১৬. প্রচেষ্টা ও সমর্পণ

১৬. প্রচেষ্টা ও সমর্পণ

সুবৰ্ণ মধ্যম মতবাদ হিসাবে চিত্তাকর্ষক নয়, আমি মনে করতে পারি, যখন আমি তরুণ ছিলাম ঘৃণা এবং অবজ্ঞার সাথে এই মত বর্জন করেছিলাম, কারণ সেসব দিনে বীরোচিত চরম কিছুই ছিল আমার কাছে বরণযোগ্য। যা হোক সত্য সবসময় উৎসাহব্যঞ্জক হয় না এবং যে সব জিনিসকে বিশ্বাস করা হয় উৎসাহব্যঞ্জক বলে, বাস্তবে তাদের অনুকূলে তেমন কিছু প্রমাণ মেলে না। সুবর্ণ মধ্যম যে অনুৎসাহব্যঞ্জক মতবাদ এটা হয়তো একটি উদাহরণ, কিন্তু অনেক বড় ব্যাপারে এটা সত্য নীতি।

একদিকে প্রচেষ্টা, অন্যদিকে সমর্পণ– এই দুইয়ের ভারসাম্য রাখতে সুবর্ণ মধ্যমকে প্রয়োজনীয় বলে গ্রহণ করতে হবে। এই দুটি নীতিরই চরম সমর্থকরা রয়েছেন। সমর্পণ বা ভাগ্যকে বরণ করার নীতি প্রচার করেছেন সাধুপুরুষ ও অতীন্দ্রিয়বাদীরা। আর প্রচেষ্টা বা উদ্যমশীলতার নীতি প্রচার করেছেন দক্ষ কুশলী এবং পৌরুষদীপ্ত খ্রিস্টানেরা। এই দুই বিপরীত মতের প্রবক্তাদের নীতিতে খণ্ডিত সত্য আছে, পুরো সত্য নেই। আমি এই অধ্যায়ে একটা ভারসাম্য আনয়নের চেষ্টা করব এবং প্রচেষ্টার পক্ষকে সমর্থন করে শুরুটা করব।

সুখ, কয়েকটি দুর্লভ ক্ষেত্র ছাড়া, এমন জিনিস নয় যা শুধুমাত্র শুভ ঘটনার যোগাযোগ ছাড়া পাকা ফলের মতো মুখে এসে পড়বে। আর এই কারণেই আমি এই বইয়ের নাম রেখেছি সুখের সন্ধানে’। কারণ পরিহারযোগ্য এবং অপরিহানীয় দুর্ভাগ্যে, রোগ এবং মানসিক জটিলতায়, সংগ্রাম এবং দারিদ্র্যে এবং বিদ্বেষে ভরা, এই পৃথিবীতে যে পুরুষ ও নারী সুখী হতে চায়, তাকে প্রত্যেক মানুষ যে অসংখ্য রকম পথে সুখ খুঁজে বেড়ায় তার জন্যে সংগ্রাম করে যেতে হবে। খুব কমক্ষেত্রেই এর জন্যে বড় রকমের উদ্যোগ প্রয়োজন হতে পারে। সহজ স্বভাবের লোক, যে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক ধন-সম্পদ অর্জন করেছে, যার স্বাস্থ্য ভাল, রুচি উন্নত, সে জীবনকে খুব আরামের সাথে উপভোগ করতে পারে এবং চারপাশের জীবনসংগ্রামের গোলমা দেখে অবাক হয়ে তার কারণ খুঁজে বেড়ায়। সুন্দরী আরামপ্রিয় রমণী যদি এমন কোন ধনবান পতিকে বরণ করে, যে তার কাছে কোনও আয়াসসাধ্য কাজ চাইবে না এবং বিয়ের পর যদি চর্বি বৃদ্ধিতে কোনও আপত্তি না করে, তাহলে সেও এক ধরনের অলস আরাম উপভোগ করবে, যদি অবশ্য তার সন্তানের বিষয়ে সৌভাগ্য থাকে। অধিকাংশ লোক ধনী নয়, অনেক ভাল স্বভাব নিয়ে জন্মায় না, অনেকের অস্বস্তিজনক সব প্রবৃত্তি থাকে, তার কাছে শান্ত এবং সুনিয়ন্ত্রিত জীবন অসহনীয় রকমের একঘেয়ে মনে হয়। স্বাস্থ্য হচ্ছে আশীর্বাদ কিন্তু তা রক্ষা করা যাবেই এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। বিয়ে অবধারিতভাবে পরম সুখের উৎস নয়। এইসব কারণে অধিকাংশ নারী-পুরুষের জন্যে সুখ অবশ্যই একটি সফল অর্জন। দেবতার দান নয় এবং এই অর্জনে অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী উভয়েরই প্রচেষ্টা একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্তর্মুখী প্রচেষ্টার মধ্যে সমর্পণের প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তাই আপাতত আমরা বহির্মুখী প্রচেষ্টার কথা বিবেচনা করেছি।

যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রে, পুরুষ অথবা নারী, যাদের জীবিকার জন্যে কাজ করতে হয় তাদের এ সম্পর্কে প্রচেষ্টার প্রয়োজন এমনই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে তার ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা সত্য যে ভারতীয় ভিক্ষুকরা বিনা প্রচেষ্টায় ধর্মভীরু মানুষের সামনে শুধু ভিক্ষাপাত্রটি এগিয়ে দিয়েই জীবিকার সংস্থান করতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশসমূহে শাসক-কর্তৃপক্ষ এ ধরনের উপার্জনকে ভাল দৃষ্টিতে দেখে না। তা ছাড়া এই কাজটিকে উষ্ণ এবং শুষ্ক জলবায়ুর দেশে যেমন আরাম দেয়, সেসব দেশে তা নয়। শীতকালে, যে কোনওভাবে খুব কম লোক পাওয়া যাবে যারা গরম ঘরের কাজ ফেলে বাইরে অলসভাবে ঘুরে বেড়াবে। সুতরাং পশ্চিমী দেশে শুধু সমর্পণ সৌভাগ্যের অনেক পথের মধ্যে একটি নয়।

পাশ্চাত্যের দেশসমূহে অনেক মানুষের সুখের জন্যে যা প্রয়োজন তার চেয়ে কিছু অতিরিক্ত অর্থের চাহিদা থাকে। কারণ তা তাদের কাছে সাফল্যের অনুভূতি তৈরী করে। কোনও কোনও পেশায় যেমন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই অনুভূতি বেশি উপার্জনশীল নয় এমন লোকের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ পেশায় উপার্জনের পরিমাণকে সাফল্যের মানদণ্ডরূপে ধরা হয়। এইখানে আমরা এমন একটি প্রসঙ্গকে স্পর্শ করেছি যার সম্পর্কে প্রায় ক্ষেত্রেই কিছু সমর্পণের উপাদান বাঞ্ছনীয়। কারণ এই প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে বড় ধরনের সাফল্য শুধু অল্পসংখ্যক লোকের পক্ষেই মাত্র সম্ভব।

বিবাহ এমন একটা বিষয় যার সম্পর্কে প্রচেষ্টার প্রয়োজন হতেও পারে অথবা নাও হতে পারে। যেখানে একটি লিঙ্গ যদি সংখ্যালঘু হয়, যেমন ইংল্যান্ডে পুরুষ এবং অষ্ট্রেলিয়ায় নারী, তা হলে সেই সংখ্যালঘুদের ইচ্ছানুযায়ী বিবাহের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই কম প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। আর যে লিঙ্গের সদস্যরা সংখ্যাগুরু তাদের বেলায় বিপরীতটাই সত্যি। মেয়েরা সংখ্যাগুরু হলে তারা যে পরিমাণ প্রচেষ্টা ও চিন্তা এই বিষয়ে ব্যয় করে, তা নারী বিষয়ক সাময়িকীতে যেসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় তা চর্চা করলেই সহজে বোঝা যাবে। যেখানে পুরুষরা সংখ্যাগুরু সেখানে তারা প্রায়ই খুব তাড়াতাড়ি কাজ হয় এমন পথ খুঁজে নেয় যেমন রিভলবার চালনায় দক্ষতা। এটা খুব স্বাভাবিক, কারণ সংখ্যাগুরু পুরুষরা এখন সভ্যতার প্রান্তসীমায় রয়ে গেছে। যদি কোনও মহামারী পক্ষপাতিত্ব করে ইংল্যান্ডের পুরুষদের সংখ্যাগুরুতে পরিণত করে, তাহলে তারা কী করবে জানি না, হয়তো তারা প্রাচীন প্রেমিক বীরদের পথ অবলম্বন করবে।

সন্তানদের যথার্থভাবে মানুষ করে তুলতে যে পরিমাণ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় তা এমনই সুস্পষ্ট যে কেউ তা অস্বীকার করবে না। যেসব দেশ সমর্পণে বিশ্বাসী এবং যাকে ভুল করে জীবনের প্রতি আধ্যাত্মিক দর্শন বলা হয়ে থাকে, যেসব দেশে শিশু মৃত্যুর হার খুব বেশি, ওষুধ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, নির্বীজকরণ, উপযুক্ত পথ্য এইসব জিনিস পার্থিব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পাওয়া যায় না। এসব লাভ করতে হলে প্রয়োজন বস্তুগত পরিবেশের দিকে শক্তি ও বুদ্ধিচালনা। যারা মনে করে বস্তুমাত্রই মায়া, তারা আবর্জনাকেও তাই মনে করে এবং এভাবে চিন্তা করতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর কারণ ঘটায়।

আরো সাধারণভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যাদের স্বাভাবিক বাসনা পুষ্টির অভাবে শুকিয়ে যায়নি, তাদের প্রত্যেকের স্বাভাবিক এবং ন্যায্য উদ্দেশ্যের মূলে রয়েছে কোনও শক্তি। মানুষ কোন শক্তিটি কামনা করবে তা নির্ভর করে তার সবচেয়ে প্রাধান্যকারী আসক্তির ওপর। কোনও মানুষ শক্তি কামনা করে অন্য মানুষের কাজের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে। আরেকজন কামনা করে অন্যের চিন্তার ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে, তৃতীয়জনের কামনা অন্যের আবেগের ওপর। একজন চাইছে বস্তুগত পরিবেশকে পরিবর্তন করতে, অন্যজনের কামনা বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ। জনকল্যাণকর প্রতিটি কাজের সাথে কোনও একটি মুক্তির কামনা বিজড়িত, যদি না এই উদ্দেশ্য সামলে রেখে দুর্নীতির সাহায্যে অর্থলাভ করা একমাত্র লক্ষ্য না হয়, তা হলে এই কথা সত্যি যে লোকটি মানুষের দুর্দশার অকৃত্রিম মানবতাবোধ জাত বেদনা থেকে কর্ম প্রেরণা লাভ করছে, তার দুঃখবোধ যদি বিশুদ্ধ হয়, তা হলে সে মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্যে ক্ষমতা কামনা করবে। একমাত্র যে মানুষ ক্ষমতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন সে তার সহমানুষ সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ উদাসীন। সুতরাং যেসব মানুষের সহযোগিতায় উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে, তাদের কর্মপদ্ধতির ভিতর কোনও কোনও ধরনের ক্ষমতার জন্যে কামনা থাকবেই এবং এটাকে স্বীকার করে নিতে হবে। ক্ষমতা কামনার প্রত্যেকটি ধরণ যেখানে জড়িত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ব্যর্থ হয়, তা হবে পারস্পরিক সমন্বয়ের একটি প্রচেষ্টা। পাশ্চাত্য দেশের মানসিকতায় এই উপসংহার খুব সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু পাশ্চাত্যে এমন লোকেরও অভাব নেই যারা ভান করছে, যাকে বলা হয় প্রাচ্যবিজ্ঞতা’ তা পাওয়ার জন্যে যে মুহূর্তে প্রাচ্যই তা পরিত্যাগ করেছে। সম্ভবত তাদের কাছে আমরা যা বলছি তা সন্দেহমুক্ত নয় এবং তাই যদি হয় তা হলে আমাদের বলাটা যথার্থ।

সুখের অধিকার অর্জনে সমর্পণেরও একটা ভূমিকা আছে। প্রচেষ্টার ভূমিকার চেয়ে তার গুরুত্ব কম নয়। বুদ্ধিমান লোক পরিহারক দুর্ভাগ্যের সামনে বসে না থাকলেও অবধারিত দুর্ভাগ্য এড়াতে সময় এবং আবেগ নষ্ট করবে না এবং যেসব দুর্ভাগ্য নিজে থেকেই পরিহারযোগ্য, তা পরিহার করতে যদি আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে নির্ধারিত সময় নষ্ট হয়, তা হলে তা পরিহার না করে বরং তা সহ্য করে যাবে। এমন অনেক লোক আছে যারা পছন্দ না হলে প্রত্যেকটি তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঝামেলা করে এবং যে শক্তি প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো যেত তা এইভাবে নষ্ট করে। এমনকী কাজ অত্যন্ত ব্যর্থতার চিন্তা সবসময় মনের শান্তিকে বিনষ্ট করতে থাকে। খ্রিস্টান ধর্ম ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের কাছে নিজেকে অর্পণ করার কথা বলেছে। এমনকী যারা এই বাগ-বৈশিষ্ট্য মেনে নিতে পারে না তাদের জন্যেও তাদের সবরকম কাজকে ব্যাপ্ত করে ঐরকম কিছু থাকা উচিত। কোনও ব্যবহারিক কাজে যে কর্মদক্ষতা প্রয়োজন তার অনুপাত, যে পরিমাণ আবেগ তাতে দেওয়া হয় তার সমান নয়। প্রকৃতপক্ষে আবেগ অনেক সময় কর্ম দক্ষতার প্রতিবন্ধক। যে মনোভাব দরকার তা হল নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করব কিন্তু ফল ছেড়ে দেব ভাগ্যের হাতে। সমর্পণ বা ভাগ্য বরণ দুরকমের একটির মূলে হতাশা, অন্যটির মূলে অদম্য আশা। প্রথমটি খারাপ, দ্বিতীয়টি ভাল। চরমভাবে পরাজিত হয়ে যে লোক বড় কিছু লাভ করার আশা পরিত্যাগ করেছে সে হতাশাজনিত সমর্পণ শিখতে পারে এবং যদি সে তা করে তাহলে সে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে দেবে। যে তার হতাশাকে ধর্মীয় নীতিকথায় ঢেকে রাখতে পারে অথবা তার হতাশাকে, তত্ত্বভাবনাই মানুষের যথার্থ লক্ষ্য–এই নীতির ছদ্মবেশে আড়াল করতে পারে। কিন্তু সে তার অন্তর্হিত পরাজয়কে যেভাবেই আড়াল করুক সে সাধারণভাবে অনুপযুক্ত এবং নীতিগতভাবে অসুখী হয়ে থাকবে। যে মানুষের সমর্পণ অদম্য আশার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার কর্মধারা আলাদা। যে আশা অপরাজেয় তাকে বৃহৎ এবং নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। আমার ব্যক্তিগত কার্যসূচি যাই হোক, আমি মৃত্যুর হাতে পরাজিত হতে পারি অথবা কোনও রোগের কাছে। আমার শত্রুরা আমাকে পরাস্ত করতে পারে। কাজ করতে গিয়ে হয়তো দেখা গেল এমন একটা অজ্ঞানতার পথে আমি এগিয়েছি যাতে সফল হতে পারব না। এইভাবে হাজার রকম উপায়ে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত আশার ব্যর্থতা অবধারিত হতে পারে কিন্তু যদি ব্যক্তিগত আশা, মানবজাতির কোনও বড় আশার অংশ হয়, তা হলে ব্যর্থ হলেও তাতে সম্পূর্ণ পরাজয়ের ভাব থাকবে না। যে বৈজ্ঞানিক নিজে কোনও বড় আবিষ্কারের কামনা করেন এবং বিষয়টির ওপর তার ব্যক্তিগত অবদান বড় না হয়, তা হলে নির্ভেজাল অহংভাবপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে যিনি গবেষণা করেন, তার নৈরাশ্যের তুলনায়, সম্পূর্ণ অন্যরকম হবে। বহু প্রয়োজনীয় কোনও সংস্কার সাধনের কাজ শেষ হল না এবং তিনি হয়তো এই কথাটি মেনে নিতে বাধ্য হবেন যে, তার জীবদ্দশায় আর একাজ তিনি করতে পারবেন না। কিন্তু যদি তার নিজের অংশগ্রহণ ছাড়াও মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আগ্রহ থাকে তাহলে তাঁর অসম্পূর্ণতার জন্যে পুরোপুরি নৈরাশ্যে ডুবে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

যেসব বিষয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছি তাতে সমর্পণ অত্যন্ত কঠিন। অন্য অনেক বিষয় আছে যাতে তা সহজ। এই বিষয়গুলি হচ্ছে যেখানে শুধু গৌণ উদ্দেশ্যগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু জীবনের প্রধান লক্ষ্যসমূহের সাফল্যের সম্ভাবনা বজায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনও লোক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও দাম্পত্য জীবনে অসুখী হওয়ার জন্যে মন বিক্ষিপ্ত থাকে, তা হলে তার পক্ষে বাঞ্ছিত সমর্পণ মেনে নিতে ব্যর্থতা দেখা দেবে। যদি তার কাজ সত্যি মন ভরে রাখার মতো হয়, তাহলে তার উচিত এই ধরনের সব আপতিক বাধাকে বৃষ্টির দিনের মতোই বিরক্তিকর মনে করা, কারণ এইরকম বিরক্তিকর বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়া বোকামি।

কোনও কোনও লোক ধৈর্যের সাথে সেইসব অসুবিধা সহ্য করতে পারে না, যা বাধা না পেলে আমাদের জীবনের একটা বড় অংশকে দখল করে রাখে। এরকম লোক গাড়ি ধরতে না পারলে ক্ষেপে যায় নৈশাহারের রান্না খারাপ হলে প্রচণ্ড রেগে যায়, চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হলে হতাশায় ডুবে যায়, পোশাক পরিচ্ছদ সময়মত স্টীমলড্রি থেকে ফিরে না আসলে সমস্ত শিল্প জগতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করে বসে। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে যে শক্তি নষ্ট হয়, তা যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগাতে পারলে একটা সাম্রাজ্য গড়া এবং ভাঙ্গার জন্যে যথেষ্ট। গৃহ পরিচারিকা যে ধুলা পরিষ্কার করেনি, রন্ধনকারী যে আলু সিদ্ধ করেনি, ঝাড়ুদার যে ঠিকমত ঝুল ঝাড়েনি বুদ্ধিমান লোক তা দেখেও দেখেন না। আমি বলতে চাই না যে তিনি এর প্রতিবিধান করেন না, সময় পেলে অবশ্যই করেন। আমি বলতে চাই যে, তিনি এসব আবেগ বর্জন করে করেন। উদ্বেগ, বিরক্তি ও উত্তেজনা এসব হল আবেগ যা কোনও উদ্দেশ্যই সিদ্ধ করে না। এসব যিনি প্রবলভাবে অনুভব করেন, তিনি হয়তো বলবেন, এসব আবেগ দমন করতে তিনি অপারগ এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, পূর্বে উল্লেখিত মৌলিক সমর্পণের চেয়ে অন্যকোনও কম প্রয়োজনীয় কিছুতে তাকে দমন করা যেতে না পারে। বড় নৈর্ব্যক্তিক আশা যা মানুষকে তার কাজে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা অথবা দাম্পত্য জীবনের দুঃখকে সহ্য করতে সক্ষম করে, তার সম্বন্ধে সেই একই প্রকার মনোযোগ তাকে গাড়ি ধরতে না পারার বা কাদায় ছাতা পড়ে যাওয়ার দুঃখেও ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেবে। তিনি যদি বদমেজাজি হন, তা হলে এর চেয়ে কম কিছুতে তার রোগ সারবে কিনা বলা কঠিন।

যে মানুষ সারাক্ষণ উত্তেজিত থাকেন, তাকে যদি উদ্বেগের সাম্রাজ্য থেকে উদ্ধার করা যায়, তাহলে তিনি জীবনকে অনেক বেশি আনন্দময় বলে নতুন করে খুঁজে পাবেন। পরিচিত বক্তিদের নিজস্ব যেসব আচরণ-বৈশিষ্ট্য এতকাল তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলত, এখন তার কাছে তা কৌতুকপ্রদ মনে হয়। যখন মিস্টার এ, তার টিয়েরা ডেল ফিউয়েগোর বিশপের পুরানো সত্য কাহিনীটি তিনশ সাতান্ন বার বিবৃত করা শেষ করবেন, তখন আর রেগে না গিয়ে শুধু কবার বলা হল তার সংখ্যা গুনে মজা পাবেন এবং পূর্বের মতো নিজের জানা কোনও কাহিনী বলার চেষ্টা করে বিষয় পরিবর্তনের বৃথা চেষ্টা করবেন না। যখন ভোরের গাড়ি ধরার তাড়ার সময় তার জুতোর ফিতে ছিঁড়ে যায়, তখন তা ঠিক করে নিয়ে তিনি ভাববেন এই বিপুলা পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনার বিশেষ কোনও গুরুত্ব নেই। যখন তিনি বিয়ের প্রস্তাবকালীন বিরক্তিকর কোন প্রতিবেশির আগমনে বাধাপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি ভাবেন মানুষমাত্রই এই ধরনের বিপত্তির সীমা নেই, যা আসে অদ্ভুত এবং বিচিত্র সাদৃশ্য এবং সমান্তরাল ঘটনা থেকে। আমার ধারণা প্রত্যেক নরনারীর মনে নিজের সম্পর্কে একটা ছবি তৈরী হয়ে আছে এবং যদি কোনও ঘটনা সেইসব নষ্ট করে তারা বিরক্ত হয়। এই বিরক্তি থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে শুধু একটি ছবি নয়, একটি পুরো চিত্রশালা তৈরী করে রাখা যাতে প্রয়োজনে যে ঘটনা উল্লেখ করা হল, তার উপযুক্ত একটিকে নির্বাচন করা যায়। যদি কোনও ছবি হাস্যকর মনে হয়, তবে আরো ভাল। নিজেকে সবসময় বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতো দেখা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়, নিজেকে সর্বক্ষণ কৌতুক নাটকের বিদূষক রূপে দেখার কথাও আমি বলছি না, কারণ যারা এমন করে তারা আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। অবস্থানুযায়ী উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে সামান্য কৌশল প্রয়োজন। অবশ্য যদি নিজেকে বিস্মৃত হয়ে আদৌ কোনও ভূমিকা গ্রহণ না করা হয় সেটা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু কোনও ভূমিকায় অভিনয় করা যদি দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে মনে করতে হবে স্থায়ী অভিনয়কারী কোনও নাট্যদলের অভিনেতারূপে এবং তাতেই একঘেয়েমিকে এড়ানো যাবে।

অনেক সক্রিয় লোকের মত হল, তাঁরা যে কর্মশক্তি এবং দৃঢ় সংকল্পের সাহায্যে সফল হন বলে মনে করেন, সেখানে তা বিন্দুমাত্র সমর্পণ এবং হাস্যরসের সামান্য ঝলকও তা নষ্ট করে দিতে পারে, এটা তাদের বিশ্বাস। এসব লোকেরা আমার মতে ভ্রান্ত। কাজের মূল্য আছে এমন কাজ তাঁরাও করতে পারেন, যারা কাজের গুরুত্ব অথবা সহজ-সাধ্যতার ধারণা নিয়ে আত্মপ্রতারণা করেন না। যারা শুধু আত্মপ্রতারণার সমর্থন পেলেই কাজ করতে পারেন, তাদের উচিত পেশাগত কাজ শুরু করার আগে সত্যকে সহ্য করার শিক্ষা আয়ত্ত করা। কারণ এখন না হয় পরে কোনও সময়, এই যে অবাস্তব ধারণার কারণে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা, তা তাদের কাজকে হিতকর না করে ক্ষতিকর করবে। ক্ষতি করার তুলনায় কিছু না করা ভাল। পৃথিবীর অর্ধেক প্রয়োজনীয় কাজ শুধু ক্ষতিকর কাজের সাথে যুদ্ধ করতেই নষ্ট হয়। বাস্তবের মূল্য বুঝতে কিছু সময় নষ্ট হলে প্রকৃতপক্ষে তা নষ্ট হয় এবং এরপর যে কাজ করা হবে তা যাদের কাজে বিরামহীন অহমিকার প্রেরণার প্রয়োজন হয় তার চেয়ে কম ক্ষতিকর। নিজের সম্পর্কে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছার সাথে এক ধরণের সমর্পণ বা ভাগ্যবরণ জড়িয়ে আছে। এই ধরনের যদিও প্রথমদিকে কিছু বেদনা থাকতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং সম্ভাব্য একমাত্র রক্ষাকবচ। যা আত্মপ্রতারকদের নৈরাশ্য এবং মোহমুক্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। যা প্রতিদিন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তাকে বিশ্বাস করার মতো ক্লান্তিকর এবং শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত তার মতো চরম বিরক্তিকর আর কিছু হতে পারে না। এইরকম প্রচেষ্টা থেকে মুক্ত হওয়াই হল নিরাপদ এবং স্থায়ী সুখের অপরিহার্য শর্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *