১৩. ঈশ্বরের অস্তিত্ব

১৩. ঈশ্বরের অস্তিত্ব

(বার্ট্রান্ড রাসেল ও ফাদার এফ. সি. কলেস্টোন-এর মধ্যে একটি বিতর্ক। এই বিতর্কটি মূলত ১৯৪৮ সালে বিবিসির থাউ প্রোগ্রামে সম্প্রচারিত হয়। ১৯৪৮ সালের হিউম্যানটিয়াস’ পত্রিকার শরৎকালীন সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং বর্তমান গ্রন্থে ফাদার কলেস্টোনের সহৃদয় অনুমতিতে পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছে।)

কপলেস্টোন : যখন আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি, তখন আমাদের সম্ভবত এমন একটি অস্থায়ী চুক্তিতে আসার দরকার যার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে ঈশ্বর বলতে ঠিক কি বোঝায়। আমি মনে করি, ঈশ্বর বলতে বোঝায় একটি চরম ব্যক্তিগত সত্তা যিনি জগৎ এবং জগতের স্রষ্টার থেকে স্বতন্ত্র। অন্তত সাময়িকভাবে কি আপনি ঈশ্বর বলতে আমি যা বোঝাতে চাইলাম তা গ্রহণ করবেন?

রাসেল : হ্যাঁ, আমি এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলাম।

কপলেস্টোন : ধন্যবাদ। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার মতামত ধনাত্মক এবং আমি মনে করি তার অস্তিত্ব দার্শনিকভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে। সম্ভবত আপনি অবশ্যই আমায় জানাবেন যে আপনি এ বিষয়ে একজন নাস্তিক অথবা অজ্ঞেয়বাদী মনোভাব রাখেন কি না। আমি বলতে চাই যে আপনি কি এটি বলতে পারবেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে কি না?

রাসেল : না, আমি বলতে পারি যে আমি অজ্ঞেয়বাদকে সমর্থন করি।

কপলেস্টোন : আপনি কি এটি আমার সঙ্গে মেনে নেবেন যে ঈশ্বরের সমস্যা হল একটি মহৎ গুরুত্বের সমস্যা? উদাহরণস্বরূপ, আপনি কি মেনে নেবেন, যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকত তবে মানবজাতি এবং মানবের ইতিহাস অন্য কোন উদ্দেশ্যে না চলে কেবলমাত্র নিজেদের পছন্দ মতো উদে. ই চলত। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি সেই উদ্দেশ্যের কথা, কার্যকরীভাবে যে উদ্দেশ্য কেবলমাত্র তারাই অন্য লোকের উপর চাপাবে যাদের অন্যদের উপর উদ্দেশ্য চাপিয়ে দেবার মতো ক্ষমতা আছে।

রাসেল : মোটামুটিভাবে বলতে গেলে আমি হ্যাঁ বলব, যদিও আপনার শেষ বাক্যটির উপর আমার কিছু সীমা (Limitation) রাখা প্রয়োজন।

কপলেস্টোন : আপনি কি এটি মেনে নেবেন যদি ঈশ্বর বলে কিছু না থাকে অর্থাৎ পরম সত্তা বলে যদি কিছু না থাকে তবে কোন পরম মূল্য থাকতে পারে না? আমি বোঝাতে চাইছি যে আপনি কি এটি মেনে নেবেন যে যদি কোন পরম মঙ্গল না থাকে তবুও মূল্যসমূহের আপেক্ষিকতা ফল প্রয়োগ করতে পারে?

রাসেল : না, আমি মনে করি এইসব প্রশ্নগুলি যুক্তিগতভাবে স্বতন্ত্র । উদাহরণস্বরূপ, ধরুন জি. ই. মুর-এর প্রিন্সিপিয়া এথিকা (Principia Ethica) গ্রন্থটির কথা। সেখানে তিনি দেখিছেন যে, অমঙ্গলের একটা স্বতন্ত্রতা আছে এবং এই দুটোই একটি নির্দিষ্ট কল্পনা, কিন্তু এই ধারণাটিকে সমর্থন করার জন্য তিনি ঈশ্বরের ধারণার অবতারণা করেননি।

কপলেস্টোন : ধন্যবাদ। মনে করা যাক আমরা মঙ্গল বিষয়ক প্রশ্নটিকে ততক্ষণ সরিয়ে রাখব যতক্ষণ না আমরা কোন নৈতিক বিষয়বস্তুতে আসছি। আমি প্রথমে অধিবিদ্যাগত যুক্তি দেব। আমি লাইবনিজের অনিশ্চয়তা’ (Contingency) সম্পর্কিত বিষয়ের উপর নির্ভর করে যে অধিবিদ্যাগত যুক্তি গড়ে ওঠে তাকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু বলব এবং তারপর আমরা নৈতিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। ধরুন আমি অধিবিদ্যাগত বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেব, তারপর আমরা ঐ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা চালাতে পারি কি?

রাসেল : আমার মনে হয় এটাই ঠিক পরিকল্পনা।

.

অনিশ্চয়তাজাত বিষয়ে

কপলেস্টোন : ধন্যবাদ। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে আমি বিষয়টিকে কয়েকটি স্তরে ভেঙে নেব। সবার আগে আমার জানা দরকার যে এই জগতে অন্তত এমন কিছু সত্তা আছে যাদের বেঁচে থাকার কোন কারণই নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার পিতামাতার উপর নির্ভর করে থাকি, বাতাসের উপর, খাদ্যের উপর ও এরকম আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে থাকি। দ্বিতীয়ত, জগৎ সহজভাবে বাস্তব অথবা সামগ্রিকভাবে কল্পিত অথবা ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর (Individual objects) সমষ্টি এবং তাদের মধ্যে কোন একটি বস্তুও নিজের অস্তিত্বের কোন কারণ প্রকাশ করতে পারে না। এমন কোন জগৎ নেই যে-জগৎ যে-বস্তু (object) থেকে গঠিত হয়েছে তার থেকে স্বতন্ত্র। জগতের এইসব সদস্য-বস্তুদের চেয়ে মানুষ কিছুটা স্বতন্ত্র হলেও সেও তাই। এইজন্য, আমার বলা উচিত, যেহেতু বস্তুসমূহ বা ঘটনাসমূহ বিদ্যমান এবং যেহেতু অভিজ্ঞতালব্ধ কোন বস্তুই তার অস্তিত্বের কোন কারণ নিজের মধ্যে দর্শাতে পারে না, তাই সমগ্র বস্তুর পেছনে যে- কারণ আছে তা অবশ্যই বস্তুর বাইরে অবস্থিত এবং সেই কারণটি অবশ্যই এক বিদ্যমান সত্তা। তাই বলা যায় এই সত্তাটি হয় নিজেই নিজের অস্তিত্বের কারণ অথবা তা নয়। যদি তাই হয় তবে তা শুভ এবং মঙ্গলময়। যদি তা না হয় তা হলে আমরা আরও কিছুটা দূর এগোতে পারি। কিন্তু ওই অর্থে যদি আমরা অসীমের দিকে এগোই তাহলে অস্তিত্বের ব্যাখ্যা করবার জন্য আর কিছুই পড়ে থাকে না। সুতরাং আমার বলা উচিত, অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করবার জন্য আমাদের অবশ্যই এমন একটি সত্তার নিকট আসার দরকার যে সত্তাটি তার নিজের অস্তিত্বের কারণটি নিজেই ধারণ করে রাখে। অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে যেটি কখনও অবিদ্যমান (not exist) হতে পারে না।

রাসেল : এই প্রশ্নের উত্তর বহুদিক থেকে দেওয়া যেতে পারে এবং ঠিক কোন দিক থেকে এর উত্তর শুরু করা যাবে তা বার করা সামগ্রিকভাবে খুব সোজা কাজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি যে, আপনার যুক্তির উত্তরে সম্ভবত যে উত্তম দিকটিকে নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায় সেটি হল প্রয়োজনীয় সত্তা। প্রয়োজনীয় (necessary) এই শব্দটি বচনের (propositions) উপর তাৎপর্যমূলক ভাবে কেবলমাত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি। বস্তুত এই ধরণের বিষয় বিশ্লেষণমূলক অর্থাৎ বলা যেতে পারে এই ধরণের বিষয় অস্বীকার করার ক্ষেত্রে স্ববিরোধমূলক। যদি এমন কোন সত্তা থাকে যার অস্তিত্ব অস্বীকার করার ক্ষেত্রে স্ববিরোধমূলক, তবে আমি কেবল প্রয়োজনীয় সত্তাকেই স্বীকার করে নেব। এখন আমি জানতে চাই লাইনিজ বচনসমূহকে কারণের সত্যসমূহ এবং ঘটনার সত্যসমূহ এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন তা আপনি গ্রহণ করবেন কিনা। পূর্বেরটি অর্থাৎ কারণের সত্যসমূহ (truth of reason) প্রয়োজনীয় সত্তা।

কপলেস্টোন : যদি তাই হয় তবে আমার এই বিষয়ে সম্মতি দেওয়া উচিত নয় যে বিষয়টিকে লাইবৃনিজের ধারণাপ্রসূত কারণের সত্যকে ঘটনার সত্য (truth of fact) বলা হেয়ে থাকে। যেহেতু লাইবৃনিজের জন্যই বিষয়টি পরবর্তী সময় কেবলমাত্র বিশ্লেষণমূলক বচনে (analytical proposition) পর্যবসিত হয়। মনে হত পারে যে লাইবনিজের ঘটনার সত্যসমূহ শেষে কারণের সত্যসমূহের আকারে এসে ঠেকে, অর্থাৎ বিশ্লেষণমূলক বচনে (analytical proposition) উপনীত হয়, অন্তত একজন সর্বজ্ঞ মনের (omnis-cient mind) কাছে। অতএব, তার সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। কেবলমাত্র একটি বিষয়ের জন্যই এটি স্বাধীনতার (freedom) অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। কিন্তু আমি লাইনিজের সমগ্র দর্শনটিকে সমর্থন করতে চাই না। তবে অনিশ্চয়তা থেকে প্রয়োজনীয় সত্তা পর্যন্ত তার সেইসব যুক্তি আমি ব্যবহার করে থাকি যেগুলি যথার্থ কারণের আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কারণ, আমার মনে হয় এইসব যুক্তি এমন একটি সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার সাধারণ সূত্রাকারে প্রকাশ যা আমার মতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সমর্থনে একটি মৌলিক অধিবিদ্যাগত বিষয়।

রাসেল : কিন্তু আমার মনের কাছে একটি প্রয়োজনীয় বচন’ অবশ্যই বিশ্লেষণমূলক হবে। এটা অবশ্যই অন্য কোন অর্থ বোঝাবে বলে আমার মনে হয় না। বিশ্লেষণমূলক বচন সর্বদাই জটিল হয়ে থাকে এবং কিছুটা পরে যুক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিচারশক্তিশূন্য পশুও পশু’ বচনটি একটি বিশ্লেষণমূলক বচন, কিন্তু এটি হয় একটি পশু এমন বচন কখনই বিশ্লেষণমূলক হতে পারে না। বস্তুত, সমস্ত বচন যেগুলি বিশ্লেষণমূলক হতে পারে সেগুলো গঠিত হতে কিছুটা সময় নেয়।

কপলেস্টোন : এ-রকম একটি বচনকে নেওয়া যাক যদি অনিশ্চিত কোন সত্তা থাকে তবে প্রয়োজনীয় সত্তা আছে। আমি মনে করি, যে-বচনটিকে অনুমানসিদ্ধ ভাবে প্রকাশ করা হল তা একটি প্রয়োজনীয় বচন। যদি আপনি প্রতিটি প্রয়োজনীয় বচনকে একটি বিশ্লেষণমূলক বচন বলতে যান, তবে পরিভাষাগত বিবাদ এড়াতে আমি বচনটিকে বিশ্লেষণমূলক বচন হিসেবে মেনে নেব, যদিও আমি বচনটিকে পুনরুক্তিগত বচন (tautolgical proposition) হিসেবে বিবেচনা করব না। কিন্তু অনিশ্চিত একটি সত্তা আছে এই অনুমানের উপর বচনটি একটি প্রয়োজনীয় বচন। যে-অনিশ্চিত সত্তাটি কার্যত বিদ্যমান তাকে অভিজ্ঞতার দ্বারা অবশ্যই আবিষ্কৃত হতে হবে। একটি অনিশ্চিত সত্তা আছে, এইরকম বচন কখনই বিশ্লেষণমূলক বচন হতে পারে না। যদিও আপনি জানেন, আমার এ কথা বলা উচিত যে একটি অনিশ্চিত সত্তা আছে এবং যা অনুসরণ করে এমন এক প্রয়োজনীয়তাকে যাকে অনুসরণ করে ধরে নিতে হয় একটি প্রয়োজনীয় সত্তা আছে।

রাসেল : এই বিষয়ে যে বাধাটি আছে তা হল যে আমি প্রয়োজনীয় সত্তার ধারণাটিকে স্বীকার করি না। আমি স্বীকার করি না অন্য সত্তাকে ‘অনিশ্চিত বলে ভাবার মধ্যে কোন বিশেষ অর্থ আছে। এইসব শব্দগুচ্ছগুলি আমার কাছে কোন তাৎপর্যমূলক বিষয় নয় একমাত্র সেই যুক্তির মধ্যে ছাড়া যে যুক্তিটিকে আমি বাতিল করেছি।

কপলেস্টোন : আপনি কি এই বোঝাতে চাইছেন যে আপনি এই পদগুলিকে বাতিল করেন এই কারণে যে সেগুলো সেই তর্কবিদ্যার সঙ্গে মানানসই হবে না যাকে ‘আধুনিক তর্কবিদ্যা’ বলা হয়ে থাকে?

রাসেল : পদগুলোর ঠিক কি অর্থ তা আমি বুঝতে পারি না। যেমন ‘প্রয়োজনীয় এ পদটি আমার মনে হয় একটি অনর্থক শব্দ। একমাত্র যখন শব্দটি বিশ্লেষণমূলক বচনে প্রয়োগ হয় তখন মানতে পারি, কিন্তু যখন বস্তুসমূহের (things) প্রতি প্রয়োগ হয় তখন আমার কাছে তা অনর্থক বলে মনে হয়।

কপলেস্টোন : প্রথমেই আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করব আধুনিক তর্কবিদ্যা’ বলতে আপনি কি বোঝেন? যতদূর আমি জানি পৃথক ব্যবস্থাসমূহ (differing system) বলতে কিছু আছে। দ্বিতীয়ত, কখনই সমস্ত আধুনিক তর্কবিদ অধিবিদ্যার অর্থহীনতাকে নিশ্চিতভাবে স্বীকার করে নেবেন না। যে-কোনভাবেই হোক আমরা উভয়ই জানি যে এমন একজন বিখ্যাত আধুনিক চিন্তাবিদ আছেন যার আধুনিক তর্কবিদ্যার উপর জ্ঞান সুগভীর কিন্তু যিনি অবশ্যই অধিবিদ্যাকে অর্থহীন বলে ভাবেননি অথবা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে তিনি ঈশ্বরের সমস্যাকে (problem of God) অনর্থক এমন ভাবেননি। আবার বলা যায় যদি সমস্ত আধুনিক তর্কবিদরা অধিবিদ্যাকে অর্থহীন মনে করেন তাহলেও এটা মনে করার কোন মানে নেই যে তারা সবাই সঠিক। অধিবিদ্যাগত পদসমূহ অর্থহীন এই বচনটি আমার কাছে এমন একটি বচন যা নির্ভর করে আছে অনুমিত বা কাল্পনিক দর্শনের উপর। এর পেছনে যে গোঁড়ামিটা কাজ করে তা হল যা আমার মস্তিষ্কে ঢোকে না তাই অ-বিদ্যমান (non-existent), অথবা তা অর্থহীন কিংবা এটি একটি আবেগমূলক ভাবে প্রকাশ। আমি সহজভাবে এটাই বলতে চাইছি যে, যারা বলেন আধুনিক তর্কবিদ্যার একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা যে কোন অর্থ (mean ing) বোঝাবার একমাত্র মানদণ্ড তারা আরও বেশি গোঁয়ার। তারা গোঁয়ার্তুমি করে দর্শনের একটি অংশকে দর্শনের সমগ্র অংশ রূপে চালাতে চাইছে। সর্বোপরি, একটি ‘অনিশ্চিত’ (Contingent) সত্তা এমন একটি সত্তা যার নিজের মধ্যেই নিজের সত্তার কোন কারণ নেই, অনিশ্চিত সত্তা বলতে আমি এ রকমই বোঝাতে চাই। আমার মতো আপনিও জানেন যে আমাদের বাইরে অবস্থিত কোন কিছু বা কারুর স্বীকৃতির দ্বারা আমাদের অস্তিত্বের কোন ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা পিতামাতার কথা বলতে পারি। অন্যদিকে একটি প্রয়োজনীয় সত্তা বলতে বোঝায় এমন একটি সত্তা যা কখনই অ-বিদ্যমান’ (not-exist) হতে পারে না। আপনি বলতেই পারেন যে এ রকম কোন সত্তা নেই, কিন্তু এ বিষয়ে আপনি আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে পদসমূহ আমি ব্যবহার করছি তা আপনি বোঝেন না। যদি আপনি সেইসব পদসমূহকে না বোঝেন, তা হলে কেমনভাবে আপনি বলতে পারেন যে এ রকম কোন সত্তা নেই, যদি এই হয় তবে আপনি কি বলবেন?

রাসেল : দেখুন, অনেকগুলো দিক থেকেই এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় কিন্তু আমি সেগুলোর ভেতর ঢোকার কোন প্রস্তাব করছি না। সাধারণভাবে কখনই আমি অধিবিদ্যার অর্থহীন ব্যাপার সম্পর্কে আলোচনা চালিয়ে যাব না। আমি আলোচনা করব বিশেষ বিশেষ কিছু পদসমূহের অর্থহীনতার সম্পর্কে, কেননা সেই সমস্ত পদসমূহের কোন ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কোন সাধারণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি সেগুলোকে আলোচনা করব না। এটা কোন সাধারণ মতো নয়– এটা একটা বিশেষ বস্তু (thing), কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য সেইসব দিকগুলোর সম্পর্কে আমি আলোচনা বন্ধ রাখবো এবং আমি বলবো যে যা এতক্ষণ ধরে আপনি বলেছেন আমার মনে হয় তা আমাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো সেই তাত্ত্বিক (ontological) বিষয়ের দিকে যে, এমন একটি সত্তা আছে যার সারসত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অস্তিত্ব, তাই তার অস্তিত্ব বিশ্লেষণমূলক। কিন্তু আমার মনে হয় এটা অসম্ভব, কারণ এর ফলে যে প্রশ্নটা সামনে আসে তা হল অস্তিত্ব বলতে একজন কি বোঝে এবং এই বিষয়ে আমি মনে করি একটি নামাঙ্কিত কর্তাকে (subject) কখনই তাৎপর্যমূলকভাবে বিদ্যমান বলা যেতে পারে না কিন্তু বর্ণিত (described) কর্তাকে বিদ্যমান বলা যেতে পারে এবং সেই অস্তিত্ব কখনই বিধেয় (predicate) নয়।

কপলেস্টোন : আমি মনে করি আপনি বলতে চাইছেন যে এটি একটি ভুল ব্যাকরণ অথবা বলার ক্ষেত্রে একটি বাজে পদ-বিন্যাস, উদাহরণস্বরূপ, টি. এস. এলিয়ট বিদ্যমান আছেন’, উদাহরণরূপে, একজন বলতে পারেন মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথিড্রাল-এর লেখক, বিদ্যমান আছেন। আপনি কি বলতে চাইছেন জগতের কারণের অস্তিত্ব আছে এই ধরণের বচন অর্থহীন? আপনি বলতে পারেন যে জগতের কোন কারণ নেই, কিন্তু আমি এটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কেমনভাবে আপনি বলতে পারেন যে ‘জগতের কারণ আছে’ এই রকম বচন অর্থহীন? বচনটিকে প্রশ্নাকারে রাখুন যেমন, ‘জগতের কি কোন কারণ আছে, অথবা জগতের অস্তিত্বের কোন কারণ কাজ করে কি? বেশিরভাগ মানুষই এ ধরণের প্রশ্নকে অবশ্যই বুঝবে, যদি তারা উত্তর সম্পর্কে একমত না-ও হয়।

রাসেল : জগতের অস্তিত্বের কোন কারণ কাজ করে কি?’ এই ধরণের প্রশ্নের অর্থ আছে বই কি। কিন্তু যদি আপনি বলেন হ্যাঁ, ঈশ্বরই জগতের কারণ’ তাহলে আপনি ঈশ্বরকে নামবাচক বিশেষ্য বা একটি নির্দিষ্ট নামে (proper name) ব্যবহার করছেন। তাই ‘ঈশ্বর বিদ্যমান আছেন এই ধরণের বাক্য কখনই এমন একটি বিবৃতি হয়ে উঠতে পারে না যার একটি মানে আছে– ঠিক এই কথাটিই আমি বলতে চাইছি। কারণ এইজন্যই বলা যেতে পারে যে এ ধরণের বাক্য কখনই বিশ্লেষণমূলক বচন হতে পারে না যদি আমরা বলি যে এটা বা ওটা বিদ্যমান আছে। উদাহরণরূপে মনে করুন যে আপনি একটি কর্তাকে নিতে পারেন যেমন বিদ্যমান গোলাকার-চৌকোণ,’ এটাকে একটি বিশ্লেষণমূলক বচনের মতো লাগলেও তা বিদ্যমান নয়।

কলেস্টোন :না, তা নয়। অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা আপনার না থাকলে আপনি কখনই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না যে এটি বিদ্যমান নয়। যেমন ধরুন ‘গোলাকার-চৌকোণের অস্তিত্ব’, আমি অবশ্যই বলব এর কোন মানে নেই।

রাসেল : আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। প্রয়োজনীয় সত্তা’ প্রসঙ্গে আমি ওই একই কথা বলব।

কপলেস্টোন : আমার মনে হয় আমরা একটা কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। প্রয়োজনীয় সত্তা এমন একটি সত্তা যে অবশ্যই বিদ্যমান আছে অথবা বিদ্যমান। থাকতে পারে না– এই ধরণের বচন আমার কাছে একটি নির্দিষ্ট মানে রাখে। কিন্তু আপনার কাছে এর কোন অর্থ নেই।

রাসেল : আমরা বিষয়টির উপর একটু চাপ দিতে পারি। আপনার মত অনুযায়ী একটি সত্তা যা অবশ্যই বিদ্যমান এবং বিদ্যমান থাকতে পারে না, অবশ্যই এমন একটি সত্তা হবে যার সারসত্তাই তার অস্তিত্ব।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, এটি এমন একটি সত্তা যার সারসত্তাকে অবশ্যই বিদ্যমান থাকতে হবে। কিন্তু কেবলমাত্র ঈশ্বরের সারসত্তার (essence) ধারণা থেকে আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ইচ্ছুক নই। কারণ এখনো পর্যন্ত ঈশ্বর সম্পর্কে কোন পরিষ্কার সজ্ঞা (intuition) আমাদের আছে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি অভিজ্ঞতার জগতের দ্বারাই আমাদের ঈশ্বরের বিষয়ে তর্ক চালাতে হবে।

রাসেল : হ্যাঁ, পার্থক্যটি আমি পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারছি। কিন্তু একই সঙ্গে একটি সত্তা সম্পর্কে যার যথেষ্ট জ্ঞান আছে তার পক্ষেই এটা বলা সত্য হবে ‘এখানে এই সত্তাটি আছে যার সারসত্তাই তার অস্তিত্ব!

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, যদি কেউ ঈশ্বরকে দেখত তবে অবশ্যই সে বুঝতে পারত যে ঈশ্বর অবশ্যই বিদ্যমান।

রাসেল : অতএব আমি বলতে চাই যে এমন একটি সত্তা আছে যার সারসত্তাই তার অস্তিত্ব, যদিও আমরা সেই সারসত্তাকেই জানি না।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, আমি এর সঙ্গে আরও যোগ করব যে আমরা পূর্বকল্পিত ধারণা হিসেবে সারসত্তাকে জানি না। আমাদের অভিজ্ঞতায় কেবলমাত্র একটি পশ্চাদ্বতী কল্পনা যার দ্বারা আমরা সত্তার অস্তিত্ব বিষয়ক জ্ঞানে আসতে পারব এবং তারপর কেউ প্রমাণ করতেই পারে যে সারসত্তা এবং অস্তিত্ব অভিন্ন। কারণ ঈশ্বরের সারসত্তা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি অভিন্ন না হত তবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্যেই ঈশ্বরের বাইরে অন্য কোন যথার্থ কারণের প্রয়োজন হয়ে পড়ত।

রাসেল : এবার যথেষ্ট কারণের দিকে সমগ্র বিষয়টি ঘুরে গেল এবং আমি অবশ্যই বলব যে যথেষ্ট কারণ সম্পর্কে আপনি এমনভাবে ব্যাখ্যা করেননি যাতে আমি বুঝতে পারি আপনি যথেষ্ট কারণ বলতে ঠিক কি বোঝেন? আপনি কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি বোধহয়?

কপলেস্টোন : কখনই নয়। কারণ (cause) হল এক ধরনের যথেষ্ট কারণ (sufficient reason)। একমাত্র অনিশ্চিত সত্তার একটি কারণ থাকতে পারে। ঈশ্বর তাঁর নিজের জন্য যথেষ্ট কারণ এবং তিনি নিজেই তার কারণ (cause) নন। যথেষ্ট কারণ বলতে আমি বোঝাতে চাই কোন বিশেষ সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনুরূপ বা পর্যাপ্ত ব্যাখ্যার কথা।

রাসেল : কিন্তু ঠিক কখন একটি ব্যাখ্যা অনুরূপ বা পর্যাপ্ত হতে পারবে? ধরুন আমি একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন ধরাতে উদ্যোগী। আপনি বলতে পারেন যে এর জন্য অনুরূপ যে ব্যাখ্যাটি হবে তা হল আমি দেশলাই কাঠিটিকে দেশলাই বাক্সের উপরে ঘষবো।

কপলেস্টোন : বাস্তব উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে এটি ভালো কথা কিন্তু তত্ত্বগত দিক দিয়ে এটা একটি আংশিক ব্যাখ্যা। একটি অনুরূপ বা পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হল সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা। যার সঙ্গে আর কোন কিছুই নতুন করে যোগ করা সম্ভব নয়।

রাসেল : তা হলে আমি বলতে পারি যে আপনি তাকিয়ে আছেন এমন কিছুর দিকে যেটি কখনই পাওয়া যেতে পারে না এবং যাকে কারুর পাবার আশা করাও উচিত নয়।

কপলেস্টোন : একজন এটা দেখেনি বলতে এক জিনিস বোঝায়, কিন্তু একজনের এটা দেখা উচিত নয় বলাটা আমার কাছে গোঁড়ামি মনে হয়।

রাসেল : হতে পারে, তবে আমি জানি না। আমি বলতে চাই একটি বস্তুর ব্যাখ্যা হল একটি অন্য বস্তু যা দ্বিতীয় বস্তুর উপর নির্ভরশীল করে তোলে। আপনি যা করতে চাইছেন তার জন্য আপনাকে একটি দুঃখজনক পথ অবলম্বন করতে হবে যা আমরা করতে পারি না।

কপলেস্টোন : আমাদের বস্তুসকলের দুঃখজনক নকশা (Scheme) সম্পর্কে কিংবা সমগ্র বিশ্বের দুঃখজনক নকশা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই কি আমাদের তোলা উচিত নয়?

রাসেল : হ্যাঁ, আমি মনে করি না এধরণের প্রশ্ন করার মধ্যে কোন রকম অর্থ আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ব’ (universe) শব্দটিকে আমার সুবিধাজনক শব্দ হিসেবে মনে হয়, কিন্তু আমি মনে করি না কোন কিছুর স্বপক্ষে এই শব্দটি বসালেই তার একটি অর্থ হয়ে যাবে।

কপলেস্টোন : যদি শব্দটি অর্থহীন হয় তা হলে সেটিকে ব্যবহার করাটা খুব সুবিধাজনক হতে পারে না। কোন ক্ষেত্রেই আমি বলি না যে বিশ্বটি সেই বস্তুসমূহের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র যে বস্তুসমূহ তাকে গঠন করেছে। (প্রমাণের সংক্ষিপ্ত সারাংশে আমি যার ইঙ্গিত দিয়েছিলাম) যা কিছু আমি করছি তা কারণকে খোঁজার জন্যই করছি। এই ব্যাপারে বস্তুসকলের কারণ একটি বাস্তব বা কল্পিত সমগ্রতা (totality) যা গঠন করেছে তাকে যাকে আমরা বিশ্ব বলে ডেকে থাকি। এই বিশ্ব অথবা যদি আপনি পছন্দ করেন তবে বলব আমার অস্তিত্ব, কিংবা অন্য যে-কোন অস্তিত্বকে আপনি কি অবোধগম্য বলে মনে করেন?

রাসেল : আমি কি এই প্রশ্ন করতে পারি যে যদি একটি শব্দ অর্থহীন হয় তবে কি তা সুবিধার্থে ব্যবহারযোগ্য (Handy) হতে পারে না? যে শব্দটি শুনতে ভালো কিন্তু বাস্তবে বেঠিক। যেমন ‘The’ অথবা ‘Then’-এর মতো শব্দকেই ধরুন। এই শব্দ দুটি কোন বস্তুকে নির্দেশ করে না, কিন্তু এই শব্দ দুটি যথেষ্ট দরকারি শব্দ। আমি মনে করি ‘বিশ্ব’ (Unvierse) শব্দটিও তাই। কিন্তু এই বিষয়টিকে ছেড়ে যদি আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন বিশ্ব’ শব্দটিকে আমি অবোধগম্য ভাবি কি না, তবে আমি বলব যে আমি মনে করি ‘বিশ্ব’টি অবোধগম্য। –আমি এটাও মনে করি যে এর কোন ব্যাখ্যা হয় না। আমার মতে বোধগম্য শব্দটি একটি অন্য জিনিস। বোধগম্যতা নিজেই বস্তুর সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে কাজ করতে বাধ্য থাকে কিন্তু তার সম্পর্কসমূহের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য থাকে না ।

কপলেস্টোন : আমি যা বলতে চাই তা হল ঈশ্বরের থেকে বিচ্ছিন্ন জগৎ অত্যাবশ্যকভাবে অবোধগম্য। আপনি জানেন আমি বিশ্বাস করি না অনন্তবাচক ধারাবাহিক ঘটনাসমূহ বা তার অনুভূমিক ধারাবাহিকতাকে যদি এই ধরণের ধরাবাহিকতাকে অনন্ত ঘটনাসমূহে প্রমাণ করা যেত তবে তা অবস্থার (situation) সঙ্গে কিছুটা হলেও সঙ্গতিকর হত। যদি আপনি চকোলেটকে যুক্ত করেন তবে আপন চকোলেটকেই পাবেন, কখনই ভেড়াকে পাবেন না। যদি আপনি অনন্তের সঙ্গে চকোলেটকে যুক্ত করতেন তবে আপনি আনুমানিকভাবে অনন্ত সংখ্যা চকোলেট পেতেন। তাই যদি আপনি অনিশ্চিত সত্তার সঙ্গে অনন্তকে যুক্ত করেন তবুও অনিশ্চিত সত্তাকেই পাবেন কখনও প্রয়োজনীয় সত্তাকে পাবেন না। আমার ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী অনিশ্চিত সত্তাসমূহের অনন্ত ধারাবাহিকতা একটি অনিশ্চিত সত্তার মতোই নিজেই নিজেকে ঘটাতে অসমর্থ (বা নিজেই নিজের কারণ হতে অসমর্থ অনুবাদক) যদিও আমি মনে করি যে আপনি বলবেন কোন বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করবে কে সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাটা অবৈধ?

রাসেল : যদি এটিকে ব্যাখ্যা করে আপনি এটাই বোঝান তবে তা সর্বৈব সঠিক, কেননা আপনি এর একটি কারণ অনুসন্ধান করেছেন।

কপলেস্টোন : যদি তাই হয় তবে একটি বিশেষ বস্তুর বেলায় থামব কেন? কেন সমস্ত বিশেষ বস্তুসমূহের অস্তিত্বের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়?

রাসেল : কারণ আমার মনে হয় চিন্তা করবার মতো কোন যুক্তি (reason) নেই। কারণের (cause) সমগ্র ধারণাটি এমন একটি ধারণা যা আমরা বিশেষ বস্তুসমূহের পর্যবেক্ষণ থেকে পেয়ে থাকি। সমগ্র বস্তুসমূহের কোন রকম কারণ আছে, এরকম যুক্তি কোন রকম ভাবে সঙ্গতিকর বলে আমি মনে করি না।

কপলেস্টোন : যদি তাই হয়, তাহলে বলা যায় যে কারণ বলে কিছু নেই বিবৃতিটি আমাদের কোন কারণ অনুসন্ধান করা উচিত নয় বিবৃতিটির মতো একরকম নয়। কারণ বলে কিছু নেই তখনই বলা যাবে (যদি কখনও বলা যায়) যখন অনুসন্ধান শেষ হবে, কিন্তু অনুসন্ধান শুরুর সময় এ ধরনের বিবৃতি দেওয়া যায় না। যে-কোন ক্ষেত্রে, যদি সমগ্রের কোন কারণ না থাকে, তাহলে আমার চিন্তাধারা অনুযায়ী তার অবশ্যই নিজের একটি কারণ আছে। যা আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়। অধিকন্তু যদি একটি প্রশ্নের উত্তরে এটা বলা যায় যে জগৎ বলে কিছু একটা আছে তবে স্বীকার করে নেওয়া যায় যে প্রশ্নটির অর্থ আছে।

রাসেল : না, এর নিজের কোন কারণের প্রয়োজন নেই। আমি যা বলছি তা হল কারণের কল্পনাকে সমগ্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না।

কপলেস্টোন : তাহলে সারত্রের সঙ্গে আপনি একমত হবেন যে, বিশ্ব হল তাই যাকে তিনি ‘অকারণ’ (gratuitous) বলেছেন?

রাসেল : ‘অকারণ’ (gratuitous) যে ধরণের অর্থ বহন করে তা বোধহয় অন্য কোন অর্থ। আমি বলি যে বিশ্বটা বিশ্বই এবং এটাই সব।

কপলেস্টোন : আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে সমগ্র (total) অথবা যে-কোন কিছু যা এখানে আছে সে সম্পর্কে কোন বৈধতা মেনেই আপনি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। কেন কিছুই না থাকার থেকে কিছু থাকা ভালো–এটা প্রশ্ন? ঘটনাটি হল যে বিশেষ কারণ থেকে আমরা যে আকস্মিকতার জ্ঞান (Knowledge of casuality) অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবে পেয়ে থাকি তা ধারাবাহিকতার কারণ কি এই জিজ্ঞাসার সম্ভাবনাকে অবৈধ করে তোলে না। যদি কারণ’ (Cause) শব্দটি অর্থহীন হয় অথবা জড়বস্তু (Matter) সম্পর্কে কারেন্টর দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক বলে দেখানো যেতে পারত তবে আমি মেনে নিতাম যে প্রশ্ন করাটি অবৈধ হবে, কিন্তু আপনি কারণ’ শব্দটিকে অর্থহীন বলে ধরতে চান না এবং আমি এ-ও মনে করি না যে আপনি একজন কান্টীয় (Kantian)।

রাসেল : আপনার হেত্বাভাস বা দোষ (Fallacy) আমার কাছে কিরকম মনে হয় তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। বিদ্যমান প্রতিটি মানুষের একটি মা আছে এবং আপনার যুক্তিটি আমার কাছে এরকম মনে হয় যে এইজন্যই মানবজাতির একটি মা আছে, কিন্তু মানবজাতির অবশ্যই কোন মা নেই– এটা তর্কবিদ্যার ভিন্ন। ক্ষেত্র।

কপলেস্টোন : এর মধ্যে কোন সমতা দেখতে পাচ্ছি না। যদি আমি বলতাম ‘প্রতিটি বস্তুর একটি বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ (Phenomenal cause) আছে, তাই সমগ্র শ্রেণীর (Whole series) একটি বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ আছে, তবে সেখানে একটি সমতা থাকত, কিন্তু আমি তা বলছি না। আমি বলছি, প্রতিটি বস্তুর একটি বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ আছে, যদি আপনি অনন্ত ধারাবাহিকতার (Infinit series) উপর জোর দেন কিন্তু বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণসমূহের ধারাবাহিকতা, ধারাবাহিকতার সম্পর্কে একটি অপর্যাপ্ত ব্যাখ্যা। এইজন্য ধারাবাহিকতার কোন বাহ্য ব্যাপার সংক্রান্ত কারণ নেই কিন্তু তার অজ্ঞেয় কারণ (Transcendent cause) আছে।

রাসেল : এটাই সর্বদা ধরে নেওয়া হয় যে কেবলমাত্র প্রতিটি বস্তুই নয়, সামগ্রিকভাবে সমগ্র জগতেরও একটি কারণ আছে। কিন্তু এই ধারনার কোন ভিত্তি আমি দেখতে পাই না। তবে যদি আপনি এই ভিত্তির উপর আমাকে কিছু বলেন তবে আমি শুনবো।

কপলেস্টোন : ঘটনাসমূহের শ্রেণী হয় কারণগত অথবা কারণগত নয়। যদি এটি কারণগত হয়, তবে শ্রেণীর বাইরে কোন কারণ অবশ্যই থাকবে। যদি এটি কারণগত না হয় তবে তা নিজেই নিজের পর্যাপ্ত কারণ যাকে আমি প্রয়োজনীয় বলে থাকি। কিন্তু এটি কখনও প্রয়োজনীয় হতে পারে না যেহেতু প্রতিটি সদস্যই অনিশ্চিত এবং আমরা এ বিষয়টি মেনেই নিয়েছি যে সমগ্রের কোন বাস্তবতা নেই। এইজন্যই এটি কখনই প্রয়োজনীয় হতে পারে না অথবা অকারণগতও হতে পারে না তাই এর অবশ্যই কোন কারণ আছে। আমি বলতে চাই, বিশ্বটা কেবল আছেই এবং তা ‘অনির্বচনীয়’–এই ধরণের বিবৃতি কখনও যুক্তিগত বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া যায় না।

রাসেল : এই বিষয়ে আমি উদ্ধত হতে চাই না, কিন্তু আমি বলতে পারি যে আমি সেইসব বস্তুসমূহকে কল্পনা করতে পারি যে বস্তুসমূহ আপনার মতে মানবমন কল্পনা করতে পারে না। বস্তুসমূহের কোন কারণ নেই তা পদার্থবিদরা আমাদের নিশ্চিত করে দেখিয়েছেন এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে পরমাণুর মধ্যে প্রতিটি কোয়ান্টামের স্থানান্তরণের (Individual quantum transition in atom) কোন কারণ নেই।

কপলেস্টোন : এই বিষয়টি একটি অস্থায়ী অনুমান কিনা সে বিষয়ে আমি বিস্ময় বোধ করছি।

রাসেল : তা হতে পারে, কিন্তু বিষয়টি এই সত্য প্রদর্শন করছে যে পদার্থবিদদের মন একে কল্পনা করতে পারে।

কপলেস্টোন : আমি স্বীকার করি কিছু বিজ্ঞানী পদার্থবিদরা একটি সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যে প্রত্যয়হীনতার (Indetermination) বিষয়টি বাদ দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীরা এরকম করতে ইচ্ছুক নন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডিঙ্গল এই মত পোষণ করেন যে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব আপেক্ষিক পর্যবেক্ষণ (Correalting observation) বর্তমান পারমাণবিক তত্ত্বের সফলতা (অথবা অসফলতা) সম্পর্কে আমাদের কিছু জানাতে পেরেছে কিন্তু প্রকৃতির সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি। অনেক বৈজ্ঞানিক এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। আমি এটাই বুঝে উঠতে পারি না কিভাবে যে-কোন ব্যাপারে পদার্থবিদরা তত্ত্বকে বাস্তব ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন অথচ তারা তত্ত্ব গঠনের ক্ষেত্রে এরকম করেন না। আমি বুঝতে পারি না প্রকৃতিতে যে বোধগম্যতা (Intelligibility) এবং শৃঙ্খল (Order) আছে তার চেয়ে অন্য অনুমানের উপর কিভাবে বিজ্ঞানকে পরিচালিত করা যেতে পারে। পদার্থবিদরা নীরবতার সঙ্গে পূর্বেই মেনে নেন যে অনুসন্ধানমূলক প্রকৃতির মধ্যে এবং ঘটনাসমূহের কারণসমূহকে খোঁজার মধ্যে কিছু অর্থ আছে, ঠিক যে-রকমভাবে একজন গোয়েন্দা পূর্বে মেনে নেয় যে খুনীকে খুঁজে বার করাটার মধ্যে একটা অর্থ আছে। অধিবিদ্যাবিদরা ধরে নেন যে সরাসরি ইন্দ্রিয়গোচর বস্তু বা বিষয়ের কারণ অথবা যুক্তিকে খোঁজার মধ্যে একটা অর্থ আছে। একজন কান্টীয় না হয়ে আমি মনে করি যে একজন অধিবিদ্যাবিদ অনুমানের ক্ষেত্রে একজন পদার্থবিদের মতোই ন্যায় সংগত। উদাহরণস্বরূপ, যখন সারত্রে বলেন যে জগৎটি অকারণ তখন আমি মনে করি তিনি অকারণ’ বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন সে বিষয়ে পর্যাপ্ত বিবেচনা করেননি।

রাসেল : এখানে একটি বিশেষ অনধিকার চর্চা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। একজন পদার্থবিদ কারণের অনুসন্ধান করেন, এবং তা অনিবার্যভাবে এই অর্থ প্রকাশ করে যে সর্বত্রই কারণ সমূহের অস্তিত্ব আছে। যে-মানুষটি সোনার খোঁজ করছে সে এই ভেবে সোনার খোঁজ করছে না যে সোনা সর্বত্রই আছে। এই একই কথা পদার্থবিদের ক্ষেত্রেও সত্য যখন তিনি কারণসমূহের অনুসন্ধান করেন। সারত্রের কথাই ধরুন। তিনি কি বলতে চেয়েছেন তা আমি জানি বলে স্বীকার করি না, কিন্তু আমার এরকম মনোভাব রাখা উচিত নয় যে তাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। আমার দিক থেকে আমি মনে করি যে জগতের খেয়ালের (Otion of the world) একটি ব্যাখ্যা আছে এরকম মনে করাটা একটা ভুল। আমি বুঝি না কেন একজন এইরকম ব্যাখ্যা পাবার আশা করে থাকে এবং আমি মনে করি আপনি বিজ্ঞানীদের অনুমানকে কেন্দ্র করে যা বললেন তা একটি অতিবিবৃতি।

কপলেস্টোন : আমার মনে হয় বিজ্ঞানীরা এই ধরণের অনুমান গঠন করেন। যখন একটি বিশেষ সত্তাকে বার করতে তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান, তখন সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার পেছনে একটি অনুমান নিহিত থাকে যে বিশ্বটি কোন অবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে একটি সত্যকে আবিষ্কার করার সম্ভাবনা আছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা মন্দও হতে পারে, অথবা তারা যে-ফল চান সেই অনুযায়ী না-ও হতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে একটি সত্য আবিষ্কার করার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই কারণেই আমার মনে হয় একটি শৃঙ্খলিত ও বোধগম্য বিশ্বকে অনুমান করা যায়।

রাসেল : আমার মনে হয় আপনি যতটা প্রয়োজনীয় তার থেকে বিষয়টিকে বেশি সাধারণ করে তুলেছেন। নিঃসন্দেহে একজন বিজ্ঞানী অনুমান করতে পারেন যে কোন বস্তুকে বা সত্যকে হয়ত বার করা যাবে এবং প্রায় সে-রকমই বার হবে। কিন্তু তিনি এইরকম অনুমান করেন না যে সেটাই বার হবে। এটাই আধুনিক পদার্থবিদ্যার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কপলেস্টোন : আমি মনে করি বিজ্ঞানী তার কাজ করতে করতে অনুমান করেন অথবা অনুমান করতে বাধ্য থাকেন। অধ্যাপক হালডেনকে উদ্ধৃত করে এটাও বলা যায়, যখন আমি কেটলীর নীচে গ্যাস জ্বালালাম তখন জলের কিছু অণু বাষ্প হয়ে উড়ে গেল, কিন্তু কে এই কাজটা করছে তা দেখবার কোন পথ নেই। তা বলে সম্ভাবনার ধারণাকে (Idea of change) সর্বত্র ব্যবহার করা যাবে কেবলমাত্র আমাদের যেখানে জ্ঞান আছে সেখানে ছাড়া এই ধরণের ধারণাকে কখনই তিনি অনুসরণ করতে বলেননি।

রাসেল : না, তা অবশ্যই নয় অন্তত তিনি যা বলেছেন তা যদি আমি করতে পারি। তিনি বহু বস্তুকেই খুঁজে বার করেছেন। বিজ্ঞানীরা জগতে যা কিছু ঘটছে তার অনেক কিছুই খুঁজে বার করছেন, সর্বপ্রথমে যেগুলো সাময়িক শৃঙ্খলসমূহকে (Casual chains) শুরু করেছে। প্রথম কারণগুলি এমন যে কারণসমূহের নিজেদেরই কোন কারণ নেই। তিনি মনে করেন না যে প্রতিটি বস্তুর একটি কারণ আছে।

কপলেস্টোন : নিশ্চয়ই সেগুলো বিশেষ নির্বাচিত ক্ষেত্রের মধ্যে স্থিত প্রথম কারণ (First cause), কিন্তু আপেক্ষিকভাবে প্রথম কারণ।

রাসেল : আমি মনে করি না যে তিনি এ ধরণের কথা বলবেন। যদি এটি এমন একট জগৎ হয় যেখানে সব ঘটনা না হলেও বেশিরভাগ ঘটনার কারণ আছে, তাহলে তিনি অনুমানের দ্বারা সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তাকে বর্ণনা করতে সক্ষম হবেন যে আপনি যে বিশেষ ঘটনাটির সম্পর্কে উৎসাহিত তার সম্ভবত একটি কারণ আছে। যে-কোন ব্যাপারেই আপনি সম্ভাবনার চেয়ে বেশি কিছু পাবেন না। এবং সেটাই যথেষ্ট।

কপলেস্টোন : এটাও হতে পারে বিজ্ঞানী সম্ভাবনার (Probability) চেয়ে বেশি কিছু অর্জন আশা করতে পারে না, কিন্তু প্রশ্নের অবতারণা করে তিনি অনুমান করেন যে ব্যাখ্যা সম্পর্কিত প্রশ্নের একটি অর্থ আছে। কিন্তু মহানুভব রাসেল, আপনার বিষয়টি কি তাই যে জগৎ সম্পর্কে কোন রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাটাও একটা অবৈধ ব্যাপার?

রাসেল : হ্যাঁ, আমি এমন মতই পোষণ করে থাকি।

কপলেস্টোন : যদি এটা এমন একটি প্রশ্ন হয় যার কোন অর্থ আপনার কাছে নেই, তাহলে তার সম্পর্কে আলোচনা করাটাও দুষ্কর হয়ে উঠবে, তাই নয় কি?

রাসেল : হ্যাঁ, এটা খুবই দুষ্কর। আপনি কি বলেন আমরা কি অন্য কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করতে পারি?

ধর্মীয় অভিজ্ঞতা

কপলেস্টোন : আসুন আলোচনা করা যাক। সম্ভবত আমি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি কথা বলতে পারি এবং তারপর আমরা নৈতিক অভিজ্ঞতার উপর আলোচনা চালাতে পারি। আমি মনে করি না ধর্মীয় অভিজ্ঞতার অর্থ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত দৃঢ় প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং আলোচনার চরিত্রটির কিছুটা পরিবর্তন হল। আমার মতে এ বলাটা সত্য হবে যে এর সব থেকে উত্তম ব্যাখ্যাটি ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বলতে আমি কেবল মঙ্গলজনক অনুভবকে বোঝাতে চাইছি না। আমি বোঝাতে চাইছি বস্তু সম্পর্কে একটি প্রেমময় অথচ অপরিচ্ছন্ন সচেতনতাকে যা অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর কাছে নিজ আত্মার এক ধরণের তুরীয় ভাব। এটি এমন এক ভাব যাকে চিত্রিত করা যায় না অথবা কল্পনা করা যায় না, কিন্তু যার বাস্তবতা সম্পর্কেও কোন সন্দেহ করা অসম্ভব অন্তত অভিজ্ঞতা অর্জন করার সময় কোন রকম সন্দেহ করাটা অসম্ভব। আমি দাবি করতে পারি যে তা যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব এবং মানসিকভাবে নিজের মনেই নিজে জানা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যে কোন মাত্রায় যে প্রকৃত প্রাথমিক অভিজ্ঞতা এই প্রকল্পের বা অনুমানের উপর সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় সে অভিজ্ঞতার কিছু বস্তুগত কারণ আছে।

রাসেল : এই যুক্তির উত্তরে আমি যা বলব তা হল, এই সমগ্র বিষয়টি আমাদের নিজেদের মানসিক অবস্থা থেকে জাত হয়ে আমাদের বাইরে কোন কিছুকে নির্দেশ করে। যা আমার মতে অতি চালাকির বিষয়। এমনকি যখন আমরা সবাই তার ন্যায্যতাকে স্বীকার করে নিই, এবং এইরকম করাটাকে আমরা যখন ন্যায়সংগত বলে অনুভব করি, তখনও বিষয়টিকে আমার এক ধরণের চালাকি মনে হয়। আমরা এরকম করি তার কারণ এটি মানবজাতির একরকম সংস্কার। যদি একটি ঘরে ভীড় থাকে এবং যদি সে ঘরে একটা ঘড়ি থাকে, তবে সবাই ওই ঘড়িটিকেই দেখতে পাবে। ঘটনাটি হল যে তারা সবাই ঘড়িটিকে দেখতে পাবে। এই ঘটনাটি তাদের এই চিন্তা করাবে যে এই ঘটনাটি কোন মতিভ্রম বা মায়া নয়। কিন্তু সেখানে এইসব ধর্মীয় অভিজ্ঞতাসমূহ অতি ব্যক্তিগত হবার প্রবণতাসম্পন্ন হয়।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এই রকম ঘটে। আমি যথার্থ অতীদ্রিয় অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমি কোন ভাবে এই ব্যাপারে দর্শনসমূহকে (Visions) অন্তর্ভুক্ত করছি না। আমি কেবল বোঝাতে চাইছি তুরীয় বস্তু সম্পর্কে অভিজ্ঞতাকে বা যাকে তুরীয় বস্তু (Transcendent object) বলা হয়ে থাকে তাকে। আমি সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করি যে তা অবর্ণনীয়। আমার মনে আছে জুলিয়ান হাক্সলে তাঁর কোন একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন যে ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, অথবা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, প্রেমে পড়া, কলা ও কাব্যকে প্রশংসা করার অভিজ্ঞতার মতোই অনেকটা। তাই আমি বিশ্বাস করি, যখন আমরা কাব্য ও কলাকে প্রশংসা করি তখন আমরা নির্দিষ্ট কোন কবিতাসমূহ ও কলা সম্পর্কীয় কর্মকে প্রশংসা করে থাকি। যদি আমরা প্রেমে পড়ি তাহলে আমরা কারুর সঙ্গে প্রেমে পড়ি, কখনই এমন প্রেমে পড়ি না যেখানে কেউ নেই।

রাসেল : কিছুক্ষণের জন্য আমি ধারাবাহিকতাকে ভাঙছি। এই বিষয়টিই যে সর্বদাই ঘটবে এরকম কোন কারণ নেই। যতক্ষণ কিছু জলজ্যান্ত মানুষ কাল্পনিক নায়িকার প্রেমে আত্মহত্যা না করছে ততক্ষণ জাপানী ঔপন্যাসিকরা মনে করেন যে তাদের সফলতা আসেনি।

কপলেস্টোন : জাপানের এই ধরণের ঘটনার পক্ষে আপনার বক্তব্যকে আমি সমর্থন করি। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমি আত্মহত্যা করিনি, কিন্তু দটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ পড়ার পর আমি আমার জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। যদিও আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে আমার উপর ওই গ্রন্থ দুটির বাস্তব প্রভাব ও যথার্থ অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মধ্যে আমি কোন সাদৃশ্য দেখতে পাইনি, কেননা একজন বহিরাগত হিসেবে সেই অভিজ্ঞতার ধারণা যটা অর্জন করা যেতে পারে ততটাই আমার ছিলো।

রাসেল : আমরা অবশ্যই ঈশ্বরকে উপন্যাসের চরিত্রসমূহের কোন সত্তা হিসেবে দেখবো না। আপনি অবশ্যই স্বীকার করবেন যে এই দুটির মধ্যে একটি স্বতন্ত্রতা আছে।

কপলেস্টোন : আমি অবশ্যই তা স্বীকার করব। কিন্তু আমি একথা অবশ্য বলব যে উত্তম ব্যাখ্যা সম্ভবত হয় কোন শুদ্ধ অধ্যাত্মবাদী ব্যাখ্যা (Subjectivisit explanation) নয়। যদিও অধ্যাত্মবাদী ব্যাখ্যা কিছু বিশেষ মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব, যাদের ভেতর অভিজ্ঞতা ও জীবনের মধ্যে খুব কম সম্পর্কই আছে। মোহগ্রস্ত, প্রবঞ্চিত ও এমন ধরণের মানুষদের এরকমভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের মতানুযায়ী যাকে শুদ্ধ ধরনের অধ্যাত্মবাদ বলে আমরা মনে করতে পারি, তার অভিজ্ঞতা যখন আপনি পাবেন তখন তার ফল হবে গতিশীল ও সৃষ্টিশীল প্রেমের প্রবাহ। আমার মনে হয় অভিজ্ঞতার বিষয়গত কারণের (Objective cause) প্রকৃত অস্তিত্বই তার একমাত্র উত্তম ব্যাখ্যা।

রাসেল : ঈশ্বর বলে কিছু নেই এরকম কিছু নিয়ে আমি গোঁয়ারের মতো লড়াই করতে চাইছি না। যে ভাবে আমি অন্য নথিসমূহকে (Records) নিয়ে থাকি সেরকম ভাবে যা নথিভুক্ত তাকেই কেবল গ্রহণ করতে পারি। আমি জানি সেখানে অনেক কিছু সম্পর্কেই বলা হয়েছে। আমি এ বিষয়েও নিশ্চিত যে আপনি মঙ্গলকর উপদেবতা এবং অমূলক বস্তু ও শয়তান বিষয়ক বহু জিনিস সেখান থেকে গ্রহণ করবেন না যেখানে এই সমস্ত জিনিস সম্পর্কেও ওই একই প্রত্যয় ও বিশ্বাসের সঙ্গে বলা হয়েছে। একজন অতীন্দ্রিয়বাদীর দর্শন (Vision) যদি সত্যই হয় তবে শয়তান আছে এই বিষয়টিও সত্য। কিন্তু আমি শয়তান আছে বলে কিছু জানি না।

কপলেস্টোন : কিন্তু শয়তানের বিষয়ে বলতে গিয়ে মানুষ দর্শন, ভূত, দেবদূত, মঙ্গলকর উপদেবতা এবং আরও অনেক কিছুর কথা বলে থাকে। আমি কাল্পনিক ভূত ইত্যাদিকে অবশ্যই বাতিল করব, কারণ আমি মনে করি বস্তুর অস্তিত্ব ছাড়াই সেগুলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এবং যেগুলোকে দেখা যেতে পারে বলে মনে হয়।

রাসেল : কিন্তু আপনি কি জানেন না এমন প্রচুর পরিমাণ নথিভূক্ত ঘটনা আছে যেখানে মানুষ তাদের নিজেদের হৃদয়ের ভেতর থেকে শয়তানের কথা শুনেছে ঠিক সেই রকম ভাবে, যেরকম ভাবে ঈশ্বর তাদের হৃদয় থেকে নিজের অতীন্দ্রিয় অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত করেছেন। কোন বাহ্যিক দর্শনের কথা এখন বলছি না, আমি সম্পূর্ণভাবে মানসিক অভিজ্ঞতার কথা বলছি। ঈশ্বরের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মতোই এও সেই একই ধরণের অভিজ্ঞতা এবং আমি এটাই বুঝতে পারি না যে কিভাবে অতীন্দ্রিয়বাদীরা আমাদের বলে থাকেন যে ঈশ্বর বিষয়ক যে কোন আলোচনা শয়তান বিষয়ক আলোচনার সমানুপাতিক নয়।

কপলেস্টোন : এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। যদিও সেইসব মানুষ কল্পনা করেছিল বা চিন্তা করেছিল যে তারা শয়তানকে বলতে শুনেছিল বা তাকে দেখেছিল। শয়তানকে অস্বীকার করে সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। কিন্তু আমি মনে করি যে মানুষ এই দাবি করেছে যে তারা ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। অ-খ্রীষ্টীয় পুটনিয়ামের ঘটনার কথাই ধরা যাক তিনি স্বীকার করেছেন যে এই ধরণের অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়। বস্তুটি কেবল প্রেমময় এবং এইজন্য তা এমন কোন বস্তু নয় যা ভয় বা ঘৃণার কারণ হয়ে থাকে। এবং সেই অভিজ্ঞতার প্রভাবকেই সেখানে বহন করা হয়েছে, অথবা আমি বলতে চাই সেই অভিজ্ঞতার বৈধতাকেই পুটনিয়ামের জীবনের নথিপত্রে বহন করা হয়েছে। যে-কোন ভাবেই হ’ক এটি মনে করা খুবই যুক্তিযুক্ত হবে যে তার এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যদি আমরা পুটনিয়ামের দয়া ও বদান্যতা সম্পর্কে প্রফিরির তথ্যসমূহকে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হই তবে তা আমরা অবশ্যই মেনে নেব বলে আশা করি।

রাসেল : একটি বিশ্বাস মানুষকে খুব নৈতিক করে তোলে এরকম কোন প্রমাণ নেই, তা সেই বিশ্বাসের স্বপক্ষে যতই বলা হ’ক না কেন।

কপলেস্টোন : কিন্তু যদি প্রকৃতই প্রমাণ করা যেতে পারে যে বিশ্বাসই মানুষের জীবনের উপর শুভ কার্য করতে পারে তবে তাকে আমি একটি সত্যের সাপেক্ষে অনুমান বলে ধরে নেব, এবং সেই সত্যের সম্পূর্ণ বৈধতাকে মেনে না নিলেও তার যে কোন পরিমাণের ধনাত্মক দিকটিকে মেনে নেব। যে-কোন ঘটনাতেই অতীন্দ্রিয় সত্যবাদিতা ও পবিত্র জীবনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে আমি চরিত্রগুলো ব্যবহার করেছি। কিন্তু তার বিশ্বাসসমূহের পক্ষে কোন প্রমাণ হিসেবে আমি তা দেখাইনি।

রাসেল : কিন্তু আমিও তাকে প্রমাণ হিসেবে মনে করি না। আমি নিজেও একটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম যা আমার চরিত্রকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং সেই সময় আমি ভেবেছিলাম মঙ্গলের জন্যই আমার চরিত্রটি পরিবর্তিত হয়েছে। সেইসব অভিজ্ঞতাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু তারা আমার বাইরে কোন অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমি মনে করি না যে যদি আমি মনে করতাম যে তারা আমার বাইরে কোন অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত, তবে ঘটনাটি দাঁড়াত এই যে, সেই অভিজ্ঞতাগুলির এমন একটি কার্যকরী প্রভাব থাকত, যার ফলে আমি যে ঠিক, এই রকম কোন-না-কোন প্রমাণ রাখত।

কপলেস্টোন : না, তা নয়, আমি মনে করি যে আপনার মঙ্গলজনক অভিজ্ঞতার বর্ণনার মধ্যে দিয়েই যে সত্যের প্রমাণ হচ্ছে সেটাই মঙ্গলজনক কার্য। দয়া করে মনে রাখবেন, আমি একথা বলছি না যে একজন অতীন্দ্রিয়বাদী তার নিজের অভিজ্ঞতা বা মধ্যস্থতার ব্যাপারে আলোচনা ও সমালোচনা থেকে মুক্ত হবেন।

রাসেল : স্পষ্টতই একটি যুবক ছেলের চরিত্র ইতিহাসের কোন মহান মানুষের সম্পর্কে পড়ার পর চিরকালের জন্য দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং এইরকম প্রায়শই হয়। এটাও ঘটতে পারে যে সেই মহান মানুষটি পৌরাণিক হয়ে গেছেন এবং বিদ্যমান নন, কিন্তু সেই যুবক চিরকালের জন্য এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছে যেন সেই মহান মানুষটি নিজেই তাকে এরকম প্রভাবিত করেছেন। এইরকম মানুষ এখানে অনেক আছেন। উদাহরণস্বরূপ, পুটার্কের জীবন যে লাইকারগুসকে গ্রহণ করেছিল তিনি কোন কালেও বিদ্যমান ছিলেন না, কিন্তু যদি লাইকারগুসকে পড়েন তবে আপনার এমন মনে হবে যে তিনি আগে বিদ্যমান ছিলেন। তখন আপনি এমন একটি বস্তুর দ্বারা প্রভাবিত হবেন যাকে আপনি ভালোবাসেন কিন্তু তা কোন বিদ্যমান বস্তু নয়।

কপলেস্টোন : এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একমত যে একটি মানুষ উপন্যাসের কোন চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। যা তাকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে কোন প্রশ্নে না গিয়ে (আমি অবশ্যই বাস্তব মূল্যের কথা বলব) আমি বলব যে সেই মানুষটির অবস্থা (Situation) এবং একজন অতীন্দ্রিয় মানুষের অবস্থা স্বতন্ত্র। সর্বোপরি যে মানুষটি লাইকারগুসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে সে এমন কোন দুর্দমনীয় ধারণা অর্জন করতে পারেনি যে সে যে-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা চরম বাস্তব।

রাসেল : আমি মনে করি না যে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি এবং ইতিহাসে এইসব অনৈতিহাসিক চরিত্রগুলির সম্পর্কে আমার যুক্তিটি আপনি ধরতে পেরেছেন। আমি অনুমান করতে পারছি না সেই বিষয়টিকে যাকে আপনি কারণ-নির্ভর কার্য বলে অভিহিত করেছেন। আমি অনুমান করছি, যুবক ছেলেটি এই ব্যক্তির সম্পর্কে পড়ে এবং তাকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করে, তাকে ভালোবাসে– যা ঘটা খুবই সহজ এবং তার এই ভালোবাসাটা একটা ভূতকে ভালোবাসার মতো।

কপলেস্টোন : একটি অর্থে সে একটি ভূতকে ভালোবাসছে বিষয়টি যথার্থভাবে সত্য। আমি এই অর্থেই কথাটি বলছি যে সে এক্স বা ওয়াই-কে ভালোবাসছে যে বিদ্যমান নয়। কিন্তু ওই একই সময়ে আমার মনে হয়, সে যাকে ভালোবাসছে সে ভূত নয়। সে অনুভব করে একটি বাস্তব মূল্যকে, এবং এমন একটি ধারণাকে সে স্বীকার করে নেয় যা বস্তুগতভাবে ন্যায্য এবং এই কারণেই তা তার প্রেমকে উত্তেজিত করে তোলে।

রাসেল : এই একই অর্থ আমরা উপন্যাসের চরিত্রগুলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পূর্বেই পেয়েছিলাম।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, একটি অর্থে মানুষের অশরীরী বা ভূতকে ভালোবাসা যথার্থভাবে সত্য। কিন্তু আর একটি অর্থে সে তাকেই ভালোবাসছে যাকে সে একটি মূল্য হিসেবে অনুভব করে।

নৈতিক বিষয়

রাসেল : কিন্তু আপনি কি এখন সেই কার্যের কথা বলছেন না, আমি বলতে চাইছি যা কিছু ভালো তাই ঈশ্বর অথবা যা কিছু ভালো তার সমষ্টি ঈশ্বর– এমন একটি ব্যবস্থা যা মঙ্গলময় এবং এই কারণে যখন একটি যুবক কোন কিছুকে ভালোবাসে তখন সেটাই ভালো যেটাকে যে ভালোবাসছে। আপনি কি এগুলেই বলতে চাইছেন? যদি তাই হয় তবে বিষয়টি একটু তর্ক সাপেক্ষ।

কপলেস্টোন : সর্বেশ্বরবাদকে সামনে রেখে ঈশ্বর সমগ্র মঙ্গলের সমষ্টি বা এমন কিছু একটা ব্যবস্থা (System) যা মঙ্গলময়–এরকম আমি বলি না। আমি সর্বেশ্বরবাদী নই, কিন্তু আমি মনে করি যে সমস্ত মঙ্গলময়তা যে-কোন পথেই ঈশ্বরে প্রতিফলিত হয় এবং তাঁর কাছ থেকেই অগ্রসর হয়, এই অর্থে একটি মানুষ যে সত্যই মঙ্গলজনক কোন কিছুকে ভালোবাসে সেই ঈশ্বরকে ভালোবাসে, এমনকি যদি সে ঈশ্বরের প্রতি মনোযোগ নাও রাখে তাহলেও। কিন্তু এখনও আমি মেনে নেব যে মানুষের এই ধরণের আচরণের ন্যায্যতা নির্ভর করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার উপর।

রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু তা প্রমাণ করবার একটি বিষয়।

কপলেস্টোন : একেবারেই ঠিক, কিন্তু আমি অধিবিদ্যাগত বিষয়টিকে প্রমাণপত্র হিসেবে ভাবি, তবে এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে পার্থক্য ঘটবে।

রাসেল : আমি অনুভব করি যে কিছু বস্তু মঙ্গলময় এবং অন্য বস্তুগুলো মন্দ। আমি সেইসব বস্তুকে ভালোবাসি যেগুলো মঙ্গলময়, কেননা সেগুলোকে আমি মঙ্গলময় ভাবি এবং আমি সেই সমস্ত বস্তুকে ঘৃণা করি যেগুলোকে আমি ঘৃণা করি। আমি এরকম বলি না যে এই বস্তুগুলো ভালো কেননা তারা স্বর্গীয় মঙ্গলময়তার সঙ্গে যুক্ত।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, কিন্তু ভালো ও মন্দের মধ্যে বিচারটি আপনার কি-রকম অথবা এই দুটির মধ্যে পার্থক্য আপনি কিভাবে করেন?

রাসেল : যখন নীল ও হলুদের মধ্যে পার্থক্য করতে যাই তখন আমার বিচারের কোন প্রয়োজন হয় না। নীল ও হলুদের মধ্যে পার্থক্য করতে গেলে আমার কি বিচারের প্রয়োজন? আমি দেখতেই পাই যে তারা স্বতন্ত্র।

কপলেস্টোন : এটি একটি সুন্দর বিচার বলে আমাকে মানতেই হবে। আপনি নীল ও হলুদ রঙকে দেখেই তাদের পার্থক্য করেন, কিন্তু ভালো ও মন্দকে পার্থক্য করেন কোন ক্ষমতা বলে?

রাসেল : আমার অনুভবের দ্বারা।

কপলেস্টোন : আপনার অনুভবের দ্বারা আপনি তা করেন। ঠিক আমি এটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি কি মনে করেন শুভ এবং অশুভ বিষয়টি কেবল অনুভবের বিষয়?

রাসেল : কেন এক ধরণের বস্তুকে নীল মনে হয়, এবং অন্য ধরণের বস্তুকে হলুদ মনে হয়? পদার্থবিদদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমি একটু বেশি বা কম উত্তর দিতে পারি এবং ওই একইভাবে একটি জিনিস মঙ্গলময় ও আর একটি জিনিস অশুভ কি করে হয় তার উত্তরও দেওয়া সম্ভব, কিন্তু উত্তরটি বিষয় সাপেক্ষে যাচ্ছে না, তাই আপনাকে আমি উত্তরটি দিতে পারব না।

কপলেস্টোন : বেলসেনের সেনানায়কের আচরণের কথা আলোচনা করা যাক। যা আপনার অনাকাক্ষিত ও অশুভ মনে হবে আমার কাছেও তাই হবে, কিন্তু অ্যাডলফ হিটলারের কাছে তা মঙ্গলময় ও আকাঙ্ক্ষিত বলে মনে হবে। আমি মনে করি যে আপনি অবশ্যই স্বীকার করে নিয়েছেন যে-বিষয়টি হিটলারের জন্য মঙ্গলজনক আপনার কাছে তা অমঙ্গলজনক।

রাসেল : না, বিষয়টিকে আমি এমন ভাবে নেব না। আমি মনে করি মানুষ এ বিষয়ে ভুল করতেই পারে যেমন সে অন্য বিষয়ে ভুল করতে পারে। যদি আপনার ন্যাবা রোগ হয় তবে আপনি সব কিছুতেই হলুদ দেখবেন কিন্তু সেগুলো হলুদ নয়। আপনি একটি ভুল করছেন।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, একজন ভুল করতে পারে, কিন্তু প্রশ্নটি যদি কেবলমাত্র অনুভব বা আবেগ সম্পর্কিত হয় তবে কি আপনি ভুল করবেন? কি তার আবেগসমূহে আবেদন রাখতে পেরেছিল সে সম্পর্কে হিটলারই সম্ভবত একমাত্র বিচারক।

রাসেল : এটা বলা একদম ঠিক হত যে এটি তার আবেগসমূহে আবেদন রেখেছিল, কিন্তু আপনি সে সম্পর্কে অনেক কিছুই বলতে পারেন, অন্যান্য এতগুলো বিষয়ের মধ্যে কেবলমাত্র ওই একই ধরণের বস্তু যদি হিটলারের আবেগসমূহে আবেদন রাখে তাহলে হিটলার আমার আবেগসমূহে স্বতন্ত্র আবেদন রাখবে।

কপলেস্টোন : বিষয়টি আমি মেনে নিলাম। অনুভবের বাইরে কোন বস্তুগত প্রমাণ নেই, তাহলে বেলসেনের সেনানায়কের আচরণকে আপনি কিভাবে নিন্দা করবেন?

রাসেল : ঠিক সেই ভাবে যেভাবে একজন বর্ণান্ধ মানুষকে করা যায়, তার থেকে বেশি কিছু নয়। আমরা বিদ্যাবুদ্ধিগতভাবে একজন বর্ণান্ধ মানুষকে নিন্দা করি ও আমরা এরকম করি ব্যক্তি সংখ্যালঘিষ্ঠদের মধ্যে পড়ে বলেই না?

কপলেস্টোন : এর কারণ হিসেবে আমি বলব সেই মানুষটির যা অভাব তা সাধারণত মানব প্রকৃতির অন্তর্গত।

রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু সে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে পড়ে তবে তার সম্পর্ক আমরা ও কথা বলব না।

কপলেস্টোন : তাহলে আপনি বলবেন যে অনুভবের বাইরে এমন কোন বিষয় নেই। যা দিয়ে কেউ বেলসেনের সেনানায়ক, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস অথবা ক্যান্টারবেরির আর্ক বিশপের আচরণকে আলাদা করে দেখতে পারবে।

রাসেল : অনুভব বিষয়টি অতি সাধারণীকরণ। আপনাকে কার্যসমূহের প্রভাবসমূহকে এবং সেই প্রভাবসমূহ অনুযায়ী আপনার অনুভবকে নিতে হবে। আপনি দেখবেন, এই বিষয়ে আপনি একটি যুক্তি দিতে পারেন যদি আপনি বলেন যে কিছু বিশেষ ধরণের ঘটনা আছে যেগুলো আপনার পছন্দ অনুযায়ী নয়। তারপর, আপনি কার্যসমূহের প্রভাবসমূহকে অবশ্যই কারণ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হবেন। তখন আপনি খুব ভালো ভাবে বলতে পারবেন যে বেলসেনের সেনানায়কের কার্যসমূহের প্রভাব খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং নিরানন্দজনক ছিল।

কপলেস্টোন : শিবিরে থাকা মানুষের কাছে তা সত্যই নিরানন্দজনক ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল বলে আমি স্বীকার করি।

রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু তা শুধু শিবিরে থাকা মানুষদের কাছেই নিরানন্দজনক ছিল না, বাইরের মানুষদের কাছেও তা চিন্তার বিষয় ছিল।

কপলেস্টোন : হ্যাঁ, কল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে পুরোপুরি সত্য। এটাই আমার যুক্তি। আমি তাদের অনুমোদন করি না এবং আমি জানি যে আপনিও তাদের অনুমোদন করেন না। আমি বুঝতে পারছি না কি সেই কারণ যে-কারণে আপনি তাদের অনুমোদন করেন না, কারণ সর্বোপরি সেইসব কার্যসমূহ বেলসেনের সেনানায়কের কাছে আনন্দজনক।

রাসেল : হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানেন যে ওই ব্যাপারে আর বেশি কোন দরকার নেই যতটা দরকার আমার বর্ণ (Colour) উপলব্ধি করবার জন্য আছে। এমন। কিছু মানুষ আছে যা মনে করে সব কিছুই হলুদ, এমন কিছু মানুষ আছে যারা ন্যাবা রোগে ভুগছে এবং আমি এটা প্রমাণ করতে পারব না যে বস্তুগুলো হলুদ নয় এবং তার কোন প্রমাণও নেই, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন যে সেগুলো হলুদ নয়, এবং অনেক মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন যে বেলসেনের সেনানায়ক ভুল করেছিলেন।

কপলেস্টোন : আপনি কি কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করবেন?

রাসেল : এ সম্পর্কে উত্তর দিতে গেলে একটা বড়োসড়ো উত্তর দিতে হয়। বাস্তব ভাবে বলতে গেলে বলব– হ্যাঁ। তত্ত্বগতভাবে বলতে গেলে বরং যত্ন সহকারে আমার দরকার নৈতিক বাধ্যবাধকতা ব্যাখ্যা করা।

কপলেস্টোন : আপনি কি মনে করেন যে ‘উচিত’ (ought) শব্দটির একটি ভাবাবেগগত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে।

রাসেল : না, আমি তা মনে করি না, কারণ আপনি জানেন, কিছুক্ষণ আগেই আমি বলেছিলাম, কারুকে কার্যের হিসেবে নিতেই হয়, এবং আমি মনে করি যে। সঠিক আচরণ হল তাই যা ঘটনাসমূহের (circumstances) মধ্যে নিহিত সম্ভাব্য সকল রকমের কার্যসমূহের (Acts) অন্তনিহিত মূল্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারসাম্য তৈরি করে এবং আপনি যাকে সঠিক কাজ বলে ভাবেন সেই কার্যের সম্ভাব্য প্রভাবসমূহের (effects) হিসেবটা আপনাকে নিতেই হয়েছে।

কপলেস্টোন : নৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আমি নিয়ে এসেছি কারণ আমি মনে করি যে এই পথেই কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভুল ও ঠিকের মধ্যে একটি পার্থক্য টেনে এনেছিল এবং ভবিষ্যতেও আনবে। আমি মনে করি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নৈতিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার একটি চেতনা আছে। আমার মত হল এই যে, বাধ্যবাধকতা, নৈতিক আইনের চেতনা এবং মূল্যের অনুভবের ব্যাখ্যা সব চেয়ে ভালো হয়ে থাকে মূল্যের তুরীয় ভিত্তি (Transcendent Ground Of Value) এবং নৈতিক আইনের রচনাকারের কল্পনার মধ্য দিয়ে। নৈতিক আইনের রচনাকার’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি নৈতিক আইনের একজন খামখেয়ালী রচনাকারের কথা। বাস্তবে আমি মনে করি যে আধুনিক নাস্তিকেরা উল্টো পথে গিয়ে এই যুক্তি দেখান যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, সুতরাং কোন পরম মূল্য বা পরম আইন বলে কিছু নেই’ বিষয়টি পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত।

রাসেল : আমি ‘পরম’ শব্দটি পছন্দ করি না। আমি মনে করি না পরম বলে কোন কিছু থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নৈতিক আইন সর্বদাই পরিবর্তিত হচ্ছে। মানবজাতির ক্রমবিবর্তনের কোন একটি সময় সবাই মনে করত যে নরখাদকতা একটি কর্তব্য।

কপলেস্টোন : আমি মনে করি না যে কোন বিশেষ নৈতিক’ বিচারসমূহের মধ্যে স্বতন্ত্রতা নৈতিক আইনের চিরন্তনতার বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্তমূলক যুক্তি খাড়া করতে পারে। কিছুক্ষণের জন্য আসুন আমরা মনে করি যে পরম নৈতিক মূল্যসমূহ বলে কিছু আছে। এমনকি এই কল্পনার উপর নির্ভর করে আশা করা যেতে পারে যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসমূহ এবং স্বতন্ত্র সম্প্রদায়সমূহ সেইসব মূল্যসমূহের অন্তরে বিভিন্ন মাত্রায় অন্তদৃষ্টিকে ভোগ করে থাকে।

রাসেল : একজনের উচিত’ (ought) বলতে ধরণের অনুভব কাজ করে আমি ঠিক সেই অনুভবের সঙ্গে ‘উচিত’ কথাটিকে নিতে উৎসাহী এবং অনুভবের সেই অনুরণনের সঙ্গে নিতে চাই যেভাবে একের পর এক মানুষের পিতামাতারা ও তাদের ধাত্রীরা এখনও পর্যন্ত নিয়ে আসছে।

কপলেস্টোন : আমি বিস্মিত হব যদি আপনি কেবল পিতামাতা ও ধাত্রীদের সাপেক্ষে ‘উচিত’ শব্দটির ধারণাকে বাজে অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যান। আমি প্রকৃতপক্ষে জানি না কিভাবে এই শব্দটি নিজের অর্থের চেয়ে অন্যভাবে কোন কারুর কাছে প্রকাশিত হতে পারে। আমার মনে হয় যে যদি মানুষের বিবেক বাহিত একটি নৈতিক শৃঙ্খলা থাকত তাহলে সেই নৈতিক শৃঙ্খলা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছাড়া অবোধগম্য হত।

রাসেল : তাহলে আপনাকে দুটি বস্তুর মধ্যে একটি বা অন্যটির সম্পর্কে বলতে হবে। ঈশ্বর খুব কম শতাংশ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন– যাদের মধ্যে আপনিও পড়েন– অথবা তিনি বর্বরদের বিবেকের মধ্যে যা বলে থাকেন তা সত্য নয়।

কপলেস্টোন : আপনি জানেন, আমি এ-রকম কোন প্রস্তাব করছি না যে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর বিবেককে নৈতিক উপদেশ প্রদান করেন। নৈতিক আইনের বিষয়বস্তু বা আধেয় সম্পর্কে মানবজাতির ধারণা পরিবেশ ও শিক্ষার বিশাল বিস্তৃতির উপর নিশ্চিতভাবে নির্ভর করে এবং একটি মানুষ তার সামাজিক সম্প্রদায়ের প্রকৃত নৈতিক ধারণাসমূহের বৈধতা নির্ধারণের যুক্তিকে অবশ্যই ব্যবহার করবে। কিন্তু গৃহীত নৈতিক সংহিতার সমালোচনার সম্ভাবনাকে সামনে। রেখে আগেই মনে করে নেওয়া হয় যে একটি বস্তুগত মান বিদ্যমান, ফলস্বরূপ একটি আদর্শ নৈতিক শৃঙ্খলা আছে যা নিজেই নিজেকে স্থাপন করে (আমি বোঝাতে চাই যার বাধ্যবাধকতামূলক চরিত্রকে স্বীকার করে নেওয়া যায়)। আমি মনে করি যে এই আদর্শ নৈতিক শৃঙ্খলার স্বীকৃতি অনিশ্চয়তার স্বীকৃতির একটি অংশ যা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তব ভিত্তির অর্থ প্রকাশ করে।

রাসেল : কিন্তু আমার মনে হয় যে আইনপ্রণেতা সর্বদা কারুর পিতামাতা বা ওই রকম কিছু হয়ে আসছে। এই হিসেবে বহু পার্থিব আইনপ্রণেতা আছেন এবং এই কারণেই বলা যায় কেন ভিন্ন কাল ও দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের বিবেক আশ্চর্যরকম স্বতন্ত্র ।

কপলেস্টোন : বিশেষ নৈতিক মূল্যসমূহে যে-ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় তাকে ব্যাখ্যা করতে এটি সাহায্য করে, যদি না হত, তবে তা ব্যাখ্যাতী হয়ে যেত। বাণীর বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সেই নৈতিক আইনের বিষয়ে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে তাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে-নৈতিক আইন তা এই জাতি (nation)অথবা ওই জাতি, অথবা এই ব্যক্তি অথবা ওই ব্যক্তির দ্বারা গৃহীত। কিন্তু কান্টের ভাষা যার আকারকে (Form) নিরপেক্ষ অনুজ্ঞা বা পরম আদেশ (Categorical imperative) বলা যায় সেই ‘উচিত’ (Ought) শব্দটি কিভাবে পিতামাতা ও ধাত্রীর দ্বারা বাহিত হয়ে অন্যের কাছে পৌঁছচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না। যতদূর আমি জানি, এমন কোন পদ নেই যার দ্বারা এই শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই শব্দটিকে কেবল এই শব্দের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়, অন্য কোন পদের দ্বারা একে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ একবার এই শব্দটিকে কেবল এই শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা না করে অন্য পদের দ্বারা ব্যাখ্যা করে আপনি বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন। ‘উচিত’ শব্দটি আর বেশি দিন নৈতিক ‘উচিত’ (Moral ought) রইল না। শব্দটি অন্য আরও কিছু অর্থ বহন করে।

রাসেল : আমি মনে করি ‘উচিত’ শব্দের অথটি কোন কল্পিত অসম্মতির প্রভাব যা ঈশ্বরের কোন কল্পিত অসম্মতিও হতে পারে। অবশ্য এটি কারুর কল্পিত অসম্মতি এবং আমার মতে এটিই ‘উচিত’ শব্দটির অর্থ।

কপলেস্টোন : আমার মনে হয় শব্দটি বাহ্যিক প্রথা ও ধর্মীয় নিষেধ এবং এরকম এমন কিছুর অর্থ বহন করবে যাকে পরিবেশ এবং শিক্ষার মধ্য দিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু সবকিছু যার অন্তর্ভুক্ত তাকেই আমি আইনের বিষয় বা বিষয়ের আধেয় (Content) বলে থাকি। ‘উচিত’ (Ought) এমনই একটি শব্দ যা যে-কোন মানুষের দ্বারা কখনই আর একটি মানুষের কাছে বাহিত হতে পারে না, কারণ এমন অন্য কোন পদসমূহ নেই যার দ্বারা এই শব্দটি বাহিত হতে পারে। এই শব্দটি আমার কাছে পুরোপুরি (রাসেল কপলেস্টোনকে কথাটি শেষ করতে না দিয়ে বললেন)–

রাসেল : আমি এরকম কথা বলবার কোন যুক্তি দেখি না আমি বোঝাতে চাইছি যে আমরা সবাই জানি অবস্থাসাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াসমূহকে (Conditioned re-flexes)। আমরা জানি যে একটি জন্তু যদি কোন একটি কাজ করার জন্য বারবার এক ধরণের শাস্তি পেয়ে থাকে তবে কিছুকাল পরে সে ক্ষান্ত হয়ে যাবে। আমি মনে করি না যে জন্তুটি এই যুক্তি নিজের মধ্যে তুলে নিজেকে ক্ষান্ত করবে যে আমি যদি এই কাজটি করি তবে প্রভু রাগ করবেন। তার এই অনুভবটি কাজ করবে, যে ওই কাজটি করবার মতো কাজ নয়। এটাই একমাত্র আমরা আমাদের সঙ্গে করতে পারি, আর কিছু নয়।

কপলেস্টোন : একটি জন্তুর কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে বলে মনে করার কোন যুক্তি আমি দেখি না। একটি জন্তু তার অমান্যতাধর্মী কার্যসমূহ করবার জন্য নৈতিকভাবে দায়ী হবে এরকমভাবে একটি জন্তুকে আমরা অবশ্যই দেখি না। কিন্তু একটি মানুষের নৈতিক মূল্যসমূহ ও বাধ্যবাধকতার চেতনা আছে। একটি মানুষকে মানুষ যে মর্যাদা দেবে তা একটি জন্তুকেও দেওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি না যদি কেউ এমন করেও তবুও আপনি সত্যই এরকম করতে চাইবেন। যদি আচরণবাদ’ সত্য হত তাহলে সম্রাট নিরো এবং আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের নৈতিক উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন স্বতন্ত্রতা থাকত না। মহানুভব রাসেল, আপনি জানেন যে আপনি বেলসেনের সেনানায়কের আচরণকে নৈতিকভাবে দূষণীয় বলে মনে করেন, কিন্তু আপনি নিজে এ ধরণের কার্যের কোন পরিবেশে কখনই থাকেননি, অথচ আপনি কি এরকম মনোভাব পোষণ করেন যে সম্ভবত মানবজাতির সুখের ভারসাম্য কিছু মানুষের উপর এই রকম জঘন্য আচরণ চালিয়ে বাড়ানো যেতে পারে?

রাসেল : আমি একটি পাগলা কুকুরের আচরণকে কখনই অনুকরণ করব না। ঘটনাটি হল এই যে আমি এটা করব না বললেই তা বাস্তবে এই প্রশ্নের জবাব হয়ে যাবে না।

কপলেস্টোন : না, যদি আপনি ঘটনার ফল হিসেবে ঠিক ও ভুলের উপযোগিতামূলক ব্যাখ্যায় যেতেন তবে হয়ত এই রকমই হত। আমি মনে করি কিছু উন্নত ধরণের নাৎসি এরকমই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যদিও এই ধরণের ব্যাখ্যা দেওয়াটা অনুশোচনামূলক, তবে অনেক পরে যে ভারসাম্য আমরা দেখতে পাব তা মানুষকে আরও বেশি করে সুখি করবে। আমি মনে করি না যে আপনি এরকম কথা বলবেন, আপনি কি এরকম বলবেন? আমার ধারণা অনুযায়ী আপনি বলে দেন যে এই ধরণের কাজ ঠিক নয়– তা সত্ত্বেও যদি আপনি একথা বলতে প্রস্তুত থাকেন তবে আমি মনে করব যে আপনার অবশ্যই ভুল বা ঠিকের একটি মানদণ্ড আছে যে-মানদণ্ড যে-কোন ভাবেই হ’ক অনুভবের বাইরে। আমার কাছে মনে হবে অনুভবের বাইরে কোন মানদণ্ডকে মেনে নিলে শেষে ফলস্বরূপ তা মূল্যের পরম ভিত্তি ঈশ্বরে গিয়ে দাঁড়াবে।

রাসেল : আমার মনে হচ্ছে সম্ভবত আমরা সব গুলিয়ে ফেলছি। এটি কার্য সম্পর্কে এমন একটি সরাসরি অনুভব নয় যার দ্বারা আমি বিচার করব, কিন্তু বিষয়টি কার্যসমূহ অনুযায়ী বরং একটি অনুভব। আমি এমন কোন পরিস্থিতিকে স্বীকার করি না যেখানে বিশেষ ধরণের কিছু আচরণ মঙ্গলজনক কার্য করবে। আমি এমন কোন পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতে পারি না যেখানে এই ধরণের কার্যসমূহ কোন লাভজনক কার্য করতে পেরেছে। যদিও আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হচ্ছি ‘আমি এইগুলি পছন্দ করি না, কিন্তু আমি এগুলির বিষয় একমত হচ্ছি ঠিক যেভাবে আমি অপরাধমূলক আইনের সম্পর্কে একমত হয়ে থাকি, যদিও আমি শাস্তিকে গভীরভাবে অপছন্দ করি।

কপলেস্টোন : সম্ভবত এইবার আমি আমার অবস্থান গুছিয়ে নেব। আমি দুটি বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেছি। প্রথম, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অধিবিদ্যার যুক্তির দ্বারা দার্শনিকভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে, দ্বিতীয়, একমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্বই এমন একটি ঘটনা যা মানুষের নৈতিক অভিজ্ঞতা ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার চেতনা তৈরি করতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি যে মানুষের নৈতিক বিচারকে পরিমাপ করবার জন্য আপনার পথ অনিবার্যভাবে এমন একটি স্ববিরোধের দিকে নিয়ে যায় যেখানে আপনার তত্ত্ব যা বোঝাতে চায় এবং আপনার নিজের স্বতঃস্ফূর্ত বিচার দুটি একে অপরের থেকে ভিন্ন। অধিকন্তু আপনার তত্ত্ব নৈতিক বাধ্যবাধকতাকে বাতিল করে দেয় এবং বাতিল করে দেওয়া বিষয়টির কোন ব্যাখ্যা হতে পারে না। অধিবিদ্যাগত বিষয় আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এই ঐকমত্যে আসতে পেরেছিলাম যে জগৎটি অনিশ্চিত সত্তার দ্বারা গঠিত। অর্থাৎ তা এমন একটি সত্তা যার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউই কোন কিছু নির্ণয় করতে পারে না। আপনি বলেন ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতার (Series of events) কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আমি বলি যে যদি কোন প্রয়োজনীয় সত্তা না থাকে, তাহলে কোন সত্তা অবশ্যই বিদ্যমান থাকবে না এবং বিদ্যমান থাকতে পারে না এবং কিছু বিদ্যমান থাকবে না। অনিশ্চিত সত্তাসমূহের ধারবাহিকতার অসীমতা যদি প্রমাণিতও হয় তবুও তা অসঙ্গত প্রমাণিত হবে। কিছু অবশ্যই বিদ্যমান, এইজন্য এমন কিছু অবশ্যই থাকবে যা এই ঘটনার কারণ, আর তা হল এমন একটি সত্তা যা অনিশ্চিত সত্তাসমূহের ধারাবাহিকতার বাইরে অবস্থিত। যদি আপনি এটি স্বীকার করেন তাহলে আমরা এই আলোচনা করতে পারব যে সত্তাটি ব্যক্তিগত, মঙ্গলময় এবং এরকম আরও অন্য কিছু কি না। প্রকৃত যে বিষয়টির উপর আলোচনা হয়েছে তা হল প্রয়াজনীয় সত্তা আছে কি নেই তার উপর। এ বিষয়ে আমি ধ্রুপদী দার্শনিকের সঙ্গে আমার নিজে মিল খুঁজে পেয়েছি।

আমি মনে করি যে আপনি এই মত পোষণ করেছেন যে বিদ্যমান সত্তাসমূহ কেবলমাত্র এখানে আছে বলেই আছে, তাই তাদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার কোন ওজর আমার নেই। কিন্তু আমি এই বিষয় অবশ্যই নির্দেশ করব যে এই অবস্থাকে কোন যুক্তিগত বিশ্লেষণের দ্বারা সত্য বলে প্রমাণ করা যাবে না, এটি এমন এক দর্শনকে (Philosophy) প্রকাশ করে থাকে যা নিজেই নিজের প্রমাণ রূপে দাঁড়ায়। আমি মনে করি আমরা একটি কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি কারণ আমাদের দর্শনের ধারণাসমূহ মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র। আমার মনে হয় যে যাকে আমি দর্শনের একটি অংশ বলে ভাবি তাকে আপনি সমগ্র দর্শন বলে ভাবেন, অন্তত যতদূর পর্যন্ত আপনি দর্শনকে যুক্তিযুক্ত বলে ভাবেন ততটা পর্যন্তই আপনি তাকে দর্শন বলে ভাবেন। যদি আপনি আমায় ক্ষমা করেন তবে বলব যে আপনার নিজের যৌক্তির ব্যবস্থা যাকে আপনি সেকেলে যুক্তির (উদ্দেশ্যপূর্ণ বিশ্লেষণ) বিপরীতে ‘আধুনিক’ বলে আখ্যায়িত করেন, তা করতে গিয়ে আপনি এমন এক দর্শন পোষণ করে থাকেন যাকে যৌক্তিক বিশ্লেষণের দ্বারা কখনই সত্য বলে প্রমাণ করা যাবে না। সর্বোপরি, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সমস্যা একটি অস্তিত্ববাচক সমস্যা যেখানে যৌক্তিক বিশ্লেষণ অস্তিত্বের সমস্যার সঙ্গে সরাসরি কোন সম্পর্ক ঘটায় না। সুতরাং আমার মনে হয় যে পদসমূহ কেবল একটি সমস্যাসমূহের গুচ্ছের সঙ্গে জড়িত এরকম ঘোষণা করাটা অর্থহীন কেননা তা অন্য সমস্যাসমূহের গুচ্ছের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রকৃতির শুরুর সময় থেকে স্থাপন করতে হবে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্যই দর্শনের বিস্তৃতি ঘটে। এটি নিজেই একটি দার্শনিক কার্য যা ন্যায্যতা বা সত্যতা প্রতিপাদনের প্রয়োজনে নিজেই নিজের পক্ষে দাঁড়ায়।

রাসেল : আমার বক্তব্যের সারাংশ হিসেবে আমি অল্প কিছু বলতে চাই। প্রথমত, অধিবিদ্যাগত বিষয়ের দিক থেকে আমি অনিশ্চিত জাতীয় কোন পদকে স্বীকার করি না অথবা ফাদার কপলেস্টোনের মতানুযায়ী এরকম ধরণের ব্যাখ্যার সম্ভাবনাকেও আমি স্বীকার করি না। আমি মনে করি ‘অনিশ্চিত’ শব্দটি অনিবার্যভাবে কোন কিছুর সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে যা আপনার মতানুযায়ী এক ধরনের দৈবাৎ চরিত্রসম্পন্ন এবং আমি একমাত্র কারণগত অর্থ ছাড়া সত্য বলে কোন কিছুকে চিন্তা করি না। আপনি কখনও কখনও কোন বস্তু সম্পর্কে কারণগত ব্যাখ্যা দিতে পারেন যাকে আপনি কোন কিছুর প্রভাব বা কার্য ভাবেন, কিন্তু তা একটি জিনিসের পরিবর্তে আর একটি জিনিস বোঝাচ্ছে এবং আমার মতে যে কোন কিছুর সম্পর্কে ফাদার কপলেস্টোনের ধারণা অনুযায়ী কোন ব্যাখ্যা নেই এবং যে-সব বস্তুসমূহকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে তার কোন অর্থই নেই কারণ তারা যেমন হতে পারে সেরকম বস্তু বলে কিছুই নেই। এই কারণেই ফাদার কপলেস্টোনের অভিযোগ সম্পর্কে আমি কয়েকটি কথা বলব। তাঁর অভিযোগ সমস্ত দর্শনের মতোই আমি তর্কবিদ্যাকে সম্মান করি তবে সেটা কোন ঘটনাই হতে পারে না। আমি দর্শনের মতো তর্কবিদ্যাকে কোন মতেই মেনে নিই না। আমি মনে করি তর্কবিদ্যা দর্শনের একটি অতিপ্রয়োজনীয় অংশ এবং দর্শনে তর্কবিদ্যাকে অবশ্যই ব্যবহৃত হতে হয় এবং তার ফলে আমি মনে করি তিনি এবং আমি একই জায়গায় অবস্থিত। তিনি যে-তর্কবিদ্যা ব্যবহার করেন তা অ্যারিস্টটলের সময় নতুন ছিল এবং সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল এক ধরনের গুজব বা হট্টগোল এবং অ্যারিস্টটল সেই তর্কবিদ্যা সম্পর্কে নিজেও হট্টগোল তৈরি করেন। বর্তমানে এটি পুরোনো ও সম্মানীয় হয়ে পড়েছে এবং আপনি অবশ্যই এই নিয়ে বেশি হইচই করবেন না। যে-তর্কবিদ্যায় আমি বিশ্বাসী তা তুলনামূলকভাবে নতুন এবং এই কারণে আমি একে নিয়ে হইচই করবার জন্যই অ্যারিস্টটলকে অনুকরণ করতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু তা বলে আমি এর সব কিছুই যে দর্শন বলে মনে করি না তা নয়। আমি মনে করি এটি দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং যখন আমি তা বলি তখন সেই বা সেই শব্দের কোন অর্থও আমি দেখতে পাই না এবং যেভাবে একটি বিশেষ শব্দকে আমি খুঁজে বার করেছি তার ভিত্তির এটাই পুঙ্খানুপুঙ্খ কারণ যে আমি তা পেরেছি কারণ আমি সেইসব শব্দগুলোকে নিয়ে চিন্তা করেছি। তবে অধিবিদ্যায় ব্যবহৃত সমস্ত শব্দগুলোই যে অর্থহীন তা ভাবার কোন কারণ নেই, অথবা এইরকম যে-কোন কিছু সম্পর্কে আমার সত্যই কোন ধারণা নেই।

নৈতিক বিষয় সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে আমি দেখি নৃতত্ত্ব বা ইতিহাস পড়বার সময় কিছু মানুষ কার্যটিকে জঘণ্য বলে মনে করে এবং এই কারণেই আমি নৈতিক বাধ্যবাধকতার বিষয়ে স্বর্গীয় উৎসকে স্বীকার করতে পারি না, অবশ্য ফাদার কপলেস্টোন আমাকে তার উত্তর দেবার জন্য অনুরোধ করেননি। নিজের বাবাকে খেয়ে আনন্দ কর এবং এরকম আরও অনেক কিছু, যাকে নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে ভাবা হয় সেইরকম নৈতিক বাধ্যতাকে আমি কখনও খুব সুন্দর ও মহৎ বস্তু বলে ভাবতে পারি না। এজন্যেই নৈতিক বাধ্যবাধকতা অর্থে আমি কোন স্বর্গীয় উৎসকে আরোপ করি না, আমি মনে করি বিষয়টিকে সহজ ভাবে একেবারে অন্য পথ দিয়েও নির্ণয় করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *