়োমেডিস, ওডিসিয়াস প্রমুখ সকল বীরকে জাগাব। অ্যাজাক্স ও আইডোমেনেউসের জাহাজ দুটি দূরে এক প্রান্তে আছে। ওখানেও আমরা যাব। তবে মেনেলাসের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে দোষ না দিয়ে পারছি না। তুমি রাগ করলেও আমি স্পষ্ট কথা বলব। তার এখন সব ভার তোমার উপর চাপিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা উচিত হয় নি। তার এখন যতসব গ্রীক রাজাদের নিকট গিয়ে অনুনয় বিনয় করে তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত ছিল, কারণ আমাদের সম্মুখে এখন সমূহ বিপদ উপস্থিত।

অ্যাগামেমনন বললেন, মহাশয়, আপনি এক এক সময় ন্যায়সঙ্গতভাবেই দোষারোপ করতে পারেন তার উপর, কারণ সে এক এক সময় সত্যই হতোদ্যম ও যুদ্ধবিমুখ হয়ে পড়ে। তবে তার এই সাময়িক উদ্যমহীনতার কারণ কোন আলস্য বা ঔদাসীন্য নয়, আমার নির্দেশের প্রতীক্ষায় মাঝে মাঝে সে স্তব্ধ হয়ে থাকে মাত্র। আজকের ক্ষেত্রে অবশ্য যে আমার আগেই উঠে পড়ে এবং নিজে থেকেই সে আমার কাছে আসে। আমিই তাকে যে সব রাজন্যবর্গের নাম করলেন আপনি, তাদের ডাকতে পাঠিয়েছি। এখন চলুন আমরা যাই। প্রাচীরদ্বারের বাইরে তারা প্রহরীদের সঙ্গে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য। আমি সেখানে যাবার জন্যই নির্দেশ দিয়েছি তাদের।

নেস্টর বললেন, তাহলে গ্রীকরা কোনমতেই তাঁকে দোষ দেবে না এবং অবনত মস্তকে তাঁর সব আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলবে তারা।

এই কথা বলে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে অর্থাৎ ঘন চর্মনির্মিত বহির্বাস, কোমরবন্ধনী, পায়ে চটি ও হাতে বর্শা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নেস্টর। প্রথমে তিনি ডাকলেন ওডিসিয়াসকে। চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন ওডিসিয়াস, কেন আপনি একা এই স্তব্ধ নিশীথে জাহাজগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? কী এমন প্রয়োজন?

নেস্টর বললেন, হে লার্তেস পুত্র মহান ওডিসিয়াস, দেবতাদের মন্ত্রণাদাতা, আমার এই আগমনের তাৎপর্যকে লঘু অর্থে নিও না। গ্রীকরা এখন বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এস আমার সঙ্গে। অন্যান্য বীরদের ডেকে জাগিয়ে তোল। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে এখন আমাদের স্থির করতে হবে, আমরা যুদ্ধ করব না দেশে ফিরে যাব।

একথা শুনে তাঁর শিবিরের মধ্যে গিয়ে মুহূর্তমধ্যে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এলেন ওডিসিয়াস। প্রথমে তাঁরা গেলেন ডায়োমেডিস-এর কাছে। দেখলেন তাঁর শিবিরে একটি গালিচার উপর পাতা বলদচর্মের উপর সহকর্মীদের সঙ্গে বর্ম পরিধান করেই গভীরভাবে ঘুমোচ্ছেন ডায়োমেডিস। হাতগুলোকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁরা। তাদের পাশে মাটিতে গাঁথা বর্শার উজ্জ্বল ফলকগুলো আকাশের তারার মত জ্বল জ্বল করছিল অন্ধকারে। তাকে জাগাবার জন্য কাছে গিয়ে পা দিয়ে নাড়া দিয়ে ভর্ৎসনার সুরে বললেন, জেগে ওঠ টাইডেউসপুত্র, কেমন করে তুমি ঘুমোচ্ছ এখন? তুমি কি দেখনি ট্রয়সৈন্যরা আমাদের জাহাজের অতি সন্নিকটে শিবির স্থাপন করেছে? তাদের ও আমাদের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই।

এ কথায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন ডায়োমেডিস। বললেন, হে বয়োপ্ৰবীণ বীর, আপনার অন্তর কি লৌহনির্মিত? আপনি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম গ্রহণ করেন না? আপনার কি ক্লান্তি বলে কোন জিনিস নেই? এমন কি কোন যুবক নেই যে এখন জাহাজে ঘুরে ঘুরে রাজন্যবর্গনে জাগাতে পারে?

নেস্টর উত্তর করলেন, বৎস তুমি যা বলেছ সব সত্য। গ্রীক দলপ্রধানদের জাগাবার জন্য আমার অনেক পুত্র ও মিত্র আছে। কিন্তু গ্রীকদের বিরাট বিপদের কথা ভেবে স্থির থাকতে পারলাম না। তুমি আমার থেকে বয়সে নবীন, তুমি অতি শীঘ্র গিয়ে অ্যাজাক্স ও ফাইলেউসপুত্রকে জাগাও।

সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এলেন ডায়োমেডিস। তিনি তখন প্রতিটি জাহাজে ঘুরে ঘুরে বীরদের জাগিয়ে তাদের সঙ্গে করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দেখলেন, তখন সকলেই ঘুম ঝেড়ে ফেলে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। মেষপাল প্রহরারত সারমেয়গুলো যেমন পর্বতসংলগ্ন কোন অরণ্য হতে আগত কোন বন্যজন্তুকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তাড়িয়ে দেয় তেমনি গ্রীকরা তাদের সম্মিলিত ও সশব্দ সমারোদ্যমের দ্বারা সমস্ত ঘুমকে তাড়িয়ে দিল পরস্পরের চোখ থেকে। সম্মুখস্থ রণপ্রান্তরে ট্রয়সৈন্যদের মাঝে কোন তৎপরতা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সজাগ ও সতর্ক হয়ে উঠল গ্রীকরা। তাদের এই সতর্কতা দেখে আনন্দিত হলেন বৃদ্ধ নেস্টর। উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হে আমার প্রিয় বৎসগণ, নিদ্রাকে প্রশ্রয় নিয়ে কখনই জয়ের সুযোগ এনে দিও না শত্রুদের।

অনন্তর অন্যান্য গ্রীক রাজপুরুষদের সঙ্গে নিয়ে প্রাচীরসংলগ্ন পরিখা পার হয়ে রণপ্রান্তরের একাংশে উপবেশন করলেন নেস্টর। এই স্থান হতে গতকাল সন্ধ্যায় হেক্টর তাঁর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা হতে সহসা বিরত হয়ে চলে যান। সেই স্থানে উপবেশন করে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন গ্রীকবীরেরা।

নেস্টর প্রথমে কথা বললেন। বললেন, বন্ধুগণ, আমাদের মধ্যে এমন সাহসী বীর কি কেউ আছেন যিনি গোপনে ট্রয়বাসীদের মাঝে গিয়ে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সংবাদ আমাদের এনে দিতে পারবেন? তারা কি এখন তাদের নগরদ্বারের বাইরে আমাদের জাহাজের সন্নিকটেই অবস্থান করবে না আমাদের এইভাবে বিপন্ন রেখে আশ্বস্ত হয়ে নগরমধ্যে গিয়ে বিশ্রাম লাভ করবে? যদি কেউ এই সংবাদ নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন তাহলে তিনি এক আকাশচুম্বী যশের অধিকারী হবেন এবং প্রকৃত পুরস্কার ভূষিত হবেন। সমস্ত দলপ্রধানরা তাকে একটি করে শাবকসহ কালো ভেড়ী উপহার দেবে এবং তিনি যেকোন ভোজসভায় বা উৎসবে মর্যাদার সঙ্গে আমন্ত্রিত হবেন।

সকলে চুপ থাকলেও ডায়োমেডিস বলে উঠলেন, হে নেস্টর, যদি একজনও কেউ আমার সঙ্গে যায় তাহলে আমি ট্রয়বাসীদের মাঝে যাব স্বচ্ছন্দে। দুজন একসঙ্গে থাকলে সুবিধা হয়, কারণ দুজন দুদিকে ভালভাবে লক্ষ্য রাখতে পারবে। একা লোক সব সময় অসহায় এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের দিক হতে দুর্বল থাকে।

এবার অনেকেই যেতে চাইলেন ডায়োমেডিস-এর সঙ্গে। অ্যাজাক্স, নেস্টরপুত্র মেরিওল মেনেলাস, সকলেই যেতে চাইলেন। অসমসাহসী বীর ওডিসিয়াসও যেতে চাইলেন ট্রয়বাসীদের মাঝে। তখন অ্যাগামেমনন বললেন, হে টাইডেউসপুত্র, তুমি তোমার পছন্দমত সহকর্মী বেছে নাও। যারা যেতে চেয়েছে তাদের মধ্যে যাকে তুমি শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করবে তাকেই গ্রহণ করবে সঙ্গে। কারো বংশগৌরবের খাতিরে কম যোগ্য লোককে গ্রহণ করবে না; প্রকৃত যোগ্যতাই হবে তোমার নির্বাচনের মাপকাঠি।

অ্যাগামেমননের একথা বলার কারণ এই যে, তিনি ভেবেছিলেন বংশগৌরবের খাতিরে মেনেলাসকে নির্বাচন করবেন ডায়োমেডিস। ডায়োমেডিস তার উত্তরে বললেন, যদি আপনি আমাকে আমার পছন্দমত ব্যক্তি নির্বাচন করতে বলেন তাহলে আমি বীর ওডিসিয়াসের কথা না ভেবে কি করে পারি বলতে পারেন? কারণ ওডিসিয়াসই একমাত্র বীর যিনি যেকোন রকমের বিপদ ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারেন স্বচ্ছন্দে এবং তিনি দেবী প্যালাস এথেনের অনুগ্রহভাজন। যদি তিনি আমার সঙ্গে থাকেন তাহলে আমি আগুনের মাঝখান থেকেও বেরিয়ে আসতে পারব স্বচ্ছন্দে। কারণ তার পর্যবেক্ষণশক্তি তীক্ষ্ণ ও বোধশক্তি গভীর।

ওডিসিয়াস বললেন, হে টাইডেউসপুত্র, আমার সম্বন্ধে ভালমন্দ কোন কিছুই বলার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ গ্রীকদের মধ্যে তুমি আমাকে সবচেয়ে ভালভাবে চেন। এখন চল আমরা যাই, কারণ রাত্রি শেষ হয়ে আসছে, উষাকাল আগতপ্রায়। রাত্রির দুই তৃতীয়াংশ এখন অতিক্রান্ত, আর মাত্র একটি প্রহর অবশিষ্ট আছে।

অতঃপর বর্ম পরিধান করলেন দুজনে। থ্রেসিমেদিস ডায়োমেডিসকে দিলেন একটি ঢাল আর একটি তরবারি, কারণ তাঁর অস্ত্র দ্রুত আসার সময় তাঁর জাহাজে ফেলে রেখে এসেছেন ডায়োমেডিস। নেস্টরপুত্র মেরিওল ওডিসিয়াসকে দিলেন একটি ধনুর্বাণ আর শূকরদন্তখচিত এক চর্মনির্মিত শিরস্ত্রাণ। এই শিরস্ত্রাণটি একদিন ওর্মেনাসপুত্র অ্যামাইনটরের প্রাসাদ আক্রমণকালে সেখান থেকে চুরি করে আনেন অটোলিকাস।

এইভাবে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে রওনা হলেন দুই বীর। পথে বেরিয়েই দক্ষিণ দিকে পথের ধারে প্যালাস এথেনপ্রেরিত একটি বলাকা দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে তা দেখতে না পেলেও তার ডাক শুনতে পেলেন তাঁরা। অন্ধকারে তা দেখতে না পেলেও তার ডাক শুনতে পেলেন তাঁরা। এই সুলক্ষণ দেখে আনন্দিত হয়ে দেবী এথেনের নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন ওডিসিয়াস, আমার কাতর আবেদনে সাড়া দাও। হে জিয়াসকন্যা, তুমি আমার যেকোন বিপদ আপদের সময়ে কাছে কাছে থাক এবং আমাকে মুক্তির পথ বলে দাও। আজ আমার এই ঘোর বিপদে কাছে আমাকে সাহায্য করো। আজ এমন কিছু উপায় বলে দাও যার দ্বারা ট্রয়বাসীদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে বীরত্বের গৌরব সহকারে আমাদের জাহাজে নিরাপদে ফিরে আসতে পারি।

তখন ডায়োমেডিসও প্রার্থনা করতে লাগলেন আমার আবেদনেও সাড়া দাও হে জিয়াসকন্যা, গ্রীকদের দ্বারা রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরিত হয়ে থবস নগরী গমনকালে পিতাকে যে সদয় সাহচর্য ও সহায়তা দান করেছিলে আজ আমাকেও তাই দান করো আমার পিতা অ্যাসোপাস নদীর তীরে গ্রীকগণকে বিদায় দিয়ে একাকী ক্যাডমীনদের কাছে শান্তির বাণী বহন করে নিয়ে যান। প্রত্যাবর্তনকালে তিনি শত্ৰুকর্তৃক আক্রান্ত হন। কিন্তু হে দেবী, একমাত্র তোমার কৃপায় ও সহায়তায় আমার পিতা একাকী সকল শত্রুদের পরাস্ত করে বিপদ হতে মুক্ত হন। আজ আমাকেও তেমনি রক্ষা করো এবং তার প্রতিদান স্বরূপ আমি বহুবর্ণে চিত্রিত এক বত্সরের একটি কচি গোবৎসকে বলি দেব তোমার উদ্দেশ্যে।

এইভাবে দুজনেই প্রার্থনা জানালেন দেবী প্যালাস এথেনের উদ্দেশ্যে। দেবী তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। নৈশ শিকারে উন্মত্ত দুটি সিংহের মত বীরবিক্রমে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত শত্রুসৈনদের পরিত্যক্ত বর্মের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন তাঁরা।

ওদিকে হেক্টরও নিশ্চিন্তে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে পারেন নি। তিনিও এক মন্ত্রণাসভার আহ্বান করলেন ট্রয়বীরদের। তিনি তাদের বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন একজনও কি আছে যে এক বিরাট পুরস্কারের বিনিময়ে আমার আদেশ পালন করতে পারবে? আমার কথামত কাজ করতে পারলে আমি তাকে একটি রথ, কয়েকটি দ্রুতগামী অশ্ব ও অনন্ত সম্মান ভূষিত করব। সে এখন গ্রীকদের জাহাজে গিয়ে দেখবে তারা কি এখনো আমার মত অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত আছে অথবা আমাদের কাছে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে বিপন্ন ও অবসন্ন অবস্থায় প্রহরা বিরত হয়েছে এবং দেশে ফিরে যাবার পরিকল্পনা করছে।

তাদের মধ্যে উপস্থিত সকলে চুপ করে রইল। কিন্তু ইউমেদিস নামে জনৈক খ্যাতনামা প্রহরীর পুত্র ডোলন উঠে দাঁড়াল। তাকে কেউ পছন্দ করত না, কিন্তু সে খুব ছুটতে পারত, পঞ্চ কন্যার পর সে ছিল তার পিতামাতার একমাত্র পুত্রসন্তান। সে হেক্টরকে সম্বোধন করে বলল, আমি যাব হেক্টর। গুপ্তচররূপে আমি যাব গ্রীক জাহাজে। কিন্তু তার আগে রাজদণ্ড ছুঁয়ে আপনাকে শপথ করতে হবে পেলেউসপুত্রের ব্রোঞ্জনির্মিত রথ আর দ্রুতগামী অশ্বগুলো আমায় উপহার দেবেন। আমি সৈনিক হিসেবে কখনই পশ্চাদপদ হব না। আমি গ্রীকদের সমস্ত জাহাজগুলো একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে অবশেষে যাব অ্যাগামেমননের জাহাজে, যার মধ্যে গ্রীকবীরেরা এক মন্ত্রণাসভায় মিলিত হয়েছেন।

তার কথা শেষ হলে রাজদণ্ড ছুঁয়ে শপথ করলেন হেক্টর, হেরানাথ বজ্ৰাধিপতি জিয়াস সাক্ষী রইলেন, আমি শপথ করে বলছি, একমাত্র তুমি ছাড়া আর কোন ট্রয়বাসী ও অশ্বগুলোতে আরোহণ করতে পারবে না।

যে শপথবাক্য উচ্চারণ করলেন হেক্টর তা ছিল মিথ্যা। তবু তা অনুপ্রাণিত করল ডোলনকে। সে একটি ধূসর রঙের নেকড়ের চামড়ায় দেহগাত্র আবৃত করে স্কন্ধে ধনুর্বাণ আর হাতে তীক্ষ্ণ বর্শা নিয়ে রওনা হল গ্রীক জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে। কিন্তু গ্রীকজাহাজ হতে কোন সংবাদ সে এনে দিতে পারে নি হেক্টরকে। ট্রয়শিবির হতে রওনা হয়ে সে যখন দ্রুতবেগে অগ্রসর হচ্ছিল তখন ট্রয়শিবিরপথে আগমনরত ওডিসিয়াস তাকে দেখতে পেয়ে ডায়োমেডিসকে বললেন, দেখ ডায়োমেডিস, নিশ্চয় ট্রয়শিবির থেকে কোন লোক আসছে। আমি বুঝতে পারছি না লোকটা কোন গুপ্তচর বা মৃতদেহ-লুণ্ঠনকারী কোন তস্কর। যাই হোক, ওকে কাছে আসতে দাও। তারপর ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা। আর যদি লোকটা তার আগেই ছুটে পালিয়ে যায় তাহলে ওকে পিছন দিক হতে বর্শার দ্বারা আঘাত করে আমাদের জাহাজের দিকে টেনে নিয়ে যাব যাতে ও আর ট্রয়শিবিরে ফিরে যেতে না পারে।

এই বলে তারা মৃতদেহের স্কুপের পাশে এমনভাবে লুকিয়ে রইলেন যাতে ডোলন তাদের দেখতে পেল না। সে তাদের পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। ওডিসিয়াম ও ডায়োমেডিসও তার পশ্চাদ্ধাবন করতে লাগলেন। ডোলন ভাবল হয়ত দুজন ট্রয়বীর হেক্টরের নির্দেশেই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন বুঝতে পারল তারা শত্রু তখন সে ছুটে পালাতে লাগল। গ্রীকজাহাজের দিকে ঊধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল ডোলন। তাকে অন্য গ্রীক প্রথম আঘাত করার গৌরব অর্জন করবে এই ভয়ে দেবী এথেন নতুন শক্তি সঞ্চার করলেন ডায়োমেডিস-এর দেহে। তিনি তখন দ্রুততর বেগে ডোলনের নিকট গিয়ে বর্শা নিক্ষেপ করে বললেন, দাঁড়াও, না হলে আমি তোমার প্রাণ সংহার করব।

বর্শাটি ডোলনের ডান কাঁধের উপর দিয়ে চলে গিয়ে মাটিতে গাঁথা পড়লেও সে ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে ভয়ে মলিন হয়ে কাঁদতে লাগল এবং তার দাঁতে দাঁত লেগে গেল। ডায়োমেডিস তার কাছে গিয়ে তার হাত ধরতেই সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে মেরো না, জীবিত অবস্থায় বন্দী করো। আমাদের অনেক সোনা ও মূল্যবান ধাতু আছে। আমার পিতা আমার জীবনের বিনিময়ে তোমাদের তা উপঢৌকন দেবেন।

ওডিসিয়াস বললেন, ভয় করো না, মৃত্যুর কথাও ভেবো না। আমাকে শুধু সত্য কথা বল। বল, কেন তুমি এই নিশীথ রাত্রিতে তোমাদের শিবির হতে আমাদের রণতরীগুলো অভিমুখে ছুটে যাচ্ছিলে? তুমি কি মৃতদেহ লুণ্ঠন করতে যাচ্ছিলে? অথবা তুমি স্বেচ্ছায় এদিকে আসছিলে?

ডোলন কাঁপতে কাঁপতে বলল, তার মিথ্যা ছলনাময় প্রতিশ্রুতির দ্বারা আমার বিচারবুদ্ধি লুপ্ত কর দেয় হেক্টর। সে আমাকে পেলেউসপুত্রের রথ আর অশ্ব দেবার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে এই অন্ধকার রাত্রিতে শত্রুদের শিবিরে গিয়ে খবর আনার আদেশ দেয়। সে জানতে চায় গ্রীকরা কি এখনো অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে আছে অথবা বিপন্ন ও অবসন্ন প্রহরা হতে বিরত হয়ে দেশে যাবার পরিকল্পনা করছে।

হেসে উত্তর করলেন, ওডিসিয়াস, তুমি একটা বড় পুরস্কারের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিলে এবং সমস্ত অন্তর দিয়ে তা কামনা করছিলে। কিন্তু জেনে রেখো, ঈয়াকাসের বংশধরদের অশ্ব একমাত্র অ্যাকেলিস ছাড়া অন্য কোন মানুষ পালন বা চালনা করতে পারবে না। অ্যাকেলিস তা পারে কারণ তার মাতা একজন দেবী। আমাকে সত্য কথা বল, যখন তুমি এখানে আসার জন্য রওনা হও তখন হেক্টর কোথায় ছিল? তার পরিধেয় বর্ম ও রথাশ্ব কোথায়? প্রহরার কি ব্যবস্থা করা হয়ছে এবং বাকি লোকদের কোথায় ঘুমোবার স্থান স্থির করা হয়েছে? ট্রয়সৈন্যরা কি এখন তাদের নগর হতে দূরে আমাদের এই রণতরীগুলোর সন্নিকটেই অবস্থান করবে অথবা গ্রীকদের বিপদে ফেলতে পারার আত্মপ্রসাদ লাভ করে তারা নগরের মধ্যে গিয়ে বিশ্রাম করবে?

ডোলন বলল, আমি সত্য কথা বলব। হেক্টর এখন অন্যান্য মন্ত্রণাদাতাদের সঙ্গে রাজা ইলিয়ামের স্মৃতিস্তম্ভের পাশে এক নির্জন স্থানে আলোচনা করছে। প্রহরার কাজের জন্য কোন নির্দিষ্ট লোক নিযুক্ত করা হয় নি। তবে ট্রয়বাসীরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এখানে সেখানে প্রহরাগ্নি জ্বেলে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। কিন্তু তাদের যে সব মিত্রশক্তির লোকেরা দূর থেকে এষেছে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে কারণ তাদের পুত্রপরিবার এখানে না থাকায় তাদের নিরাপত্তার চিন্তা তাদের নেই।

ওডিসিয়াস তখন বললেন, আচ্ছা বলত, মিত্রশক্তির লোকেরা কি ট্রয়সৈন্যদের মধ্যেই একসঙ্গে ঘুমুচ্ছে না তারা পৃথকভাবে শুয়ে আছে। এটা আমাকে খুলে বল।

ডোলন উত্তর করল আমি তোমাদের সব সত্য কথাই বলব। সমুদ্রের দিকে শুয়ে আছে কারিয়া ও পীগুনের তীরন্দাজরা। আছে লেনিজেস, ককোলিয়া ও পেলামগির অধিবাসীরা। লাইসিয়া, মাইসিয়া, ফার্জিয়া ও মীওনিয়ার সৈন্যদর আছে থাম্রার দিকে। কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তোমরা কি ট্রয়শিবিরে প্রবেশ করতে চাও? তাহলে থ্রোসিয়ার সেনাদল যেদিকে আছে সেইদিকে যাবে। রা ট্রয়সৈন্যদের থেকে পৃথক আছে। ওরা সম্প্রতি এখানে এসেছে। ওদের রাজা ইওনিয়াসের পরিবর্তে তার পুত্র রীসাস এসেছে ওদের সঙ্গে। রীসাসের ঘোড়ার মত সুন্দর ঘোড়া তুমি জীবনে কখনো কোথাও দেখ নি। সেগুলো দেখতে বরফের থেকেও সাদা আর বাতাসের থেকেও দ্রুতগামী। রীসাসের রথ সোনা আর রূপো দিয়ে মোড়া। আর সোনার বর্ম অপরূপ কারুকার্যে খচিত যা কোন মানুষের দেহেও দেখা যায় না, যা একমাত্র দেবতাদের দেহেই শোভা পায়। এখন আমাকে হয় তোমাদের জাহাজে নিয়ে চল অথবা এখানেই বেঁধে রাখ। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি সেইভাবেই থাকব। তোমরা আমার কথা সব সত্য কি না পরীক্ষা করে দেখবে। ডায়োমেডিস তখন বললেন তুমি মনে ভেবো না ডোলন যে এই সব সত্য সংবাদ আমাদের দান করার জন্য তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে। কারণ যদি আমরা তোমায় কোন উপঢৌকন নিয়ে মুক্তি অথবা এমনিই ছেড়ে দিই, তাহলে তুমি আবার গুপ্তচর অথবা প্রকাশ্য শত্রুরূপে গ্রীকদের জাহাজে আসবে। কিন্তু যদি তোমাকে হত্যা করি তাহলে আর কখনো কোনদিন আসতে পারবে না তুমি।

এই কথা বলে ডায়োমেডিস তার তরবারি দিয়ে ডোলনের দাড়ি ধরে তার গলাটি কেটে ফেললেন। তার মুণ্ডটা মাটিতে পড়ে গেলে তখন তারা তাঁর মাথার টুপি, নেকড়ের চামড়ার গাত্রাবরণ, ধনুর্বাণ ও হাতের বর্শা সব নিয়ে নিলেন। ওসিডি তখন সেগুলো উঁচুতে ঝুলিয়ে লুণ্ঠনের দেবী এথেনের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, আমাদের এই উৎসর্গ গ্রহণ করো দেবী, অলিম্পাসের অন্য কোন দেবতাকে তা না দিয়ে এগুলো তোমাকেই দিচ্ছি। এবার আমরা ঘুমন্ত থ্রেসীয় সেনাদের দিকে ধাবিত হব।

এই কথা বলে ওডিসিয়াস সেগুলো একটি তেঁতুলগাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলেন। তারা যখন শত্রুশিবির হতে অন্ধকারে ফিরে আসবেন তখন এগুলো নিশানা হিসেবে কাজ করবে। তারা এরপর অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়লেন। পরিত্যক্ত বর্ম আর রক্তাক্ত মৃতদেহের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চললেন তাঁরা। অবশেষে তারা গ্রেসী শিবিরে গিয়ে দেখলেন, তারা সকলে সারাদিনের ক্লান্তির পর অকাতরে ঘুমোচ্ছে। সৈন্যদের পাশে পাশে তাদের আপন আপন অশ্বগুলো বাঁধা আছে আর বর্মগুলো এক জায়গায় তিনটি সারিতে সাজানো আছে। তাদের মাঝখানে শুয়ে ছিলেন যুবরাজ রীসাস। তাঁর সুন্দর রথের সাথে অশ্বগুলো বাঁধা ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে ওডিসিয়াস বললেন, এই অশ্বগুলোর কথাই ডোলন আমাদের বলেছিল। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকো না ডায়োমিডিস, হয় অশ্বগুলোর বাঁধন খুলে দিয়ে তাদের নিয়ে যাও অথবা লোকগুলোকে হত্যা করো।

দেবী এথেন শক্তি সঞ্চার করলেন ডায়োমেডিস-এর অন্তরে। তখন দুধারে ঘুমন্ত শত্রুসৈন্যদের একের পর এক হত্যা করে যেতে লাগলেন ডায়োমেডিস। এইভাবে বারোজন ঘুমন্ত শত্রুসেনাকে হত্যা করলেন। ওডিসিয়াস সঙ্গে সঙ্গে তাদের অশ্বগুলোর বাঁধন খুলে দিয়ে তাদের একজায়গায় বেঁধে রাখলেন। অবশেষে ডায়োমেডিস যুবরাজ রীসাসের নিকট এলেন। তখনো ঘুমোচ্ছিলেন রীসাস আর সেই ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাকে হত্যা করলেন ডায়োমেডিস। মনে হলো সহসা এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠলেন রীসাস। এই নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল তের। ওডিসিয়াস তখন ঘোড়াগুলোকে একজায়গায় বেঁধে তাঁর হাতের ধনুক দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি একটি বাঁশী বাজিয়ে ডায়োমেডিসকে যাবার জন্য সঙ্কেত দান করলেন।

কিন্তু ডায়োমেডিস তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি কি করবেন ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি রীসাসের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রসমেত গোটা রথটাই নিয়ে যাবেন না আরও গ্রেসীয় সৈন্য হত্যা করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। এইভাবে তিনি যখন ইতস্তত করছিলেন তখন এথেন তাঁর সামনে এসে সতর্ক করে দিলেন তাঁকে। বললেন, ফিরে যাও ডায়োমেডিস, এর বেশি কিছু করতে গেলে অন্য কোন দেবতা দেখে ফেলে ট্রয়সৈন্যদের জাগিয়ে দেবে।

দেবী এথেনের কথায় চৈতন্য হলো ডায়োমেডিস-এর। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে বসলেন আর ওডিসিয়াস সেটিকে তাড়িতে দিলেন। তারা দুজনেই তখন গ্রীক জাহাজগুলোর দিকে দ্রুত রওনা হলেন।

এথেন যখন ডায়োমেডিস-এর সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন অ্যাপোলো তাঁকে দেখতে পেয়ে রেগে যান। তিনি তৎক্ষণাৎ থ্রেসীয় শিবিরে গিয়ে হিপ্পোকুন নামে একজন গ্রেসীয় ও রীসাসের আত্মীয়কে জানান। হিপ্পোকুন চমকে জেগে ওঠে দেখলেন, তাদের ঘোড়াগুলো নেই এবং অনেক গ্রেসীয় সৈন্য মৃত্যুযন্ত্রণায় হাপাচ্ছে। তা দেখে চিৎকার করে উঠলেন হিপ্পোকুন। আর সেই চিৎকার শুনে ট্রয়সৈন্যরা জেগে হৈ চৈ ও ছোটাছুটি করতে লাগল। কিভাবে গ্রীকবীরেরা তাদের শিবিরে এসে এত ক্ষয়ক্ষতি করে দিয়ে গেল ভাবতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল তারা।

ডোলনকে যেখানে হত্যা করেছিল ঠিক সেইখানে এসে একবার ঘোড়া থেকে নেমে তার রক্তাক্ত অস্ত্রগুলো তুলে নিলেন গ্রীকবীররা। তারপর আবার ঘোড়ায় চড়ে গ্রীকশিবির অভিমুখে রওনা হলেন তারা। তাদের অশ্বক্ষুরধ্বনি প্রথম শুনতে পেলেন নেস্টর। তিনি বললেন, আমি বেশ বুঝতে পারছি এ অশ্ব ডায়োমেডিস ও ওডিসিয়াসের। ট্রয়বাসীদের কাছ থেকে কেড়ে এনেছেন। আবার ভয়ও হচ্ছে, তাদের যদি কোন ক্ষতি হয় শত্রুদের হাতে।

নেস্টরের কথা শেষ হতে না হতেই সেখানে গিয়ে অশ্ব হতে হতে অবতরণ করলেন ডায়োমেডিস ও ওডিসিয়াস। অন্যান্য গ্রীকবীরেরা তখন আনন্দে করমর্দন করল তাদের সঙ্গে। নেস্টর প্রথমে কথা বললেন, বল ওডিসিয়াস, কি করে তোমরা এই অশ্বগুলো লাভ করলে? তোমরা কি এগুলো ট্রয়শিবির হতে অপহরণ করে এনেছ অথবা কোন দেবতা তোমাদের পথে দেখতে পেয়ে দান করেছেন? সূর্যরশ্মিসন্নিভ এদের তেজ। আমি ট্রয়বাসীদের সবকিছু জানি, আমি একজন বয়োপ্রবীণ যোদ্ধা কিন্তু এসব অশ্ব কোথায়ও কখনো দেখি নি। যেহেতু তোমরা দুজনেই জিয়াস ও এথেনের প্রিয়, নিশ্চয় কোন দেবতা তোমাদের দান করেছেন এ অশ্ব।

ওডিসিয়াস বললেন, হে গ্রীকগৌরব নেলেউসপুত্র নেস্টর, দেবতারা এর থেকে অনেক ভাল অশ্ব দান করতে পারতেন, কারণ তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালী। কিন্তু যে অশ্বের কথা আপনি জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে তা ফ্রেশ দেশ হতে সম্প্রতি এসেছে। ডায়োমেডিস থ্রেসীয় যুবরাজ সমেত বারোজন থ্রেসীয় সৈন্যকে হত্যা করে। এছাড়া হেক্টর প্রেরিত একজন গুপ্তচরকে পথে হত্যা করি আমরা।

এই কথা বলতে বলতে হাসিমুখে পরিখা পার করে অশ্বগুলো ডায়োমেডিস-এর শিবিরে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রেখে দিলেন ওডিসিয়াস। অন্যান্য গ্রীকরা সাহায্য করল তাঁকে। অশ্বগুলো শস্য খেতে লাগল। ওডিসিয়াস তখন ডোলনের অস্ত্রগুলো তার জাহাজে ঝুলিয়ে রেখে দিলেন দেবী এথেনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গস্বরূপ। তারপর দুজনে পবিত্র তেল মেখে সমুদ্রে স্নান করতে গেলেন। ফিরে এসে এথেনকে উৎসর্গ করে মদ্য পান করতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *