০৬. ঈর্ষা

৬. ঈর্ষা

দুশ্চিন্তার পরেই অসুখী হওয়ার এক শক্তিশালী কারণ সম্ভবত ঈর্ষা। আমার বলা উচিত এই ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা মানুষের সর্বাপেক্ষা সনাতন এবং গভীরতম ক্রোধ-প্রবৃত্তির অন্যতম। বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে শিশুদের এটি খুব বেশি চোখে পড়ে এবং প্রত্যেক শিক্ষাদানকারীর উচিত এই প্রবৃত্তিকে খুব স্নেহময় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা। একটি শিশুকে বঞ্চিত করে অন্য এক শিশুর প্রতি সামান্য পক্ষপাতও সাথে সাথে তার চোখে পড়ে এবং তাতে সে রেগে যায়। যারা শিশুদের দেখাশোনা করেন, তাদের চরম, কঠোর, অপরিবর্তিত এবং সমভাগে বণ্টনযোগ্য ন্যায়বিচারের পথে চালিত হতে হবে। কিন্তু ঈর্ষা ও বিদ্বেষ (বিদ্বেষ ঈর্ষারই বিশেষ এক রূপ) বিষয়ে শিশুরা বড়দের তুলনায় একটু বেশি খোলামেলা। এই আবেগ শিশুদের মধ্যে যেমন বড়দের মধ্যেও একই রকম দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ পরিচারিকাদের কথা বলা যায়। আমার মনে পড়ে একজন বিবাহিতা পরিচারিকা গর্ভধারণ করার পর আমরা বলেছিলাম সে কোনও ভারী জিনিস তুলুক, আমরা তা চাই না। তার অব্যবহিত ফল দেখা গেল অন্যসব পরিচারিকারাও ভারী জিনিস তোলা বন্ধ করে দিল। তখন সেরকম কাজের দরকার হলে আমাদের নিজেদেরই তা করে নিতে হত। ঈর্ষা হল গণতন্ত্রের ভিত্তি। হেরাক্লিটাস(১) বলেন এফেসাসের নাগরিকদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। কারণ তারা বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে কেউ প্রথম স্থানীয় হবে না। গ্রীকরাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনই প্রায় এই ক্রোধ-প্রবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। আধুনিক গণতন্ত্র সম্বন্ধেও একথা সত্যি। তবে একটি আদর্শবাদী মতবাদ রয়েছে, যার মতে গণতন্ত্রই হল আদর্শ রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থা। আমি নিজে এই মতবাদকে সত্যি বলে মনে করি। কিন্তু ব্যবহারিক রাজনীতিতে এমন কোনও বিভাগ নেই, যেখানে বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্যে আদর্শবাদী মতবাদ যথেষ্ট শক্তিশালী। যখন বড় কোনও পরিবর্তন ঘটে যায়, তখন তাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্যে যেসব মতবাদ দেখা দেয় তা সবসময় ছদ্মবেশী মানসিক চাঞ্চল্য। মাদাম রোলার স্মৃতিকথা পড়ে দেখুন, যিনি বারংবার জনসেবায় উদ্বুদ্ধ মহিয়সী নারীরূপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দেখা যাবে যা তাকে এমন উদ্দীপ্ত গণতন্ত্রীতে পরিণত করেছিল তা হল অভিজাত বাসগৃহ দেখার পর তার ভৃত্যদের বাসস্থান দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা।

সাধারণ সম্ভ্রান্ত মহিলাদের জীবনে ঈর্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

যখন ভূগর্ভস্থ রেলে বসে থাকেন তখন পাশ দিয়ে যদি কোনও সুসজ্জিতা মহিলা চলে যান, তখন অন্য মহিলাদের চোখের দিকে তাকাবেন, দেখবেন তাদের নিজেকে সম্ভবত আরো ভালরূপে সজ্জিতা দুচারজন ছাড়া সেই পাশ কাটানো মহিলার প্রতি ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে এবং নানাভাবে তার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। এই সাধারণ ঈর্ষার একটি রূপ হচ্ছে কুৎসার প্রতি আসক্তি। অন্য নারী সম্পর্কে যে কোনও কুৎসা, তুচ্ছ প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও সাথে সাথে বিশ্বাস করা হয়। উন্নত নীতিজ্ঞানও একই উদ্দেশ্যসাধন করে। যারা ঘটনাক্রমে এর বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলে, তাদের ঈর্ষা করা হয় এবং তাদের অন্যায়ের জন্যে শাস্তি প্রদানকে পূণ্য কাজ বলে মনে করা হয়। এই বিশেষ ধরনের পূণ্য নিশ্চয় নিজেরই পুরস্কার।

ঠিক একই জিনিস আবার দেখা যাবে পুরুষদের মধ্যেও। পার্থক্যটা শুধু এই যে নারীরা অন্য সব নারীকেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবে, কিন্তু পুরুষরা একই পেশাজীবী হলে তবেই পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। এইটাই সাধারণ নিয়ম। পাঠক, আপনি কখনো অবিবেচকের মতো এক চিত্রশিল্পীর কাছে অন্য শিল্পীর প্রশংসা করেছেন? আপনি কী কখনো একই দলের একজন রাজনীতিবিদের প্রশংসা অন্য রাজনীতিবিদের কাছে করেছেন? যদি করে থাকেন, তা হলে শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রে আপনি বিদ্বেষের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। লেবনিজ(২) এবং হাইজেনসের(৩) মধ্যে যেসব পত্র বিনিময় হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি চিঠিতে দেখা যায় নিউটনের(৪) মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে। এই অনুমান থেকে অনেক দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা পরস্পরকে লিখেছে ‘মিঃ নিউটনের মতো অতুলনীয় প্রতিভার বিচার ক্ষমতা আচ্ছন্ন হয়ে পড়া কি পরিতাপের বিষয় নয়? এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তি একের পর এক চিঠিতে স্পষ্টতই বিষয়টি মনে মনে উপভোগ করেছেন এবং কুম্ভীরাশ্রু ফেলেছেন। বাস্তবক্ষেত্রে যে ঘটনা নিয়ে তারা শোকের ভণিতা করেছেন, তা ঘটেইনি, যদিও নিউটনের কিছু খামখেয়ালি আচরণ এই ধরনের গুজবের জন্ম দিয়েছিল।

সাধারণ মানুষের সবরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঈর্ষা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। ঈর্ষান্বিত লোক শুধু যে অন্যের ওপর দুর্ভাগ্য চাপাতে চায় তা নয়, সুযোগ পেলে চাপিয়ে দেয় এবং সে নিজেও ঈর্ষায় অসুখী হয়। নিজের যা আছে তা থেকে আনন্দলাভ না করে অন্যের যা আছে তা নিয়ে দুঃখ পায়। সে অন্যের যেসব সুবিধা ভোগ করছে, সম্ভব হলে তা থেকে বঞ্চিত করে। অথচ যেসব সে নিজে পেলে তা তাদের মতোই তার কাছে কামনীয় হত। যদি এই মনোবৃত্তিকে যথেচ্ছভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে তা সকল সৌন্দর্যের পক্ষে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এমনকী বিশেষ দক্ষতার সফল প্রয়োগেও। শ্রমিক যখন পায়ে হেঁটে তার কাজে যায় তখন চিকিৎসক রোগী দেখতে গাড়িতে যাবেন কেন? যেখানে সকলে প্রতিকূল আবহাওয়ায় বাস করছে তখন বিজ্ঞান গবেষককে কেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বাস করতে দেওয়া হবে? কেন বিশ্বের পক্ষে মূল্যবান এবং দুর্লভ জ্ঞানের অধিকারী কোনও ব্যক্তিকে গৃহকর্মের ভাবনা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে? ঈর্ষা এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারে না। সৌভাগ্যক্রমে মানুষের স্বভাবে একদিকে কিছুর অভাব থাকলে অন্যদিকে তার পরিপূরক কিছু থাকে, যেমন প্রশংসার মনোবৃত্তি। যিনি মানবজাতির সুখবৃদ্ধি কামনা করেন, তার উচিত প্রশংসা বাড়ানো এবং ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা কমানো।

কিন্তু ঈর্ষার প্রতিষেধক কি? সন্তদের কাছে স্বার্থত্যাগরূপ প্রতিষেধক আছে। যদিও তাদের ভিতর এক সন্ত অন্য সন্তকে ঈর্ষা করছেন এমনটা অসম্ভব নয়। বহু বছর ধরে উচ্চ স্তম্ভে বাস করে সেন্ট সিমিয়ান স্টাইলাইটস যদি শুনতেন অন্য কোনও সন্ত আরো দীর্ঘদিন এবং আরো সরু কোনও স্তম্ভে বাস করছেন তা হলে সম্পূর্ণ খুশী হতেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। সন্তদের কথা থাকুক, সাধারণ নর-নারীর পক্ষে ঈর্ষার একমাত্র ওষুধ হচ্ছে সুখ লাভ করা। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে এই যে ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা নিজেই সুখের পথে একটি মারাত্মক বাধা। শৈশবের দুরবস্থা ঈর্ষাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। যে শিশু দেখে তাকে ছেড়ে তার কোনও ভাই বা বোন বেশি আদর পাচ্ছে তখন থেকে সে ঈর্ষা করতে শেখে। সে যখন বড় হয়ে বাড়ি ছেড়ে বাইরে আসে, তখন সেইসব অবিচার খুঁজে বেড়ায়, যা তার প্রতি হওয়া সম্ভব। যদি অবিচার হয়, সাথে সাথে তা তার চোখে পড়ে। যদি তা না হয়, তাহলে সেই অবিচার নিয়েই সে কল্পনা করে, এমন লোক তো অসুখী হবেই।

সে বন্ধুদের কাছেও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। কারণ কোন সময় কল্পনাজাত অবহেলা এড়িয়ে চলার কথা সে মনে রাখতে পারে না। কেউ তাকে পছন্দ করছে না, সেকথা সে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে প্রথমে। পরে সে বিশ্বাসকে নিজের ব্যবহারের সাহায্যে সত্যি করে তোলে। শৈশবের আরেকটি দুর্ভাগ্য হচ্ছে যেসব পিতামাতার বাৎসল্যবোধ কম তাদের সন্তান হওয়া। এই অবস্থায় নিজের বাড়িতে আদরের কোনও ভাইবোন না থাকলেও অন্য পরিবারের বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের তার চেয়েও বেশি আদর করছে দেখতে পারে। এতে শিশুদের প্রতি তার ঘৃণা জন্মাবে, নিজের বাবা-মার ওপরও এবং বড় হলে তার অবস্থা বাইবেলে বর্ণিত ইসমাইলের মতো হয়েছে মনে হবে। কোনও কোনও রকম সুখ প্রত্যেকের স্বাভাবিক জন্মগত অধিকার। তা থেকে বঞ্চিত হওয়া তাকে মানসিকভাবে বিকৃত আর বিষাক্ত করে তোলে।

কিন্তু ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি বলতে পারে, আমাকে এসব কথা বলে কী লাভ যে, সুখ হল ঈর্ষার প্রতিষেধক। আমি যতক্ষণ ঈর্ষা বোধ করি ততক্ষণ সুখের সন্ধান পাই না, আর তুমি বলছ সুখ না পাওয়া পর্যন্ত আমি ঈর্ষা হতে বিরত হতে পারব না। কিন্তু বাস্তব জীবন এত যুক্তির ধার ধারে না। ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতার কারণগুলি যদি জানতে পারা যেত, তাহলে এই রোগটি সারাবার পথে অনেক অগ্রগতি হত। কোনও তুলনার ভাষায় চিন্তা করার অভ্যাস ভয়ানক। যদি সুখদায়ক কিছু ঘটে তা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা উচিত, তখন ভাবা উচিতই নয় যে, অন্য কোনও লোক হয়তো এমন সুখ উপভোগ করে যা এর তুলনায় বেশি। ঈর্ষাকাতর লোকটি বলবে, “ঠিক কথা, রোদে ভরা উজ্জ্বল দিন, এখন বসন্তকাল, পাখিরা কুজন করছে, ফুলদল বিকশিত; কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, সিসিলির বসন্ত এর চেয়ে সহস্র গুণ বেশি মনোরম। সেখানে হেলিকনের কুঞ্জবনে পাখিদের গান আরও মধুর এবং শারণের গোলাপ আমার বাগানের যে কোনও গোলাপের চেয়ে আরও বেশি মনজুড়ানো। এসব ভাবতে ভাবতে ঈর্ষাকাতর লোকটির মনের আকাশে সূর্যকে মেঘে ঢেকে দেয়, পাখির গান অর্থহীন কোলাহলে পরিণত হয়, ফুলগুলির দিকে আর তাকাতে ইচ্ছা করে না। এইভাবে জীবনে সব আনন্দকে সে দূরে ঠেলে দেয়। সে ভাবে, আমার প্রেমিকা খুব সুন্দরী, আমরা পরস্পরকে কত ভালবাসি, কিন্তু শেবার রাণি কী অপরূপাই না ছিলেন! হায়রে সলোমন যেসব সুযোগ পেয়েছিলেন, আমি যদি তা পেতাম!’ এই ধরনের সব তুলনা অর্থহীন এবং নির্বুদ্ধিতা। শেবার রাণি হোক অথবা পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হোক, যদি আমাদের অতৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে উভয়ক্ষেত্রেই সে কারণ সমান মূল্যহীন। বুদ্ধিমান অন্যের কী আছে আর কী নেই তা নিয়ে ভেবে নিজের আনন্দকে নষ্ট করে না। প্রকৃতপক্ষে ঈর্ষা এক ধরনের অন্যায়, যার কিছু অংশ নৈতিক, কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক। ঈর্ষার নিজের কোনও রূপ নেই, শুধু তুলনার সাহায্যে তাকে অনুভব করা যায়। মনে করুন আমি যে বেতন পাচ্ছি তা আমার প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর। যাতে আমার তৃপ্ত থাকা উচিত। কিন্তু আমি জানতে পারলাম, এমন একজন, যে আমার চেয়ে কোনও দিকেই বড় নয়, সে আমার দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছে, তৎক্ষণাৎ আমি যদি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ি তা হলে আমি যা পাচ্ছি যা আমার তৃপ্তিদায়ক হওয়া উচিত, তা ম্লান হয়ে গেল এবং আমার ওপর অবিচারের ধারণা আমাকে ক্ষয় করতে শুরু করল। এসবের যথাযথ প্রতিকার হচ্ছে মানসিক শৃঙ্খলা এবং অর্থহীন চিন্তা করার অভ্যাস ত্যাগ করা। মূল কথা হচ্ছে, সুখ অপেক্ষা ঈর্ষা করার মতো বড় কিছু নেই। যদি আমি ঈর্ষাকে দূর করতে পারি তাহলে আমি সুখকে পেয়ে যাব এবং তখন আমি হব ঈর্ষার পাত্র। যে ব্যক্তি আমার চেয়ে দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছেন। এই চিন্তার কোনও শেষ নেই। যদি আপনি গৌরব চান তা হলে হয়তো নেপোলিয়নকে(৬) ঈর্ষা করবেন। কিন্তু নেপোলিয়ন সীজারকে(৭) ঈর্ষা করতেন। সীজার করতেন আলেকজান্ডারকে(৮) এবং নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আলেকজান্ডার ঈর্ষা করতেন হারকিউলিসকে(৯)। যার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। অতএব একমাত্র সাফল্যের দিক থেকে আপনি ঈর্ষাকে এড়াতে পারবেন না। কারণ ইতিহাসে অথবা পূরাণে সব সময় এমন লোক পাওয়া যাবে যিনি আপনার চেয়ে বেশি সফল। আপনি ঈর্ষা থেকে দূরে থাকতে পারেন। যদি যে আনন্দ আপনার কাছে আসবে, তা উপভোগ করেন, যে কাজ আপনার করা উচিত তা করেন অহেতুক যাদের আপনি বেশি সৌভাগ্যবান মনে করেন তাদের সাথে নিজেকে তুলনা না করেন।

অপ্রয়োজনীয় বিনয়ের সঙ্গে ঈর্ষার সম্পর্ক গভীর। বিনয়কে একটি গুণ বলেই মনে করা হয়। কিন্তু আমার নিজের সন্দেহ খুব বেশি, বিনয়ের বাড়াবাড়ি হলে তাকে আর গুণ বলা যায় কিনা। বিনয়ী লোকের মনে বিশেষ প্রত্যয় জাগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। তারা সার্থকভাবে পারবেন এমন কাজ শুরু করতেও সাহস পান না। বিনয়ীদের বিশ্বাস, তারা যাদের সঙ্গে সাধারণভাবে মিশে থাকেন, তারা সব বিষয়েই বড়। তাই তারা বিশেষভাবে ঈর্ষার শিকার হন, যার জন্যে তাদের মনে ঈর্ষা থেকে অতৃপ্তির জন্ম হয়। আমি মনে করি, কোনও বালককে বড় করে তোলার সময় সে যে খুব ভাল, এই কথাটা বলার পক্ষে অনেক কিছু আছে। আমার মনে হয় না কোনও ময়ুর তার পুচ্ছের জন্যে অন্য ময়ুরকে ঈর্ষা করে, কারণ প্রত্যেকটি ময়ুর মনে করে তার পুচ্ছই পৃথিবীতে সুন্দরতম। এর ফলেই ময়ুরেরা শান্তিপ্রিয় বিহঙ্গ। কল্পনা করুন, কোনও ময়ুরকে শেখানো হল, নিজেকে নিয়ে সুন্দর ভাবনা অন্যায়, তা হলে সে অন্য ময়ুরকে পেখম মেলতে দেখামাত্র নিজেকে বলত, “আমি কিছুতেই কল্পনা করব না যে, আমার পেখম ওর চেয়ে সুন্দর, কারণ তা হবে আত্ম-অহংকার। কিন্তু হায়, তাহলে তো আমি ওর মতো সুখী হতাম। ঐ জঘন্য পাখিটা নিজের সৌন্দয্য সম্বন্ধে এতটা আত্মবিশ্বাসী! ওর কটা পালক যদি ছিঁড়ে দিই, তাহলে আর তুলনার কোনও ভয় থাকবে না। সম্ভবত সে তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে এবং প্রমাণ করবে যে এটি একটি খারাপ ময়ুর, যে অময়ুরোচিত আচরণের অপরাধে দোষী এবং সে তাকে ময়ুরদের নেতৃমণ্ডলীর অধিবেশনে অভিযুক্ত করবে। ক্রমে সে এই নীতি প্রতিষ্ঠা করবে যে, বিশেষভাবে সুন্দর পুচ্ছধারী ময়ুরেরা প্রায় সবসময় খারাপ হয় এবং ময়ুররাজ্যের জ্ঞানী শাসকদের উচিত ঝুলে পড়া বিশীর্ণ পালকধারী নিরহংকার ময়ুরকেই ভাল ময়ুর বলে নির্বাচন করা। এই নীতি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার পর সে সুন্দর শ্রেষ্ঠ সব ময়ুরদের একসাথে করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। শেষ পর্যন্ত সত্যিই সুন্দর ময়ুরদের মনোহরণ পুচ্ছ অতীতের এক অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে যাবে। নীতিধর্মের ছদ্মবেশে এই হচ্ছে ঈর্ষার জয়লাভ। কিন্তু যেখানে প্রত্যেক ময়ুর নিজেকে অন্যের চেয়ে বেশি সুন্দর মনে করছে, সেখানে এইসব দমননীতির কোনও প্রয়োজন নেই। প্রতিযোগিতায় প্রত্যেকটি ময়ুর প্রথম পুরস্কার পেতে আশা করে এবং প্রত্যেকেই সেখানে তার নিজের ময়ুরীকে মূল্যবান মনে করে। তাই সে বিশ্বাস করে প্রথম পুরস্কার সেই পেয়েছে।

ঈর্ষা অবশ্যই প্রতিযোগিতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যে সৌভাগ্য আমাদের নাগালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে কখনো আসবে না তাকে আমরা ঈর্ষা করি না। যে যুগে সামাজিক স্তরভেদ ঈশ্বরের বিধান বলে নির্ণীত হয়ে গেছে, সেই যুগে ধনী দরিদ্রের ভেদকেও ঈশ্বরের বিধান বলে মান্য করার বাধ্যতা চলে এসেছে। সেখানে দরিদ্ররা ধনীদের ঈর্ষা করে না, ভিক্ষুকরা কোটিপতিদের ঈর্ষা করে না। কিন্তু অন্য ভিক্ষুকরা যদি সাফল্য লাভ করে, তাহলে অবশ্যই তাদের ঈর্ষা করবে। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক অবস্থানের অস্থায়িত্ব এবং গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের

সাম্যনীতিতে ঈর্ষার পরিসর অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান মুহূর্তে এটি ক্ষতিকর। কিন্তু আরো ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থায় পৌঁছাবার জন্যেই এই অন্যায়কে সহ্য করে যেতে হবে। অসম ব্যবস্থাকে যুক্তি দিয়ে দেখলে তাকে অন্যায় বলেই মনে হবে যদি অবশ্য সেই অসমতা গুণের উৎকর্ষের ওপর না দাঁড়ায়। যখনি তাকে অন্যায় বলে দেখা হবে তখন সে ঈর্ষার জন্ম হবে তার প্রতিকার সেই অন্যায় দূর না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। সুতরাং আমাদের যুগে ঈর্ষা এক অদ্ভুত রকম ভূমিকা পালন করছে। দরিদ্র ধনীকে ঈর্ষা করে, দরিদ্রতর জাতিরা ধনী জাতিদের ঈর্ষা করে, নারী ঈর্ষা করে পুরুষদের, সতী নারীরা ঈর্ষা করে অসতীদের, তারা শাস্তি পাচ্ছে না বলে। যদিও এই কথাটাই সত্যি যে ঈর্ষা বিভিন্ন শ্ৰেণী, বিভিন্ন জাতি ও নারী পুরুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রধান সহায়ক শক্তি। একই সাথে একথাও সত্যি যে ঈর্ষার ফলে যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা হয়, তা কিন্তু ভাগ্যহীনদের সুখ বাড়ায় না। যেসব আবেগ ব্যক্তিজীবন নষ্ট করে দেয়, তা সমাজজীবনও নষ্ট করে দেয়। একথা মনে করা অনুচিত যে ঈর্ষার মতো ক্ষতিকর কিছু থেকে ভাল ফল পাওয়া যাবে। সুতরাং যারা আদর্শবাদী নীতির কারণে সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বৃদ্ধি কামনা করেন তাদের অবশ্যই আশা করা উচিত যে, ঈর্ষা ছাড়া অন্য কোনও শক্তিই হবে সেই পরিবর্তনের যন্ত্র।

সব খারাপ জিনিসের মধ্যেই পরস্পর একটা যোগসূত্র থাকে এবং একটি খারাপ থেকে অন্য একটি খারাপের জন্ম হতে পারে। সাধারণভাবে দেখা যায় অবসাদ ঈর্ষার একটি কারণ। যখন নিজের কাজ শেষ করার পক্ষে নিজের শক্তিকে অপ্রতুল মনে হয় তখন সাধারণভাবে তার মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, তাদের প্রতি ঈর্ষা জেগে উঠবেই। ঈর্ষা কমানোর একটা সহজ উপায় হচ্ছে তাই অবসাদ কমানো। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে এমন একটা জীবন বেছে নেওয়া যা প্রবৃত্তিকে সুখজনক করে তোলে। যে ঈর্ষা স্বাভাবিক পেশাজাত বলে মনে হয় এমন অনেক ঈর্ষার বাস্তব উৎস হল যৌনতা। বিবাহিত জীবন সুখের হলে এবং মনের মতো সন্তান পেলে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সন্তানকে উপযুক্তভাবে মানুষ করার মতো প্রচুর সংস্থান থাকবে, ততক্ষণ সে অন্য লোকদের তার অতিরিক্ত বৈভব বা সাফল্যের জন্যে ঈর্ষা করবে না। মানুষের সুখের উপকরণগুলি এতই সাধারণ যে, ভদ্রলোকরা তা স্বীকার করতে চান না যে তাদের অভাব কীসের। যে কোনও সুসজ্জিতা রমণীকে দেখলেই যেসব রমণী ঈর্ষিত দৃষ্টিতে তাকান তাদের কথা আগেই বলেছি। তারা যে তাদের সহজ প্রবৃত্তিজাত জীবনধারায় সুখী নন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রবৃত্তিজাত সুখ ইংরেজিভাষী মানুষের মধ্যে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে খুব দুর্লভ। এই ব্যাপারে সভ্যতা মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে। ঈর্ষা কমাতে হলে তার কারণ খুঁজে বের করতেই হবে এবং যদি কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে আমাদের সভ্যতার জন্যে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে, যা থেকে উৎপন্ন ঘৃণিত উন্মত্ততায় ধ্বংস হয়ে যাবে সেই সভ্যতা। প্রাচীনকালে লোকে শুধু তাদের প্রতিবেশীদের ঈর্ষা করত, কারণ তাদের পরিচিতের সেই ছিল সীমা। এখন শিক্ষা এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিকে না চিনেও বৃহত্তর মানবসমাজ তাদের কাছে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠে। ছায়াছবির মাধ্যমে ধনীদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তারা জানতে পারে বলে মনে করে। সংবাদপত্র তাদের বিদেশী জাতির অসভ্যতা সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়। প্রচারের মাধ্যমে যাদের চামড়ার রং তাদের চেয়ে আলাদা তাদের নোংরা কার্যকলাপের কথাও তারা জানতে পারে। হলুদ জাতি ঘৃণা করে সাদাদের, সাদা কালোদের এবং এইভাবেই চলতে থাকে। বলা যেতে পারে এসব প্রচারের কুফলজাত। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় কোনও গভীরতা নেই। প্রচার কেন বন্ধুত্বের মনোভাব তৈরী না করে, ঘৃণা সৃষ্টিতে অধিকতর সাফল্য লাভ করে? এর স্পষ্ট কারণ হচ্ছে মানুষের মনকে বর্তমান সভ্যতা যেভাবে তৈরী করেছে তাতে সে বন্ধুত্বের চেয়ে ঘৃণার দিকেই বেশি করে ঝুঁকে পড়েছে। সে ঘৃণাপ্রবণ কারণ সে অতৃপ্ত, কারণ সে গভীরভাবে অনুভব করে সম্ভবত নিজের অজান্তে সে কোনও কারণে জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। সম্ভবত অন্যেরা আমাদের ঠকিয়ে প্রকৃতির দান, মানুষের সব আনন্দ উপভোগের ভাল ভাল জিনিসগুলি নিয়ে নিয়েছে। আধুনিক মানুষ যেসব সুখ ভোগ করে সেসবের আসল সমষ্টি আদিম যুগের সমাজে যেসব সুখ দেখা যেত তার চেয়ে সন্দেহাতীতভাবে অনেক বেশি। কিন্তু তা আরও কত বাড়ানো যেতে পারে সেই চেতনাই যেন বেশি তাদের মধ্যে। সন্তানদের নিয়ে যখনই পশুশালায় যাওয়ার সুযোগ ঘটে, তখনই আপনি যেসব বানর ব্যায়ামের কসরত দেখাচ্ছে না বা বাদাম ভেঙে মুখে দিচ্ছে না তাদের চোখে এক অদ্ভুত অব্যক্ত বেদনা দেখতে পাবেন। আপনি কল্পনা করতে পারেন তারা ভাবছে তাদের মানুষ হয়ে জন্ম। নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তার রহস্য উদ্ধার করতে পারছে না। বিবর্তনের পথে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের জ্ঞাতিরা এগিয়ে গেছে তারা পড়ে রয়েছে পিছনে। সভ্য মানুষের সত্ত্বাও একইরকম, পশুশালায় বানরের মতোই পীড়িত ও বেদনাহত। সে বুঝতে পারে প্রায় তার নাগালের মধ্যেই তার চেয়ে ভাল কিছু রয়েছে, কিন্তু সে জানে না কোথায় তাকে খুঁজে বেড়াবে, কীভাবেই বা তাকে লাভ করবে। নৈরাশ্যে আক্রান্ত হয়ে সে তারই মতো পথহারা এবং অসুখী মানুষদের ওপর রেগে যায়। বিবর্তনের পথে চলতে চলতে আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি যেটি অন্তিম পর্যায় নয়। এই পর্যায়কে আমাদের অতিক্রম করে যেতে হবে অতি দ্রুত, কারণ যদি আমরা তা না পারি তাহলে আমাদের অধিকাংশ মধ্যপথে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং অবশিষ্টেরা সন্দেহ আর ভয়ের অরণ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং ঈর্ষা অশুভ হলেও-এর ফল ভয়ানক হলেও সম্পূর্ণরূপে শয়তানের নিয়ন্ত্রণে নয়। এটি আংশিকভাবে একটি বীরসুলভ বেদনার প্রকাশ, এই বেদনা তাদের অন্ধরাত্রে পথ চলা আরো ভাল বিশ্রামের স্থান পেতে অথবা মৃত্যু আর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। এই নৈরাশ্যের মধ্যে সঠিক পথটি খুঁজে পেতে হলে সভ্য মানুষ তার হৃদয়কে উদার করবে। যেমন সে করেছে তার মনকে। নিজেকে অতিক্রম করার শিক্ষা তাকে শিখে নিতে হবে এবং তা করতে গিয়ে তাকে জেনে নিতে হবে সমগ্র বিশ্বের মুক্তির পথ।

———
১. হেরাক্লিটাস্, Heraclitus (খ্রিঃ পূঃ ৫৩৫-৪৭৫), প্রাচীন গ্রীসের বস্তুবাদী, অজ্ঞেয় এবং অলৌকিক তত্ত্বের বিরুদ্ধবাদী দার্শনিক।

২. লেবনিজ, Leibniz Gottfried (১৬৪৬-১৭১৬)। জার্মান গণিতবিদ, পদার্থবিদ্যা এবং দর্শনেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

৩. হাইজেনস, Christian Huygens (১৬২৯-১৬৯৫)। জন্ম নেদারল্যান্ডে। বিখ্যাত পদার্থ এবং গণিতবিদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তাঁর অবদান অসামান্য।

৪. নিউটন, Sir Issac Newton (১৬৪২-১৭২৭), বস্তুজগতের ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের আবিষ্কারক। তাঁকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

৫. সেন্ট সিমিয়ান স্টাইলাইটস, St Simeon stylites (খ্রিঃ পূঃ ৩৯০-৪৯৫), সিরিয়ার সিসানে জন্ম। সিরিয়ার আলেপ্লেতে একটি স্তম্ভের ওপর উপবিষ্ট হয়ে একইভাবে ৩৭ বছর সাধনা করেছিলেন।

৬. নেপোলিয়ন, পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

৭. সীজার, Julias Caesar (খ্রীঃ পূঃ ১০২-৪৪), রোমের অদ্বিতীয় বীর জুলিয়াস সীজার। ইতিহাসে তাঁর মতো চরিত্রের দেখা খুব কম মেলে।

৮. আলেকজান্ডার, Alexander (খ্রীঃ পূঃ ৩৫৬-৩২৩), বিশ্বের দিগ্বিজয়ীদের তালিকায় প্রথম নাম–Alexander the Great।

৯. হারকিউলিস, Hercules, গ্রীক পূরাণের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। গ্রীক পুরাণে তাকে উপদেবতার (Demigod) মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *