০৬. ডায়োমেডিস-এর কৃতিত্ব ॥ হেক্টর ও অ্যান্ড্রোমেকের মিলন

ষষ্ঠ পর্ব
ডায়োমেডিস-এর কৃতিত্ব ॥ হেক্টর ও
অ্যান্ড্রোমেকের মিলন

যুদ্ধ তেমনই চলতে লাগল। সাইময় ও জ্যানথাস নদীর তীরবর্তী বিশাল রণপ্রান্তরে বিরামহীন যুদ্ধের পরস্পরবিরুদ্ধ দুটি বিক্ষুব্ধ স্রোত ইতস্তত প্রবাহিত হতে লাগল।

প্রথমে গ্রীকশক্তির স্তম্ভস্বরূপ তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স শত্রুপক্ষের এক শক্তিস্তম্ভকে ভেঙ্গে ফেললেন। তিনি গ্রেসীয় বীর ইউসোয়াসপুত্র অ্যাকামাসকে নিহত করলেন। অ্যাকামাস ছিলেন যেমন সাহসী বীর তেমনি বলিষ্ঠ ও বিশালাকার। তার শিরস্ত্রাণের অগ্রভাগ ভেদ করে তার তার ললাটদেশ বিদ্ধ করে অ্যাজাক্সের বর্শা।

তারপর ডায়োমেডিস হত্যা করলে টিউথ্রাসের পুত্র অ্যাকসাইলাসকে। অ্যারিমতে নগরের অধিবাসী অ্যাকসাইলাস ছিলেন প্রভূত পরিমাণ ধনসম্পদের অধিকারী। তিনি ছিলেন যেমন অতিথবৎসল তেমনি জনপ্রিয়। পথের ধারে তার একটি বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি যেকোন পথিককে আহ্বান ও আপ্যায়িত করে তুষ্ট করতেন তাকে। কিন্তু আজ সেই অতিথিবৎসল পরোপকারী অ্যাকসাইলাস যখন ডায়োমেডিস-এর অব্যর্থ বর্শার আঘাতে ধরাশায়ী হলেন তখন কিন্তু কেউ তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল না। অ্যাকসাইলাসের সারথি ক্যালেসিয়াসকেও বধ করলেন ডায়োমেডিস।

ড্রেমাস ও ওথেনটিয়াসকে হত্যা করার পর ইউরিয়ালাস এসেপাস ও পেদাসাসের সন্ধানে বেগে ধাবিত হলেন। এসেপাস ও পেদাসাস ছিলেন মহান ধার্মিক ও বুকলিয়নের যমজ পুত্র। একবার বুকলিয়ন যখন মাঠে গোচারণক্ষেত্রে তাঁর ভেড়া চরাচ্ছিলেন তখন জলপরীর সঙ্গে তাঁর হঠাৎ দেখা হয়। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তারা এবং তাঁদের সেইখানে সেইক্ষণে দেহমিলন ঘটে। যথাসময়ে দুটি যমজ সন্তান প্রসব করেন সেই সুন্দরী অলরা! আজ সেই সন্তানদ্বয় নিহত হলো মেসিসটিরয়াসপুত্র ইউরিয়ালসের হাতে। এরপর পলিপীটেস হত্যা করলেন অ্যাসটিয়ালাসকে। ওডিসিয়াস হত্যা করলেন পাক্যোটের পিডাইটেসকে এবং টিউসারের দ্বারা নিহত হতেন আরেতাওন। নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকাসের বর্শার আঘাতে নিহত হলেন অ্যালতেরাস। সালনিও নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসী ইলেটাসকে হত্যা করলেন রাজা অ্যাগামেমনন। ধাবমান ফাইলেকাসকে হত্যা করেন লীটাস এবং মেলানথাসকে হত্যা করেন ইউরিপাইলাস।

মেনেলাস ট্রয়বীর অ্যাড্রেস্তাসকে জীবন্ত বন্দী করলেন। রণক্ষেত্রের উপর দিয়ে তার রথের উপর চড়ে যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি তখন সহসা তাঁর রথটি ভেঙ্গে যায়, রথের অশ্বগুলো পালিয়ে যায় আর তখন মাটিতে পড়ে যান অ্যাড্রেস্তাস। মেনেলাস তখন তাঁর কাছে বর্শা হাতে ছুটে যেতে তাঁর কাছে কাতর কণ্ঠে জীবনভিক্ষা করেন অ্যাড্রেস্তাস। তিনি বলেন, আমাকে জীবন্ত বন্দী করো আত্রেউসপুত্র। আমার পিতা ধনী। আমি তোমাকে অনেক উপঢৌকন দেব। যদি তুমি আমাকে বন্দী করে তোমাদের জাহাজে রেখে দাও আর সেই কথা আমার পিতা শুনতে পান তাহলে তিনি তার ধনভাণ্ডার হতে বহু স্বর্ণ ও মূল্যবান ধাতু উপঢৌকন দেবেন তোমায়।

তার কথায় সম্মত হয়ে মেনেলাস তাঁর জনৈক সহকারীর হাতে অ্যাড্রেস্তাসকে অর্পণ করে তাঁকে তাদের জাহাজে নিয়ে যাবার আদেশ দান করেছিলেন। কিন্তু সহসা সেখানে অ্যাগামেমনন এসে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন মেনেলাসকে। তিনি বললেন, হে আমার প্রিয় মেনেলাস, তুমি কি তাহলে ট্রয়বাসীদের ধনরত্নে ঘর সাজাতে চাও তোমার? তাদের একজনকেও ছাড়া উচিত নয়। এমন কি মাতৃগর্ভের কোন অজাত শিশুকেও বাদ দেওয়া হবে না। সমস্ত ইলিয়ামবাসীকে নিঃশেষে হত্যা করতে হবে, তাদের একজনকেও বাঁচিয়ে রাখা চলবে না।

অ্যাগামেমননের ন্যায়সঙ্গত যুক্তি অস্বীকার করতে পারলেন না মেনেলাস। মেনেলাস তখন তাঁর বন্দীকে অ্যাগামেমননের হাতে অর্পণ করতেই তার হাতের বর্শাটি অ্যাগামেমনন আমূল বসিয়ে দিলেন অ্যাস্তোসের বুকে। অ্যাড্রেস্তাস মাটিতে পড়ে যেতে তার বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই বর্শাটি উৎপাটিত করলেন।

নেস্টর তখন চিৎকার করে গ্রীকদের বললেন, বন্ধুগণ ও গ্রীক যোদ্ধাগণ, এখন শুধু শত্রুদের হত্যা করে যাও, তাদের কোন মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করতে যেও না। পরে যা হয় হবে। শুধু অকাতরে হত্যা করে যাও।

এই কথা বলে নেস্টর গ্রীকদের এমনভাবে উত্তেজিত করতে লাগলেন যে তারা ট্রয়বাসীদের বিতাড়িত করে ইলিয়াম নগরীর অভ্যন্তরে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য করতে পারত। কিন্তু বিজ্ঞ মেনেলাস প্রিয়মপুত্র হেক্টর ও ঈনিসকে সম্বোধন করে বললেন, হে বীর হেক্টর ও ঈনিস, তোমরা দুজনেই হচ্ছ ট্রয় ও লাইসিয়াবাসীদের একমাত্র আশা ও ভরসা। তোমরা যেমন যুদ্ধে পারদর্শী তেমনি বিজ্ঞ ও সুবিবেচক। তোমরা প্রথমে ছিন্নভিন্ন ট্রয়সৈন্যদের সমবেত করে নতুন উদ্যাম যুদ্ধ শুরু করার জন্য তাদের অনুরোধ করগে। তাদের মধ্যে উপযুক্ত সাহস ও উৎসাহের সঞ্চার করার পর তোমরা চলে যাবে নগর অভ্যন্তরে। তোমাদের মাতাকে যা যা ঘটেছে সব বলবে। আরও বলবে তিনি যেন দেবী এথেনের মন্দিরের চাবি খুলে দিয়ে ইলিয়াম নগরীর সমস্ত পুরনারীদের একত্রিত করে প্রার্থনা করেন দেবী এথেনের কাছে। তারপর তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় পোশাকটি যেন এথেনের জানুর উপর ছুঁইয়ে নেন। দেবী এথেন যদি দয়াপরবশ হয়ে আমাদের ইলিয়াম নগরীর নারী ও শিশুদের রক্ষা করার জন্য টাইডেউসপুত্রকে আপাতত আক্রমণাত্মক অভিযানপ্রবণতা থেকে বিরত করেন তাহলে আমরা খুবই উপকৃত হই। কারণ এখন আমাদের একমাত্র ভয় টাইডেউসপত্র ডায়োমেডিসকে। আমার মতে গ্রীকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হলেন ডায়োমেডিস। কোন এক দেবমাতার গর্ভপ্রসূত অ্যাকেলিসের থেকেও তিনি শক্তিশালী। তাঁর ক্রোধের কোন সীমা নেই, তেমনি শক্তিরও তুলনা নেই।

মেনেলাসের কথামত কাজ করার মানসে রথ হতে অবতরণ করে ট্রয়বাসীদের মাঝে গিয়ে তাদের যুদ্ধে নতুন করে প্রবৃত্ত করার জন্য প্ররোচিত করতে লাগলেন হেক্টর। তাঁর উৎসাহব্যঞ্জত বাক্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন উদ্যামে ঐক্যবদ্ধ ও সমবেত হলো ট্রয়সৈন্যরা এবং তাদের এই অত্যুৎসাহী ভাব দেখে তাদের আক্রমণাত্মক অভিযান থেকে কিছুক্ষণের জন্য বিরত হলো গ্রীকসৈন্যরা। তারা ভাবল হয়ত কোন দেবতা আবার স্বর্গ থেকে নেমে এসে যুদ্ধে উৎসাহ দান করেছেন ট্রয়বাসীদের। হেক্টর ট্রয়সৈন্যদের সম্বোধন করে আবার বললেন, হে আমার বন্ধু ও প্রিয় সহকর্মিগণ, অক্লান্ত ও নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করো তোমরা। ইতিমধ্যে আমি ইলিয়াম নগরীর অভ্যন্তরে গিয়ে আমাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও পূজা ও উপাসনার জন্য অনুরোধ করিগে।

এই বলে সশব্দে চলে যেতেই টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস ও হিল্লোলোকাসপুত্র গ্লাকাস একক যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন দুজনে। তারা দুজনে পরপরের নিকটবতী হলে ডায়োমেডিস তার প্রতিপক্ষকে সম্বোধন করে বললেন, কে তুমি হে বীর মহাশয়? তোমাকে এর আগে তো কখনো এ যুদ্ধক্ষেত্রে দেখি নি। যাই হোক, যদি তুমি আমার আক্রমণ সহ্য করতে পার তাহলে সত্যিই তুমি সাহসী বীররূপে আখ্যাত হবে। তবে সাধারণত আমার হাত থেকে কেউ পরিত্রাণ পায় না এবং আমার হতভাগ্য প্রতিপক্ষদের পিতাদের প্রায়ই শোকাশ্রু বর্ষণ করতে হয়। তবে যদি তুমি স্বর্গ হতে আগত কোন দেবতা হও তাহলে আমি যুদ্ধ করব না তোমার সঙ্গে, কারণ ড্রায়াসপুত্র বীর লাইকৰ্গসও দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেশিদিন বাঁচতে পারেন নি। একবার গো তাড়নের পাঁচন দিয়ে লাইকৰ্গস দেবতা ডাইওনিসাসের সেবিকাদের প্রহার করেন। লাইকৰ্গসের প্রচণ্ড মূর্তি দেখে ভয়ে ডাইওনিসাস সমুদ্রগর্ভে চলে যান। সেখানে জলদেবী থেটিস তাঁকে বক্ষে ধারণ করে সান্ত্বনা দান করেন। মানবসন্তান লাইকৰ্গসের এই স্পর্ধা দেখে ক্রুদ্ধ হন ডাইওনিসাস। একথা দেবতারা শূনে লাইকৰ্গসের প্রতি সকলেই ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং দেবরাজ জিয়াস তাঁকে অন্ধ করে দেন। সকল দেবতাদের ক্রোধের কারণ হয়ে আর বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেননি লাইকৰ্গস। তবে তুমি মর্তবাসী মৃত্তিকাজাত ফলভক্ষণকারী হও তাহলে কাছে এস, তোমার শোচনীয় পরিণাম ভোগ করো।

হিপ্পোলোকাসপুত্র তখন উত্তর করলেন, হে বীর টাইডেউসপুত্র, কেন তুমি আমায় আমার বংশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করছ? স্বল্পজীবী বৃক্ষপাত্রের মত বৎসরের পর বৎসর এই পৃথিবীতে মানুষ আসে আর যায়। শীতকালে সব পাতা ঝরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বসস্ত নতুন কিশলয়ে ভরে দেয় সব শূন্যবৃন্তগুলোকে। মানবজাতির মধ্যে দেখবে প্রবীণরা বিদায় নেয় আর নতুনরা এসে তাদের স্থান গ্রহণ করে। ঠিক আছে, শোন তবে আমার তার নাম ঈফাইয়া। সেখানে বাস করতেন মানবজাতির মধ্যে চাতুর্যে সুপ্রসিদ্ধ সিসিফাস। তিনি ছিলেন ঈওলাসের পুত্র এবং তার গ্লুকাস নামে এক পুত্র ছিল। এই

কাসের আবার লোবোফোন নামে এক পুত্র ছিল যিনি দৈবানুগ্রহে অনন্ত সৌন্দর্যে ভূষিত হন। কিন্তু তার চেয়ে শক্তিশালী প্রীটাস তাঁকে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করেন। একবার পীটাসপত্নী অ্যান্টিয়া সুদর্শন বেলারোফোনের প্রেমে পড়ে তাঁর সঙ্গম প্রার্থনা করেন। কিন্তু বেলারোফোন ছিলেন সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। তিনি অ্যান্টিয়ার কুৎসিত প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। আর তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে অ্যান্টিয়া প্রীটাসের কাছে মিথ্যা কথা বলে তাঁর মনকে বিষাক্ত করে তুললেন বেলারোফোনের প্রতি। তিনি বললেন, শোন প্রীটাস, হয় তুমি বেলারোফোনকে হত্যা করো, তা না হলে নিজে মৃত্যু বরণ করো, কারণ সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার সঙ্গে প্রেমালাপ করতে চেয়েছে। একথায় অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন রাজা প্রীটাস। কিন্তু হত্যা করলেন না তিনি বেলারোফোনকে। তিনি কৌশলে একখানা চিঠি লিখে লাইসিয়ার রাজা তার শ্বশুরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন তাঁকে। সে চিঠিতে লেখা ছিল রাজা যেন কৌশলে বেলারোফোনকে হত্যা করেন।

দেবতাদের কৃপায় বেলারোফোনের যাত্রা শুভ হলো। লাইসিয়ার উপকণ্ঠে ক্যানথাস নদীর সমীপবর্তী হবার সঙ্গে সঙ্গে লাসিয়ারাজ সাদর অভ্যর্থনা জানালেন বেলারোফোনকে। তাঁর সম্মানার্থে নয় দিন ধরে নয়টি বকনা কেটে ভোজসভার আয়োজন করা হলো। দশম দিনে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রীটাস প্রেরিত পত্রখানি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন লাইসিয়ারাজ। সে পত্র পাঠ করার পর সিমেরা নাম্নী এক অদ্ভুতদর্শনা রাক্ষসীকে বধ করার জন্য বেলারোফোনকে আদেশ দান করেন লাইসিয়ারাজ। মানবী বা দেবী তা কিছুই বোঝা যেত না সিমেরাকে দেখে। তার মাথাটা ছিল সিংহের মত, দেহটা ছিল ছাগলের মত আর তার পশ্চাদভাগে ছিল সাপের মত লেজ; মুখ থেকে প্রতিনিয়ত আগুন উদগীরণ করত সিমেরা। দেবতাদের নির্দেশ অনুসরণ করে কৌশলে সিমেরাকে বধ করলেন বেলারোফোন। এরপর তিনি যুদ্ধে অজেয় প্রসিদ্ধ বীর সলিমির সঙ্গে যুদ্ধ করেন। পরে তিনি ভয়াবহ আমাজান নারীদের হত্যা করেন। এরপরও লাইসিয়ারাজ গোপনে বেলারোফোনকে হত্যা করার জন্য লাইসিয়ার সুনির্বাচিত যোদ্ধাদের নিযুক্ত করেন। কিন্তু বেলারোফোন তাদের প্রত্যেককে হত্যা করেন। অবশেষে লাইসিয়ারাজ বুঝতে পারলেন বেলারোফোন নিশ্চয়ই মানববেশী কোন দেবসন্তান এবং দৈব আশীর্বাদ ধন্য। একথা ভেবে তিনি তখন আপনকন্যাকে দান করলেন বেলারোফোনের হাতে এবং তাকে বসবাসের জন্য এক সমৃদ্ধ রাজ্য দান করলেন।

লাইসিরাজের কন্যা বেলারোফোনের ঔরসে তিনটি সন্তান গর্ভে ধারণ করেন। তাঁরা হলেন ইসান্ডার, হিপ্পোলোকাস ও লাওডামিয়া নামে এক কন্যা সন্তান। দেবরাজ একবার লাওডামিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে তার গর্ভে সার্পেডন নামে এক পুত্র উৎপন্ন করেন। পরে কোন কারণে দেবতারা বেলারোফোনকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকেন এবং রণদেবতা অ্যারেস তাঁর পুত্র ইসান্ডারকে হত্যা করেন। দেবী আর্তেমিসের হাতে নিহত হয় তাঁর কন্যা। আমার পিতা হচ্ছেন হিপ্পোলোকাস। তিনি যখন আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেন বীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করি এবং নিজে বীরত্ব অর্জন করি। আমি যেন আমার বংশের পবিত্র রক্তকে কলঙ্কিত না করি। এই হল আমার বংশপরিচয়। আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ইফাইয়া ও লাইসিয়ার সুপ্রসিদ্ধ জননায়ক।

হিপ্পোলোকাসপুত্র গ্লকাসের একথা শুনে আনন্দিত হলো ডায়োমেডিস-এর অন্তর। ভূমিপরে হস্তধৃত বর্শাটি স্থাপন করে বন্ধুত্বসুলভ সহৃদয়তার সঙ্গে বললেন, তাহলে তুমি আমার পিতৃকূলের এক পুরাতন বন্ধুর সন্তান। আমাদের পূর্বপুরুষ আমার পিতামহ মহান এনেউস একবার তোমার পিতামহ বেলারোফোনকে কুড়ি দিন ধরে আপ্যায়িত করেছিলেন নিজ গৃহে। তারা বন্ধুভাবে উপহার বিনিময় করেছিলেন পরস্পরের মধ্যে। আমার পিতা টাইডেউসের কথা আমার স্মরণ হয় না, কারণ আমার যখন শৈশব অবস্থা তখন তিনি থীবস যুদ্ধে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। একবার আমার পিতামহ এনেউস বেলারোফোনকে এক নীলকান্তমণিসমন্বিত কটিবন্ধনী উপহার দেন আর বেলারোফোন এনেউসকে দেন এক আশ্চর্য দ্বিমুখী পানপাত্র। সেই থেকে আমাদের আর্গসে যেমন বহু ট্রয়জাতির লোক বাস করে তেমনি তোমাদের লাইসিয়াতে বাস করে বহু গ্রীক। সুতরাং এখন পরস্পর যুদ্ধ না করে এস বন্ধুত্ব ও বর্ম বিনিময় করি। যাতে আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা উপস্থিত অন্যান্য সকলে জানতে পারে।

ডায়োমেডিস-এর কথা শেষ হতেই রথ হতে দুজনেই অবতরণ করে পরস্পরের হস্ত ধারণ করে সখ্যতা স্থাপন করলেন। কিন্তু দেবরাজ জিয়াসের ইচ্ছায় সমায়িকভাবে বুদ্ধিভ্রংশ ঘটল গ্লুকাসের যার ফলে তিনি ডায়োমেডিস-এর বোঞ্জনির্মিত বর্মের বিনিময়ে আপন সুবর্ণনির্মিত বর্ম দান করলেন। তার সুবর্ণ বর্মের মূল্য একশত পশুর মূল্যের সমান; কিন্তু ব্রোঞ্জের মূল্য মাত্র নয়টি পশুর মূল্যের সমান।

ট্রয়নগরীর তোরণদ্বার-পথে একটি ওকগাছের তলায় হেক্টর উপস্থিত হলে তখন তাঁকে দেখতে পেয়ে অসংখ্য ট্রয়রমণী ছুটে এল তাদের আপন আপন যুদ্ধরত আত্মীয়বর্গের কুশলবার্তা জানার জন্য। হেক্টর তাদের সকলকে মন্দিরে প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাদের অনেকেই প্রিয়জনকে হারিয়ে শোক প্রকাশ করতে লাগল।

এরপর রাজা প্রিয়ামের অনন্ত ঐশ্বর্যমণ্ডিত বিশাল প্রাসাদ অভ্যন্তরে গিয়ে প্রবেশ করলেন হেক্টর। সুমসৃণ প্রস্তরস্তম্ভনির্মিত এই বিশাল প্রাসাদের কুড়িটি শয়নকক্ষ নির্দিষ্ট ছিল প্রিয়ামের কুড়িটি পুত্রের জন্য যেখানে তারা আপন আপন ধর্মপত্নীদের অঙ্কশায়িনী করে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতেন। সেই শয়নকক্ষগুলোর বিপরীত দিকে অর্থাৎ প্রাসাদের অন্তর্গত বিস্তৃত অঙ্গনের অপর পারে দ্বিতলে ছিল আরও দ্বাদশটি শয়নকক্ষ যেখানে রাজা প্রিয়ামের দ্বাদশটি কন্যা তাদের আপন আপন স্বামীসহ নিদ্রাসুখ উপভোগ করতেন। হেক্টর সেখানে যেতেই তার মা ও তাঁর ভগিনী সুন্দর লাওডিসকে সঙ্গে নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন। হেক্টরের একটি হাত আপন হাতে নিয়ে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র। কেন তুমি যুদ্ধক্ষেত্র হতে এখানে এসেছ? দুষ্ট গ্রীকদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে তুমি কি নগর মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছ? তুমি কি এখন দুর্গ হতে দেবরাজ জিয়াসের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করবে? ক্ষণকাল অপেক্ষা করো, আমি মদ্য নিয়ে আসি। সেই মদ্য প্রথমে জিয়াস ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে পরে তুমি পান করে সুস্থ হবে। মদ্য ক্লান্ত ও অবসন্ন মানুষের ক্লান্তি অপমোনদন করে। তুমি এখন তোমার সমগ্র জাতির পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছ।

হেক্টর তখন উত্তর করেলেন, হে মাতঃ, মদ্যে আমার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এ সময়ে মদ্য পান করলে শক্তি হারিয়ে ফেলব আমি। তাছাড়া আমার হাত এখন অপরিস্কৃত। এই অপবিত্র হাতে আমি দেবরাজ জিয়াসকে কখনো মদ্য উৎসর্গ করতে পারি না। রক্ত ও ময়লা লেগে আছে যার সারা দেহে সে কখনো জিয়াসের নিকট প্রার্থনা করতে পারে না। তুমি এখন পুরনারীদের সমবেত করো। তারা এথেনের প্রতিমূর্তির জানুর উপর তোমাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় ও মূল্যবান পোশাক স্থাপন করবে। সেই সঙ্গে বারোটি কচি বকনা বলি দেবারও প্রতিশ্রুতি দেবে। দেবী এথেনের কাছে প্রার্থনা করবে তিনি যেন অসংখ্য নারী ও শিশুসহ এই ইলিয়াম নগরীর উপর দয়া করেন। তোমরা মন্দিরে যাও আর আমি প্যারিসের কাছে গিয়ে থাকে কিছু নীতি উপদেশ দিই। দেখি সে আমার কথা শোনে কি না। রাজা প্রিয়াম আর তাঁর পুত্রদের ধ্বংসের জন্যই দেবরাজ জিয়াস সৃষ্টি করেছিলেন প্যারিসকে। ধরিত্রীমাতা যদি মুখ ব্যাদান করে তাকে গ্রাস করত এবং সে যদি নরকের গহ্বরে পতিত হত তাহলে আমি আমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে পারতাম।

হেক্টরের মাতা রাণী হেকুবা প্রথমে অন্তঃপুরে গিয়ে সব নারীদের ডাকলেন। সেই সব নারীরা নগরে অন্যান্য নারীদের একত্রিত করার জন্য বিভিন্ন দিকে যাত্রা করলেন। তারপর তাঁর ভাণ্ডারগৃহে গমন করলেন। সে কক্ষে সিডোনিয়াবাসিনী বহু রমণীর শ্রমসাধ্য সূক্ষ্মসুন্দর সূচীশিল্পে সমৃদ্ধ অনেক মূল্যবান পোশাক সংরক্ষিত ছিল। সমুদ্র যাত্রাকালে বিদেশ পরিভ্রমণরত অবস্থায় প্যারিস যখন রাণী হেলেনকে ট্রয়দেশে নিয়ে আসেন সেই সময়েই সিডোনিয়ার এই সব রমণীদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনি। এই সব রমণীরা সূচীশিল্পকর্মে সবিশেষ প্রসিদ্ধ। সর্বাপেক্ষা বড় এবং কারুকার্যখচিত যে পোশাকটি সিন্দুকের তলদেশে তারকার মত দীপ্তি দান করছিল সেটিকে বার করে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে চলে গেলেন রাণী হেকুবা।

ট্রয়রমণীরা এথেনের মন্দিরদ্বারে সমবেত হতেই মন্দিরদ্বার খুলে দিলেন পূজারিণী থীয়ানো। অ্যান্টিনরের পত্নী ও পিসিয়াসের কন্যা থীয়ানোকে ট্রয়বাসীরা এথেনের মন্দিরের দেবদাসী ও পূজারিণী নিযুক্ত করে। নারীরা সকলে হাত তুলে চিৎকার করে দেবীর বন্দনা করল। তাদের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ পোশাকগুলোকে নিয়ে থীয়ানো দেবীর মূর্তির জানুর উপর স্থাপন করল। তারপর দেবীর উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, হে নগররক্ষাকারিণী দেবী, দয়া করে আমাদের রক্ষা করো, ডায়োমেডিস-এর উদ্ধত বর্শা ভেঙ্গে খণ্ড বিখণ্ড করে দাও, আমাদের নগরদ্বারের সম্মুখে ভূপাতিত করো তাকে। আমরা তোমাকে দ্বাদশটি গোবৎস উৎসর্গ করব যথাসময়ে। তুমি আমাদের নারী ও শিশুদের উপর প্রসন্ন হও, দয়া করো।

থীয়ানোর এই প্রার্থনা কিন্তু মঞ্জুর করলেন না দেবী এথেন।

ট্রয়রমণীরা যখন এথেনের মন্দিরে প্রার্থনায় রত ছিল, হেক্টর তখন সোজা চলে গেলেন প্যারিসের বাসগৃহে। রাজা প্রিয়াম আর হেক্টরের ঘরের মাঝখানে ছিল প্যারিসের ঘর। একটি দীর্ঘ বর্শা হাতে হেক্টর প্রবেশ করলেন সে ঘরে। হেক্টরের বর্শার সুতীক্ষ্ণ ফলকটি ব্রোঞ্জনির্মিত দণ্ডের সঙ্গে একটি সোনার আংটা দিয়ে সংযুক্ত ছিল। প্যারিসের ঘরের দ্বারদেশে গিয়ে হেক্টর দেখলেন প্যারিস তার বর্শা, ধনুর্বাণ প্রভৃতি অস্ত্রসজ্জার কাজে ব্যস্ত আর তার কাছে বসে গ্রীকললনা হেলেন তার সহচরীদের বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দান করছে। প্যারিসকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভর্ৎসনার সুরে হেক্টর বললেন, এই নগরপ্রাচীরের বহির্ভাগে তোমারই দেশে জনগণ যখন যুদ্ধ করে প্রাণবলি দিচ্ছে, তখন যে মনোভাব পোষণ করে ঘরের মধ্যে বসে আছ সে মনোভাব সত্যিই অন্যায়। যুদ্ধ হতে বিরত হয়ে এভাবে কোন সৈনিককে বসে থাকতে দেখলে তুমি নিজেই তাকে ভর্ৎসনা করতে। ওঠ, যুদ্ধে চল, তা নাহলে সমগ্র নগর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে অবিলম্বে।

আলেকজান্দ্রাস উত্তর করলেন, হেক্টর, তোমার এই ভর্ৎসনা খুবই ন্যায়সঙ্গত। তবে শোন, ট্রয়বাসীদের প্রতি কোন হিংসার মনোভাব পোষণ করে বসে নেই এখানে আমি, অথবা অযথা কোন দুঃখকে প্রশ্রয় দিয়ে অলসভাবে বসে নেই। আমার স্ত্রীও আমাকে যুদ্ধে যাবার জন্যই প্ররোচিত করছেন। আর আমিও অবিলম্বে বর্ম ও অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে তোমার পূর্বেই উপস্থিত হব যুদ্ধক্ষেত্রে।

হেক্টর আর কোন কথা বললেন না। হেলেন তখন তাঁকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, হে ভ্রাতঃ, যেদিন আমার মা আমাকে এই পৃথিবীর ভূমিপরে প্রসব করেন সেদিন নিশ্চয় কোন দূর্ষিত ঘূর্ণিবায়ু নরকের অন্ধকার গর্ভ হতে আমার ঘৃণিত ও অধঃপতিত আত্মাকে নিয়ে আসে এই মর্ত্যলোকের মাটিতে। তারপর হয়ত কোন অরণ্যসঙ্কুল জনহীন পর্বতশিখরে অথবা কোন গর্জনশীল সমুদ্রতরঙ্গশীর্ষে কেউ লালন করে আমাকে। ক্রমে এক ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্যের দ্বারা তাড়িত হয়ে এখানে আনীত হই। আমি। কিন্তু আমার এই সব দুঃখ ও দুর্ভাগ্য নিশ্চয় দেবতাদের চক্রান্তের ফল। যদি এঁর থেকে যোগ্যতর কোন ব্যক্তির স্ত্রী হবার সৌভাগ্য হত আমার তাহলে তিনি নিশ্চয়ই এই ধরনের অপমান বা অপরের কটুবাক্য সহ্য করতেন না। আমার এই বর্তমান স্বামীর উপর কখনই নির্ভর করতে পারা যায় না আর উনিও ওঁর অপকর্মের প্রতিফল অবশ্যই পাবেন। কিন্তু সে যাই হোক, আপনি এই আসনে উপবেশন করুন। আমি জানি, আলেকজান্দ্রাস ও আমার ঘৃণ্য আত্মার দ্বারা কৃত সমস্ত পাপের বোঝা আপনাকেই বহন করতে হচ্ছে। হয়ত দেবরাজ জিয়াসের ইচ্ছানুসারে আমাদের দুজনের অবৈধ প্রণয়জনিত এই সব অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা পরিণত হবে এক অমর সঙ্গীতের বিষয়বস্তুরূপে এবং তা গীত হবে ভবিষ্যৎ মানুষের মুখে মুখে।

হেক্টর উত্তর করলেন, আমাকে বসতে বলো না হেলেন। আমার প্রতি তোমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি এখানে আর কালক্ষেপ করতে পারি না। ট্রয়সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য আমাকে দ্রুত ফিরে যেতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে। কারণ আমার ক্ষণকালীন অনুপস্থিতিও বিব্রত ও অসহায় বোধ করবে তারা। তোমার স্বামীকে বরং উপযুক্ত প্ররোচনার দ্বারা অবিলম্বে আমার পূর্বেই যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য করো। ইতিমধ্যে আমি একবার ঘরে গিয়ে আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব, কারণ, যুদ্ধে গ্রীকদের হাতে পতন ঘটবে কি না, আবার আমি ঘরে ফিরে আসব কি না জানি না আমি।

সেখান থেকে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন হেক্টর। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অ্যান্ড্রোমেককে দেখতে পেলেন না সে ঘরে। অ্যান্ড্রোমেক তখন তার শিশুপুত্রকে নিয়ে তাঁর সহচরীদের সঙ্গে দুর্গপ্রাকার হতে ক্রন্দররত অবস্থায় যুদ্ধদর্শন করছিলেন। অ্যান্ড্রোমেককে ঘরে দেখতে না পেয়ে তাঁর সহচরী ও পরিচারিকাদের ঘরের সামনে গিয়ে বললেন হেক্টর, অ্যান্ড্রোমেক কখন এ গৃহ ত্যাগ করেছে এবং সে কোথায় গেছে তা আমাকে বলতে পার কি তোমরা? সে কি আমার ভগিনী অথবা ভ্রাতৃবধূদের কাছে গেছে অথবা অন্যান্য ট্রয়ললনাদের সঙ্গে প্রার্থনা করতে গেছে এথেনের মন্দিরে।

তাঁর গৃহরক্ষিণী বলল, শুনুন বীর হেক্টর, আপনার স্ত্রী আপনার ভগিনী বা ভ্রাতৃবধূসহকারে যান নি, ভীষণা দেবী এথেনের মন্দিরেও যান নি তিনি প্রার্থনার জন্য। তিনি গেছেন ইলিয়াম নগরীর সুউচ্চ দুর্গপ্রাকারে। ধাত্রী গেছে তার শিশুপুত্রকে বহন করে। কারণ তিনি শুনেছেন গ্রীকগণ সংখ্যায় যেমন বিপুল, তেমনি ট্রয়বাসীদের থেকে বেশি শক্তিশালী। সেকথা শুনে তিনি উন্মাদিনীর মত ছুটে গেছেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি স্বচক্ষে লক্ষ্য করার মানসে।

আর কাল বিলম্ব না করে আপন কক্ষ হতে চলে গেলেন হেক্টর। যে পথে এসেছিলেন সেই নগরপথে গিয়ে নামতেই অ্যান্ড্রোমেক তাঁকে দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন তাঁর কাছে। প্লেকাস পর্বতের নিম্নদেশের গভীর অরণ্য অঞ্চলে অবস্থিত থীবস দেশের অধিপতি ঈশন ছিলেন অ্যান্ড্রোমেকের পিতা। সে অঞ্চলে মিনিসিয়া নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি বাস করত এবং ঈশন ছিলেন তাদের শাসনকর্তা। কালক্রমে ঈশনকন্যা অ্যান্ড্রোমেক ট্রয়বীর হেক্টরকে বিবাহ করে স্বামীগৃহে আসেন। স্বামীকে অকস্মাৎ দেথতে পেয়ে তাঁর কাছে ছুটে এলেন পতিপ্রাণা অ্যান্ড্রোমে। তাঁর শিশুপুত্রটি তখন দেদীপ্যমান নক্ষত্রের মত উজ্জ্বলভাবে শোভা পাচ্ছিল ধাত্রীর বুকে। হেক্টর তাঁর শিশুপুত্রের নামকরণ করেন অ্যাসটিয়ানাক্স। তার শিশুপুত্রকে দেখে মৃদু হাসলেন হেক্টর, কিন্তু কোন কথা বললেন না। অ্যান্ড্রোমেক তখন হেক্টরের একখানি হাত আপন হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অশ্রুসজল কণ্ঠে বললেন, হে আমার প্রিয়তমা স্বামী, তোমার সাহস ও বীরত্ব ডেকে আনবে তোমার ধ্বংস। তুমি একবার তোমার শিশুপুত্র ও আমার কথা ভাব। অবিলম্বে আমি বিধবা হব, কারণ গ্রীকগণ দলবদ্ধভাবে এবার আক্রমণ করে হত্যা করবে তোমায়। যদি তোমার আগেই আমার মৃত্যু হত এবং আমি সমাহিত হতাম কোন সমাধিগর্ভে তাহলে ভাল হত। তোমার অবর্তমানে আমাকে সান্ত্বনা দেবার কেউ থাকবে না। বর্তমানে আমার পিতামাতা, ভ্রাতা বা কোন আত্মীয়ই অবশিষ্ট নেই। অ্যাকেলিস থবস নগরী বিধ্বস্ত কবার সময় আমার পিতাকে হত্যা করেন। হত্যা করলেও আমার পিতার দেহকে বিকৃত করেন নি অ্যাকেলিস। সে দেহকে তিনি যথারীতি ভস্মীভূত করেন এবং তাঁর ভস্মস্তূপের চারিদিকে পার্বত্যদেবীর এলমগাছের কুঞ্জবন রচনা করেন। আমার মাকেও বন্দী করেন, পরে প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে মুক্তি দেন। সে বীর হেক্টর, বর্তমানে তুমি আমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, স্বামী-সব। তুমি যুদ্ধে যেও না, এখানেই অবস্থান করো। তোমার পুত্রকে অনাথ আর তোমার স্ত্রীকে বিধবা করো না। আর ট্রয়বাসীদের নগরপ্রাচীরের এক বিশেষ জায়গায় ডুমুরগাছের ধারে একত্রিত করো, কারণ ঐ স্থানটি সমগ্র নগর-প্রাচীরের মধ্যে দুর্বল অংশ এবং ঐ স্থান দিয়ে সহজে দুর্গপ্রাকার অতিক্রম করা যায়। অ্যাজাক্স বীরদের নেতৃত্বে আত্রেউস ও টাইডেউসপুত্রগণ তিন তিনবার ঐ স্থান আক্রমণ করেন।

হেক্টর এর উত্তরে বললেন, হে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, এসব কথা আমি পূর্বেই ভেবেছি। কিন্তু যদি আমি যুদ্ধের ভয়ে কাপুরুষের মত এখানে এসে লুকিয়ে থাকি তাহলে কেমন করে আমি এ মুখ ট্রয়বাসীদের দেখাব? আমি তা কিছুতেই করতে পারি না। আমি শুধু ট্রয়বাসীদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করে আমার ও আমার পিতার গৌরব বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন কথাই এখন ভাবতে পারি না। আমি ভালভাবেই জানি এমন একদিন শীঘ্রই আসবে যেদিন রাজা প্রিয়াম ও তাঁর প্রজাপুঞ্জসহ সমগ্র ইলিয়াম নগরী হবে বিধ্বস্ত। কিন্তু তার জন্য কিছুমাত্র ভাবি না আমি। আমি তোমার মাতা, পিতা ও ভ্রাতাদের কথাও চিন্তা করি না। আমি শুধু ভাবছি তোমার কথা, সে দিনের কথা, যেদিন বিজয়ী গ্রীকদের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি চিরদিনের মত তোমার স্বাধীনতা হরণ করে তোমায় ক্রন্দররত অবস্থায় টেনে নিয়ে যাবে দূরে বহু দূরে। হয়তো তোমার সুদূর আর্গসস্থিত কোন এক গৃহে এক গৃহকত্রীর আদেশে, চরকার সুতো কাটতে অথবা হাইপীরিয়া বা মেসিনার কোন নির্জন ঝর্ণা হতে জল আনতে হবে কলসী করে। কোন এক নিষ্ঠুর ব্যক্তির বন্দিনীরূপে কত দুঃসহ আদেশবাক্য সহ্য করতে হবে তোমায়। তখন যদি কেউ তোমার সে শোচনীয় দূরবস্থা দেখে বলে, এই নারী ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ট্রয়বীর হেক্টরের স্ত্রী, তাহলে নতুন করে অশ্রু উদগত হবে তোমার চোখে। বন্দিনীরূপে তোমার কণ্ঠ হতে সকরুণ ক্রন্দনধ্বনি নিঃসৃত হবার আগেই আমার যেন মৃত্যু হয় এবং আমার এই মরদেহ ভস্মস্তূপে পরিণত হয়।

অতঃপর আপন শিশুসন্তানের প্রতি বাহু দুটি প্রসারিত করে দিলেন হেক্টর। কিন্তু তার উজ্জ্বল বর্ম ও তাঁর শিরস্ত্ৰণাসংলগ্ন দোদুল্যমান অশ্বপুচ্ছরাজি দেখে ভীত হয়ে শিশুটি ধাত্রীবক্ষকে আঁকড়ে ধরল সজোরে। তা দেখে তার পিতা-মাতা দুজনেই হেসে উঠলেন। হেক্টর তখন তার শিরস্ত্রাণটি ভূতলে স্থাপন করে বক্ষে টেনে নিলেন তার শিশু পুত্রকে। তাকে বারবার চুম্বন ও আদর করে দেবরাজ জিয়াসের উদ্দেশ্যে বললেন, হে পরমপিতা ও স্বর্গের অন্যান্য দেবতাগণ, তোমাদের কৃপায় আমার সন্তান যেন আমার মতই বীর হয়, সে যেন ট্রয়বাসীদের নেতৃত্বদানে সক্ষম হয়। ভবিষ্যতে কোন যুদ্ধ শেষে বিজয়গৌরবসহ প্রত্যাবর্তনকালে জনগণ যেন বলাবলি করে, এই পুত্র তার পিতার থেকেও অধিকতর যোগ্য, বীরত্বে ও বীর্যে শ্রেষ্ঠ। সে যেন যত সব দুর্ধর্ষ শত্রুকে পরাস্ত করার গৌরব অর্জন করতে পারে এবং তার মাতার আনন্দ বর্ধন করতে সমর্থ হয়।

একথা বলার পর তাঁর শিশুপুত্রকে তার মার কোলে অর্পণ করলেন হেক্টর। আপন শিশুসন্তানকে বক্ষে ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হাসি ফুটে উঠল অ্যান্ড্রোমেকের অশ্রুসজল বিষাদক্লিষ্ট মুখমণ্ডলে। অ্যাড্রেমেকের পানে তাকিয়ে সত্যিই দুঃখ জাগল বীর হেক্টরের অন্তরে। তিনি তাকে আদর করে মৃদু সম্ভাষণে বললেন, হে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, এসব কথা নিয়ে বেশি দুঃখ করো না। মনে রেখো, আমার মৃত্যুর সময় না এলে কেউ আমাকে মৃত্যুপুরীতে পাঠাতে পারবে না। আরও মনে রেখো, যে যত বড় বীর বা কাপুরুষ হোক অন্তিমকাল আগত হলে তাকে ধরাধাম ত্যাগ করতেই হবে। অতএব আর দুঃখ বা বিলাপ না করে আপন গৃহাভ্যন্তরে গিয়ে সূচীকার্য, সম্মার্জনা অথবা গৃহকর্ম তত্ত্বাবধানে মনোনিবেশ করগে। যুদ্ধকার্য হচ্ছে পুরুষের ব্যাপার এবং যুদ্ধে আমার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

পালকসংবদ্ধ শিরস্ত্রাণটি আবার মস্তকে তুলে নিলেন হেক্টর। সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্ড্রোমেকও তাঁর গৃহাভ্যন্তরের পথে অগ্রসর হলেন। তখনও অশ্রু ঝরে পড়ছিল তার চোখ হতে এবং তিনি বারবার পিছনে ফিরে তাঁর বিদায়ী স্বামীর পানে তাকিয়ে দেখছিলেন। আপন কক্ষের মাঝে গিয়ে তাঁর সহচরী ও পরিচারিকাদের সকলকে তাঁর সঙ্গে শোকবিলাপে অংশগ্রহণ করতে বললেন অ্যান্ড্রোমেক, কারণ তাঁর দৃঢ় ধারণা, যুদ্ধক্ষেত্র হতে তাঁর স্বামী আর কোনদিন প্রত্যাবর্তন করবেন না নিরপদে। গ্রীকদের ভয়ঙ্কর কবল হতে আর কোনদিন মুক্ত হবেন না তিনি।

এদিকে প্যারিসও বেশিক্ষণ রইলেন না গৃহাভ্যন্তরে। উজ্জ্বল ব্রোঞ্জনির্মিত বর্ম পরিধান করে নগরপথে দ্রুতবেগে রওনা হলেন তিনি। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ভোজনের পর আস্তাবলবাসী কোন অশ্ব যেমন দ্বিগুণ উদ্যমে ও বেগে প্রান্তরবর্তী কোন প্রবহমান নদীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ছুটে চলে অথবা কোন রতিমিলনোদ্দেশ্যে কোন ঘোটকীর দিকে গমন করে, প্যারিসও তেমনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে নগরপথ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে লাগলেন যুদ্ধক্ষেত্রের অভিমুখে। হেক্টরকে তাঁর নিকট উপনীত দেখে বললেন, আমার মনে হয় আসতে আমার কিছু বিলম্ব হয়ে গেছে।

হেক্টর বললেন, তুমি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করো। ন্যায়বিচারপরায়ণ ব্যক্তি কখনই তোমার সামরিক কৃতিত্বকে খর্ব বা লঘু করে দেখতে পারবে না। তবে তোমার জন্য দুঃখভোগের হেতু ট্রয়বাসীরা যখন তোমার নিন্দা করে তখন সে নিন্দাবাক্য শুনে আমার বড় দুঃখ হয়। এখন চল আমরা যুদ্ধে যাই। দেবরাজ জিয়াসের কৃপায় যদি আমরা গ্রীকদের বিতাড়িত করে মুক্ত করতে পারি আমাদের ইলিয়াম নগরীকে তাহলে স্বর্গের দেবতাদের আহ্বান করে তৃপ্ত করব তাদের পান ও ভোজনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *