০৫. ডায়োমেডিস-এর কৃতিত্ব

পঞ্চম পর্ব
ডায়োমেডিস-এর কৃতিত্ব

টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস-এর অন্তরে এমনভাবে সাহস সঞ্চার করলেন দেবী প্যালাস এথেন যাতে সে অন্যান্য গ্রীকবীরদের ছাড়িয়ে যেতে পারে তার বীরত্বে আর বিক্রমে। ডায়োমেডিস-এর ঢাল আর শিরস্ত্রাণের উপরে এমন এক অগ্নিজাল সৃষ্টি করলেন যা দেখে মনে হলো, ওডিয়ানাস মহাসমুদ্র স্নান করে শতভিষা নক্ষত্র সে অত্যুজ্জ্বল কিরণ দান করছে নিদাঘের নৈশ আকাশে। সেই অগ্নিজালমণ্ডিত মস্তক নিয়ে শনিধন অভিলাষে বেগে ধাবিত হলেন ডায়োমেডিস।

ট্রয়বাসীদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন দেবপুরোহিত হিফাস্টাসের পুরোহিত দারেস। তাঁর ফেগেউস ও আইডেউস নামে সমরকুশলী দুই পুত্র ছিল। শত্রুপক্ষের সম্মুখসারিতে বীর ডায়োমেডিসকে দেখে বেগে রথ চালনা করে তার দিকে এগিয়ে এল দুই ট্রয়বীর। ফেগেউস প্রথমে বর্শা ছুঁড়লেন ডায়োমেডিসকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সে বর্শা ডায়োমেডিসের বাম স্কন্ধের পাশ দিয়ে চলে গেল; স্পর্শ করতে পারল না তাকে। এরপর ডায়োমেডিস যে বর্শাটি ফেগেউসকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লেন সে বর্শা তার বক্ষস্থল ভেদ করল। রথ থেকে যুদ্ধ করতে করতে সহসা ভূতলে পড়ে গেল ফেগেউস। পায়ে তার রথচক্রে তার ভাইয়ের মৃতদেহটি পিষ্ট হয় এই ভয়ে রথ হতে অবতরণ করে পশ্চাদপসরণ করতে লাগলেন আইডেউস। হিফাস্টাস যখন কৃত্রিম অন্ধকারের মেঘ সৃষ্টি করে এমনভাবে ঢেকে রাখলেন পশ্চাদপসরণরত আইডেউসকে যে তাকে দেখতেই পেল না শত্রুপক্ষের লোকেরা। ট্রয়সৈন্যরা যখন দেখল দারেসের দুই পুত্রের একজন নিহত এবং আর একজন পলায়নরত তখন স্বাভাবিকভাবেই রাগান্বিত হয়ে উঠল তারা। এথেন অ্যারেসের হাত ধরে বললেন, হে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের দেবতা রক্তাপুতদেহী নগরাবরোধকারী, চল আমরা চলে যাই। ট্রয় আর গ্রীকজাতির লোকেরা নিজেরাই যুদ্ধ করে স্থির করে নিক তাদের জয় পরাজয়। চল দেখি কোন পক্ষের গলদেশে বিজয়মালা দান করেন দেবরাজ জিয়াস। জিয়াসের ক্রোধের কারণ না হয়ে চল আমরা চলে যাই এ রণক্ষেত্র ত্যাগ করে।

এই কথা বলে অ্যারেসকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে সরিয়ে নিয়ে গেলেন এথেন। স্কামান্দর নদীর খাড়াই তীরের উপর নিয়ে গিয়ে বসালেন তাঁকে। ট্রয়দের হিতাকাক্ষী দেবতা অ্যারেস চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রীকরা ক্রমশ বিতাড়িত করে নিয়ে যেতে লাগল ট্রয়সৈন্যদের। তাদের নির্বিচারে হত্যা করে যেতে লাগল যতসব গ্রীকসেনাপতি ও সর্দারেরা। প্রথমে রাজা অ্যাগামেমনন তার রথ হতে একটি বর্শা নিক্ষেপ করে ট্রয় উপজাতি সর্দার ওডিসিয়াসকে হত্যা করলেন। ওডিসিয়াস যখন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করছিল তখন অ্যাগামেমননর দ্বারা নিক্ষিপ্ত বর্শাটি তার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে এবং সে পড়ে যায়।

থোয়াসপুত্র ফীস্টাস যখন তার রথে আরোহণ করছিল তখন বীর আইমোনেউেসের একটি বর্শা তার দক্ষিণ স্কন্ধ বিদ্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর অন্ধকার ঘন হয়ে নেমে আসে তার চোখে। আইডোমেনেউসের সহচরেরা তখন ফীস্টাসের বর্ম কেড়ে নেয় তার অচেতন মৃতদেহ থেকে।

আত্রেউসপুত্র মেনেলাস সুদক্ষ শিকারী স্ট্রোফিয়াসপুত্র স্কামাজ্রাসকে হত্যা করলেন। শিকারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আর্তেমিস নিজে পর্বত ও অরণ্যনিবাসী জীবজন্তু কিভাবে বধ করতে হয় তা শিখিয়ে দিয়েছিলেন স্কামাজ্রাসকে। কিন্তু শিকার বিদ্যায় পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও অ্যাগামেমননের সুতীক্ষ্ণ বর্শাফলক হতে নিজেকে রক্ষা করতে পারল না স্কামান্দ্রাস। হতচেতন অবস্থায় পড়ে গেল ভূতলে।

অতঃপর মেরিওন হত্যা করলেন টেকটনপুত্র ফেরেক্লাসকে। ফেরেক্লাস ছিলেন দেবী প্যালাস এথেনের প্রিয় এবং কাষ্ঠশিল্পে সুদক্ষ। ট্রয়যুদ্ধের মূল কারণ আলেকজান্দ্রাসের জাহাজ তিনিই নির্মাণ করেন। দেবতাদের বিধান না মেনে ট্রয়জাতি ও গ্রীকদের মধ্যে এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনেন আলেকজান্দ্রাস। ফেরেক্লাস যখন বেগে রথ চালনা করছিলেন তখন মেরিওন তাঁকে আঘাত করলেন। মেরিওনের বর্শাটি তার তলপেটে লাগতেই চিৎকার করে পড়ে গেলেন তিনি।

মেজেস হত্যা করেন অ্যান্টিনরপুত্র পেদেউসকে। পেদেউস অ্যান্টিনরের অবৈধ সন্তান হলেও অ্যান্টিনরের স্ত্রী পুত্রবৎ স্নেহে লালন পালন করেন। মেজেস তার কাছে গিয়ে তার হাতের বর্শাটি পেদেউসের ঘাড়ে আমূল বসিয়ে দিলে ধুলোর উপর পড়ে গেল পেদেউস।

ইউইমনপুত্র ইউরিপাইলাস ডলোপিয়নপুত্র হিপসেনরকে হত্যা করেন। হিপসেনর ছিলেন স্কামান্দার নদীর পুরোহিত এবং লোকে তাঁকে দেবতার মত ভক্তি করত। হিপসেনর যখন রথে চড়ে তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তার হাতের তরবারি দ্বারা আঘাত করে সে হাতটি দেহ থেকে ছিন্ন করে ফেললেন ইউরিপাইলাস। মুহূর্তে তাঁর চোখে নেমে এল মৃত্যুর ছায়া। শীতকালীন অতিবৃষ্টির দ্বারা পুষ্ট কোন বিশাল স্রোতধারা যেমন কূলপ্লাবিত করে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, তেমনি টাইডেউসপুত্র বেগে ধাবিত হলেন রণক্ষেত্রের অভিমুখে। বিপুলসংখ্যক ট্রয়সৈন্যের একটি দল শত চেষ্টাতেও তার গতিরোধ করতে পারল না।

এইভাবে যখন অপ্রতিহত বেগে ট্রয়সৈন্যদের বাত্যাতাড়িত তরঙ্গমালার মত বিতাড়িত করে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন টাইডেউসপুত্র তখন লাইকাওনপুত্র তা দূর হতে দেখে একটি শাণিত তীর নিক্ষেপ করলেন তাঁকে লক্ষ করে। সেই তীরটির অব্যর্থ আঘাতে স্কন্ধদেশ হতে রক্ত ঝরতে লাগল তাঁর। উত্তেজিত হয়ে বিজয়গর্বে গর্বিত লাইকাওনপুত্র বলতে লাগলেন, হে ট্রয়বীরগণ, তোমরা এগিয়ে এস এবার। শ্রেষ্ঠ গ্রীকবীরদের অন্যতম আজ আহত। অ্যাপোলোর আশীর্বাদের দ্বারা সত্য সতই যদি ধন্য হয়ে থাকি আমি, তাহলে উনি বেশিক্ষণ আর জীবিত থাকতে পারবেন না ইহলোকে।

কিন্তু লাইকাওনপুত্রের অব্যর্থ শরাঘাত মারাত্মক হয়ে উঠেনি টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস-এর পক্ষে। তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত স্কন্ধদেশ নিয়ে তার প্রতীক্ষমান রথের দিকে এগিয়ে গেলেন ডায়োমেডিস। রথচালক স্থেনেলাসকে বললেন, অবিলম্বে নেমে এস ক্যাপেনিসপুত্র, রথ হতে নেমে এসে আমার স্কন্ধ হতে তীরটি উৎপাটিত করো।

রথ হতে মুহূর্তে অবতরণ করলেন স্থেনেলাস। তারপর তীরটি ডায়োমেডিস-এর ক্ষতস্থান হতে উৎপাটিত করতেই রক্ত ঝরতে লাগল সেই ক্ষতস্থান হতে। তখন দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে লাগলেন ডায়োমেডিস, হে দেবরাজ জিয়াসকন্যা শোন আমার কথা, যদি তুমি কোনদিন কোন বিপজ্জনক যুদ্ধে আমার পিতাকে সাহায্য দান করে থাক তাহলে আজ আমার এ বিপদেও সাহায্য করো আমাকে। তাহলে আজ বর্শাফলকের অব্যর্থ আঘাতে আমার আঘাতকারীর যেন মৃত্যু হয়। কারণ সে আমাকে অতর্কিত আক্রমণ করে অন্যায়ভাবে আহত করে এবং অবিলম্বে তার সেই আঘাতে আমার জীবনবসান হবে বলে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে।

ডায়োমেডিস-এর কাতর প্রার্থনা শুনে দয়া হল এথেনের। তিনি মুহূর্তে সুস্থ ও দ্রুততর করে তুললেন ডায়োমেডিস-এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে। তারপর তাঁর নিকটে গিয়ে বললেন, ভয় করো না ডায়োমেডিস, ট্রয়জাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে চল নির্ভীকভাবে, কারণ আমি তোমার অন্তরে তোমার পিতার তেজস্বীতা সঞ্চার করেছি। তাছাড়া তোমার চোখ থেকে সেই অবিদ্যার মায়া অপসারিত করে দিয়েছি যার ফলে তুমি দেবতা ও মানুষের পার্থক্য বুঝতে পারবে। যদি অন্য কোন দেবতা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসে তাহলে তার সঙ্গে যুদ্ধ করো না। কিন্তু যদি জিয়াসকন্যা অ্যাফ্রোদিতে আসে তাহলে তাকে তোমার বর্শার দ্বারা আঘাত করবে।

এই কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন দেবী এথেন। পূর্বেকার সমরদ্যোমকে ত্রিগুণীকৃত করে পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস। কোন মেষপালকের দ্বারা আহত ক্রুদ্ধ পার্বত্য সিংহের মতই তিনি হয়ে উঠলেন ভয়ঙ্কর। শঙ্কাবিহ্বল মেষের পাল সহসা লাফিয়ে পড়া আহত সিংহের মত ছিন্নভিন্ন ট্রয়সৈন্যের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডায়োমেডিস।

অ্যাসটাইনের ও হাইপীরিয়ন নামে দুই জাতীয় অধিনায়ককে হত্যা করলেন ডায়োমেডিস। একজনকে বর্শার দ্বারা তার বক্ষস্থলে এবং আর একজনকে তরবারির দ্বারা আঘাত করলেন তিনি। তাদের দুজনকে নির্জিত ও ভূপাতিত করার পর প্রবীণ স্বপ্নপরীক্ষক ইউরিমেডাসের দুই পুত্র আবাস আর পলিডাসের সন্ধান করতে লাগলেন। তাদের দুজনকেও হত্যা করলেন ডায়োমেডিস। তারপর বৃদ্ধ ফীনপস-এর দুই পুত্র জ্যানথাস ও থুনকে হত্যা করলেন। বৃদ্ধ ফীনপস-এর সন্তান সৃষ্টির ক্ষমতা আর না থাকায় তার দুই পুত্র ছিল তার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়। ডায়োমেটিস এর হাতে দুই পুত্রের প্রাণবিয়োগ হওয়ায় ফীনপস-এর বিষয়সম্পত্তির আর কোন উত্তরাধিকারী রইল না। ফলে তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করেছিল সে সম্পত্তি।

রাজা প্রিয়ামের দুই পুত্র একিমন ও ক্রোমিয়াস যখন রথে চেপে এগিয়ে যাচ্ছিল রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে তখন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডায়োমেডিস বনপার্শ্বস্থ কোন চারণক্ষেত্রে মেষপালের উপর অপ্রতিহতবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়া সিংহের মত ডায়োমেডিস প্রাদুর্ভূত হলেন তাদের মাঝে। তাদের প্রবল বাধাদান সত্ত্বেও রথ হতে টেনে নামালেন ডায়োমেডিস। দেহ হতে খুলে নিলেন তাদের বর্মরাজি। তারপর রথের অশ্বগুলো তাদের সহকর্মীদের দান করলেন।

ট্রয়বীর ঈনিস যখন দেখলেন একের পর এক হত্যার তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রীকবীর ডায়োমেডিস তখন তিনি অবিরাম বর্ষাবৃষ্টি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে লাগলেন তার গতিরোধ করার জন্য। অবশেষে লাইকাওনপুত্রের দেখা পেয়ে ঈনিস বললেন, হে বীর প্যান্ডারাস, কোথায় তোমার সেই অপরাজেয় ধনুর্বাণ? ধনুর্বিদ্যায় তুমি এমনই অপরাজেয় যে সারা লাইসিয়া দেশের মধ্যে তোমার সমকক্ষ বীর কেউ নেই। অতএব দেবরাজ জিয়াসের নিকট প্রার্থনা করে একটি অব্যর্থ তীর নিক্ষেপ করো সেই দুর্ধর্ষ গ্রীকবীরের উপর যিনি অপ্রতিহত ও অপ্রতিরোধ্য বিক্রমে একের পর এক নির্বিচারে হত্যা করে চলেছেন ট্রয়বীরদের। বহু বীরকে ইতিপূর্বেই ধ্বংস করেছেন তিনি। নিশ্চয়ই কোন উৎসর্গের ব্যাপারে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়েছেন ট্রয়জাতির উপর আর সেই কারণেই এমন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ডায়োমেডিস-এর হত্যার হস্ত।

লাইকাওনপুত্র তখন উত্তর করলেন, ঈনিস, আমি জানি উনি টাইডেউসপুত্র ব্যতীত আর কেউ নন। তাঁর হাত, শিরস্ত্রাণ আর রথা দেখে আমি তাকে চিনতে পেরেছি। তিনি দেবতা নন, মানুষ। কিন্তু দেবানুগ্রহ ব্যতীত কখনই তিনি এ ধ্বংসকার্য সাধন করতে পারতেন না। মেঘান্ধকারপরিবৃত কোন দেবতা অদৃশ্য অবস্থায় তাঁর পাশে অবস্থান করে নিশ্চয়ই তাঁর প্রতি নিক্ষিপ্ত আমার তীরটির অকস্মাৎ গতি পরিবর্তন করে দেন। তথাপি আমার তীরটি তার স্কন্ধদেশ বিদ্ধ করে। আমার এবিষয়ে নিশ্চিত ধারণা ছিল যে আমি তাঁকে পাতালপুরীতে প্রেরণ করব। কিন্তু আমি তাঁকে হত্যা করতে পারি নি। নিশ্চয়ই আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন কোন দেবতা। তার উপর আমার সঙ্গে কোন রথ বা রথা নেই। অথচ আমার পিতার রথশালায় একাদশটি নবনির্মিত রথ অশ্বসংযোজিত অবস্থায় বিরাজ করছে। আমার বৃদ্ধ পিতা লাইকাওন চেয়েছিলেন সেই সব রথ ও অশ্ব গ্রহণ করে তার দ্বারা ট্রয়বাসীদের নেতৃত্ব দান করি যুদ্ধে। কিন্তু আমি আমার পিতার অনুরোধে কর্ণপাত করি নি। যুদ্ধক্ষেত্রে সেই সব অশ্বগুলোর খাদ্যাভাব ঘটতে পারে এইরূপ আশঙ্কা করে আমি সঙ্গে রথ না নিয়ে কেবলমাত্র ধনুর্বাণ সঙ্গে নিয়ে ইলিয়াম নগরীতে পদব্রজে চলে আসি। আজ আমার এই ধনুর্বাণের আর কোন প্রয়োজন নেই, কারণ আমি এর দ্বারা দুই গ্রীকবীর আত্রেউসপুত্র ও টাইডেউসপুত্রকে আঘাত করে তাদের রক্তপাত ঘটিয়েছি। তবে শুধু ধনুর্বাণ দ্বারা ইলিয়াম নগরীতে হেক্টরকে সাহায্য করতে এসে ভুল করি আমি। আজ যদি আমি ব্যর্থ হয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করি তাহলে অবশ্যই বংশগৌরব গৌরবান্বিত আমার আত্মীয় পরিজনবর্গের কেউ না কেউ আমার শিরচ্ছেদ করে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলবে আমার ধনুর্বাণ।

ঈনিস উত্তর করল, আর বাক্যব্যয় করো না। ঐ ব্যক্তিটির নিকটে গিয়ে তাকে অস্ত্রদ্বারা আক্রমণ না করা পর্যন্ত কিছু হবে না। সুতরাং আমার এই রথে আরোহণ করো। তবে দেখ সুশিক্ষিত এই অশ্বগুলো কিভাবে কৌশলে রণক্ষেত্রের মধ্যভাগে শত্রুসৈন্যাভিমুখে বেগে ধাবিত হতে পারে। জিয়াস যদি টাইডেউসপুত্রকে বিজয়গৌরব দান করেন তাহলে আমরাও নিরাপদে প্রত্যাগমন করব আমাদের নগরীতে। হয় এই রথাশ্বের বন্ধু ধারণ করে অশ্বচালনা করো, না হয়ত আমার হাতে সে বল্পা দান করে অশ্বচালনা করো।

লাইকাওনপুত্র বললেন, ঈনিস, নিজে গ্রহণ করো তুমি বল্লা ও অশ্বচালনার ভার, কারণ টাইডেউস পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধকালে একমাত্র তোমার কণ্ঠস্বরই নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে তোমার রথাশ্বকে। তারা তোমার বশীভূত। প্রয়োজন হলে তোমার নির্দেশে তারা আমাদের দুজনকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে। তা না হলে টাইডেউসপুত্র আমাদের দুজনকেই হত্যা করে তোমার রথ ও অশ্ব অধিকার করে নেবে। সুতরাং তুমি নিজে রথচালনা করো।

অতঃপর ঈনিস ও প্যান্ডারাস রথে আরোহণ করে টাইডেউসপুত্রের সন্ধানে বেগে অশ্বচালনা করতে লাগল। তাদের দেখে টাইডেউসপুত্রের সারথি স্থেনেলাস বলল, হে। টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস, আমি দুজন প্রসিদ্ধ ট্রয়বীরকে আমাদের দিকে বেগে ধাবিত হতে দেখছি। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত তীরন্দাজ লাইকাওনপুত্র প্যান্ডারাস আর একজন হলেন দেবী অ্যাফ্রোদিতের গর্ভে অ্যাঙ্কিসেসের ঔরসজাত ঈনিস। আমার কথা শোন, আর অগ্রগমন না করে রথে চড়ে এই মুহূর্তে পশ্চাদপসরণ করো। তা না হলে তোমার মৃত্যু অবধারিত।

ক্রুদ্ধ হয়ে তার পানে তাকিয়ে উত্তর করলেন ডায়োমেডিস, পলায়েনের কথা আমার কাছে বলো না। আমি তোমার কথা শুনব না। আমি এমনই এক বীর জাতির সন্তান, যে জাতি কখনো পলায়ন করতে বা ভয়ে যুদ্ধে পরাজুখ হতে জানে না। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখানো ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে নি। সুতরাং আমি রথে আরোহণ না করে ঐ দুই ট্রয়বীরের সম্মুখীন হব। দেবী প্যালাস এখন আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন কোন মানবসন্তানকে ভয় না করি। ওদের মধ্যে একজন কোনরকমে পলায়ন করলেও ওরা দুজন কখনই চলে যাতে পারবে না এই রণক্ষেত্র হতে। আর একটা কথা আমার শুনে রাখ, দেবী এথেনের কৃপায় যদি আমি ঐ দুই বীরকে হত্যা করতে সমর্থ হই তাহলে তুমি অবিলম্বে ছুটে গিয়ে ঈনিসের অশ্বগুলো নিয়ে আসবে এদিকে। ঐ অশ্বগুলো সাধারণ অশ্ব নয়, আপন পুত্রের বিনিময়ে অ্যাঙ্কিসেস ঐ অশ্বগুলো লাভ করেছিলেন জিয়াসের কাছ থেকে। সারা মর্ত্যভূমির মাঝখানে ঐ ধরনের অশ্ব কোথাও পাবে না। লাওমীডনের অজ্ঞাতসারে রাজা অ্যাঙ্কিসেস ঐ দুটি অশ্বের সঙ্গে দুটি ঘোটকীর মিলন ঘটান এবং তার ফলে তারা ছয়টি অশ্বশাবক দান করে। তার মধ্যে চারটি শাবক আপন আস্তাবলে রেখে দুটি পুত্র ঈনিসকে দান করেন রাজা অ্যাঙ্কিসেস।

ডায়োমেডিস যখন এইভাবে তাঁর সারথির সঙ্গে কথোপকথনে রত ছিলেন তখন দুই ট্রয়বীর উপনীত হলেন তাঁদের সন্নিকটে। তাদের মধ্যে লাইকাওনপুত্র প্যারাস বলল, হে বীর টাইডেউসপুত্র, আমার শর একবার তোমাকে ভূপাতিত করতে ব্যর্থ হয়। এবার তাই আমি বর্শা নিক্ষেপ করব তোমার প্রতি।

প্যান্ডারাস নিক্ষিপ্ত বর্শাফলকটি ডায়োমেডিস-এর ঢালের উপর প্রতিহত হলো। সে ফলক ঢালের উপরিপৃষ্ঠ কিছুটা ভেদ করলেও তার অঙ্গ স্পর্শ করতে পারল না। কিন্তু ভালোভাবে না দেখে হর্ষধ্বনি করে উঠল প্যারাস। বলল, আমার বর্শাফলক তোমার উদরদেশ ভেদ করেছে। তুমি আর বেশিক্ষণ ধরাধামে থাকবে না।

কোনরূপ ভীত না হয়ে ডায়োমেডিস উত্তর করলেন, এবারও ব্যর্থ হয়েছে তোমার লক্ষ্য। কিন্তু এবার তোমরা হয় দুজনই অথবা দুজনের একজন আপনার দেহনিঃসৃত রক্তের দ্বারা তুষ্ট করবে তোমাদের যুদ্ধদেবতাকে।

এই বলে ডায়োমেডিস তাঁর বর্শাটি হাত হতে নিক্ষেপ করতেই এথেন তা লক্ষ্যাভিমুখে সঠিকভাবে চালনা করে দিলেন। ফলে সে বর্শা প্যারাসের নাসিকার ঊর্ধ্বভাগ এমনভাবে বিদ্ধ করল যাতে মুহূর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হলো তার সমস্ত দন্ত ও সমগ্র মুখমণ্ডলের অস্থিমজ্জা। ভূতলে লুটিয়ে পড়ল তার প্রাণহীন দেহ।

প্যান্ডারাসের সেই নিষ্প্রাণ দেহটি যাতে গ্রীকরা নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে তার জন্য রথ হতে অবতরণ করে সে দেহ আনার জন্যে এগিয়ে গেলেন ঈনিস। একহাতে ঢাল ও অন্য হাতে বর্শা ধারণ করে বীরবিক্রমে আস্ফালন করে বললেন, যে প্রথম এগিয়ে আসবে তাকেই তিনি বধ করবেন।

কিন্তু ডায়োমেডিস তখন একটি বিশাল আয়তন প্রস্তরখণ্ড একাই তুলে ঈনিসের পশ্চাদভাগে এমনভাবে নিক্ষেপ করলেন যাতে তাঁর ভয়ঙ্কর আঘাতে ভগ্নপ্রায় হয়ে উঠল তার কটিদেশ। সামনের দিকে নতজানু হয়ে পড়ে গেল ঈনিস। চোখে অন্ধকার নেমে এল তার। এইভাবে অকালে অপঘাতে প্রাণবিয়োগ ঘটত তা যদি না তার মাতা দেবী অ্যাফ্রোদিতে এসে তার দৈব পোশাকের অঞ্চলদেশ দ্বারা আচ্ছন্ন করে সরিয়ে নিয়ে যেতেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে।

ঈনিসকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে তার মা সরিয়ে নিয়ে যেতেই ডায়োমেডিস-এর সারথি স্থেনেলাস তাঁর রথ ত্যাগ করে দ্রুত গিয়ে ঈনিসের অশ্ব দুটিকে নিয়ে এল। তারপর সে দুটিকে তার এক বিশ্বস্ত সহকর্মী দীপাইরাসকে দিয়ে তাদের জাহাজে নিয়ে যেতে বলল। তারপর স্থেনেলাস ডায়োমেডিস-এর সন্ধান করতে লাগল সেই বিশাল রণক্ষেত্রে বিভিন্ন দিকে ঘুরে ঘুরে।

এদিকে ডায়োমিডেস তখন উন্মত্তের মত খুঁজে চলেছেন পলায়নরতা দেবী অ্যাফ্রোদিতকে। তিনি জানতেন, কাম ও প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী অ্যাফ্রোদিতের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের কোন অধিকার নেই। তাঁর দ্বারা আহত তাঁর শত্রুকে রক্ষা করা বা তাকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ারও কোন অধিকার নেই তার। হস্তষ্কৃত শিকার হস্তচ্যুত হয়ে গেলে যেমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ব্যাঘ্র তেমনি এক ভয়ঙ্কর প্ৰতিশোধবাসনায় উন্মত্ত হয়ে ধাবিত হয়ে অ্যাফ্রোদিতের সন্নিকটস্থ হলেন ডায়োমেডিস। ঈনিসকে ধারণ করে থাকা তাঁর একটি হাতে বর্শার দ্বারা এমনভাবে আঘাত করলেন যাতে ঈনিসকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন তিনি। তখন স্বর্গদেবতা অ্যাপোলো দয়াপরবশ হয়ে ঈনিসকে ধারণ করে এমন এক কৃত্রিম মেঘান্ধকার দ্বারা আচ্ছন্ন করে রাখলেন যাতে গ্রীকরা তাকে দেখতে না পায়। ডায়োমেডিস তখন চিৎকার করে অ্যাফ্রোদিতকে বললেন, শোন জিয়াসকন্যা, অপরিণামদর্শিনী বুদ্ধিহীনা নারীদের প্রতারিত করেই ক্ষান্ত থাকা উচিত তোমার। যদি তোমার স্বীয় কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করে আমাদের এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে আস অন্যায়ভাবে, তাহলে তোমায় এমন শিক্ষা দান করব যাতে ভবিষ্যতে যুদ্ধের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের কম্পন জেগে উঠবে তোমার বুকে।

বাতাসের মত দ্রুতগামী আইরিস যুদ্ধক্ষেত্র হতে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন দেবী অ্যাফ্রোদিতেকে।

যাবার পথে অ্যাফ্রোদিতে দেখলেন তাঁর ভ্রাতা আক্রমণাত্মক যুদ্ধের ভয়ঙ্কর দেবতা অ্যারেস সেই বিশাল রণক্ষেত্রের বামদিকে রথে আরোহণ করে কিসের প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে রয়েছেন। অদূরে একটি মেঘখণ্ডের উপর বিরাজ করছে তার একটি বর্শা আর দুটি বেগবান অশ্ব।

আইরিসের সাহায্যে অ্যারেসের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে অ্যাফ্রোদিতে বললেন, হে আমার প্রিয় ভাই, আমাকে তোমার মায়াময় অশ্বদুটি একবার দাও। এছাড়া আমি আমাদের স্বর্গরাজ্য অলিম্পাসে ফিরে যেতে পারব না। ডায়োমেডিস নামে এক মানবসন্তান আঘাত করেছে আমার দেহে। তাকে দেখে মনে হলো সে যেন স্বয়ং দেবরাজ জিয়াসের সঙ্গেও যুদ্ধ করবে।

অ্যারেস তাঁর রথ আর অশ্ব দুটি দিতেই তাতে চেপে আইরিসের সঙ্গে সুদুর অলিম্পাসে গিয়ে উপস্থিত হলেন অ্যাফ্রোদিতে। অ্যাফ্রোদিতে সোজা গিয়ে তার মা ডাওনের কোলে উঠলেন। ডাওনও তাঁর দুহাত বাড়িয়ে তাকে আদর করতে করতে বললেন, কোন দেবতা তোমাকে এভাবে আঘাত করল? আর তুমি কীই বা এমন প্রকাশে অন্যায়কর্ম করেছ?

অ্যাফ্রোদিতে তখন উত্তর করলেন, আপন শক্তিগর্বে ডায়োমেডিস আমাকে আঘাত করেছে কারণ আমি আমার প্রিয় পুত্র আহত ঈনিসকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন ট্রয়যুক্ত আর ট্রয় ও গ্রীকজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, কারণ ডায়োমেডিস সামান্য মানবসন্তান হলেও সে দেবতাদের গায়ে আঘাত করছে, দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রয়াস পাচ্ছে।

দেবী ডাওন উত্তর করলেন, নীরবে সহ্য করো বৎসে! বরং এই আঘাত ও দুঃখের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করো। আমরা অলিম্পাসবাসী দেবতাবৃন্দ মানুষের উপর যেমন অনেক দুঃখকষ্টের বোঝা চাপিয়ে দিই তেমনি আমাদেরও মাঝে মাঝে অনেক দুঃখ মানুষের হাতে ভোগ করতে হয়। একবার অ্যালিয়াসের দুই পুত্র ওটাস ও অ্যাফিয়ানটেস ব্রোঞ্জনির্মিত এক কারাগায়ে অ্যারেসকে ত্রয়োদশ মাসকাল আবদ্ধ করে রাখেন। যদি ওটাসদের বিমাতা তা দেখে সে কথা দেবী হারমিসকে না বলতেন আর হারমিসও যদি অ্যারেসকে সেখান থেকে গোপনে সরিয়ে না নিয়ে যেতেন তাহলে সেই কারাগারেই প্রাণত্যাগ করতে হত অ্যারেসকে। আর একবার মানবসন্তান অ্যাম্ফিট্রিওনের পুত্র এক ত্রিমুখী তীর দ্বারা দেবী হেরার বক্ষস্থল বিদ্ধ করেন। অসহনীয় যন্ত্রণায় মৃতপ্রায় হয়ে পড়েন হেরা। আর একবার মৃত্যুর দেবতা হেডস-এর এই অবস্থা হয়। হেরাকে যে ব্যক্তি আঘাত করে সেই ব্যক্তিই এক অব্যর্থ শরাঘাতে নরকের দ্বার পথে হেডস-এর স্কন্ধদেশ বিদ্ধ করে। সেই দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অলিম্পাসে জিয়াসের কাছে চলে যান হেডস। দেবতা হয়েও অপরিসীম ব্যথা ও বেদনায় বড়ই কাতর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দেববৈদ্য পীওন তখন গাছগাছড়ার দ্বারা নির্মিত এক আশ্চর্য ওষুধ প্রস্তুত করে তা প্রয়োগ করলেন হেডস-এর ক্ষতস্থানের উপর আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত যন্ত্রণার উপশম ঘটল তাঁর। ক্রোধে ও দুঃখে হেডস জিয়াসকে বললেন, এথেনের প্ররোচনায় সেই পাপাত্মা ডায়োমেডিস অলিম্পাসবাসী দেবতাদেরও শরাঘাতে জর্জরিত করছে। কিন্তু সে একবার ভেবে দেখছে না যে মানুষ স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গে লড়াই করতে যায় সে কখনো পুতপরিবার নিয়ে সুখে শান্তিকে দীর্ঘদিন বাস করতে পারে না। সে ভেবে দেখছে না তার থেকে আরও বলশালী একজন বীরের সঙ্গে তাকে একদিন যুদ্ধ করতে হবে আর তখন তার স্ত্রী আদ্রোসকন্যা ইজিয়ালেনকে তার মৃত স্বামীর জন্য গভীর শোকে নিমগ্ন হতে হবে।

এই কথা বলে অ্যাফ্রোদিতের হাতের ক্ষতস্থান থেকে তীরের বিষটি তুলে নিতেই সমস্ত যন্ত্রণার উপশম ঘটল। আবার সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল এফ্রোদিতের হাতটি। কিন্তু এথেন ও হেরা দেবরাজ জিয়াস সকাশে দেবী অ্যাফ্রোদিতেকে দেখে সন্দেহের বশবর্তী হলেন। বিদ্রুপের ভঙ্গিতে এথেন তখন বললেন, হে দেবপিতা জিয়াস, ক্রুদ্ধ হয়ো না আমার প্রতি। আমার মনে হয় ঐ সাইপ্রাসদেশীয় দেবী অ্যাফ্রোদিতে আবার হয়ত কোন সতীসাধ্বী গ্রীকরমণীকে ট্রয়নগরীতে নিয়ে যাবার জন্য প্ররোচিত করছিলেন, কারণ উনি ট্রয়বাসীদের প্রতি অহেতুক পক্ষপাতদুষ্ট। তাই হয়ত সেই ক্রোধকুটিল গ্রীকরমণীর সম্মতিসূচক মস্তকসঞ্চালহেতু তার কেশপাশপোথিত স্বর্ণকাটায় বিক্ষত তাঁর রজতশুভ্র বাহুদেশ।

মৃদু হেসে কামদেবী অ্যাফ্রোদিতেকে কাছে ডাকলেন দেবপিতা জিয়াস। বললেন বৎসে যুদ্ধ তো তোমার কাজ নয়। যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। প্রেম ও পরিণয় সম্পর্কিত যা কিছু ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তোমার কর্মক্ষেত্র। সুতরা তার মধ্যেই ক্ষান্ত থেকে যুদ্ধ সম্পর্কিত সমস্ত ব্যাপার ছেড়ে দেবে অ্যারেস আর এথেনের উপর।

এদিকে দেবতারা যখন কথোপকথনে ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের মধ্যে, ওদিকে তখন হত্যার নেশায় উন্মত্ত ডায়োমেডিস হয়ে উঠেছিলেন ঈনিসের সন্ধানে ব্যস্ত। দেবশ্রেষ্ঠ অ্যাপোরলা ঈনিসকে আশ্রয় দিয়েছেন একথা জেনেও তিনি কিছুমাত্র ভীত ও কুণ্ঠিত না হয়ে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন ঈনিসকে হত্যা করার জন্য। তিনবার তিনি অ্যাপোলোর দ্বারা ধৃত ও সুরক্ষিত ঈনিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন আর তিনবারই তাঁর নিজস্ব ঢাল দিয়ে ডায়োমেডিস-এর সমস্ত আঘাতকে প্রতিহত করলেন অ্যাপোলো। তারপর ডায়োমেডিস যখন চতুর্থবার ঈনিসের উপর আঘাত হানার জন্য উদ্যত হলেন তখন অ্যাপোলো রূঢ় ভাষায় বললেন, সাবধান টাইডেউসপুত্র, ক্ষান্ত হও, সরে যাও। মনে ভেবো না তুমি দেবতাদের সমকক্ষ হবে বীরত্বে ও বিক্রমে। জেনে রেখো, মর্তবাসী মরণশীল মানুষ আর দেবতাদের সঙ্গে কখনই তাল মিলিয়ে চলতে পারে না।

অ্যাপোলোর রোষ হতে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য কিছুটা সরে গেলেন ডায়োমেডিস। আর সেই অবসরে ঈনিসকে তাঁর পারগামাস্থিত মন্দিরে নিয়ে গেলেন অ্যাপোলোলা। সেখানে লিটো ও আর্তেমিস ঈনিসকে আরোগ্য করে তুললেন ক্ষতজনিত সমস্ত যন্ত্রণা থেকে। অ্যাপোলো তখন ডায়ামেডিস-এর প্রতি ঈনিসের সমস্ত ক্রোধ নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে প্রতিশোধ বাসনায় অ্যারেসের নিকট গিয়ে বললেন, হে রক্তপিপাসু নগরধ্বংসকারী যুদ্ধের দেবতা অ্যারেস, যে ব্যক্তি মানুষ হয়ে দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় এবং দেবরাজ জিয়াসকেও পরাস্ত করার প্রয়াস পায়, ডায়োমেডিস নামে সেই উদ্ধত অহঙ্কারী ব্যক্তিটিকে দমন করতে পারছ না? সে প্রথমে কামদেবী অ্যাফ্রোদিতের বাহুতে আঘাত করে, পরে সে আমাকে আক্রমণ করে এবং এমন এক উদ্ধত ভাব দেখায় যাতে মনে হয় নিজেই একজন দেবতা।

অতঃপর পারগামাস্থিত মন্দির শিখরে আরোহণ করে হস্তে রজত নির্মিত ধনুর্বাণ ধারণ করে বসে রইলেন অ্যাপোলো। আর তখন নরহত্যাপিপাসু অ্যারেস ট্রয়সৈন্যদের মাঝে গিয়ে উত্তেজিত করতে লাগলেন তাদের। বললেন, রাজা প্রিয়ামের হে বীর প্রজাগণ, আর কতদিন তোমরা এইভাবে গ্রীকদের দ্বারা নিহত হবে পশুর মত? তোমরা কি তাদের এমনি করে ধীরে ধীরে ট্রয়নগরীর প্রাচীরমধ্যে প্রবেশাধিকার দেবে? হেক্টরের সমকক্ষ বীর অ্যাঙ্কিসেসপুত্র ঈনিসের আজ পতন ঘটেছে। সুতরাং আর নীরব থেকো না। তোমাদের যে সব বীর সহকর্মী বন্দী হয়েছেন শক্তহস্তে তাঁদের মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হও।

এই সব তপ্ত উত্তেজনাপূর্ণ বাক্যের দ্বারা অপরিসীম সাহস ও উৎসাহের সঞ্চার করলেন অ্যারেস ট্রয়সৈন্যদের মনে। সার্পেৰ্ডন তখন বীর হেক্টরকে সম্বোধন করে বললেন, কোথায় তোমার সেই অজেয় অপ্রধৃষ্য শক্তি হেক্টর? তুমি না একবার আস্ফালন করে বলেছিলে বাইরের কোন লোকের সাহায্য ব্যতিরেকে একমাত্র তোমার বীরপ্রসূতবংশের জ্ঞাতিভ্রাতাদের দ্বারাই ট্রয়নগরী রক্ষা করতে পার? কিন্তু তোমার সেই বীর জ্ঞাতিভ্রাতাদের একজনকেও তো দেখছি না। সিংহসকাশে শিকারী কুকুরের মত নতশির ও হীনবল তারা। আমাদের মত তোমার কিছু কিছু মিত্র যুদ্ধের সকল বোঝাভার বহন করে চলেছে জেনে রেখো, বহু দূর হতে বহু কষ্ট সহ্য করে এখানে এসে এ যুদ্ধে যোগদান করেছি আমি। আমি এসেছি বিশাল জ্যানথাস নদী পার হয়ে সুদূর লাইসিয়া হতে। সেই জ্যানথাস নদীর জনহীন তীরে আমি আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ধনসম্পদসহ ত্যাগ করে এসেছি। তাদের সেই ধনসম্পদ সহজেই প্রলুব্ধ করতে পারে দস্যুদের। তবু আমি সেসব কথা বিস্মৃত হয়ে আমার প্রজাপুঞ্জ লাইসিয়ার অধিবাসীদের পরিচালিত করছি এ যুদ্ধে। করছি বিনা স্বার্থে, কারণ গ্রীকদের লুণ্ঠন করে আমি কিছুই পাব না। অথচ তুমি তোমার প্রজাদের প্রতিরক্ষার কাছে অনুপ্রাণিত না করে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রয়েছ। কিন্তু দেখো, যেন জালবদ্ধ মৎস্যের মত তুমি সদলবলে বন্দী হয়ো না শক্তহস্তে আর তোমাদের সাধের ট্রয়নগরী যেন বিধ্বস্ত না হয় শত্রুদের দ্বারা। এই কথা দিবারাত্র মনে রেখে তোমার দলপতিদের নির্দেশ দাও তারা যেন অটল অবিচলভাবে দেহের শেষ রক্তবিন্দু দান করেও যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

সাপেডনের এই ওজস্বিনী ভাষায় তপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন হেক্টর। বর্ম ও বিভিন্ন অস্ত্রে পূর্ণমাত্রায় সজ্জিত হয়ে রথ হতে অবতরণ করে সমরোদ্যমসূচক এক তীব্র চিৎকারে বিদীর্ণ করে তুললেন চারিদিকের আকাশ বাতাস। বাতাসে উৎক্ষিপ্ত চূর্ণিত শস্যকণার মত অসংখ্য অশ্বক্ষুরতাড়িত শুভ্র ধূলিজালে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল উভয়পক্ষের সৈন্যরা। সেই ধুলিধূসর এক কৃত্রিম অন্ধকারে ট্রয়সৈন্যদের আচ্ছন্ন ও অপরিদৃশ্য করে ফেললেন রণদেবতা অ্যারেস। তারপর ট্রয়সৈন্যদের উৎসাহিত করার জন্য ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তাদের মাঝে। কারণ তিনি অ্যাপোলোর কাছে শুনেছিলেন প্যালাস এথেন যেভাবে গ্রীকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন, তাঁরও ঠিক সেইভাবে ট্রয়সৈন্যদের উত্তেজিত করে তোলা উচিত।

এদিকে পারগামাসের সেই স্বর্ণমন্দিরে ঈনিস দৈব কৃপায় সুস্থ হয়ে ওঠার পর অ্যাপোলো তাকে আবার পাঠিয়ে দিলেন ট্রয়বাসীদের মধ্যে। যুদ্ধক্ষেত্রে আপন সহকর্মীদের মাঝে স্বীয় মর্যাদাসহ প্রত্যাবৃত্ত হলেন ঈনিস। তিনি তখনো জীবিত আছেন দেখে হর্ষমিশ্রিত এক বিস্ময় অনুভব করল ট্রয়বাসীরা। কিন্তু অ্যারেসকৃত উত্তেজনার প্রাবল্যে সেদিকে মনোনিবেশ করতে পারল না তারা।

ওদিকে ট্রয়সৈনদের পুনরাক্রমণে কোনরূপ ভীত ত্রস্ত না হয়ে অনমনীয় সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল গ্রীকসৈন্যরা। দুই অ্যাজাক্সবীর, ওডিসিয়াস ও ডায়োমেডিস সর্বত্র ঘুরে ঘরে উত্তেজিত করে বেড়াতে লাগলেন গ্রীকসৈন্যদের। ক্রোনাসপুত্র জিয়াস দ্বারা উথিত পর্বতশিখরস্থ নিবাতনিষ্কম্প মেঘমালার মত সম্মিলিত ট্রয়সৈন্যদের মাঝে এক অটল দৃঢ়তায় স্তব্ধ হয়ে রইল গ্রীকসৈন্যগণ। তখন আত্রেউসপুত্র রাজা অ্যাগামেমনন গিয়ে গ্রীকদের সম্বোধন করে বললেন, বন্ধুগণ, বীরের মত যুদ্ধ করে সমস্ত অপমান ও অসম্মানের হাত হতে মুক্ত করো নিজেদের। রণক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে, আর যারা পলায়ন করে প্রাণ বাঁচায় তারা প্রাণ মান কিছুই বাঁচাতে পারে না।

এই কথা বলতে বলতে ট্রয়সৈন্যদের সম্মুখ সারির মাঝে হস্তত বর্শাটি সহসা নিক্ষেপ করলেন অ্যাগামেমনন। সে বর্শার আঘাতে আহত হলো পার্গেসাসপুত্র মীকুন নামে ঈনিসের জনৈক সহকর্মী। প্রিয়ামপুত্রের মত এক সমান মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত ছিল মীকুন ট্রয়বাসীদের। অ্যাগামেমননের বর্শাটিকে প্রতিহত করতে পারল না মীকুনের ঢাল। সে বর্শাফলক অবাধে মীকুনের উদরদেশের নিম্নভাগ আমূল বিদ্ধ করায় সশব্দে ভূতলশায়ী হলো মীকুন।

এই দৃশ্য দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ঈনিস দুজন গ্রীকবীরকে হত্যা করলেন। তাঁরা হলেন ক্রীথপ ও ওর্সিলোকাস। পাইলিয়ার বিশাল সমভূমিকে বিধৌত করে সে আলফিয়াস নদী বয়ে চলেছে সেই নদীতে জন্ম হয় তাদের পিতা ওর্সিলোকাসের। তিনি ছিলেন ধনী এবং ফেরী নগরীর অধিবাসী। এই ওর্সিলোকাসের পুত্র ডায়োসেসের ঔরসেই ক্রীথপ ও ওর্সিলোকাস নামে সমরকূশলী দুই পুত্রের জন্ম হয়। এই দুই পুত্র যৌবনাবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেনেলাস ও অ্যাগামেমননের অনুরোধে গ্রীক জাহাজে করে ইলিয়ামে একে ট্রয়যুদ্ধে যোগদান করে। মেষপালকের দ্বারা নিহত মেষাহরণরত সিংহশাবকদ্বয়ের মত ট্রয়বীর ঈনিসের দ্বারা নিহত হলো তারা। দীর্ঘ বলিষ্ঠ পাইনবৃক্ষের মত ভূপাতিত হলো তারা অকালে।

তাদের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করলেন মেনেলাস। উজ্জ্বল বর্ম ও অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় সম্মুখসারিতে এসে অস্ত্র নিক্ষেপে উদ্যত হলেন। এদিকে যাতে তিনি ঈনিসের দ্বারা নিহত হন তার জন্য শত্রুপক্ষের দিক হতে তাঁকে উত্তেজিত করছিলেন অ্যারেস। কিন্তু অ্যারেসের সে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো না। কারণ নেস্টরপুত্র অ্যান্টিলোকস ঈনিস ও মেনেলাস উভয়কে আক্রমণোদ্যত দেখে মেনেলাসের পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর সাহায্যের জন্য। তখন তার সম্মুখে দুই গ্রীকবীরকে মিলিত দেখে আক্রমণ করতে সাহস পেল না ঈনিস। এই অবসরে গ্রীসসৈন্যরা সদ্য নিহত মৃতদেহ দুটি সরিয়ে নিয়ে গেল অবাধে।

অতঃপর প্যাফ্লাগনিয়ার বীর যোদ্ধা পাইলমেনেসকে হত্যা করল গ্রীকরা। পাইলমেনেস যখন দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর রথের উপরে তখন তার বর্শার আঘাতে ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে দিলেন মেনেলাস আর সেই সঙ্গে অ্যান্টিলোকাস তাঁর সারথি মাইডন যখন রথে করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁকে হত্যা করলেন। অ্যান্টিলোকাস একটি ভারী প্রস্তরখণ্ড ছুঁড়ে মারতেই মাইডনের হাত থেকে গজরত্নখচিত রথাশ্বচালনাকারী বল্লাটি পড়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিলোকাস ছুটে এসে তরবারির দ্বারা এমনভাবে তাঁকে আঘাত করেন তার কপালে যে তিনি রথ থেকে রণক্ষেত্রের বালুমিশ্রিত মাটিতে পড়ে যান। অ্যান্টিলোকাস তখন মাইডনের রথাদুটিকে তাড়না করতেই তারা মাইডনের মৃতদেহটিকে রথচকক্রে পিষ্ট করে ছুটে চলে যায়।

এ দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না হেক্টর। একদল ট্রয়সৈন্যসহ এগিয়ে এলেন তিনি সম্মুখ সারিতে। ভীষণাকৃতি এক বর্শা হাতে অ্যারেস ও রথচামুণ্ডা মূর্তিতে দেবী এথেনও উৎসাহ দিতে লাগলেন তাদের।

হেক্টর ও ট্রয়সৈন্যদের বেগে ধাবিত হতে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন ডায়োমেডিস। অবারিত কোন সমতল প্রস্তরভূমি অতিক্রম করতে করতে সহসা দূরতিক্রম্য এক স্রোতস্বিনী নদী দেখে ভীত হয়ে পড়ে যেমন পথিক, স্তব্ধ হয়ে যায় তার গতি, ঠিক ডায়োমেডিসও তেমনি দীর্ঘক্ষণ ধরে যুদ্ধ করতে করতে বহু শত্রুসৈন্য অবাধে হত্যা করে অকস্মাৎ এক দূরতিক্রম্য বাধার সম্মুখীন হলেন। অগ্রগমন হতে বিরত হয়ে তিনি তাঁর সহকর্মীদের সম্বোধন করে বললেন, বন্ধুগণ, বীর হেস্টরের অব্যর্থ বর্শাচালনার কথা কে না জানে? তাছাড়া মানুষের ছদ্মবেশে কোন দেবতা রক্ষা করে চলেছেন তাঁকে। সুতরাং ট্রয়সৈন্যদের উপর দৃষ্টি রাখা সত্ত্বেও তোমরা পশ্চাদপসরণ করো আপাতত, কারণ দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ্য ও সঙ্গতি আমাদের নেই।

ডায়োমেডিস-এর কথা শেষ হতে না হতেই আরও নিকটস্থ হলো হেক্টরের নেতৃত্বাধীন ট্রয়সৈন্যরা। গ্রীকদের নিকটস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রথারূঢ় দুই গ্রীকবীর মেনেসথেস ও অ্যাঙ্কিয়ালাসকে হত্যা করল। তেলামনপুত্র অ্যাজাক্স শোক প্রকাশ করতে লাগল তাদের পতনে। তারপর তার বর্শার দ্বারা মেনেলাসপুত্র ট্রয়বীর অ্যাফিয়াসকে আঘাত করল। অ্যাফিয়াস ছিল একজন ধনী চাষী; তার প্রচুর শস্যক্ষেত ছিল। কিন্তু সব ফেলে প্রিয়ামকে সাহায্য করার জন্য ট্রয়যুদ্ধে যোগদান করেছিল সে। অ্যাজাক্সের বর্শা তার কোমরবন্ধনী ভেদ করে তার উরুদেশ বিদ্ধ করতেই পড়ে গেল সে। অ্যাজাক্স তখন ছুটে গিয়ে তার বুকের উপর পা দিয়ে তার গাত্রদেশ হতে বর্ম খুলে নেবারও চেষ্টা করল। কিন্তু ট্রয়বীরেরা বর্শাবৃষ্টি করতে করতে চারদিক হতে ছুটে আসার ফলে আর সেখানে দাঁড়িতে থাকতে পারল না অ্যাজাক্স।

এইভাবে যুদ্ধের গতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল দুই পক্ষের মধ্যে। এবার হেরাকলসপুত্র নিপোলিমাস এগিয়ে আসতে বাধ্য হলেন সার্পেডনের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। দুজনের কাছাকাছি হলে নিপোলিমাস কথা বললেন প্রথমে, সার্পেৰ্ডন লাইসিয়া জাতির পালনকর্তা ও পরামর্শদাতা শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে খ্যাত। তুমি কেন এলে এই যুদ্ধক্ষেত্রে। যারা বলে তুমি জিয়াসের ঔরসজাত তারা মিথ্যা কথা বলে, কারণ জিয়াসপুত্রের সঙ্গে আকৃতির দিক হতে কোন সাদৃশ্যই নেই তোমার। আমার পিতা হেরাকলস ছিলেন জিয়াসের ঔরসজাত মানবসন্তান। তিনি ছিলেন যথার্থ বীর আকৃতি ও প্রকৃতি উভয় দিক হতে। তিনি মাত্র ছয়টি অর্ণবপোত আর অল্পসংখ্যক অনুচরবর্গসহ লাওমীডনের অশ্বের সন্ধানে এখানে এসে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যান সমগ্র ইলিয়াম নগরীর পথ ঘাট ও প্রাসাদ অট্টালিকা। তুমি হচ্ছ প্রকৃতপক্ষে একজন কাপুরুষ। তোমার জনগণ আর তোমায় চায় না। তুমি লাইসিয়া দেশ হতে এলেও ট্রয়বাসীদের কোন উপকার সাধন করতে পারবে না তুমি। কারণ শীঘ্রই তুমি আমার হাতে পরাস্ত হয়ে নরকের দ্বারে উপস্থিত হবে।

লাইসিয়া জাতির অধিনায়ক সার্পেডন তখন উত্তর করলেন, নিপোলিমাস, তোমার পিতা ইলিয়াম নগরী ধ্বংস করেন তার কারণ এই যে নির্বুদ্ধিতাবশত লাওমিডন কাজ করিয়ে নিয়ে একজনকেও তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেয় নি। যে অশ্বের জন্য তোমার পিতা বহুদূরদেশ হতে আগত হন সে অশ্ব তাকে দেয় নি সে। কিন্তু তা বলে তোমার পরিত্রাণ নেই। তোমাকে আমার হাতে মরতেই হবে। তোমার সব গৌরব আমি লাভ করব আর তোমাকে নরকে গমন করতে হবে।

এইভাবে কথা বলতে বলতে দুজনে দুটি বর্শা নিক্ষেপ করল একই সঙ্গে। সার্পেডনের বর্শাটি নিপোলিমাসের গলদেশ বিদ্ধ করে তার মৃত্যু ঘটাল আর নিপোলিমাসের বর্শাটি সার্পেডনের বাম উরু ভেদ করে সেখানকার সব অস্থি চূর্ণ করে ফেলল। কিন্তু তার দেবপিতার মধ্যস্থতায় তার মৃত্যু ঘটল না এই ভয়ঙ্কর আঘাত সত্ত্বেও।

ট্রয়সৈন্যরা আহত সার্পেৰ্ডনকে আর গ্রীকসৈন্যরা নিপোলিমাসের মৃতদেহ দ্রুত সরিয়ে নিয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্র হতে। ওডিসিয়াস তা দেখে এগিয়ে এলেন বীরবিক্রমে। প্রথমে বুঝে উঠতে পারলেন না, জিয়াসপুত্র আহত সার্পেৰ্ডন বা তার দলভুক্ত সৈন্যদের হত্যা করবেন তিনি। কিন্তু সার্পেডনের মৃত্যু তখন বিধিনির্দিষ্ট ছিল না বলে তিনি তাঁর দলভুক্ত সৈন্যদের আক্রমণ করে কোরানাস অ্যালাস্টার, ক্রোমিয়াম, অ্যানিয়াসদ্রাস, হ্যাঁলিয়াস, নিওমান ও প্রাইট্যানিসকে হত্যা করলেন অল্পকালের মধ্যে। তিনি হয়ত আরও অনেককেই হত্যা করতেন যদি না ট্রয়বীর হেক্টর তার দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে না আসতেন তাঁর প্রতিরোধ করার জন্য। হেক্টরকে দেখে ভূতলশায়ী আহত সাড়েন কাতরভাবে বললেন, আমাকে তুমি তোমাদের নগরপ্রাচীরের মধ্যে নিয়ে যাও। এখানে থাকলে গ্রীকরা আমরা লাঞ্ছিত করবে। আমি যখন আর আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্রের কাছে ফিরে যাতে পারব না তখন তোমাদের ট্রয়নগরীর মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।

সেকথার কোন উত্তর দান না করে একই সঙ্গে বহু গ্রীকসৈন্য নিধন করার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন হেক্টর। এদিকে তখন আহত সার্পেডনকে ট্রয়সৈনরা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি বিশাল ওকগাছের তলদেশে স্থাপন করলেন। সার্পেডনের বন্ধু সহকর্মী সেনাগণ তার উরুদেশ হতে বর্শাটি সজোরে উৎপাটিত করতেই যন্ত্রণায় মূচ্ছিত হয়ে পড়ল সার্পেড়ন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একঝলক উত্তুরে শীতল বাতাস প্রবাহিত হতেই তার প্রাণপ্রদায়িনী স্পর্শে মূৰ্ছাভঙ্গ হলো সার্পেডনের।

হেক্টর ও অ্যারেসকে সম্মুখ সারিতে দেখেও ভয়ে পশ্চাদপসরণ করল না গ্রীকসৈন্যরা বরং অ্যারেস ও হেক্টরের হাতে প্রাণবলি দেবার জন্য যারা এগিয়ে এসে মুত্যুবরণ করলেন তাঁরা হলেন প্রসিদ্ধ সারথি ওরেস্টন, টেনাস, ইটোরিয়ার বীর যোদ্ধা ট্রেকাস, ঈনোমাস, হেলেনাস ও ওরেসিয়াস। এদের মধ্যে ওরেসিয়াস বেফিনিসয়ানদের তীরবর্তী এক উর্বর ভূখণ্ডে বাস করতেন এবং তিনি সর্বাপেক্ষা ধনী ছিলেন এঁদের মধ্যে।

গ্রীকসৈন্যদের ব্যাপকভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলেন দেবী হেরা। তিনি তখন এথেনকে ডেকে বললেন, হায় জিয়াসকন্যা, মেনেলাস ইলিয়ামনগরী ধ্বংস না করে দেশে ফিরবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি আমরা তাকে দিয়েছিলাম সে প্রতিশ্রুতি ততদিন কিছুতেই কার্যকরী হবে না যতদিন অ্যারেস থাকবে ট্রয়বাসীদের সঙ্গে। সুতরাং এই মুহূর্তে আমাদের যেতে হবে ওখানে।

এথেন বাধা দিলেন না হেরাকে। হেরার সহচরী হেরি কালবিলম্ব না করে তাঁর স্বর্ণ ও রজতনির্মিত রথ প্রস্তুত করল। ইতিমধ্যে এথেন তাঁর বিচিত্র কারুকার্যখচিত বসনাঞ্চলখানিকে তাঁর পিতা দেবরাজ জিয়াসের সিংহাসনের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে তাতে ছুঁইয়ে নিলেন। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার মানসে জিয়াসের কোমরবন্ধনীটি ধারণ করলেন। দ্বন্দ্ব, শক্তি ও শঙ্কার প্রতীকচিহ্ন সমন্বিত একটি দণ্ড স্কন্ধে তুলে নিলেন। এক হস্তে ধারণ করলেন দানব গর্জনের ভীতিসঞ্চারকারী মুণ্ড। মাথায় পরলেন চারটি পালক ও শতনগরীর চিত্রখচিত এক আশ্চর্য মুকুট। আর এক হস্তে একটি ভয়ঙ্কর বর্শা ধারণ করে রথে আরোহণ করলেন এথেন। অশ্বচালনা করতে লাগলেন হেরা। রথ চলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে উন্মুক্ত হয়ে গেল স্বর্গের দ্বার। দিবারাত্রির প্রহরগুলো অবিরাম প্রহরায় সততনিযুক্ত থাকে সে দ্বারপাশে। সেই দ্বারদেশ সতত অবরুদ্ধ থাকে নিয়তনিবিড় মেঘমালায়। একমাত্র কোন দেবতার আদেশে বা নির্দেশেই সে মেঘমালা অপসারিত হয় এবং উন্মুক্ত হয় সে দ্বারদেশ।

দেবী হেরার স্বর্ণরথ স্বর্গদ্বার অতিক্রম করে শূন্য আকাশমণ্ডলে উড্ডীন হতেই তিনি ঊর্ধ্বলোকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন অলিম্পাস পর্বতের স্বর্ণশিখরদেশে একাকী উপবিষ্ট রয়েছেন দেবরাজ জিয়াস। সেইদিকে রথ চালনা করে তার সমীপে গিয়ে হেরা বললেন, হে দেবপিতা, তুমি কি এখনো ক্রুদ্ধ হও নি অ্যারেসের প্রতি তার অপকর্ম কি এখনো চোখে পড়ে নি তোমার? দেখ আজ তারই প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় কত গ্রীকবীর অকারণে নিহত হয়েছে। আর তাই দেখ অ্যাফ্রোদিতে ও অ্যাপোলো আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উন্মাদ অ্যারেসকে নতুন করে উত্তেজিত করছে এই অপকর্মসাধনে। আমি আশা করি, যদি আমি সেখানে গিয়ে যুদ্ধোন্মাদ অ্যারেসকে শিক্ষা দিয়ে তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে বার করে দিই তাহলে আমার উপর ক্রুদ্ধ হবে না তুমি। জিয়াস বললেন, এথেনকে পাঠাও। কারণ সে-ই সবচেয়ে ভাল অন্যায়কারীকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করতে পারে।

জিয়াসের কথামত কাজ করলেন হেরা। রথের অশ্বদুদিকে প্রহার করে তাড়না করতেই আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী বায়ুমণ্ডলে ঝাঁপ দিল হেরার স্বর্ণরথ। অবাধ অন্তহীন বায়ুর সমুদ্র সন্তরণ করতে করতে রথটা নিচের দিকে নামতে লাগল। অবশেষে ট্রয়নগরীর উপকণ্ঠে উপনীত হলো সে রথ। সেখানে সাইময় ও স্কামান্দার নামে দুটি নদী মিলিত হয়ে একটি বিস্তীর্ণ জলরাশিতে পরিণত হয়েছে সেখানে রথ থামিয়ে নদী দুটিকে আপন রথে তুলে নিলেন হেরা। এক ঘন মেঘাবরণ ঢেকে রাখলেন তাদের। হেরার আদেশে সেই রথের মধ্যে এক পবিত্র জলধারার সৃষ্টি করল এবং সেই জল পান করে তৃপ্ত হলেন দেবী হেরা। তারপর আবার দুই দেবী হেরা ও এথেন বায়ুস্তর অতিক্রম করে উড়ে যেতে লাগলেন গ্রীক শিবিরাভিমুখে ডায়োমেডিসকে কেন্দ্র করে যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রীকবীর সমবেত হয়েছেন এবং যেসব গ্রীকবীরের শক্তি ও সহিষ্ণুতায় সর্বাগ্রগণ্য, সেইখানে হেরা গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, হে গ্রীকবীরগণ, তোমাদের বীরত্ব কেবল বাহ্যত, কার্যত তোমরা হীন কাপুরুষ। তোমাদের লজ্জাবোধ করা উচিত। যতদিন পর্যন্ত বীর অ্যাকেলিস যুদ্ধে রত ছিলেন ততদিন ট্রয়বাসীরা তাঁর ভয়ে দার্দানীয় দুর্গের বাইরে আসতে সাহস পেত না। কিন্তু আজ তারা অকুতোভয়ে তোমাদের উপকূলবর্তী অর্ণবপোতগুলোতে প্রবেশ করে যুদ্ধ করছে।

হেরা যখন এইভাবে তপ্তবাক্যে অনুপ্রাণিত করছিলেন গ্রীকবীরদের, এথেন তখন নিঃশব্দে চলে গেলেন ডায়োমেডিস-এর কাছে। রথ হতে অবতরণ করে ডায়োমেডিস তখন তার দেহে প্যান্ডারাসকৃত ক্ষতস্থানগুলোর শুশ্রূষা করছিলেন। ক্ষতবিক্ষত বাহুতে ভারী ধাতব ঢালটি দীর্ঘক্ষণ ধারণ করে থাকায় দ্বিগুণীকৃত বোধ হচ্ছিল ক্ষতস্থানের ব্যথা। যন্ত্রণায় কাত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। দেবী এথেন তখন তাঁর রথপার্শ্বস্থ ভূমির উপর দাঁড়িয়ে তাকে সম্বোধন করতে বলতে লাগলেন, হে টাইডেউসপুত্র, তুমি তোমার পিতার মত হও নি। টাইডেউস আকারে খর্বাকৃতি হয়েও আমার নিষেধ অমান্য করে শনিধন মানসে বেগে ধাবিত হতেন সব সময়। একবার তিনি থবস নগরীতে একা নিরস্ত্র অবস্থায় বহু কীডমন জাতির যুবক শত্রুকে হত্যা করেন। তাঁর সেই অসমসাহসিকতার জন্য আমি সাহায্য করেছিলাম তাকে। আজ আমি তোমাকেও সাহায্য করার মানসে তোমার পার্শ্বে উপস্থিত হয়েছি এবং তোমাকে ট্রয়সৈন্যদের সঙ্গে অক্লান্তভাবে যুদ্ধ করার জন্য আদেশ দিচ্ছি। কিন্তু তোমাকে মনে হচ্ছে হয় তুমি ক্লান্ত না হয় তুমি ভীত ও সন্ত্রস্ত, অথবা হতোদ্যম হয়ে পড়েছ। এই কারণেই আমি তোমাকে বলছি তুমি বীর টাইডেউসের আসল সন্তান নও। ডায়োমেডিস উত্তর করলেন, হে দেবী, আমি জানি, তুমি জিয়াসকন্যা এথেন। তবে শোন আমি ক্লান্ত বা ভীত নই। আমি হতোদ্যম হয়েও পড়িনি। আমি শুধু তোমার পূর্বপ্রদত্ত নির্দেশ পালন করে চলেছি অক্ষরে অক্ষরে। তুমি একবার আমায় বলেছিলে একমাত্র কামদেবী অ্যাফ্রোদিতে ব্যতীত আর কোন দেবতার সঙ্গে যেন যুদ্ধ না করি। এখন যেহেতু রণদেবতা অ্যারেস স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে আমাদের শত্রুসৈন্যদের চালনা করছেন, সেই হেতুই আমি আপাতত যুদ্ধে বিরত হয়ে আমার সহকর্মী গ্রীক সৈন্যদের এখানে সমবেত হবার আদেশ দান করেছি।

এথেন বললেন, শোন টাইডেউসপুত্র ডায়োমেডিস, অ্যারেসকে আর মোটেই ভয় করবে তা তুমি, কারণ আমি বন্ধু হিসেবে সাহায্যে আশ্বাস দান করেছি। শুধু তাই নয়, তুমি সরাসরি অ্যারেসের সন্নিকটস্থ হয়ে ক্রোধোন্মাধ, মূর্তিমান শয়তানটাকে সম্মুখসমরে আঘাত করবে। সম্প্রতি সে আমার মাতা দেবী হেরাকে গ্রীকদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দান করেছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি। সে এখনো পর্যন্ত ট্রয়বাসীদের সাহায্য করে চলেছে।

ডায়োমেডিস-এর রথ হতে সারথি স্থেনেলাসকে সরিয়ে দিয়ে নিজে তার জায়গায় ডায়োমেডিস-এর পাশে বসে বল্পা ধারণ করে রথ চালনা করতে লাগলেন দেবী এথেন। অনতিকালমধ্যে রথ নিয়ে উপস্থিত হলো ভয়াবহ রণদেবতা অ্যারেসের সন্নিকটে। প্যালাস এথেন দেখলেন, অ্যারেস তখন ভূতলশায়ী ট্রয়বীর পেরিফাসের নিস্পন্দ দেহটিকে বর্মমুক্ত করছেন। ওরেসিয়াসপুত্র পেরিফাস ছিলেন ইটোলিয়াবাসীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। মৃত্যুর দেবতা হেডস-এর শিরস্ত্রাণ মস্তকে পরিধান করে থাকায় দেবী এথেনকে চিনতে পারলেন না রক্তাক্ত অ্যারেস। তিনি শুধু রথোপরি উপবিষ্ট ডায়োমেডিসকেই দেখতে পেলেন। পেরিফাসের দেহটিকে সেইভাবে ফেলে রেখে তৎক্ষণাৎ ডায়োডেমিস-এর দিকে এগিয়ে এলেন অ্যারেস। কিন্তু অ্যারেসের হস্তনিক্ষিপ্ত বর্শাটি ডায়োমেডিস-এর অঙ্গ স্পর্শ করার আগেই আপন হস্তে ধারণ করে রথের উপর দিয়ে সেটিকে দূরে ফেলে দিলেন এথেন। এবার ডায়োমেডিস যে বর্শাটি নিক্ষেপ করলেন অ্যারেসকে লক্ষ্য করে সেটি এথেন ঠিকপথে চালনা করায় তা অ্যারেসের কোমরবন্ধী ভেদ করে তার পাকস্থলীতে আঘাত করল। সমবেত সহস্র মানুষের মত এমন সুতীব্রভাবে গর্জন করতে করতে স্বর্গোদ্দেশে রওনা হলেন অ্যারেস, দেখে মনে হলো তাপপ্রবাহে উত্তপ্ত কোন বিশাল কৃষ্ণ-মেঘরাশি গর্জনরত অবস্থায় দিগন্ত হতে ঊর্ধ্ব আকাশে উক্রমণ করছে।

দ্রুতবেগে আকাশপথে উক্রমণ করে অলিম্পাস শিখরস্থ জিয়াস সমীপে উপস্থিত হলেন আহত অ্যারেস। মরণশীল মানুষের আঘাতে তার অমর দেবদেহের শিরা হতে যে পবিত্র রক্ত ক্ষরিত হচ্ছে তা দেবরাজ জিয়াসকে দেখিয়ে বললেন, হে দেবপিতা জিয়াস, তুমি কি এখনো চুপ করে থাকবে? আমরা যে সব দেবতা মানুষদের সাহায্য করছি তাদের বিপদে তারা মানুষদের হাতে কত লাঞ্ছনা, কত দুঃখ ভোগ করছে তা তুমি দেখবে না? আমাদের সকলের একমাত্র অভিযোগ তোমার কাছে, তোমার উন্মাদিনী কন্যা এথেনই মানুষদের এই সব অপকর্মসাধনে প্ররোচিত করছে। আমরা ও অন্যান্য দেবতারা তোমার আদেশ মেনে চলি, অন্যথায় সমুচিত শাস্তি ভোগ করি। কিন্তু তার কোন অপকর্মের জন্য কোন শাস্তিই দাও না তাকে। কিন্তু একবার ভাল করে শোন কিভাবে সে গর্বিত ডায়োমেডিসকে প্ররোচিত করে একের পর এক করে দেবতাদের তার অকারণ ক্রোধের শোচনীয় শিকারে পরিণত হচ্ছে। প্রথমে দেবী অ্যাফ্রোদিতের বাহুতে আঘাত করে, পরে সে দেবোপম ঔদ্ধত্যে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকেও আঘাত করে। আমি যদি এখানে পালিয়ে না আসতাম তাহলে আমাকে সেখানে আরও অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করতে হত এবং তার বর্শার আঘাতে জীবন্ত অবস্থায় কাল যাপন করতে হতো।

অ্যারেসের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিয়াস বললেন, আমার কাছে অভিযোগ জানাতে এস না। সকল দেবতার মধ্যে আমি তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি, কারণ তুমি সব সময় যুদ্ধবিগ্রহ আর মানুষের ক্ষতিসাধন করে বেড়াও। তুমি তোমার এই একগুঁয়ে অনমনীয় মনোভাব তোমার মাতা হেরার কাছ থেকেই লাভ করেছ। আর আজ তার জন্যই তোমার এই শোচনীয় অবস্থা। আমি শুধু তোমাকে একটু সংযত করতে পারি এবিষয়ে। যাই হোক, যেহেতু তোমার মা আমার ঔরসে গর্ভে ধারণ করে তোমাকে, সেইহেতু তোমাকে এইভাবে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ থাকতে দিতে পারি না। যদি তুমি অন্য কোন দেবতার সন্তান হতে তাহলে তোমার এই ধ্বংসাত্মক মনোভাবের জন্য আজ টিটানদের থেকেও অধিক অপমান সহ্য করতে হত তোমায়।

টিটানরা ছিল এক ধরনের দানবাকার নিসর্গ দেবতা। তাদের ধ্বংসাত্মক ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হয়ে তার্তারাস নামে নরকান্তর্গত এক অন্ধকার গর্ভে তাদের বন্দী করে রাখেন জিয়াস। দেববৈদ্য পীওনকে ডেকে অ্যারেসকে আরোগ্য করার আদেশ দিলেন জিয়াস। পীওন উপযুক্ত ওষধি প্রয়োগে নিরাময় করে তুললেন অ্যারেসের যন্ত্রণানিষিক্ত ক্ষতস্থান। ডুমুর গাছের তরল রস দুধকে যেমন ঘন করে তোলে তেমনি পীওনপ্রদত্ত ওষধি মুহূর্তে মধ্যে বন্ধ করে দিল অ্যারেসের রক্তক্ষরণ। তারপর শুশ্রূষাকারিণী দেবসেবিকা হেরি সেই ক্ষতস্থান প্রস্ফালন করে দিলেন সযত্নে। তখন সুস্থ হয়ে জিয়াসের পাশে উপবেশন করলেন অ্যারেস।

এবার অ্যারেসের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ বন্ধ করতে পারায় অলিম্পাসে প্রত্যাবর্তন করলেন দেবী হেরা ও এথেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *